#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১০
শেফা মনে মনে প্রচুর হাসলো। পূরব যে এতোদিন দেশেই ছিলোনা আর সেহেরের খোঁজ প্রতিনিয়ত নিয়ে যাচ্ছে সেই খবর সেহেরকে জানাতে ইচ্ছে করলোনা। থাকুক না ব্যাপারটা গোপন। সময় হলে হয়তো পূরবই বলবে। শেফা হালকা কেশে বলে উঠলো, ‘তো তুই যে ওনাকে পছন্দ করিস সেটা বলছিস ওনাকে?’
সেহের হতভম্ব হয়ে বলল, ‘আমি? ওনাকে পছন্দ করি? কবে, কখন এসব বললাম শেফা? এসব ফালতু কথা আমার সামনে একদম বলবিনা৷ যত্তসব…’
‘কেন?’
‘ওনারা কতো বড়লোক। আর আমি? ছিঃ! ওনাদের সাথে আমার তুলনা? কখনোই না। তাছাড়া ওনাকে আমার এমনিতেই অপছন্দ।’
‘এরকম ড্যাশিং একটা ছেলেকে এরকম বলতে পারলি?’
সেহের রেগে বলল, ‘ড্যাশিং হলে কী হবে? স্বভাব একদম ভালোনা…’
‘তুই কীভাবে জানলি ওনার স্বভাব ভালোনা?’
‘ভালো হলে কী এসব করতো? কোনো অপরিচিত মেয়ের বাসায় এসে ঢিল ছুঁড়তো? নাকি সারারাত দাঁড়িয়ে থাকতো? আর কথা শুনলে তো গা জ্বলে যায়। আর কেমন সন্ত্রাসী সন্ত্রাসী ভাব চেহারায় দেখলেই ভয় লাগে। মনে হয় এক্ষুনি গিলে খেতে আসবে।’
‘একবার বলিস চোর, এখন বলছিস সন্ত্রাসী? কিন্তু যা-ই বলিস না কেন ওনার ইউনিক লুকটা আমার বেশ পছন্দ। আহা ড্রেসের সাথে ম্যাচিং করে হ্যাট পরে, আর এটিটিউডের কথা কী বলবো, উফ..জাস্ট মাইন্ড ব্লোয়িং!’
‘তোর মাথা।’
‘আর কিছুসময়। তারপর ওনার বউ হলে সারাদিন চোর চোর বলিস৷ দেখব তখন এতো কিউট একটা ছেলেকে কেমনে তুই বাজে কথা বলিস!’
সেহের লজ্জা পেয়ে গেলো। ওর মনে যে পূরবের জন্য অনুভূতি নেই তা কিন্তু নয়৷ এতোদিনে পূরব ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন রাত্রে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ও শুধু সুন্দর লোকটাকেই দেখতো। মশার কামড় খেয়ে কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকতো লোকটা? কিন্তু আজকাল আর আসেনা কেন? হয়তো রুচি বদলে গেছে তাই। লোকটা কি জানে ওর জন্য সেহের কতোরাত লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছে? ভালোবাসে কিনা জানেনা, ভালো তো লাগে! কিন্তু ও তো একটা গরিব ঘরের এতিম মেয়ে। পূরবের স্ট্যাটাসের নয়। ওদের মিল হওয়াটা আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া অন্য কিছুই নয়। তবুও সেইরাতে যখন প্রথমবারের মতো প্রেমে পড়ার কথাটা সেহেরকে বলেছিলো পূরব, এক সমুদ্র ভালোলাগা হঠাৎ করেই তৈরি হয়ে গিয়েছিলো লোকটার প্রতি! সেই থেকে অপেক্ষার শুরু!
শেফার কথাটা হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়ার ভান করে সেহের চোখমুখ কুঁচকে বলল, ‘চরিত্র নষ্ট হয়ে গিয়েছে তোর।’
‘এরকম বলতে পারলি? আমি কী বারোভাতারি মেয়ে? আমার একজন হলেই যথেষ্ট। আর সেটা পেয়েও গেছি।’
সেহের বলল, ‘জিসান ভাইকে মোটামুটি ভালোই মনে হয়। ওনার ফ্যামিলিতে কে কে আছে?’
‘মা আর বোন। বোন তো মাকে নিজের কাছে নিয়ে রেখেছে।’
‘কেন?’
‘পড়াশোনা করে তো। হোস্টেলে থাকতে চায়না, তাই ওনার বোনের কাছে আম্মাকে পাঠিয়েছে।’
‘ওহহ। তাই বল। কোথায় পড়ে?’
‘চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে।’
‘অনেক দূর!’
‘হুম।’
সেহেরের সাথে সারারাত অনেক গল্পই হলো শেফার। একসময় ঘুমিয়ে পড়লো৷ ওদিকে পূরব ওর বাবাকে সেহেরের কথা বলতে গিয়েও বলতে পারলোনা। কারণ ইরফান আহমেদের জরুরি একটা মিটিং পড়ে গিয়েছে হঠাৎ, তাই ল্যাপটপ নিয়ে ঘরে চলে গিয়েছেন৷ পূরব আর বাবাকে ডিস্টার্ব করতে চাইলোনা। জিসানকে সোফায় গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে পূরব এগিয়ে গেলো। দুই-পা ওপরে তুলে বসলো। হাতঘড়ির স্ট্রিপটা খুলতে খুলতে পূরব গম্ভীর গলায় বলল, ‘আব্বু চলে গেল?’
‘কী বলবি আমায় বল না?’
‘তুই আমাকে জন্ম দিছোস? আমার তো আব্বুর পারমিশন লাগবে, তোর না।’
জিসান হেসে বলল, ‘ভাবসাব দেখেতো মনে হচ্ছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবি।’
‘অবশ্যই ইম্পোর্টেন্ট কথা বলব। আমি ফালতু কথা বলিনা, ফালতু কাজও করিনা৷ যা করি সেটা নিজের বা অন্যের প্রয়োজনে করি। আর সেটা তুই খুব ভালো করেই জানিস। বাই দ্যা ওয়ে, তুই যে আমার সাথে ছলনা করিস সেটাতো আমি জানতাম না। নইলে এত ইম্পোর্টেন্ট একটা কথা তুই আমাকে একবারও জানালি না? এই তুই আমার জানের জিগার দোস্ত?’
জিসান অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘কোনটার কথা বলছিস? কি বলিনি আমি?’
পূরব ধমক দিয়ে বলল, ‘তোর সাথে শেফার সম্পর্ক আছে এটা জানাসনি কেন আমাকে?’
জিসান বোকার মতো তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘কে বলেছে তোকে?’
‘কেন? শেফা নিজে বলেছে!’
জিসান লজ্জা পেয়ে গেলো। তার জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ কথাটা সে পূরবকে বলেনি শুধুমাত্র লজ্জার কারণে। এমনিতে সব বিষয় শেয়ার করে, কিন্তু এই ব্যাপারটা জানাতে গিয়ে বারবার ওর গলায় কথা আটকে গিয়েছে। শব্দ ভুলে গিয়েছে। পূরব ওকে আর কিছু বললোনা। ছোট্ট করে ‘কংগ্রাচুলেশনস’ জানালো। জিসানও হাসলো। পূরবকে কথাটা বলতে পারছিলোনা, ও যখন নিজেই জেনে গিয়েছে ভালোই হলো৷ প্রেম, ভালোবাসা বিষয়টা খুব সেন্সেটিভ মনে হয় জিসানের কাছে৷ এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা ওর খুবই অপছন্দ। ভালোবাসা হলো দুটো মানুষ আর দুটো পরিবারের মিলন। দুনিয়া ভুলে সারাদিন ফোনে কথা বলা বা অন্যান্য পাগলামো করাটা নেহায়াতই বোকার কাজ। কেউ তোমার হবার হলে সে এমনিই তোমার হবে। ঠিক এমন সময় ফোন বেজে উঠলো জিসানের।
জিসান ওর মায়ের সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে নিজের ঘরে চলে গেলো। পূরব বেশ ক্লান্ত ছিলো তাই নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়লো। এসির টেম্পারেচার বাড়তি, তবুও কুলকুল করে ঘামছে ও। ইচ্ছে করছে এক ছুটে সেহেরের কাছে চলে যেতে। কিন্তু ক্লান্ত শরীর নিয়ে বেরুনোটা ঠিক হবেনা৷ দু-রাত ঘুমাতে পারেনি। আজ ঘুমিয়ে শরীরটাকে ঠিক করে নিতে হবে। মাথাটা ভার হয়ে আছে। পেটে ক্ষিধেয় ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। কি আশ্চর্য! খেয়েই তো এলো। পূরব ওঠে নিচে চলে গেলো। ফ্রিজ থেকে নুডুলসের বাটিটা বের করলো। খুব ঠান্ডা। অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও তা গরম করে ঘরে চলে গেলো। খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লো। সারারাত ভেবে ভেবে একটা প্ল্যান বের করলো। ওই মাহিমকে একটা শাস্তি দিতে পারলে তবেই ওর শান্তি! যা হবার হবে, এর একটা বিহিত করতেই হবে। মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘুমিয়ে পড়লো পূরব।
পরদিন সকালে ইরফান সাহেবকে ফ্রি পাওয়া গেলো। পূরব সরাসরি বলল, ‘এখন কথা বলতে পারবে?’
ইরফান সাহেব বললেন, ‘হুম।’
‘আব্বু আমি বিয়ে করতে চাই।’
ওনি অবাক হয়ে বললেন, ‘কাকে?’
‘তোমার খুব প্রিয় একটা মানুষকে।’
ইরফান আহমেদ অবাক হয়ে বললেন, ‘আমার প্রিয়? কে সে?’
‘সেহের!’
‘সত্যি?’
‘হুম। এখন বলো তুমি কী চাও!’
‘ওকেই পছন্দ তোমার?’
‘হ্যাঁ।’
ইরফান সাহেব হেসে বললেন, ‘তাহলে আমার প্রবলেম নেই। আমি বরণ করতে রাজি!’
পূরব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘থ্যাংকস আব্বু।’
ইরফান সাহেব যে রাজি হবেন সেটা জিসান, পূরব দুজনেই জানতো। সকালের নাস্তা সেরেই জিসানকে নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো পূরব। ও খুব ফুরফুরে মন নিয়ে অফিস করলো। আজকের দিনটা এতো সুন্দর কেন!! বারোটার দিকে অফিস শেষে সোজা চলে গেলো সেহেরের ভার্সিটিতে। এখন ওদের ক্লাস শেষ হবে। ও গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে। তারপর জিসানকে ফোন লাগালো। কয়েকবার রিং হবার পর জিসানের কন্ঠ শোনা গেলো।
‘হ্যালো দোস্ত?’
‘হ্যাঁ তুই কোথায়?’
‘আমিতো অফিসে। তুই কই?’
‘আমি সেহেরের ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে আছি।’
জিসান অবাক হয়ে বলল, ‘কেন?’
‘কয়েকটা গুন্ডাপান্ডা ধরণের ছেলে জোগাড় করে দিতে পারবি?’
‘হঠাৎ গুন্ডাপান্ডা কেন?’
‘পারবি কিনা সেটা বল।’
‘পারবো। কিন্তু কেন সেটা তো বল?’
‘ফাহিম না কি যেন নাম ওই ছেলেটার? আরে তুই যার কথা বলেছিলি ওটাকে পিটাতে হবে।’
‘ফাহিম না মাহিম। কিন্তু মারবি কেন? তোর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে?’
পূরব রেগে বলল, ‘তুই জেনেও না জানার ভান করছিস? এই তুই আমার বন্ধু? ড্যামেট…’
জিসান বলল, ‘ওকে ওকে। আমি ব্যবস্থা করছি। কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করিসনা। শেষে হিতে বিপরীত না হয়ে যায়।’
‘ডোন্ট ওরি!’
পূরব ফোন রেখে দিলো। মাথা থেকে হ্যাটটা খুলে স্টিয়ারিংয়ের ওপর রাখলো। কালো চুলগুলো হালকা বাতাসে দুলছে। এখন যদি কেউ জানতে পারে ইফরাজ পূরব এখানে এসেছে, তাহলে মুহূর্তেই হুলস্থুল কান্ড লেগে যাবে৷ সেজন্য বাইরে বেরুলে ও সবসময় সানগ্লাস আর হ্যাট পরিধান করে থাকে৷ যদিও এটা এখন ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর প্রিয় মানুষটার দেখা পাবে। যাকে সে কোনোভাবেই হারাতে চায়না। সেই অসাধারণ রমণীটিকে সারাজীবন প্রিয় তুমি করে রাখবে!
(বোনাস অংশ)
ক্লাস শেষে মাহিম যখন বেরিয়ে এলো তখন ফাঁকা জায়গা দেখে কয়েকটা ছেলে ওকে ঘিরে ধরলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলেগুলো ওকে কিল-ঘুষি দিতে লাগলো। প্রায় দশমিনিট এভাবে মারার পরে ওরা চলে গেলো। যাবার আগে বলে গেলো, আমাদের ভাবির কাছ থেকে অলওয়েজ দশ হাত দূরত্ব বজায় রাখবি। নইলে পূরব ভাই তোকে দুনিয়া থেকে আউট করে দেবে। পূরব কে চিনছিস তো? ইফরাজ পূরব! আর তার হবু বউ সেহের। তার সাথে আজ থেকে তোর মেলামেশা যেন না দেখি। বলেই ছেলেগুলো চলে গেলো। মাহিম হতভম্ব। ও বুঝতে পারছেনা হঠাৎ করে কোথা থেকে কারা এসে ওকে মেরে চলে গেলো। তাও সামান্য এক কারণে। যেখানে ওর কোনো দোষই নেই। একপর্যায়ে ব্যথায় ও অজ্ঞান হয়ে গেলো। সেহের, শেফা, রিমা এই খবর শুনে দ্রুত ছুটে এলো। কমন রুমে নিয়ে ওকে পানি ছিঁটিয়ে জ্ঞান ফিরানো হলো। সবাই কি হয়েছে জানতে চাইলে মাহিম পুরো ঘটনা খুলে বললো। শেফা, রিমি হাসতে হাসতে বলল, ‘কী জেলাস রে পূরব ভাইয়া৷ মাই গড! সেহের তুই পাইছিস..’
‘কী পেয়েছি?’
‘বলছিলাম না পূরব ভাই তোকে পছন্দ করে?’
সেহের মাথা নিচু করে মাহিমকে বলল, ‘দুঃখিত আমি। আমার জন্য এসব হলো। আমি এটা চাইনি।’
মাহিম হাসতে হাসতে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘এরকম প্রেমিক তো জীবনে দেখিনি। প্রেমিকার সাথে কথা বললেও মাইর? ইউ আর ভেরি লাকি গার্ল সেহের। বাই দ্যা ওয়ে, আমি কিছু মনে করিনি। তোমার অপ্রস্তুত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা অলওয়েজ বেস্টফ্রেন্ড থাকবো। আমারও এবার থেকে কঠোর প্রেমিক হতে হবে, আমিও তো চাইনা আমার প্রিয় মানুষটা কারো সাথে কথা বলুক, আফটার অল আমিও জেলাস হই। হাহা।’
রিমি কড়া চোখে মাহিমের দিকে তাকালো। সেহের খুব লজ্জ্বা পেলো। মাহিমের কাছে স্যরি চেয়ে বাসায় ফিরে এলো। এসবের মানে কী? পূরব সেহেরকে ভালোবাসে? তাহলে সামনে এসে বলেনা কেন? আর এটাও বুঝি সম্ভব? আকাশ আর পাতালের কোনোদিনও বুঝি মিল হয়? কোথায় রাজপুত্র আর কোথায় ঝি’য়ের মেয়ে। হাস্যকর হলেও সেহেরের মনে একটু প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেলো। সঙ্গে খুব রাগ আর অভিমান হলো। ওর জন্য শুধু শুধু মার খেলো মাহিম! আসুক না বিয়ের কথা বলতে, মজা দেখিয়ে দেবে সেহের! দুটো কড়া কথা যদি না শুনিয়েছে তাহলে ওর নামও সেহের নয়! সেহেরের মনে প্রিয়ের জায়গা করে নেওয়াটা এতোটাও সহজ নয় কিন্তু, এটাও জানা উচিৎ লোকটার। সবকিছুতে এতোটা সিনেমাটিক হলে চলে না। বাস্তব বলে কিছু তো আছে। কই, নিজে থেকে এসে তো বলেনি ভালোবাসি৷ রাস্তার মানুষকে পিটিয়ে ভালোবাসা জানান দেওয়াটা কেমনতর কাজ? সাহস থাকলে সামনে এসে বলুক, হুহ!
ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। সাজানো গোছানো একদম ভালো হয়নি!
চলবে..ইনশাআল্লাহ!