প্রীতিকাহন পর্ব-০৭

0
784

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_৭

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো মিষ্টি। এরপর জানতে চাইলো, “ভালো? পরিবারের চোখে, সমাজের চোখে কলঙ্কিনী বানিয়ে তুমি আমার কী ভালো করলে নবাব?… প্রতি মূহুর্তে যে বিধবা হওয়ার আশঙ্কায় আঁতকে উঠছে তার কী ভালো করলে তুমি?”

মুখে সামনে ধরে রাখা ফোন নামিয়ে নবাব এবার নিজের মাথাও নুইয়ে নিলো। নিশ্চুপ নবাবের দিকে মিষ্টি বললো, “এরচেয়ে যদি গলায় দড়ি দিতাম তাও ভালো ছিল। অন্তত নিজেকে বোঝাতে পারতাম, আমার জন্য কাউকে লাশ হতে হয়নি। কিন্তু মাবুদের হুকুম নেই কারণ উনি আত্মহত্যা নিষিদ্ধ করেছেন।”

ধীরে ধীরে নবাব বললো, “তুমি কেন মরবে? মরা উচিত আমার কারণ আমি তোমাকে কাপুরুষের মতো বিয়ে করেছি। তোমার মনের বিরুদ্ধে তোমার স্বা…”

বিরক্তি নিয়ে বললো মিষ্টি, “দয়া করে চুপ করো। যেটা উচ্চারণ করতে চাইছো, সেটা মুখে তো দূর মনেও আনবে না। তোমার এমন কর্মকাণ্ডের পরও আমি প্রতিবাদ করছি না বলে ভেবো না সবকিছু চুপচাপ মেনে নিবো। আমার জায়গায় যদি অন্য মেয়ে থাকতো তবে এতক্ষণে হুলস্থুল বাঁধিয়ে বাসায় চলে যেত। কিন্তু আমি একটা গাধা তাই যা বলছো তাই করছি।” এক নিশ্বাসে সবটা বলে ক্ষান্ত হলো মিষ্টি। ওর কথায় ইতি পড়তে নবাব এবার বলতে শুরু করলো, “হুলস্থুল বাঁধাবে বলেই আমি অন্য কোনও মেয়ে নয়, তোমাকে বিয়ে করেছি।” বাম দিকে বসা মিষ্টির দিকে খানিকটা ঝুঁকে এলো নবাব। মুখ তার সামনের দিকে কিন্তু শরীর ঝুঁকে আছে মিষ্টির দিকে। ফিসফিস করে নবাব বললো, “আর মেয়েরা গাধা হয় না, গাধী হয়।” এই বলে হাসিতে শরীর দুলিয়ে উঠলো নবাবের। এদিকে মিষ্টির লজ্জায় কান গরম হতে লাগলো। লজ্জায় চঞ্চল হওয়া চোখ জোড়া নামিয়ে বিড়বিড় করলো, “সুযোগের সৎ ব্যবহার সবাই করতে জানে।”

নিচু গলায় বললেও কথাটা কানে এলো নবাবের। ফোন স্ক্রোল করতে গিয়ে জবাব দিলো, “তুমিও তো করো, তাই না? সেখানে অন্য কেউ করলে দোষ কেন হবে?”

প্রতুত্তরে কিছু বলতে যাবে মিষ্টি এর আগে নবাব উঠে দাঁড়ালো। পকেটে ফোন পুড়ে ব্যাগ নিতে শুরু করলো। নামানো চোখে মিষ্টিকে বললো, “চলো, বাস এসেছে।”

একটু আগে হাসিতে লুটিয়ে পড়া ছেলেটার হঠাৎ গম্ভীর মুখ দেখে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো মিষ্টি। অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো। পরিচিত মানুষের পদচিহ্ন অনুসরণ করে অপরিচিত গন্তব্যে পা বাড়ালো।

.

আঁধার রাতে পৃথিবীতে নেমে এলো পূর্ণ চাঁদের শুভ্র জোছনা। বাতাসে মাখানো জোছনার সাথে ভাসছে সুমিষ্ট ঘ্রাণ। প্রবল বাতাসের তোরে এলো হওয়া বোরকা সামলাতে গিয়ে মিষ্টির মনের কোণে বারবার ভেসে উঠছে,

“এমন চাঁদের আলো
মরি যদি তাও ভালো
সে মরণ স্বর্গ সমান।”

দীর্ঘদিন পুরোনো এই চরণের সাথে মিষ্টির পরিচয় হয়েছিল কোনো এক বইয়ের পাতায়। চরণগুলোর সাথে আজকের রাত্রিরের ওতোপ্রোতো সম্পর্ক পেয়ে, সেটা মনের খাতায় চকচক করে উঠলো।

চলন্ত বাসে পাশাপাশি বসে আছে মিষ্টি আর নবাব। মিষ্টির নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে নবাব ওকে জানলার পাশে বসিয়েছে আর নিজে ওর পাশে বসেছে। সিটে বসেই নবাব কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিয়েছে। দুইদিনের দৌড়ঝাঁপে তার শরীরে ক্লান্তি এসেছে অধিক হারে। চোখ বুঁজে তাই এখন সিটে হেলান দিয়ে পড়ে আছে। বাসে উঠা আগে শেষবারের মতো নবাব কথা বলেছিল মিষ্টির সাথে। প্রায় একঘন্টা হয়ে গেছে অথচ পাশাপাশি বসা দু’টো মানুষের মুখে কোনো কথা নেই।

একবার নয়, কয়েকবার তাকিয়ে দেখেছে মিষ্টি নবাবকে। প্রতিবারই কিছু বলবার ইচ্ছায় তার মুখ কেঁপে উঠেছে কিন্তু বাক্য নিসৃত হয়নি। এখনও তাকালো মিষ্টি নবাবের দিকে।

“কী দেখছো?” চোখ বুঁজে হঠাৎ প্রশ্ন করলো নবাব আর এতে চমকে গিয়ে তোতলালো মিষ্টি, “ক…কই? কি…কিছু না।”

চোখ মেলে সোজা হয়ে বসে ইয়ারফোন খুলে নবাব আবার জিজ্ঞেস করলো, “কী দেখছো বাইরে?”

মিষ্টি অন্য কিছু ভেবে ঘাবড়ে গিয়েছিল কিন্তু এখন ভুল বুঝতে পেরে স্বাভাবিক হয়ে বললো, “আকাশের চাঁদ।”

“আর ভেতরে?” ধীর গলায় প্রশ্ন করে শান্ত চোখে তাকালো নবাব। ক্যাপ আর মাস্কের মাঝে বিদ্যমান চোখে তাকিয়ে লজ্জায় পড়লো যেন মিষ্টি। ওর ধারণা প্রথমেই ঠিক ছিল, নবাব মিষ্টিকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকার জন্যই প্রশ্ন করেছে, “কিন্তু চোখ বুঁজেও নবাব বুঝলো কী করে আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি?” মাথা নত করে ভাবতে লাগলো মিষ্টি। ওকে ভাবতে দেখে নবাব প্রশ্ন করলো, “উত্তর দিলে না যে?”

“জানি না।”

“সব জেনেও প্রতিবার এই মিথ্যা কথাটা কেন বলো?”

হঠাৎ মাথায় রাগ চেপে ধরতে মিষ্টি পাল্টা প্রশ্ন করলো, “সবকিছুর কৈফিয়ত দিতে হবে?”

“চোখ রাঙিয়ে কথা বলছো কেন? সত্যি বলার সাহস না থাকলে সেটা ঢাকতে মিথ্যা রাগ দেখিও না। তোমাকে আমি আজকে থেকে চিনি না। জন্মের পর থেকে দেখে আসছি। তাই তোমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা আছে। আর কৈফিয়তের কথা বললে না? এটা তো তুমি নিজেই দিতে আমি না বললেও। তাহলে আজকে এটা নতুন করে কেন জিজ্ঞেস করছো?”

দাঁতে দাঁত চেপে মিষ্টি বললো, “বাস ভর্তি লোকের সামনে তোমাকে জাহির করতে হবে তুমি আমায় আগে থেকে চেনো? বলতে হবে তুমি আমার আত্নীয়?”

“তুমি রিকশাওয়ালা মামা, বাসস্ট্যান্ড ভর্তি লোকের সামনে আমার কর্ম তুলে কথা বললে। আর আমি চুপিচুপি কয়টা কথা বলে দোষী হয়ে গেলাম? নিজের বেলায় ন্যায় আর আমার বেলায় কেন অন্যায় মিষ্টি?”

রাগে চোখ-মুখ খিঁচে মিষ্টি বললো, “প্রতিশোধ নিচ্ছো? আমার প্রতি এত আক্রোশের জন্ম হলে আমার কী করা উচিত তোমাকে? তুমি তো আমাকে সবার চোখে নামিয়ে এখানে এনেছো। এখানে এনে জোর করে সবকিছু করে এখন ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য খোঁজায় বসেছো?”

“হ্যাঁ, তুমি তো শুধু নিচে নেমেছো আর আমি ওপরে উঠতে উঠতে এবার পরপারেই চলে যাবো। এরপর সুখে থেকো।”

এক গাল হেসে উঠলো মিষ্টি, “সুখ? এটা আমার জীবনে আদোও আসবে?”

“মন থেকে গ্রহণ করে কর্মে ভালোবাসা প্রকাশ করো। তোমার চেয়ে সুখে এই বিশ্বে কেউ হবে না।” শান্ত গলায় বলা নবাবের কথা শুনে রাগটা মিইয়ে গেল মিষ্টির। হৃদয় একটা টান অনুভব করতে সাথে সাথে মুখ ফিরিয়ে বাইরে তাকালো। নিজেকে নবাবের থেকে আড়াল করতে জোছনা বিলাশে মত্ত হলো।

হঠাৎ চুপ করে যাওয়া মিষ্টির দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলো নবাব। পুনরায় ইয়ারফোন কানে গুঁজে বাসের সিটে হেলান দিলো। চোখ বুঁজে গানের সাথে শব্দহীন গেয়ে উঠলো,

“রাত নির্ঘুম বসে আছো তুমি
দক্ষিণের জানালা খুলে
যত নির্বাক অভিমান মনে
আজ সবটুকু নিলাম তুলে

এসো তবে বৃষ্টি নামাই
সৃষ্টি ছাড়া ভালোবাসায়…
এসো তবে জোছনা সাজাই
দু’চোখে তারায় তারায়…”

ক্লান্ত চোখে বাইরে তাকিয়ে হঠাৎ মিষ্টির বোধ হলো। বাসে করে রাতের ভ্রমণ এর আগে সে কখনও করেনি। তবে দশম শ্রেণির ছাত্রী থাকাকালীন একবার শিক্ষা সফরে গিয়েছিল। সেদিন বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গিয়েছিল। সেই স্মৃতি আজকে হঠাৎ করে চোখের সামনে ঝলমল করে উঠলো।

সকাল ছয়টা। শীত বিদায় নিয়েছে অনেক আগে কিন্তু শীতের রেশ কাটেনি এখনও। বিছানায় পড়ে থাকা উনিশ বছরের একটা প্রাণ ফ্যানের তীব্র বাতাসে কুঁকড়ে উঠছে। পাতলা কাঁথায় ফ্যানের ঠান্ডা বাতাস দূর করতে বারবার কাঁথা মুড়ে কুঁজো হচ্ছে। ঘুমের টানে ফ্যান বন্ধ করতেও উঠছে না। হঠাৎ সুইচ টিপে কেউ ফ্যান বন্ধ করে দিলো। ঘরময় আলোকিত করে আদুরে গলায় ডাকলো, “মিষ্টি, মিষ্টি?”

একটু নড়েচড়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে ছোট্ট করে জবাব দিলো, “হুম।”

“ছয়টা বাজে। আজকে না স্কুল থেকে শিক্ষা সফরে যাওয়ার কথা?”

শিক্ষা সফর– শব্দযুগল মিষ্টির কানে পৌঁছাতে তড়াক করে উঠে বসলো সে। ঘুম ঘুম চোখে মাঝ বয়সী থ্রিপিস পরহিত নারীর মুখ দর্শন করে জিজ্ঞেস করলো, “গোসল করে নাস্তা করবো না-কি নাস্তা করে গোসল করবো মা?”

“গোসল করেই নাস্তা করিস। আমি চুলায় গরম পানি বসিয়ে এসেছি। তুই কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে যা।”

মাথা চুলকে জবাব দিলো মিষ্টি, “ঠিক আছে।”

…চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে