#প্রিয়দর্শিনী🍂
#সুমাইয়া_যোহা
পর্ব-০১
: আ’ম স্যরি তরু। আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না। আমার পরিবার কখনোই তোমাকে মেনে নিবে না। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। আগামী মাসের প্রথম তারিখে আমার বিয়ে।
প্রিয় মানুষটার মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি। সাড়ে চার বছরের সম্পর্ক আমাদের। আজ পর্যন্ত কখনোই এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যার জন্য আজকে নুহাশ এমন একটা সাংঘাতিক কথা আমাকে বলে দিল। আচ্ছা ওর কি বিন্দু পরিমাণও খারাপ লাগছে না কথাটা বলতে? ওর কি কষ্ট হচ্ছে না এইটা বলতে? এক অসহ্য ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। বাকরুদ্ধ হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আমি ওর দিকে। নুহাশ আমাকে কিছুটা ঝাকুনি দিতেই আমি ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলাম। নুহাশ আমাকে ঝাকিয়ে আবার বলা শুরু করল-
: তরু….! তুমি কি আমার কথা শুনতে পারছো!? আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না…! আমার পরিবার এই বিয়েতে রাজি নয়। আর আমি আমার পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না!
নুহাশের কথাগুলো আমার কান অবদি পৌঁছালেও যেন নিজেকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করাতে পারছি না। আমি নুহাশের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকেই জিজ্ঞেস করলাম-
: আজ সম্পর্কের সাড়ে চার বছর পর মনে পড়লো যে তোমার পরিবার আমাকে মেনে নিতে পারবে না। তোমার পরিবার আমাদের বিয়েতেও রাজি হবে না। আচ্ছা সত্যি করে একটা কথা বলবে নুহাশ? তুমি কি আমাকে সত্যিই ভালোবেসেছিলে?
নুহাশ আমার থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলল-
: এখন এসব প্রশ্নের কোনো মানেই হয় না। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। আর সাড়ে চার বছরের সম্পর্কের জন্য কি আমি নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে চলে যাবো নাকি?! কোনো একটা ভালো ছেলে দেখে পরিবারের কথায় বিয়ে করে নিও। আমি আসছি। আশা করি আর কখনোই আমাদের যোগাযোগ হবে না। ভালো থেকো তুমি তরু।।
নুহাশ চলে গেল। ওকে আটকানোর জন্য ভীষণ ভাবে ইচ্ছে করছে কিন্তু পারছি না। পারছি না তাকে জড়িয়ে ধরে বলতে যে আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি যে তোমাকে ছাড়া বড্ড একা হয়ে যাবো। তার যাওয়ার দিকে পলকহীন ভাবেই তাকিয়ে রয়েছি। আমি এখনো সেখানে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। পায়ের নিচের মাটি যেন সড়ে গিয়েছে আমার। হাটার বিন্দুমাত্র কোনো শক্তি যেন খুঁজে পাচ্ছি না। প্রিয় মানুষটার সুখী হওয়াতে খুশি হবো নাকি নিজের ভালো থাকার যেই কারনটা ছিল সেইটা হারিয়ে যাওয়ায় কাদবো? তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না।
———————————-
চারিদিকে যেন ফাগুনের স্নিগ্ধ বাতাস বয়ে চলছে। সবাই বসন্ত বরনে ব্যস্ত। গাছে গাছে নতুন সজীব পাতা গজাবে নতুন ফুল ফুটবে। কিন্তু একজনের গাছে যেন নতুন ফুল ফুটা তো দূরের কথা যেই কটা সজীব পাতা গজিয়ে উঠার ছিল তাও যেন ঝড়ে গেছে। আর সে হলো তরুনিমা। তরুনিমা এখনো পাথরের মূর্তির ন্যায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তরুনিমা ওর মা বাবার অনেক আদরের মেয়ে। তরুনিমার বাবা কবির হাসনাত সবেমাত্র সরকারি চাকরী থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। ছয় মাস আগে তরুনিমার মা মারা যায়। অনেক কষ্টে নিজেকে তখন সামলে নিয়েছিল সে। তরুনিমা কখনোই নিজের কষ্ট কাউকে বুঝতে দেয় না। তরুনিমাকে দেখলে মনেই হবে সে অনেকটাই প্রানচঞ্চল মেয়ে। যখন ওর মা মারা যায় তরুনিমা অনেকটাই শক্ত ছিল যা দেখে তরুনিমার বাবা নিজেকেও সামলে নিয়েছিলেন। তরুনিমার ছোট একটি ভাই আছে, যে এবার কলেজের গন্ডি পেরিয়ে সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, নাম অন্তু। তরুনিমার পড়াশোনার প্রায় শেষের দিকে।
নুহাশ আর তরুনিমার সম্পর্কটা কারোই অজানা ছিল না। এমনকি নিজের পরিবারেরও না। ও তরুনিমাকে বলেছিল ওর পরিবারের সাথে তাকে দেখা করাবে। নুহাশ একটা ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত। গতকাল রাতেও নুহাশের সাথে যখন তরুনিমা ফোনে কথা বলে সবকিছু স্বাভাবিকই মনে হয়েছিল তার। তরুনিমা আজকে সুন্দর করে সেজেগুজেই নুহাশের সাথেদেখা করতে গিয়েছিল। ওর সাজটা যথেষ্ট সাদামাটা হলেও ওর সাদামাটা সাজই ওকে যেন সবার থেকে আলাদা এবং অতুলনীয় করে তুলে। মায়ার্ত বড় বড় মারবেলের মতো চোখ। আবার ঠোঁটের বাম দিকে থুতনির খানিকটা উপরে ছোট একটা তিল। নুহাশ ওকে সাদামাটা এমন রূপেই নিজের মাঝে আয়ত্ত করেছিল। সেইটা নুহাশ নিজে মুখেই ওকে বলেছিল। নুহাশ কিন্তু হঠাৎ এমন ঝড় যে তার সব ওলট পালট করে দিয়ে চলে গেল। ও যে ভিতর থেকে একেবারে দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে সেইটা যে কেউ দেখতে পারছে না। সত্যিকারে ভালোবাসায় কি এতোটা কষ্ট পেতে হবে তা বুঝি ওর আর আগে জানা ছিল না। জনসমাবেশের লোকচক্ষুর আড়ালে চোখের কোণায় জমে থাকা জলগুলো যখন গাল বেয়ে নেমে যেতে নিয়েছিল সেটা সে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে খুব সাবধানতার সাথে মুছে খানিকটা সাহস জুগিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
—————————————
রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে আস্তে আস্তে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছি। সিড়িগুলোও যেন আজকে বিশাল বিশাল পাহাড়ের সমান মনে হচ্ছে আমার। কোনোমতে ধীরস্থির হয়ে অবশেষে নিজের বাসার দরজায় কলিং বেল বাজাতে নিয়েও একটু থেমে নিলাম। নিজের মনের ভিতর চলতে থাকা ঝড়টাকে বাবা আর অন্তুর সামনে আনলে যে তারা ভেঙে পরবে তার জন্য নিজেকে সামলে নিলাম। কারন আমাকে আমার বাবা আর অন্তু এইভাবে দেখলে তারা নিজেরা অনেকটা কষ্ট পাবে। আর আমি সেটা কখনোই পারবো না। অবশেষে দরজায় কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে অন্তু আমাকে একপ্রকার জড়িয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পরে। আমাকে ধরে লাফাতে থাকে। আমি অন্তুকে ধরে নিজের থেকে ছাড়ানোর শক্তিটুকুও যেন হারিয়ে ফেলছি। নিজের ভাইটিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাই করে প্রচন্ড কান্না করতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু তা করা যাবে না। অন্তুকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম-
: কি হয়েছে অন্তু? তুই এভাবে লাফাচ্ছিস কেন?
: আরে আপুনি, তুমি আগে ভেতরে আসো। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা হচ্ছে।
: প্রিয় মানুষটার কাছ থেকে বিচ্ছেদের চেয়ে বড় সারপ্রাইজ আর কি হতে পারে?!
কথাটা নিজের মনে মনে ভাবতেই যেন আবার নিজের সব কথাগুলো যেন দলা পাকিয়ে গলায় আটকে যাচ্ছে। অন্তু আমার হাত ধরে ওর সাথে টানতে টানতে ভিতরে নিয়ে যায়। ভিতরে গিয়ে দেখি সবাই ড্রয়িং রুমে বসে আছে। ড্রয়িং রুমে আমার বড় মামা-মামী, খালামনি-খালু, মিনহাজ ভাইয়া (খালামনির ছেলে), তৃষা- ইশান (মামাতো ভাই বোন) সবাই উপস্থিত। সবাই যেন প্রচুর খুশি। বড় মামীমনি আমার কাছে এসে আমার কাধে হাত রেখে বললেন-
: তোকে একটা খুশির সংবাদ দিতে এসেছিরে তরু! তার আগে বল মা তুই কেমন আছিস?
“কেমন আছিস?” এই প্রশ্নটি যেন আমার মনে বিষাক্ত তীরের মতো গিয়ে বিঁধলো। তাও ঠোঁটের কোণে একটা মিথ্যে হাসি দিয়ে বললাম-
: অনেক ভালো আছি বড় মামীমনি। তোমরা সবাই কেমন আছো?
: আমরাও ভালো আছি রে মা।
: তা সবাই এতো খুশি কেন? নিশ্চয়ই কোনো খুশির সংবাদ আছে?
আমি হাস্যজ্জ্বল একটা মুখ করে কথাটা জিজ্ঞেস করলাম। মিনহাজ ভাইয়া বসা থেকে এসে আমার মাথায় বিলি কেটে দিয়ে বলল-
: তোর জন্য একটা অনেক ভালো ছেলে দেখেছি। তোর বিয়ে দিয়ে তোকে শ্বশুর পাঠাবো দেখে সবাই এসেছি।
মিনহাজ ভাইয়া শেষের লাইনটুকু শেষ করতেই যেন নিজের চোখের পানি আর স্থির করে রাখতে পারি নি। টপ টপ করে গাল বেয়ে চোখের পানি বেয়ে পড়ে আমার।
#চলবে_____