প্রীতিকাহন পর্ব-১৮+১৯

0
633

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_১৮

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

প্রচন্ড রাগে নবাব নিজের ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে দিলো। মিনিট পাঁচেক বিছানায় ঝিম মেরে বসে থেকে আবার উঠে দাঁড়ালো। ওয়াশরুমের দরজার দিকে আঁড়চোখে তাকালো। ওয়াশরুমের ভেতর থেকে পানির শব্দ খুব জোরে ভেসে আসছে। হঠাৎ নবাবের মনে হলো মিষ্টিকে একবার ডাকা প্রয়োজন। ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়িয়েও থেমে গিয়ে ভাবলো, “নাহ, বাইরে থেকে ওর প্রতিক্রিয়া আন্দাজ করতে পারবো না। যা হওয়ার হবে আমি বরং রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে আসি।”

বিছানা থেকে ফোন নিয়ে নবাব রুমের বাইরে চলে এলো৷ দরজা তালাবন্ধ করে পা বাড়ালো খাবারের সন্ধানে। প্রায় আধঘন্টা পর খাবারের ব্যবস্থা করে রুমে প্রবেশ করলো। খাবার রেখে চারপাশে মিষ্টিকে খুঁজতে গিয়ে দেখলো ওয়াশরুম থেকে এখনও পানির শব্দ আসছে। এতে নবাবের হৃদয় আঁতকে উঠলো অজানা একটা ভয়ে। এক প্রকার ছুটে এসে নবাব দরজা ধাক্কাতে শুরু করলো, “মিষ্টি?”

পানির শব্দ ব্যতীত অন্য কোনও শব্দ শুনতে না পেয়ে নবাব আরও অস্থির হলো। দরজায় ধাক্কা দেওয়ার তীব্রতা বাড়ার সাথে কন্ঠস্বরও দ্বিগুণ হারে বাড়লো, “মিষ্টি… মিষ্টি…মিষ্টি…?”

ভারী কন্ঠে অস্ফুট প্রশ্ন এসে নবাবের কানে ধরা হলো, “কী হয়েছে?”

কিঞ্চিৎ স্বস্তি পেলেও নবাবের অস্থিরতা কমলো না, “সেই কখন ওয়াশরুমে ঢুকেছো। এখনও হয়নি?” মিষ্টি জবাব দিলো না কিন্তু নবাব কান পেতে দাঁড়িয়ে রইলো জবাবের আশায়। হঠাৎ পানির শব্দটা শোনা গেল না।

প্রায় পাঁচ মিনিট পর ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হতে নবাব এক কদম পিছিয়ে গেল। কিন্তু মিষ্টিকে দেখে নবাব হতভম্ব হয়ে গেল। মুখ-চোখ লাল হওয়ার পাশাপশি ফুলে ফেঁপে উঠেছে। চোখ নামানো এবং মুখমণ্ডল ভেজা তবুও স্পষ্টত ঐ চেহারা বুঝিয়ে দিচ্ছে মিষ্টি এতক্ষণ কাঁদছিল।

“মিষ্টি?” নামটা উচ্চারণ করতে গিয়ে নবাবের কন্ঠস্বর কেঁপে উঠলো। মিষ্টি নবাবের সাথে থেকেও এমন লুকিয়ে কেঁদেছে বলে তার ভেতরটা যেন তীব্র অনলে জ্বলছে।

মিষ্টির দৃষ্টি চঞ্চল হলেও সে নবাবের দিকে তাকালো না। নবাবকে এড়িয়ে যাবার জন্য সে পা বাড়ালো কিন্তু নবাব হাত ছড়িয়ে অবিশ্বাসের চোখে জানতে চাইলো, “এমন করলে কেন? আর করছোই বা কেন?”

