#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১
দরজার পেছনে একটা লোকের সাথে লেপ্টে আছে সেহের। ওর কোমড় ধরে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে। যে-কেউ দেখলে খারাপ ধারণা করবে। কিন্তু লোকটার এতে কোনো হেলদোল নেই। তার গরম নিঃশ্বাস সেহেরের চোখেমুখে পড়ছে, হাতদুটো অবাধ বিচরণ করছে ওর কোমড়ে। সেহেরের ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। বাধ্য হয়ে লোকটার পায়ে পাড়া দিয়ে সরে দাঁড়াতে গেলেই লোকটা আবার তার কোমড় চেপে ধরে বুকের সাথে লেপ্টে ধরে। ধমকের সুরে কানে কানে ফিসফিস করে বলল, ‘এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকো। একদম নড়াচড়া করার চেষ্টা করবেনা।’
সেহের ধমক শুনে ঢোক গিললো। কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে থাকো মানে কী? ও কী লোকটার নিজস্ব সম্পত্তি? একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের উপর নিজের নির্দেশ চাপিয়ে দিতে চাইছে। লোকটা তো মহা বেয়াদব! সেহের প্রচন্ড রাগ নিয়ে এবার বলে উঠলো, ‘আমাকে এভাবে ধরে রাখার মানেটা কী? আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড বা বউ নই। ছাড়ুন আমায়।’
লোকটার মাথায় একটা কালো রঙের বড় হ্যাট। সেটা একচোখ আড়াল করে কোনাকুনি উঠে যাওয়ায় দেখতে অদ্ভুত লাগছে। চোখে দামী সানগ্লাস। পোশাক-পরিচ্ছদও পরিপাটি। নিশ্চয়ই কোনো বড়লোক ঘরের ছেলে হবে! সেহেরের কথা শুনে রাগে তার নাক লাল টকটকে হয়ে গেছে। গলার স্বর নামিয়ে বলল, ‘এতবেশি কথা না বলে মুখটা বন্ধ রাখো।’
‘আপনি ছাড়ুন আমায়। আমি কিন্তু এবার চিৎকার করবো…’
‘চিৎকার করে দেখো তোমার কী অবস্থা করি।’
সেহের খানিকটা ভয় নিয়েই জিজ্ঞেস করলো, ‘কে আপনি? আর আমার সঙ্গে এমন অসভ্যের মতো আচরণ করছেন কেন?’
‘আমি কে সেটা তোমার না জানলেও চলবে।’
‘তাহলে আমাকে ছেড়ে দিন, আমার প্রচুর কাজ আছে।’
লোকটা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোমার কাজ পরে করে নিও।’
‘পারবোনা। আমার ইমিডিয়েটলি যেতে হবে। তাছাড়া বাইরে কিছুক্ষণ পরই বৃষ্টি নামবে।’
‘উফ…শিট! একটু আস্তে কথা বলো।’
সেহের চুপ হয়ে গেলো। অনেক মানুষের কোলাহল ভেসে আসছে। এটা একটা রেস্টুরেন্ট। এরকম হতেই পারে, কিন্তু এতো লোকের গলা শোনা যাচ্ছে যেন কোনো নামীদামী লোক এখানে এসেছে আর তার ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য মিডিয়ার লোকেরা ভিড় জমিয়েছে। যেমনটা কোনো সেলিব্রেটি এলে হয়! কিন্তু কোথাও তো এরকম গণমান্য ব্যক্তিবর্গ দেখা যাচ্ছেনা। তাহলে? যাইহোক, এই লোকের সমস্যাটা কী? সেহেরকে কেন এখানে আটকে রেখেছে, তাও কেমন চোরের মতো! সেহের কিছু একটা চিন্তা করে এবার তীক্ষ্ণ কন্ঠে হ্যাট পরা লোকটার দিকে তাকালো। লোকটা ভ্রু দুটো নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে?’
‘আপনি কী চোর?’
নিচু গলায় চিৎকার করে লোকটা বলল,
‘হোয়াট?’
‘আপনি চোরের মতো লুকিয়ে আছেন কেন? আর আপনি চোর-ডাকাত যা-ই হোন না কেন আমাকে এভাবে এখানে নিয়ে এসেছেন কেন? বিলিভ মি, আমি ভদ্র পোশাক পরে কখনো কাউকে চুরিটুরি করতে দেখিনি।’
লোকটা কপট রাগ নিয়ে বলল, ‘আমাকে দেখে চোর মনে হচ্ছে?’
‘হতেই পারে। বাইরে দেখছেন না কত লোকজন জড়ো হয়েছে? বাংলাদেশে এতো মানুষ কখন জমা হয় জানেন? যখন কোনো চোর-ডাকাত ধরা পড়ে তখন!’
লোকটা সেহেরকে ছেড়ে দিয়ে ঠিক করে দাঁড়ালো। সেহের এতোক্ষণ পর ছাড়া পেয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিলো। ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে কপালের ঘামটুকু মুছে নিয়ে দরজার পেছন থেকে বেরুতে গেলে একটা শক্ত-সামর্থ্য হাত ওকে টেনে ধরে। সেহের বিরক্ত হয়ে পেছনে ফিরে জিজ্ঞেস করলো, ‘সমস্যা কী চোরমশাই? মেয়েদের গায়ে হাত দিতে বুঝি অনেক ভালো লাগে?’
লোকটা ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘এখন যাওয়ার পার্মিশন তো আমি দিইনি!’
‘আপনার পার্মিশনে আমাকে চলতে হবে? ও মাই গড! কে আপনি ভাই? কোন মন্ত্রীর ছেলে?’
‘সেটা না হয় পরে জেনে নিও। আপাতত এখান থেকে বেরুনোর কথা ভুলে যাও।’
সেহেরের ইচ্ছে করছে এই ছেলের কানের মাঝে দুটো থাপ্পড় দিয়ে সিঁধে করে দিতে। একে তো চুরি, তার উপর সিনাজুড়ি! আবার ওর উপর আদেশ জারি করছে! এই রাতে কোন কুক্ষণে যে রেস্টুরেন্টে কাজের খোঁজে এসেছিলো তা ভেবেই নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। কাজের কাজ কিছুই তো হলোনা বরং আরো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লো। মনটা এমনিতেই বেশ খারাপ হয়ে আছে। হাজারো টেনশনের মধ্যে এখন আবার এই উটকো ঝামেলা। চোখেমুখে রাজ্যের ক্লান্তি। দাঁতে দাঁত চেপে এবার বলে উঠলো, ‘আপনি আমাকে এখান থেকে যেতে দিন। নইলে আমি এক্ষুনি বাইরে গিয়ে সবাইকে বলে দিচ্ছি চোর এখানে লুকিয়েছে আর আমার সাথে অসভ্যতামি করেছে! তখন মজা টের পাবেন মিস্টার চোরমশাই।’
‘স্টপ ইট..’
বলেই সেহেরের মুখ চেপে ধরলো লোকটা। ও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। ঘটনাটি বুঝতে ওর বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। যখন মাথায় এলো তখন নিজেকে ছাড়ানোর জন্য লোকটার হাতে কামড় দিয়ে বসলো। রক্তচক্ষু নিয়ে হ্যাট পরা লোকটা ওর দিকে তাকাতেই ভয়ে চুপসে গেলো। কিন্তু লোকটা নিজের হাত সরালোনা। মিনিট খানেক পর লোকটা বাঁ হাতে পকেট থেকে ফোন বের করে কাকে যেন কল করলো।
‘হেই জিসান, ওরা চলে গিয়েছে?’
ওপাশ থেকে জিসান নামক কেউ একজন বলল, ‘অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বের করেছি। তুই এখন বেরিয়ে আসতে পারিস।’
‘ওকে। থ্যাংকস তোকে সবটা হ্যান্ডেল করার জন্য।’
‘এসব ফর্মালিটি করার কোনো প্রয়োজন নেই। তুই কোথায়?’
‘এসে বলছি। তুই সেকেন্ড ফ্লোরে ওয়েট কর।’
‘ওকে আয়।’
ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে হ্যাট পরা লোকটা শান্তির নিঃশ্বাস ফেললো। সেহেরকে ছেড়ে দিয়ে ক্ষিপ্ত গলায় বলল, ‘আমার সাথে যে বাজে বিহেভিয়ারটা তুমি করলে এটার জন্য এখন তোমাকে কিছু বললাম না, তাই বলে ভেবোনা আমি এই ব্যাপারটা ভুলে গিয়ে তোমায় ক্ষমা করে দিয়েছি। আবার কখনো দেখা হলে এর শোধ আমি নিয়েই ছাড়বো।’
সেহেরও এবার রেগে গেলো। ওর সাথে বাজে ব্যবহার করে আবার ওকেই কথা শোনানো হচ্ছে? ও বিগলিত কন্ঠে বলল, চোরের মায়ের বড় গলা!’
‘স্টুপিড! কে, কে চোর?’
‘এই যে আমার সামনে ভদ্র পোশাকে দাঁড়িয়ে থাকা অভদ্র একটা মানবসন্তান। যার নূন্যতম বিবেকবুদ্ধি নেই!’
‘আমার বিবেকবুদ্ধি নেই কী আছে সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেব সময়মতো! বাট একটা থ্যাংকস তোমার প্রাপ্য।’
সেহের আচমকা অবাক হয়ে হ্যাট পরা লোকটির দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো, ‘থ্যাংকস কেন?’
‘তোমার জন্য আজ বেঁচে গেলাম।’
সেহের ভাব নিয়ে বলল, ‘থাক থাক। একটা চোরকে বাঁচিয়ে আমি কোনো নেকী লাভ করিনি। লোকগুলোর হাতে তুলে দিলেই ভালো ছিলো। একেবারে পিটিয়ে পিঠের ছালচামড়া তুলে দিতো। আর কোনো মেয়ের সাথে এরকম চিপকে দাঁড়িয়ে থাকার সাধ সুদে-আসলে মিটিয়ে দিতো।’
লোকটা নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের রাগ সামাল দিলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, ‘বাই দ্যা ওয়ে, তুমি এতো রাতে রেস্টুরেন্টে কীজন্য এসেছিলে?’
‘আপনাকে বলবো কেন?’
‘না শোনার ইচ্ছে হলো আরকি!’
‘কাজ খুঁজছিলাম। এটা তো নতুন খুলেছে তাই ভাবলাম ছোটখাটো একটা কাজ পেলেও পেতে পারি। কিন্তু আজ নাকি ইন্টারভিউ নেওয়া হবেনা, সময় শেষ। তাই পরশু আসতে বললো।’
লোকটা মুচকি হেসে বলল, ‘ওহ তাই বলো।’
‘তো চোরমশাই আমি এবার আসছি।’
লোকটা উত্তর দিলোনা। সেহের বেরিয়ে এলো করিডোরের বাঁ দিকের দরজার আড়াল থেকে। প্রচন্ড রাগ নিয়ে হ্যাট পরা লোকটা সেহেরের চলে যাওয়া দেখলো। অতঃপর নিজেও বেরিয়ে এলো। পেছনের সিঁড়ি বেয়ে একেবারে বাগানের কাছে চলে এলো। সেলফোন বের করে ফোন লাগালো জিসান নামক কাউকে।
রাত সাড়ে আটটা। সেহের আলিশান রেস্টুরেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা ভাবছে। রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারের সাথে ইন্টারভিউয়ের বিষয়ে কথা বলে তিনতলার রিসেপশন থেকে নামার সময়ই মানুষের শোরগোল শুনতে পায়। সামনে এগুনোর জন্য পা বাড়াতেই কোথা থেকে আসা হ্যাট পরা লোকটার সাথে ওর ধাক্কা লাগে। শব্দ শুনে এদিকে লোকজন এগিয়ে আসতে নিলেই ওকে নিয়ে একপ্রকার জোর করে দরজার আড়ালে লুকিয়ে পরে লোকটা। কিন্তু এরকম করার মানে কী? গার্ড থেকে জানতে পারলো রেস্টুরেন্টে কোনো চুরিটুরি হয়নি। কোনো একজন সেলিব্রিটি আসায় মিডিয়ার লোকেরা হামলে পড়েছিলো। গার্ডরাও জানেনা সে কে? নিশ্চয়ই বড় কেউ হবে, নইলে কি এতো লোক ভিড় জমাতো!
চলবে।