#প্রিয়দর্শিনী🍂
#সুমাইয়া_যোহা
পর্ব-১৬
ব্যালকনির সাইডে ছোট ডিভানে পা গুটিয়ে বসে আছে পান্থ। পান্থর ব্যালকনিটা ছোটখাটো একটা কোনো কল্পনার রাজ্য বলা যায়। চারিদিকে গাছ, ডিভানের থেকে কিছুটা দূরে ডান দিকে ছোট একটা চারকোনা টাইলস দিয়ে তৈরি সুইমিং পুলের মতো বানানো। যেটাতে বিভিন্ন রকমের ছোট ছোট গোল্ড ফিশ ঘুরছে। পান্থ কফির মগে চুমুক দিচ্ছে আর আকাশের পানে তাকিয়ে আছে। ওর ব্যালকনি থেকে আকাশটা দেখতে বড় মিষ্টি লাগে। ব্যালকনি পেরুলেই যখন আরেকটু সামনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে বড় ছোট সম্মিলিট বিল্ডিং। তবে চারপাশে কোনো কোলাহলের আওয়াজ পাওয়া যাবে না। হুট করেই পান্থ আনমনে হেসে উঠে। ফোনের আওয়াজে ধ্যান ভাঙলে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে মাহিম ফোন করেছে। সে ফোনটা রিসিভ করেই খুব হাস্যজ্জ্বল কন্ঠে বলল-
: কেমন আছেন মি: মাহিম শাহরিয়ায় দ্য বস অফ “টি-টে” গ্রুপ? হা..হা..
: ফাজলামি করছিস?
পান্থ নিজের হাসিটা দমিয়ে কিছুটা চেপে বলল-
: মোটেও না।
: তা বেশ খুশি খুশি লাগছে। কোনো বিশেষ কারন?
মাহিমের উৎসুক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলে পান্থ ভাবলেশহীন কন্ঠে জবাব দেয়-
: সেইটা তোমার অজানা থাকার কথা নয়।
: ওহ! রিয়েলি? কিন্তু আমি তো কিছু জানি না। বাই দ্য ওয়ে একটা বলবি?
: হুম নির্দ্ধিধায় জিজ্ঞেস করতে পারো।
: তরুনিমার সাথে তোর কিসের সম্পর্ক? পছন্দ করিস নাকি ভালোবাসিস?
মাহিম কিছু জোরালো হয়ে কথাটা বললে পান্থ স্বাভাবিক কন্ঠেই বলল-
: তেমন কিছু না ভাইয়া। তবে কিছু একটা আছে সেইটা নাহয় সময় হলে জানতে পারবে। হঠাৎ ফোন দিলে যে?
: এমনেই ফোন দিলাম। হুট করে চলে গেলি যে। তোর সাথে তো কথার বলার সময়ও পেলাম না।
: চলে এসো। যেই কারনে ওই শহরকে এক বিন্দু পরিমাণও ছেড়ে আসতে পারছো না আদৌ কি সেই কারনটার হদিস খুঁজে পাবে?
: খুঁজে না পেলেও সেই কারনটাই যে আজ সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছে। সব কিছুর উপর থেকে মায়া কাটানো সম্ভব। তবে ভালোবাসার মানুষটির প্রতি যদি একবার মায়া জন্মে যায়,হোক সেই মানুষটি সাময়িকের! তবুও সেই মায়া কাটানোর চেষ্টা চালানো বৃথা মাত্র।
মাহিম কথাগুলো খুব শান্ত কন্ঠে বলে। পান্থ নীরবে কথাগুলো শুনে স্মিত হাসে। মাহিম পান্থর সাথে কথা শেষ করে ফোনটা রেখে দেয়ার পর সে একটা ছোট শ্বাস ফেলে ডান হাতে ব্লেজারটা উঠিয়ে বাম হাতের বাহুর উপর ব্লেজারটা রেখে গাড়ির চাবি নিয়ে অফিস থেকে বের হতেই তরুনিমার প্রবেশ ঘটে অফিসে। তরুনিমাকে এমন সময় দেখে চমকে যায় মাহিম।
——————————————————
স্টেশনে এসে ট্রেন থামলে ঘুম ঘুম চোখে বাহিরে তাকাতেই দেখি আমার গন্তব্যস্থল। কখন যে চোখজোড়ায় ঘুম নেমে এসেছিল তা আন্দাজ করতে পারিনি। অবশেষে আবার সেই শহরে এসে পরলাম যেই শহরে কখনো ফিরে না আসার জন্য নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছিলাম। ট্রেন থেকে নেমেই দেখি অন্তু আর বাবা হাস্যজ্জ্বল চেহারা দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্য। বাবার চেহারা অন্যবারের চেয়ে আজকে অনেকটা উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। হয়তো তার মেয়ে তরু যে এই শহরে সাময়িকের জন্য হলেও ফিরে এসেছে তাই ভেবে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছেন। অন্তুও বেশ খুশি। কিন্তু আমার যে মনের ভিতর বিন্দু পরিমাণ আনন্দ বিরাজ করছে। একরাশ শূণ্যতা এসে যেন ঘিরে ধরছে। আবার সেই শহরে আসতে যেই শহরে নিজের সবচেয়ে কাছের দুটি মানুষের কাছ থেকে পেয়েছিলাম ছলনা আর বিশ্বাঘাতকতা। কোনো কিছু হারিয়ে গেলেও বুঝি এতোটা কষ্ট অনুভব হয়না, যতোটা না বিশ্বাস ভাঙলে হয়। তবুও পারতে হবে আমাকে! নিজের জন্য না হলেও নিজের পরিবারের জন্য।
বাসায় প্রবেশ করতেই দেখি মামা-মামিমনীরা সবাই এসে হাজির। সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় করে নিজের ঘরে প্রবেশ করা মাত্র দেখি সবকিছু সেই আগের মতো গোছানো আছে। শুধু বিছানার চাদরটুকু বদলানো হয়েছে। বাসায় দুটো ব্যলাকনি রয়েছে। নিজের ঘরের ব্যালকনির দরজা খোলার পরে যেন সেই পুরোনো স্মৃতি জেকে বসে মাথায়। ব্যালকনির পেরিয়ে সামনে তাকাতেই প্রশস্ত সেই রাস্তা দেখে একজনের দাঁড়িয়ে থাকার অবয়ব ভেসে উঠে চোখের সামনে। যদিও সেই অবয়ব শুধু কল্পনাতে রয়েছে। চোখগুলো যেন আবারও ঝাপসা হয়ে আসতে শুরু আমার। উপরের দিকে তাকিয়ে চোখের পানিগুলো যেন আটকে রাখার চেষ্টা চালিয়ে নিলাম। দরজায় কারো কড়া নাড়াতেই একপা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করতেই দেখি তৃষা মিষ্টি হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তৃষাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই দুই হাত মুঠ করে সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল-
: তরু এই দুটো যেকোনো একটা ধরো তো! তাড়াতাড়ি!
আমি তৃষার কথামতো বাম হাত স্পর্শ করতেই সে হাতে মুঠটা খুলে দিতেই দেখি ওর হাতের মুঠোয় একটা নুড়ি পাথর। সে একটা বিশ্বজয়ের হাসি হাসলো। তার হাসি যেন থামার কোনো নাম নেই। আর আমি হ্যাবলার মতো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি। আমাকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তৃষা নিজের হাসি থামিয়ে বলল-
: তরু আপু অন্তু ভাইয়ার সাথে বেট দিয়েছিলাম যদি তুমি নুড়ি পাথরটা যে মুঠে আছে ওই মুঠটা ধরলে অন্তু ভাইয়া আজকে আমাদের সবাইকে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াবে। সে নাকি খুব ভালো রান্না জানে!
আমি চোখদুটো বড় বড় করে তাকিয়ে আছি। আর অন্তু দরজার ওপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমার জানামতে বাবা আর ওর রান্না বুয়া করে দেয়। আর অন্তু যদি রান্না ঘরে যায় তাহলে রান্না আর রান্না ঘর থাকবে না। একটা ছোটখাটো যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে। অন্তু মাথা আস্তে আস্তে কেটে পরতে নিলেই ইশান ওকে খপ করে ধরে ফেললে অন্তু আমার দিকে অসহনীয় দৃষ্টিতে তাকায়। বেচারার জন্য বড্ড খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। চাপাবাজি করতে গিয়ে ভালোমতো ফেসে গেছে।
দুপুরে সবাই গোল হয়ে মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বসেছি খাওয়ার জন্য। এই জিনিসটা খুব মজার। মাদুর পেতে সবাই একসাথে বসে খাওয়াতে যেন এক আলাদা তৃপ্তি পাওয়া যায়। শুধু খালামনিরাই মিসিং। খালি প্লেট নিয়ে এক ঘন্টা যাবত বসে আছি অন্তুর স্পেশাল ডিশের জন্য। অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হতে শুরু করলে নিজে উঠে কিচেনে যেতেই চোখদুটো যেন ছানাবড়া হয়ে গেছে। অন্তু এখনো চপিং বোডে সবজি কাটছে। তাও সবজি কাটছে নাকি মাংস কাটছে তা বুঝতে আমার কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে যায়। অন্তুর সামনে গিয়ে দুই হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলি-
: আজকের রাত শেষ হয়ে ভোর হয়ে যাবে তবুও তোর শেষ হবে নারে অন্তু। তোর এক চাপাবাজির কারনে এখন সবাই ক্ষুধার্ত থাকবে। দেখি সর! আর যা গিয়ে ফ্রিজ থেকে ডিম নিয়ে আয়।
অন্তু ঠোঁট উল্টে ছোট ছোট চোখ করে মাথা চুলকাতে চুলকাতে আমার হাতে ডিম এনে দেয়। তারপর আর কি চটজলদি অন্তত ডিমভুনা করে অন্তুর হাত দিয়ে পরিবেশন করি। সবাই খেয়ে অন্তুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ করলে বাবা খুব গম্ভীর হয়ে অন্তুকে বলল-
: তা অন্তু রান্না তো খুব চমৎকার করেছো। তবে তরুর মতো ডিমভুনা রান্না করা কবে শিখলে?
নিজের মেয়ের হাতে রান্না এতো মাস পর খাওয়ায়ও বাবার একটুখানিও চিনতে ভুল হলো না দেখে অবাক হলাম আমি। অন্তু মাথা নিচু করে বসে আছে। আমি কিছু বলতে নেয়ার আগে সে সবটা খুলে বলে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। সবাই ওকে কিছুটা হলেও বকাবকি করলে অন্তু চুপ করে সবটা হজম করে নেয়। কাউকে কিছু বলে না। কিন্তু অন্তুকে এমনভাবে বকাবকি করায় মোটেও ভালো লাগল না। তাই বেশ জোরালো কন্ঠে বললাম-
: মানছি অন্তু ভুল করেছে। কিন্তু তাই বলে ওকে তোমরা এইভাবে বকাবকি করতে পারো। ও তো নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। ওকে এতো কথা না শুনিয়ে ক্ষমা করে দাও তোমরা।
: অন্তুকে আমরা বকছি না। অন্তু ভুল করেছে তাই ওকে আমরা বুঝাচ্ছি। ওর কি করা উচিত হয়েছে? এখন যদি তুমি ডিমভুনাটা রান্না না করতে তাহলে সবাইকে না খেয়ে থাকতে হতো।
: অন্তু ভাইয়া ভুল করেছে সেখানে তুমি ওকে কিছু না বলে তরু আপু তুমি উল্টো অন্তু ভাইয়ার সাপোর্ট নিচ্ছো। ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করছো।
: দেখো তৃষা প্রথমত অন্তুকে আমি বাঁচানোর চেষ্টা করছি। আর অন্ঢ় আমার ছোট ভাই। ওর বড় বোন হিসেবে আমার কর্তব্য ও যদি ভালো কিছু সেইটাতে এপ্রিসিয়েট করা। আর যদি ভুল কিছু করা তাহলে সেটাতে অনুতপ্ত করানো। আর ও যে অনুতপ্ত তা তুমি আমি এখানের সবাই বুঝতে পেরেছে। আর অন্তু অনুতপ্ত থেকে ক্ষমা চেয়েছে। আমাদের উচিত ওকে এতো কথা না শুনিয়ে ওকে ক্ষমা করে দেয়া এবং পরবর্তীতে এমন কোনো মিথ্যে বা চাপাবাজি না করে সেইটা থেকে সতর্ক করে দেয়া। কারন এসবের ফল কখনোই ভালো কিছু বয়ে নিয়ে আসতে পারে না। আর সাপোর্টের কথা যদি বলো তোমরা তাহলে যতো কিছুই হয়ে যাক না কেন! অন্তুর তরু আপু ওর পাশে ছায়ার মতো থাকবে সবসময়। ভুল হলে শুধরে দিব প্রয়োজনে শাসন করবো কিন্তু আমার ভাইয়ের মাথার উপর থেকে ওর বড় বোনের ছায়া সর্বদা থাকবে। সেইটা কেউ সরাতে পারবে না।
সবাই যেন চুপ হয়ে যায়। কারো আর কোনো কিছু বলার সাহস থাকে না। অন্তু আমার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। আর বাবা আড়ালে যেন একটা মৃদু হাসি দিলেন।
বিকালের দিকে অন্তুর জন্য খাবার নিয়ে ওর ঘরে গিয়ে দেখি অন্তু কাবার্ডের একপাশে গুটিশুটি দিয়ে বসে আছে। অন্তুকে এই অভ্যেসটা আজও পরিবর্তন হয় নি। ওকে যখন কেউ বকাবকি করতো তখন কাউকে কিছু বলবেনা সে চুপচাপ এসে গুটিশুটি দিয়ে ওর প্রিয় জায়গা কাবার্ডের চিপায় বসে থাকবে। খাবারটা ওর বেডের উপর রেখে ওর সামনে দিয়ে বসতেই ও চমকে যায়। আমি মৃদু হেসে বললাম-
: তা আমার ছোট ভাই কাবার্ডের চিপায় বসে কি করছে?
অন্তু কোনো জবাব দিল না। আমি ওর মাথা হাত বুলিয়ে বললাম-
: মন খারাপ?
অন্তু এবারও চুপ করে রইল। আমি বেডে থেকে খাবারের প্লেটটা নিয়ে ভাত মেখে ওর মুখে সামনে ধরতেই ও আমার দিকে স্নেহার্ত চাহনি নিক্ষেপ করে আছে। আমি ওর মুখে লোকমা দিয়ে ভাতগুলোকে মাখতে মাখতে শান্ত কন্ঠে বললাম-
: তুই তখন অল্প খেয়ে চলে এসেছিলি তাই খাওয়াতে আসলাম।
অন্তু আমার দিকে চোখগুলো ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। আমি খাবারের প্লেটটা এক পাশে রেখে ওর এক হাত ধরে বললাম-
: অন্তু যেটা হয়ে গেছে সেটা হয়ে গেছে। সেটা নিয়ে কখনো মন খারাপ করে বসে থাকবি। যদি সেটা নিয়ে মন খারাপ থাকিস তা।লে পরের সময়গুলো নষ্ট হবে।তুই যেহেতু তোর ভুল বুঝতে পেরেছিস তাই তোর মনে একটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা থাকতে হবে যে পরবর্তীতে এমন কোনো কাজ করবি না যেন কেউ তোর দিকে আঙুল তুলতে পারে।
: হুমম। তোমার মনে আছে তরু আপু যখন আম্মু আমাকে বকতো তুমি এইভাবে আমাকে বুঝাতে, আমি মন খারাপ করে না খেলে আমাকে খাইয়ে দিতে? আর সেইজন্য আম্মুর চেয়ে বেশি আমি তোমাকে আমার আপনজন ভাবতাম। আম্মু সবসময় বলতো যে “আমি তোর কে? তোর তরু আপুই তোর সব!” জানো আপু যখন আম্মু হুট করে চলে যায় তখনও ততোটা একা লাগতো না কারন তমুই ছিলে আগলে রাখার জন্য। কিননতু যখন তুমি চলে গেলে আমার অনেক একা লাগতে শুরু করে। রোজ তোমার ঘরে এসে তোমার জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে রেখে আসতাম। যাতে তুমি যখন আবার ফিরে আসবে তখন যেন মনে না হয় যে তোমার ভাই তোমার ঘরটা অপরিচ্ছন্ন রেখে গেছে।
: দূরে ছিলাম তারমানে এই নয় যে তোর বোন তোর পাশে নেই। সবসময় ছিলাম আছি এবং থাকবো। এখন চুপচাপ খেয়ে নে তো। নইলে ওই বিচ্ছুগুলো আসলে হামলে পরবে।
অন্তু আমাকে হুট করে জড়িয়ে ধরে বলল-
: সবার ভাগ্যে বড় ভাই বোন থাকে না। কিন্তু আমি অনেক লাকি আপু যে আমাকে উপরওয়ালা একটা বড় বোন দিয়েছেন যে আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমিও তোমাকে অনেক অনেক ভালোভাসি তরু আপু। অনেক বেশি।
: আমিও অনেক লাকি যে আমার এমন একটা ছোট ভাই আছে। আর আমার ছোট ভাইটাকে আমিও সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। এইবার সব আহ্লাদ বাদ খাওয়া শেষ কর।
আমি অন্তুকে খাইয়ে দেয়ার সাথে সাথে সে নিজেও আমার মুখে খাবার তুলে দেয়। হঠাৎ খেয়াল করি যে বাবা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে চোখ মুছেন। আমি বিষয়টি খেয়াল করেও না বুঝার চেষ্টা করি।
#চলবে____
#প্রিয়দর্শিনী🍂
#সুমাইয়া_যোহা
পর্ব-১৭
প্রায় অনেকদিন কেটে গেছে। তরুনিমা যেই ডিলটা ফাইনাল করার জন্য সেটার কাজও প্রায় অর্ধ শতাধিক শেষ। যতো দ্রুত সম্ভব ও ওর কাজগুলো শেষ করে বিদায় নিতে চায় এই শহর থেকে। কাজ শেষ করে ল্যাপটপ অফ করেব্যালকনিতে চলে যায় তরুনিমা। ব্যালকনি পেরিয়ে বড় বড় বিল্ডিংগুলোর বাসাতে এখনো আলো জ্বলজ্বল করছে। এই ব্যস্ত শহরের মানুষগুলোও অনেক ব্যস্ত থাকে। কারো জন্য কারো দু-দন্ড সময় নেই। সবাই শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। সময়ের সাথে সবাই তাল মিলিয়ে চলে যাচ্ছে। তরুনিমাও সময়ের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে নিজের সামনে এবং পিছনে শক্ত দেয়াল তৈরি করে ফেলেছে যাতে নতুন করে কেউ যদি আঘাত দিতে চায় সেইটা আর সম্ভব হবে না। নানা রকম কথা ভাবতে ভাবতেই সে আনমনে বলে উঠে-
: “কোনো এক শেষ বেলায়;
এই শহরে হয়েছিল,
তোমার আমার বিচ্ছেদ।
নিয়তির ব্যবধানে,
তোমার পাশে আজ অন্যকেউ;
আমার পাশটা ফাঁকা।”
🍂সুমাইয়া যোহা🍂
একটা ছোট শ্বাস ফেলে সে। এই দীর্ঘশ্বাসে কতো মানুষের কতো শত অভিমান, কষ্ট, অনুতাপ প্রভৃতি লুকায়িত থাকে তা কেবল সেই মানুষটাই জানে। ঘরে দিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই লক্ষ্য করে আননোন নম্বর থেকে অনেকগুলো মিসড কল পরে আছে। সে কল ব্যাক করতে চেয়েও করে নি। হয়তো ইচ্ছে নেই। ফোনটাকে রেখে সে গুটিসুটি দিয়ে গায়ে চাদর দিয়ে শুয়ে পড়ে।
সূর্যের আলো যখন ব্যালকনি ভেদ করে ওর ঘরে এসে উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু চটজলদি উঠে যায় তরুনিমা। উঠেই ঘুম ঘুম চোখে চারিদিকে তাকাতেই বেড পেরিয়ে দেয়ালের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে তার চোখগুলো বড় বড় হয়ে যায়। বড্ড বেশি দেরি হয়ে গিয়েছে আজ। তরুনিমা কখনো এতো ঘুমায় না। যদিও তার রাত আজও নির্ঘুমে কেটে যায়। এই এক বছরে বোধহয় কয়েকটি রাতই সে ঘুমাতে পেরেছে। আজকেও কখন ঘুমিয়ে গেছে তা সে জানে না। বিছানা ছেড়ে উঠে সোজা ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নেয় সে। হাতে ঘড়ির চেইন আটকাতে আটকাতে সে বাসার পেরিয়ে বেরুতে নিলেই কবির হাসনাত তাকে থামিয়ে দেয়। কবির হাসনাত নিউজ পেপারে মুখ গুজে থাকা সত্ত্বেও নিজের মেয়ে পাওয়ার আওয়াজ ঠিকই লক্ষ্য করেছেন। নিউজ পেপারটা এক পাশে রেখে চেহারায় এক প্রকার গাম্ভীর্যতা এনে বলেন-
: না খেয়ে কোথায় যাচ্ছো? তাড়াতাড়ি গিয়ে খেয়ে নাও। আর যদি খেতে ইচ্ছে না করে খাবার টেবিলে একটা ছোট বক্স আছে ওইটা নিয়ে যেও। পরে সময় করে খেও। আনডার্সট্যান্ড?
তরুনিমা শুধুই মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বক্সটা বেগে নিয়ে চলে যায়। তরুনিমার বাড়ি থেকে মেইন রাস্তা অনেকটা দূরে। আর এইদিকে শুধু রিক্সা ছাড়া আর কিছুই চলাচল করে না। কিন্তু আজ বোধহয় রিক্সা মামারা তরুনিমাকে তার রিক্সায় তুলবে না বলে পণ করে বেরিয়েছে। উপর থেকে এতোটাই প্রখর রোদ উঠেছে আজ যে দাঁড়িয়ে থাকাটাও কষ্টের। তাই সে ঠিক করে হেটে মেইন রাস্তায় যাবে। মেইন রাস্তায় যেতে ওর শরীর যেন থেমে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আধঘন্টা রোদে দাঁড়ানো পর অবশেষে সে একটা সিএনজি খুঁজে পায়। অফিসের সামনে যেতে হুট করে পেছন থেকে একটা প্রাইভেট ধাক্কা দিয়ে বসে। আমাদের দেশের মানুষদের একটা স্বভাব খারাপ আছে যদি ভুল করে তাহলে তা ক্ষমা না চেয়ে সেখানেই তর্কাতর্কিতে শুরু করে দিবে। প্রায় ছোটখাট একটা জ্যামেরও সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। তরুনিমা বিষয়টা মিটমাট করার চেষ্টা করেও যখন ব্যর্থ হয়ে গেছে তখন সে সিএনজি মামাকে ভাড়া মিটিয়ে বাকি রাস্তাটুকু হেটে যাওয়ার প্ল্যান করে। কিন্তু তা যে শরীরটা সায় দিচ্ছে না। তরুনিমা মাথা ভনভন করে উঠছে। চারিদিকে ঘোলা ঘোলা লাগছে। সে সাবধানতা সাথে রাস্তা পার হতে নিলে একটা প্রাইভেট কার যেন তার দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু সে যে আর সামনে এগুতে পারছে। পুরো পৃথিবী যেন এখন ঘুরতে শুরু করেছে তার।
—————————————————–
পান্থর বিভাগের অন্যান্য ডক্টরদের সাথে মিটিং শেষ করে নিজের চেম্বারে এসেই খেয়াল করে যে ওর টেবিলের উপর একটা ছোট বক্স আর তার উপর একটা স্টিকি নোট লাগানো। সে বক্সটা নিয়ে স্টিকি নোটের উপর ছোট ছোট করে লিখা “তোমাকে নিরাশ আমি কখনোই করতে চাইনা, তোমার জন্য।” পান্থ লেখাগুলো কার সেইটা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু লেখাগুলো মানে বুঝতে না পেরে বক্সটা খোলার সাথে সাথেই তার মুখে যেন একটা হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু এদিক সেদিক তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করেও খুঁজে না পাওয়ায় বক্সটা হাতে নিয়েই বেরিয়ে যায়।
শরীরে স্যালাইনের ক্যানেল লাগিয়ে হসপিটালের বেডে শুয়ে আছি। তখন রিন্তা নামের সেই মেয়েটা না থাকলে হয়তো এতোক্ষণে পুরো সড়কে আমার রক্ত মেখে একাকার হয়ে যেত। কিছুক্ষণ পর রিন্তা এসে আমার পাশে বসে জিজ্ঞেস করে-
: কেমন আছেন তরু আপু, এখন?
এইভাবে আপু ডেকে সম্বোধন করায় খানিকটা চমকে উঠি আমি। তারপর চারপাশে একনজর তাকিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করি-
: আগের চেয়ে বেটার। কিন্তু.. তরু আপু?
: জ্বি। কারন আপনি আমার বয়সে আর আপনার ফাইলগুলো চেক করেছি আমি। অফিস থেকে ফোন এসেছিল তখন জেনেছি আপনার নাম তরুনিমা হাসনাত। তাই শর্ট করে তরু আপু ডেকেছি। আপনি মেইবি অফিসে যাচ্ছিলেন বাট রাস্তায় সেন্সলেস হয়ে গাড়ির নিচে পড়তে নিয়েছিলেন তখন আমিই আপনাকে ধরে নিয়ে আসি। ডিহাইড্রেশনের জন্য এমনটা হয়েছে। এখন আপনি রেস্ট নিন আর প্লিজ জাস্ট কল মি তুমি এন্ড মাই নেইম ইজ রিন্তা, রিন্তা শিকদার।
: থ্যাংকস আ লট আমাকে বাঁচানোর জন্য। তোমাকে অনেকটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিলাম তাই না?
: মোটেও না! এইটা আমার কর্তব্য। আর আমি একজন ডক্টর। তাই একজন ডাক্তারের প্রধান ধর্ম হচ্ছে মানুষের সেবা করা আর তার জীবন বাঁচানো। আমি সেটারই চেষ্টা করছি। তাই নিজেকে গিল্টি ফিল করানোর কোনো প্রয়োজন নেই। যদিও এখনো মেডিকেলের স্টুডেন্ট ডাক্তার হতে এখনো ঢের বাকি।
: কয় বছর?
: এই… পুরোপুরি ডাক্তার হিসেবে বের হতে আরও দুই আড়াই বছর বাকি আছে।
: ইনশাআল্লাহ তুমি একজন ভালো ডাক্তার হবে। যার ভিতর মানুষের সেবা করার জন্য নিজেকে সপে দেয়ার মনোভাব আছে সে অবশ্যই একজন ভালো ডাক্তার হতে পারবে।
আমি রিন্তাকে অনেকটা আশ্বস্ত করে কথাগুলো বললে সে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল-
: ইনশাআল্লাহ! এখন আপনি রেস্ট নিন আপু।
: আপুও ডাকলে আবার আপনিও বলছো। আমাকে তুমি করে বলো প্লিজ!
আমি রিন্তাকে চিকন সুরে বলি-
: আচ্ছা। রেস্ট নাও। আমি একটু পর আবার দেখে যাবো।
রিন্তা স্মিত হেসে চলে যেতে নিলেই পান্থ আমার কেবিনে প্রবেশ করে। উনি আমাকে এইভাবে দেখে উনার মুখে যেই ছোট্ট একটা হাসি ঝুলে ছিল সেইটা যেন বিলীন হয়ে যায়।
পান্থ ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রিন্তাকে ডাকার জন্য কেবিনে ঢুকতে তরুনিমাকে হুট করে এমনভাবে দেখে যেন বাকহীন হয়ে পড়ে। রিন্তা ওর আঙুল দিয়ে তুড়ি বাজাতেই ও ঘোর থেকে বেরিয়ে এসে কেবনিএর ভেতর প্রবেশ করে সামনে অগ্রসর হয়ে তরুনিমার দিকে তাকিয়েই রিন্তাকে জিজ্ঞেস করে-
: উনি এখানে কেন? কি হয়েছে ওনার?
: তুমি চেনো ওনাকে?
: সে আমার ফ্রেন্ড মেহুর ননদ তরুনিমা হাসনাত। উনি এখানে কি করছে?
রিন্তা সবকিছু খুলে বলার পর পান্থ কোনো রেসপন্স করে নি। সে তরুনিমার দিকে তাকিয়ে আছে। তরুনিমা মাথা নিচু করে আছে। ও কোনোমতেই পান্থর দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছে না। অন্যসময় হলে কিছু একটা বলে দিত। কিন্তু এখন কেন পারছে না সেইটা ও নিজেও জানে না। পান্থর নিজের উপর যেন খুব রাগ হচ্ছে সে কোনো কিছু না বলেই চলে যায়। রিন্তা কোমরে হাত গুজে দিয়ে বলে-
: এইটা কি হলো? পান্থ কোনো কিছু না বলে এভাবে চলে গেল কেন?
রিন্তার কথা শুনে আমি মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে পান্থ নেই। উনি এইভাবে কোনো কিছু না বলে চলে যাওয়াতে কিছুটা অভিমান হলো আমার। কিন্তু উনার সাথে তো আমার কোনো সম্পর্ক নেই। উনি কিছু বললেও কি আর না বললেও কি? তবুও কোথাও একটা চাপা অভিমান সৃষ্টি হলো। তার চেয়ে বড় কথা উনি এখানে কি করছেন? রিন্তা আর উনার কথোপকথনে মনে হলো পরস্পরকে চিনে। পরে রিন্তাকে জিজ্ঞেস করলে সে আমাকে ওর আর পান্থর ব্যাপারটা খুলে বলে। আমার সেদিকে মাথাব্যথা নেই। মাথাব্যথা এইখানে উনি যাতে বাসায় কাউকে কিছু না সেইটাই আগে সিউর হতে হবে। রিন্তাও কেবিন থেকে চলে যাওয়ার পর খেয়াল করি পান্থর হাতে একটা বক্স দেখেছিলাম সেইটা উনি এখানেই আমার বেডে রেখে চলে গেছেন। কৌতূহল বশত বক্সটা খুলতেই যা দেখি তাতে বিন্দু পরিমাণও অবাক লাগে নি আমার।
#চলবে____
(বাস্তবিকতা ও কাল্পনিকতার সংমিশ্রনে গল্পটি সাজানো। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গুড লাক।)