#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫
সেই মুহূর্তে লজ্জ্বায় সেহেরের গা- হাত-পা কাঁপছিলো। রাগ, জিদ আর লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো সেই সময়টাতে। পাতলা ফিনফিনে কাপড়ের আড়ালে ওর সুগঠিত দেহের অনেক কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। শেফা মাথা নিচু করে শুকনো ওড়না এনে সেহেরেকে ঢেকে দেয়। জিসান বন্ধুর করা এহেন আচরণে প্রচন্ড লজ্জা পেয়েছে, পূরবের কাছ থেকে এমন কোনোকিছুই সে আশা করেনি। বারবার সেহেরকে স্যরি বলে পূরবকে একপ্রকার জোর করে টেনে নিয়ে আসে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আরেকটু পরেই আকাশখানি চাঁদের আলোয় গা ডুবিয়ে বসে থাকবে, গাঢ় আঁধারে ছেয়ে যাবে চারিপাশ।
পূরবের মাথা গরম হয়ে আছে। ওই মেয়েটার প্রতি জিসানের এতো আদিক্ষেতা দেখানোর কোনো মানে হয় নাকি? মেয়েটাকে আরও উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার দরকার ছিলো। যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। আবার তারই বন্ধু ওর প্রতি সিমপ্যাথি দেখাচ্ছে। বিষয়টা ওর মোটেও পছন্দ হলোনা। কোনোমতে বাসায় ফিরলো। একটা হট শাওয়ার নিয়ে ডিনারটা সেরে ইজি চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিলো। খানিক বাদেই জিসান ফ্রেশ হয়ে বেরুলো ওয়াশরুম থেকে। পূরব কোনো কথা বললোনা। ঘুমানোর সময়ও এমন। জিসান বুঝতে পারলো পূরব তাকে ইগনোর করছে। তাই রাগ ভাঙাতে সে ডাকলো পূরবকে।
‘আমাদের রাজপুত্রের মনে কি কেউ আঘাত দিয়েছে? যার জন্য সে তার পরম বন্ধুর সঙ্গেও মত বিনিময় করছেনা?’
পূরব অগ্নিদৃষ্টি ছুঁড়লো জিসানের দিকে। ও মিনমিন করে নিচু স্বরে বলল,
‘এভাবে তাকাইস না ভাই, আমি ভয় পাই।’
‘তুই আমাকে ভয় পাস এটা আমার মানতে হবে?’
‘এভাবে বলিস না বন্ধু!’
‘তোর আজকের বিহেভিয়ার প্রুফ করে দিলো আমি তোর কেউ না।’
‘কী করলাম আমি?’
‘ভুলে গেলি এতো তাড়াতাড়ি?’
জিসান ওর কথার মানেটা বুঝতে পারলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলি, আছিস আর ফিউচারেও থাকবি। তোর সব কাজে আমি তোকে সাপোর্ট করে গেছি। তার মানে এই নয় যে, তুই কোনো ভুল করলে আমি তা ধরিয়ে দেবো না। আমি ওমন বিশ্বাসঘাতক বন্ধু নই৷ সবসময় মেয়েদের প্রতি তোর আলাদা একটা জায়গা দেখতে পেয়েছি। যেটা সম্মানের যোগ্য!’
‘তাতে কী কোনো সন্দেহ আছে?’
জিসান হেসে বললো, ‘একদমই না।’
‘তাহলে হঠাৎ এমন কথা বললি কেন?’
‘বলছি তার কারণ আছে। ওই সেহের নামক মেয়েটা না হয় ভুল করে তোকে দুটো কথা শুনিয়েই দিয়েছিলো, বা অসভ্যতামি ও করেছে। বাট ক্ষমা তো চেয়েছে তাইনা?’
‘এর মানে? তুই কী বলতে চাইছিস?’
‘বুঝেও না বোঝার ভান করিস না!’
‘তো ভনিতা না করে বলে ফেল না।’
‘তোর আজকের আচরণে আমি বেশ লজ্জিত হয়েছি।
পূরব অবাক হয়ে বলল, ‘লজ্জিত হয়েছিস? বাট কেন? এরকম কোনো কাজই আমি করিনি যার কারণে কাউকে লজ্জা পেতে হয়।’
‘বিষয়টা মেয়েলি এবং সেনসেটিভ। তুই ওরকমভাবে পানি ঢেলে একদম ঠিক করিসনি৷ তাছাড়া বেরুনোর সময় মেয়েটার বান্ধবীকে বলতে শুনলাম ওর নাকি অনেক প্রবলেম আছে।’
‘সো হোয়াট?’
জিসান অধৈর্য্য হয়ে বলল, ‘আচ্ছা তুই কী কিছুই বুঝতে পারছিস না? মেয়েটা যখন তোর কাছে মাফ চাইলো তোর উচিৎ ছিল ওকে ক্ষমা করে দেওয়া৷ তা না করে উলটো আরেক কান্ড ঘটালি। সেদিন রাতে জানালায় এভাবে ঢিল ছুঁড়াছুঁড়ি করাটাও ঠিক হয়নি। আর নিজের বিবেককেই একবার প্রশ্ন করে দেখ না। তোর মতো একজন মানুষের কী এই কাজগুলো করা মানায়? যেখানে সবার সাহায্যে নিজে থেকে এগিয়ে আসিস ; সেখানে তুই নিজেই অন্যের সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছিস!’
জিসানের বলা প্রতিটি সত্য কথা পূরবের মনে গভীর দাগ কাটলো। চিন্তায় ফেলে দিলো। পূরব নিজেও এবার নিজের প্রতি বিরক্ত হলো। ক্ষমা চেয়েছিলো যখন মাফ করে দেওয়াটাই উত্তম ছিলো। কতশত মানুষই তো ওকে কটুক্তি করে, মানবসেবার কাজ করার জন্য। কই ও তো এমন বাচ্চাদের মতো আচরণ করেনি৷ সেলিব্রেটিদের হেটার্স যেমন থাকে, লাভার্স ও তেমন থাকে। ধরে নেওয়া যাক সেহের তার হেটার্স, তাই বলে ওর সাথে ওরকম আচরণ করাটা ঠিক হয়নি। আজকাল ও বড্ড অসচেতন হয়ে গিয়েছে। রাগ জিনিসটা সর্বদাই ওর শত্রু! কেন যে এতো রাগ ওর বুঝতে পারেনা। বংশগত বৈশিষ্ট্য বোধহয় একেই বলে, কারণ ওর দাদা নাকি ভীষণ রাগী ছিলেন। গ্রামের লোকেরা ওনার ভয়ে কাঁপতো! যাইহোক, সামান্য বিষয়টাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আকাশসমান করে তুলছে। পূরব ঠান্ডা মাথায় পুরো ঘটনাটাকে সাজালো, বোঝার চেষ্টা করলো। আচ্ছা পূরব তুমি কী মানসিকভাবে সিক?? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো। জিসানের কোনো কথার জবাব না দিয়ে বেডে শুয়ে পড়লো। আর তারপরই ওর মানসপটে ভেসে উঠলো সেহেরের কান্নারত মুখটা। মেয়েটা খুব বেশি ফর্সা নয়। গায়ের রঙ তামাটে, চুলগুলো কোমড় অবধি লম্বা, চোখগুলো ভীষণ সুন্দর, উচ্চতায় খুব বেশি লম্বাও নয়। এমনিতে পুতুল পুতুল চেহারা৷ তবে স্বভাবে বোঝা যায় মেয়েটা চঞ্চল ; কিন্তু কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছে।
এসব ভেবে ও নিজেই অবাক হচ্ছে। এই প্রথম কোনো মেয়েকে নিয়ে এতো ভাবছে। মেয়েটার সাথে বিভিন্ন কারণে, ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় কাকতালীয়ভাবে পাঁচবার দেখা হয়েছে মাত্র। এর আগে কতশত মেয়ে ওর সাথে কাজ করেছে, প্রপোজ করেছে আরও নানা কিছু করেছে কিন্তু ও অতোটা ভাবেনি তাঁদের নিয়ে, যতোটা এই সেহেরকে নিয়ে ভেবেছে। অতি নগন্য কারণগুলোকেই ও বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। আর ফলাফলসরুপ ওকে এসব বিশ্রি ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
রাতের বেশিরভাগ সময়ই কেটে গেলো সেহেরের কথা ভাবতে ভাবতে। একসময় চোখ লেগে এলো তার। ঘুমের মধ্যে কেঁপে উঠলো কয়েকবার। শান্তিতে ঘুমাতে পারলোনা একটুও। বারবার মনে হতে লাগলো ইফরাজ পূরবকে এসব আচরণে মানায় না, সে তো সবার বন্ধু! তার আলাদা একটা জায়গা আছে মানুষের হৃদয়ে। সে কী করে এমন করতে পারে! শিট…
সকালে ঘুম ভাঙার পরে পূরব জিসানকে সেহেরের সম্বন্ধে খোঁজ নিতে বললো। সব ইনফরমেশন জোগাড় করে ওকে জানাতে বললো। জিসান বেশ অবাক হলেও পূরবকে আর ঘাঁটালো না। পূরব ওর কালো রঙের ফেডোরা হ্যাটটি মাথায় চাপিয়ে জিসানকে নিয়ে রওয়ানা দিলো অফিসের উদ্দেশ্যে। এবার বেশ বড় একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছে ওরা। সেটা ভালোভাবে শেষ করতে পারলে ওর রেস্টুরেন্টের ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠবে! লভ্যাংশের টাকাটা দিয়ে একটা বৃদ্ধাশ্রম খুলবে ভাবছে। এ নিয়ে পূরবের বাবা ইরফান আহমেদের প্রাথমিক আলাপচারিতাও ইতোমধ্যে শেষ।
কাল ওরকম একটা ঘটনার পর রাতে সেহেরের বেশ জ্বর উঠেছিলো। শেফা আর রিমি না থাকলে মরেই পড়ে থাকতো বোধহয়, কেউ খোঁজ নিতে আসতোনা। সকালবেলা ঘুম ভাঙার পরে নিজেই সব নাস্তা তৈরি করলো। গমের রুটি আর ডালভাজি। শেফা আর রিমি ঘুম থেকে ওঠে ওর পাকনামি দেখে অনেকক্ষণ ধমকালো। অসুস্থ শরীর নিয়ে এসব করার মানে হয়? সেহেরের সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। যাইহোক, তিন বান্ধবী মিলে ব্রেকফাস্ট শেষে একসাথেই ভার্সিটিতে রওয়ানা দিলো। কালকের ঘটনাটা ভুলে থাকার জন্য সেহের আপ্রাণ চেষ্টা করলো। বাড়ি বয়ে এসে এমন কান্ড..ছিঃ! পূরবের প্রতি ওর ভীষণ ঘৃণা হলো।
এরপর অনেকদিন ওর সাথে পূরবের দেখা হলোনা। সেহেরও ঘটনাটা বেমালুম ভুলে গেলো। নিজের মতোই দিন কাটতে লাগলো। কয়েকটা টিউশন যোগাড় করে বাড়িভাড়া আর পড়াশোনার খরচ চালানোর ব্যবস্থা করলো। যদিও মাস শেষে হাত পুরো খালি হয়ে যায়, তখন গলির দোকান থেকে বাকিতে চাল-ডাল কিনতে হয়। কী করবে, ওর খরচ চালানোর মতো তো কেউ নেই এই ব্রহ্মান্ডে! বাবা-মা হারা এতিম মেয়েদের কারো সংসারে বুঝি জায়গা হতে নেই। তাইতো চাচার সংসারে ওর জায়গা হয়নি! কিন্তু আজকাল টের পায় কেউ ওকে ফলো করছে, ওকে দেখছে সারাক্ষণ! এই নিয়ে ভীষণ চিন্তায় আছে সেহের!
এই এতোগুলো দিন খুব ব্যস্ততায় কেটেছে পূরবের। সেহেরের কথা প্রায় ভুলেই বসেছিলো। কিন্তু জিসান মনে করিয়ে দিলো ওর কথা। একটা কাজে সিলেট গিয়েছিলো জিসান। সেখান থেকে ফিরে সোজা চলে এলো পূরবদের বাড়ি। এই বাড়িটাতে পূরব আর ওর বাবা ছাড়া আর কেউ থাকেনা, জিসানও থাকে ওদের সাথে। ইরফান আহমেদ ব্যবসার কাজে এতোটাই ব্যস্ত যে বাড়িতে থাকার সুযোগই পান না। আর পূরবের মা এক বছর হলো পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। যাইহোক, জিসান লোক লাগিয়ে খোঁজ নিয়েছে সেহেরের। সে বিষয়ে কথা বলতেই এখন এসেছে পূরবের কাছে।
________
চলবে…ইনশাআল্লাহ