প্রিয় বাবা – Shakib Shahriar Prio

0
486

#গল্পপোকা_চিঠি_প্রতিযোগিতা_২০২০

প্রিয় বাবা,
তোমার মনে পড়ে? মায়ের যখন বিয়ে হয়, তখন তাঁর বয়স ১৭। তোমার ২৫।
লং ডিসটেন্সে কেন বিয়ে, এই প্রশ্নের উত্তর আমি বড় হবার পরেও তোমাদের দিতে শুনেছি। আমার নানাবাড়ি বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের তিন জেলার একটায়, নীলফামারী জেলায়, আর দাদাবাড়ি মাগুরাতে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চল।

আমি যখন জন্মগ্রহণ করি, তখন মায়ের বয়স ১৯। জন্মের পর থেকে প্রায় ৪-৫ বছর আমি নানাবাড়িতেই ছিলাম।
শুনেছি, অনেকে জিজ্ঞেস করত, ওর বাবা কই? আসেনা?

অথচ তুমি আসতে মাঝেমধ্যেই। তিস্তা ব্যারেজের ওখানে ডালিয়ায় থাকতে তুমি। পানি উন্নয়ন বোর্ডে।
কিন্তু মানুষজন দেখা হলেই জিজ্ঞেস করত, আমার বাবা আসে কি না!
আমার মাকে জিজ্ঞেস করার সাহস করত না। কিন্তু আমি নাকি অন্যের কোলে থাকলেই এই প্রশ্নের আলোকপাত।

বড় হয়ে আমি জানি। এই প্রশ্নের ভাবার্থ আর আক্ষরিক অর্থ এক নয়।
ভাবার্থ হল, ‘আসে কি না’ তা জানা নয়, বরং ‘তুমি আমাদের কবে নিয়ে যাবে’ – এটা জানার চেষ্টা করা।

অথচ তুমি তখন জীবনযুদ্ধে লড়ছো। তুমি সেসময় সরকারি চাকরিতে জুনিয়র। কয়েকজন কলিগ নিয়ে একসাথে থাকা আর বুয়ার রান্না করা ভাত-ভাজি খাওয়া ছিল তাঁর জীবনের অংশ। ভার্সিটিতে উঠে আমি বুঝেছি, এই ব্যাপারটা মোটেও সহজ নয়। অথচ ভার্সিটির হলে খেতে আমাকে বাজার করতেও হয় নি, ডাইনিং ছিল। কিংবা আরো ভালো কিছু খেতে ক্যান্টিন, হোটেল ছিল। এছাড়া সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ ছিল। তাছাড়া তো আছে নানান কিছু। টিভি রুম, কমন রুম, এদিকে ওয়াইফাই আর ল্যাপটপ।
এরপরেও আমার মনে হয়েছে, কত কষ্ট, জীবন কেন এমন – এইসব হাবিজাবি চিন্তা!

কিন্তু আমার বাবা এত বড় পিছুটান রেখে আর দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে কিভাবে দিন কাটাত, সেটা ভাবলে এখন বুঝি, আমার কষ্ট কোনো কষ্টের ডেফিনিশনেই পড়তে পারে না। এসব ব্যাপারকে সবাই হয়ত তখন বোঝার চেষ্টা করত না, তাই ওভাবে প্রশ্ন করতে বাঁধত না। তাই এলাকাবাসীকেও আমি দোষ দেই না। এসব প্রশ্ন করা মানুষ স্বাভাবিক চোখেই দেখে। কেউ কি শুনতে চায়, পেছনের গল্প কী!
….
তোমার ডায়েরীতে জেনেছি, রাজশাহী ভার্সিটিতে টিকেও তুমি কেন ভর্তি হল না, সেই গল্পটা অনেক ইন্টারেস্টিং, একইসাথে প্যাথেটিক। টিউশনি করাতে হবে বলে সে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হলে তুমি। তখন জগন্নাথ ছিল কলেজ(বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়)। এরপর তুমি ঢাকায় সে টিউশনি করাতে, আর সেই টাকা মেজো, সেজো চাচার জন্য পাঠাতে। এদিকে চাচারা পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে তখন ব্যবসা করে, এবং বিয়েও করে ফেলে তাঁদের বড় ভাইয়ের আগেই। এখন তাঁদের অনেক বড় বড় ব্যবসা। মাগুরা শহরে মার্কেট, গোডাউন। সেজন্য তাঁদের পরিশ্রমকেও আমি শ্রদ্ধা করি। সবার দ্বারা চাকরি হতে পারে, কিন্তু ব্যবসা হয় না। তাঁরা তো সেটা করেছে।
কিন্তু সেসব করার পর কি করেছে? আমার দাদার সকল সম্পত্তি দখল করেছে। এমনকি তোমার অফিস থেকে লোন নিয়ে ১১০ শতক জমি কেনা, সেটাও দখল করে রেখে পাট উৎপাদন করে। গ্রামের মানুষ জানে, ওটা তাঁদেরই জমি, তোমার নয়। আর ফসলি জমিতে কেউ কাগজপত্র দেখে না, দেখে কার দখল আছে, জমি তার। এদিকে গ্রামে কখনো মিটিং-সালিশ বসে না। ভূমি অফিস কখনো চেকিং করে যায় না। কারণ, টাকাপয়সাওয়ালাদের বিরুদ্ধে কোথাকার তাঁদের বড় ভাই, আমার বাবা, গভমেন্ট জব হোল্ডার, নিজের ১১০ শতক জমির দখল পাচ্ছেনা, সেটা নিয়ে কার কি দায়!
….
পৃথিবীটা এমনই হয় বাবা, খুব একপেশে। কেউ রক্ত পানি করে টাকা আয় করে, আর সেই টাকা দিয়ে অন্যরা সুখ লাভ করে।
তবে সুখ লাভ করাটাও একটা আর্ট, আমি এটা মানি। সবাই কি আর আর্টিস্ট হতে পারে?
আমি তাই জীবনে লক্ষ্য নিয়েছি শুধু তোমার জন্য আর্টিস্ট হবার, নিজের জন্য নয়। যদিও সেসব তোমাকে আমি বুঝতে দেই না। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েও কেন প্রশাসনে যাওয়ার টার্গেট করেছি, তা দুটো অদ্ভুত কারণে, একটা নিজের প্যাশন, আর আরেকটা অতীতের হিসাব-নিকাশ। আল্লাহ চাইলে তোমার জন্য যুদ্ধে জিতব, অথবা হারব। তবে যুদ্ধটা করবোই, বাবা।
….
“বাবা দিবস” এর সকালে তোমার আগে ঘুম থেকে উঠতে পারি নি। এজন্য যথেষ্ট লজ্জিত বোধ করছি। তোমাকে চমকে দেয়া হল না কিছু করে। কিই বা চমকে দিতাম সেই লোকটাকে, যে লোকটা সারাজীবন যুদ্ধ করে চমকে দিচ্ছে আমাকেই।
তাই এই দিনেও ঘুম থেকে উঠে দেখেছি, দুই ভাইবোনের জন্য কোণ আইসক্রিম রাখা। আর তুমি কিছু খেয়ে চলে গেছ রোজকার সরকারি চাকরিটায়। এদিকে আমি নির্লজ্জ ঘুম থেকে ৯টায় উঠে নির্লজ্জের মতই খাওয়াদাওয়া করেছি। তুমি কখনো বলো নি আমাকে ‘ভালোবাসি’, কিন্তু আমার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞাটাই তো তুমিই।
….
‘ফাদারস ডে’ টা বাবারা তেমন একটা পালন করে না, কিংবা অনেকে মনেই রাখে না। তুমিও রাখো না, বা রাখলেও বলো না।
কেন রাখার দরকার নেই, আমি জানি।

কারণ যোদ্ধাকে কি মনে করে দিতে হবে যুদ্ধের কথা?

কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হয়। মনে রাখা দরকার। কারণ, আমরা অকৃতজ্ঞ এবং ভুলোমনা। আর অকৃতজ্ঞদের অবশ্যই কৃতজ্ঞতার প্রাকটিস করতে হবে। নইলে অভ্যাস হবেনা। যে দায়িত্ব বাবারা সারাজীবন পালন করে আসছে, তা যদি আমরা ভুলে গিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাই?

পুরনো ইতিহাস ভুলেও তো যেতে পারি একসময়, তাই না?
এইজন্যই মনে রাখাটা দরকার।

“হ্যাপি ফাদারস ডে, বাবা”।
শুধু এটাই আফসোস, আমার কোনো চিঠিই তোমার পঠিত নয়। আমার কাছেই রয়ে যায়।
তাতে কী!
চিঠি দিয়ে আর কী হবে? যখন হৃদয়েই এঁকে রেখেছি তোমার জন্যে ভালোবাসা।
পৃথিবীর বুকে আমি হতে চাই তোমার সবচাইতে বড় শক্তি।

ইতি-
তোমার পুত্র।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে