প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৯৩
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
আবীরদের বসার ঘরে ধপ করে বসে পরে মীরা। ব্যাপারটা যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না ও। আবীর এমনটা করতে পারলো?
হুট করেই চোখ উপচে নোনা পানির স্রোত গড়িয়ে পরলো দুই গাল বেয়ে। মীরা তখনো যেন সবটা বুঝতে উঠতে পারে নি। আবীর চলে যাওয়ার জটিল অংকে ব্যাস্ত ওর ব্রেইন জেনে গেছে আবীর নেই, এখন কাঁদা উচিত, তাইতো চোখ পূর্ণ নোনা জলে, অথচ মীরার চেহারায় কান্নার কোন লক্ষণ নেই, নিপাট সরল চিন্তামগ্ন মুখ। মন আর মাথার সংযোগ ঘটাতে ব্যার্থ মীরা তখনো হিসাব আবীর নামের জটিল অংকের হিসাব মেলাতে ব্যাস্ত।
কিছু সময় এমনি কাটার পর হঠাৎ-ই দুই হাতে মুখ চেপে কাঁদতে থাকে মীরা। এতক্ষণে মন-মাথা দু’টোই বুঝলো চলে গেছে আবীর। ভিতরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। আবীর পারলো ওর সাথে এমনটা করতে? আপনজন না ভাবুক, না দিক ওর জীবণে ঠাঁই, পরিচিত হিসেবেও তো ও জানতে পারতো ওর ঢাকা ছাড়ার খবরটা। এত কঠিন আবীরের হৃদয়, এত ঘৃণা ওর মীরার প্রতি, যে একটাবার জানানোটা ও প্রয়োজন মনে করলো না।
এমন সময় সোবহান চাচা চা নিয়ে ঘরে ঢুকে। তার ডাকে হুঁশ ফিরে যেন ওর। মীরাকে চা দিলে ঘড়িতে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায় মীরা। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কি একটা করতে করতে, পিছন থেকে ডাকলে মীরা উত্তর দেয় – চা খাওয়ার সময় নেই চাচা, আজ আসি। বলেই দ্রুত বেরিয়ে পরে ওদের বাড়ি থেকে।
চওড়া গলির পথ টুকু পেরিয়ে মেইন রোডে অপেক্ষা করে “পাঠাও” এর কল করা গাড়ির অপেক্ষায়। মিনিট তিনেকের মধ্যে গাড়ি এসে হাজির হয় মেইন রোড সংলগ্ন ইস্টার্ন ক্লাব মাঠের সামনে। সেখান থেকে গাড়িতে উঠে মীরা নক করে ফিওনাকে৷ মীরা আর ফিওনার দুই দেশের সময়ের পার্থক্য এগারো ঘন্টা। এখন স্থানীয় সময় এগারোটা পয়তাল্লিশ, তারমানে এখনো ঘুমিয়ে পরেনি ফিওনা, ওকে পাওয়া যাবে ফোন করলে। সাত-পাঁচ না ভেবে ফিওনাকে কল করে মীরা। ফোনটা বেজে কেটে যাচ্ছে, কেও রিসিভ করছে না।
ওকে কয়েকবার চেষ্টা করে না পেয়ে একটা টেক্সট করে মীরা। “call me, It’s urgent ” খুব সম্ভবত ফোনটা সাইলেন্ট। নতুন বাচ্চাকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়তো, কিংবা ঘুমিয়ে পরেছে।
ফিওনাকে ম্যাসেজ করে নভোএয়ারের ওয়েবসাইট ভিজিট করে মীরা। ঢাকা-চট্টগ্রামের একটা টিকিট বুক করে ও গাড়িতে বসেই। ইদানীং জরুরি কাজে বাই এয়ারে হুটহাট করে ঢাকার বাইরে যাতায়াতে করতে হয়েছে মীরাকে। তাই টিকিট বুক করতে সময় লাগলো না ওর। ওয়েবসাইটে দেখাচ্ছে ডিপার্চার টাইম দুপুর একটা। এখন সময় এগারোটা পঞ্চান্ন। তারমানে ডমেস্টিক ঐ ফ্লাইট ধরতে সাড়ে বারোটার মধ্যে এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে হবে মীরাকে। এত অল্প সময়ে যেতে পারবে ও?
এত খারাপের মধ্যে আশার খবর হচ্ছে আজ শুক্রবার। রাস্তায় আজ গাড়ির চাপ কম থাকবে। পথের দূরত্বের বিপরীতে সময় খুবই নগন্য। তবুও মনের মধ্যে কেন উচাটন, কোন চাঞ্চল্য নেই, মীরার৷ গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে ধীর স্থির ভাবে বসে আছে ও। দেখলে মনে হবে ঘুমিয়ে আছে । কিন্তু চোখ বেয়ে পরছে নিরব কান্নার স্রোত। মনে একটাই জিদ ওর এত কিসের দেমাগ তার? এত কেন সাহস মীরাকে উপেক্ষা করবার৷
এরমধ্যে মীরা আবার ট্রাই করে ফিওনাকে। এবারও সেইম রিং হচ্ছে কেউ রিসিভ করছে না। উপায়ন্তর না পেয়ে মীরা কল করে আবীরের বন্ধু টুটুলকে। আবীরের ব্যবসা থাকা কালীন দীর্ঘ সময় একসাথে কাজ করেছে টুটুল আবীরের সাথে। এবার অসুস্থ থাকাকালীন সময়েও টুটুল হসপিটালে এসে দেখে গেছে আবীরকে। আবীরের বন্ধু হওয়ার সুবাদে মীরাকে আগেই চিনতো টুটুল তবে হসপিটালেই ওদের প্রথম আলাপ হয়।
টুটুল আবীর ব্যবসায়ী হলেও ওরা ফ্যামেলি ফ্রেন্ডের মতো। তাই টুটুল ওদের দুজনের আদ্যোপান্ত সবটাই জানে। ও নিজেও চায় সব ভুলে আবীর, মীরা এক হোক আবার। ওদের এড্রেস চাইতে ফোন করে টুটুলকে সবটা খুলে বলতে হয় না মীরাকে। ও আবীরের গ্রামের বাড়ির এড্রেস চাওয়ায় কোন বাক্য ব্যয় না করে সেটা টেক্সট করে দেয় মীরাকে। টেক্সট পাঠিয়ে কল ব্যাক করে টুটুল নিজ থেকেই বলে-
: আসলে কি বলবো বলুন, আবীর ছেলেটা বরাবরই বর্ণচোরা। বুক ফেটে মরে যাবে তবুও মুখ ফুটবে না ওর। আমি জানি ও আপনাকে না বলেই বাড়ি চলে গেছে, সত্যি বলতে ও নিজেকে বোঝা মনে করছে আপনার জীবণে। কিন্তু আপনাকে যে ও এখনো ভালোবাসে সেটা না বললেও আমি টের পাই। তাইতো ওকে অনেক বুঝিয়েছি আমি, কিন্তু যতই বোঝাই ওর এক কথা- “মীরা আরো বেটার কাওকে ডিজার্ভ করে’ আপনি শক্ত করে ধরেন ওকে। জানি ও বাইরে থেকে দূর্ভেদ্য, কিন্তু সেটা ভেদ করতে পারলে দেখবেন ও কত কোমল, কত শুদ্ধ একটা মানুষ। নিজের বন্ধু বলে বলছি না, ও সত্যি চমৎকার একজন মানুষ।
উত্তরে মীরা চুপ ছিলো পুরোটা সময়। কথা শেষ করে টুটুল ফোন রেখে দিলে রাস্তায় নজর দেয় মীরা। টুটুলের কথা শুনে আরো রাগ হয় মীরার আবীরের প্রতি। ভালোই যখন বাসিস তবে কেন ছুটে পালানো?
বদের হাড্ডি একটা।
গাড়ি এখন মধ্য বাড্ডায় রয়েছে। আনমনে পথের দিতে তাকিয়ে থাকে মীরা। আবীরকে পাওয়াটা এত কেন কঠিন হয়ে যাচ্ছে? কেন এক পা এগুলো আবীর দশ পা পিছিয়ে যাচ্ছে?
এমন সময় সিগন্যালে আটকে পরে ওদের গড়িটা। ফোন বের করে গুগল ম্যাপ চেক করে মীরা, নাহ্ শুক্রবারের দুপুর হওয়ায় জ্যাম নেই কোথাও, রাস্তা মোটামুটি ফাঁকাই বকা চলে। এ সিগন্যাল ছাড়া গাড়ি রানিং রয়েছে পুরোটা সময় কোথাও কোন সিগন্যাল এ থামতে হয় নি। ফোনের ঘড়ি বলছে সময় এখন বারোটা বিশ।
মীরার মনে চাপা উচাটন, শেষ পর্যন্ত পৌছাতে পারবে তো? মনে মনে ঠিক করে ও, যদি একটার ওই ফ্লাইট মিস করে মীরা। তাহলে আর কখনোই সামনা সামনি হবে না ও আবীরের।
এমনি একেকটা অভিমানী মেঘ এসে ভীড় করে মীরার মনের আকাশে। এরপর সময় কাটতে লাগলো সময়ের মতো করে…..
———————————–
এদিকে বাড়ির বাগানে আড্ডায় সকলের সাথে বসে আছে আবীর। বাড়ি ভর্তি কাজিনেরা সকলে মিলে ওর বড় চাচার ছোট ছেলে আহনাফের ব্যাচলর পার্টি করছে। পাশেই বড়রা বিকেলের চায়ের আড্ডায় মেতেছে। সন্ধ্যায় বারবিকিউ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ছেলেরা। একদল মেয়েরা ক্রাফট দিয়ে সাজাচ্ছে একপাশে। আরেক দল টেবিলে ফুড ডেকোরেশন করছে। কেউ লাইট লাগাচ্ছে তো কেউ সাউন্ড বক্সে সাউন্ড চেক করছে। সকলেই ব্যাস্ত কোন না কোন কাজে। এদের বেশীরভাগই দেশের বাহিরে থাকে। কেউ পড়াশোনা করে, কেউবা নিজের পরিবার নিয়ে সেখানে স্যাটেল। এদের একসাথে পাওয়া মানে হাতে চাঁদ পাওয়া। সকলের চোখেমুখে খুশি উপচে পরছে যেন।
বড় চাচার ছোট ছেলের বিয়ের উপলক্ষে সকলে এলেও ফিওনা আসতে পারছে না। নতুন শহর, নতুন বাচ্চা সব মিলিয়ে ও অনুপস্থিত এখানে। চা খাওয়া শেষে বড়রা ভিতরে চলে গেলো। শীতের দিনে বেলা ছোট হওয়ায় দিনের আলো নিভু নিভু। মাগরিবের আজান পরলো বলে। এত কাজের মধ্যে লম্বু আবীরকে দেখা যাচ্ছে স্টেজে ব্যানরা আটকাতে। বাড়ি থেকে বিদুৎতের লাইন টানার কাজ করছে সায়মন। এমন সময় দুম করে বাড়ির সব আলো নিভে যায়।
ব্যানার রেখে আবির সায়মনকে রাগাতে থাকে। সন্ধ্যা হলো বলে, তবুও এখনো বাইরে কোন আলোর ব্যাবস্থা তো হলোই না উল্টো পুরো বাড়ির লাইন কেটে বসে আছে সে। সায়মন সহ অনেকেই চেষ্টা করছে, তবে সমস্যা কোথায় তা ধরতে পারছে না কেউ। কামাড়ের কাজ কি কুমোরকে দিয়ে হয়? বড় চাচী বাড়ির কাজের ছেলেকে পাঠিয়েছে মিস্ত্রির খোঁজে।
একটু পরে সন্ধ্যা নেমে এলো পাহাড়ের ঢালু বেয়ে। পাহাড়ি ঢালে গাছগাছালির ঘেরা আবীরদের দাদার বাড়িটা ওর দাদা এমন জায়গায় তৈরি করেছে যে দূর থেকে সূর্যাস্ত দেখে মনে হয় সূর্য ওদের বাড়ির পেছনে লুকালো যেন। পুরে বাড়িতে বিদ্যুৎ না থাকায় হুট করে চারপাশ যেন পুরোপুরি অন্ধকারে ডুবে গেলো । সাথে সাথে মাগরিবের আজান পরলো চারপাশে। অন্ধকারের মধ্যেই বড়রা নামাজে গেলো। বাইরে তখন ল্যাম্প দিয়ে কাজ চলছে।
আবীরও ওদের সাথে চেষ্টা করছে লাইন মেরামতের। এমন সময় আবীরকে ডাকতে আসে বাড়ির কাজের ছেলে বিপুল। ও বললো – কে নাকি এসেছে আবীরের খোঁজে। বিপুলের কথায় অবাক হয় আবীর। ওকে আবার খুঁজবে কে?
উঠে দাঁড়িয়ে বিপুলের পিছু যায় আবীর। আবীরকে পথ দেখিয়ে ভিতরের বাড়িতে যায় বিপুল। অন্ধকারে দূর থেকে গাছের নিচে একটা একটা অবয়ব চোখে পরে আবীরের। চারদিকে অন্ধকার, তবুও গাছের নিচে দন্ডয়মান সেই নারী মূর্তি দেখে অবাক হলো ও। এ অবয়ব, দন্ডয়মান নারী মূর্তিকে অন্ধকারে ও ঠিক চিনতে পারলো আবীর। ঠিক তখনই ওর হৃদপিণ্ড যেন খামচে ধরলো কেউ। হাঁটার গতি ধীর হয়ে গেলো। সেই নারী মূর্তি ওর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কি ভেবে যেন আশেপাশে দেখলো আবীর। নাহ্ বড়রা কেউ নেই এখানে। কাছাকাছি পৌঁছে আবীরই প্রথম প্রশ্ন করে তাকে-
: “তুমি এখানে!?”
আলো থাকলে হয়তে আবীর দেখতো ওর সামনে দাঁড়ানো অগ্নিমূর্তিকে, তখন হয়তো নিপাট এই প্রশ্ন করা কঠিন হতো ওর। সেদিক বিবেচনায় অন্ধকারটা বেশ উপকার-ই করলো আবীরের।
অস্ফুটে সেই দন্ডয়মান মুর্তিটি বললো-
: ” একটু বাইরে আসবেন? দুটো কথা সামনাসামনি বলতে আমি এতদূর এসেছি, কথা দুটো বলেই চলে যাবো?”
: “বাইরে কেন? ভেতরে আসো?”
: “নাহ্, থাক ভিতরে যাবো না আমি। আচ্ছা আপনাকে বাইরে যেতে হবে না, অনেক কষ্ট করলেন আপনি আমার জন্য আর আপনাকে কষ্ট দিবো না”
: “এভাবে কথা বলছো কেন তুমি?”
: “কিভাবে কথা বলবো আমি?
আবীর ঠান্ডা গলায় বললো –
: ” তুমি অনেক ক্লান্ত, চলো ভিতরে বসে কথা বলি ”
: “নাহ্, আমি এখানেই ঠিক আছি। এখন আপনি আমাকে বলেন – ” কেনো আমাকে না বলে এখানে চলে এসেছেন আপনি? অন্য সব কিছু বাদ পরিচিত হিসেবেও কি আমি জানতে পারি না আপনার ঢাকা ছাড়ার খবরটা?
কিসের এত দম্ভ আপনার? কেন আপনি আমাকে সবসময় তুচ্ছজ্ঞান করেন? জবাব দিন”
: “আমি সরি তোমাকে বলি নি এখানে চলে আসার কথা, আসলে তুমি নূহার অসুস্থতা নিয়ে পেরেশানিতে ছিলে তাই, আর দম্ভের যে কথাটা বললে, ওটা তোমার ভুল ধারনা”
শেষের কথাটা শুনে যেন জ্বেলে উঠলো মীরা। রাগান্বিত কন্ঠে বললো-
: “দম্ভ নয়তো কি? আপনার এত অপমান, অবজ্ঞা, সহ্য করেও আমি আপনার দিকে এক পা এগুচ্ছি, তো আপনি দশ পা পিছিয়ে যাচ্ছেন, কেন?
কেন আপনি বার বার একই কথা বলেন-
“you deserve better”?
“you deserve better”?
এর উত্তরে মৌণ থাকে আবীর, কি বলবে বুঝতে পারে না । আবীরকে চুপ করে থাকতে দেখে মীরা কঠিন গলায় বলে-
: “আমি কি তাহলে ধরে নিবো আমি আপনার যোগ্য না, কিংবা আপনি আপনার মনের এক্সেস অন্য কাওকে দিয়ে রেখেছেন? ”
ম্লান হাসি হেসে আবীর বলে-
: “এরকম কিছুই না”
আবীরের হাসির শব্দে এবার যেন ধৈর্যচ্যুত হয় মীরা। ওর কাছে এসে কঠিন গলায় বলে-
: ” তাহলে আপনার সমস্যা কোথায়? কেন আপনি বারবার আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন? বলুন, কি সমস্যা আপনার, আমি না হয় একবার ভুল করেছিলাম, তার শাস্তিও যথেষ্ট হয়েছে।
অন্যত্র তাকিয়ে চুপ করে থাকে মরা। তারপর আবার আবীরের চোখে চোখ রেখে আগেরচেয়ে ও কঠিন গলায় বলে- “নাকি আমি বিবাহিত, এক বাচ্চার মা বলে আপনার আমাকে একসেপ্ট করতে…….
কথাটা শেষ করতে দেয় না আবীর মীরাকে। হাত দিয়ে মীরার মুখ চেপে ধরে। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে-
: ” আমি যাকে ভালোবাসি তার ভালো মন্দ সবটা নিয়ে ভালোবাসি, তোমার মিনিং ফুল লাইফে আমার নামে একটা মিনিংলেস চ্যাপ্টার থাকুক তা আমি চাই না”
কথাটা বলেই মুখ থেকে হাত সরিয়ে দূরে সরে যায় আবীর। যেন ভুল করে অন্য দেশের সীমানায় ঢুকে পরেছিলো ও। বুঝতে পেরেই নিরাপদে সরে গেলো।
থুম ধরে মীরা দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আবীর এভাবে ওর মুখ চেপে ধরবে কল্পনা করে নি ও। কেন জানি মীরার রাগ হঠাৎ-ই পানি হয়ে গেলো। তারপর মৌণতা ভেঙে আহত কন্ঠে মীরা বললো-
: ” আপনি এমন কেন ভাবছেন? আজ আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, সেই পথটা আপনার দেখানো। বিশ্বাস করুন
আপনাকে যদি আমার জীবণে পাই আমি আপনিই হবেন আমার লাইফের সবচেয়ে মিনিংফুল চ্যাপ্টার। আমার জীবণে অর্থ, ক্ষমতা, সম্মান সব আছে কিন্তু শান্তি নেই। জীবণে আপনার চেয়ে বেটার কাওকে হয়তো পাবো আমি, কিন্তু অন্ধকারে আমাকে না দেখেও যে আমার ক্লান্তি টের পায় তার মতো শান্তি এই দুনিয়ার কেউ আমাকে দিতে পারবে না”
চলবে……
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৯৪
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
বিয়ে বাড়ির ব্যাস্ততায় মুখর চারপাশ। সকলেই এই সেই নানান কাজে ব্যাস্ত। এদিকে মীরা ঢাকা ফিরে গেছে, মাঝখানে ঝড়ের গতিতে কত কিছু হয়ে গেলো তবুও আবীর যেন ঘোরের মধ্যেই রয়েছে এখনো। বিয়ের আয়োজন, কোলাহল, ব্যাস্ততা আবীর কে যেন ঐ অন্ধকার সন্ধ্যার কথোপকথনের ঘোর থেকে বের করতে পারছে না। সে কথোপকথন এ বুদ থাকতেই যেন ভালো লাগছে ওর।
একটু আগে বড় চাচী এসে তৈরী হওয়ার তাগাদা দিয়ে গেছে সকলকে। বৌ আনতে ঢাকায় যেতে হবে, বিয়ে পড়ানো হলে তাকে আবার বাড়িতে আনতে হবে। এতখানি পথ যাওয়া আসা, চাট্টিখানি কথা!
আবীরের উদাস ভাব দেখে মনে হচ্ছে ও না গিয়ে পারলে যেতো না। এমনিই চিন্তার নদীতে ডুবে থাকতো মীরাকে নিয়ে।
আবীরের অনাড়ম্বর জীবনে সারপ্রাইজ রয়েছে হাতে গোনা কয়েকটা। ঐদিন মীরার আবীরকে খুঁজতে খুঁজতে চিটাগং চলে আসাটা ওর জীবণের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ ছিলো। যদিও পূর্বতন বড় সারপ্রাইজটাও মীরাই দিয়েছিলো ওকে, বিয়ের পরদিন ওর দেয়া আংটি বিক্রি করে সে টাকা দিয়ে অন্য কাওকে বিয়ে করে।
আবীরের মনে কেমন যেন উচাটন আজ। ও বুঝে গেছে, যতই পালাতে চেষ্টা করুক, না বোঝার ভান ধরুক মীরা ওর জীবণ নাট্যের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তা না হলে যেই মেয়ে কিছু না বোঝার বয়সে বুঝেছিলো আবীরকে ত্যাগ করতে হবে, সেই মেয়ে এখন সব বুঝে, নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়েও পিছু নিয়েছে ওর। এটা কি ওর দায় নাকি দয়া?
কথাটা মীরা ঢাকা ফিরে যাবার পর ওকে ফ্রেঙ্কলি জিজ্ঞেসা ও করেছিলো আবীর। উত্তরে মীরা বলেছিলো-
: ” এটা কি আপনি তা বুঝেন না? ”
আবীর ভাবলেশহীন ভাবে বলেছিলো-
: “না”
উত্তরে মীরা বলেছিলো-
: “এটা আর যাই হোক দায় কিংবা দয়া কিছুই না”
ঘড়িতে সকাল সাড়ে দশটা বেজে গেছে। পিয়ালী এসে আবার তাগাদা দেয় আবীরকে, বলে-
: “কিরে ভাই, আমরা কি তোরে রেখেই রওনা দিয়ে দিবো? ”
শোয়া থেকে উঠে পরলো আবীর। যেন সত্যি ওকে রেখেই রওনা দিয়ে দিলো ওরা। তরপর বললো-
: “আরেহ দাঁড়া, আমাকে না নিলে তারা খেতে দিবে তোদের? হুহ্। ছেলেদের তৈরী হতে কি ছয় মাস নয় মাস লাগে?”
বলেই উঠে বসলো আবীর। পিয়ালী মুচকি হেসে বাড়ির চাচী-ফুফুদের খবর দিতে গেলো। তারা সকলে কি সব রিচুয়্যাল মেনে গোসল করালো বরকে। তারপর কাজিনরা সকলে মিলে শেরওয়ানি, পাগড়ি পরিয়ে তৈরি করলো বরকে। অবশেষে তৈরী হয়ে রওনা দিলো ওরা সাড়ে এগারোটার মধ্যে। গাড়ি স্মুথ ভাবে বিশাল দূরত্ব পেরিয়ে সাড়ে তিনটায় পৌঁছে গেলো কনের বাড়ি। কোন আড়ম্বরপূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠান না এটি, কেবল নিকট আত্মীয়দের নিয়ে সাদামাটা বিয়ে।
বিয়ে সাদামাটা হলেও গেইট ধরা, জুতা লুকানো সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করলো কনে পক্ষের ছেলেপেলেরা। বর মহাশয় গেইটে কোন ঝুটঝামেলা, বার্গেনিং না করে ওদেরকে আটক করা সাঙ্গোপাঙ্গর ডিমান্ড ফুলফিল করে ভিতরে প্রবেশ করলো। কাজিনরা সকলে ফিসফাস করছে বরের হাবভাব দেখে।
মুখ পোড়া পিয়ালী বরের কানে কানে বললো-
: “এহে্ আর যে তর সহিতেছে না… তাহাদিগকে কি বলিবো বৌ-খানা আমাদিগকে জলদি বুঝাইয়া দিতে, আমরা তা হইলে তাহাকে লইয়া এইখান হইতে দ্রুত প্রস্থান করি”
বর বেচারা লাজুক মুখে রাগ দেখায় পিয়ালীকে মনে মনে বলে-
: “আহা, বেহায়াপনা বেশী হয়ে গেলো কি?”
এদিকে খাওয়া দাওয়ার পর্ব শুরু হয়ে গেলো। বর বেচারার খাবারের দিকে মন নাই, তার মন পরে আছে কনের কাছে। কখন তাকে দেখবে।
আয়োজন ঘরোয়া হলেও কনে পক্ষ বিশাল ডালা সাজিয়ে হুলুস্থুল কান্ড করে ফেলেছে। দুপক্ষের ছেলেপেলেরা বরের সাথে খাবার খেলো। খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে বিয়ের আসরে বসানো হয় বরকে। সুন্দর নেটের পর্দা আর ফুল দিয়ে দেয়াল করা হয়েছে বর কনের মাঝখানে। আবছা দেখা যাচ্ছে দু’পাশের সবকিছু।
একটু বাদে কনের দুই খালা নিয়ে আসে কনেকে। লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে মাথা তুলে কনেকে লুকিয়ে দেখে বর। কনেকে দেখে একটা ধাক্কার মতো খায় সে। মনে মনে ভাবে এমন একজনকে নিজের করে পাওয়ার জন্য শত বছর তপস্যা করা যায়৷
কনে নিজেও তাকায় বরের দিকে। মুচকি হেসে চোখ নামিয়ে নেয় সে। কনের খালারা তাকে বসিয়ে দেয় বরের অপর প্রান্তে।
বরের মেঝো চাচী বলেন-
: “কিরে বৌ এগুলো কোন শাড়ি পরেছে? আমরা তো এটা কিনি নি”
বর ফিসফাস করে পিয়ালীকে বলে- “এটা আমার ওকে দেয়া প্রথম উপহার ছিলো”
পীচ কালারের জমিনের উপর সোনালী সুতোর কাজ করা জামদানী গায়ে বউকে দেখতে ভীষণ সুন্দর লাগছে। একেবারে সাদামাটা সাজে সেজেছে সে। গলায় সিম্পল ডিজাইনের নেকলেস, কানে দুল কপালে টিকলি আর দুই হাত ভর্তি কাচের চুড়ি। এ চুড়ি গুলোও বরের দেয়া প্রথম উপহার। কনেকে দেখে মুগ্ধতা সকলের চোখেমুখে। তারা নিজেরাও ভীষণ খুশি ঘরের ছেলের জন্য এমন বৌ পেয়ে।
অবশেষে কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করে।
মুসলিম আইনের চিরায়ত ধারার ন্যায় কাজী সবিস্তারে বিবাহ নামা পড়ে শুনানোর পর প্রথমে কনের পক্ষ হতে সম্মতি চান, বলেন-
: “বলুন মা আলহামদুলিল্লাহ কবুল”
উত্তরে কনে কাঁদতে শুরু করে, এটা ব্যাতিক্রম কিছু না। বিদায় মুহূর্তে সব কনেরাই বাবা-মার থেকে আলাদা হওয়ার কষ্টে কাঁদে, কিন্তু কনের কান্নার থামা থামি না দেখে বর বেচারা ঘাবড়ে যায়, মনে মনে ভাবে এত শক্তপোক্ত মনের মেয়েটা এমনি করে কাঁদছে কেন?”
কনের মা খালারা তাকে কবুল বলতে একপ্রকার জোরাজোরি করে। নিজের পছন্দের পাত্রের সাথে বিয়ে হচ্ছে, তাহলে এত কান্নাকাটির কি আছে? কনের যেন কান্নার বাঁধ ভেঙেছে।
বর বেচারা ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করতে উঠে দাঁড়ায়। বড়দের সম্মতি চেয়ে দুজনের মধ্যখানে দেয়া পর্দার দেয়াল ভেদ করে কনের কাছে যায়। দুই হাঁটুতে মাথা গুজে কান্না করা কনের কাঁধে হাত রাখে বর। মাথা তুলে হবু বরকে দেখে কান্না যেন আরো বাড়ে তার।
বর- বেচারা একটা বড়সড় ধাক্কা খায় কনেকে কাছ থেকে দেখে। বিয়ের কনে এমনও হয়? সাদামাটা সাজপোশাকের এই রমনী যেন বিশ্ব সুন্দরী, তার তুলনা কেবল সে নিজেই।
কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে মাথা তুলে কনে। কনে বরকে দেখে তার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে-
: “আজকের এই দিনটা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না আমার”
এমন সময় বর মুচকি হেসে একটা তুলকালাম কান্ড করে ফেলে৷ পাশে থাকা মানুষগুলোকে অগ্রাহ্য করে কনের দুই গালে হাত রেখে তার কপালে চুমু খায়। এমন কান্ড দেখে কনে বেচারী ধাক্কা খেলো যেন। তাকে ধাতস্থ হতে সময় না দিয়ে বর তার কানে ফিসফিস করে বলে-
: “কাঁদছো কেন?”
উত্তরে কনে আবার কাঁদতে শুরু করে। কান্না জরানো কন্ঠে বলে-
: ” আপনাকে প্রথমে কিছু না বুঝেই পেয়েছিলাম, আর আজ আমি আপনাকে জয় করে নিয়েছো”
সেই খুশিতে কাঁদছি”
কনে কান্নারত অবস্থায় বরের হাত মুষ্টি বদ্ধ করে কনে জিজ্ঞেস করে –
: “এসব কি সত্যি ”
বর মুচকি হেসে বলে –
: “হ্যা সত্যি ”
মুষ্টি বদ্ধ অবস্থাতেই বর-কনের বিয়ে হয়। বিয়ে পড়ানোর পর এখন শুধু কনেকেই না কনের মাথার সাথে নিজের মাথা মিলিয়ে কাঁদতে দেখা যাচ্ছে আমাদের আজকের বিয়ের বর “আবীরকেও”
মনে মনে আবীর তখন বলছিল-
“আমি পাইলাম, অবশেষে আমি তাহাকে পাইলাম”
——————————-
ফিরে দেখা-
সেদিন মীরার কথা শেষ হলে আবীর শান্ত গলায় বলেছিলো-
: “মীরা এখন এসব নিয়ে কথা বলার সময় না। ঢাকায় ফিরে এ নিয়ে কথা বলবো আমরা, এখন তুমি ভিতরে চলো প্লিজ, বাইরে ঠান্ডা বাতাস তোমার সাথে কোন গরম কাপড়ও নেই”
কঠিন কন্ঠে মীরা তখন বললো-
: “নাহ্, কোন কিছুর দরকার নাই আমার, আপনার পিঁছু করতে করতে অনেক বেশী বেহায়াপনা দেখিয়ে ফেলেছি আমি, আর সম্ভব না, আপনি এখন আমার উত্তর দিন, ” আমাদেরকে, মানে আমি আর আমার মেয়েকে আপনি আপনার লাইফে এক্সেস দিবেন কি?” ছোট্ট কথায় উত্তর চাই হ্যা অথবা না। আমি আপনাকে কোন ফোর্স করবো না, কোন ব্যাখ্যাও চাইবো না।
সিম্পলি উত্তর দিবেন হ্যা অথবা না”
আবীর অন্যত্র তাকিয়ে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসি লুকানোর চেষ্টা করলো। অন্ধকারেও মীরার চোখ এড়ালো না ব্যাপারটা। এই হাসিই ফাসালো মীরাকে, এত সুন্দর হাসে ছেলেটা। পাশ থেকে মীরার দিকে মুখ ফিরিয়ে আবীর বলে-
: “এখনি দিতে হবে উত্তর? ”
আবীরের হাসি দেখে নিজের মেল্ড হওয়া মনটাকে জোড় করে শক্ত করে মীরা দৃঢ় ভাবে বললো-
: “হ্যা, ইট’স নাউ অর নেভার”
কথাটা শুনে আবীর আবার মুচকি হাসলো। বেপরোয়া এই মীরাকে দেখে কেমন যেন লাগছে, এই অনুভূতির নাম জানা নেই ওর। হাসিটাকে সংবরন করে যথাসম্ভব গম্ভীর ভাব নিয়ে কি যেন ভাবতে শুরু করলো আবীর। আবীরের ঠোঁটের হাসি তখনো মিলিয়ে যায় নি। অন্ধকার সয়ে যাওয়ায় মীরা তা স্পষ্ট দেখতে পেলো। ক্ষণকালের বিরতি পেরিয়ে আবীর বলল-
: ” আচ্ছা ঠিকাছে আমার উত্তর “হ্যা”, তবে আমার একটা শর্ত আছে”
মীরা যেন কোন গোলক ধাঁধায় পরলো শর্তের কথা শুনে। অস্ফুটে বললো-
: “শর্ত”
: “হ্যা”
মীরা তোতলানো স্বরে বললো-
: “কি…. শর্ত”
আবীর গলা পরিষ্কার করার ভঙ্গি করে চুপ থাকলো কিছু সময়, যেন কথা সাজিয়ে নিচ্ছে, তারপর ধীর কন্ঠে বললো-
: “শোন আমাদের দুজনের মধ্যে নূহা একটা বড় ফ্যাক্টর…
কথাটা শুনে কেঁপে উঠে যেন মীরা, পুরো কথাটা শুনবার ভয় ভর করে যেন ওর চোখেমুখে। সারাদিনের ক্লান্তি আর আবীরের অর্ধেক কথা দুটো যেন ওর মাথা ঘুরিয়ে দিলো। কেমন যেন টলতে লাগলো মীরা পুরো কথাটা নিজ থেকে জেনে ফেলার আশংকায়। আবীর মীরার একটু কাছে সরে এসে ওকে সাপোর্ট দিতে চাইলো। মীরা হাত দিয়ে আবীরকে থামনোর ভাঙ্গি করে পেছনের গাছটাকে এক হাতে ধরলো ভারসাম্য রক্ষা করতে। তারপর বললো –
: “আমি ঠিক আছি, আপনি বলুন”
কথাটা বলতে গলা কেঁপে উঠে ওর।
আবীর ওর চোখে চেয়ে বললো-
: ” শর্তটা হচ্ছে – নূহা যদি আমাকে বাবা হিসেবে মেনে নেয় তবেই আমি এ সম্পর্কে আমি এগুবো”
কথাটা শুনে মীরা এমন একটা ধাক্কা খেলো, গভীর কোন খাদে পরে যাবার অনুভূতি হতে লাগলো । আবীর দ্রুত মীরার হাত ধরে ওকে পরে যাওয়া থেকে আটকালো। আবীরের হাতে হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো মীরা। নিজের দুই হাতে মুষ্টিবদ্ধ করলো আবীরের হাত দুটো। সেখানেই মাথা ঠেকিয়ে মুহূর্তেই কেঁদে ফেললো ও। আবীর যেন চমকে গেলো ওর কান্না দেখে। নিজের হাত ছাড়িয়ে মীরার নত মস্তক তুলে ধরলো। অস্ফুটে মীরা বললো-
: আমার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো, বাকীটা শুনবার অপেক্ষায়। এজন্যই হয়তো বলে- ” মিথ্যের চেয়ে বেশি ভয়ংকর হলো অর্ধেক সত্য”
আবীর এবার মীরার হাত দুটো নিজের হাতে পুরে নেয়। ওর খুব ইচ্ছে করে মীরাকে জড়িয়ে ধরে, এতো দিনকার দূরত্বে ও তা পারে না। কিন্তু মীরা আবীরের সে ইচ্ছেটা পড়ে নেয় যেন, নিজের হাত ছাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে আবীরকে। ব্যাপারটা বুঝতে কিছুটা সময় লেগেছিলো আবীরের। তবে মুহূর্তেই কি হলো বুঝতে পেরে ও নিজের হাত দুটো বাড়িয়ে দেয় মীরার দিকে।
ঠিক তখনি অন্ধকার বাড়িটা আলোকিত হয়ে উঠেছিলো নানা রঙের আলোয়।
চলবে….
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৯৫
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
আবীরের বড় চাচীর আবদারে চট্টগ্রামে বাড়িতেই বৌ তুলতে হবে আবীরকে। তিনি আবীরকে বলেছিলেন-
: ” এখানে থাকবি বলে এসে এক্সিডেন্টের পর আবার ঢাকার বাড়িতে রয়ে গেলি। তোর খুশি তুই কোথায় থাকবি। কিন্তু তোর বিয়েটা এ বাড়ি থেকে হোক তা চাই আমি। তোর মা-বাবা কেউ নেই, কোন দায়িত্বই তো পালন করতে পারিনি, এটুকু দায়িত্ব শুধু পালন করতে দে ”
না করে নি আবীর, চাচীর কাঁধেই বিয়ের সব দায়িত্ব দিয়েছে ও। ওর বাবা মা কেউ নেই, বোন একটা সেও পরে আছে বিদেশ বিভুঁইয়ে । এদিকে ভাবতে গেলে বড় চাচী আবীরকে ভারমুক্ত করেছেন। তাই ঢাকার বাড়িতে বৌ না তুলে বৌ তুলেবে চট্টগ্রামের দাদার বাড়িতে।
বৌ নিয়ে বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত নেমেছে এখানটায়। গাড়িতে সামনের সিটে বসেই পিয়ালী যখন ওদের দাদাবাড়ী এলাকার সীমানা দেখাচ্ছিলো আর গল্প করছিলো তখন অন্ধকারের মধ্যেই অভিভূত হচ্ছে মীরা। দুইপাশে গাছে ঘেরা বিশাল প্রান্তর, বেশ খানিকটা পথ পেরুলে দুই একটা ঘর, বাড়ি, মানুষজন দোকানপাট দেখা যায়। তাছাড়া পুরো জায়গাটা যেন অন্ধকারে ডুবে আছে। মীরার মনে হয় ঠিক যেন কোন জনমানবহীন অরন্য যাত্রায় যাচ্ছে ও। অন্ধকার আর নিশব্দে ঘেরা চারপাশ। গাড়ির শব্দ কেবল চারপাশের নিরবতাকে ভেঙে খানখান করে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। ওদের সাথের দুটো গাড়ি সামনে চলে গেছে। ওরাই কেবল পিছনে রয়ে গেছে।
যেদিন সন্ধ্যায় মীরা প্রথমবার এদিকে এসেছিলো আবীরের খোঁজে সেদিন জায়গাটা ততোটা খেয়াল করে নি ও। সেদিন আবীরকে নিয়ে ওর চিন্তায় বুদ থাকাটা এতই গভীর ছিলো যে রাস্তার এই জনমানবহীনতা, নির্জনতা, তেমন একটা ছুঁতে পারে নি ওকে। কিন্তু আজ এদের সাথে এসেও সেদিনের কথা ভেবে ভয় হচ্ছে ওর। কি মারাত্মক কাজ ও করে ফেলেছিলো সেদিন। ঐদিন ড্রাইভার কিছুতেই আসতে চাইছিলো না এখানটায়। এত ভিতরের দিকে গেলে ফিরতি পথে প্যাসেন্জার পাওয়া যায় না তাই। মীরা প্রথমটা ভেবেছিলো বাড়তি ভাড়া আদায়ের বাহানা। তাই মীরাই বলেছিলো প্রয়োজনে দ্বিগুণ ভাড়া দিবে। তাই তো রাজি হয়েছিল ড্রাইভর লোকটা। এখন ও ভাবছে অচেনা এই নির্জন শহরটায় ড্রাইভার লোকটা যদি ওকে খু*ন করে পুঁতেও রাখতো কেও জানতো না ওর খবর। মীরার কেমন একটা কাঁপন অনুভব হয় হঠাৎ ঐদিন কার কথা ভেবে, পাশে বসা আবীর ওর কাঁপনের টের পেয়ে মীরার কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে-
: “কোন সমস্যা? ”
তৎক্ষনাৎ মাথা ঝাঁকিয়ে “না” বাচক উত্তর দেয় মীরা। কিন্তু মনে মনে ভাবে অনেক সাহসী কাজ সে করে ফেলেছিলো সেদিন, তাইতো মীরাকে ঐ বাড়িতে সেদিন দেখে আবীরের অবাক হওয়াটা ছিলো চুড়ান্ত পর্যায়ের।
আবীর আবার ওকে প্রশ্ন করে –
: “ঠান্ডা লাগলে গ্লাসগুলো তুলে দিই?”
মীরা এবারও উত্তর দেয় – “না”
ঠান্ডা ওর লাগছে তা সত্যি তবে উপভোগ ও করছে।
কি ভেবে যেন গাড়ির দরজার কাছে মাথা রেখে বাইরের দিকে দেখায় মন দেয় ও। দুপাশে ঘন জঙ্গলের মাঝখানে তৈরী করা সরু রাস্তা পেড়িয়ে যাচ্ছে ওদের গাড়িটা, চলছে তো চলছেই, এ যেন অনন্ত যাত্রা। এত দীর্ঘ পথ দীর্ঘ যাত্রা তবুও দেহ মনে ক্লান্তির ছিটেফোঁটাও নেই মীরার। বরং এই পথ, ঢালু পথ বেয়ে ছুটে চলা, দুপাশের গাছ, মাঝেমাঝে উঁকি দেয়া চাঁদ, শীতের সন্ধ্যার বাতাস সবটাই যেন উপোভোগ্য। মীরার মনে হয় জীবণে এমন কিছু হয়েছে আজ, এমন কিছু পেয়েছে ও যে কোন ক্লান্তি, দুঃখ, জড়া ওকে আর ছুঁতে পারবে না কখনো।
হঠাৎই গাড়ির দু’পাশে পথের চিত্র বদলে গেলো । গাড়িরা গা ঝাড়া দিয়ে দু’পাশের গাছপালা ঝেড়ে সামনে এগুলো যেনো। কিছুক্ষণ হলো পাহাড় কাটা পথ ধরে এগুচ্ছে ওরা। তার মানে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠছে ওদের গাড়িটা।
পথের দু’ধারে কখনো পাহাড়ের মাটি, কখনো বা গাছ ঘিরে রাখা সবুজ পাহাড় দেখছে ও। পাহাড়কে সবুজে ঢেকে রাখাটা জানান দিচ্ছে এ পথ কত আগের, কত যত্নের তৈরি। বিশাল গাছগুলো যেন প্রহরা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নতুন বৌ কে। কিন্তু মাঝেমাঝে দুপাশে ঘন গাছ থাকায় চাঁদ দেখতে পাচ্ছে না ও। মাঝেমধ্যে গাছের ফাঁকফোকড় বেয়ে চাঁদের আলো উঁকি দিচ্ছে নতুন বউয়ের মুখ দেখতে। এমনি করে আধঘন্টার মতো গাড়ি চলার পর সমতল পথে উঠলো গাড়িটা। এতক্ষণ ধরে পাহারা দেয়া রাস্তার দুইপাশের ঝোপঝাড় গুলো হঠাৎ একপাশে সরে গেলো যেন। ওমনি একঝাঁক চাঁদের আলো বরন করে নিলো ওকে। অনেকক্ষণ বাদে চাঁদের আলোর দেখা পেয়ে মীরা আরো সেরে এলো গাড়ির জানালায় দিকে। ঠান্ডা বাতাসে চোখ বন্ধ করে মীরা কেমন একটা জংলি গন্ধের টের পেলো। গন্ধটা প্রথমে আগন্তুকের মতো ঠেকলেও ধীরে ধীরে কেমন পরিচিত লাগে ওর।
এদিকে নিজের আসনে গা এলিয়ে বসা আবীর গাড়ির জানালার ফাঁকে চাঁদের আলোতে দেখছে মীরার চুড়ি ভর্তি হাত। কেমন অপার্থিব সুন্দর দেখাচ্ছে দৃশ্যটা। ওর ইচ্ছে হচ্ছে হাত দুটোকে ওর নিজের কাছে টেনে রাখে। পাছে কি ভাবে মীরা তাই এই ইচ্ছেটা দমন করে। ভালো লাগে ভাবতে হাত কি পুরো মানুষটাই আজ ওর নামে লিখা হয়ে গেলো।
পিয়ালী ধারাভাষ্যকারের মতো তখনো বর্ননা করেই যাচ্ছে রাস্তার বর্ননা, বিশেষ কোন স্থান কিংবা কোন জায়গা ঘিরে ওদের ছোটবেলা কার মজার কোন স্মৃতি। পিয়ালীর বকবকে মন নেই কারোরই। নিজের কাজে পিয়ালীর অখন্ডতা দেখে সাহস করে মীরার হাতটা ধরেই ফেলে আবীর। চোখ খুলে মীরা ওর দিকে তৎক্ষনাৎ তাকায়, গাড়ির ভিতরটা অন্ধকার, তবুও মীরা যেন বুঝতে পারে আবীরের অব্যাক্ত কথা ” কি দেখছো অমন করে? আমার দিকেও তো একটু দেখো”
সত্যি বর বেচারাকে একলা করে এমন চন্দ্র বিলাস মোটেও ভালো কথা নয়। মুচকি হেসে মীরা আবীরের কাছ ঘেঁষে বসলো। আবীর তখনি ওর একটা হাত নিয়ে নিলো নিজের দখলে।
মীরার যেন তাড়া নেই হাত ছাড়িয়ে নেয়ার। বরং আবীরের শরীরের উষ্ণতার সবটুকু যেন শুষে নিচ্ছে ওর ঠান্ডা হাত।
একটু বাদে আবীর ফিসফিস করে বললো-
: ” নূহাকে কোথাও দেখলাম না কেন?”
: “পিয়াসা নিয়ে গেছে ওর বাড়ি, আমি চাই না ওর মাথায় মায়ের বিয়ের কোন স্মৃতি থাকুক”
: “মেয়েটাকে এখনো দেখতে পেলাম না, তুমি বড্ড পাষাণ ”
আবীরের দিকে চেয়ে শান্ত কন্ঠে মীরা বলে-
: “আমি যা করি ভেবেই করি, ও জানে আমি ওর মা, ওর বাবা বিদেশে থাকে, ও জানবে ওর বাবা এত বছর পর বিদেশ থেকে ফিরেছে। এই মেমরিটা তৈরী করতে আমার এই পাষাণ হওয়া। তাই আমি চাই আপনারা আরেকটু অপেক্ষা করুন, বাবার জন্য মেয়ের
অপেক্ষার ফল মিষ্টি হোক ”
এমন সময় পিয়ালী পিছনে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে –
: “কিরে তোরা কি ফিসফাস করছিস?”
মীরা পিয়ালীর পিছনে ফেরা দেখে ওর হাতটা সরিয়ে নিতে চায়, আবীর তখন আরো শক্ত করে হাতটা ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখে বলে-
: “কই ফিসফিস করছি? কানে বেশী শুনিস? বাতাসের শব্দে তোর এমন মনে হচ্ছে ”
মীরা কিছুক্ষণ হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেয়। তারপর কি ভেবে যেন আবীরের কাঁধে মাথা রাখে। আবীর প্রথমে চমকে গেলেও, পরে ওর মাথাতে নিজের মাথাটা ছুঁইয়ে রাখে।
এমনি করে চলতে থাকে গাড়ি। মীরা ফিসফিস করে বললো-
: “আপনার দাদা আর জায়গা পায়নি বাড়ি করার, একেবারে বাংলাদেশের শেষ সীমানা বাড়ি করেছেন”
মুচকি হেসে আবীর বলে-
: “যুদ্ধের সময় এক হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে নামমাত্র দামে এই বিশাল বাড়িটি কিনেছিলেন তিনি।
বাড়ির মধ্যে তাইতো হিন্দুয়ানা ভাব আছে। তুমি পুরো বাড়ি ঘুরলেই বুঝতে পারবে”
অবশেষে দীর্ঘ যাত্রা শেষে নতুন বৌ পৌঁছালো শ্বশুর বাড়ি। এখানে পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমেই অবাক হওয়ার পালা শুরু নতুন বউয়ের। গাড়ি থেকে নামতেই দেখে ফিওনা বাড়ির মেইন ফটকে দাঁড়িয়ে ওদের বরন করার অপেক্ষায়। অচেনা সব মানুষের ভীড়ে ফিওনাকে দেখে মীরার সব দুশ্চিন্তা উবে গেলো মুহূর্তেই। মীরার সাথে সাথে অবাক হয় আবীরও। কিছুক্ষণ যেন সময় নেয় ও সবটা বুঝতে তারপর বিষ্মিত কন্ঠে বলে-
: “কিরে তুই?”
ওর এ বিয়েতে আগমন সত্যি অবিশ্বাস্য। আবীরকে পাশ থেকে আলিঙ্গন করলো ফিওনার বর। কানে কানে অভিবাদন জানালো নতিন জীবণের জন্য। মীরাও ফিওনাকে জড়িয়ে ধরলো। আনন্দে কাঁদছে মেয়েটা। মীরাকে জড়িয়ে ধরে ওর কানে কানে ফিওনা বলে-
“তুমি পেরেছো মীরা, তুমি পাথরে ফুল ফুটিয়েছো। দোয়া করি অনেক সুখী হও তোমরা, আফসোস একটাই যে তোমাকে আবীরের বউ হিসেবে দেখতে
চেয়েছিলেন সেই দেখলো না” পাশে থাকা দুই চাচী স্বান্তনা দেয় ফিওনাকে।
নতুন বউয়ের আগমনে সবার উচ্ছাসে এ তিনজনে বিস্ময় মিলিয়ে গেলো। ফিওনা মীরার হাত ধরে ওকে বাড়ির ভিতরে নিতে। মুগ্ধ হয়ে চারপাশে চোখ বুলায় মীরা৷ বিশাল জায়গা নিয়ে করা দোতলায় বাড়িটা যেন আলোর ঝলকানিতে স্বাগত জানাচ্ছে ওকে।
বিয়ে বাড়িতে আলোর এমন সাজসজ্জা এর আগে মীরা কখনো দেখেনি। আলের বাহাদুরি দেখাতে কোন কার্পন্য করেনি লোকগুলো । বিশাল আলোর বেষ্টনি দূর থেকে ঘোষণা করছিলো যেন এর পুরো সীমানা।
প্রতিটি গাছ, বসার জায়গা, দোলনা, খেলার জায়গা সবকিছুই আলোয় আলোকিত। এরা যেন অন্ধকারে জানান দিচ্ছে নিজ নিজের অবস্থান।
একটু হেঁটে এগুতেই থমকে দাঁড়িয়ে মীরা মন ভরে দেখে নেয় কল্পনায় আঁকা এ বাড়িটি। কত কত গল্প শুনেছিলো মীরা এ বাড়ির। আজ মনে হচ্ছে বাড়িটি আবীরের মায়ের মানে মীরার শ্বাশুড়ির বর্ণনার চেয়েও সুন্দর। কোথাও কোন চাকচিক্যের বাড়তি বোঝা নেই।
সহজ সরল এ বাড়িটার বিশেষত্ব এর দরজা, জানালা, দীর্ঘ মোটা খুঁটি, লাল মেঝেতে। পুরো বাড়িটা লাল মেরুন রঙে রঙানো। বাড়ির খিলানে, খুটিতে, জানালায়, দরজায় কারুকার্য গুলো সাদা রঙের। যেন কারুকার্য গুলোকে ফুটিয়ে তুলতেই এই রঙের ব্যবহার করা হয়েছে।
বাড়ির ঠিক মাঝখানটা অর্ধবৃত্তাকারে সামনের দিকে বর্ধিত। অনেকটা বারান্দার মতো। নিচের এ বাড়তি অংশটুকু হাঁটাচলার প্যাসেজ হলেও উপরের দিকের বর্ধিত এ অংশটুকু বারান্দাই। বাড়িটা জমিদার বাড়ি না হলেও এটা যে কোন সম্ভ্রান্ত বনেদি পরিবারের ছিলো তা সহজেই বোঝা যায়।
বাড়ির চাচীরা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বরন করে মীরাকে। তারপর সব কাজিনরা সিড়ির দিকে আটক করে বউকে।
পিয়ালী বলে-
দেখেছিস তোরা বউদের বাড়িতে কোন হাঙ্গামা করলো না সে, এখন আমাদের দাবী পূরন করো। হাসি মুখে আবীর বলে-
: “যা, কোথায় নিবি নিয়ে যা তোরা বৌকে”
আহনাফ বলে খুচরো কথায় কাজ নেই ব্রো৷ পঞ্চাশ চাইতাম তুমি ত্রিশ দিয়ে দাও বাকীটা আমি ম্যানেজ করে নিবো”
পাশ থেকে সাদমান বলে-
: আমার ভাইয়ের সাথে জুলুম করছিস তোরা। ত্রিশ না ভাইয়া তুমি পঁচিশ দাও, আর ভাবী বাকী পঁচিশ তুমি দাও”
পাশ থেকে সবাই হে হে করে হেসে উঠে। আহনাফ বলে, নেউ ঠ্যালা, নারীপুরুষ সমতা চাও না তোমরা এবার ভাবী বের করো পঁচিশ। মুচকি হাসে মীরা ওদের এসব কথা শুনে।
আবীর বলে-
: ” আমাকে আটকে রাখ তোরা ওকে যেতে দে, আমার বৌ ভীষণ ক্লান্ত”
কথাটা বলেই হুশ হয় ওর কি বকে ফেললো। উল্টো ঘুরে জিবে কামড় দেয় আবীর। বড় চাচী কান ধরে বলে-
: “বিয়ে হয়ে সারা গেলো না এখনি আমার বৌ”
আবীর তখন ওদেরকে বলে, এত টাকাতো ক্যাশ নেই, তাহলে উপায়?
আহনাফ বলে- “আরেহ্ চিল ব্রো উপায় আছে”
এরপর মোবাইল ব্যাংকিং এ ওর ভাগের টাকাটা পরিশোধ করে আবীর। মীরা খুশি মনে ওদেরকে ওর ভাগের ২৫ হাজার টাকা দিয়ে দেয়। তারপর ফিতা কেটে মীরাকে নিয়ে যায় দোতলার সবচেয়ে বড় ঘরটাতে।
এ ঘরটাতেই থাকতো এ বাড়ির আদরে ছোট ছেলে মানে আবীরের বাবা। ভাইয়েরা বড় হচ্ছিল যখন তখন তিনি বলেছিলেন বড় ঘরটা তার চাই। দুই বড় ভাই তাই ভালোবেসে তাকেই এ ঘরটা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ভিতরে ঢুকে এমনি গল্প জুড়ে দিলেন আবীরের বড় চাচী। আবীরের মাকে একা বিয়ে করায় আবীরদের পরিবার ঢাকায় থাকলেও এ ঘরটা তাদের জন্যই বরাদ্দ ছিলো। ছোট ছেলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেও এত বছরেও এর মালিকানা কোন ভাই বা তাদের ছেলেমেয়ে কেও নেয় নি।
আবীর ফিওনা অবশ্য মাঝেমধ্যে বেড়াতে আসতো এ বাড়ি। কিন্তু আমৃত্যু এ বাড়িতে আর ফিরেন নি তিনি। এমনকি মা*রা গেলে তাকে যেনো ঢাকাতেই দাফন করা হয় তাই বলে গিয়েছিলেন। অথচ যাকে নিয়ে এতকিছু তিনি কিন্তু ইদে চাঁদে ঠিকই আসতেন শ্বশুর বাড়ি। ইদ কিংবা কোন উপলক্ষ এলে শ্বাশুড়ি বড় ছেলেকে পাঠাতেন ছেলের বৌ আর নাতি-নাতনীকে আনতে। সবাই ভেবেছিলো একসময় সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়েছিলো ঠিকই শুধু এ বাড়ির ছোট ছেলেটা ছাড়া।
পিয়ালী পাশ থেকে বলতে শুরু করে-
: “হেহ্ মা, কি কীর্তন শুরু করলা, মাত্র বাড়ি এলো মেয়েটা, সরো তো অনেক সময় পাবা এ গান শুনাবার। ওকে একটু একলা ছাড়ো, কতটা পথ পেড়িয়ে এসেছে বেচারি”
মীরার হঠাৎ মাথা ব্যাথা শুরু হয়। চারপাশে মানুষের কথাবার্তা, গানবাজনা, হৈ-হুল্লোড়ের মাথা ধরে গেছে হয়তো।
কোত্থেকে একটা কফির মগ নিয়ে হাজির হলো ফিওনা, ঘরে ঢুকেই বললো-
: ” নাও, ভাই পাঠিয়েছে, কিছুর দরকার হলে জানিও আমি আসছি ” বলে বেরিয়ে যায় ও। কফির মগ হাতে মুচকি হাসে মীরা। মনে মনে বলে-
: “আমার কি দরকার তা আমার চেয়ে ভালো জানা লোক এখন আছে আমার, আমার চিন্তা নাই”
মুচকি হেসে কফিটা ধীরে ধীরে শেষ করে ও। মগটাকে সাইড টেবিলে রেখে উঠে ফোনটা নিয়ে একে একে ফোন করে মা, নূহা, আর মুখলেস চাচাকে।
ধীরে ধীরে মীরার আশেপাশের ভীড় পাতলা হতে থাকে। রাতের সাথে পাল্লা দিয়ে কমতে থাকে কোলাহল। মাঝখানে একবার শুধু আবীর দেখা করে গেছে মীরার সাথে, আর তার খবর নাই। লোকটা ওকে এমনিভাবে বসিয়ে গেলো কোথায়?
একটু পরে রাতের খাবার নিয়ে আসে পিয়ালি আর ওর মা, মীরা এক ফাঁকে পিয়ালীকে জিজ্ঞেস করে আবীরের কথা। গাধা মেয়ে ওর মাকে বলে কিনা-
: “মা, আবীর ভাই কোথায় গেলো জানো কিছু? ভাবী জিজ্ঞেস করছে..”
মীরা মনে মনে বলে-
“আরেহ গাধী প্রশ্ন পর্যন্ত ঠিক আছে, ভাবী জিজ্ঞেস করছে.. এটা বলার কি দরকার ছিলো৷ পিয়ালীর মা মানে বড় চাচী নিজ হাতে মীরাকে খাইয়ে দিলো। বাড়ির লোকেদের সম্পর্কে এটা সেটা জিজ্ঞেস করলো। খাওয়া, আলাপ শেষ হলো তবুও আবীরের দেখা নেই।
আশেপাশের লোকই যেন কমে না ঘরে। অবশেষে মেঝো চাচী এসে ঘর থেকে সবাইকে বের করে দেয়। ঘরে বসেই মীরা শুনতে পায় বাইরে দাঁড়িয়ে পিয়ালীর সাথে কথা বলছে ভরাট কন্ঠের একজন। মীরা ভিতর থেকেই বুঝতে পারে যার অপেক্ষায় ও এতক্ষণ ধরে বসে আছে সে কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে। কেমন একটা উচাটন ভর করে বুকে। সময়ের সাথে সাথে সেই উচাটন বড়তে থাকলো। এতক্ষণে ও যেন পুরোপুরি টের পেলো আবীরের মালিকানার। একটা মানুষের আধিপত্যের।
চলবে….
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৯৬
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
আশেপাশের লোকই যেন কমে না ঘরে। অবশেষে মেঝো চাচী এসে ঘর থেকে সবাইকে বের করে দেয়। ঘরে বসেই মীরা শুনতে পায় বাইরে দাঁড়িয়ে পিয়ালীর সাথে কথা বলছে ভরাট কন্ঠের একজন। মীরা ভিতর থেকেই বুঝতে পারে যার অপেক্ষায় ও এতক্ষণ ধরে বসে আছে সে কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে। কেমন একটা উচাটন ভর করে বুকে। সময়ের সাথে সাথে সেই উচাটন বড়তে থাকলো। এতক্ষণে ও যেন পুরোপুরি টের পেলো আবীরের মালিকানার। একটা মানুষের আধিপত্যের।
কি মনে করে হঠাৎ পিয়ালী ঢুকলো ঘরে, মীরার কানে কি এক গোপন কথা বলে ঠোঁট টিপে হাসলো সে। লজ্জায় লাল হলো মীরাও । এই মেয়ে আসলেই একটা গাধা, কখন কি বলবে তার হুঁশ নেই। কথা শেষ করে পিয়ালী বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কি মনে করে আবার এগিয়ে এলো মীরার দিকে। তারপর মীরার শাড়ির উপর ঘোমটা দেয়া পাতলা ওড়নাটা টেনে ঘোমটাটা লম্বা করে দিলো। মীরা প্রথমটাতে বিরক্ত হলো, মনে মনে ভাবলো বুড়ো বয়সে কি সব আদিখ্যেতারে বাবা ! পরোক্ষণেই মনে হলো এমন রাত, এই অপেক্ষার অভিজ্ঞতা ওর দ্বিতীয় বারের মতো হলেও, আবীরের বিয়ে, ফুলশয্যা, নারীসঙ্গ সবকিছুর প্রথম আজ। তাই মনে মনে ভাবে নিজের তিক্ত অতীত টেনে আবীরের আজকের বিশেষ দিনটার রঙ কিছুতেই ম্লান হতে দিবে না ও। এত ভালোবাসবে আবীরকে যাতে ওকে নিজের করে পাওয়ার দীর্ঘ অপেক্ষার আক্ষেপ ঘুঁচে যায়।
তাইতো একবুক ভালোবাসার নিয়ে মধুর অপেক্ষায় নত মস্তকে বসে আছে আবীরের জন্য । পিয়ালী বেরুতেই আবীরকে ছোটবেলার রেলগাড়ী খেলার মতো ঠেলে পাঠিয়ে দেয় সব কাজিনরা মিলে। মীরা ওদের হাসাহাসি শুনে ওড়নার ঘেরাটোপ থেকে
তাকিয়ে দেখে ওকে ঠেলে পাঠিয়ে বাইরে থেকেই বিদায় হচ্ছে ওরা।
ওরা চলে যাবার পরও আবীর লাজুক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে দরজার সামনে। ওর দৃষ্টি খাটের মধ্যে খানে বসে থাকা মীরার দিকে। মীরা তখনো নত মস্তকে জবুথবু হয়ে বসে আছে। আবীরের অস্তিত্বের টের পেয়ে যেন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু দেখার ভয়ে হুট করে চোখদুটো বন্ধ করে ফেললো ও।
ঘরে ঢুকে অবিশ্বাসী ভঙ্গিতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছে আবীর। জীবণের সুন্দরতম আজকের এই দিনটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। এই ঘর, হ্যা এই ঘরেই নিজেকে বন্দি করেছিলো আবীর মীরা ওকে ছেড়ে চলে যাবার পর। লোকলজ্জার ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছিলো ও এই ঘরটাতে। কত কত নির্ঘুম রাত, বোবা কান্নার সাক্ষী এই ঘর, এই দেয়াল, এই মার্বেলের শীতল মেঝে৷ তাইতো ভাবতে অবিশ্বাস হয়, সত্যি এই ঘরেই এসেছে মীরা ওর বৌ হয়ে। দরজাটা বাম হাতে ঠেলে সামনে এগুলো আবীর, খুট করে একটা শব্দ হলো দরজা লক হওয়ার। সেই শব্দটা মীরাকে জব্দ করলো যেন। কেমন শক্ত হয়ে গলো ওর শরীর।
শান্ত পায়ে এগিয়ে এসে খাটের এক কোণে বসলো আবীর মীরার দিকে পিঠ দিয়ে। কি এক ঘোরের মধ্যে রয়েছে যেন ও এখনো। মীরা মাথা তুলে আবীরের পিঠ দেখতে পেয়ে মুচকি হাসলো। তখনি পিছন ফিরে চাইলো আবীর, চোখাচোখি হলো দুজনে। কেমন বোকা হাসি হাসলো আবীর। মুচকি হেসে সে হাসিতে যোগ দিলো মীরাও। এবার ঘুরে বসলো আবীর, মীরার দিকে তাকিয়ে বললো –
” বাবা অসুস্থ হওয়ার পর কাজেকর্মে এতটাই ডুবে ছিলাম যে বিয়ে নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা ছিলো না, মা প্রায়ই বলতো তার খুব শখ লাল টুকটুকে এক বৌ আনবে তার ছেলের জন্য। ঐদিন মা আমাকে বিয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলো “আমার কোন পছন্দ আছে কিনা, মানে প্রেমটেমের ব্যাপারটা ঘুরিয়ে বলা আরকি” -বলে হাসলো আবীর।
যেন ওর বর্ননার ঐদিন ব্যাপারটা গত পরশুর ঘটনা।
তারপর আবার বলতে শুরু করলো-
” আমি মুখচোরা, কাজপাগল মানুষ আমার আবার প্রেম-ট্রেম”
বলে একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলো-
“সেদিন রাতে তোমার বাবাকে দেখে বাসায় ফিরে মা বললো – তোমার বিয়ের জন্য তোমার বাবা-মা পাত্র খুঁজছে। একটা সময় তিনি জিজ্ঞেস করলেন- আমার যেহেতু কোন পছন্দ মানে প্রেমটেম নেই আমি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি কি-না? প্রথমটায় একটু ধাক্কা খেলেও আমি কিন্তু অমত করিনি।
আবীরের মুখে এসব শুনে তড়াক করে তাকায় মীরা।
মনে মনে ভাবে- “এসব কি বলছে আবীর! আবীরের বাবা মা, কিংবা ওর নিজের বাবা কেউ-ই তো বেঁচে নেই এখন, তাহলে এসব বলার মানে কি!”
আবীর সলজ্জ চোখে ঘুরে বসে দেখে মীরাকে। কিছুসময় পর শেরওয়ানীর দুই পকেটেই কিসের যেন খোঁজ চালায় ও। বাম পকেট থেকে কি একটা বের করে মীরার আরো কাছে এগিয়ে এসে সংকোচে আলতো করে ওর বাম হাত ধরে আবীর, মীরা তখনো বিয়ের ওড়নার ঘেরাটোপ ভেদ করে ভ্যাবাচ্যাকা দৃষ্টিতে আবীরের মুখের দিকে তাকিয়ে। হাতটা নিজের আয়ত্তে এনে বাম হাতের অনামিকা আঙুলে একটা আংটি পরিয়ে দিলো আবীর। হাসিমুখে বললো-
“এ আংটিটার একটা গল্প আছে, এটা আমার দাদীর আংটি, দাদী প্রথম দেখে মা’কে এটা দিয়েছিলেন, এটা মায়ের কাছে খুবই স্পেশাল, মা তাই এটা তার পুত্রবধূর জন্য তুলে রেখেছিলেন”
আবীরের কাছে থাকা হাতটা নিজের দৃষ্টি সীমানার কাছে এনে ওড়নার ফাঁক দিয়ে আংটিটা দেখে চমকে উঠে মীরা। একযুগ আগে তপ্ত দুপুরে যে আংটি বিক্রি করে বিয়ে করেছিলো কিশোরী মীরা আর বউন্ডুলে রাজিব এটা সেই আংটিই। কেমন ধাঁধায় পরে গেলো ও। বিস্ময় চেপে ওড়নার ভিতর থেকেই তাকালো ওর দিকে। আবীরের চোখেমুখে কেমন যেন ভাব।
এবারও নিরবতার ঘোর কাটলো আবীর, বললো-
জানো এ ঘরটা আমার অনেক দুঃসময়, দুঃখের সাক্ষী। তুমি আজ আমার হয়ে এ ঘরে এসেছো আমার কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে।
কিছু সময় মৌন থাকে আবীর, দুই হাতে ওর মনের অস্থিরতার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠে। কি যেন ভাবছে বেচারা মনে মনে। মীরা তখনো অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে। ঘুরে নিচ থেকে পা তুলে মীরার কাছ ঘেঁষে বসে আবীর। একদৃষ্টে মীরার দিকে চেয়ে কি একটা ভাবে যেন। তারপর বলে-
“দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর তুমি আমার হয়েছো, কখনো অবিশ্বাস হচ্ছে তো কখনো মিথ্যা মনে হচ্ছে। খুশিতে আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছি মীরা। কি বলছি, কি করছি আমি নিজেই জানি না।
তারপর ধীর হাতে মীরার দীর্ঘ ঘোমটা তুলে ধরে মীরার মুখোমুখি হয়ে মুচকি হেসে অস্ফুটে বলে ওঠে-
” আমার নজরই না লেগে যায়”
ঠোঁট টিপে হেসে মীরা বলে-
: “মাশাল্লাহ বলেন”
কিছু যেন শুনতে পায় না আবীর, এমনিভাবে ওর চোখে চোখ রেখে চেয়ে থেকে। কিছু সময় পর আবীর শান্ত কন্ঠে বলে –
“এসব কি সত্যি মীরা? সত্যি কি তুমি আমার হয়েছো?”
দুপুরে যে ভুতে ধরেছিলো মীরাকে তা এখন চেপেছে আবীরের কাঁধে। ছেলেটার সত্যিকার ভালোবাসা, এত বছরকার অপেক্ষা, নানান প্রতিকূলতা ওকে অবিশ্বাসী করে তুলেছে। তাইতো এতোদিনকার, এত বছরকার কাঙ্খিত মানুষটিকে কাছে পেয়েও দিশেহারা ভাব ওর চোখেমুখে।
আবীরের চোখে চোখ রাখে মীরা, কপাল কুঁচকে ভাবে
– “আবীরটা কি পাগল হয়ে গেলো? এমন অসংলগ্ন কথাবার্তা, উদ্ভট প্রশ্ন, এসবের মানে কি ?
হুট করে কি একটা হয় মীরার- তারপর এসব যে স্বপ্ন নয় বাস্তব তার প্রমাণ দিতে হুট করেই আবীরের একটা হাত টেনে সেটাতে কামড় বসায়।
মীরার দিকে তাকিয়েই উফ্ করে উঠে আবীর।
ঝাঁঝালো গলায় বলে-
: এবার বিশ্বাস হলো তো?”
মুচকি হাসে আবীর ওর এমন কান্ড দেখে। তারপর
মীরাকে কাছে টেনে ওর কপালে চুমু খায়। তৎক্ষনাৎ লজ্জায় লাল হয়ে আবীরের বুকের মধ্যে লুকায় মীরা ।
আবীরও দুই বাহু প্রসারিত করে আগলে নেয় মীরাকে যেন অতি মূল্যবান কিছুকে লুকিয়ে রাখলো সে পৃথিবীর থেকে। মীরা এত শান্তি পেলো আবীরের বুকে লুকিয়ে। হঠাৎ মনে হলো ওর- ও তো এটাই চেয়ে এসেছে, দুনিয়ার থেকে পোড় খেয়ে খেয়ে, যে কেও একজন ওকে আগলে রাখুক, লুকিয়ে রাখুক পৃথিবীর থেকে।
কিছুক্ষণ পর মীরা বুঝতে পারলো আবীরের শরীর কাঁপছে। বন্ধনরত থেকেই উপরে তাকালো মীরা। একহাতে আগলে রেখেছে সে মীরাকে অন্য হাতে চোখ ঢেকে কাঁদছে।
এত বছরকার অপেক্ষা, প্রিয়জনকে না পাওয়ার কষ্ট সব যেন নোনা জল হয়ে বেরুচ্ছে আবীরের চোখ দিয়ে। আবীরকে আঁকড়ে ধরা মীরারও চোখ ভিজে আসে। আজ দু’জনই দু’জনকে জয় করে নিয়েছে ভালোবাসার দামে। এ কান্না সেই জয়ের উদযাপন।
এমনি ভাবে অনেকক্ষণ বসে থাকে ওরা। মীরা সে বন্ধন আলগা করে চোখ মুছে দেয় আবীরের। তারপর অনুতাপের কন্ঠে বলে-
: “আমার করা একটা ভুল আমাদের দুজনের জীবণের এক যুগ কেড়ে নিয়েছে। আপনি আমাকে ক্ষমা কর দিবেন আবীর”
আবীর মীরার ঠোঁটে ডান হাতের তর্জনী রেখে ওর কথার স্রোত আটকায়। তারপর ধীর কন্ঠে বলে-
: ” একবার ভাবো তো আমাদের জীবণে ঐ ভুলটা যদি না থাকতো তাহলে এমনি মরিয়া হতে তুমি? আমি কাজিনের বিয়ে উপলক্ষে এখানে কয়েকদিনের জন্য এসেছিলাম চট্টগ্রাম , তোমাকে বলে আসতে পারি নি। একেবারে চলে এসেছি ভেবে তুমি উড়ে চলে এসেছিলে আমার খোঁজে। এমন বেপরোয়া ভালোবাসা পেতে ঐরকম ভুল, দীর্ঘ প্রতীক্ষা এসব ব্লেসিং মনে হচ্ছে এখন। তুমি যদি ঐ ভুল না ও করতে কোনমতে যদি বিয়েটা টিকে যেতো আমাদের এখনকার মতোন এমন টান থাকতো দুজনার দুজনের প্রতি? কক্ষনও না, তখন দেখা যেতো আমাকে একাই বয়ে নিয়ে যেতে হতো সংসারটা”
কথাটা শুনে মাথা নত করে মুচকি হাসে মীরা, ক্ষীণ কন্ঠে বলে- ”এটা আপনার বিনয়”
মীরার দুই হাত নিজের হাতে মুষ্ঠিবদ্ধ করে আবীর বলে-
: ” বিনয় না মীরা, একটা কথা জানো তো- “গড ইজ দ্য বেস্ট প্লানার” তিনি জানতেন এভাবে এক হওয়াটা আমাদের জন্য মঙ্গল। পেছনের সবকিছু পিছনে ফেলে নতুন করে শুরু করবো, দেখো অনেক সুখী হবো আমরা”
এমনি করে নানান টুকরো কথায় এগিয়ে যেতে থাকে বিশেষ রাতটা৷ কখনো টুকরো কথা, কখনো হাসির শব্দ ও শোনা যাচ্ছে ওদের ঘর থেকে।
আবীর একটা সময় বলে-
: “চলো তোমাকে একটা চমৎকার জিনিস দেখাবো”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধীর পায়ে নামতে নেয় মীরা। শাড়ির পাড়ে পা জড়িয়ে পরে যেতে নিলে ওর হাত ধরে আবীর। পা সামলে উঠে দাঁড়ায় মীরা। তারপর আবীর ওর হাত ধরে নিয়ে যায় ওর ঘরের লাগোয়া বারান্দায়।
পুরনো ধাঁচের এ বাড়িটার এক একটা ঘর যেন এক একটা পৃথিবী, এত বিশাল! ঘর পেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে চমকে যায় মীরা৷ এ যেন অপার্থিব সৌন্দর্য। কুয়াশায় পুরো দৃশ্যপট দেখা না গেলেও ঠিক বোঝা যাচ্ছে ওদের বাড়ির ঠিক পর থেকেই ঢাল বেয়ে নেমে গেছে যেন অরন্য ঘেরা পাহাড়টা এবং তা এত নিখুঁত ভাবে যে এ বাড়ির সীমানা বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে
সবুজের সমুদ্রের কিনারায় থাকা এ বাড়িটা পৃথিবীর শেষ সীমানায় একটা দ্বীপ। এত সবুজ, পাহাড়ি ঢাল প্রকৃতির এমন নিখুঁত সাজসজ্জা এর আগে দেখেনি মীরা। ওর দেখা গ্রাম মানে ওর নানু বাড়ি দাদু বাড়ি আর এখনকার দৃশ্যপট পুরো আলাদা৷ মুগ্ধ চোখে এসব দেখে মীরা, আর মীরার মুগ্ধতা দেখে আবীর।
শীতের রাতের শেষ ভাগ, শনশন করে বাতাস আসছে।
হঠাৎ করে শীতে কেঁপে উঠে মীরা। আবীর পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো –
: “কি হলো? ”
: “কিছু না শীত করছে”
: ” ঘরে চলো তাহলে..”
: “না, ভালো লাগছে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে”
: ” আচ্ছা, শালটা নিয়ে আসি তাহলে ঘর থেকে … ”
মীরা ওর হাত ধরে টেনে বলে-
: “যেতে হবে না, একটু পরেই রুমে চলে যাবো”
মীরা এখন খোলা বারান্দার রেলিং ধরে সামনে তাকানো। আর আবীর দেয়ালে হেলান দিয়ে দূর থেকে তাকানো মীরার দিকে৷ একটা সময় মীরা ব্যাপারটা খেয়াল করে মাথা নেড়ে কাছে ডাকে ওকে। হেসে মাথা নেড়েই “না” বলে আবীর। হাত বাড়িয়ে মীরা কাছে টেনে আনে ওকে৷ মীরার একাবারে কাছে এসে আবীর, মীরা ওর চুল নাড়ে আর বলে- “আপনার চুল গুলো নেড়ে দেয়ার কথা কত কত দিন মনে মনে ভাবতাম”
“কেন?”
মীরা হেসে জবাব দেয়-
“সজারুর কাটার মতো দেখতে ছিলো বলে”
হো হো করে হেসে দেয় আবীর কথটা শুনে। প্রাণখোলা হাসি যাকে বলে৷ মীরা মুগ্ধ হয়ে দেখে আবীরের হাসি। এত সুন্দর হাসে ছেলেটা…
বাইরের খোলা প্রকৃতিতে সে শব্দ আরো জোড়ালো শোনালো। দ্রুত মীরা ওর হাত ঝাঁকিয়ে বললো-
“আস্তে, বাড়ির মানুষ কি ভাববে শুনলে?”
“কেউ কিছু ভাববে না, আমি কি অন্য কারো সাথে আছি নাকি? সবাই জানে আমি এখন আমার বিয়ে করা বৌর সাথে আছি”
আবীরের মুখে বৌ কথাটা শুনে ওর ভিতরটা কেমন কেঁপে উঠে যেন। তখনো নিচে টাকা ভাগ বাটোয়ারার সময়ও আবীর যখন এ শব্দটা বলেছিলো তখনো এমনি কাঁপন ধরেছিলো ওর বুকে৷ মীরা আবীরের ধরা হাতটা ছেড়ে দিলো। পাছে ওর কাঁপন না টের পেয়ে যায় আবীর।
ব্যাপারটা বুঝে আবীর কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তাকায় ওর দিকে, ভীরু দৃষ্টিতে তাকায় মীরাও। না বলেও অনেক কথা বলা হয় দু’জনে। আবীর বাতাসে মীরার মুখের ওর আছড়ে পরা চুলগুলো সরিয়ে দেয়। হঠাৎ মুচকি হেসে চোখ সরিয়ে নিলো সে। এত কাছাকাছি দুজনে তবুও আবীরের মধ্যে এখনো কেমন সংকোচ, আড়ষ্টতা।
পাশাপাশি দাঁড়ানো মীরা আবীরের একটা হাত ধরে মাথাটা ওর কাঁধে রাখে। কিছু সময় মনের যুদ্ধ শেষে আবীর আরেকটা হাত দিয়ে পরম মমতায় কাছে টেনে নেয় ওকে। আবীরের দিকে তাকায় মীরা। আবীর ওর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়, আবীরের কাছে মীরাকে বুকের মধ্যে আগলে রাখাটাই যেন বেশী সুখের।
মীরাও ওকে আঁকড়ে ধরে সমান মমতায়, আর ভাবে – “থাকুক জড়তা ওর মধ্যে দূর্লভ জিনিস পাওয়া তো কষ্টসাধ্য হবেই। আমার কোন তারাহুরো নেই, প্রয়োজনে আমি না হয় আরো অপেক্ষায় থাকবে কখন আবীর গভীর বাঁধনে বাঁধবে আমাকে।
চলবে……