মুখের চারপাশে থাকা খুচরো চুল থেকে চুইয়ে পানি পড়ছে৷ ভেজা গাল বেয়ে যখন সেটা গড়িয়ে পড়ছে, তখন শিরশিরানি অনুভূতি হচ্ছে। তাই ভেজা মুখ ওড়না দিয়ে মুছে চোয়াল শক্ত করলো মিষ্টি। ওর এমন মুখপানে তাকিয়ে নবাব জিজ্ঞেস করলো, “চুপ করে কেন আছো? এভাবে কেঁদে কাকে কষ্ট দিতে চাইছো তুমি?… আমাকে?” এবার চোখ তুলে তাকালো মিষ্টি। ওর চোখ লাল হয়ে আছে। অতিরিক্ত কান্নায় চেহারায় একটা লাবন্যতা ভাসছে। অতি অল্প সময়ের এই চেহারা দেখে নবাবের মনে হয়েছিল, মিষ্টিকে অন্যরকম লাগছে।

“সরে দাঁড়াও আমার সামনে থেকে।” মিষ্টির কন্ঠে জোর নেই। কান্না মিশ্রিত কন্ঠ হলেও রাগের তীব্রতা কান্নার চেয়ে বেশি।

“আমি আমার প্রশ্নের উত্তর চাই।”

“উত্তর আমার অজানা।” দাঁতে দাঁত চাপলো মিষ্টি।

“সারাদিন জার্নি করে এসব নিতে পারছি না মিষ্টি।” নবাবের কন্ঠেও স্পষ্ট রাগ দেখা গেল।

“আমি তো কাউকে কিছু নিতে বলেনি।”

নবাব নিজেকে শান্ত করবার চেষ্টায় বললো, “ঠিক আছে, তাহলে খেয়ে নাও।”

“মরে গেছে আমার ক্ষুধা। এবার আমিও মরতে চাই।” হঠাৎ করে চিৎকার করে উঠলো মিষ্টি আর পরক্ষণেই কাঁদতে শুরু করে বেলকনির দিকে ছুটতে শুরু করলো।

“মিষ্…” নবাব পুরো নামটা উচ্চারণ করতে গিয়েও থেমে গেল। প্রচন্ড রাগে এবং কষ্টে তার মাথা যেন ঘুরছে৷ একহাত কপালে আর অন্য হাত কোমড়ে রেখে সে মনে মনে কারোর উপর ফুঁসে উঠলো, “অর্ষা, এখন যদি সামনে পেতাম। তবে ক্রসফায়ারে শেষ করে দিতাম।” নবাব বুঝতে পারছে মিষ্টির মাঝে হঠাৎ করে আসা পরিবর্তনের কারণ অর্ষা। নিশ্চিত হওয়ার জন্য নবাব মিষ্টির কাছে ইনিয়ে-বিনিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু মিষ্টি অর্ষার ব্যাপারে কোনো কথাই তুললো না অথচ কেঁদে-কেটে একসা করে ফেলেছে।

বেলকনির মেঝেতে হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে মিষ্টি। হাঁটুর উপর দুইহাত রেখে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। এমন দৃশ্য দেখামাত্র নবাবের হৃদয় আত্মচিৎকার করে উঠলো অতি গোপনে। মিষ্টির চোখ থেকে আগেও অজস্র অশ্রু ঝরেছে। সে নিজেও মিষ্টিকে বহুবার কাঁদিয়েছে। কিন্তু এই মূহুর্তে ওর কান্নায় নবাবের সহ্য ক্ষমতাকে ভঙ্গুর করছে।

হাঁটু ভেঙে মেঝেতে বসে মিষ্টি মাথায় হাত রাখলো নবাব তৎক্ষনাৎ মিষ্টি ওর হাত সরে দিলো। পুনরায় নবাব হাত রাখতে গেল আর মিষ্টি আবারও হাত সরিয়ে দিলো। মিষ্টি সোজা হয়ে বসছে না এমনকি নবাবকে না দেখেই বার-বার হাত সরিয়ে দিচ্ছে। নবাবের বোধগম্য হচ্ছে মিষ্টির রাগ কিন্তু সে নিজের মাঝে থাকা রাগটা মিষ্টিকে দেখাতে চাইছে না। তাই আবারও মিষ্টির মাথায় হাত রাখলো কিন্তু মিষ্টি ওর হাত সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে নবাব এবার মিষ্টির ডান হাত দুই হাতে চেপে বললো, “এই মিষ্টি, কেন এমন করছো? আমার কি এসব খুব ভালো লাগছে?” নবাব যখন হাত ধরেছে, তখনই মিষ্টি মাথা তুলে তাকিয়ে ছিল। এখন নবাব এমন প্রশ্ন করতে চোখ সরিয়ে সোজা হয়ে বসেছে। কান্না থামিয়ে অনবরত নাক টানছে। নবাবের হাতের মুঠোয় বন্দি হওয়া নিজের হাত ছাড়াতে মিষ্টি কোনও চেষ্টা করেনি।

