#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-২৭|
“রুহানি,চলো বিয়ে করে ফেলি। বিয়ে আমাদের সব সমস্যার সমাধান।”
রুহানি ফালাকের কথা শুনে চমকে উঠল। ধীরে ধীরে ফালাকের মুখের দিকে তাকাল। ফালাককে দেখে মনে হচ্ছে না মজা করছে। ওর মুখ দেখেই মনে হচ্ছে সিরিয়াস মুডে আছে।
রুহানি আমতা আমতা করে বলল,
“কি বলছো?”
রুহানি সরে যেতে চাইলে ফালাক ওর দুবাহু চেপে ধরে বলল,
“বিয়ের কথা শুনে ভয় পাচ্ছো কেন? বিয়ে করতে চাও না আমাকে হাহ?”
রুহানি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। তারপর নিচু সুরে বলল,
“অবশ্যই চাই, কিন্তু সিচুয়েশন তো দেখছো। হুট করে বিয়ে করা যায় না-কি?”
ফালাক হালকা হাসল। হেসে বলল,
“সিচুয়েশনের দিকে চেয়ে থাকলে এ জীবনে আর বিয়ে করা হবে না। তোমার ফ্যামিলি আমাকে যে ট্রাপে ফাসিয়েছে তাতে তো নয়ই।”
রুহানি ফালাকের কথা শুনে ক্ষেপে গিয়ে বলল,
“আমার ফ্যামিলি ট্রাপ কষেছে? কি করেছে আমার ফ্যামিলি?”
“তোমার মা আমাকে সাতদিনের সময় দেয়নি? সাত দিন! সিরিয়াসলি? সাত দিন কি যথেষ্ট ছিল? উনারা জানেন না আমার বাড়ির আবহাওয়া কেমন? জাস্ট দেখানোর জন্য আমাকে সাতদিনের সময় দিয়েছে। মন থেকে চাইছেন আহিলের সাথে বিয়ে দিতে।”
রুহানি রেগেমেগে বলল,
“তোমার মা-ও তো রাজি হচ্ছে না। সেটা তোমার চোখে পড়ছে না? ”
ফালাক শক্ত কন্ঠে বলল,
“তোমার ফ্যামিলি আমার ফ্যামিলি কেউ চাইছে না আমাদের সম্পর্কটা থাকুক। আর আমি এই সম্পর্ক রাখার জন্য, একটা নাম দেওয়ার জন্য সব করতে পারি।”
রুহানি ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
“কি করতে চাইছো তুমি?”
ফালাক রুহানির চোখে চোখ রেখে বলল,
“যদি বলি অলরেডি চাওয়া পূরণ করে ফেলেছি।”
রুহানি বুঝতে পারছে না কোন চাওয়া, কখন, কিভাবে পূরণ করেছে। কিছুই না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল,
“কিসের চাওয়া? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
ফালাক রুহানিকে ছেড়ে দিয়ে অন্য দিকে ঘুরে গেল। নিজের চুলে হাত বুলিয়ে রুহানির দিকে ঘুরে বলল,
“তোমাকে আজ বউ সাজালাম কেন? কেন বউ সাজে দেখতে চাইলাম? নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে।”
রুহানি সেটাও জানে না কেন? তাই প্রশ্ন করল,
“কেন?”
ফালাক রুহানির একদম কাছে এসে দাঁড়াল।
তারপর চোখে চোখ রেখে বলল,
“আমি তোমাকে বিয়ে করে ফেলেছি। তুমি আইননুসারে আমার স্ত্রী।”
রুহানি কপাল কুঁচকে বিস্ময় নিয়ে বলল,
“কিহ!”
ফালাক উচ্চস্বরে বলল,
“হ্যাঁ। বিয়ে করেছি আমি তোমাকে।”
রুহানি দু’পা পিছিয়ে বলল,
“মজা করছো তাই না?”
“তোমার কি মনে হচ্ছে আমি মজা করার মুডে আছি? আমি সিরিয়াস, আমি তোমাকে বিয়ে করে ফেলেছি। তুমি চাইলে প্রুভও দেখাতে পারি।”
রুহানি অবাকের উপর অবাক হয়ে যাচ্ছে। ফালাক কি বলছে আদৌও ওর মাথায় ঢুকছে না।
“কিসের প্রুভ? আর আমি বিয়ে করেছি আমিই জানি না? ফাজলামো করছো আমার সাথে?”
ফালাক সোজাসাপটা বলতে পারছে না। থেমে থেমে বলল,
“বিয়েটা তোমার অজান্তেই হয়েছে। আমি সেদিন কিছু পেপারে তোমার সাইন লাগবে বলে কাবিননামায় তোমার সাইন করিয়ে নিয়েছি।”
রুহানির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। চোখে পানি এসে পড়েছে। ফালাকের কলার চেপে ধরে বলল,
“বুঝতে পারছো কি বলছো তুমি? তুমি মিথ্যা বলছো তাই না? আমার সাথে তুমি কখনো এমন করতে পারো না। কিছুতেই আমাকে ধোঁকা দিয়ে বিয়ে করতে পারো না। আমি বিশ্বাস করি না।”
ফালাক নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আমি এটাই করেছি। আর আমি ভুল কিছু করিনি। তোমাকে বলেছি না তোমার এতটা কাছে আমি কাউকে সহ্য করব না? তাই তোমাকে নিজের করে নিয়েছি। আমি কিচ্ছু ভুল করিনি। যা আমার আমি তাই অধিকার করে নিয়েছি। তোমার যদি মনে হয় আমি অন্যায় করেছি তাহলে করেছি। এর জন্য তুমি আমাকে ফাঁসি দিয়ে দেও আমার আপত্তি নেই।”
রুহানি মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ল। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না ফালাক ধোঁকা দিয়ে বিয়ে করেছে। এই বিয়ের কথা জানাজানি হলে তুফান শুরু হয়ে যাবে। ওর চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে।
ফালাক আলমারি থেকে একটা পেপার এনে রুহানির সামনে ধরল। রুহানি দ্রুত পেপারটা দেখল। ওর নাম স্বাক্ষরের জায়গায় জ্বলজ্বল করছে।
“তোমার একাউন্ট চেক করোনি। দেনমোহরের টাকা সেদিনই শোধ করে দিয়েছি।”
রুহানি রাগে,ক্ষোভে পেপার ছিড়ে ফেলে বলল,
“এটা কোন বিয়ে না। এভাবে কখনো বিয়ে হয় না। আমি এই বিয়ে মানি না।”
রুহানি চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়াল। ফালাকের দিকে তাকাল।
“পেপার ছিড়ে ফেললেই একটা সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় না, তুমি অস্বীকার করতে পারবে না। মেনে নেও তুমি বিবাহিত। ফালাকের স্ত্রী।”
“অন্যভাবে হলে খুশি খুশি মেনে নিতাম কিন্তু তুমি যে ওয়ে ব্যবহার করেছো তাতে আমি কিছুতেই মানব না।”
রুহানি চোখের পানি মুছতে মুছতে চোখ শক্ত করে ফালাকের দিকে চেয়ে দরজার দিকে যাচ্ছে। ফালাক ওকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলে রুহানি আরও রেগে যায়।
“খবরদার, আমাকে ছুবে না। একদম ছুবে না।”
ফালাক জোর করে রুহানিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“একশোবার ছুতে পারি। তুমি আমার বিয়ে করা বউ। অধিকার আছে।”
রুহানি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াল। ফালাক পেছনে থেকে রুহানিকে জড়িয়ে ধরে ওর চুলে নাক ডুবিয়ে বলল,
“রুহানি মাফ করে দেও। এছাড়া আমার উপায় ছিল না।”
রুহানি ফালাককে ধাক্কা মারল। কিন্তু ফালাক ওকে ছাড়ল না। জোর করেই শক্ত করে ধরে রাখল। ঘাড়ে, গলায় উষ্ণ ছোঁয়া দিচ্ছে। রুহানি ছোটার জন্য ছটফট করছে। ফালাক রুহানিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। রুহানি ভয়ানক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল। রাগে ফুসফুস করছে। কিন্তু ফালাক পাত্তা না দিয়ে মুচকি হাসল। এক হাতে ওর দু’হাত চেপে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট মিলাল। রুহানি প্রথমে বাঁধা দেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও পরে শান্ত হয়ে গেল। ফালাকের আহবানে সাড়া দিল। ফালাক ওর হাত ছেড়ে দিল। রুহানি দু’হাতে ফালাককে নিজের সাথে আলিঙ্গন করে নিল গভীর থেকে গভীর ভাবে। ফালাক রুহানির সম্মতিতেই নিজের অধিকার আদায় করে নিল।
চলবে…..
#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-২৮|
আলোয় ঝলমলে রুমটায় বর্তমানে ঘুটঘুটে অন্ধকার রাজত্ব করছে। ফালাকের ঘুম ভাঙতেই নিজেকে হালকা অনুভব হচ্ছে। ফালাক দ্রুত চোখ মেলল। ডানপাশে বামপাশে চোখ বুলিয়ে কাউকে না পেয়ে বেড সাইড টেবিল ল্যাম্প অন করল। রুহানি বিছানায় নেই। আর ঘরটায় এত অন্ধকার যে মৃদু আলোতে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ফালাক রুহানিকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এখন রুহানিকে না পেয়ে বুকটা শূন্য শূন্য লাগছে। ফালাক দ্রুত বিছানা থেকে নামতে নামতে রুহানির নাম ধরে ডাকছে। রুমের লাইট অন করল। বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। ফালাক ঘড়ির দিকে তাকাল। সন্ধ্যা ৭টা ১৩ বাজে। ওর বুকটা ধুক করে উঠল। রুহানি চলে যায়নি তো? ফালাক ওয়াশরুমে নক করল। দরজা খোলা। ওয়াশরুমে শাড়িটা অর্ধ ভেজা হয়ে অবহেলায় পড়ে আছে। ফালাক শাড়িটা ছুয়ে মেঝেতেই রেখে দ্রুত ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে গেল। ড্রয়িং, ডাইনিং, কিচেন সব জায়গায় খুঁজল কিন্তু রুহানি নেই। ফালাক রুহানির নাম্বারে ডায়েল করল। কল হয়ে কেটে গেল। কয়েকবার ট্রাই করার পরেও রিসিভ হলো না। ফালাক ফোন টেবিলের উপর রেগে রাগে গজগজ করছে।
“রুহানি কিছু না বলেই চলে গেলে? কিছু তো বলে যাবে? একটা মেসেজ করতে পারতে। কলও রিসিভ করছো না।”
.
রুহানি ওয়াশরুমে শাওয়ার ছেড়ে বসে আছে। ওর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। দু’হাতে মুখ চেপে বসে আছে।
“কি করলি এটা তুই রুহানি? আবেগের বশে কি করে বসলাম? যেখানে কেউ আমাদের সম্পর্কটাই মেনে নিতে প্রস্তুত নয় সেখানে আমি… ” রুহানি নিজের চুল ধরে নিজেই টানছে।
.
ফালাক বারবার ফোন করেও রুহানিকে না পেয়ে এক প্রকার বিরক্ত। রুহানি ছোট্ট একটা মেসেজ করে দিল ফালাককে।
“আমার শরীর খারাপ লাগছে। ঘুমাবো এখন প্লিজ ফোন করো না।”
রুহানি তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ফালাকের সাথে এখন কথা বলতেও অস্বস্তি লাগছে। আর কি বলবে, কি বলার আছে।
.
ফালাক আর চেষ্টা করেও রুহানির সাথে তেমন কথা বলতে পারেনি। রুহানি ফালাককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলল,
“পরশু থেকে আমার পরীক্ষা। আমি এখন শুধু পড়াশোনায় মন দিতে চাই। অন্য কোন প্যারা নিতে চাই না। প্লিজ আমাকে কিছুদিনের জন্য এসব থেকে দূরে রাখো।”
রুহানি ফালাকের নিশ্বাসের শব্দ পেল। ফালাক বড় করে নিশ্বাস ফেলে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু নিজের থেকে দূরে রাখছি না।”
ফালাক সাথে সাথে ফোন কেটে দিল।
রুহানির পরীক্ষার সময় খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য ফালাক অনেকবার ফোন করেছে কিন্তু রুহানি একবারো রিসিভ করেনি। রুহানি মূলত সেদিনের ঘটনার জন্য ভয় পেয়ে আছে। এখন ফালাককেও ওর ভয় লাগছে। ফালাক ফোন করে ওকে পায় না কিন্তু রুহানি কিছুক্ষণ পরে ঠিকি মেসেজ করে। ঘুমাচ্ছিলাম, খাচ্ছিলাম, কাজ করছিলাম, পড়ছিলাম, ওয়াশরুমে ছিলাম এই ধরনের বাহানামূলক মেসেজ পায়। ফালাক এগুলো দেখে মুচকি হাসে। তারপর থেকে ফালাক টুকটাক মেসেজ করে রুহানিকে। রুহানি মেসেজের উত্তর দেয়, ফালাকের খোঁজ খবর নেয়, পরীক্ষা পড়াশোনার খবরাখবর দেয়। এভাবেই চলছে৷ ফালাক রুহানির পরীক্ষা শেষ হওয়ার আশায় আছে।
দেখতে দেখতে পরীক্ষার বাইশ দিন কেটে গেল। এই ক’টা দিন ফালাক দূর থেকে রুহানিকে দেখতো। সামনে যেত না ইচ্ছে করে। রুহানিকে নিজের মতো থাকতে দিয়েছে। চায়নি কোনো কিছুর প্রভাব ওর পড়াশোনার ক্ষতির কারণ হোক। পরীক্ষা শেষ হতেই ফালাক ওকে ফোনের উপর ফোন করেই যাচ্ছে। কিন্তু রুহানি রিসিভ করছে না। ফালাকের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে৷
ফালাক রাতের বেলায়ই রুহানির বাসার নিচে চলে গেল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বারান্দার দিকে চোখ রেখে ফোন দিয়েই যাচ্ছে অনবরত। ফালাক রাগে ফুসফুস করছে আর পাইচারি করছে। চেহারায় রাগ স্পষ্ট। চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে পায়ের আঘাতে মাটি ভেদ করে ফেলবে।
বারবার ফোন বাজায় রুহানি সাইলেন্ট মুডে রেখে দিয়েছে। মেসেজও আসছে। রুহানির মন উশখুশ করছে মেসেজ দেখার জন্য। আঙুলটাও ইসপিস করছে। রুহানি ওর মেসেজ দেখে চোখ বড়বড় করে তাকাল। লাফ দিয়ে উঠে চুপিচুপি বারান্দায় গেল। ফালাক সত্যিই রাস্তার ওপাড়ে পাইচারি করছে। চেহারা অন্ধকারে স্পষ্ট বুঝা না গেলেও অববয় বলছে এটা ফালাক।
রুহানি ঘামছে৷ কি করবে বুঝতে পারছে না। ঘরের ফোনটা আবারও বেজে উঠল। রুহানি টোনের শব্দে চমকে উঠল। কল রিসিভ করতে বাধ্য হলো।
কল রিসিভ করতেই ফালাক যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেল। মুচকি হেসে বিরবির করে বলল যাক কাজ হয়েছে৷
কল রিসিভ করে বাজখাঁই গলায় বলল,
“আমি তোমার সাথে মিট করতে চাই রাইট নাও।”
রুহানি না যাওয়ার জন্য বাহানা খুঁজছে।
“এত রাতে আমি…
” ডোন্ট টেল মি এত রাতে বের হতে পারবে না। এত রাত নয় মাত্র ন’টা বাজে৷ আর এর চেয়ে বেশি রাতেও তুমি অনিরাপদ জায়গায় হেঁটেছো। আর আমি তোমার জন্য নিরাপদ। তাড়াতাড়ি এসো। আমাকে অপেক্ষা করিও না।”
ফালাক ফোন কেটে দিলে রুহানি ফোনের দিকে অসহায় ফেস করে তাকাল।
.
রুহানি গেট দিয়ে বের হতেই ফালাক ওর হাত ধরে নিজের গাড়িতে ওঠায়। রুহানিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। কিছুদূর গিয়ে ফাঁকা রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের কাছে গাড়ি থামাল। তারপর নিজে নেমে রুহানিকেও নামাল। রুহানি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফালাক ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে। রুহানি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে তাই ফালাক বলল,
“হুয়াট্স রং উইথ ইউ?”
রুহানি একবার চোখ তুলে ফালাকের দিকে চেয়ে চোখ নামিয়ে নিল। ফালাকের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। রুহানির দুবাহু চেপে ধরে বলল,
“কি সমস্যা আমার সাথে?”
রুহানি নিচুস্বরে বলল,
“কিছু না।”
ফালাক রুহানির হাত ছেড়ে দিল। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে রাগটা কন্ট্রোল করে বলল,
“আমি সেদিন তোমাকে জোর করেছি? করিনি তো। তোমার সায় ছিল। তবে কিসের শাস্তি পাচ্ছি আমি? কেন সেদিনের পর থেকে এমন করছো আমার সাথে?”
রুহানি এইবার মুখ খুলল।
“তোমাকে কিসের শাস্তি দেব? শাস্তি তো দিচ্ছি নিজেকে। সেদিন থেকেই শাস্তি পাচ্ছি। আবেগপ্রবণ হয়ে আমি একটা অন্যায়….”
রুহানির কথা শেষ হবার আগেই ফালাক চিৎকার করে বলল,
“অন্যায়? কোনো অন্যায় করোনি। না তুমি করেছো আর না আমি। সেদিন যা ছিল তার নাম ভালোবাসা, পূর্ণ ইচ্ছে, অধিকার। আবেগ বলে অপমান করবে না। টেক ইট ইজি।”
ফালাকের জন্য ইজি হলেও রুহানির জন্য ইজি লাগছে না। যেখানে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে। রুহানির ভাবনার মাঝেই ফালাক ওকে জড়িয়ে ধরল।
রুহানি ইতস্তত করে বলল,
“ফালাক রাস্তা এটা। কেউ দেখলে কি ভাববে?”
“ভাবুক। কতদিন পর তোমাকে এত কাছ থেকে দেখছি, ছুতে পারছি। এই দূরত্ব সহ্য করতে পারছি না।”
রুহানি আর কিছু বলল না। যা হবার হোক। মুহুর্তটা নষ্ট হতে দেবে না। ফালাকের সাথে লেপ্টে রইলো কিছুক্ষণ।
.
রুহানি বাসায় ঢুকতেই ওর মা কিচেন থেকে বের হতে হতে রুহানিকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
“এত রাতে কোথায় গিয়েছিলি?”
রুহানি চট করে বলল,
“ছাদে গিয়েছিলাম।”
হাতে দুধের গ্লাস নিয়ে রুহানের রুমে যেতে যেতে বলল,
“রাতের বেলায় ছাদে আর যাস না।”
রুহানি মাথা নাড়িয়ে কোনো ভাবে রুমে চলে এলো। রুহানের দুদিন পর থেকে এসএসসি পরীক্ষা। পড়াশোনা করছে খুব৷
রুহানি গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। রুহানের পরীক্ষা শেষ হবার পর এই বাড়িতে একটা বড়সড় ঝড় হবে যার পূর্বাভাস রুহানি আগে থেকেই পেয়ে গেছে। তবে আর ভয় পাচ্ছে না অপেক্ষা শুধু সেই সময়ের।
.
.
রুহানির জব, মাঝেমধ্যে ফালাকের সাথে সবার অজান্তে মিট করা, আহিলের সাথে প্রতিনিয়ত অবজ্ঞা করা, কড়া জবাব দেওয়ার মধ্যে দিয়ে দিন কেটে যাচ্ছে। রুহানের পরীক্ষাও ভালো কতো চলছে।
ফালাকের মা ছেলের ডেস্পারেট অবস্থার জন্য বিরক্ত। কিছুতেই ছেলেকে ফেরাতে পারছেন না আর না ফালাক বাড়িতে ফিরছে। ফোন করলেই তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যায়। এখন তো ফালাক বলছে রুহানিকে কাগজে কলমে বিয়ে করে নিয়েছে। যদিও ছেলের কথা তিনি বিশ্বাস করেনি কিন্তু মাথা গরম হয়ে গেছে ওর কথার ধরণ দেখে। রাগের মাথায় রুহানির বাবাকে ফোন করলেন। রুহানির মা ফোন রিসিভ করে লাউডস্পিকার দিয়ে ওর বাবাকে দিলেন।
সালাম, কোন প্রকার সম্ভাষণ ছাড়াই বলতে শুরু করলেন,
“আপনারা কি পেয়েছেন বলুন তো? কি চান আমার ছেলের কাছে? শুনলাম আপনার মেয়েকে একটা ছেলে বিয়ে করতে চায়। তার সাথে বিয়ে দিয়ে শান্তি থাকুন না। না আপনাদের একজন বিলিয়নধারী জামাইয়ে পোষাবে না? আল্লাহর ওয়াস্তে আমার ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে ওই ছেলের সাথে দ্রুত বিয়ে দিয়ে আমাদের উদ্ধার করে দিন। আপনার কাছে এটা আমার অনুরোধ।”
তারপর খট করে ফোন কেটে দিল। রুহানির মায়ের দিকে চেয়ে বলল,
“রুহানিকে ডেকে দেও।”
.
রুহানি ওর বাবার পাশে বসে আছে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবে বুঝতে পারছে। তিনি বলতে শুরু করলেন,
“আমরা কোটিপতি জামাই নয় তোর উজ্জ্বল ভবিষ্যত চেয়েছি। সব বাবা-মাই ছেলেমেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যত চায়। এতে দোষের কিছু নেই। তুই আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছিস। তবে আমিও কিন্তু তোকে কষ্ট করেই বড় করেছি। বিনা পরিশ্রমে আমার ব্যাংকে টাকা জমা হয়নি। এত দামী জামাকাপড়, বিলাসবহুল গাড়ি, বন্ধুদের সাথে টাকা উড়ানো এমনে এমনেই আসেনি। সব আমার পরিশ্রম থেকে এসেছে। আমি বাবা হিসেবে আমার দায়িত্ব পালন করেছি আর তুই মেয়ে হিসেবে বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছিস। আমরা তোর ভালো চাই। আমরা ভেবেচিন্তে ডিসিশন নেই তোর মতো আবেগপ্রবণ হয়ে নয়। আমি হাতজোড় করছি তুই ফালাককে ভুলে যা আর আহিলকে বিয়ে করে নে।”
রুহানির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। বাবার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে। ওর মুখে কথা সরছে না। বাকরুদ্ধ হয়ে নীরবে চোখের জল ফেলছে।
পরের দিন আহিল চলে এসেছে। সাথে কিছু পেপার। রুহানি নাস্তা করছিল। আহিলকে সকাল সকাল দেখেই মেজাজ চটে গেল। আহিল রুহানির দিকে একবার তাকাল তারপর হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,
“আপনাদের বাড়ির পেপার।”
রুহানির মা অবাক হয়ে হাতে নিয়ে পেপার ঘেটে দেখছে। উনাদের সেই বাড়ির পেপার। রুহানি বাড়ির পেপারের কথা শুনে নাস্তা করা রেখে উঠে এসে বলল,
“বাড়ির পেপার মানে?”
“ক’দিন পরে আমাদের বিয়ে। রুহানের পরীক্ষা শেষ হলেই তো। আর বিয়ে উপলক্ষে আমার তরফ থেকে তোমার জন্য উপহার এই বাড়িটা। দেনমোহর দেয় না তেমন আর কি।”
আহিলের কথা শুনে রুহানি স্তব্ধ হয়ে রইল।
তারপর বলল,
“আমি আপনার কাছে চেয়েছি? আমি বলেছি দেনমোহর হিসেবে আমাকে বাড়ি গিফট করুন?”
“তাহলে এটা গিফট হিসেবেই রাখো। আর বলো তুমি কি চাও?”
“আমি যা চাই তা আপনি কিছুতেই দিতে পারবেন না। তাই দূরেই থাকুন। আর আমি কোনো পণ্য নই যা একটা বাড়ি দ্বারা বিনিময় করা যাবে।” (মায়ের দিকে চেয়ে)
ওর মা ধমকে উঠল,”রুহানিইই। তোর বাবা গতকাল কি বলল? ভুলে গেছিস?”
“তাই বলে বিক্রি করে দিবে?”
রুহানির এই কথা শুনে ওর মায়ের মাথায় যেন আগুন জ্বলে গেল। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে রুহানিকে থাপ্পড় মারল। রুহানি গালে হাত দিয়ে চোখে আগুন জ্বালিয়ে আহিলকে বলল,
“জীবন থাকতে আমি আপনাকে বিয়ে করছি না। রুহানি ফালাকের আছে, থাকবে আর আছে। মিলিয়ে নিবেন। আর হ্যা একদিন ঠিকই বুঝতে পারবেন তবে সেদিন আপসোস ছাড়া কিছু করার থাকবে না।”
রুহানির লাল টকটকে চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। আহিল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। রুহানি মা’য়ের দিকে একবার তাকাল তারপর ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।
রুহানি সোজা ফালাকের ফ্ল্যাটে গেল। ইন্সটিটিউটে পরে যাবে। ফালাক অফিসের জন্য তৈরি হয়েছে৷ রুহানিকে এই সময় দেখে কিছুটা অবাক হলো আর ওর বিধ্বস্ত মুখটা দেখে চিন্তিত।
ফালাক কিছুটা অনুমানও করতে পারছে। ব্যস্ততার সুরে বলল,
“জরুরী কিছু বলতে এসেছো? বিয়ের দাওয়াত দিতে নয়তো?”
রুহানির ফালাকের কথা শুনে যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।
রুহানি রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
“কি করে বলছো তুমি এই কথা? মজা লাগছে তোমার?”
ফালাক রুহানির এক হাত চেপে ধরে বলল,
“তাহলে কি লাগবে? আমার বিয়ে করা বউয়ের আরেকজনের সঙ্গে বিয়ের কথা চলছে।”
“ওটা কোনো বিয়ে? কাউকে না জানিয়ে ইনফ্যাক্ট আমার অজান্তে তুমি কি করে বিয়ে করতে পারলে? কেউ মানবে?”
“তাহলে আর কি এক কাজ করো আহিলকে বিয়ে করে নেও।”(নির্লিপ্ত ভাবে)
রুহানি অসহায় ফেস করে বলল,
” ফালাক প্লিজ। তোমার মা গতকাল রাতে ফোন করে উল্টো পাল্টা বলেছে৷ বাবা জেদ ধরে বসে আছে আহিলের সাথেই বিয়ে দিবে। এখন আমি কি করব?”
“কি করবে? বিয়ে করবে৷ বাবার সামনে দাঁড়িয়ে তো বলতে পারবে না, স্বীকার করবে না বিয়েটাকে সো একজনের স্ত্রী থাকা অবস্থায় অন্য একজনকে বিয়ে করে নিবে, একজনকে ভালোবেসে আরেকজনকে বিয়ে করে নিবে, একজনের সাথে ফিজিক্যালি ইনভলভ হওয়ার পরেও অন্যজনের ছোয়া মেনে নিবে। ব্যাস আর কিছু না।”
রুহানির চোখ ছলছল করছে। ফালাকের দিকে চেয়ে আছে। ফালাকের কথাগুলো বেশ আঘাত করছে ওকে। কেমন সহজেই বলে দিচ্ছে কথাগুলো।
ফালাক ডাইরেক্ট বলল,
“তোমার কাছে দুটো অপশন খোলা আছে। তোমার আমার পরিবার কেউ আমাদের মানবে না তাদের আশা ছেড়ে দেও৷ চলে এসো আমার কাছে। পরিবার, পারিবারিক দায়-দায়িত্ব সব ভুলে যাও। আর নয়তো ফ্যামিলির খুশির জন্য নিজের খুশি বিসর্জন দিয়ে আহিলকে বিয়ে করে নেও। আমার আর কিছু বলার নেই।”
“ফালাক তুমি দায়সারা কথা কি করে বলছো? আমার অবস্থা, আমার মানসিক অবস্থা তোমার চোখে পড়ছে না? তুমি তোমার ডিসিশন আমার উপর চাপিতে দিচ্ছো কি করে? আমি এসেছিলাম তোমার সাহায্য, সাপোর্ট চাইতে আর তুমি?”
ফালাক রুহানির হাত ধরে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আ’ম ফিড আপ৷ আর না। তুমি এখানে এসেছো ড্রামা করতে৷ বিয়ে তুমি আহিলকেই করতে চাও। আহিল তো তোমাদের বাড়িও কিনে নিয়েছে তোমার নামে। তোমাকে গিফট করার জন্য। এমন হাসব্যান্ড ক’জন পায়। তোমাকে যা বলার আমি বলে দিয়েছি। আহিলের সাথে সুখে থাকো। নাও গেট আউট।”
ফালাক ঠাস করে রুহানির মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দিল।
রুহানি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই ফালাককে চিনতেই পারছে না। এত রাতারাতি একটা মানুষ বদলে যায় কি করে। রুহানি কাঁদতে কাঁদতে দরজা ধাক্কাচ্ছে।
“ফালাক দরজা খোল। এভাবে আমাকে তাড়িয়ে দিতে পারো না। কথা বলো আমার সাথে। তুমি আমাকে ভালোবাসো। এভাবে দায়সারা কথা বলতে পারো না। আমি আহিলকে বিয়ে করতে পারব না। দরজা খোল।”
ফালাক দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ইচ্ছে করেই কথা বলছে না। অনেকক্ষণ ধাক্কাধাক্কির পরেও দরজা না খোলায় রুহানি বাধ্য হয়ে চলে যায়।
রুহানির সাড়াশব্দ না পেয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। লাল ড্রেস পরা একটা মেয়ে রিকশায় উঠে যাচ্ছে।
“রুহানি সরি তোমাকে হার্ট করার জন্য। তোমাকে যদি হার্ট না করি তাহলে তুমি কঠোর হতে পারবে না। ডিসিশন নিতে পারবে না। তাই তোমার প্রতি কঠোর হয়েছি। আমাকে হারানোর ভয় তোমার মধ্যে ঢুকলে তবেই তুমি সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবে তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমি তোমার হাসব্যান্ড। পারিবারিক দায়বদ্ধতা এড়াতে পারবে, মানসিক মুক্তি পাবে।”
চলবে…..!