প্রিয় অসুখ – Sazia Afrin Sapna

0
537

#গল্পপোকা_চিঠি_প্রতিযোগিতা_২০২০

প্রিয় অসুখ

তুমি আমার আসবে বলেও না আসা অসুখ। তুমি আমার ছুঁয়ে দিয়ে কেড়ে নেয়া কাঙ্ক্ষিত সুখ। তুমি আমার যতটা না সুখ, তারচেয়েও বড় অসুখ।
কর্ণধারহীন সিন্ধুতে লক্ষ‍্যহীন তরণীর মতো একটা ডুবন্ত জীবনে বিফল প্রেমের বীজ বপন করেছিলাম জীবনের মধ‍্যপ্রহরে। লক্ষ‍্যহীন স্রোতে ভেসেও চোখ বন্ধ করে আমার না হওয়া সংসার সাজিয়েছি মনের মাধুরি ঢেলে, যেখানে তুমি ছিলে কেন্দ্রবিন্দু হয়ে। বুকের মাঝ বরাবর তীক্ষ্ণ বিশ্বাস ছিল তোমার প্রতি, সাগরের অবাধ‍্য ঢেউয়ের মতো তুমি ভালোবাসায় ভেঙে ভেঙে পড়বে আমার হৃদয়ের কিনারায়। আমার সারাজীবনের ভালোবাসার শূন‍্যতা ভরিয়ে দেবে ভরাকটালের জোয়ার হয়ে। কস্মিনকালেও ভাটা আসবে না আমার জীবনে। আমরা ভালোবাসার নির্যাসে সাজাবো জীবন। সারা পৃথিবী বিমুখ হলেও তুমি স্বর্ণলতার মতো থাকবে আমাকে আঁকড়ে ধরে। সারা জগত আমাকে তাচ্ছিল‍্য তিরস্কার করলেও তুমি আমাকে গাঢ় আলিঙ্গনে আগলে রাখবে। এই সুতীব্র বিশ্বাসে আমি যে মনে মনে কতটা অহংকারী ছিলাম তা কেউ জানত না। একে অপরের নামে করা শপথ, “কেউ কাউকে ছেড়ে যাব না কখনও।” এই অঙ্গিকার যেন আমাকে অধিক শক্তিশালী আর সাহসী করেছিল।
মনমন্দিরে তুমি ছিলে প্রণয় দেবতা। আমি ছিলাম তোমার পূজারী। তোমায় ভালোবেসে হেমলক পান করা কঠিন কিছু ছিল না। সবটুকু উজাড় করে ঢেলে তোমার অর্চনায় অসংজ্ঞায়িত অনুভূতির ইন্দ্রজালে আমি বিভোর ছিলাম। তুমিই ছিলে আমার পথের শেষ সীমানা, তার ওপারে আর কিচ্ছু নেই। অথচ বাস্তবিক ভাবে আমার কোনো পথই ছিল না। আমি ছিলাম অকূল সাগরের ভাসমান শেওলার মতো এক যাযাবর। এই কথাটা ভুলিয়ে দিয়েছিল তমসায় আচ্ছন্ন আমার ভয়াবহ আকাঙ্ক্ষা। যে আকাঙ্ক্ষার অলৌকিক আবেশে আমি প্রেমময়ী এক প্রেমের দেবী আফ্রিদির মতো শুধু প্রেম নিঃসরণেই বিভোর ছিলাম।

ভালোবাসা মানেই তো লাল নীল হলুদ রঙা স্বপন। আর বিচ্ছেদ মানে সব স্বপনের মরণ।
দিনে দিনে সবকিছুরই রং বদলায়, বদলে যায় ভালোবাসার রং, অনুভূতির রং। সেই রং বদলে আবেগের ঘন কুহেলি সরে স্পষ্ট হয় বাস্তবতা। সুস্পষ্ট ভাবে তমসা সরে সমুখে এলো অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। কাছের মানুষগুলো ছিল আমার প্রতি খুব উদাসীন। জীবনের একটা মোড় ঘুরলেই খাবো কী তা জানতাম না, মাথা গুজার ঠাঁইও থাকবে না। কত শত চিন্তার বোঝা ছিল আমার মাথায়, যা তোমার প্রতি প্রলয়ঙ্কারী প্রণয়ের আবেশে দীর্ঘকাল আচ্ছন্ন ছিল। রং বদলেও সেসব নতুন করে চাপা দিয়ে তোমার সাথে হাসির তরঙ্গ তুলেছি, স্বপ্নের আলিঙ্গনে ঘর বাঁধার স্বপন বুনেছি, বারংবার তোমার প্রেমেই পড়েছি। অনুভূতির মিছিলে তোমায় আঁকড়ে রাখতে চেয়েছি। শব্দের বাঁধনে বাঁধতে চেয়েছি একান্ত নিজের করে।
আমার স্বল্প চাওয়া পাওয়ার তালিকাটা ছিল অতি ক্ষুদ্র। ছোট্ট জীবনের চাওয়া পাওয়ার দ্বিধাদ্বন্দ্বে শুধু তোমাকেই চেয়েছি, তোমার ভালোবাসা চেয়েছি। পুরোনো ঘ্রাণে আমার প্রতি তোমার নিরাকর্ষণে দিনে দিনে চাওয়া পাওয়ার তালিকা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে গেল। চাওয়া পাওয়ার ক্ষুদ্র পরিসরে শেষ প্রত‍্যাশাটাও ধরে রাখতে অক্ষম হলাম। হায়রে জীবন! সংসারের স্বপ্নও একদিন বিসর্জন দিলাম। এরপর অবশিষ্ট আর কিছুই রইল না। সেই আমাদের একসাথে করা শপথ কালের গহ্বরে বিলিন হয়ে গেল। তারপর, জয়ী হলো বুনো ক্রোধ আর হেরে গেল ভালোবাসা, বিসর্জিত হয়ে গেল সম্পর্ক।

ভাগ‍্যের বিড়ম্বনায় তোমায় পাওয়া হয়ে ওঠেনি। জীবনের সেই মধ‍্যপ্রহরেও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেয়েছিলাম। তারপর থেকে প্রাণহীন আমিটা নিশ্চল পাথরের মতো হয়ে গেলাম। আমার বেঁচে থাকাটা বেঁচে থাকাই ছিল না। যে বেঁচে থাকায় তুমি পাশে নেই, সেই বেঁচে থাকা কী করে বেঁচে থাকা হয় বলো? কিন্তু সব প্রাণীর ভেতরেই বেঁচে থাকার আকুলতা থাকে। তোমার মুখের একটু কথা শোনার জন‍্য অব‍্যক্ত আকুতিতে তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো ছটফট করেও আনুতাপ আত্মগ্লানি আর অভিমানের জমাট দেয়ালে থমকে গিয়েছি। তোমার জন‍্য অপেক্ষমান হৃদযন্ত্রে বেজে উঠেছে মন্দিরের ঘন্টার মতো কাতর রুগ্ন রাগীনি। আমার শ্বাসপ্রশ্বাস রক্তবিন্দু শিরা উপশিরা হৃদপিন্ড আমাকে নিস্তার দেয়নি। সারাজীবনের সঞ্চিত সব ভালোবাসা অবাধ‍্য হয়ে তোমার দিকে তীরের মতো বর্ষিত হতে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। অবাধ‍্য সেই ভালোবাসার বিদ্রোহকে সামলাতে আমাকে আরও ভয়ানক কঠোর বিদ্রোহী হতে হয়েছিল। একটা অলিখিত উপন‍্যাসের আবর্তনে লুকিয়ে ছিল সহস্রব‍্যাথার ব‍্যঞ্জন, যা সবার অগোচরেই থেকে গেছে। নয়নও চৌকাঠে তোমার নামে মহাসাগর রচনা করেছি। কেউ কখনও দেখেনি বেহিসেবী কান্নার অশ্রুস্রোতে থৈ থৈ করা সেই এক চিলতে উঠোন।

একজীবনে আমার না হওয়া সংসারটা আমাকে খুব করে দগ্ধে দগ্ধে ঝলসাতো। বেদনার ঘূর্ণিপাকে হাহাকার আর আক্ষেপে আমি রোজ মরে গেছি আবার জীবিত হয়েছি পরেরদিন মরব বলে। জীবিত হওয়া আর মরে যাবার খেলার মানে বুঝো তুমি? মাঝরাতে পাশ ফিরতে গিয়ে ঘুম ভেঙে যাবার পরে আর ঘুম না আসার মানে বুঝো তুমি? জানি বুঝো না, বুঝবার কথাও না। তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেখার আকুতিতে অন্তর্দহন আমাকে গ্রাস করেছে। সবাই বলে, দিনে দিনে ক্ষত শুকায় অথচ আমার বুকের কোণে ক্ষত বেড়েছে দিনে দিনে। তোমার বুকে মুখ লুকিয়ে হয়নি তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেখা। শূন্য জীবনের শূন্য খাতায় শূন্য এই অন্তঃকরণে রয়ে গেছে শুধু শূন‍্যতার এক বিশাল সুড়ঙ্গ। বিধাতার কাছে কত হিসেব নিকেস রয়ে গেছে অথচ আমার বিদায় ঘন্টা বাজতে চলেছে। আমি তোমার পথ চেয়ে জীবনের সব সময় পার করে দিয়েছি। তুমি আসোনি প্রিয় অসুখ, তবে প্রাণঘাতী অসুখ ঠিকই এসেছে আমাকে নিতে। এতদিনে আমি আমার নিজের বাড়িতে যেতে চলেছি। আদৌ কী ওটা আমার নিজের বাড়ি হবে? নারীদের কোনো নিজের বাড়ি থাকে না। এরা বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়িতে যায় তারপর বাকী জীবন কাটায় ছেলের বাড়িতে। অবশেষে চলে যায় আল্লাহর বাড়িতে। আর যারা আমার মতো সৌভাগ‍্য নিয়ে পৃথিবীতে পুড়তে আসে তাদের মরণের আগে বিশেষ একটা বাড়ি থাকে। যার নাম বৃদ্ধাশ্রম। যাযাবর এই জীবনে আমার যে নিজের একটা ঘর হলো না, সংসার হলো না। বিধাতা আমার এই প্রাপ্তির হিসেব কেন দিলেন না তা বলতে পারো?

সব শেষ হবার পরেও প্রিয় অসুখ তোমাকে খুব করে চেয়েছিলাম। পাজরের ভেতরে লুকিয়ে রেখে অনুভব করতে চেয়েছিলাম। ঘুমের ঘোরে অচেতনতায় পাশ ফিরে তোমাকেই চেয়েছিলাম। দিন শেষে তোমার সুবিশাল লোমশ ভরসার বুকটা চেয়েছিলাম। যেখানে কোনো এককালে আমার ঘরবসতি ছিল, ছিল একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়। যে বুকে মাথা রেখে ব‍্যর্থতার সব গল্প করা যায়। ভালোবাসা শূন‍্যতায় রুগ্ন হৃদয়ে আমার হাতের তালুতে তোমার অধরের ছোঁয়া চেয়েছিলাম। আমি তোমাকে চেয়েছিলাম প্রিয় অসুখ, বারংবার ঘুরেফিরে শুধু তোমাকেই চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম, সুখের চেয়েও বড় অসুখ হয়ে বসতি গড়ো আমার পাজরে, মিশিয়ে দাও তোমার নির্যাস আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আমি তরুণী থেকে বৃদ্ধা হয়ে গেলাম কিন্তু তুমি আসবে বলেও এলে না প্রিয় অসুখ। তুমি একবার আসিও, আমার মৃত‍্যুর পরে নিশ্চল এই আমিটাকে ময়নাতদন্ত করে দেখিও। নিশ্চিত আমার অন্তর্দেশে দেখতে পাবে, সব স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েও মনের কোণে একটা অলিখিত চাওয়া আজও রয়ে গেছে, “তুমি, আমি, ছোট্ট একটা ঘর আর ঘরভরা ভালোবাসা।”

ইতি-
রাধিকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে