#প্রিয়দর্শিনী🍂
#সুমাইয়া_যোহা
পর্ব-০৮
প্রায় অনেকক্ষণ যাবত ভাবির ফ্রেন্ডের স্বভাবগুলো লক্ষ্য করে যাচ্ছি। কিছু একটা বললেই উনি টুস করে হাসা শুরু করে দেন। এমন অদ্ভুদ কথা বলছেন যেটা থেকে সত্যিই মনে হচ্ছে যে জনাব মেন্টাল পেশেন্টদের চিকিৎসা করতে করতে নিজেই মনে হয়ে পাগল হয়ে গেছেন। বেচারার জন্য খারাপও লাগছে। ভাবিকে বলতে হবে যে উনার ফ্রেন্ডকেও মেন্টাল ওয়ার্ডে চিকিৎসা করানো দরকার। আমি আপাতত উনার কথার কোনো জবাব দিচ্ছি না। ভাবছি কিভাবে এখান থেকে চলে যাওয়া যায়। বড্ড অস্বস্তি লাগছে। একটু পরে মেহু ভাবি সেখানে আসলে আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। মেহু ভাবির সামনে উনি অত্যন্ত হতাশ জনক কন্ঠে বললেন-
: কিরে মেহু! তোর ননদ এতো নিরামিষ কেন? এক বিন্দু পরিমানও আমিষ নেই উনার ভিতর।
: হ্যাঁ রে আমার ননদটা একটু বেশিই নিরামিষ। তুই ওকে কিছু আমিষ ধার দিস।
আমি উনাদের দুইজনের দিকে চোখগুলো বড় বড় করে হা করে তাকিয়ে আছি। আমার এমন চাহনি দেখে তারা দুইজনই ফিক করে হেসে দেয়। পরক্ষণে বুঝলাম যে তারা দুইজনই আমাকে নিয়ে নিছকই মজা করছেন। হঠাৎ করে আমার ফোনে কল আসা আমি সেখানে সরে এসে এক সাইডে এসে দাঁড়িয়ে দেখি ফোনের স্ক্রিনে মাহিম ভাইয়ার নাম্বারটা ভেসে উঠেছে। ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিতেই মাহিম ভাইয়া বললেন-
: আপনি কি ঠিক আছেন তরুনিমা? আজকে অফিসে আসলেন না। আর ইউ ওকে?
: জ্বি, আমি ঠিক আছি। আসলে আমার বাসায় একটা প্রোগ্রাম চলছে তাই আজকে অফিস যাই নি। আমি ম্যানেজার সাহেবকে বলে এসেছি তো। আর আপনি হঠাৎ এমনভাবে প্যানিক হচ্ছেন কেন?
আমি অত্যন্ত স্থির কন্ঠে কথাটা বলি। মাহিম ভাইয়া কিছু সময় চুপ থেকে বললেন-
: কালকে অফিসে আসবেন তো?
: না আসার তো কিছু নেই। যদি তেমন প্রয়োজন না থাকে তাহলে নাও আসতে পারি। ইটস্ ডিপেন্ড। এখন আমি রাখছি।
মাহিম ভাইয়া কিছু একটা বলার চেষ্টায় ছিলেন যদিও। কিন্তু সেইটা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত নই। অবশ্য আমি সেইটা শুনতেও চাই না। ফোনটা কেটে দিয়ে অনুষ্ঠানে মনোনিবেশ করি।
——————————————-
ফ্রেশ হয়ে তরুনিমা সোজা ব্যালকনিতে চলে যায়। এখন ঘড়ির কাটায় প্রায় একটা বাজতে চলেছে। তরুনিমার সামনে হঠাৎ কফির মগ ধরাতে সে লক্ষ্য করে যে মেহু ঠোঁটের কোণে একটা মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে আছে। তরুনিমা দরজার দিকে লক্ষ্য করতেই মেহু বলল-
: একচুয়ালি দরজা খোলা ছিল। তাই দরজা নক না করেই চলে এসেছি।
: ইটস্ ওকে, ভাবি। দাও কফিটা।
তরুনিমা কফির মগটা হাতে নিয়ে ব্যালকনির সামনের দিকে তাকিয়ে মগে চুমুক দিতে মেহু খানিকটা ইতস্তত কন্ঠে বলল-
: তরুনিমা কালকে একটু সময় দিতে পারবে পান্থকে তুমি।
তরুনিমা মেহু কথার শুনে চমকে তাকালে মেহু বলল-
: তুমি অন্যকিছু ভেবো না। পান্থ বলছিলো যে ও একটু সিলেট ঘুরে দেখবে। কারন ওর আবার আগামী পরসু থেকে রোগী দেখায় ব্যস্ত হয়ে যাবে। সময় আবার কখন হবে ও সেটা জানে না। আবার কালকে আমার একটা কনফারেন্সও আছে। মিনহাজ তো মিনহাজ তো মিনহাজই। ওকে বললে বলে যে আমাকে যেতে। কিন্তু…
: আচ্ছা ঠিকাছে ভাবি সব বুঝলাম। কিন্তু আমার তো কালকে অফিস আছে। আমি কিভাবে পারবো?
: একটু ম্যানেজ করো না। আমি আবার মুখ ফসকে তোমার নাম বলে দিয়েছি যে তুমি কালকে ওকে সিলেট শহরটা ঘুরাবে। এখন যদি তুমি না করে দাও তাহলে ও অনেক রাগ করবে আমার সাথে। ও এমনিতে যথেষ্ট ফ্রি সবার সাথে, শান্ত। কিন্তু ওর রাগ সাংঘাতিক। যদিও ওর রাগের সাথে আমি একবার পরিচিত হয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার আর পরিচিত হতে চাই না।
: আচ্ছা আমার সুইট ভাবি। ডোন্ট ওরি আই উইল ম্যানেজ। এখন যাও রাত অনেক হয়েছে।
মেহু যেন একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তরুনিমা মনে মনে শুধু ভাবছে-
: আজকে কিছুক্ষণ উনার সাথে থেকে আর সহ্য করতে পারলাম না। কালকে সারাটা দিন কিভাবে সহ্য করবো। আল্লাহ আমার উপর একটু দয়া করো।
——————————————–
ভোর হয়েছে কি, এখনো হয়নি সেইটা জানি না। গতকাল টায়ার্ড থাকার ফলে তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হুট করেই ফোন বেজে উঠতেই নিজেকে ব্যালকনিতে থাকা সিঙ্গেল সোফায় আবিষ্কার করি। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে ঘুম ঘুম চোখে ফোনটা রিসিভ করতেই বিপরীত পাশ থেকে পুরুষালী কন্ঠে একজন বলল-
: গুড মর্নি…!
কন্ঠটা একটু হলেও চিনা চিনা লাগলেও চিনতে পারিনি। তার উপর ঘুমের ভিতর কেউ ফোন দিলে প্রচন্ড বিরক্ত অনুভব হয় আমার। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গিয়েছে তখন। বিরক্তি নিয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললাম-
: কে ভাই আপনি?! টাইম সেন্স নেই!? এতো সকালে কেউ ফোন করে? কে বলছেন?
ফোনের বিপরীতে পাশে থাকা মানুষটা যেন আমার কথাগুলোকে রীতিমতো কোনো কৌতুক বিবেচনা করে হাসা শুরু করে দেয়। যার ফলশ্রুতিতে আমি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে ঝাঝালো কন্ঠে বললাম-
: এই যে মি: কে আপনি? আমি হাসার তেমন কিছুই বলি নি আপনি হাসবেন। পরিচয় দিলে বলুন নাহলে আমি কাটছি।
: আরে, আরে..! ওয়েট এ মিনিট ম্যাডাম।
আমি ফোন কাটতে নিলে উনার কথায় আবার ফোনটা কানে নিতেই উনি আবার বললেন-
: প্রথমত, আগে বলুন কয়টা বাজে?
আমি উনার প্রশ্নে বিরক্তি নিয়ে ফোনের স্ক্রিনে চেক করে নিজেই লজ্জায় পরে যাই। কারন ফোনে তখন প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। উনি খানিকটা গম্ভীর হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন-
: কয়টা বাজে?
: সাড়ে আটটা।
: তো মিস তরুনিমা, আমার জানামতে আপনার অফিস দশটায়। সো সকাল সাড়ে আটটা আপনার জন্য ভোর নয়। আমি টাইম জেনেই আপনাকে ফোন দিয়েছিলাম। বাট ইট ওয়াজ মাই ব্যাড লাক। হোয়াটএ্যাভার, আমি পান্থ। আপনার মেহু ভাবির ফ্রেন্ড। এইবার চিনেছেন?
আমি উনার কথাগুলো শুধু শুনেই যাচ্ছি। কারন এখন উনার কথার পিঠে কথা বলার মতো যে কিছু বলবো তা আর খুঁজে পাচ্ছি না। উনি আমার নীরবতা দেখে আবার জিজ্ঞেস করেন-
: কি হলো চিনতে পারেন নি?
: না মানে জ্বি চিনেছি।
আমি তড়িৎ বেগে কথাটা বললে উনি আবারও হেসে দেন। আমি উনার হাসির শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেয়েও চুপ করে আছি। উনি আমাকে চুপ থাকতে দেখে নিজের হাসি থামিয়ে বললেন-
: একটু পর আমি আপনাকে পিক করতে আসবো। কারন জিজ্ঞেস করবেন না প্লিজ..! কারনটা আপনিও জানেন আর আমিও জানি। এন্ড ইয়েস কাইন্ডলি নাম্বারটা সেভ করে নিবেন। নইলে পরে আবার আপনি আমাকে ঝারি দিয়ে নিজেই লজ্জায় পরে যাবেন। খোদা হাফেজ।
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই উনি টুপ করে ফোনটা কেটে দেন। চোখ ডলতে ডলতে যথাসময়ে রেডি হয়ে হলরুমের দিকে আসতেই দেখি পান্থ সবার সাথে বসে গল্প করছেন। আমি উনার দিকে একবার তাকিয়ে আবার অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নেই। ব্রেকফাস্ট টেবিলে ব্রেকফাস্ট শেষ করেই উনি সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গিয়ে গাড়িতে বসেন এদিকে আমিও বের হয়ে উনার গাড়িকে সাইড ক্রস করতে নিলেই উনি গাড়ির গ্লাসটা নামিয়ে বললেন-
: এই যে মিস! আ…
উনার পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে বললাম-
: আপনি গাড়ি নিয়ে বাইরে আসুন আমি দাড়োয়ান চাচা সাথে কথা বলে আসছি।
উনি গাড়ি নিয়ে বাইরে যেতেই আমি দাড়োয়ান চাচার কাছে গিয়ে উনাকে দুই হাজার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম-
: চাচা আপনি অনেকদিন যাবত গ্রামে যাবেন বলছিলেন। এই টাকাটা রাখেন। চাচিকে আপনাদের সদর হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভালো একটা ডাক্তার দেখান। যদি বেশি সিরিয়াস কিছু হয় তাহলে ঢাকায় নিয়ে আইসেন। আমি যা ব্যবস্থা করার করবো।
টাকা প্রথমে নিতে না চাইলেও আমি পরে জোর করে দিয়ে দেই। দাড়োয়ান চাচা আজ পর্যন্ত নিজের আত্মসম্মানকে ছোট করে কারো কাছে কখনো হাত পেতে কিছু নেননি। উনি নিজের চোখ দুটো মুছে আমার মাথায় হাত রেখে অশ্রু ভেজা কন্ঠে বললেন-
: মাঝে মাঝে অনেক কষ্ট লাগে মা। সারাজীবন যেই ছেলেরে নিজের মাথার ঘাম পায়ে ফেইলা এতো বড় অফিসার বানাইলাম। মাইডারেও ভালো জায়গায় বিয়া দিলাম ভালো চাকরিও করে। হেই পোলা মাইয়াই আজকে আমগো চিনে না। টেলিফোন করলে কয় তারা নাকি অনেক ব্যস্ত। সময় নাই আমগো জন্য। আর ওইদিকে তোমার চাচি রোজ কান্দে। তুমি যে নিজের মাইয়া না হইয়াও যা করছো তোমার বাপ মা অনেক ভাগ্যবান গো। বাইচা থাকো মা।
চাচার কথাগুলো শুনে সত্যিই মনটা ভার হয়ে আসে। আমি গাড়িতে উঠে চোখের কোণে পানিটা আঙুল দিয়ে মুছতে নিলে পান্থ বিষয়টা লক্ষ্য করতেই জিজ্ঞেস করেন-
: আর ইউ ওকে?
: সন্তানের জন্য মা বাবা কতো কিছুই করে। আর যখন সন্তানের সময় আসে মা বাবার জন্য কিছু করার তখন সে অজুহাত খুঁজতে থাকে, মুখ ফিরিয়ে নেয় তাদের থেকে। বয়সের শুরুতে সন্তানেরা মা বাবার আশ্রয়ে থাকে আর শেষ বয়সে মা বাবার যখন আশ্রয়ের প্রয়োজন হয় তখন তাদেরকে পুরাতন আসবাবপত্রের মতো ফেলে দেয়া হয়।
আমি কথাগুলো অন্যমনা হয়ে বলে একটা ছোট শ্বাস ফেলে লক্ষ্য করি পান্থ আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে হালকা কাশি দিতেই উনি নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে গাড়ি ড্রাইভ করা শুরু করেন।
#চলবে____
#প্রিয়দর্শিনী🍂
#সুমাইয়া_যোহা
পর্ব-০৯
তরুনিমা প্রান্থকে অফিসের সামনে গাড়ি থামাতে বলে সে গাড়ি থেকে নেমে পান্থকে অপেক্ষা করতে বলে। প্রায় এক ঘন্টা পর তরুনিমা অফিস থেকে বেরিয়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে বসে বলল-
: আমি দুঃখিত এতোক্ষণ অপেক্ষা করানোর জন্য। চলুন এইবার। প্রথমে কোথায় ঘুরতে চান?
: আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন।
তরুনিমা অনেক ভেবেচিন্তে বলল-
: আমার অফিস থেকে মাধবপুর লেক প্রায় কাছাকাছি। প্রথমে ওখানেই যাওয়া যাক।
তরুনিমা আর পান্থ গাড়ি নিয়েই মাধবপুর টি-স্টেটের ভিতরে প্রবেশ করে। মাধবপুর টি-স্টেটের ভেতর গেলে মাধবপুর লেক যাওয়া যায়। মাধবপুর লেক সমতল ভূমি থেকে একটু উপরে। সবচেয়ে সুন্দর হলো এই লেকে চারপাশে পাহাড়। পান্থ আর তরুনিমা গাড়ি থামিয়ে লেকের দিকে এগিয়ে যায়। পান্থ লেকের দিকে অগ্রসর হতেই যেন চোখ দুটো বন্ধ করে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয়। চোখ খুলতেই পান্থ ওর পাশে তরুনিমাকে চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় দাড়িয়ে প্রকৃতির স্বাদ অনুভব করতে দেখে। পান্থ যেন তরুনিমার দিকে এক পানে তাকিয়ে আছে। পান্থ মনে মনে নিজের সাথেই বলল-
: যেই মায়াবিনী আর প্রাণোচ্ছল মেয়েটাকে কবর দিয়ে নিজেকে পাথর বানিয়ে রেখেছো আজ একটু হলে সেটাকে জীবন্ত করতে হবে আমায়। তোমাকে সেই আগের তরুনিমা আমিই বানাবো। এন্ড ইটস্ মাই চ্যালেঞ্জ!
তরুনিমা আঙুলের ইশারায় পান্থ মুখের সামনে তুড়ি বাজাতেই পান্থ যেন ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে একটা স্নিগ্ধ হাসি দেয়। পান্থর মাথায় হঠাৎ একটা অদ্ভুদ রকমের বুদ্ধি আসে। সে তার হাতের ঘড়ি, চোখের চশমা তরুনিমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে জুতো মোজা লেকের বামদিকে বসার জায়গা হিসেবে পাকা করে টুল আছে যেইখানে বসে লেকের চিত্র উপভোগ করা যাবে, সেই স্থানে খুলে রাখে। প্যান্টের নিচের অংশ বিশেষ গুটিয়ে এবং শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে পান্থ ছোট সিড়ি বেয়ে লেকের দিকে নামছে। তরুনিমা পান্থ ঘড়ি আর চশমাটা হাতে নিয়ে থ মেরে সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে চোখগুলো বড় বড় করে পান্থর কান্ড দেখছে। তরুনিমার হাঠৎ নিজের কথা মনে পড়ে যায় সেও একসময় লেক হোক পুকুর হোক এমন কোনো স্থানে গেলে নিজেও পা আর হাত ভিজাতো। অনেক সময় তো সেই পানিতে এলার্জি হয়ে যেত। তবুও যেন আবার সেই কাজটাই করতো। সে হঠাৎ করে লেকের দিকে সিড়ি দিয়ে নেমে পান্থকে গিয়ে বলল-
: আপনি কি বাচ্চা নাকি? বাচ্চাদের মতো পানি নিয়ে খেলছেন?
: প্রকৃতির সংস্পর্শে আসলে আমি বাচ্চাই হয়ে যাই বুঝলেন ম্যাডাম। আপনার মতো এডাল্ট ম্যাচিউর বিহেভিয়র আমার দ্বারা হবে না। আর দেখুন না এই লেকের পানিগুলো কতোটা স্বচ্ছ। পানির নিচে কি আছে তাও দেখা যায়।
পান্থ তরুনিমার এক হাত ধরে টান দিয়ে ওর পাশে বসাতে নিলে তরুনিমা তাল সামলাতে না পেরে লেকে পরে যেতে নিলে পান্থ দুইহাত দিয়ে ওকে ধরে। তরুনিমার যেন হুট করেই কলিজা পুরো শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হতে নিয়েছে। পান্থ একটা স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে আশ্বস্ত কন্ঠে বলল-
: চিন্তা করবেন না। আমি পাশে থাকতে এতো সহজে পরে যেতে দিব না।
পান্থর কথা শুনে তরুনিমা যেন রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে লেকের স্বচ্ছ পানির দিকে তরুনিমা অন্যমনা হয়ে বলল-
: পাশে থাকতে সবাই চায় তবে সামলে নেয়ার জন্য নিজেকেই নিজের পাশে থাকতে হয়। আমাদের সমাজ ঠিকই সমাজবদ্ধ কেউ কাউকে ছাড়া চলতে পারে না। তবুও দিনশেষে ঠিকই মানুষকে একা চলতে হয়। এই স্বার্থপর সমাজে সবাই শুধু আশ্বস্তটুকুই করতে পারে এর চেয়ে বেশি কিছু না।
তরুনিমা কথাগুলো শেষ করে একটা ছোট শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে আবার বলল-
: চলুন সামনে আগানো যাক। এখানে অনেকটা সময় কেটে গেছে। আরো জায়গা আছে দেখার।
তরুনিমা আস্তে আস্তে উপরে উঠছে। পান্থও বসা থেকে উঠে তরুনিমার পিছনে পিছনে লেকের নিচ থেকে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে বলল-
: ঠিকই বলেছো তুমি, তরু। এই স্বার্থপর সমাজে কেউ কারো জন্য নয়। তাই তো আমিও নিজ স্বার্থের জন্যই তোমার পাশে থাকতে চাই।
তরুনিমা পিছন ঘুরে পান্থর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
: আপনি কি কিছু বললেন?
পান্থ উপরে উঠে এসে তরুনিমার হাত থেকে চশমাটা চোখ পরে। তারপর ঘড়ি পরতে পরতে বলল-
: কিছু বললে তো শুনতেনই। নাকি আপনি আবার কানে কম শুনতে পান নাকি?
তরুনিমা ঝাঝালো কন্ঠে বলল-
: কানে কম শুনলে আপনাকে জিজ্ঞেস করতাম না যে আপনি কিছু বলেছেন নাকি! মেহু ভাবির কথায় রাজি না হলেই ভালো হতো। অসহ্য লোক একটা!
শেষের অংশটুকু তরুনিমা পান্থর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে করতে বললে পান্থ আবার তরুনিমার এমন আচরনে হেসে দেয়। আর তরুনিমার এইবার পুরো রেগে গিয়ে পান্থর দিকে রাগে গজগজ করতে করতে এগিয়ে এসে বলল-
: এই যে মি: আমাকে কি আপনার সার্কাসের জোকার মনে হয়? কোনো কারন ছাড়াই হু হা করে হেসে দেন!
পান্থ তরুনিমার দিকে ঝুকে নিজের ঠোঁটের কোণে থাকা হাসিটাকে আরো প্রসারিত করে ভ্রু নাচিয়ে বলল-
: আমার হাসিটা কি খারাপ নাকি? কিন্তু আমার দিদা বলে, আমার হাসিতেই নাকি মায়া আছে। যে দেখেই সেই এই হাসির মায়ায় জড়িয়ে যায়।
তরুনিমা পান্থর থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে নাকের নিচের ঘামটা মুছে তীক্ষ্ণ সুরে বলল-
: আপনার দিদা ভুল বলেছেন। আপনার হাসি চারশত বছর আগের ডাইনোসরের হুংকারের চেয়ে ভয়ংকর।
পান্থ যেন এইবার আরো জোরে জোরে হাসতে থাকে। পারলে ও এখন মাটিতে গড়াগড়ি করেও হাসতে পিছপা হবে না। তরুনিমার যেন পান্থ এমনভাবে হাসতে দেখে এখন মনে হচ্ছে নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়তে। তরুনিমা আর কোনো কথা না বলে সামনে দিকে অগ্রসর হয়ে হাটা শুরু করে। পান্থ হাসতে হাসতেই তরুনিমাকে উদ্দেশ্য করে জোরে জোরে বলল-
: হাসলে হার্ট ভালো থাকে ম্যাডাম। মনের ভিতর এক আলাদা প্রশান্তি পাওয়া যায়। ওই যে দেখুন, লেকের পার ঘেষে পাহাড়গুলোও কিভাবে হাসছে। আপনি যখন খুশি থাকবেন প্রকৃতিকেও মনে হবে যে সে খুশি আছে। আর আপনি যদি এইভাবে গম্ভীর একটা ভাব নিয়ে থাকেন তাহলে দেখবেন প্রকৃতিও গম্ভীর হয়ে আছে এমনটাই মনে হবে। তাই প্রাণখুলে হাসুন ম্যাডাম।
————————————————–
মাহিম অফিসের চেয়ারে হেলান দিয়ে তরুনিমার ফোনে ফোন দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তরুনিমার ফোন আনরিচেবল বলছে। সারা পাশের ডেস্কে বসে বারবার মাহিমের কার্যক্রম দেখে চলছে। তারপর একটা হতাশাজনক শ্বাস ফেলে নিজের কাজে মনোযোগ দেয়। একটু পর হঠাৎ মাহিম এসে সারা ডেস্কের সামনের চেয়ারে এসে বসে। সারা মাহিমকে ওর ডেস্কের সামনের চেয়ারে দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। মাহিম সারার ডেস্কের উপরে ডান হাত দিয়ে হালকা বারি মেরে সারার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
: আচ্ছা সারা আপনি বলতে পারবেন, তরুনিমা কি আমাকে ভালোবাসে?
মাহিমের প্রশ্নটি শুনে সারা মনের ভিতর যেন ঝড় শুরু হয়ে যায়। তার মনটা যেন ভেঙেচূরে চুরমার হয়ে গেছে। সে মাহিমের দিকে ছলছল চোখে তাকায় কিন্তু মাহিম সেইটা বুঝতে পারে না। মাহিম আবার জিজ্ঞেস করে-
: কি হলো বলছেন না কেন? আপনি তো উনার ছোট বোনের মতো। তরুনিমা কি অন্যকাউকে ভালোবাসে?
সারা কিছুই বলতে পারছে না। সব শব্দগুলো যেন দলা পাকিয়ে গলার মাঝে আটকে গেছে। কিছু বলতে পারছে না সারা। মাহিম আবারও জিজ্ঞেস করলে সারা নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে ফাইল ঘাটতে ঘাটতে বলল-
: আমি তরুনিমা আপুর ছোট বোনের মতো, ছোট বোন নয়। আর এতোই যদি জানার আগ্রহ থাকে তাহলে সরাসরি উনাকেই জিজ্ঞেস করবেন। আমাকে ম্যানেজার সাহেব ডেকেছেন। আমি আসছি।
সারা তড়িৎ বেগে ডেস্ক থেকে একটা ফাইল উঠিয়ে চলে যায়। মাহিম একটা হতাশজনক নিঃশ্বাস ফেলে নিজের ডেস্কে চলে যায়।
#চলবে____