প্রিয় ভুল পর্ব-৯৭+৯৮+৯৯+১০০

0
413

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৯৭
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

পরদিন সকালে আগে ঘুম ভাঙে আবীরের। সকালের ঝলমলে আলো অনুপ্রবেশকারীদের মতো ঢুকে গেছে ওদের ঘরটাতে। গত রাতে পর্দা টেনে দেবার কথা মনে ছিলো না ওর। সাবধানে বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে পর্দা টেনে দেয় আবীর। পিছন ফিরে দেখে বিছানার এক প্রান্তে কম্ফোর্টার মুড়িয়ে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে মীরা। ভাবতেই ভালো লাগছে পা থেকে মাথা অব্দি কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা মীরা গতকাল থেকে ওর নামে লেখা হয়ে গেছে। এই প্রাপ্তি, হঠাৎ পাওয়া সুখ কোন স্বপ্ন নয় সত্যি।

আস্তে করে দরজা খুলে বারান্দায় যায় আবীর, পাছে ঘুম না ভাঙে মীরার, গত রাতটা দুজনের কেটে গেছে বোবা গল্প আর চাপা অনুভূতির আদান প্রদানে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে ও সেখানটায়। ভাবতে থাকে ঘোর লাগা সময়, বেপরোয়া ভালোবাসা আর ছোট্ট মেয়ে নুহার কথা। আবীর মীরাকে পেয়ে যতটা সুখী, নুহাকে পাওয়াটা ততোটাই সৌভাগ্যের মনে করছে ও। কারন ও মনে করে খোদা ওর হেলায় ফেলে আসা সময়ের ক্ষতির কিছুটা হলেও পূরণ করে দিয়েছেন এই মেয়ের বাবা হওয়ার মধ্যে দিয়ে। নতুন এ সম্পর্কের বড় পাওনা এখনো বাকী। আর সেটা হচ্ছে নুহার সাথে প্রথম দেখা হওয়া। মীরাকে পাওয়াটা যেমন ভাবাচ্ছে তেমনি উচাটন ছোট্ট মেয়ে নুহাকে নিয়ে। মীরা না হয় মেনে নিলো আবীরকে মেয়ের বাবা হিসেবে, কিন্তু নূহা! আমরা ভাবি ছোটারা কিছু বুঝে না, কিন্তু বাচ্চা কাচ্চাদের সানিধ্য পছন্দ করা আবীর জানে ছোট্ট বাচ্চাদের অনুভূতি কতটা প্রখর। তাইতো ওর চিন্তা এই ব্যাপারটা নিয়ে৷

ভাবনার ছেদ ঘটে পিয়ালীর রুম থেকে ভেসে আসা গানের সুরে। এই মেয়েটার সকাল শুরু হয় গান দিয়ে। ওর পছন্দের গান সাজিয়ে তৈরী করা প্লেলিস্ট চলতে থাকে দশটা অব্ধি। গান শোনা নিয়ে কত বকা যে খেলো ও, তাও শুধরালো না। এসব ভাবতেই গানের কথাগুলো শোনার চেষ্টা করে আবীর- মিষ্টি কন্ঠের এক মেয়ে আনন্দের সাথে বলছে-

” দেখো আমার এ খুশিতে ঐ বাগানে ফুল ফুটে, সেই খুশিতে সূর্যটাও মুচকি হেসে উঠে” গানটা শুনে হেসে দেয় ও। চারপাশে চেয়ে দেখে বুনোফুলে ভরে গেছে এ দিকটা, আর অন্যদিকে গত তিন যাবৎ কুয়াশার দাপটে দেখা না দেয়া সূর্যটাও আজ খুব সকালেই কুয়াশার চাদর ভেদ করে উঁকি দিয়েছে আকাশে। এমন মিষ্টি কন্ঠের গান, অপরূপ প্রকৃতি আর আবীরের খুশি মিলেমিশে একাকার।

বেশ খানিকটা সময় পর আবীর রুমে এসে দেখে মীরা তখনো ঘুমিয়ে। ওকে ঘুমে রেখেই বাথরুমে যায় ও। মীরা উঠার আগে বাথরুমের কাজটা শেষ করতে। মিনিট পনেরো পর গোসল শেষ করে ও যখন রুমে এলো দেখলো মীরা উঠে ঝিম ধরে বসে আছে।

আবীর কোন রিস্ক না নিয়ে গোসল শেষে বাথরুম থেকেই একেবারে কাপড় পরে তৈরি হয়ে এসেছে। পাছে না বেইজ্জতি হতে হয়। বাথরুম থেকে বের হয়ে মীরাকে ঘুম থেকে উঠতে দেখে মনে মনে ভাবে যাক বুদ্ধিমানের মতো একটা কাজ করেছি তাহলে।

তোয়ালেতে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে আবীর খেয়াল করে মীরাকে। ওর গায়ের এলোমেলো বসন, খোলা চুল, ঘুমিয়ে চোখে মুখে ফুলে উঠা আদুরে ভাব এসব দেখায় অনভ্যস্ত আবীর যেন আবিষ্কার করলো ওর এই রূপ। ওর কাছাকাছি এসে মিষ্টি হেসে আবীর বললো-

: “শুভ সকাল”

উত্তরে মীরাও হাম তুলে বললো-

: “শুভ সকাল”

: “জলদি তৈরি হয়ে নাও, আমি নিচ থেকে কফি নিয়ে আসছি”

মীরা হু-হা কিছুই বলে না। বিছানা ছেড়ে নতুন কাপড় গোছাতে থাকে। মীরাকে ঘরে রেখে নিচে যায় আবীর।

মিনিট পনেরো পর দরজা নক করে ঘরে ঢুকে সে। ঢুকে দেখে এর মধ্যেই মীরা গোসল সেরে নতুন একটা শাড়ি পরেছে। সদ্যস্নাত মীরা, সারা শরীরের স্নিগ্ধ ভাব, চুল দিয়ে টিপটিপ করে পরা পানি এসব যেন পৃথিবীর অত্যাশ্চর্যের চেয়েও আশ্চর্য মনে হচ্ছে ওর কাছে। দুই কাপ কফির একটা ওর সামনে রেখে নিজের জন্য একটা নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের বিপরীতে থাকা শোকেসে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় আবীর। সেখান থেকেই বিশাল আয়নায় দেখতে পাওয়া তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে থাকা মীরার দিকে একদৃষ্টে চেয়েছিলো সে। পুরোনো আমলের দীর্ঘ ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় হঠাৎ তা লক্ষ্য করে মীরা। চোখা চোখি হতেই লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিয়েছে আবীর । তখনি ঘুরে তাকিয়েছে মীরা আবীরের দিকে। ফিরে দেখেছে আবীর হাতেনাতে ধরা পরে ঘুরে সাইড টেবিলে কি খুঁজবার বাহানা করছে।

মুচকি হাসে মীরা আবীরের এমন কান্ড দেখে। তারপর ক্ষীণ কন্ঠে বলে-

: “একটু এদিকে আসেন তো”

আবীর যেন শুনতেই পাচ্ছে না, মীরা তখন আবার বলে-

: “আমার চুলগুলো একটু মুছে দিবেন? ”

নতুন শাড়ি পরা মীরার দীর্ঘ চুলগুলো মুছতে সত্যি সমস্যা হচ্ছে।

এবার সে শুনতে পেলো যেন, মীরার কথাটা শুনে আবীর বললো – “পিয়ালীকে ডাকি? ও তোমার চুল মুছে দিক?”

কপট রেগে মীরা মনে মনে বলে- “পিয়ালী না…?”

তোয়ালে হাতে ওই যায় আবীরের কাছে, হাতে তোয়ালে ধরিয়ে দিয়ে বলে-

: “এই সামান্য কাজে সকাল সকাল ওকে বিরক্ত করার কি আছে, নিন…

আবীরকে তেয়ালে দিয়ে কাছাকাছি খাটের এক কোনে

বসলো মীরা। আবীর সংকোচে চুল মুছে দিতে এগিয়ে এলো ঠিকই কিন্তু কাজটা করার চেয়ে বেশী মনোযোগ ছিলো ওর হাত যাতে মীরার শরীর না ছোঁয় সে ব্যাপারে।

ব্যাপারটা বুঝতে পেরো মনে মনে হাসে মীরা। ওকে সহজ করতে এই সেই গল্প করে। এক পর্যায়ে আবীরও সহজ হয় কথা বলায়। মীরাকে জিজ্ঞেস করে নুহার সম্পর্কে। ওর জন্মদিন, পছন্দ, অপছন্দ, প্রিয় ফুল, ফল, রঙ মোটমুটি সবকিছু।

এমন সময় পিয়ালী বাইরে দাঁড়িয়ে ডাকতে থাকে-

“ভাবী ভাবী….”

আবীর মীরার চুল ছেড়ে দরজার দিকে যায়। দরজা খুলে বলে –

: ” সকাল সকাল ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে ঘুমের বারোটা তো বাজিয়ে দিয়েছিস, এখন আবার আসছিস জ্বালাতে”

অবাক ভাঙ্গিতে পিয়ালী বলে-

: “কিরে ভাই!! বৌ পেয়েই নগদে পল্টি? হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে নালিশের সুরে মীরাকে বলে-

: ” দেখছো ভাবী, আমার ভাইতো এক রাতেই তোমার হয়ে গেলো, কি সব আবোলতাবোল বলছে”

মীরা কেমন তব্দা খেয়ে যায় ওর কথা শুনে। এ মেয়েরে কথা শিখাবার স্কুল কলেজে ভর্তি করা উচিত। কি আপত্তিকর কথাবার্তা। মীরা আবার মনে মনে ভাবে এটা মনে হয় আমার বেশী ভাবনার ফল। পরে আহনাফ পিয়ালীকে ডাকতে এলে পিয়ালী বলে-

: ” ভাবী মা তোমাদের দু’জনকে জলদি নিচে যেতে বলেছেন, মেঝো বৌ- মনির মা এসেছেন তোমাকে দেখতে, আমি চললাম”

ওরা চলে গেলে আবীরও বাইরে যায় মীরাকে জলদি তৈরি হতে বলে।

খুব দ্রুত তৈরী হয় মীরা। চওড়া পাড়ের টাঙ্গাইল শাড়ি পরে হালকা রঙের। হাতে চুড়ি গলায় হালকা হার, আর দুল। দ্রুত তৈরি হয়ে কফি শেষ করে মীরা কল করে আবীরকে, কোথায় যাবে ও তা না বুঝতে পেরে। কলটা কেটে দেয় আবীর। নিশ্চয়ই রুমের দিকে আসছে ও, তাই কল কেটে দিলো হয়তো, হলো ঠিক তাই।

আবীর দরজা নক করে রুমে ঢুকে দেখে পরিপাটি মীরাকে। না কোন উগ্র প্রসাধন কিংবা সাজের বহর নেই মীরাতে। নিপাট সরল মুখশ্রীর বাড়তি বলতে কেবল গাঢ় লিপস্টিক। হালকা রঙের শাড়ি, হালকা প্রসাধন চাকচিক্যের সবটুকু ঠোঁটের লিপস্টিকে। ফিওনা বলতো মেয়েরা চোখে মুখের ক্লান্তি, অনিদ্রায় তৈরী আন্ডার আই ডার্ক সার্কেল লুকায় গাঢ় লিপস্টিক পরে। মীরাও হয়তো সেই ট্রিকটাই ফলো করেছে। তবে চোখের নিচের অনিদ্রার ছাপ ওর আদুরে ভাব একটু ও ম্লান করতে পারেনি। বেশ মিষ্টি দেখাচ্ছে মাথায় ঘোমটা টানা মীরাকে। আবীর ওকে দেখার ঘোর কাটিয়ে বলে চলো বড়-বৌমনি ডাকছে।

ঘর থেকে বেরিয়ে পাশাপাশি হাঁটে দুজনে। দিনের বেলা ওদের বাড়ি দেখার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় ঘর থেকে বেরিয়েই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় মীরা। এত সুন্দর এত সুন্দর…!

এজন্যই তো এ বাড়িটা দখল করতে স্থানীয় লোকেদের এত বাহানা। মানুষ টাকাপয়সা খরচা করে বাড়ির ভেতরে বাহিরের সৌন্দর্য বর্ধন করে। আর এ বাড়িটাকে প্রকৃতি নিজ হাতে সাজিয়েছে তার সৌন্দর্যে।

বাড়ির পেছনে পাহাড়ের ঢাল। আর সামনে বনজঙ্গলের মতো। মীরা পাশে থাকা আবীরকে জিজ্ঞেস করলো –

: ” সব এক রকমের এগুলো কি গাছ?”

: ” এটা শালবন” এখান থেকে সমতল যে পর্যন্ত চোখ যায় সবটুকু আমাদের দাদার সম্পত্তি”

: “এত সুন্দর বন! মাশাল্লাহ! মনে হচ্ছে কোন রিসোর্টে এসেছি ”

মুচকি হেসে আবীর বলে-

: “এই শালবনের শেষে একটা পাহাড়ি ঝরণা রয়েছে। সেটা দেখলে তোমার অনেক পছন্দ হবে”

: “নিয়ে যাবেন? ”

: “রাতে তৈরী থেকো, আবার ওদের দাওয়াত দিও না, শুনলে ওরাও পিছু নিবে”

মুচকি হাসে মীরা আবীরের এমন টোনের কথা শুনে। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে।

উঁচু সিঁড়ি বেয়ে নামতেই আন্দাজ না থাকায় মীরা পরে যেতে নেয়। আবীর দ্রুত নেমে হাত ধরে মীরার। মীরা উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ালে হাত ছাড়িয়ে নিতে চায় আবীর। কিন্তু মীরা দখল ছাড়ে না আবীরের হাতের। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আবীর তাকায় মীরার দিকে, অন্য দিকে চেয়ে মুচকি হাসে মীরা, ওর হাসি দেখে আরো শক্ত করে ধরে মীরার হাত।

একেবারে ড্রইংরুমে পৌঁছানো অব্দি মীরার হাত শক্ত করে ধরে রাখে আবীর। ঘরভর্তি মুরুব্বিদের দেখে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে মীরা । কিন্তু আবীর! বেহায়ার মতো হাত ধরেই এগোয় সবার সামনে। আবীরের পেটে গুঁতো দেয় মীরা হাত ছাড়াবার ইশারায়। আবীরও নাছোড়বান্দা মীরার হাত ছাড়ে না কিছুতেই। “ঐ এসেছে তারা” আহনাফের ডাকে সবার দৃষ্টি ফিরে ওদের দিকে। শেষ মুহূর্তে আবীর আলগোছে হাত ছেড়ে দেয় মীরার । হাঁপ ছাড়লো মীরা সবার সামনে লজ্জিত হওয়া থেকে বেঁচে। তৎক্ষনাৎ তাকায় মীরা আবীরের দিকে, ভ্রু উঁচিয়ে চোরা হাসি ওর চোখে মুখে। ওর হাসি দেখে মীরাও হেসে ফেলে। এটা যেন আবীরের এক অন্য রূপ ধরা পরলো মীরার কাছে। নিঃশব্দে, গোপনে আবীর জানিয়ে দিলো ভালোবাসায় আমি কম যাই না প্রিয়।

মেঝো বৌ-মনির মা বলে উঠলো-

: “কি গো নাত-বৌ, এত হাসির কি হলো আমাদেরও বলো আমরাও হাসি”

মীরা কাছে এগুয়ে সালাম করে তাকে, মেঝো বৌমনি মীরাকে পরিচয় করিয়ে দিলো তার মায়ের সাথে। তার কাছেই বসতে জায়গা করে দিলেন তিনি, মীরা বসেই জিজ্ঞেস করলো তার হালহকিকত। কোন কৃত্রিমতা নেই মীরাতে মীরা যেন এদেরই একজন। সেই যে এ বাড়িতে রাতে এসেছিলো প্রথমবার সেদিনই এ বাড়ির সকলেই আপন করে নিয়েছে মীরাকে। তাই কথাবার্তায় কোন ঘেরাটোপ নেই মীরার। অতি আপনজনের মতো খোঁজ খবর নেয় মীরা তার, তার ছেলেমেয়ে, পরিবারের।

মীরাকে বেশ পছন্দ হয় তার। আবীরকে বলে-

: “কিরে ভাই এত সুন্দর বৌ, এত মিষ্টি কথাবার্তা, আচার-আচরণ কোত্থেকে আনলি একে হ্যা?

আমার ছেলের জন্য…..

মেঝো বৌ-মনি তার মাকে থামিয়ে বলে উঠলো-

: ” আবার সেই গান, বাজে কথ রাখো তো মা, নতুন বৌয়ের মুখ দেখেছো এখন সালামী দাও, এসব শুনতে শুনতে…”

মীরা মেঝো বৌ-মনিকে থামিয়ে বললো-

: “বলুক না, আমি কি বাইরের কেউ? আমি শুনছি আপনি বলুন নানী ”

পাশ থেকে মেঝো চাচা বলে উঠলো-

: “বুঝলে মীরা ছেলে মেয়েরা নিজেদের পছন্দে বিয়ে করলে সে যতই সুন্দর হোক, যত উপযুক্তই হোক তাতে বাবা মায়ের মন ভরবে না, তারা যদি কানা, খোঁড়া এনে দেয় তাও রাজপুত্র ”

মেঝো বৌ-মনি তার বরের পেটে গুঁতো দিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়। মীরা বুঝতে পারে তারা পছন্দ করে বিয়ে করেছিলো হয়তো, এবং জামাই তার মনঃপুত হয় নি।

তাইতো সুযোগটাকে কেমন কাজে লাগিয়ে দিলেন তিনি। এক ঢিলে সব পাখি মেরে ফেলার মতো। এমনি করে চা, আড্ডা গল্পে কাটতে থাকে সময়। বৌভাত অনুষ্ঠান হবে আগামী পরশু।

সেদিন সারাটা সকাল সারাটা দুপুর মীরা ছিলো বাড়ির অন্য সকলের দখলে। আবীর পুরোটা সময়ই কাছে কাছে ঘুরছে মীরার। আহনাফ, জাদিদ ওরা কি এক কাজে ডেকেছিলো আবীরকে৷ ও এই সেই বাহানায় বাড়িতেই রয়ে গেছে। বাড়ির সকলে ব্যাস্ত বৌভাত অনুষ্ঠান আয়োজনে। আবীর ব্যাস্ত মীরাতে।

বড় চাচা দ্বিতীয় দফা চায়ের আবদার করলে মীরা নিজ থেকে বলে-

: “চা টা আমি তৈরি করি বৌ-মনি”

বড় চাচী না করলেও, মিষ্টি আবদারে এতটুকু করার অনুমতি চায় মীরা। শেষে আর না করতে পারে না সে।

মীরা চা বানাতে রান্নাঘরে ঢুকলে সুযোগ খুঁজে আবীর সেখানে যাওয়ার। কিছু সময় আগের ব্যাপারটা হয়তো বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে৷ সেটা কতটুকু তা মাপতেই সেখানে যাওয়া দরকার।

উসখুস করে মেঝো চাচী বেরুতেই রান্নাঘরে ঢুকে আবীর। মীরাকে বলে-

: ” চায়ে চিনি বেশী দিও না, এ বাড়ির সাবার ডায়বেটিস আছে কিন্তু ”

: “এটা বলতেই এলেন বুঝি”

: “হ্যা, সাবাধান করতে এলাম, পাছে না বদনাম হয়ে যায় ”

: ” আপনাকে অনেক ভালো লোক মনে করেছিলাম, কিন্তু আপনি?”

: “আমি আবার কি করলাম”

: “কি করলাম নাহ?”

এমন সময় রান্নাঘরে ঢুকে পরে মেঝো চাচীর মা, তাকে দেখে রান্নাঘর থেকে বোরিয়ে যায় আবীর। উনি লোক ভালো না শেষে কি বলতে কি বলে বসেন তা ভেবে।

উনি বেরুতেই নানী মীরার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যান। মীরার সৌন্দর্য, মীরার নাম, যশ, খ্যাতি এসবের অকৃপণ প্রশংশা করেন তিনি। মীরাও বিনীত ভাবে তার কথার উত্তর দেন। একটা সময় হঠাৎ গলা খাদে নামিয়ে বলেন…

: “শোনো নতুন বৌ নাতীর যে আগে একটা বিয়ে হয়েছিলো তা কি তুমি জানতা?”

মীরা অসম্ভব সুন্দর এই পৌঢ়ার এমন কথায়, এমন বিশ্রী রূপে কেমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। ঐদিকে চায়ের দুধ উথলে উঠার শব্দে সংবিৎ ফিরলো যেন ওর। মীরা তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দুধের জ্বাল কমিয়ে দিলো। পাশ থেকে নানী মীরার আরো কাছ ঘেঁষে বললো-

: “আরেহ আগের বৌ তো কয়েকদিন সংসার করেই চলে গেছে কি সমস্যা নাকি আছে ওর তাই, তুমি এত সুন্দর মেয়ে, এত নাম যশ শুনলাম তোমার, কি কপাল পুড়লো। তুমি জানলে নিশ্চয়ই বিয়েটা করতে না”

: “সংসার করেছে দেখেছেন আপনি”

: ” দেখি নাই মানে, আমরা আত্নীয় মানুষ আমাদের সামনে বিয়ে হলো, আমরা দেখবো না, কি পরীর মতো সুন্দর বউ ছিলো! তুমি কি সুন্দর? তারচে কয়েকগুণ বেশী সুন্দরী ছিল সেই মেয়ে, স্বামী সুখ না পেলে অর্থসম্পদ ধুয়ে পানি খাবে নাকি? তাই তো চলে গেছে”

: “নানী আমি তো শুনেছি আপনি আপনার এক নাতনীকে নাকি বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন উনার বৌ চলে যাবার পর, কথাটা কি সত্যি? ”

ভুত দেখার মতো চমকে উঠলেন তিনি এ কথা শুনে। কারন এ কথা এত দ্রুত তো নতুন বৌয়ের জানার কথা না। আসলে কথাটা মীরা জেনেছিলো ফিওনার কাছ থেকে। তাও বেশ কয়েকবছর আগে। তা তো তিনি জানেন না। আর তিনি যে মিথ্যা বলছেন তার বড় প্রমাণ মীরা নিজে। কারন এক যুগ আগে আবীরের যে বৌ ওকে রেখে চলে গিয়েছিলো সে তো অন্য কেউ না মীরা নিজেই।

পাশে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে মীরা ওদের এক যুগ আগের ছবিটা বের করে দেখায়৷ তারপর বলে-

: “দেখেন তো নানী এই মেয়েটাই কি না?”

সপক্ষের প্রমাণ ভেবে হ্যা হ্যা শব্দে জোড়ালো করার চেষ্টা করে ব্যাপারটা। ফোন হাতে নিয়ে বলেন হ্যা এই যে প্রথম বিয়ের ছবি, দেখেছো আমি মিথ্যা বলিনি। আসলে নিজেদের কুকীর্তির কথা বলতেও খারাপ লাগে কিন্তু আপন ভেবে তোমাকে বললাম কথাটা৷

ফোনটা তার হাত থেকে মীরা ছিনিয়ে নিয়ে বলে-

: “আপন ভেবে বলেছেন তা ঠিক আছে কিন্তু কথাগুলো সব সত্যি কি?”

: “হ্যা সত্যি, তুমি চাইলে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো বড় বৌকে, আমার মেয়ে না হয় মিথ্যা বলবে সে তো আর মিথ্যা বলবে না, তাই না?”

এমন সময় মেঝো বৌমনি রান্নাঘরে ঢুকলে আলগোছে বেরিয়ে যান তিনি। মীরা কেমন বোকা বনে যান তার কথাবার্তায়। তিনকাল গেছে তার এককালও নেই৷ কি দরকারে এই মিথ্যা গুলো বললেন তিনি?

চা তৈরী শেষ হলে তা সার্ভ করতে যায় মীরা। মেঝো বৌমনির মা ঘোষেটি বেগম দলছুট হয়ে একটু দূরে বসে আছেন। মীরা চা হাতে তার দিকে এগিয়ে যান। তারপর গল্পের ভঙ্গিতে বলেন-

: ” আমাকে আপন ভেবে কথাগুলো বলে আপনি ভালোই করেছেন। তা না হলে ভবিষ্যতে আমার জন্য কিছু মানুষ চিনতে ভুল হতো”

হাসি হাসি মুখে তিনি বলেন-

: “তুমি আবার এসব বলো না যেন কাউকে”

: “আরেহ্ আমি কি পাগল! এসব কাওকে বলা যায়? ”

: “নিজ চোখে না দেখলে এসব বলতাম না” মীরা চোখমুখ শক্ত করে বলে-

: ” নানী তার বিয়ে আগে একটা হয়েছে তা সত্যি, কিন্তু বৌ আপনি নিজ চোখে দেখেন নি। দেখলে আপনি ঠিক জানতেন তার প্রথম বৌ আমিই ছিলাম”

কথার দমকে হাত কেঁপে উঠে তার, কিছুটা চা ছলকে পরে তার শাড়িতে। ফোনে থাকা বিয়ের দিনকার ওর একা ছবি দেখিয়ে বলে –

“মিলিয়ে দেখুন এটা ষোলো বছর বয়সী মীরার ছবি, আর এই যে এখন আমি” বলেই মুচকি হেসে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় ও। শকটা যে ৪৪০ এর চেয়ে বেশী ভোল্টোর হয়ে গেছে তা ঠিক বুঝতে পারে মীরা। লজ্জা থাকলে এ মহিলা এই জীবনে আর ওর মুখোমুখি হবে না।

চলবে…

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৯৮
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

দুপুরে খাওয়ার পর মীরা একটু ঘুমিয়েছিলো। ঘরে থাকলে মীরার অস্বস্তি হতে পারে ভেবে আবীর সে সময়টা বাইরেই ছিলো। মীরার শরীরটা কেমন ক্লান্ত, গতরাতে দীর্ঘ জার্নির পরও ঘুম পুরোপুরি হয়নি তাই হয়তো। খুব আরামের ঘুম ঘুমালো মীরা। এমন শান্তির ঘুম শেষ কবে ঘুমিয়েছে তা ও মনে করতে পারছে না। ঘুমের মধ্যে কেমন একটা স্বপ্ন দেখলো ও। সেটাকে সুন্দর স্বপ্ন বলবে নাকি দুঃস্বপ্ন তা-ও বুঝতে পারছে না। ওর স্বপ্নটা ছিলো- ওরা পুরো পরিবার মিলে সমুদ্রের পাড়ে ঘুরতে গিয়েছে। নূহা, ওর বাবার সাথে খুব আনন্দ করছে, আর মীরা দূরে বসে দেখছে আর হাসছে। হঠাৎ দেখলো ওরা একটা ছোট্ট বোটে বসে। বিশাল একটা ঢেউ হঠাৎ-ই আছড়ে পরলো ওদের ছোট্টো বোটে। তাতেই উল্টে গেলো বোটটা। পাথরের টুকরোর মতো পানিতে ডুবে গেলো ওরা একেএকে তিনজন। সাঁতার না জানা মীরা ডুবে যাচ্ছে ক্রমশ, ডুবছে নূহাও, এ তিনজনের মধ্যে নূহার বাবাই কেবল সাঁতার জানা। কাকে বাঁচাবে সে? নূহা? নাকি মীরাকে? পানির নিচেই মীরা ওর হাত ছাড়িয়ে ইশারায় তাকে বললো নূহাকে নিয়ে উপরে উঠতে৷ তখনি মীরার হাত শক্ত করে ধরলো সে, কোলে তুলে নিলো নূহাকেও। আর তখনি প্যারাসুটের মতো কি এক ওয়াটার স্যুট চালু করলো নুহার বাবা, পানির মধ্যে উড়তে শুরু করলো ওরা, কিছু সময় পর ওরা পানির তলা থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর সাঁতরে পাড়ে উঠে ক্লান্ত শরীরে আছড়ে পরলো যেন তিনজনে। মীরা দ্রুত শ্বাস টানতে টানতে বললো- ভাগ্যিস তুমি এই ওয়াটার স্যুটটা নিয়ে এসেছিলে তা না হলে কি য়ে হতো! পাশ থেকে নূহা বললো- “জানো মা, আমি জানতাম বাবা ঠিক আমাদেরকে বাঁচিয়ে নিবে”

তখনি ঘুম ভাঙলো মীরার, পানি থেকে ডুবে উঠার ক্লান্তি, আর শ্বাসপ্রশ্বাসের দ্রুততায় তখনো রয়েছে। যেন বাস্তবেই ঘটেছে তা। আবীর রুমে ঢুকে বলে-
: ” এত আস্তে দরজা খুললাম তাও ঘুম ভেঙে গেলো তোমার?”
উত্তরে মীরা কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। ওর
দ্রুত শ্বাস নেয়াটা খেয়াল করলো আবীর। দ্রুত কাছে এসে বললো-
: ” কি ব্যাপার? কোন ভয়ংকর স্বপ্ন টপ্ন দেখেছো নাকি?”
হ্যা সূচক মাথা নেড়ে অস্ফুটে মীরা বললো-
: “পানি”
আবীর দ্রুত জগ থেকে পানি ঢেলে দেয় ওকে। মীরা এক টানে শেষ করে গ্লাসের সব পানি। তখনি মাগরিবের আযান পরে চারদিকে।

আবীর খানিকটা দূরত্ব রেখেই বসা ওর থেকে। দেখছে মীরার শ্বাস-প্রশ্বাসের উঠানামা আর ওর ঘামে আর্দ্র মুখ। তোয়ালে এনে দিয়ে বলে-
: ” কয়েকটা দিন খুব স্ট্রেস গেছে তোমার, তাই হয়তো… ”
তুমি মাগরিবের নামাযটা পড়ে নাও, আমিও পড়ে আসি। নামায পড়লে দেখবে মনটা শান্ত হবে৷ বলেই নামাযের উদ্দেশ্যে বের হয় আবীর।

নামাযের পর চা নাশতার জন্য ডাক পরে ওদের। মীরা তখন নূহার সাথে কথা বলছিলো ফোনে৷ আবীর রুমে এসে মীরার কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকে। নূহা জিজ্ঞেস করলো-
: “কবে আসবে তুমি?”
মীরা উত্তরে বললো- “আগামীকাল মা ”
: “বাবা কবে আসবে? ”
: “বাবা এখনো টিকেট পায় নি মা, তবে বলেছেন যতদ্রুত সম্ভব আসবেন”
কথাটা বলেই ফোনের লাউডস্পিকার অন করে মীরা যাতে নূহার পাকা পাকা কথা শুনতে পায় আবীর। তখনি আদুরে গলায় নূহা বলে-
: “বাবা কি আবার আমাকে রেখে বিদেশ চলে যাবে? ”
: “না মা আমরা বাবাকে আর বিদেশ যেতে দিবো না”
: “আমি বাবার কোল থেকেই নামবো না'”
কথা শুনে হেসে দেয় মীরা, ছোট্ট মেয়েটার বাবাকে ঘিরে কত কথা। একটু পর মীরা নুহাকে প্রশ্ন করে –
: “শোন তোমার বাবা ফোনে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো কি আনবে তোমার জন্য? ”
: “আমার কিছু চাই না মা, বাবাকে বলো তার বসকে বলে এক্কেবারে বড়… ছুটি নিয়ে আসতে, বাবাকে যাতে আর না যেতে হয় আমাকে ছেড়ে।
: ” বসকে কি বলবে মা? তুমি একটু শিখিয়ে দিবে?”
: ” বাবা বসকে বলবে যে বাবাকে ছাড়া আমার খুব কষ্ট হয়, সবার বাবারা স্কুলে আসে, আমার বাবা বিদেশে তাই আসতে পারে না,
এমন সময় মীরা খুবই ইমোশনাল হয়ে লাউডস্পিকার অফ করে দেয়। আবীর ফোনটা মীররা থেকে হাতে নিয়ে আবার কথা চালু করতে ইশারা দেয় মীরাকে৷

মীরার হাতটা শক্ত করে ধরে আবীর, আস্তে করে বলে-
: “আমি কথা বলবো?”
মীরা ইশারায়-ই উত্তর দেয় ‘না’
তখন মীরা মেয়ের সাথে কথা শেষ করে ফোন রেখে দেয়৷ দু’জনে মৌন হয়ে বসে থাকে অনেকটা সময়। কেউ-ই বলবার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছে না যেন। এমন সময় দরজায় নক করে কেউ মীরা চোখমুখ মুছে নেমে গিয়ে দরজা খোলে। দেখে গেইটের কাছে আহনাফ এসেছে, পাশের বাড়ির মেয়ে বৌরা এসেছে নতুন বৌ দেখবে বলে। মীরা ”তৈরী হয়ে আসছি”- বলে ওকে বিদায় করে দরজা আটকে দিয়ে তৈরী হতে বসে নিচে যেতে। এমন সময় আবীর বলে-
: ” যা গেছে সব বাদ দিয়ে নতুন করে শুরু করা কি খুব কঠিন মীরা? তোমার জীবণের দুঃখ আর কষ্টের অতীত শেষ, আমায় কি তোমার ভরসা হয় না? ”
আহত চোখে তাকায় মীরা, আবীর ওর চোখে চোখ রেখে, ওর দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলে-
: “আমায় ভরসা করো, দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে,
মীরাও চক্ত করে ধরে আবীরের হাত।

মুখ ভার করে রেখো না, একটু হাসো…”
হাসার চেষ্টা করে মীরা, আবীর এতেই খুশী হয়, বলে চা পাঠাবো এখানে নাকি নিচে গিয়ে খাবে?
: “আপনি যান আমি আসছি”
: “ওকে জলদি তৈরী হও, আমি গিয়ে এক কাপ খাচ্ছি, তোমার সাথে আরেক দফা হবে”

মিনিট পনেরো পর তৈরি হয়ে একাই নিচে নেমে বসে মীরা। নীচতলার সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল মাথায় তোলার চেষ্টা করে সে, এমন সময় পিয়ালী ইশারায় আবীরকে দেখতে বলে সেদিকে। চায়ের কাপ ঠোঁটে ছুঁইয়ে আবীর মাথা ঘুরায় পিয়ালীর তাগাদা দেখে। বিষ্ময়ের দমকে চা ছলকে পরে যায় ওর গায়ে। সেটাকে হাতে রেখেই ও মনোযোগ দিয়ে চেয়ে দেখে আসমান থেকে নেমে আসা এক পরী শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে নিচ্ছে। গাঢ় বেগুনি ব্ল্যাউজ দিয়ে ল্যাভেন্ডার রঙের শাড়ি পরেছে সে। এক হাত ভর্তি বেগুনী রঙের কাচের চুড়িতে। আরেক হাতে চওড়া বেল্টের কালো ঘড়ি। শাড়ির আঁচল মাথায় তুলতে তুলতে সম্মুখে তাকিয়ে নিচে নামছে সে। হতভম্ব হয়ে সেদিকেই তাকিয়ে আছে আবীর। এই পরীটা ওর বউ! এটা কি সত্যি? ”
মুচকি হাসে মীরা আবীরের তাকানো দেখে। ভ্রু উচিয়ে জিজ্ঞেস করে – “কি?”
তখনি হেসে চোখ নামিয়ে নেয় আবীর। ঘর ভর্তি লোকের মনোযোগ তখন মীরাতে।

এ ওকে ফিসফিস করে বলছে- নতুন বউ কি সুন্দর দেখতে…। নিজেকেই নিজের হিংসা হতে থাকলো, আচ্ছা ওর আচরণ কি নার্সিসাসের মতো হয়ে যাচ্ছে? পরোক্ষণেই মনে হলে নার্সিসাস তার নিজের সৌন্দর্যে
বিমোহিত হয়েছিলো, আর ও বিমোহিত হচ্ছে ওর ভাগ্যের প্রতি। পাছে না নিজেরই নজর লাগে তাই ও অস্ফুটে বলে – “মাশাল্লাহ ”

পরদিন বৌভাত অনুষ্ঠান হবে। তাই বাড়ির বড়োরা মোটামুটি ব্যাস্ত। ব্যাস্ত বাড়ির অন্যান্যরাও। মধ্য মনি মীরা আবীরের তেমন কোন কাজ নেই। আবীর এই-সেই বাহানায় মীরার কাছাকাছি ঘুরঘুর করলেও, মীরা পরেছে বিপাকে৷ নতুন বউ বলে স্ট্যাচুর মতো বসে থাকা লাগছে, কেউ এলে তাকে সালাম করা তার সাথে কথাবার্তা বলা এটাই ওর কাজ। তারা কথা বলছে তো বলছেই। কথার গাড়ির কোন থামাথামি নেই। আবীর ঠিক বুঝতে পারে মীরা বোর হচ্ছে এসবে। মীরা উঠে চলে গেলে কাছেপিঠের আত্নীয়রা মন্দ ভাবতে পারে ওকে।

উপায়ন্তর না পেয়ে আহনাফের সাথে ছাদে যায় আবীর,যাবার আগে ফিসফিস করে মীরাকে – “উপরে যাচ্ছি আমি” বলেই সিঁড়ি ভেঙে ছাঁদে চলে যায় সে। অসহায় চোখে মীরা ওর চলে যাওয়াটা দেখে।

একটু পর বড় চাচী মানে আবীরের বড় বৌমনি মীরার কাছে আসে। এক কাপ চা আর একটা ঔষধ দিয়ে বলে-
: “তুমি উপরে চলে যাও মীরা, আবীরটার নাকি মাথা ব্যাথা করছে”
পাশে থাকা একজন বললো-
: “আহারে, আচ্ছা নতুন বৌ যাও তুমি, বরকে নিয়ে যেয়ো আমাদের বাড়িতে বেড়াতে”
মীরা স্মিত হেসে চা হাতে উঠে পরে। দোতলার সিঁড়িতে উঠেই হাফ ছেড়ে বাঁচে যেন ও।
” মনে একটু চিন্তা আবীরের মাথা ব্যাথার কথা ভেবে, গিয়ে দেখে দরজা খুলে মীরার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে আবীর। মীরা দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বলে অবাক কন্ঠে বলে “আপনার নাকি….”

কথাটা শেষ করতে দেয় না আবীর, ইশ্ শব্দে চুপ থাকার নির্দেশ দেয় ওকে। মীরার হাত ধরে মীরাকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা আটকে দেয় ও। তারপর বলে-
: “কাপ রাখো ভারী কিছু গায়ে জড়িয়ে নাও”
মীরা স্তম্ভিত কন্ঠে বলে-
: “আপনার চা”
: “আরে রাখো চা, ওখান থেকে তোমাকে তুলে আনতে এসব তো ভুংভাং ছিলো, দেখলাম ওখানে বসে বোর হচ্ছো তাই”
মীরা একটু অবাক হয়, মুচকি হেসে বলে-
: “এত দুষ্ট বুদ্ধি আপনার? এত বুদ্ধি নিয়ে রাতে ঘুমান কিভাবে? ”
: “আরো কত বুদ্ধি আছে, মাথায় জায়গা হয় না ঘুমানোর সময় বালিশের নিচে রেখে ঘুমানো লাগে, এখন তুমি আছো তোমার কাছে রাখবো নি। আমাকে যতটা ভালো ভাবছো, ততটা ভালো কিন্তু আমি নই, পরিবেশ পরিস্থিতির জন্য ভালো আমি, এখন যা বলি শোন ভারী কাপড় কিছু নিয়ে নাও আমরা বাইরে যাবো এখন”
: “এত রাতে!”
: “মাত্র সাড়ে নয়টা বাজে”
: “বাইরে যাবো কিভাবে? ”
: “ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে, পেছনের দরজা দিয়ে যাবো, কেউ টের পাবে না, চলো তো কথা বলা না থামালে এখানেই রাত কাবার হয়ে যাবে”
ওর এ কথা শুনে তারাহুরো করে মীরা একটা শাল টেনে নিলো লাগেজ থেকে। কোনমতে ওটাকে গায়ে জড়িয়ে নিলো। চুলগুলোকে কোনমতে টেনে আটকে নিলো ক্লিপ দিয়ে৷

দরজা আটকে সন্তর্পণে নিচে নামলো ওরা পেছনের দরজা দিয়ে৷ আবীর ওর হাত ধরে অনেক দূর ঘুরে বাড়ির অপজিটের শালবনে ঢুকলো। দ্রুত হেঁটে অনেকটা পথ পেরুনোর পর হাঁপিয়ে গেলো মীরা। হাঁটা থামিয়ে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে থেমে যায় ও। আবীরও থেমে যায় ওর পাশে, বলে- “খুব-কি কষ্ট হচ্ছে? আরেকটু পথ বাকী?”
মীরা হাঁপিয়ে গিয়ে বলে-
: ” আচ্ছা আমরা যাচ্ছি কোথায়? ”
: “চমৎকার একটা জায়গা দেখাবো তোমায়”
তারপর ধীর পায়ে হাঁটে দুজনে।

মিনিট পাঁচেক পর ওরা পৌঁছে গেলো সেই অপার্থিব জায়গাটায়। মীরা প্রথমটাতে বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। এত সুন্দর!

পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চলে যাওয়া ঝর্ণা। অন্ধকার রাতে ঝর্ণার জলের অস্তিত্ব শব্দ দিয়ে বুঝে নিচ্ছে মীরা। আরেকটু এগুতেই পানির প্রবাহমান ধারা দেখতে পায় ও । চাঁদের আলোয় ঝর্ণার জল রূপালী দেখচ্ছে। মনে হচ্ছে উপর থেকে কেউ যেন পাহাড়ের গা ধুয়ে দিচ্ছে। একটু এগিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই মীরা দেখতে পেলো ঝর্ণার জল পাহাড়ের গা বেয়ে গিয়ে পরছে সরু নদীটাতে। সামনের দিকে যতদূর চোখ যায় ততখানিই নদীর দখলে। নদীর দুই পাড়ের ঘাসবন অন্ধকারে কেমন ভয়ংকর দেখাচ্ছে।
মীরা আবীরকে জিজ্ঞেস করলো-
: “আচ্ছা নিচে নামা যাবে?”
: “নামবে?”
মাথা নেড়ে হ্যা বলে মীরা।
: “পানি যেদিকটায় পরছে সেদিকটা পিচ্ছিল সেদিকে যাওয়া যাবে না। যে কোন সময় এক্সিডেন্ট হতে পারে”
: “না বলবেন না প্লিজ, বেশীদূর নামবো না, আমি শুধু ঝর্নার পানি ছুঁয়েই চলে আসবো, ঐ দিকটায় না গেলে আফসোসের শেষ থাকবে না প্লিজ…”

: “যদি যেতেই হয় তাহলে ঐ দিকটা দিয়ে নেমে যেতে হবে, তবে সাবধান। পা পিছলে পরে গেলেই কিন্তু শেষ”

: “সাবধানেই যাবো,”
: “আচ্ছা চলো,
পা টিপে টিপে এগোয় ওরা, মিনিট তিনেক পর অনেকটা পথ ঘুরে ওরা ঝর্ণার কাছে পৌঁছালো। ঝর্ণার এ জায়গাটা সমতল। সেখানটাতে দাঁড়িয়ে
হাত দিয়ে মীরা ঝর্ণার জল ছুঁলো মীরা। একটু পানি ছুঁড়ে মারলো আবীরের মুখে, হাসি মুখে বা হাতে সে পানি মুছে নিলো আবীর। তারপর হাত দিয়ে ইশারা করে বললো-
: ” এখানে এই জায়গাটায় ছোটবেলায় লুকোচুরি খেলার সময় লুকাতাম আমরা”
মীরার সব মনোযোগ এখন ঝর্ণাকে ঘিরে। আবীরের কথার পিঠে কিছু বললো না ও। ও এখন যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে নদীর দৃশ্যটা বেশী সুন্দর। এ মুহূর্তে মীরার মনে হলো একটা নৌকা যদি থাকতো। পাথুরে পাহাড়, পেছনে শালবন, চাঁদের আলো, নদীতে ঝর্নার পানি গড়িয়ে পরা, নদীর দুই পাড়র রহস্যময় অবয়ব, সবটা মিলিয়ে অপার্থিব দৃশ্য একটা। এমন সময় নিস্তব্ধ বনে ঝর্ণার পানি আছড়ে পরার শব্দ ছাড়াও আরো কিছু শব্দ টের পায় ওরা। কিছুক্ষণ কান পেতে আবীর বুঝতে পারে বেশ কয়েকজনের সমাবেত পায়ের শব্দ । আবীর হঠাৎ মীরাকে চুপ থাকার ইশারা করে গুহার মতো জায়গাটায় টেনে নিয়ে গেলো। দুই পাথরের ছোট্ট খাঁজটা গুহার মতো দেখাচ্ছে, ছোট্ট বেলায় এখানেই লুকাতো ওরা। বড় বেলায়ও অনায়াসে ওদের দু’জনকে পুরে নিলো সে, বাইরে থেকে কেউ বুঝবেও না কেউ আছে এখানে। কিন্তু জায়গাটা এত সরু যে ওদেরকে আগেপিছে করে দাঁড়াতে হলো। মীরা কিছুই বুঝলো না। আবীর ফিসফিস করে বললো “শিশ্শ্শ্শ… ওরা এসেছে”।
আবীরের কথা মীরার কানে না যেন পৌছালো হৃদয়ে।

ভীত চোখে মীরা উপরে চেয়ে দেখে পিয়ালী, আহনাফ, জাদিদ, রোজি এ চারজনে এসেছে। বেশ কিছুক্ষণ পর ওরা কথাবার্তা হাসাহাসি করে, কি যেন বের করলো পা ঝুলিয়ে বসে। একটু পর ম্যাচের কাঠিতে আগুন জ্বেলে উঠলো, আবীর বুঝতে পারলো সিগারেট ধরাচ্ছে ওরা। পাছে কেউ দেখে ফেলে তাই এখানে এসে এই নিষিদ্ধ কর্ম সাধন করছে এরা। একে একে সে সিগারেটে টান দিলো পিয়ালী, আহনাফ, রোজি। তিনজনেই খুক খুক কাশছে। জাদিদকে স্টেবল দেখাচ্ছে। বোঝা গেলো এ চারজনের মধ্যে তিনজনের গুরু হচ্ছে জাদিদ বাবাজি। ঝর্ণার কাছ থেকে ওদের তিনজনের প্রথম ধুমপানের সাক্ষী হলো এরা দুজনে।

এদের ধুমপান পর্ব শেষ, কিন্তু তারপর ও কি এক গল্প ফেঁদেছে ওরা। কথা যেন ফুরায়ই না এদের। এদিকে আবীরের শ্বাস-প্রশ্বাসের ধাক্কার ধকল আর নিতে পারছে না মীরা। এটুকু জায়গায় দুটো লম্বাচওড়া মানুষ ভাগাভাগি করে থাকাটা খুব টাফ। মীরার পিঠ লেগে আছে আবীরের বুকের সাথে। এমনি ভাবে দাঁড়িয়ে কিছুটা অস্বস্তি ও হয় মীরার। অস্বস্তি যে আবীরের ও হয়নি তেমন না, তবে ওদের কিছুই করার ছিলো না। বিবিসি পিয়ালী যদি জানে ওরা এখানে এসেছে, তাহলে পুরো বাড়ি তে জানবেই, পুরো দেশ জানলেও অবাক হবে না ও, পরে লজ্জার শেষ থাকবে না, তাই এমনি অস্বস্তিতে ডুবে ছিলো দুজনে অনেকটা সময়।

অবশেষে ওরা বাড়ির পথে হাঁটা দিলে মীরা দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে বাইরে দাঁড়ায়। আবীর ও বেরুলো ওর পিছনে। কেমন একটা ঘোর লাগা কন্ঠে জরানো ভাবে “সরি ” বলে মীরাকে। মীরা তৎক্ষনাৎ বলে-
“সরি ফর হেয়াট?” অন্ধকারেই কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে প্রশ্নের যুতসই উত্তর না দিতে পেরে
প্রসঙ্গ বদলাতে আবীর উপরে উঠার দিকে হাত বাড়িয়ে দেখায়। মীরা সেদিকে ঘুরে একটা মুচকি হাসি হাসে৷ তারপর ধীরে ধীরে উপরে উঠে ওরা।

ফিরতি পথে পাশাপাশি হেঁটেছে ওরা দুজনে, কিন্তু বলবার মতো কোন কথাই খুঁজে পায়নি দুজনে। বাড়ির কাছে পৌঁছে আবীর বলে-
: ” মীরা!”
আবীরের সামনে থাকা মীরা পিছন ফিরে তাকালে আবীর বলে-
: ” সরি ফর আনইন্টেনশনাল টাচ্”
কথাটা শুনে মুচকি হাসে মীরা। মনে মনে ভাবে-
” এ ছেলে বড় কবে হবে?”
দৌঁড়ে গিয়ে হাগ করে দিবো নাকি একটা ঝটকা। পরোক্ষণেই মীরা ভাবে বি পেশনস্ মীরা। তারপরই ওকে রেখেই চোরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায় মীরা।

চলবে…

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৯৯
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

রুমে এসে মীরা কেবলি ভাবতে থাকে ঘোরলাগা ঐটুকু সময়ের কথা। প্রথমটাতে অনাহুত কেও ভেবে ওকে সরিয়ে নিয়েছিলো আবীর সেখানে, পরে ওরা কাছাকাছি এলে বুঝতে পারলো যে আগতোরা অনাহুত কেউ না, ওদের চাচাতো ভাইবোন। মাথা ব্যাথার কথা বলে দুজনে এখনে এসেছে জানলে আর রক্ষা ছিলো না, তাই ওখানেই ঘাপটি মেরে ছিলো তখন।

মীরার বার বার মনে পরে আবীরের ওকে টেনে নেয়ার
কথাটা। যে ছেলে চুল মুছতে গিয়ে হাতের নিজের ছোঁয়া বাঁচিয়ে রাখে, তার পক্ষে এমন ইন্টেনশনালি টাচ অসম্ভব। কথাটা ভাবতেই কোমড়ের কাছে হাত রাখে সে। আবীরের সেই সময়কার ছোঁয়াটা যেন আবার অনুভব করতে চাইলো ও। পুরো শরীরে একটা ঝাঁকুনি অনুভব করলো মীরা, অদ্ভুত এক উচাটন শরীর আর মন জুড়ে। পুরুষসঙ্গে পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় এই অনুভুতি চেনা মীরার। মনে মনে ভাবে “নাহ ঘুমিয়ে থাকা আবীরটাকে ওকেই জাগিয়ে তুলতে হবে”

ঠিক তখনি দরজায় টোকা পরে, নিশ্চয়ই আবীর হবে ভেবে অপেক্ষা করে ওর ঘরে আসার। কিন্তু বাইরে আবীরা না, রাতের খাবার খেতে ডাকছে পিয়ালী।

শোয়া থেকে উঠে শাড়ি ঠিক করে ও, তারপর ওর সাথেই নিচে নেমে যায় মীরা । নিচে গিয়ে দেখে খাবার ঘর ভর্তি সকলে থাকলেও আবীর নেই। রাতের খাওয়া দেরী হয়, জ*বা*ই করা গরুর কলিজা, ফুসফুস দিয়ে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। খিচুড়ি রান্নায় দেরি হবে বলে মীরাকে খেয়ে নিতে বলে মেঝো বৌমনি। চা, গল্প আড্ডায় অনেক রাত অবধি গল্প হলো সকলে মিলে। আগামীকাল কি কি প্রোগ্রাম হবে তারও আলোচনা হলো। সবাইকে যার যার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন বড়রা।

রান্না শেষ হলে প্রথম দফায় বাড়ির বড়রা খেতে বসলো। মীরা সবাইকে খাবার বেড়ে খাওয়ালো। পরের দফায় বাড়ির মেয়ে বৌ-রা বসলো। মীরাকে বসতে বললে মীরা পথের দিকে চেয়ে “পরে খাবো ” বললে বড় বৌমনি এক ধমক দেয়, রাত বাজে কয়টা খবর আছে? তারপর মুচকি হেসে বলে- “আরে তোমার বরকে ডাকতে পাঠিয়েছি। এক্ষুনি আসলো বলে ”

“বিয়ের পর থেকে আবীর সবসময় ওর কাছাকাছি ছিলো। ঝর্ণা দেখে ফিরেছে সেই কখন, এরপর আর তার দেখা নেই। এমনিতেই তো সহজ হতে পারছে না বেচারা, তার উপর ঐ আন-ইনটেনশনাল টাচ্ এর পর যেন আরো ফ্রিজ হয়ে গেছে সে” -খেতে খেতে ভাবে মীরা।

ঠিক তখন ঘরে ঢুকে আবীর। রোজি তখন আবীরকে ধমক দিয়ে বলে-
: ” ভাইয়া কোথায় ছিলে তুমি? তোমাকে না দেখে ভাবীর যায় যায় অবস্থা” কথাটা বলেই মীরার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে রোজি। মীরা মাথা তুলে চোখ বড় করে তাকায় ওর দিকে। আবীর রোজির মাথায় আলতো করে থাপ্পড় দিয়ে খেতে বসে।

মীরা অপর পাশ থেকে লক্ষ্য করছিলো আবীরের খাওয়া। ডানে বামে না তাকিয়ে একমনে খেয়ে যাচ্ছে সে। মীরার বিরক্ত লাগে ব্যাপারটা৷ মনে মনে ভাবে “এত সংকোচের কি আছে? তুই তোর বিয়ে করা বউয়ের কোমড়ে হাত রেখেছিস তাও বিপদে পরে” এত হাসফাস, এত অস্বস্তির কি আছে?

“ভাগ্যিস বিপদে পরেছিলো সে” – কথাটা ভেবে হেসে দেয় মীরা। এমন সময় খাওয়া শেষে হাত ধুতে যায় আবীর। খাবার শেষ না করেই মীরা যায় ওর পিছু পিছু। একে একটা শিক্ষা না দিলেই নয়। ওর হাত ধুুতে ধুতে মীরা এসে হাজির সেখানে। ওকে দেখে নিজের হাত ধোয়া রেখে মীরাকে জায়গা করে দেয় আবীর দ্য জেন্টাল ম্যান। মীরা ঘুরে ওর মুখোমুখি দাঁড়ায়। আবীরের দিকে তাকিয়ে বলে-
: “কি সমস্যা? ”

প্রথমটাতে বুঝতে পারেনা আবীর কি জিজ্ঞেস করলো মীরা, উত্তর না পেয়ে মীরা আবার জিজ্ঞেস করে –

: ” সমস্যা কি আপনার?”

এমন সময় আহনাফ হাত ধুতে এলে রাগী মুড নিয়ে তারাহুরো করে হাত ধুয়ে সোজা উপরে চলে যায় মীরা। আবীর কল ছেড়ে দাঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়া দেখে।

হাত ধোয়ার পরও বেশ খানিকটা সময় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে আবীর। বুঝতে পারে না কেন এত অস্বস্তি হচ্ছে ওর।

অবশেষে উপরে যায় আবীর, ওর ঘরের দরজার কাছে এসে দরজায় নক করতে হাত রাখে। নক করতে দরজায় হাত রাখতেই দেখে দরজাটা খোলা। দরজা ঠেলে দেখে ঘরের ভিতর অন্ধকার। পেছন ফিরে বাইরে তাকায় ও, পুরো বাড়ি আলোয় জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু রুমে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ধীর পায়ে রুমে ঢুকে ও। তখনি রহস্যময় ভাবে বন্ধ হয়ে যায় দরজা। পরিস্থিতি বুঝবার চেষ্টা করে আবীর, কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে লাইট অন করতে সুইচ বোর্ডের দিকে এগুয় ও, এমন সময় একটা উষ্ণ হাত ওর কাঁধ স্পর্শ করে। চকিতে ঘুরে দাঁড়ায় ও। বিয়ে বাড়ির মরিচ বাতির অল্প আলোয় অন্ধকার ঘরে ওর সম্মুখে ফুটে ওঠে একটা অবয়ব। কাল মুহূর্ত বিলম্ব না করে আবীরের বুকে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পরে সেই অবয়বটা। দুই হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওকে। আবীরের হৃৎস্পন্দনের অস্বাভাবিকতায় হাত যেন অসাড় হয়ে আসে, ভয় পায় হাত বাড়াতে এর থেকে বাঁচতে কিংবা একে আপন করে নিতে। অবয়বটা হাত ছেড়ে আবীরের হাত দুটো জড়িয়ে দিলো নিজের গায়ে, তারপর আবার আবীরের বিশাল বুকে আছড়ে পড়ে সে। দিশেহারা আবীর যেন এতক্ষণে দিশা পেলো। অবয়বটার তৈরী করা বন্ধন শক্ত করে সে তার বলিষ্ঠ বাহু দিয়ে। কয়েকঘন্টা আগে মনে যে সংশয় ছিলো তা দূর হয় ওর। মীরা সেটাই বললো হয়তো এমন নিরব উত্তরে দিয়ে। মাথা উঁচিয়ে মীরা বলে-

: ” এত ভীতু কেন আপনি?”

মুচকি হাসে আবীর ওর কথা শুনে, তারপর বলে-

: “ভীতু আমি?”

: “তা নয়তো কি?”

জড়ানো অবস্থায়ই পেছনের দেয়ালে মীরাকে ঠেস দিয়ে মীরার খুব কাছে যায় আবীর, এত কাছ থেকে কেউই হয়তো দেখেনি কাওকে। দুজনের চোখেই অন্ধকার সয়ে এসেছে। আবছা আলোয় দেখতে পাচ্ছে দুজন দুজনকে। বেশ কিছু সময় একদৃষ্টিতে একে অপরকে দেখেছে ওরা , আবীরের চোখেমুখে দুষ্ট হাসির ঝিলিক, মীরার দৃষ্টিতে ভীতি।

আবীর মীরার কানের কাছে সরে এসে ফিসফিস করে বলে-

: “আমি চিন্তিত তবে মোটেই ভীতু না ”

তারপর আচমকা মীরার ঘাড়ে মুখ গুঁজে চুমু খায়। মীরার চোখ দুটো বিষ্ময়ে ভরে উঠে আবীরের হঠাৎ এমন বদলে যাওয়া দেখে। প্রথমটায় চমকিত হলেও, সময় লাগলো না সেই চমক কাটতে। হাত দুটো আবীরের থেকে আত্নরক্ষায় ব্যবহার না করে প্রসারিত করলো উষ্ণ আলিঙ্গনে। আলো আঁধারিতে অন্ধকারের গায়ে ভেসে উঠছে দুই নর-নারীর প্রথম প্রেমালিঙ্গণ।

ভালোবাসাবাসিতে কেউই কম যায় না কারো থেকে। মীরার এসবে পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকলেও আবীরের আনাড়ি ছোঁয়া মীরাকে গুড়িয়ে দিচ্ছে ভিতর থেকে।
সহ্য সীমা পেরিয়ে গেলে মীরাও নেমে পরে আবীরের ভালোবাসার শোধ মেটাতে। আলতো হাতে ওর দুই হাত আবীরের দুই গালের কাছে রেখে মাথাটা নিজের দিকে টেনে দীর্ঘ চুমু একে দেয় ওর ঠোঁটে। আবীর বুঝে উঠতে সময় নিলেও ছাত্র হিসেবে সবটুকু উজাড় করে নেমে পরে ভালোবাসার গুরুদক্ষিণা দিতে।

হঠাৎ মীরা আবীরকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরে গিয়ে বলে –

: “সরি”

আবীর ওর কাছে এসে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে –

: “সরি কেন?”

মীরা মুখটা কেমন গোমড়া করে বলে-

: ” সরি ফর ইন্টেনশনাল টাচ্ ”

কথাটা শুনে যেন তেড়ে আসে আবীর মীরার দিকে। মীরাও ওর থেকে নিজেকে বাঁচাতে দৌঁড়ে খাটের অপর প্রান্তে যায়। কিন্তু ও জানে আজ ওর আবীরের হাত থেকে রক্ষা নাই।

ভালোবাসার সে দীর্ঘ রাতে ভেঙে পরে দুজনের জড়তার সব দেয়াল। সারাটা রাত আবীর মীরাকে আগলে রাখে ওর বুকে। আবাধ্য মীরা বারো বছরের ব্যবধানে পোষ মানে আবীরের।

পরদিন থেকে দুজনের জীবণটা একটু যেন বদলে যায়। ঘর ভর্তি মানুষের সামনে চোখে চোখে কথা হয় দুজনে, ভালোবাসার আদান প্রদান হয় যখন তখন। সুযোগ পেলেই একটু ছুঁয়ে ফেলা, যখন তখন জড়িয়ে ধরা এসবও চলতে থাকে সমান তালে। না আবীর কিন্তু বেয়াড়া হয় নি, এখনো ভদ্রতার সীমানা মেনে চলে সে। সীমানা অতিক্রম করে মীরা। ঘর ভর্তি মানুষের সামনে কথা বলতে বলতে সুযোগ পেলেই উড়ো চুমু পাঠায় সে। আবীর তার শোধ দিতে না পারলেও সাদরে গ্রহণ করে মীরার দান। কাজিনদের সম্মুখে ওদের আড়ালে যখন তখন তর্জনী দিয়ে পিঠে আলপনা আঁকে মীরা। আবীর না পারে সহ্য করতে না পারে শোধ দিতে৷ একটু সুযোগ পেলেই আবীরকে জড়িয়ে ধরে মীরা, কারো আসার শব্দ পেলেই, আলিঙ্গন ছেড়ে ভদ্র মেয়ের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পরে। এবং তা এমন ভাবে যেন মুহূর্ত পূর্বে কিছুই হয়নি। আবীর হাসে ওর এসব কান্ড দেখে।

দুপুরে পিয়ালীর সাথে মীরাকে ঘরে যেতে দেখে আবীর। রাতের বৌভাত অনুষ্ঠানে সাজগোজের প্রস্তুতির আলাপে । খানিক বাদে ঘরে যায় আবীর। পিয়ালীকে বলে-

: “বৌমনি ডাকছে তোকে ”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও পিয়ালী বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

পিয়ালী বের হতেই দরজা আটকে দেয় আবীর। মীরা তখন কানের দুল কোনটা পরবে তা ঠিক করছিলো। আবীরকে ভর দুপুরে দরজা আটকাতে দেখে আবীরের দুষ্ট বুদ্ধির কিছুটা টের পা মীরা। না বোঝার ভান করে দুল দেখায় মনোযোগ দেয় ও। আবীর দূর থেকে দেখে কিছুক্ষণ মীরাকে। তারপর ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসা মীরার পিছনে এসে দাঁড়ায়। আয়নাতে মীরার প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে বলে-

: ” তুমি এত্ত ফাজিল! বাব্বাহ্”

বসা থেকে আবীরের দিকে ঘুরে মীরা, তারপর কোনকিছু না বোঝার ভান করে বলে-

: “কি করলাম আমি?”

মীরার কাছে এসে ওর গাল চেপে ধরে বলে-

: ” কি করলাম না?” বলেই চুমু খায় মীরার ঠোঁটে। মীরা ওকে সরিয়ে বলে-

: “আমি ফাজিল নাহ্, আর আপনি?”

: “আমাকে আর ভালো থাকতে দিলে কই, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে, এতদিন তো নিপাট ভদ্রলোক ছিলাম”

কথাটা শুনে মুখ ভেংচি দিয়ে বলে “হেহ্ ভদ্রলোক” বলেই গাল ফুলায় মীরা, ওকে রাগ করতে দেখে হেসে দেয় আবীর। মুগ্ধ চোরা চোখে মীরা আবীরের হাসি দেখে। তারপর বসে থেকেই জড়িয়ে ধরে আবীরকে। আবীরও জড়িয়ে রাখে ওকে। মীরা মনে মনে ভাবে-

: “নিজেকে কথা দিয়েছি আমি অনেক ভালোবাসবো তোমায় আবীর”

আবীর মীরার বৌভাত অনুষ্ঠান হবে রাতে। বিকেলের মধ্যে সব আত্মীয়রা এসে পরলো। বিয়ের অনুষ্ঠানে সাদাসিধে হলেও বৌভাত অনুষ্ঠান তারা জাঁকজমকপূর্ণ করেছেন। ঢাকা থেকে মীরাদের বাড়ির সকলে এসেছে। মোখলেস চাচা অসুস্থ থাকায় তিনি আর তার স্ত্রী আসেননি শুধু। আবীর সুট বুট পরে ওদের বাড়ির বিশাল গ্রাউন্ড করা স্টেজে কি যেন করছে। এমন সময় মীরাকে নিয়ে আসা গাড়ি থামে বাড়ির সদর দরজার সামনে। এগিয়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে মীরাকে সদরে অভ্যর্থনা জানায় আবীর। মুচকি হেসে আবীরের হাত ধরে গাড়ি থেকে নামে মীরা। বৌ সাজে
মীরাকে দেখে অস্ফুটে একটা শব্দ ফুটে উঠে- “মাশাল্লাহ “। বাড়ি ভর্তি লোকের কলরবে কেউ শুনতেই পায় না তা। দুজনের চোখই দুজনায় নিবন্ধ। এমনি সময় ফটোগ্রাফার সুন্দর একটা ছবি তুলে ওদের।

মীরা বৌভাত অনুষ্ঠানে নিজের ডিজাইন করা লেহেঙ্গা পরেছে। সাথে ডায়মন্ডের গহনা। মীরা গাড়ি থেকে নেমেই নিজের বাড়ির লোকেদের সাথে দেখা করতে যায়। ভারী লেহেঙ্গা পরে কষ্ট হওয়ায় আবীর হাত ধরে নিয়ে যায় ওকে। ওদের দুজনকে একসাথে দেখে সকলেই ভীষণ খুশি হয়। মীরার বাড়ির লোকেরা ও খুশি হয় মীরাকে সুখী দেখে। মীরার মা আবেগে কেঁদে ফেলেন। মীরা ওর মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে-

: ” কাঁদছো কেন মা?”

