#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_১২
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
চিবুক নামিয়ে হালকা হাসলো নবাব কিন্তু কোনও জবাব দিলো না। মিষ্টি উত্তরের প্রতীক্ষা করলেও নবাবকে কোনও তাড়া দিলো না। পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখতে গিয়ে মিষ্টি নবাবের মাঝে সেই ছোট্ট নবাবকে খুঁজে পেল, যে ছোট্টবেলায় তাকে ‘আপু’ সম্বোধনে ব্যাকুল করে তুলতো।
“মা, আমাকে দুই প্যাকেট দাও।”
মেহমানদের জন্য খাবার সাজাতে ব্যস্ত নিঝুম মেয়ের কথায় ফিরে তাকালেন। হাতে থাকা কেকের প্যাকেটগুলো নামিয়ে রেখে বললেন, “একটার বেশি তো হবে না। সবাইকে দিতে হবে। আমি না হয় তোর বাবাকে বলে পরে তোকে এক বাক্স আনিয়ে দিবো।”
কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে কোনওমতে বোঝালেন কিন্তু মেয়ের এখনই কেক চাই। তাই পরে একগাদা কেক পাওয়ার সংবাদও তার মনঃপুত হয়নি।
“ওহ।” ছোট্ট জবাবে মিষ্টি রান্নাঘর ত্যাগ করলো। গোমড়া মুখে যখন ড্রয়িংরুম পেরিয়ে নিজের ঘরে দিকে হাঁটছে, তখন সেটা লক্ষ্য করে নবাব ওর পিছু নিলো। ঘরে এসে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়লো মিষ্টি। হাতে থাকা কেকের প্যাকেটে অহেতুক শব্দ করতে লাগলো। সেই দৃশ্য দেখে নবাব বলে উঠলো, “মিষ্টি আপু, কী হয়েছে?”
নিজের গোমড়া মুখ আড়াল না করে বরং অভিমান ভাসিয়ে মিষ্টি জবাব দিলো, “কিছু না।”
বিছানার এককোণে বসে নবাব বললো, “মিথ্যা কথা কেন বলছো? আমি তো বুঝতে পারছি তোমার মন খারাপ। আমাকে বলবে না?”
ডান দিকে ঘাড় কাত করে নবারের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি জানতে চাইলো, “তোমাকে বললে কী হবে?”
“আমায় বললে আমি তোমার মন ভালো করে দিবো।”
হালকা হেসে একটু সময় নিয়ে ভাবলো মিষ্টি। এরপর ধীরে ধীরে বললো, “মাকে বলেছিলাম আমাকে দুইটা কেক দিতে কিন্তু মা একটা কেক দিলো।”
“ওহ, এই ব্যাপার?”
সামনে পিছনে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো মিষ্টি। নবাব জানতে চাইলো, “কেক তোমার পছন্দ?”
“ভীষণ, আর Dan Cake হলে তো কোনো কথাই নেই। বিশেষ করে Chocolate Muffin Cake আমার অনেক পছন্দ। একটা কেক খেলে আমার একবেলার খাবার খাওয়া হয়ে যায়।”
“অনেক দামী কি?” কপাল ভাঁজ পড়লো নবাবের নিজের করা প্রশ্নে।
“অনেক দামী কিনা জানি না। তবে আমার বড় সাইজের কেকটা বেশি ভালো লাগে। এক প্যাকেট ত্রিশ টাকা।” বলেই হাতের প্যাকেট দেখিয়ে আবার বললো, “এই যে এটাই।”
“আমি কিনে দিলে খাবে?”
অবাক হয়ে, “তুমি কেন কিনে দিবে? তোমার কাছে টাকা আছে?”
“কেন? বড় হয়ে কিনে দিবো। যখন আমি বাবার মতো টাকা রোজগার করবো, তখন তোমাকে অনেকগুলো কেক কিনে দিবো।”
“ঠিক আছে ভাই।” হালকা হেসে মিষ্টি রাজি হলো।
“আমার আবার কেক, চকলেট এসব ঠিক পছন্দ না।” হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তে নবাব আবার বললো, “আচ্ছা আপু, তুমি কি খাবে আমার ভাগের কেক?”
সাত-পাঁচ না ভেবে মিষ্টি দ্বিমত পোষণ করলো, “উঁহু।”
“এই কেন, কেন?”
“তোমরাটা কেন খাবো? তুমি তো বেড়াতে এসেছো। অতিথিদের ভাগের খাবার খাওয়া ঠিক নয়। তাছাড়া মা জানলে রাগ করবে।”
একটু অভিমানী সুরে নবাব বলে উঠলো, “তুমি আমাকে অতিথি বানিয়ে দিলে আপু? যাও, আর তোমাদের বাসায় আসবো না।”
“না, না, আমি কি সেটা বলেছি না-কি?”
“তাহলে আমার কেকটা খেয়ে নাও।”
মা জানলে বকা দিবে এমন ভয়ে মিষ্টির মাঝে অস্থিরতা কাজ করছে। কিন্তু কেক না নিলে নবাব রাগ করবে তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। সম্মতি পেয়ে নবাব উঠে দাঁড়ালো, “গ্রেট! তুমি বসো। আমি এক্ষুণি নিয়ে আসছি।”
বাচ্চাদের আগেই কেক দেওয়া হয়ে গিয়েছিল আর নবাব তার ভাগের কেক মাকে দিয়ে রেখেছিল। ড্রয়িংরুমে নিজের মাকে খুঁজে না পেয়ে নবাব পায়ে পায়ে রান্নাঘরে চলে এলো আর পা রাখতেই নবাব শুনতে পেল, “ভাবী, মিষ্টির কথাগুলা উড়িয়ে দিবেন না। ছেলেটা ফুল না দিলেও ঘুরঘুর তো করেছে। এমনিতেই তো ওরে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। তাই আমি বলছিলাম কি, এই বিষয় নিয়ে ভাইজানের সাথে আলাপ করেন।” নবাব তার মায়ের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো। মিষ্টির মা অর্থাৎ তার মামী কিছু বলতে যাবে তার আগেই নবাবকে দেখে ওর মা জানতে চাইলো, “কী রে?”
“কেকটা দাও।”
“সোফার উপরেই রাখা আছে।”
“ঠিক আছে।” বলেই ড্রয়িংরুমে চলে এলো নবাব। মাকে যদিও সে বুঝতে দেয়নি মিষ্টিকে নিয়ে বলা কথাগুলো সে শুনেছে। কিন্তু হাঁটতে গিয়ে সে কথাগুলো খুব করে ভাবছে। কেক হাতে মিষ্টির রুমে ঢুকে বলে উঠলো, “এই নাও।”
মিষ্টি হাত বাড়িয়ে কেকটা নিয়ে জানতে চাইলো, “এটা কি ঠিক হচ্ছে ভাই?”
“এত কথা বলো না তো। দিয়েছি যখন চুপচাপ খেয়ে নাও।”
“ঠিক আছে, খাচ্ছি কিন্তু আমার সাথে তোমাকেও খেতে হবে।”
“এই না, না, আমার সত্যিই কেক ভালো লাগে না আপু।”
“বেশি অংশ আমিই খাবো। তুমি শুধু একটু খাও প্লিজ।”
অগত্যা রাজি হলো নবাব, “আচ্ছা দাও।”
কেকের চার ভাগের তিন অংশ মিষ্টি নিজের কাছে রেখে এক অংশ নবাবকে দিলো তবু নবাব বলে উঠলো, “এতখানি কেন দিলে?”
নবাবের মাথায় হালকা চাটি মেরে মিষ্টি বললো, “এতখানি কোথায়?”
মাথায় হাত বুলিয়ে নবাব মুখ কুঁচকালো, “খালি মারে।” নবাবের মুখ নিসৃত শব্দযুগলে শরীর দুলিয়ে হেসে উঠলো মিষ্টি। কিন্তু হাতের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হলো নবাব। কেক চিবিয়ে মুখের ডান পাশে রেখে মিষ্টি প্রশ্ন করলো, “নবাব, খাচ্ছো না কেন?”
শান্ত গলায় নবাব পাল্টা প্রশ্ন করলো, “আপু, তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করলে রাগ করবে?”
“নাহ, রাগ কেন করবো তাও তোমার ওপর?”
ইতস্তত করে নবাব বললো, “তোমাকে কে ফুল দিতে চেয়েছে?”
আচমকা এমন প্রশ্ন হতভম্ব হয়ে গেল মিষ্টি, “তোমাকে এসব কে বলেছে?”
“কেউ বলেনি। যখন কেক আনতে গেলাম, তখন মা আর মামীকে কথা বলতে শুনলাম। বলো না আমায় পুরো বিষয়টা।”
“তুমি বাচ্চা মানুষ এসব শুনে কী করবে?” একটু হাসার চেষ্টা করলো মিষ্টি।
“এই আপু, কী বললে তুমি? ক্লাস এইটে পড়ি আমি। তুমি আমাকে বাচ্চা কেন বলছো?”
“আমার চেয়ে তো ছোট, তাই না?”
“তুমি কি বলবে না আমায়?” নবাবের মুখের টানটান পেশী রাগের সাক্ষ্য বহন করছে।
“উফ, সবসময় এমন জেদ দেখাও কেন? ঠিক আছে, বলছি।” একটু থেমে মিষ্টি বলতে শুরু করলো, “কালকে যখন কলেজে যাবো বলে দাঁড়িয়ে ছিলাম প্রধান সড়কে, তখন দুইটা ছেলে এসে খানিকটা দূরে হাসাহাসি করছিল। আমি যখন তাকিয়ে বিষয়টা দেখেছি, তখন মনে হলো দুইটা ছেলেই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একজনের হাতে আবার গোলাপও ছিল।” এইটুকু শুনেই নবাবের চোয়াল শক্ত হলো, “তোমাকে কি কিছু বলেছে?”
“নাহ।”
“পরবর্তীতে কিছু বললে আমাকে জানাবে।”
“কেন?” বুঝতে না পেরে।
“গুলি করে খুলি উড়িয়ে দিবো।” নবাবকে রাগে ফেটে পড়তে দেখে মিষ্টি সশব্দে হেসে আবার চাটি মারলো। এতে নবাবের রাগের উন্নতি হতে সে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “ধ্যাত! আবার মারলে কেন?”
“তোমার কথা শুনে। বয়সে বড় হওনি অথচ কথা শুনলে আমার চেয়েও বড় মনে হয়।”
“কথায় নয়, একদিন কাজেই প্রমাণ দিবো আমি তোমার বড়।”
হঠাৎ নবাবের ফোন বেজে উঠতে মিষ্টি মুখ ঘুরিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি দিলো। আকাশে এখন সূর্য ভাসছে ঝলমলে রোদ নিয়ে। বেলা যত বাড়বে, ততই সূর্য দীপ্তি ছড়িয়ে পৃথিবীর বুক থেকে শীতলতা শুষে নিবে। চলন্ত বাসে বসে অবশ্য বাতাসকে তপ্ত মনে হচ্ছে না। বরং সূর্যের তাপ সরিয়ে ঠান্ডা বাতাসই মিষ্টির মন ভরাচ্ছে।
“দেরি হয় না সেটা জানা ছিল। আসলে কালকে রাতে বোধহয় জ্যামে আটকে ছিল বাস। তাই এতো দেরি হচ্ছে।” নবাব ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত। সেদিকে কান পেতে মিষ্টি কথাগুলো শোনবার প্রচেষ্টা করলো। কিন্তু নবাব কোনও নামধাম উল্লেখ করলো না বিধায় সে ঠাওর করতে পারলো না, নবাব কার সাথে কথা বলছে?
“এত ফোন করিস না। যদি ধরা পড়িস তবে খবর হয়ে যাবে।” একটু চিন্তা ভাসলো নবাবের কন্ঠে। নবাব আবার বললো, “হয়ত বেশিক্ষণ লাগবে না। ধরে নে আর আধঘন্টা।”
অপর পাশের মানুষের কথা শুনতে পেল না মিষ্টি কেবল নবাবই একে একে বলে যাচ্ছে, “হ্যাঁ, কত কাহিনির পর খাবার পেটে পড়লো।” তাচ্ছিল্যের সুরের আভাস পেতে মিষ্টি নবাবের দিকে মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। মিষ্টি এমন দৃষ্টি নবাবের চোখ এড়ায়নি। সেও তাকিয়ে রইলো মিষ্টির দিকে।
“হুম।” এই বলে নবাব কান থেকে ফোন নামিয়ে রাখতেই মিষ্টি জানতে চাইলো, “খোঁচা না দিলে কি তোমার পেটের খাবারে বদহজম হতো?”
মিষ্টির মুখের এমন তিক্ত প্রশ্নে চোখ সরিয়ে নিলো নবাব। ওকে অহেতুক ফোনে ব্যস্ত হতে দেখে মিষ্টি জানতে চাইলো, “চুপ করে আছো কেন?”
“এই কথার প্রেক্ষিতে বলবার মতো বাক্য আমার মস্তিষ্কে আপাতত আসছে না। একবার বিছানাকান্দি পৌঁছাতে দাও এরপর কোমড় বেঁধে ঝগড়া করবো। দেখবো কত ঝগড়া তুমি করতে পারো?” কপট রাগে কথাগুলো বলে নড়েচড়ে বসলো নবাব। মিষ্টি কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে রইলো। তার মনে হলে পথেঘাটে এভাবে ঝগড়াঝাঁটি করে লোক জানালে পরবর্তীতে নিজেরাই বিপদে পড়তে পারে।
…চলবে
#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_১৩
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
বাস থেকে নেমেও নবাব লক্ষ্য করছে মিষ্টি কিছু বলার জন্য অস্থির হয়ে উঠছে কিন্তু মুখ ফুটে কিচ্ছু বলছে না। হোটেলের রিসিপশনে এখন অনেক ভিড়। তাই রিসিপশনের পাশের এককোণে অপেক্ষা করছে মিষ্টি আর নবাব। মোটামুটি ধরনের একটা হোটেলেই থাকার ব্যবস্থা করেছে নবাব৷ সবকিছু আগে থেকে ঠিক করা হলেও কিছু কাজ এখন সম্পন্ন করতে হবে অন্যথায় হোটেলের রুমে প্রবেশাধিকার পাওয়া যাবে না।
“মিষ্টি, কিছু বলবে?” ফোন স্ক্রোল করার ফাঁকে আদুরে গলায় জানতে চাইলো নবাব।
মিষ্টি অস্থিরতা নিয়ে হোটেলের আশে-পাশে নজর করে দেখছিল। তাই হঠাৎ নবাবের প্রশ্নে কিঞ্চিৎ আঁতকে উঠলো। মুখ ফিরে তাকিয়ে খানিকটা ইতস্তত করলেও ছোট্ট করে জবাব দিলো, “হুম।”
“তো বলো।” স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নবাব।
মিনমিন করে বললো, “তুমি তো বলেছিলে বিছানাকান্দি যাবে কিন্তু সিলেটে কেন নিয়ে এলে?” মিষ্টির কথা শুনে নবাব শব্দহীন হাসলো কিন্তু মাস্কের জন্য তার হাসিটা মিষ্টির দৃষ্টিগোচর হলো।
“বিছানাকান্দি এখান থেকে কেবল ২৫ কিলোমিটার দূরে। তাছাড়া শুনেছি নিরাপত্তার জন্য সিলেটে থাকাই ভালো, বুঝলে?”
“হুম।”
নরম কন্ঠ আর নিদ্রাহীন ক্লান্ত চোখে নবাব বললো, “বিশ্বাস রাখতে পারো৷ আমাকে দিয়ে অথবা আমি পাশে থাকলে একটা প্রজাপতিও তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না।” নবাবের কথায় মিষ্টির মনে মৃদু সমীরণ বয়ে গেল। এটা কোনও হিমায়িত সমীরণ নয়, স্বস্তির সমীরণ, প্রিয়জনের কাছ থেকে ভরসা পাওয়ার আনন্দময়ী সমীরণ।
.
রিসিপশনের সকল কাজ সমাধা করে রুমে প্রবেশ করলো মিষ্টি আর নবাব৷ কিন্তু রুম দেখে মিষ্টির মেজাজ গিয়ে পর্বতের চূড়ায় উঠলো, “তোমার মতলবটা কি জানতে পারি?”
রুমে দরজা লাগিয়েছে নবাব কিছু পাঁচ মিনিটও হয়নি। এর মধ্যে মিষ্টির এমন ত্যাড়া প্রশ্নে চমকালো সে, “মানে?”
“কোন বুদ্ধিতে তুমি একটা রুম ভাড়া নিলে? আমি কোথায় থাকবো?” কাঠকাঠ গলায় আবারও প্রশ্ন করে হাত ভাঁজ করলো মিষ্টি।
ব্যাগ রেখে বিছানায় পা ঝুলিয়ে শুয়ে পড়লো নবাব। কালকে রাতে ঠিক করে তার ঘুম হয়নি। জীবনের প্রথম একসাথে এত কিছু সামলে তার শরীরে যেন এক তোলাও শক্তি নেই। নবাবকে চুপচাপ বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে রাগে হাত ভাঁজ করেই কয়েক কদম সামনে এলো মিষ্টি। নবাবে দিকে খানিকটা ঝুঁকে জানতে চাইলো, “চুপ করে আছো কেন?”
তড়াক করে নবাব উঠে বসতে কিঞ্চিৎ চমকালো মিষ্টি। মাথার ক্যাপ আর মুখে মাস্ক খোলার ফাঁকে বললো, “তোমার মাঝে বোধশক্তি বলে কিছু আছে? হোটেলের কাগজে স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় দিয়ে আলাদা ঘর নিয়ে আমি কি লোককে জানাবো, তোমায় তুলে এনে বিয়ে করেছি?… এতটা পথ জার্নি করে এসে ঘন্টাখানেক কি চুপ থাকা যায় না? বোরকা পরেই শুরু করে দিয়েছো।… বাহ! মানে জীবনে আরও কত কী দেখবো?”
“তুমি ইচ্ছে করে একটা ঘর নিয়ে আমার সাথে নাটক করছো। আমি থাকবো না এখানে। এক্ষুণি বাসায় যাবো।” হঠাৎ-ই এসব বলে উঠে মিষ্টি নিজেই নিজেকে আবিষ্কার করলো, তার বোধশক্তি হয়ত অতি অল্প আছে এখন। এদিকে মিষ্টির মুখে বাসার নাম শুনতেই নবাবের রাগটা দ্বিগুণ হলো।
বসা থেকে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “নাটক করছি আমি? হুম?… বাসায় যাওয়ার কথা আসছে কেন আবার? তোমার মাথায় পিস্তল রাখার সাহস যখন হয়েছে, তখন ওটা চালাতেও কষ্ট হবে না।” একটু থেমে হঠাৎ হাত ছুঁড়াছুঁড়ি করে পিছনে ঘুরে নবাব চেঁচাতে লাগলো, “হ্যাঁ, আমি ইচ্ছে করেই একটা রুম নিয়েছি। এখন তোমার যা ইচ্ছে ভাবতে পারো। আমাকে অনেক কিছু ভেবে সামনে পা ফেলতে হচ্ছে। এখন তুমি যদি আমাকে ভুল বুঝো আই ডোন্ট কেয়ার মিষ্টি।” এবার মিষ্টির দিকে ফিরে তাকিয়ে বললো, “কিন্তু এখন একটা টুঁশব্দও যেন আমার কানে না আসে। ব্যাগে কাপড়-চোপড় আছে। হয় বদল করো নয় এভাবেই সটান দাঁড়িয়ে থাকো।” হাতের ইশারায় ব্যাগ দেখিয়ে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়লো নবাব উপুড় হয়ে।
মিষ্টি ঠাঁই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো মন আকাশে ঘনায়মান মেঘ আঁকড়ে। নত মাথায় সে নবাবের কথা চুপটি করে শুনেছে, প্রতিবাদ করেনি। কারণ নবাব যে নিরূপায় সেটা মিষ্টি অনুভব করতে পারে তবুও কোথায় যেন একটা বাঁধার সৃষ্টি হয় বিধায় মিষ্টি মাঝেমধ্যে উল্টোপাল্টা চিন্তা করে।
কান্নার ঝড় কাটিয়ে উঠে মিষ্টি মাথা তুলে সিলিং-এ দৃষ্টি দিলো। নিশ্চুপ পাখায় একবার তাকিয়ে ঘুমন্ত নবাবের ওপর চোখ রাখলো। ওপাশে নবাবের মুখ ফেরানো আবার কপাল এবং চোখ জুড়ে পড়ে আছে অগোছালো চুল তবুও মায়া নামক সুতায় টান পড়তে মিষ্টি আনমনে বললো, “ফণা তুললেই কি সাপে কামড়ায়? মাথায় পিস্তল ঠেকালেও যে এর থেকে বুলেট বের হবে না, সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানবে?”
নাক টেনে ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে মুখের হিজাব খুলে দিলো মিষ্টি। ব্যাগ নাড়াচাড়া করে সুন্দর একখানা থ্রি-পিস হাতে নিয়ে চমকে উঠলো, “কবে থেকে এসব পরিকল্পনা করেছে ও? আমার জামার মাপে থ্রি-পিসও সংগ্রহ করা আছে আবার প্রিয় রঙের থ্রি-পিস। আমার তো মাথায় কিছুই ঢুকছে না।”
.
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে তার কোনও হিসাব নেই নবাবের। কারণ মিষ্টির সাথে কথা কাটাকাটি করে হঠাৎ বালিশ আঁকড়ে চোখ বুজে দিয়েছিল সে। বিছানায় শুতে আসবার আগে পাখা বন্ধ ছিল কিন্তু এখন সেটা মাথার উপর তীব্র গতিতে ঘুরছে। মিষ্টি পাখা ছেড়েছে এমন ভাবনায় মৃদু হাসলো নবাব, “ঝগড়া করেও আমার খেয়াল রাখতে ভুলে না। হয়ত এই ছোটোখাটো যত্নেই আমি ওর প্রতি দূর্বল হয়েছি নয়ত অন্য কারণ, যার সন্ধান এখনও আমার অজানা।”
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, ঝুম বৃষ্টি অথচ সকালেও রোদের তীব্রতায় চোখ ধাঁধাচ্ছিল। উষ্ণ পৃথিবীকে মূহুর্তেই শীতল চাদরে ঢেকে দিলো অমোঘ বর্ষা। এমন হিম হিম আবহাওয়ায় পাখার নিচে ঘুমিয়ে জমে যাচ্ছিলো যেন নবাব আর সেজন্যই তার ঘুম ভেঙে গেল। এখনও উপুড় হয়ে শুয়েই সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে জল্পনা করছে সে। হাই তুলে এবার সোজা হয়ে বসলো বিছানায় পা ঝুলিয়ে। পকেট থেকে ফোন বের করে সময় দেখে নিলো, দুপুর তিনটা। ঘুমানোর সময়টা ঠিকঠাক মনে করতে না পারলেও সে বুঝতে পারছে, অনেকটা সময়ই ঘুমিয়ে পার হয়ে গেছে।
মুখের পানির ঝাপটা দিয়ে বের হলো নবাব ওয়াশরুম থেকে। মাঝারি আকারে এই ঘরে ওয়াশরুম ছাড়া ছোট্ট একটা বেলকনি আছে অবশ্য সেটাকে পুরোপুরি বেলকনি বলা যায় না। রুমের সাথে লাগনো ছোট্ট একটা জায়গাকে বেলকনির আকার যদিও বা দিয়েছে কিন্তু গ্রিলের পরিবর্তে বড় আকারের কাঁচের জানালা লাগানো। ওয়াশরুম থেকে সেই জায়গাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেখানে বসার জন্য দুইটা বেতের চেয়ারও রাখা আছে। পায়ে পায়ে সেই বেলকনিতে চলে এলো নবাব। পাশাপাশি চারজন মানুষ দাঁড়াতে পারবে না এতটাই সরু।
বেলকনির এককোণে হাঁটু ভাঁজ করে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে মিষ্টি। নজর তার নিবদ্ধ জানালা পেরিয়ে ঐ রিমঝিম বৃষ্টিতে। উজ্জ্বল শ্যামলা মুখে বিষাদের ছাপ প্রখর হয়ে আছে। চিন্তায় চোখের তলায় কালি কাজল কালো হচ্ছে। মসৃণ ত্বকে ব্রণেরা বাসা বাঁধছে। মোদ্দা কথা ঐ চেহারায় সৌন্দর্য বলতে এখন তেমন কিছুই নজরে পড়ছে না তবে মায়া বাড়ছে খুব। নবাবের হৃদয় ব্যথিত হচ্ছে মিষ্টির এমন চেহারা দেখে।
“মিষ্টি?” ধীর গলায় নবাব মিষ্টিকে ডাকতে সে নড়েচড়ে বসলো। একঝলক নবাবকে দেখে চোখ নামিয়ে নিলো।
“এখানে কী করছো?” নবাবের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে মিষ্টির ছোট্ট জবাব, “কিছু না।”
“দুপুর তো হয়ে গেল। খাবে না?”
“নাহ।” চেহারায় রাগ না ভাসলেও মিষ্টির এই ক্ষুদ্র জবাবে নবাব রাগের আভাস পেল। ভেজা মুখে হাত চালিয়ে অতিরিক্ত পানি ঝেড়ে ফেলে নবাব জানতে চাইলো, “রাগ করেছো?”
পূর্বের স্বরেই মিষ্টি জবাব দিলো, “নাহ।”
পা ভাঁজ করে মিষ্টির পাশে বসে পড়লো নবাব। এতে মিষ্টির মাঝে কোনও ভাবান্তর হলো না, সে আগের মতোই বসে আছে বাইরে তাকিয়ে। মেঝেতে বসেই নবাবের চোখ পড়লো মিষ্টির পায়ে। ওর পায়ে শোভা পাচ্ছে নবাবেরই দেওয়া নূপুর। হঠাৎ লক্ষ্য করলো মিষ্টির বাম পায়ের নুপুরটা উল্টে আছে। আলতো নুপুর ঠিক করলো নবাব এরপর অহেতুক নাড়াচাড়া করতে লাগলো নত মাথায়। এতেও মিষ্টির মাঝে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।
“তোমার মিথ্যা কথাগুলো তোমার নামের মতোই মিষ্টি।” নবাবের নরম কন্ঠ শুনে মিষ্টির মেজাজ গরম হলো। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে সে দেখলো নবাবকে, “কিন্তু আমি তো করলার চেয়েও তেঁতো, মরিচের চেয়েও ঝাল আর সমুদ্রের পানির মতো লবনাক্ত।”
মাথা তুললো না নবাব। নুপুর নিয়ে ব্যস্ত থেকেই বলে উঠলো, “যত ইচ্ছে ঝগড়া করো কিছু বলবো না, অভিমানের পাহাড় দাঁড়া করাও তবুও আপত্তি করবো না কিন্তু রাগের চুরিতে আমার হৃদয় আহত করো না।… তোমার জন্য আমি আজ সব ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। একটু তো আমাকে বুঝতে চেষ্টা করো।”
কাঠ গলায় প্রশ্ন করলো মিষ্টি, “আমাকে কী করতে বলছো তুমি?”
নবাব চোখ তুলে তাকালো। সর্বদা খুশিতে চকচক করা চোখে এই মূহুর্তে শত কষ্ট এসে যে ভিড় করছে। ও চোখে তাকিয়ে মিষ্টির হৃদয় নিশ্চুপ হলো ক্ষণিকের জন্য। স্থির দৃষ্টিতে কেবল মুখ নাড়ালো নবাব, “শুধু বিশ্বাস করো আমায়– এখন কেবল এটাই চাই।” অতি সামান্য এই বাক্যে মিষ্টির থমকে যাওয়া হৃদয়ে ঝড় উঠলো। তীব্র এই ঝড়ের হদিস নবাব পেল না অথচ মিষ্টিকে দুমড়ে মুচড়ে দিলো নিমিষেই।
মুখ ফিরিয়ে মিষ্টি বললো, “হয়ত এটা পাবার আশাই আমার মুখ থেকে কবুল শব্দ বের হয়েছে।”
“তোমাকে আশাহত করবো না কখনও শুধু রাগ মুখ আমাকে দেখিও না।”
চকিতে তাকিয়ে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো, “আমরা মেয়েরাই কেন সব সহ্য করবো বলতে পারো?… আমি এখন ভাবতে পারছি না তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। আমি মানতেই পারছি না আমি পরিবার ফেলে তোমার সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছি।”
“ভুল বললে মিষ্টি। আমরা ঘুরছি না, পালিয়ে বেড়াচ্ছি।”
“কতদিন এভাবে বেঁচে থাকা যাবে? কতদিন আমায় এসব সহ্য করতে হবে?”
“জানি না।”
হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলো মিষ্টি। মুখ চেপে কাঁদতে কাঁদতে বললো, “কেন করলে এমন নবাব? কেন আমাকে আমার মতো ছেড়ে দিলে না? কেন আমার জন্য নিজের সুন্দর ভবিষ্যৎ তুমি ধ্বংস করলে?”
“আমার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ তো তুমি। ছাড়তে পারবো না আমি তোমায়।”
কান্না এবার রাগের রূপ নিতে খেঁকিয়ে উঠলো মিষ্টি, “এসব জাদুকরী কথা আমাকে শোনানো বন্ধ করো। এসব মনভোলানো কথায় জীবন চলে না।”
“তাহলে যেভাবে চলছে, সেভাবে না হয় চলতে দাও।”
“নবাব, আমি বিধবা হলে আমার কোনও আপত্তি নেই কারণ আমার ভাগ্যে এটাই লেখা আছে। কিন্তু তোমার কিছু হলে…” কথা সম্পূর্ণ করবার আগেই হাঁটুতে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো মিষ্টি।
“আমার কিছু হলে কী?”
কান্না মিশ্রিত কন্ঠে জবাব দিলো, “জানি না। তুমি এখান থেকে যাও নবাব। আমাকে একা থাকতে দাও।”
“আর কত এমন করে কাঁদবে তুমি? এই চার-পাঁচ বছরে অনেক কাঁদতে দেখেছি তোমায়। আর চাই না আমি তোমায় এমন দেখতে।”
মাথা তুলে মিষ্টি বললো, “তাহলে আমাকে মেরে ফেলো। পারছি না আমি এমন পঙ্গু জীবন পার করতে। তোমাকেও খেয়ে ফেলবো আমি। জানো, নিজেকে রাক্ষসী মনে হচ্ছে আমার।”
কপট রাগ নিয়ে বললো, “কীসব যা তা বলছো তুমি মিষ্টি?”
“যা তা নয়, সত্যিই বলছি।”
“তোমাকে কেউ বলেনি এসব বলতে। এখন কথা না বাড়িয়ে চোখে-মুখে পানি দিয়ে এসো। এরপর চুপচাপ দুপুরের খাবার খাবে। আমি সব ব্যবস্থা করছি।”
মিষ্টি দোমনা করবে এমন ভাব চোখে-মুখে ফুটে উঠতেই নবাব বললো, “তোমাকে জোর করে খাওয়ানোর অভ্যাস কিন্তু আমার আছে।” মিষ্টি চোখ নামিয়ে নাক টানলো আর নবাব একটু ঝুঁকে এসে বললো, “দরকার পড়লে হাত-পা বেঁধে খাওয়াবো।”
…চলবে।