পরম যত্নে মিষ্টির হাত নিজের বুকে আগলে নবাব জানতে চাইলো, “এই মিষ্টি, আমার অপরাধ কী বলো? আজকে তো সব ঠিকঠাক ছিল৷ পান্থুমাই গেলাম, দু’জনে কত আড্ডা দিলাম। তবে এরাতে কেন এমন রাগের পসরা সাজিয়ে আমায় কষ্ট দিচ্ছো?”

“আমার আর কী কী সহ্য করতে হবে বলতে পারো?” কান্নায় ভারী হওয়া কন্ঠে প্রশ্ন করে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মিষ্টি। নবাব স্পষ্ট দেখতে পেল মিষ্টি কাঁপছে রাগ এবং চাপা কান্নায়।

“শুধু আমার ভালোবাসাটা সহ্য করো মিষ্টি, অন্যকিছু সহ্য করতে হবে না।” সহানুভূতির সুরে নবাব বললো।

“ভালোবাসা? কীসের ভালোবাসা? তুমি… তুমি এখনও অর্ষার সাথে…” প্রচন্ড ঘৃণায় মিষ্টি মুখ ফিরিয়ে নিলো বাক্য অসম্পূর্ণ রেখে। এবার নিজের হাতের অস্তিত্ব নবাবের হাতে অনুভব করে সেটা ছাড়াতে চেষ্টা করলো। মিষ্টি যত হাত টানছে, তত নবাব শক্ত হাতে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরছে।

হাত ছাড়াতে ব্যর্থ হয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মিষ্টি। এরপর ফুঁসে উঠলো, “হাত ছাড়ো আমার।”

“সব জেনেও কেন তুমি অর্ষাকে টানছো? তুমি কি জানো না ওর আর আমার মাঝে কী ছিল?”

“না, আমি জানি না। তুমি আমার হাত ছাড়ো নয়ত চিৎকার করবো আমি।”

“করো চিৎকার। আমিও চিৎকার করেই বলবো, আমি তোমাকে ভালোবাসি আর ভালোবাসার অধিকারে হাত ধরেছি।”

মিষ্টি অন্য হাতে নবাবের হাত সরিয়ে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় করছে। আর নিজের হাতের দিকে লক্ষ্য করে নবাবকে বলছে, “যাকে অন্য মেয়ে হাজারবার কল করে খোঁজে, যাকে অন্য মেয়ে বড় গলায় প্রাক্তন দাবী করে; তাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।”

মিষ্টি যেই হাত নবাবের হাত থেকে ওর হাত সরাতে ব্যস্ত ছিল, সেই হাত শূন্যে চেপে নবাব ধীর গলায় বললো, “ভালো তো বাসো না আমায়, তাই না? তবে অর্ষার ফোনকলে এতো রি-অ্যাক্ট কেন করছো? কাউকে ভালো না বাসলে তো হিংসে হওয়ার কথা নয়, কাউকে ভালো না বাসলে তো এত কষ্ট পাওয়ার কথা নয়।” নবাবের কথা শুনে মিষ্টি থমকে গেল। নবাবের হাতে নিজের দুই হাত বন্দি রেখে ধীরে ধীরে মাথা নুইয়ে নিলো। আচমকা শান্ত হয়ে যাওয়া মিষ্টির কাছে নবাব জানতে চাইলো, “এই মিষ্টি, তবে কি তুমি আমায় ভালোবাসো?”

চকিতে মিষ্টি তাকালো নবাবের দিকে, “এড়িয়ে যেতে চাইছো বিষয়টা? নিজের কথার মারপেঁচে আমাকে ভুলাতে চাইছো?”

“কী বলছো তুমি এসব? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“তোমাকে বুঝতে হবে না। তুমি আমার হাত ছাড়ো। এক কথা আমি বারবার বলতে পারবো না।” মিষ্টি যতটা রাগ নিয়ে কথাগুলো বললো, নবাব ততটাই শান্ত গলায় বললো, “ছাড়ার জন্য কি হাত ধরেছি?” নবাব এবার মিষ্টির দুই হাত এক করে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মিষ্টির দিকে। মিষ্টি মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে বিধায় সে নিজেই বললো, “অর্ষার সাথে প্রথম দেখা, ওর প্রপোজ করা, ওর সাথে কথা বলা; কোন বিষয়টা তুমি জানো না মিষ্টি? এমন কি ওর সাথে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার বিষয়টাও তুমি জানো। আমি তোমাকে সবকিছুই বলেছি তবুও এমন কেন করছো?”

“যোগাযোগ বন্ধ হলে তোমাকে হাজারবার কেন কল দেবে? আমাকে সব কথা জানাও বলেই আমি নিজেরও চেয়ে বেশি তোমাকে বিশ্বাস করি। কিন্তু সেই বিশ্বাস কি তুমি নষ্ট করতে চাও প্রাক্তনকে দিয়ে?”

একগাল হেসে, “মিষ্টি, আমার না অসম্ভব রাগ উঠছে কিন্তু রাগটা প্রকাশ না করে শান্ত আছি৷ কেন জানো? তোমাকে আমি না চাইতেও অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। তাই এখন আর কষ্ট দিয়ে ব্যথিত করতে চাই না। সবারই একটা অতীত থাকে মিষ্টি, আমারও ছিল। কিন্তু সেই অতীতেও আমার সঙ্গী হিসেবে তুমি ছিলে। আর বর্তমান এবং ভবিষ্যতে কেবল তুমিই থাকবে।” নবাবের কথা শুনে মিষ্টির রাগ উবে যেত দেখলো সে। নবাব ভাবলো মিষ্টি এবার কিছু বলবে। কিন্তু নবাবের ভাবনার বাইরে গিয়ে মিষ্টি বলে উঠলো, “হাত ছাড়ো আমার।”

একই কথা আবার শুনে দাঁত কিড়মিড় করলো নবাব, “তুমি কি এলার্ম টিউন? হ্যাঁ? রাগে যেই কথা একবার বলো, সেটা শুধু বলতেই থাকো।”

“হাত ছাড়ো আমার।” বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিষ্টি আবারও এই কথা বললো। এতে নবাব রাগ হওয়ার পরিবর্তে শরীর দুলিয়ে হেসে উঠলো আর মিষ্টির হাত ছেড়ে দিলো। নবাবকে হাসতে দেখে চোখ নামিয়ে মিষ্টিও মুচকি হাসলো এবং ভেজা চোখে হাত বোলালো।

বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নবাব বললো, “এলার্ম টিউন একটা।” এরপর দরজার কাছে এসে ফিরে তাকিয়ে বললো, “এই যে মিস টিউন, খেতে এসো। বাকি ঝগড়াটা কালকের জন্য তুলে রাখো।” প্রতুত্তরে মিষ্টি চোখ নামিয়ে নিলো আর একটু লজ্জা মাখা হাসি নবাবকে ছুঁড়ে দিলো।

.

“এই আপু, আজকে স্কুলে কী হয়েছে জানো?”

কলেজ থেকে ফিরে নাওয়া-খাওয়া সেরে ঘুম দিয়েছিল মিষ্টি। এখন ঘুম থেকে জেগে উঠে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হলো। এক গ্লাস পানি পান করে ফোন হাতে নিতে দেখলো নবাব ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। বিছানায় পা তুলে বসে মিষ্টি জানতে চাইলো, “কী হয়েছে?”

প্রায় সাথে সাথেই জবাব দিলো নবাব, “আমাদের স্কুলে নতুন একটা মেয়ে এসেছে।”

“তাতে কী হয়েছে?”

“কী হয়নি সেটা জানতে চাও।”

চোখ উল্টে মিষ্টি ছোট্ট নিশ্বাস ফেললো। এরপর জবাব দিলো, “ভাই, ফোনে টাকা অতি স্বল্প। তাই অল্প কথায় পুরো কাহিনি বলো।”

“আরে হ্যাঁ, তোমাকে তো কেবল কোচিং-এর ফোন দেওয়া হয়েছে। এতে আবার টাকাও দেওয়া হয় না তেমন। আমার তো চিন্তা নেই। আমি মায়ের ফোন দিয়ে কাজ চালাই। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো মা বুঝতেও পারে না টাকা কোথায় গায়েব হয়।”

মিষ্টি উত্তর দিলো, “বুঝলাম ভাই কিন্তু মেয়েটা কে? নাম কী?”

“অর্ষা।”

…চলবে

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_১৯

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

“অর্ষা!” অবাক হয়ে জানতে চাইলো মিষ্টি।

“হুম।”

“এটা কেমন নাম? এমন নাম তো কোনওদিন শুনিনি।”

“আমিও শুনিনি তবে মেয়েটা না সুন্দর। আমার সাথে নিজে থেকে এসে কথা বলেছে। জানতে চেয়েছে আমি ওর ফ্রেন্ড হবো না-কি?”

হালকা হেসে টাইপ করলো মিষ্টি, “তুমি কী বললে?”

“কী আর বলবো? আমি হ্যাঁ বলে দিয়েছি।”

“বাহ! তারপর?”

“তারপর তো জানি না কিন্তু আমার ওর কথাবার্তা অনেক ভালো লেগেছে। দেখতেও কত মিষ্টি। এই যা! কারোর প্রশংসা করলেও দেখি তুমি চলে আসো।” এবারের ম্যাসেজে শরীর দুলিয়ে হেসে উঠলো মিষ্টি। বেশ কিছুক্ষণ ধরে সে হেসেই চলেছে তাই পুনরায় নবাবের কাছ থেকে ম্যাসেজ এলো, “এই আপু?”

“এই মিষ্টি?” হঠাৎ নবাবের ডাকে মিষ্টির চৈতন্য হলো। ইঞ্জিনের তীব্র শব্দ উপেক্ষা করে আসা নবাবের সম্বোধনে সে ফিরে তাকালো নবাবের দিকে৷ মিষ্টির নিষ্প্রাণ চোখ নবাবের চোখে পড়তে প্রসন্ন মুখে জানতে চাইলো, “কী ভাবছো?”

দৃষ্টি সামনে রেখে সবুজের সমারোহ আর নদীর জলে চোখ ডুবিয়ে কিঞ্চিৎ বেখেয়ালি মনে জবাব দিলো মিষ্টি, “অর্ষার কথা।”

“অর্ষার কথা মানে?” কপালে ভাঁজ পড়লো নবাবের।

কালকে রাতে অর্ষার জন্য না চাইতেও অনেক ঘটনা মঞ্চায়িত হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া শেষে যখন বালিশে মাথা রেখেছিল মিষ্টি, অজানা চিন্তার উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠেছিল। এসব বিষয় নিয়ে সে আজকে বিছানাকান্দি যাবে না বলে সকালে নবাবকে বারণ করেছিল, “আজকে আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যাও।”

“আমি যাবো মানে? আমি একা গিয়ে ওখানে কী করবো?”

“আমি সঙ্গে গেলেও চুপচাপ থাকি, তাই না? তাছাড়া আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।”

“আমি বুঝতে পারছি মিষ্টি কিন্তু আজকে না গেলে আর যাওয়া হবে না। কারণ পরশুদিন আমরা সিলেট ত্যাগ করবো।”

অবাক হয়ে, “কেন? বাসায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছো?”

“পাগল! অন্য কোথাও। এখন চটপট তৈরি হয়ে নাও।”

“কিন্তু…” মিষ্টিকে বলতে না দিয়ে নবাব বলে ছিল, “তোমার সব কিন্তুই শুনবো তবে সেটা বিছানাকান্দির পাথরের বিছানায় দাঁড়িয়ে।”

অর্ষাকে নিয়ে ভাবছিল বলেই মিষ্টি অর্ষার নাম নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু একে নিয়ে নতুন কোনো ঝামেলা করতে চায় না বলে মিষ্টি স্বাভাবিক গলায় জানতে চাইলো, “নাহ, অর্ষার সাথে কথা বলেছিলে, কেন কল করেছিল তোমায়?”

“এর কথা কেন নিচ্ছো আবার?” বিরক্তিতে নবাবের ভ্রুকুঞ্চন দেখতে পেয়ে ডান দিকে ঘাড় কাত করে গলায় আদুরী ভাব টানলো মিষ্টি, “রাগ করলে?”

স্মিত হেসে জবাব দিলো নবাব, “টক ঝালের ওপর রাগ করা যায়, মিষ্টির ওপর নয়।”

মুখে হিজাব বাঁধা সত্ত্বেও অভ্যাসবশত মিষ্টি মুখে চাপ হেসে উঠলো। পাশে বসা নবাব মুগ্ধ নয়নে মিষ্টিকে দেখে একটু কাছে এসে বলে উঠলো,

“চঞ্চল নদী স্তব্ধ হলো
তোমার ঐ হঠাৎ হাসিতে।
নয়ন আমার ব্যাকুল হলো
তার অতৃপ্ত তৃষ্ণা মেটাতে।

মনে আমার ঘোর লাগে
দেখলে তোমার হাসি।
কবে তুমি বলবে আমায়,
এই তো ভালোবাসি?”

আচমকা মিষ্টির হাসি থেমে গেল আর সে বিস্মিত চোখে নবাবকে দেখলো। নবাব সোজা হয়ে বসে ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো। মাথার ক্যাপ খুলে চুলে হাত বুলিয়ে পুনরায় সেটা পড়ে নিলো। নবাব সাধারণত মাথার চুল কপালের দিকে একটু বেশিই লম্বা রাখতে পছন্দ করে। কিন্তু এইসব ছোটাছুটি করতে গিয়ে চুল এতটাই লম্বা হয়েছে যে ক্যাপ দিয়ে সামলে রাখতে হচ্ছে।

মিষ্টি এখনও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে কিন্তু মুখ ফুটে কিচ্ছু বলছে না। তাই নবাব ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইলো, “সুন্দর না কবিতাটা? এই মাত্র মনে মনে লিখে ফেললাম।” এই বলে নবাব সামনের সবুজ গাছপালায় চোখ নিবদ্ধ করলো। মিষ্টি নবাবকে দেখে ধীরে ধীরে মাথা নুইয়ে নিলো। ওর মনে হয়েছিল নবাব ওর কাছে জানতে চেয়েছে, “কবে তুমি বলবে আমায়, এই তো ভালোবাসি?” কিন্তু সেটা হয়নি বিধায় হৃদয় একটুখানি ব্যথিত হলো।

“সুন্দর।” কিঞ্চিৎ কষ্ট প্রতীয়মান হলো এই ছোট্ট শব্দে।

“তা কবে বলবে আমায়, এই তো ভালোবাসি?” নবাব প্রথমেই টের পেয়েছে মিষ্টি অন্যবারের মতো এটাকে কবিতা না ভেবে সত্যি হিসেবে গ্রহণ করেছে। আগেও নবাব প্রায়শই মিষ্টিকে ছোট-খাটো ছন্দ বলে বিনোদন দেওয়ার চেষ্টা করতো। কিন্তু আজকে মিষ্টি সত্যি হিসেবে মেনে নেওয়ায় সে পুনরায় জানতে চাইলো।

“মানে?” মিষ্টি যেন ভেবেই পাচ্ছে না নবাব কীসব বলছে।

“সোজা বাংলায় তো জানতে চাইলাম।”

“তুমি আমাকে সবসময় এমন গোলকধাঁধায় ছেড়ে দাও কেন? আমি তোমাকে আজও বুঝতে পারি না। ভবিষ্যতে পারবো বলেও মনে হয় না।”

এক গাল হেসে নবাব মাথা নুইয়ে নিলো। তারপর কী যেন ভেবে অন্য প্রসঙ্গ টানলো, “বিছানাকান্দি নামকরণ কেন করা হয়েছে জানো বা বিছানাকান্দির সম্পর্কে?”

নবাব প্রসঙ্গ পাল্টিয়েছে বুঝতে পেরেও মিষ্টি সেটা নিয়ে কথা বাড়ালো না। নবাবের করা প্রশ্নের প্রেক্ষিতে সে জবাব দিলো, “নাহ, বিছানাকান্দি নিয়ে কখনও খোঁজখবর নিয়ে দেখিনি এমনকি এই নামে জায়গা হতে পারে সেটাও জানতাম না।”

“তাহলে জানলে কীভাবে?”

“কলেজে একবার রিতা খবরের কাগজ নিয়ে এসেছিল। সেখানে বিছানাকান্দির সুন্দর একটা ছবিসহ বেশ কিছু তথ্য দেওয়া ছিল। আমি ছবিটা মনোযোগ দিয়ে দেখলেও তথ্যগুলোর দিকে ফিরেও তাকাইনি।”

“এই কেন, কেন?”

“কারণ রিতার ওপর আমার অনেক রাগ উঠেছিল। পাঁজিটা আমাকে বলেছিল, মিষ্টি বিয়ের পর তুই হানিমুনে বিছানাকান্দি যাবি। এটা না অনেক সুন্দর জায়গা।” মিষ্টি মুখ বাঁকিয়ে কথাগুলো বলতেই নবাব অবাক হয়ে খানিকটা জোরে বলে উঠলো, “হোয়াট?” এরপর উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলো। নবাবকে হাসতে দেখে মিষ্টির হুঁশ হলো নবাবের সাথে বিয়ে হওয়ার পর সে বিছানাকান্দি এসেছে। পালিয়ে বেড়ালেও এটা একপ্রকার হানিমুনের পর্যায়েই পড়ে।

নবাবের হাসি থামার কোনো নাম নেই। এদিকে রাগে এবং লজ্জায় মিষ্টি বলে উঠলো, “ধ্যাত! সবাই আমার সাথেই এমন করে।” এই বলে উঠে দাঁড়ালো মিষ্টি। চলন্ত নৌকায় কোনওরকমে হাঁটতে শুরু করলে নবাব জানতে চায়, “এই মিষ্টি, কোথায় যাচ্ছো?” মিষ্টি জবাব দিলো না কিন্তু তীব্র হাসিতে মত্ত নবাবকে একবার দেখে নিলো মাঝিরা। মাঝবয়েসী দুইজন মাঝি নবাবকে দেখে নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করে আবার কাজে লেগে পড়লো৷

হেলে-দুলে নবাবের মুখোমুখি বসে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো মিষ্টি। নবাবও সময় ব্যয় না করে মিষ্টির পাশে বসে হাসি সংযত করার চেষ্টায় জানতে চাইলো, “শুনবে না বিছানাকান্দি সম্পর্কে?”

“নাহ।” গোমড়ামুখে মিষ্টি জবাব দিতে নবাব ওর কানে ফিসফিস করলো, “বিছানাকান্দি সম্পর্কেই বলবো অন্য কিছু না।” এই শুনে প্রায় সাথে সাথে মিষ্টি কপাল কুঁচকে তাকালো নবাবের দিকে। ওর এমন দৃষ্টিতে নবাব বুঝে গেল মিষ্টি রেগেমেগে একাকার। আর সেটা টের পেয়েই নবাব আরেক দফা হেসে নিলো প্রাণ ভরে।

“এই, তুমি এখান থেকে যাও তো। অসহ্য লাগছে আমার।”

নবাব হাসি থামানোর সর্বোচ্চ চেষ্টায় বললো, “ঠিক আছে, আর হাসবো না। এবার বিছানাকান্দির কথা শুনো।”

“একদম না। আমি কোনও কান্দি-ফান্দির কথা শুনতে চাই না। তুমি এখান থেকে যাও তো।”

“আবার একই কথা রিপিট করছো মিস টিউন?”

“মোটেও না। তোমাকে শুধু অন্য জায়গায় গিয়ে বসতে বলেছি।”

দায়সারা ভাব নিয়ে বেঞ্চে হেলান দিয়ে নবাব বললো, “মিষ্টি যেখানে থাকে মাছি তো সেখানেই যাবে, তাই না?”

অবাকে মিষ্টির চোখ গোলগোল হয়ে গেল, “কী বললে তুমি? দেখো, তোমার মুখ কিন্তু লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে।”

শীতল কন্ঠে নবাব বললো, “তাহলে আর লাগামহীন হতে দিও না।” এবার স্বাভাবিক গলায় বললো, “শুনো এবার বিছানাকান্দি সম্পর্কে।” মিষ্টির একটুও ভালো লাগছে না বিছানাকান্দি সম্পর্কিত কোনো কথা শুনতে কিন্তু নবাবকে থামাতে গেল সে বারংবার তাকে অস্বস্তিতে ফেলছে। পুনরায় লজ্জায় পড়তে মিষ্টির ঘোরতর আপত্তি আছে বিধায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুনতে লাগলো বিছানাকান্দির না জানা কথা।

…চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে