#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬
পূরব সবেমাত্র বাইরে থেকে ফিরেছে। ফ্রেশ হয়ে এসে সন্ধ্যার নাস্তা নিয়ে ডিভানের ওপর পা তুলে আরাম করে বসলো। জিসান ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে চেয়ারে বসলো। পূরব স্যালাড চামচে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলো, ‘কখন ফিরলি?’
‘এইতো আধঘন্টা হবে হয়তো।’
‘কাজ হয়েছে?’
‘হুম। ওখানকার ম্যানেজারকে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি। ওনার খুব ইচ্ছে তুই নিজে গিয়ে যাতে সবকিছু দেখে আসিস।’
‘সময় হলে যাওয়া যাবে! আপাতত শিডিউল.. ‘
‘তোকে একটা বিষয় জানাতে এলাম।’
পূরব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী?’
‘তোর মনে আছে সেহেরের কথা? আরে যে মেয়েটা তোকে চোর বলেছিল?’
পূরব প্রায় সাথে সাথেই মনে করতে পারলো। স্যালাডের বাটিটা রেখে বলল, ‘কী হয়েছে ওর?’
‘ওর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে এলাম।’
‘তা কী জানতে পারলি?’
‘খুবই করুণ ঘটনা।’
‘বল। এভাবে কথা প্যাঁচিয়ে বলবিনা, যা বলবি স্ট্রিক্ট বলে ফেল।’
‘আসলে সেহের মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলো।’
‘ছিলো মানে? এখন নেই?’
‘পুরো কথাটা তো শোন।’
‘হ্যাঁ শুনছি!’
‘তো ছোটবেলায়ই ওর বাবা-মা মারা যায়।’
পূরব ওকে থামিয়ে দিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আই মিন ওর কেউ নেই?’
‘হুম।’
পূরব কথা শুনে চুপ হয়ে গেলো। এই কথাটা ও মানতে পারছেনা কিছুতেই। তবে কী সেহেরের সঙ্গে ও অন্যায়ই করেছে? চাকরিটা দেওয়া উচিৎ ছিল কী? ওফ..
জিসান বলতে লাগলো, ‘তারপর ওর জায়গা হয় চাচার বাড়িতে। সেখানে ওর চাচী সংসারের সব কাজ করাতো ওকে দিয়ে। খুব টর্চার করতো, তারপরও সেহের নিজের পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছে। বৃত্তির টাকা দিয়ে নিজের কাজ চালিয়েছে। এমনিতে খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। এই হিংসায় ওর চাচী ওর লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে ওকে নিজের কাজের লোক বানিয়ে রাখতে চেয়েছিলো। টাকার লোভে জোর করে এক বয়স্ক লোকের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। ওকে রাজি করানোর জন্য দু’দিন ঘরে বন্দী করে অকথ্য নির্যাতনও চালিয়েছে৷ পরে ওর বান্ধবীরা খবর পেয়ে ওকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। চাচা-চাচীকে পুলিশের ভয় দেখায়। এরপর ওর চাচী সেহেরকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় এবং বলে দেয় যে, ওই সংসারে ওর কখনো জায়গা হবেনা। পারলে ফুটপাতে গিয়ে ঘুমাক, ডাস্টবিনের খাবার কুড়িয়ে খাক, তবু্ও ওর দায়িত্ব ওরা নিবেনা। আত্মসম্মানের জোরে সেহের এক কাপড়ে সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। এখন টিউশনি করেই নিজের খরচ চালাচ্ছে। এজন্যই সেদিন তোর ওখানে কাজ খুঁজতে গিয়েছিলো, কিন্তু সেখানে তুচ্ছ একটা কারণে ওর চাকরিটা তুই দিসনি। এখন এভাবেই খুব কষ্টে ওর দিনকাল চলছে।’
পূরব সেহের সম্বন্ধে এসব শুনে হতভম্ব। এটাও হওয়ার ছিল? আজকালকার দিনে চাকরি করেও যেখানে সংসার চালানো যায়না, সেখানে টিউশনি করে খরচ চালানো? ও মাই গড! তাও আবার একটা ভার্সিটির! খানিক চুপ থেকে বলল, ‘তোকে এসব কে বললো?’
‘ওর বান্ধবী শেফার কাছ থেকে জেনেছি!’
‘ওহহ!’
ভার্সিটি শেষে বাড়ি ফিরছিলো সেহের। গাড়ি ভাড়ার জন্য পর্যাপ্ত টাকা হাতে না থাকায় ঠিক করলো হেঁটেই বাড়ি পৌঁছাবে। কাঠফাটা রোদ্দুরে ছেয়ে আছে রাস্তাঘাট। সূর্যদেবের তপ্ত নিঃশ্বাসে রুক্ষ হয়ে আছে সবকিছু। ঘামে ভেজা কপাল ওড়না দিয়ে মুছে ছাতা মাথায় দিয়ে হেঁটে হেঁটে হাইওয়ে পর্যন্ত পৌঁছে। সেখানে রাস্তা পার হওয়ার সময় দেখলো একটা লোক ওপাশ থেকে রাস্তা পেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে, যেই না রাস্তার মাঝখানে পৌঁছেছে তখনই বিপরীত দিক থেকে দ্রুতগামী একটি ট্রাক চলে এলো। লোকটি তা দেখতে পেলোনা। ঘটনাটি দেখে সেহেরের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। সাত-পাঁচ না ভেবে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লোকটিকে তড়িঘড়ি করে টেনে নিয়ে এলো ফুটপাতে। লোকটি নিজেকে সামলে নিলেও সেহের গিয়ে বারি খেলো গাছের সাথে। হাত-পা ছিলে, পা মচকে গেলো। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো সেহের। লোকটি ওর কাছে গিয়ে মাটি থেকে ওকে তুললো। সেহের চোখে পানি নিয়ে অবাক হয়ে তাকালো লোকটির দিকে। এতো স্বয়ং ইরফান আহমেদ! এতোদিন শুধু টিভিতে দেখছে, আজ সরাসরি! নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না সেহের। পায়ের ব্যথার কথা বেমালুম ভুলে বসে আছে। ইরফান সাহেব ব্যস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথাও লেগেছে তোমার মা? আমি খুবই দুঃখিত!’
সেহের একটু হাসলো। বলল, ‘না স্যার। আমি ঠিক আছি। আপনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আমি এটা বিশ্বাসই করতে পারছিনা!’
‘একথা বলে লজ্জা দিও না মা। আমার খামখেয়ালিপনার জন্য তোমার বড় কোনো ক্ষতি হতে পারতো।’
সেহের মনে মনে বলল, তাহলে তো ভালোই হতো। মরে গেলে আর টেনশন থাকতোনা। বাবা-মায়ের কাছে চলে যেতাম। কারোর বোঝা হতাম না। কেউ আমাকে ছোট নজরে দেখতো না। ভালো থাকতাম তাহলে! কিন্তু মুখে একটা কথাও বললোনা। ইরফান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কোথাও যাচ্ছিলে?’
‘জি। বাসায় ফিরছিলাম।’
‘পড়াশোনা করো?’
‘জি।’
‘কীসে পড়ো?’
‘সেকেন্ড ইয়ারে। সাইকোলজির স্টুডেন্ট আমি।’
‘কোন ভার্সিটির স্টুডেন্ট?’
‘টিউলিপ ইউনিভার্সিটি।’
এভাবে আরও নানা কথাবার্তা হলো ইরফান আহমেদের সাথে। সেহেরের ব্যবহার এবং নমনীয়তা দেখে ইরফান সাহেবের খুব পছন্দ হলো। কত ভদ্র, ভালো একটা মেয়ে। আজ যদি মেয়েটা না থাকতো তাহলে হয়তো এতক্ষণে গাড়ির নিচে পিষ্ট হয়ে পড়ে থাকতো। আজই খুলনা থেকে কাজ সেরে ফিরেছেন তিনি। সাথে গাড়ি, ড্রাইভার আছে। কিন্তু একটা কাজে এখানে নামতে হয়েছিলো ওনাকে। কাজ শেষে রাস্তা
পার হতে গিয়েই দুর্ঘটনার কবলে পড়তে চলেছিলো। ভাগ্যিস মেয়েটা এসেছিলো। সেহেরকে ওনি পানি খেতে দিলেন, মেয়েটাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সেহের ইতস্তত করছিলো। কত বড় একজন মানুষ তিনি, আচার-ব্যবহাত খুবই ভালো। অথচ ওনার ছেলে, ওই পূরব না টূরব নাম! যেন আগুনের গোলা, কিছু বলাই অন্যায়! সেহের ওনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিতে হেলে ইরফাব সাহেব নিজে ওকে বাসায় পৌঁছে দেন। যদিও সেহের সেটা চাচ্ছিলো না। ওকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে ইরফান সাহেব চলে গেলেন গাড়ি নিয়ে। লোকটাকে ভীষণ ভালো লেগেছে ওর।
বাড়ি পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের রান্না সেরে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো সেহের। বিকেলের দিকে ওর রুমমেট সুমা আর শিলা গ্রাম থেকে ফিরে এলো। শিলা এসেই জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমাকে নাকি আজ ব্যবসায়ী ইরফান আহমেদের সাথে দেখা গিয়েছে? বাহ! তুমিতো ভাইরাল হয়ে গিয়েছো!’
সেহের কথাটার মানে বুঝতে পারলোনা। সুমা আর শিলা ওকে একটা ভিডিও দেখালো। সেখানে ইরফান আহমেদেকে এক্সিডেন্ট থেকে বাঁচানোর ক্লিপটা দেখা যাচ্ছে। সেহের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এ আর নতুন কী? বড় বড় মানুষের সাথে এরকম ঘটনা ঘটবে তা তো স্বাভাবিকই। তবুও সেখানে নিজেকে একদমই মানাচ্ছেনা তার। সে তো ভাইরাল হতে চায়নি, একটা মানুষকে বাঁচিয়েছে সে। এটাতো ওর দায়িত্ব! যাইহোক, এ বিষয়টা নিয়ে সেহের আর ভাবলো না। সুমা আর শিলা ওর সাথে আজ খুবই ভালো ব্যবহার করলো। এমনকি রাতে নিজেদের খাবারের ভাগও দিলো। রাতে অনেক গল্প করলো৷ সেহের ভাবলো ওদের কী হয়েছে? হঠাৎ করেই এতো আদর-আপ্যায়ন, স্ট্রেঞ্জ! ওই ভিডিও দেখেই ওদের মন গলে গেলো? হা হা।
রাতের মেঘযুক্ত আকাশ! একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেহের। মনটা আজ বেশ উৎফুল্ল। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ও অনুভব করতে পারলো, এই বিশাল পৃথিবীতে কেউ একা নয় । কারো না কারোর সাথে মানুষের একটা যোগসূত্র থাকে। এই যে, আকাশের সাথে সেহেরের একটা যোগাযোগ আছে। ওর মনের সব অব্যক্ত কথামালা আকাশ জানে। এই বিশাল আকাশটাই ওকে ছুঁতে চাওয়ার প্রেরণা যোগায়, সবাইকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়, আর তা বাস্তবে রূপায়িত করার অনুপ্রেরণা দেয়! ওর সুখ, দুঃখ সবই আকাশের ডাকবাক্সে জমা আছে। তাই আকাশ একাধারে মানুষের দুঃখের সঙ্গী এবং সুখেরও সাথী।
ইরফান সাহেব বাসায় ফেরায় পূরব আজ জমজমাট ডিনারের আয়োজন করেছে। তাঁর বাবার এক্সিডেন্টেত বিষয়টা পুরোটাই শুনেছে এবং ভিডিও দেখেছে। কোনো এক পথচারী হয়তো ঘটনাটা ফোনের ক্যামেরায় রেকর্ড করে নেটে ছড়িয়ে দেয়। সেহেরকে চিনতে ওর একটুও ভুল হয়নি। বরং অবাকই হয়েছে। পূরব ইরফান সাহেবের সাথে খেতে খেতে নানা দরকারি আলাপন সেরে নিলো৷ সেখানে জিসান প্রস্তাব দিলো ওদের কোনো একটা অফিসে বা রেস্টুরেন্টে যদি সেহেরকে চাকরি দেওয়া যায়! ইরফান সাহেব তখনোই রাজি হয়ে গেলেন। মেয়েটি তার জান বাঁচিয়েছে, কিছু একটা করে মেয়েটিকে সাহায্য করতে পারলে ওনারও খুব ভালো লাগবে। ইতোমধ্যে জিসান সেহেরের সম্পর্কে যেসব তথ্য জানে তা জানালো ইরফান সাহেবকে। ওনি বেশ দুঃখই পেলেন। পূরব সেখান থেকে উঠে চলে গেলো। এসব বিষয়ে বারবার আলোচনা ভালো লাগেনা, এসব বড্ড বিরক্তিকর! অসহ্য!
চলবে…ইনশাআল্লাহ!