জাহানারা কান্না জড়ানে গলায় বলে-

: “এ কান্না আনন্দের রে মা, আজআমি খুব গর্বিতরে মা, নিজেকে ভুল প্রমাণিত হতে দেখে ”

টপিক চেন্জ করতে ইরা বলে-
: “আহ মা কি শুরু করলা আজকের দিনে?

আবীর পাশ থেকে বলে-

: “খালাম্মা নূহা…”

পাশ থেকে মীরা তাকায় ওর দিকে। তারপর বলে-

: “আগামীকাল কেবল আমি ফিরে যাবো ঢাকা, আপনি পরশুদিন বিদেশ থেকে বাই এয়ারে ঢাকায় আসবেন”

কথাটা শুনে একটু অবাক হয় ও, আবীরের বড় বৌমনি
এসে বলে-

: ” সেটাই ভালো হবে, ও তো জানে ওর বাবা বিদেশে, বুদ্ধিটা আমিই দিয়েছি মীরাকে”

হতভম্ব আবীর অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো মীরার দিকে। এসবের কিছুই জানায়নি মীরা ওকে। ইরা, মুরসালিনের পাশ থেকে বলে-

: “হ্যা এই ভালো হবে, আন্টির বুদ্ধিটা ফার্স ক্লাস হয়েছে”

ফিওনা, এসে মীরাকে স্টেজে তুলে। স্টেজে গিয়ে চমকে যায় মীরা। ওর সামনের দুটো টি-টেবিলে জুড়ে অনেকগুলো ডালা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ফল, কেক, পোলাও কোরমা এমনকি আস্ত খাসিও সাজিয়ে রাখা হয়েছে সেখানে। মীরা ভীষণ অবাক হয়ে যায় তাদের এমন কান্ড দেখে। সেখানে গিয়ে দেখে কেকের মধ্যে লিখে রাখা ” আদরের বউ”। মীরার নিজেকে সত্যি অনেক ভাগ্যবতী মনে হয় এমন আমুদে একটা পরিবারের একজন হতে পেরে। আবীর নিজেও কম ভাগ্যবান না মীরাকে পেয়ে। যতটুকু জানা ছিলো তার উপর বাড়তি পাওনা যোগ হয়েছে মীরার বেয়াড়াপনা৷ এসব ভেবে মুচকি হাসে ও। অনুষ্ঠান শেষ হলে লেহেঙ্গা বদলে এসে সদলবলে ডালাতে হানা দেয় মীরা। গান, গল্প, আড্ডায় অনেক রাত অবধি দুই পরিবারের সকলে মিলে আনন্দ করে। অবশেষে সুন্দর ভাবে বৌভাত অনুষ্ঠান শেষ হয় ওদের। বোনকে খুশি দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলে ইরা। মুরসালিন ওকে ধমক দিয়ে বলে-
” বোকা মেয়ে কাঁদছো কেন তুমি?”

চলবে…..

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ১০০
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে বসে আছে নুহা। গতকাল বাসায় এসেই ওর মা বলেছে আগামীকাল সকাল সাড়ে নয়টায় ওর বাবা আসছে দেশে । প্রথম বার বাবাকে দেখতে পাওয়ার উত্তেজনায় বেচারী রাতে ঘুমিয়েছে দেরী করে, বাবার জন্য কার্ড তৈরি করেছে সে, কিছুদিন আগে ভর্তি হওয়া ক্রাফট স্কুলে যেসব পাখি, প্রজাপতি তৈরী করা শিখেছে ও এ কয়েকদিনের মধ্যে তা দিয়েই কার্ড তৈরি করেছে নুহা। সাথে একটা পুরাতন ড্রইং ও লুকিয়ে ভরে রেখেছে খামে। যদিও আঁকা এই ছবিটাও রাখবে কিনা তা মা’কে জিজ্ঞেস করায় মা নিষেধ করেছিলো এটাকে খামে রাখতে। কিন্তু এটা বাবাকে দেখাতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে ওর।

রাতে মীরাও ঘুমিয়েছে দেরী করে। নূহা কি পরে যাবে, তা খুঁজে ঠিকঠাক করে রাখতে গিয়ে। নুহার কার্ড তৈরীতেও সময় লেগেছে অনেকটা। বাবাকে দেখার
খুশিতে সকালেও উঠে পরেছে মীরারও আগে। পাছে ভয় মা-না ওকে রেখেই বাবাকে আনতে চলে যায়।

ঘুম থেকে উঠে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না, খাম টাকে চেক করে ও। তারপর যায় মাজেদা খালার ঘরে। ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা। সেখান থেকে সকালের খাবার খেয়ে জামাকাপড় পরা শুরু করে ও। জামা পরে মেচিং ব্রেসলেট খুঁজতে ড্রেসিংটেবিল হাতানোর সময় খুটুরখাটুর শব্দে ঘুম ভাঙে মীরার। কম্বল থেকে মাথা বের করে শব্দের উৎস্য খুঁজে সে। চেয়ে দেখে ড্রেসিং টেবিলের উপর উঠে চুরির সেলফ থেকে ব্রেসলেট নেয়ার চেষ্টা করছে নূহা । ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে সময় তখন আটটা। মীরা উঠে নিঃশব্দে মেয়ের পিছনে গিয়ে নূহাকে উঁচু করে ধরে। চকিতে ভয় পেলেও মা’কে দেখে ধরা পারার হাসি হেসে দেয় ও। মীরাও অবাক হয়ে হেসে বলে-

: “আমাকে রেখেই চলে যাচ্ছিলে তুমি?”

: ” না মা, আমার তৈরি হতে তো অনেক সময় লেগে যায়, তাই আগে থেকে শুরু করলাম”

মীরা তখন নিজে তৈরি হওয়া রেখে মেয়েকে তৈরি করে দিলো। শীত হওয়ায় ফুল স্লিভের উলের টপ পরেছে ও, তার উপর স্লিভলেস ফ্লোরাল ড্রেস। রাতেই এসব ঠিক করে রেখেছিলো ও, তাই কোন গোলমাল হয় নি একা পরার পরও।

নুহার হালকা কোঁকড়া চুলগুলো ছেড়ে রেখেছে ও। গলায় বেধে দিয়েছে ম্যাচিং রঙের কিউট একটা মাফলার। মাথায় লাল টুকটুকে “নিউজবয়” স্টাইলের হ্যাট। নূহাকে এক্কেবারে পরীর মতো লাগছে। পাছে না দেরি হয়ে যায় তাই তারাহুরো করে নূহা বললো-

: “মা মোজা, জুতা আমি পরে নিচ্ছি, তুমি জলদি তৈরী হও তো, সাড়ে আটটা বাজে, সময় কিন্তু বেশী নাই”

মেয়ের ব্যাস্ততা দেখে মীরা হেসে ফেলে, তাপর মুখ গম্ভীর করে ওর গাল টেনে বলে-

: “বাবাকে পেলে ভুলে যাবে আমাকে?”

নূহা কেমন দমে যায় মায়ের কথা শুনে, উত্তর খুঁজেপেতে খোঁজ চালায় শব্দের ডেরায়, কিন্তু কোন উত্তরই খুঁজে পায় না ও। মেয়েকে এমন চিন্তায় নাকাল হতে দেখে হেসে দেয় মীরা, তারপর বলে-

: “আমি রেডিই, শুধু শাড়ি পরবো, বেশী সময় লাগবে না। তুমি কি কি নিবে তা তোমার ব্যাগে ঢুকাও, আমার জাস্ট দশ মিনিট লাগবে।

সত্যি দশ মিনিটের মধ্যে তৈরি হলো মীরা। জামদানী শাড়ির সাথে রঙের মিল করে শাল নিয়েছে একটা, সাজ বলতে কেবল গাঢ় লিপস্টিক পরেছে ঠোঁটে।

বেরুবার আগে মাজেদা খালাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে যায় মীরা। বাড়িতে কেবল তিনিই রেয়েছেন। মা, ইরা, মুরসালিন ওরা গত রাতেই ওদের নিজ নিজ বাড়িতে চলে গেছে, পাছে বাবা-মেয়ের রসায়নে কোন অস্বস্তির তৈরী না হয়।

সকাল সকাল রাস্তা মোটামুটি ফাঁকাই ছিলো, মীরা ড্রাইভারকে বলে গাড়িটাকে শাহবাগ হয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে। ড্রাইভার কথা মতো সেখানে যায়। কয়েকটা টিউলিপ দিয়ে ছোট্ট দেখে একটা বুকে তৈরি করে দিতে বলে মীরা দেকানিকে। ছোট নেয়ার কারন হচ্ছে নূহার ধরতে সুবিধা হয় যেন।

সেটাকে নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে ওরা। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকাই ছিলো সরকারি বন্ধ থাকায়৷ গাড়িতে বসে ম্যাসেজে কথা হয় আবীর মীরার। আবীর খুব নার্ভাস নূহার ব্যাপারে। বোর্ড পরীক্ষার সময়কার মতো অস্থিরতা মনের মধ্যে তা জানায় আবীর। মীরা হেসে উড়িয়ে দেয়। বলে- এত নার্ভাস ফিল করার কি আছে বলুন? উত্তরে আবীর বলে-

: ” বাচ্চাদের মন খুব সেনসেটিভ ”

সাহস আর ভরসা দিয়ে বলে –

: “আরেহ্ কিচ্ছু হবে না, টেক ইট ইজি”

অবশেষে এয়ারপোর্টে পৌছালো ওরা। ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট নূহা। আসেপাশের সকলেই ঘুরঘুর করে দেখছে ওদেরকে। মা মেয়ে দুজনই এত সুন্দর যে খুব মুডি মানুষটাও এক পলক দেখার ইচ্ছে দমন করতে পারছে না। কেউকেউ তো ওর ক্যাপ ধরে, আদর করছে, সেখানকার একজন মহিলা পুলিশ নূহাকে আদর করে কোলে তোলে। এতক্ষণ ধরে দূরে দাঁড়িফ থাকা পুলিশগুলোও ওর কাছাকাছি এসে আদর করলো ওকে। নাম জিজ্ঞাসা করলো ওর। আধোআধো বুলিতে আহ্লাদী কন্ঠে নূহা ওর নাম বললো। কাকে নিতে এসেছো এ প্রশ্নের উত্তরে নূহা বলে-

: “আমার বাবাকে..”

মীরা তাদের আরো কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়ে নুহাকে বললো-

: “নূহা তোমার বাবা এসে গেছেন ”

কর্মরত পুলিশের একজন ওদেরকে ভিতরে যাওয়ার সুযোগ করে দিলো।

মীরা ধন্যবাদ দিয়ে ভিতরে গেলো। ভিতরে ঢুকার ব্যাপারে ইদানীং রেস্ট্রিকশন জারি করেছে কর্তৃপক্ষ। সে হিসেবে ওরা ব্লেসিং।

ভিতরে ঢুকে নূহা এটা সেটা প্রশ্ন করছে ওর মাকে। কোথায় বাবা? কখন আসবে? কোন দিক দিয়ে আসবে? ইত্যাদি ইত্যাদি। মীরা ধৈর্য ধরে ওর উত্তর দেয়, আবীর টেক্সট করেছে যে- ও অন দা ওয়ে।

ডমেস্টিক ফ্লাইটে যেহেতু কোন চেকিং হয় না, ওর বেশী সময় লাগবে না। এক্সিট গামী লোকেদের ভিড়ে দূর থেকে মীরা আবীরের বিখ্যাত হাইট দেখেই সকলের মাঝে আলদা করে ফেলে আবীরকে। মীরা নূহার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বলে –

: “ঐ যে ”

ধীর পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে এলো হাস্যজ্জ্বল আবীর। নূহার সব এক্সাইটমেন্ট যেন উবে গেলো হঠাৎই। ফুলের ছোট্ট বুকেটা মায়ের কাছে রেখেই মায়ের পেছনে লুকালো যেন ও। মীরা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। পেছন থেকে সামনে আনতে চেষ্টা করলো নূহাকে। আবীর ইশারায় থামতে বললো মীরাকে। মীরা বলতে শুরু করলো গত রাত থেকে সকাল পর্যন্ত নূহার সব কর্মকাণ্ডের কথা। এরি মধ্যে নূহা মীরার শাড়ির আঁচলে ফাঁক দিয়ে চেয়ে দেখে আবীরকে। চোখে চোখ পরে যেতেই আবার পেছনে চলে যায়।

“কি জানি বেখাপ্পা লাগে হয়তো ওর বাবা হিসেবে আবীরকে। ওদের কাছেপিঠে সকলেই ফর্সা, এমনকি মাজেদা খালারও গায়ের বরন দুধ আলতা” এমনটাই ভাবে আবীর।

মীরা ডাকলো নূহাকে, বললো-

: “ফুল আর কার্ড যে আনলে বাবার জন্য দিবে না?

পেছনে দাঁড়িয়েই নিজের ব্যাগ খুলে কার্ড বের করে নূহা এগিয়ে দেয় আবীরের দিকে। আবীর কার্ড না ধরে হাত ধরে নূহার। বলে-

: “নূহা, মা আমার…..”

ওর মুখের কথা শুনে আবীরের দিকে তাকায় নূহা। পকেট থেকে চকলেট আর একটা গোলাপ বের করে নূহার হাতে দেয় আবীর। বাবা-মেয়ের প্রথম চোখাচোখি হয় তখনি। আবীরকে দেখেই চোখ নামিয়ে নেয় নূহা, লজ্জা পেয়েছে এমন ভাব ওর চোখ-মুখে। হাঁটু গেঁড়ে মেয়ের সমান সমান হয় আবীর। তারপর চুলগুলোতে হাত দিয়ে বলে-

: “মাশাল্লাহ, আমার মা তো ছবির চাইতেও অনেক বেশী সুন্দর ”

কথটা শুনে মায়ের দিকে তাকায় নূহা। যেন আবীরের কথার সত্যতা যাচাই করতেই ওর তাকানো। স্মিত
হেসে সম্মতি মীরা , যে সত্যি ও অনেক সুন্দর।

আবীর তখন নূহাকে প্রশ্নের সুরে বলে-

: “এত সুন্দর জামা কোত্থেকে এনেছো তুমি? ”

এতক্ষণে একটু যেন সহজ হলো নূহা, বললো-

: “এটা মা ইন্ডিয়া থেকে এনেছিলো”

আর এই ক্যাপটা?

: “আমেরিকায় আমার এক আন্টি আছে ফিওনা নাম, তিনি দিয়েছেন এটা আমাকে”

ক্যাপটা যে ফিওনা দিয়েছে তা আবীর জানতো না, সহজ হওয়ায় নূহাকে কোলে তুলে নিলো আবীর। সহজ ভাবেই আবীরের কোলে উঠলো নূহা। এয়ারপোর্টের ভিতর বাহিরে সকলে চেয়ে দেখছে ওদের। সকলেই হয়তো ভাবছে “এদের মাঝে কালো লোকটা বড্ড বেমানান” এমনটাই ভাবে আবীর। গাড়িতে বসে আবারো সংকুচিত হয়ে যায় নূহা। আবীর কার্ড খুলে আলাপ জমাতে চেষ্টা করে। নূহা একসময় ওর মায়ের কানে কানে কি একটা বলে। আবীর হেসে মীরাকে জিজ্ঞেস করে –

: ” কি বললো ও? ”

মীরা হেসে বলে-

” ও জিজ্ঞেস করলো – ও কি সত্যি আমার বাবা?”

আবীর হেসে ওর কাছে আসে, তারপর বলে-

: “সত্যি আমি তোমার বাবা, দেখো না আমাদের কত মিল? এই যে তোমার ঠোঁটের কাছে তিল, এই দেখো আমারো। আর হ্যা আরো একটা মিল রয়েছে আমাদের, বলেই নূহার সামনে হাত মেলে ধরে আবীর বলে- আমার হাতের আঙ্গুল এগারোটা, তোমারও হাতের আঙ্গুল এগারোটা দেখো, বলেই দুটো হাত পাশাপাশি রাখে আবীর।

মীরার ভিতরটা ছ্যাৎ করে উঠে আবীরের এ কথাটা শুনে। হঠাৎ মীরার মনে পরে কুৎসিত এক অতীতের কথা। এই কথা, হ্যা ঠিক এই উধাহরণটা দেখিয়েই রাজিব নোংরা কিছু কথা বলেছিলো মীরাকে। চোখ উপচে পানি আসে মীরার। তৎক্ষনাৎ মীরা গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চেখের পানি লুকায় ওদের থেকে। চোখের পানি মুছে মীরা যখন ওদের দিকে দেখে নূহা তখন আবীরের হাতে হাত রেখে আরো কিছু মিল খুঁজে।

একটু পরে দেখা যায় নূহা কুটুর কুটুর করে আবীরকে বলছে কার্ডের বিবরণ। একটু পরে আবীর বের করে খামের ভিতরে ভাজ করা কাগজের টুকরোটা। সেটা দেখে চোখ সরু হয় মীরার। হঠাৎই সব ভুলে মীরা নূহাকে নলে-

: ” এটা আনতে নিষেধ করেছিলাম না?”

অপরাধী ভঙ্গিতে হাসে নূহা। তখন নূহাকে কোলে টেনে নেয় আবীর। যেন শত্রুর সীমানা থেকে বাঁচিয়ে নিলো সে নূহাকে এমনি ভাব তার চোখে-মুখে। আবীর আর মীরা পাশাপাশি এখন। নূহার দিকে চেয়ে আবীর ছবিটা বুঝিয়ে দিতে বলে ওকে। নূহা লাজুক ভঙ্গিতে তাকায় মায়ের দিকে। যেন মা ওর শত্রুপক্ষের কেউ। আবীর ভরসার সুরে বলে-

: “আরেহ আমি আছি তো, ভয় পাচ্ছো কেন তুমি, কথাটা বলেই সামান্য পাশ ফিরে ছবিটাকে আড়াল করলো আবীর মীরার থেকে। তারপর নূহার থেকে বুঝে নিলো পুরো ছবির বিবরন।

” নূহা কয়েকটা বৃত্ত আর সরলরেখা দিয়ে চারজন মানুষের প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তুলেছে ছবিটায়। ছবিতে দুটো মাথায় রশির মতো কিছু ঝুলছে বলে বোঝা যাচ্ছে ঐ দুটো মেয়ে। একটা আকাড়ে বড় আরেকটা আকাড়ে ছোট। আর বাকী দুটো বৃত্তর মাথায় এক রত্তিও চুল দেয় নি নূহা। তবে বড় ছেলেটার নাকের নিচে একটা টান দিয়েছে উল্টো ভি শেপের মতো। আবীর বুঝলো এটা বাবার মোছ, মীরার দিকে পাশ ফিরে আবীর বললো-

: “এবার আমার মোছ রাখা লাগবে বুঝলা”

ছবি দিয়ে নূহা ওর অর্ধেক চেহারা ঢেকে হাসতে থাকে। তারপর আবীর আরেকটা চুল, মোছহীন ছবিটার দিকে তর্জনী রেখে কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে-

: ” এটা কে?। নুহা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে-

: “এটা আমার ছোট ভাই, দেখো না ও আমার চেয়েও ছোট” দুটো ছবির আকাড় মিলায় আবীর, সত্যি এটা নূহার ছবির চেয়ে একটু ছোট। খুব সুন্দর হয়েছে বলে ছবিটা ভাজ করে পকেটে নেয় আবীর। তারপর আবীরকে নূহা ওর বন্ধুদের গল্প বলতে শুরু করে। মনোযোগী শ্রোতার মতো অখন্ড মনোযোগে শুনে তা আবীর৷ একটু পর পর নূহার মুখের সামনে চলে আসা চুল গুলো সরিয়ে দেয় যত্ন করে।

মীরা মনে মনে ভাবে-

: “শুরুতেই সামলে নিয়েছে আবীর নূহাকে, মর্নিং শোজ দা ডে”

নিশ্চুপ মীরা কেবলি চেয়ে দেখে ওদের বাবা-মেয়ের কথোপকথন। এই গাড়িতে বসে যত কথা নূহা আবীরকে বলেছে, কিংবা যতটা শুনেছে আবীর নূহাকে, তার শত ভাগের এক ভাগও রাজিব মনোযোগ দেয়নি ওর জন্মের সন্তানকে। নিজের জন্য স্বামী খোঁজে নি মীরা, সন্তানের জন্য বাবা খুঁজেছে। এবং ও তা পেয়েছে……

মনের ভিতর থেকে অনেক বড় ভার নামে মীরার। নিজের হালকা লাগে ভীষণ, যেন গাড়িটার ছাদ না থাকলে ও উড়েই যেতো মীরা।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে