#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-১০|
রুহানি ঝড়ের বেগে ক্লাসে ঢুকল। রনকের পাশে ধপ করে বসতেই রনক রুহানির দিকে চেয়ে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। রুহানি রনকের চমকে উঠা দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
ব্যাগ রেখে বলল,
“কি রে ভূত দেখেছিস? ভয় পেয়েছিস? বুকে থু থু দে।”
রনক এর আগে যখনই ভয় পেয়ে যেত বুকে থু থু দিত। তাই রুহানি আজ ওকে বুকে থু থু দেওয়ার কথা বলল।
রনক মুচকি হেসে বলল,
“তুমি তাহলে এসেছো। যাক সুবুদ্ধি হয়েছে।”
রুহানি মুখ বাকিয়ে বলল,
“তুই তো পন্ডিত। বাকি সবাই বোকা।”
রুহানি বইপত্র বের করে বলল, “গ্যাপগুলো পূরণ করে দিস। পাশটা তো করতে হবে। তোর কাছে তো আর টিউশন পড়তে পারব না, টাকা কই।”
রনক ওর কথা শুনে বিরক্ত হলো তারপর বলল,
“বন্ধুত্বের মাঝে টাকা পয়সার কথা কেন আসছে? আমি আগের মতোই তোমাকে পড়াব।”
রুহানি বলল,”ওকে তবে সেটা ভার্সিটিতেই। আর হ্যাঁ শোন নুশাকে বলেছি তোর জন্য টিউশন দেখতে। ওর অনেক পরিচিত জন আছে, কাজিন আছে। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে চিন্তা করিস না।”
রনক অবাক হয়ে রুহানির দিকে তাকাল। তারপর আলতো হাসল। রুহানি এই অবস্থায়ও ওর কথা ভাবছে। কি অদ্ভুত মেয়ে!
রুহানির বন্ধুরা ওদের কথা বলতে দেখছে আর নিজেদের মধ্যে কি যেন বলছে।
ব্রেকের সময় রুহানির বন্ধুরা রুহানিকে ঘিরে ধরল। রুহানি ওদের ঘিরে ধরার কারণ বুঝতে পারছে না।
“ঘটনা কি তোদের? এভাবে ঘিরে ধরলি কেন? ভীড় সরা আমার পড়াশোনা আছে।”
রুহানির এক ফ্রেন্ড বলে উঠল,
“রুহানি সত্যি কথা বলত তো ঘটনা কি? এই রনকের সাথে স্যার যেদিন থেকে বসালো তুই আর রুহানি রইলি না। সারাক্ষণ শুধু পড়াশোনা পড়াশোনা করে পাগল। রনকের সাথে চিপকে থাকিস। কি চলছে?”
রুহানি না বুঝতে পেরে কনফিউজড হয়ে বলল,
“কি চলবে?”
ওরা হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। তারপর বলল,
“প্রেম করছিস না তো?”
রুহানি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। রাগে ওর গা শিরশির করছে।
“পাগল হয়েছিস না-কি? উল্টো পাল্টা কি বলছিস? ও আমার ফ্রেন্ড। এই সম্পর্কটাকেও ছাড় দিবি না? বন্ধুত্বের মতো সম্পর্কের তামাশা উড়াচ্ছিস? ছিহ! আর এছাড়া আমার বিয়ে ঠিক জানিস না তোরা?”
শেষের লাইন বলে রুহানি থমকে গেল। ওর বিয়ে ঠিক! বিয়ে! আদৌ কি বিয়ে করবে?
রুহানি ব্যাগ নিয়ে হনহন করে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেল। ওর বন্ধুরা চুপসে গেল। রুহানির সাথে এই মজাটা করা যে একদম ঠিক হয় নি বুঝতে পারছে আর সরি ফিল করছে।
.
রুহানি পুকুর পাড়ে সিড়িতে বই খুলে বসেছে। পাশেই রনক। রনক ওকে আগের পড়া গুলো দেখিয়ে দিচ্ছে।
“রুহানি এই বইয়ে কঠিন করে দেওয়া। আমি লাইব্রেরি থেকে অন্য বই নিয়ে পড়েছি। ওটা একদম ইজি। তুমি বসো আমি বইটা নিয়ে আসি।”
রুহানি রনককে থামিয়ে বলল,
“তুই বস আমি নিয়ে আসছি। একটু হাওয়া খেয়ে আসি।”
রুহানি বইয়ের নাম জেনে লাইব্রেরীর দিকে যাচ্ছে। রনক পুকুরের স্বচ্ছ পানির দিকে তাকাল।
ফালাক লাইব্রেরীর শেলফের সামনে দাঁড়িয়ে একটা বই নেড়েচেড়ে দেখছে। রুহানি লাইব্রেরীতে গিয়ে পা টিপে টিপে হাঁটছে। ও ফালাকের চোখে পড়তেই আড়চোখে তাকাল। রুহানি শেলফে কি একটা খুঁজছে। কিছু সময় পর রুহানি শেলফ থেকে বই খুঁজে বের করে সেটা নিয়ে আবারো নিঃশব্দে বাইরে চলে গেল। ফালাক রুহানিকে দেখে অবাক না হয়ে পারল না। চুপচাপ এলো একটা বই নিল আর চলে গেল? কি করে সম্ভব?
ফালাক শেলফে বই রেখে রুহানির পেছনে পেছনে বেড়িয়ে গেল।
রুহানি বই দিয়ে সূর্যকে ঢাকার চেষ্টা করে হাঁটছে। ফালাক বেশ কিছু দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছে। রুহানি পুকুর পাড়ের কাছে যেতেই ফালাক রনককে বসে থাকতে দেখল। ফালাক দাঁড়িয়ে গেল। রুহানি গিয়ে রনকের পাশে বসে বই দিয়ে বলল,
“নে তোর বই।”
রনক বই সূচিপত্র দেখছে। রুহানি টিস্যু দিয়ে মুখের ঘাম মুছে টিস্যুটা ফেলে দিল।
রনক পেজ বের করে পড়াতে শুরু করল। রুহানি পূর্ণ মনোযোগ দিল।
ফালাক দূর থেকে রুহানিকে এত মনোযোগী আর স্থির দেখে অবাক হলো। রুহানি পড়াশোনার প্রতি এতটা সিনসিয়ার কবে থেকে হলো? বিষয়টা ফালাককে বেশ ভাবাচ্ছে।
ফালাকের খটকা লাগছে। রুহানি আবার রনকের সাথে প্রেম করছে না তো?
ফালাক কেমন অদৃশ্য এক জ্বলন অনুভব করছে। কেন জ্বলছে বুঝতে পারছে না।
.
রনক আর রুহানি এক সাথে ক্লাসে যাচ্ছে। ব্রেক শেষ। রনক হটাৎ ফালাককে দেখতে পেল। ফালাক তরিঘটি করে কোথাও যাচ্ছে। রনক ফালাককে ডাকল।
“ফালাক ভাই!”
রুহানি রনকের দিকে অবাক হয়ে তাকাল। ফালাককে কেন ডাকছে? ফালাক পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে রনককে দেখল। সাথে রুহানিকে দেখে মুখ ভার করে নিল। তাড়াহুড়োর ভাব দেখিয়ে বলল,
“হ্যা বলো।”
“ধন্যবাদ ভাই। আজকে আপনি ইশার কাজের প্রতিবাদ করেছেন। দেখেছো রুহানি তোমাকে বলেছিলাম না ফালাক ভাই খুব ভালো মানুষ?”
রুহানি মুখ বাকাল। তারপর বলল,
“ভালোর ছিরু। প্রতিবাদ করেছে এখন এওয়ার্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।”
রুহানির কথা শুনে ফালাক দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল,
“রনক, ওর জায়গায় যে কেউ থাকলেই আমি প্রতিবাদ করতাম। মানবতা বলে কিছু তো আছে। আমি আর সবার মতো অমানবিক, নিষ্ঠুর না। মানুষের প্রতি জুলুম, অবিচার করি না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। আর তোমার এই বন্ধুর মতো অকৃতজ্ঞ নই। মানুষের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটাও শিখে নি। আমি আসছি। আমার কাজ আছে। মানুষের মতো আজাইরা থাকি না।” (রুহানির দিকে তাকিয়ে)
ফালাক রুহানির দিকে আবারও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিল। তারপর আবারো ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে গেল। রুহানি হা করে চোখ বড়বড় করে ওর যাওয়ার দিকে তাকাল। রনক বুঝতে পারল না কোন রাগ ঝেড়ে গেল রুহানির উপর।
রুহানি রনকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“দেখেছিস কত কথা শুনিয়ে গেল? তুই আবার বলিস ভদ্র ছেলে। অসভ্য একটা।”
রনক বলল,
“মনে হয় কাজের প্রেশারে আছে। তাই….”
রুহানি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“কি এমন কাজ করে যে এত প্রেশার?”
রনক স্নিগ্ধ হেসে বলল,
“আরে উনি অফিস করে রোজ। ভার্সিটির পর বাকি সময় অফিসে থাকে। অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে। পড়াশোনা ও কাজের প্রতি অনেক দায়িত্বশীল।”
“গরিব না-কি? দেখে তো মনে হয় না।”
রুহানির কথা শুনে রনক হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“গরিবরাই শুধু কাজ করে? উনার বাবার বিজনেস। ভাইয়ের বাবা অসুস্থ। তাই একমাত্র ছেলে হিসেবে সব দায়িত্ব তার উপর। পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার বিজনেস সামলায়।”
রুহানির সেদিনের পার্টির কথা মনে পড়ল। ফালাককে একটা বিজনেস পার্টিতে দেখেছিল। তাহলে সেদিন সেখানে ওর নিজের কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়েছিল। বাহ! পড়াশোনা করে আবার বিজনেসও সামলায়? আর আমি বাপের টাকা উড়িয়েছি। বিনিময়ে এক ছিঁটা পরিশ্রম করি নি। আজ তার ফল ভোগ করছি।
রুহানি হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল,
“তুই এতকিছু কি করে জানলি?”
“একদিন আমার সাথে কথা হয়েছিল। সেদিন বলেছে। আসলে উনাকে লাইব্রেরীতে পড়তে দেখেছিলাম। তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি বাড়িতে পড়ার সময় পান না। কেন পান না সেটা জিজ্ঞেস করতে সব খুলে বলেছে। আমার খুব ভালো লেগেছে ব্যাপারটা। আমি ভাবতাম আমাদের বয়সী নিন্মবিত্তরাই পরিশ্রমী। কিন্তু না। সেদিন উনার সাথে কথা বলে বুঝতে পেরেছি। সবার জীবনেই একটা গল্প আছে।”
“হুম, চল ক্লাসে যাই।”
ফালাক গাড়িতে ওঠে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল। প্রচুর রাগ লাগছে। রুহানির এমন বাঁকা বাঁকা কথা ফালাকের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে দিচ্ছে। রাগ লাগছে প্রচুর। সাথে অভিমানও। এক পাহাড় অভিমান যেন ওর উপর ভর করেছে। ফালাক গাড়ি স্টার্ট দিল। অফিসে কাজ আছে প্রচুর।
.
রুহানি, রুহানের স্কুল থেকে ওকে নিয়ে বাড়িতে ফিরেছে৷ রুহানির মনে হচ্ছে এতক্ষণ স্বপ্নরাজ্যে ছিল। এখন এসে পড়েছে সেই করুণ বাস্তবতার মাঝে। দোতলার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুহানের হাত ধরে ভেতরে গেল।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে। বাড়ির পেছনের ঝুপ থেকে ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ব্যাঙের ডাক শোনা যায়। রুহানি বাবার সাথে দেখা করার জন্য রুমের কাছে গিয়ে কান্নার শব্দ পায়। দরজা ভেড়ানো ছিল তাই কান্নার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। রুহানি ভালো ভাবে শোনার চেষ্টা করছে।
রুহানির মা কাঁদছে।
“রুহানিকে কি করে এই কথাটা বলব? আমার মেয়ের কি হবে? ওর ভবিষ্যতটা এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে? ওর জন্য আমরা কিছু করতে পারব না? আমি আর এসব দেখতে পারছি না।”
রুহানির বাবা ধরা গলায় বলল,
“সম্পর্কের কোন মূল্য নেই। সবাই টাকা চিনে। নয়তো যে আহিলের বাবা তার ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ের জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল সে আজ এভাবে এই বিপদের দিনে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার কথা বলতে পারে? আমি তাকে ফোন করেছিলাম যাতে আমাকে সাহায্য করে কিন্তু না সে রুহানির সাথে আহিলের বিয়ে ভেঙে দিল। আমার এতদিনের স্বপ্ন রুহানির বিয়ে দেব আজ সব শেষ করে দিল।”
“আমার মেয়েটার কি হবে? ওর কি ভালো ঘরে বিয়ে হবে না? ওকে কি সারাজীবন এই বোঝা বইতে হবে?” এই কথাগুলো বারবার বলে রুহানির মা কাঁদছে।
“আমি পারলাম না। ব্যর্থ আমি, আমি ব্যর্থ বাবা। আমি আমার মেয়েকে সুখী দেখতে পারলাম না। এর চেয়ে আমার মরে যাওয়া উচিত ছিল।”
রুহানির চোখেও পানি জমেছে। মেইন ডোর খুলে বাইরে চলে গেল। রাস্তার ধারে ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে পড়ল। অঝোরে পানি পড়ছে চোখ দিয়ে৷ কেন কাঁদছে জানা নেই।
বাবা মায়ের কান্না দেখে? তাদের কষ্ট দেখে? না নিজে রিজেক্ট হয়েছে তাই?
রুহানি সবেমাত্র অনার্সে এডমিশন নিয়েছে। বাবা একদিন ডেকে বলল,
“ওর বিয়ে ঠিক করা। তাই ও যেন খেলার বশেও কাউকে মন দিয়ে বসে না থাকে। ভার্সিটিতে হাসি-আনন্দ যা খুশী করুক কিন্তু প্রেম-ভালোবাসায় যেন না জড়ায়।”
রুহানিও কখনো প্রেম ভালোবাসায় জড়ায় নি। আহিলের ছবি দেখে অপছন্দ করার মতো কিছু পায় নি। একদিন শুধু আহিলের সাথে কথা বলেছিল। বলেছিল ওর স্বাধীনতা চাই। যখন বিয়ে হবে তখনই যেন কর্তৃত্ব দেখায় এর আগে নয়। তারপর রুহানি নিজের মতো থেকেছে। এতকিছুর মধ্যে ওর বিয়ে ঠিক এটা মাথায় কখনো আসতো না। কিন্তু ওর বাবা-মার অপেক্ষা ছিল শুধু গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করা। তারপর ধুমধামে ওর বিয়ে দেবে।
চলবে……
#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-১১|
চারদিক নীরব নিস্তব্ধ। সুনসান নীরবতা ঘিরে ধরেছে। মাঝে মাঝে দু একটা রিকশা টিং টং বেল বাজিয়ে যাচ্ছে। রুহানি মাথা দু হাঁটুতে ভর করে ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে আছে। হটাৎ করে শা শা করে একটা গাড়ি বাতাসের বেগে চলে গেল। রুহানির গায়ে ঝাপটা বাতাস লাগতেই মাথা তুলে বসল। ওর কেমন ভয় ভয় লাগছে। রাস্তাটা অনেক সুনসান। আশেপাশে কেউ নেই। রুহানি উঠে দাঁড়িয়ে এক দৌড়ে গেটের ভেতরে ঢুকে গেল। এমনিতেই অন্ধকারে ভয় লাগে। তার উপর এমন গা ছমছমে পরিবেশ।
রুহানি সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল। দরজা খোলা ছিল তাই ভেতরে ঢুকতে সমস্যা হলো না। রুহানি নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। রুমের লাইট অফ। গাঢ় অন্ধকারে ওর জীবনের সুন্দর দিনগুলোর কথা ভাবছে। যা এখন অতীত ছাড়া কিছুই না। দরজা খোলার শব্দে রুহানি চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করল। জানে ওর মা এসেছে। রুমের লাইট অন করায় রুহানির চোখে আলো এসে বিঁধল। রুহানি চোখ কুঁচকে ভালো ভাবে বন্ধ করে নিল।
ওর মা ওর কাছে এসে বলল,
“রুহানি? ঘুমিয়ে পড়েছিস?”
রুহানি কোন সাড়াশব্দ দিচ্ছে না। ওর মা ওর সাড়াশব্দ না পেয়ে ওর কপালে হাত দিল।
“মেয়েটা এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল? ডাকব?”
রুহানির মা ডাকতে গিয়েও থেমে গেল। রুহানির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“আমার রাজকন্যাটা এমন কপাল নিয়ে জন্মালো? সারাজীবন কি এভাবেই কাটবে ওর জীবন? আল্লাহ, ওর জন্য কাউকে পাঠাও যে ওর কষ্টগুলো অনুভব করতে পারবে, ওর দুঃখগুলো দূর করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে।”
রুহানির মা কিছুক্ষণ আদর করে চলে গেলেন। কিন্তু রুমের লাইট অফ করলেন না, দরজাও বন্ধ করলেন না।
মা যেতেই রুহানি চোখ মেলল। ওর চোখ থেকে গাল বেয়ে পানি পড়ার আগেই মুছে নিল। উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মাথা রেখে চোখ মেলে রাখল। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। জীবন যেন দীর্ঘশ্বাসময়। কিছুক্ষণ পরে পায়ের শব্দ পেল। ওর ঘরের দিকে পায়ের শব্দটা প্রখর হচ্ছে। রুহানি আবারও চোখ বন্ধ করে নিল। ওর মা খাবার নিয়ে এসেছেন। বেড সাইড টেবিলে আস্তে করে রাখলেন। পানি ঢেলে গ্লাস এনে রাখলেন। সব খাবার ডেকে রেখে রুমের লাইট অফ করে দিলেন। তারপর দরজা বন্ধ করে চলে গেলেন।
।
আজকে রুহানির ক্লাস নেই। রুহানকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে গাড়ি ওদের আগের বাড়ির দিকে ঘুরাল। রুহানি গাড়ি থামিয়ে গ্লাস খুলে দূর থেকে বাড়িটা দেখছে। ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। পুরনো স্মৃতিরা জেগে উঠছে। ছাদে কত পার্টি করেছে, বৃষ্টিতে ভিজেছে, জোৎস্না বিলাস করেছে। রুহানি নিজের অজান্তেই গাড়ি থেকে নেমে গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গেটের উপর হাত রাখল। ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। রুহানি হটাৎ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল।
“যে বাড়িতে ২১বছর ধরে ছিল, হাঁটি হাঁটি পায়ে যেখানে বেড়ে উঠেছে। যেখানে জীবনের সুন্দরতম অধ্যায়গুলো কাটিয়েছে, যে বাড়ির পুরোটা জুড়ে অধিকার ছিল আজ সেখানে পা রাখতে ভয় পাচ্ছে। সময় কতটা শক্তিশালী।”
রুহানি গাড়িতে গিয়ে বসল। কিছু একটা ভেবে গাড়ি স্টার্ট দিল। ফুল স্পিডে গাড়ি চলছে। রুহানি একটা বিলাসবহুল বাড়ির সামনে গাড়ি থামাল। তারপর কাউকে পরোয়া না করে বাড়ির ভেতরে ঢুকল।
রুহানি ভেতরে গিয়েই জোরে জোরে চিৎকার শুরু করল। ওর চিৎকার শুনে ৩০-৩২ বছর বয়সী মহিলা বের হয়ে এলো। ওকে দেখে অবাক হয়ে বলল,
“রুহানি!”
রুহানির চোখ মুখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। রুহানি রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“চিনতে পারছো তাহলে?”
মহিলাটি চুপ করে গেল। রুহানি চুপ থাকতে দেখে বলল,
“মামা কই? আমি মামার সাথে কথা বলতে এসেছি। ডাকো তাকে।”
রুহানির মামী ওর মামাকে ডাকল। তিনি রুহানিকে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে বলল,
“রুহানি!”
রুহানি চিৎকার করে বলল,
“খবরদার ওই নামে আমাকে ডাকবে না। আমি শুধু একটা কথা বলতে এসেছি তুমি যা করেছো তার শাস্তি তুমি পাবে। ভয়ানক শাস্তি পাবে। তোমার উপর আল্লাহর গজব নাজিল হবে। প্রতারককে আল্লাহ ক্ষমা করেন না।”
“রুহানি, কি বলছিস? মাথা ঠান্ডা কর। এখানে এসে বস।”
“বসার মতো সম্পর্ক তুমি রেখেছো? কি করে পারলে নিজের আপন বোনের সাথে এমন করতে?”
“কি আশ্চর্য! আমি কি করেছি? কি করেছি বলবি তো।”
রুহানি তাচ্ছিল্য হেসে বলল,”কি করেছো? তুমি কি করেছো সেটা এই মুহুর্তে তোমার ভেতরে গাইছে। তবুও জিজ্ঞেস করছো? কোন মুখে জিজ্ঞেস করছো? বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই তোমার?”
রুহানির মামা রাগ ফুটিয়ে গম্ভীরমুখে বলল,
“রুহানি এবার কিন্তু বেশিই হয়ে যাচ্ছে। আমি কিছু করি নি। তোদের ভুল হচ্ছে।”
রুহানি আবারও একটু হাসল। তারপর বলল,
“হাসালে মামা, তুমি কিছু করো নি। তাহলে আমাদের এই বিপদে কোন খবর নেও নি কেন? আমরা কি করছি, কোথায় আছি, কেমন আছি জানতে চাইলে না কেন?”
রুহানির মামা অন্য দিকে ঘুরে বলল,
“কারণ তোর মা সব সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে। বলেছে ওর কোন ভাই নেই। ও মরে গেলেও যেন খোঁজ না করি।”
এমন সিরিয়াস মুহুর্তেও রুহানির মামার কথা শুনে হাসি পাচ্ছে।
“আর তোমার বোনের ছেলে-মেয়ে? তারা? তাদের খোঁজ নিয়েছো?”
রুহানির মামা কথা বলছে না। ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে যাচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না।
“মামা, তুমি প্রতিহিংসার বশে যা করেছো তাতে তোমার ক্ষতি অনিবার্য। তুমি আমাদের নিঃস্ব করে আমাদের অভিশাপ কুড়িয়েছো। আল্লাহ যেন তোমাকে এর শাস্তি দেয়। আমার বাবা তোমার জন্য অনেক করেছে। আজ তুমি যা সব কিছু আমার বাবার উছিলায়। আর তার সাথেই বেইমানি করেছো। তাকেই পেছনে থেকে ছুরিটা মেরেছো। তুমি একটা প্রতারক।”
রুহানির ৭বছরের মামাতো ভাই এসে রুহানিকে বলল,
“আপু, তুমি আমার বাবাকে বকছো কেন?”
রুহানি চুপ না করে ওকে বলল,
“কারণ তোর বাবা একটা বেইমান, নিমুকহারাম। তোর বাবা জালিয়াতি করে আমাদের সব শেষ করে দিয়েছে৷ নিজের স্বার্থে একমাত্র বোন যে সব সময় সাপোর্ট দিয়েছে তাকে তার সন্তানসহ রাস্তায় নামিয়েছে। শুনে রাখ তোর বাবা বেইমান।”
রুহানির মামী ধমক দিয়ে বলল,
“তোমার স্পর্ধা দেখে অবাক না হয়ে পারছি না। এতটুকু বাচ্চা ছেলেকে কি বলছো?”
“সত্যি বলে ভুল করে ফেলেছি? আর আমার স্পর্ধা সম্পর্কে আপনি জানেন না? আমি কিন্তু সেই রুহানিই আছি। এই আপনিও আপনার পাপের শাস্তি পাবেন। স্বামীর পাপে যেমন সঙ্গী হয়েছেন তখন শাস্তি পাওয়ার জন্য তৈরি থাকুন। অগ্রিম বরবাদি মোবারক।”
রুহানি হনহন করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। রুহানির মামী ওর মামার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি কিছু বললে না কেন?”
রুহানির মামা মুচকি হেসে সোফায় বসে বলল,
“ছাড়ো তো। পাগল হয়ে গেছে। তাই কামড়াতে এসেছিল? কিন্তু কামড়ানোর জন্য দাঁত প্রয়োজন সেটা ভুলে গেছে এই এক রত্তি মেয়ে।”
রুহানি ড্রাইভ করছে আর ভাবছে আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনেক টাকা প্রয়োজন কিন্তু এত টাকা জোগাড় করবে কিভাবে? মুহুর্তেই ভাবল গাড়িটা বিক্রি করে দিবে। কিন্তু গাড়ি বিক্রি করলে রুহান স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিবে। কিছুতেই স্কুলে যাবে না। আর গাড়ি বিক্রি করার পরও যদি কিছু প্রমাণ না করতে পারে? তাহলে? শুধু শুধু টাকাগুলো নষ্ট হবে।
।
রুহানি দ্রুত রেডি হয়ে দৌড়ে বের হচ্ছে। আজ অনেক লেট হয়ে গেছে। অনেক রাত পর্যন্ত মায়ের সাথে ঘরের কাজ করেছে৷ তাই ঘুমাতে দেরি হয়ে গেছে আর উঠতেও। রুহানি দৌড়ে দৌড়ে সিড়ি দিয়ে উঠছে। একেকজনের সাথে ধাক্কা লাগতেই সরি সরি বলে দৌড়াচ্ছে। আজ যে স্যারের ক্লাস সে খুব কড়া। এক মিনিট লেটে ক্লাসে ঢুকতে দেয় না। রুহানি দৌড়ে এসেও শেষ রক্ষে করতে পারল না। স্যার ক্লাসে ঢুকে বই হাতে নিয়ে নিয়েছেন অলরেডি৷ রুহানি দরজার সামনে থেকে সরে গেল। জানালা দিয়ে অনেকেই ওকে দেখছে। নুশা টেক্সট করে জানিয়েছে সামনে এসে স্যারের একশো কথা শোনার চেয়ে বাইরে গিয়ে হাওয়া খা। স্যারের চোখে একবার পড়লে ডেকে ভেতরে নিবেন তারপর অপমান করবেন অতঃপর বের করে দিবেন৷
রুহানি ব্যাগের বেল্ট টানতে টানতে গাল ফুলিয়ে সিড়িতে বসে রইল। একা একা বোরিং লাগছে। ফোনটা বের করে কিছুক্ষণ ফেসবুকে টু মেরে বসে রইল। ফেসবুকও ভাল্লাগছে না। আর সিড়ি দিয়ে কিছুক্ষণ পর পর ছেলে-মেয়েরা দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে। তাই বিরক্ত লাগছে। রুহানি হাই তুলতে তুলতে লাইব্রেরীর দিকে যাচ্ছে। ওর খুব ঘুম পাচ্ছে। দু-হাত উঁচু করে আড়মোড়া ভেঙে লাইব্রেরীতে গেল। ক্লাস চলছে তাই লাইব্রেরীতে মানুষের ভীড় নেই বললেই চলে৷ প্রায় ফাঁকা। রুহানি চেয়ার টেনে একটা বই বের করে বসে পড়ল।
।
ফালাক ক্লাস শেষে লাইব্রেরীতে এসে টেবিলের উপর একটা মেয়েকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে। লাইব্রেরীতে কেউ ঘুমায়? স্ট্রেঞ্জ! ফালাক আরেকটু কাছে গিয়ে রুহানিকে দেখে মুখ দিয়ে বিরক্তিকর হাওয়া বের করে বলল,
“এর যে আরো কতকিছু দেখা বাকি আল্লাহ জানে।”
ফালাক একটা বই নিয়ে ইচ্ছে করে টেবিলের উপর ধপাস করে রাখল। রুহানি ঘুমের মধ্যে চমকে গিয়ে মাথা তুলল। তারপর ঘুমঘুম চোখে ফালাককে দেখে চোখ থেকে ঘুম উবে যায়। ভালো করে তাকাল। ফালাক চোখ মুখ শক্ত করে ওর দিকে চেয়ে আছে।
রুহানি কিছুটা লজ্জা পেল। তবে লজ্জাটাকে লুকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“বই রাখলে না বোম ছুড়লে?”
ফালাক চেয়ার টেনে বসে পড়ল। তারপর বলল,
“এটা ঘুমানোর জায়গা? বাড়িতে গিয়ে ঘুমাও।”
“তোমার সমস্যাটা কই? আমার রাতে কম ঘুম হয়েছে তাই একটু চোখ লেগে গিয়েছিল। আমি তো কাউকে ডিস্টার্ব করি নি।”
ফালাক ভাবছে তাই তো। এখন কি রিজন দেখাবে? ফালাক আমতা আমতা করে বলল,
“অন্য কেউ দেখলে তোমাকে লজ্জা দিত তাই জাগিয়ে দিলাম।”
“এটা আপনার জাগানোর নমুনা? ভালো ভাবে জাগাতে পারতেন।”
“রাতভর বয়ফ্রেন্ডের সাথে গল্প না করে ঘুমালে তো আর লাইব্রেরীতে এসে ঘুমানো লাগে না।”
রুহানি ক্ষেপে গিয়ে বলল,
“আপনি জানেন আমি রাতভর বয়ফ্রেন্ডের সাথে গল্প করি?”
“কমনসেন্স!”
“ফালতু লোকের ফালতু কমন সেন্স।”
রুহানি উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বলল,
“আপনার সম্পর্কে ভালো মনোভাব পোষণ করেছিলাম কিন্তু আপনি তার যোগ্য না।”
রুহানি একা একা বিড়বিড় করতে করতে ক্লাসের দিকে যাচ্ছে। কখন যে চোখ লেগে গেল টেরই পায় নি। আর ফালাক সেই সুযোগের উত্তম ব্যবহার করল। নিজের উপর রাগ হচ্ছে সেদিন রনকের কথা শুনে ফালাকের প্রতি পজিটিভ একটা ধারণা এসেছিল,রেস্পেক্ট করেছিল। সব ভুল মনে হচ্ছে।
চলবে…..