প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৮৯
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
পরদিন সকাল হতেই হাসপাতালে গেলো মীরা আবীরের সাথে দেখা করতে। বাসার তৈরি নাশতা সাথে করে নিয়ে গেছে মীরা। খুদের ভাত আর ভর্তা। আবীরের মা এ খাবারটা খুব পছন্দ করাতেন। আরো একটা খাবার তার পছন্দ ছিলো তা হচ্ছে কাজীর ভাত, সাথে রকমারি ভর্তা । পাশাপাশি বাড়িতে থাকতে মীরার মা জাহানারা যখনই এ খাবারটা তৈরি করতো তার জন্য পাঠিয়ে দিতো। বাসা ছেড়ে চলে যাবার পরও দাওয়াত করলে পোলাও মাংস না রেঁধে তার জন্য এ খাবারটাই তৈরী করতেন তিনি। ফিওনা এসব পছন্দ না করলেও ভর্তা আবীরের ভীষণ প্রিয়, এটা জানে মীরা। আসলে দুটো পরিবার এত ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশেছে যে সবাই সবার পছন্দ অপছন্দ গুলো জীবণে চলতে পথে জেনে গেছে।
মীরা যখন হসপিটালে গেলো আবীর তখনো ঘুমে ছিলো। সোবাহান চাচা মীরাকে দেখে ডাকতে যায় আবীরকে কিন্তু মীরা নিষেধ করে বলে-
: “সমস্যা নেই চাচা, আমি বসি কিছুক্ষণ ”
ঘড়িতে সময় সাড়ে আটটা মাত্র। কথোপকথন এর এক পর্যায়ে চাচা বললো – আজ নাকি আবীরকে ডিসচার্জ দিবে। তবে তাকে হাঁটাচলা আপাততঃ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন ডাক্তার। ভাঙা পায়ে আবার ব্যাথা পেয়েছে, তাই তাদের এই নির্দেশ।
সোবাহান চাচা কথা শেষ করে মীরার জন্য চা আনতে বাইরে গেলেন। মীরা সোফায় বসে দেখতে লাগলো ঘুমন্ত আবীরকে। ভাবতে থাকে হুট করে এখানে আসাটা ঠিক হলো কি? মানুষটা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে ওর সাথে এটাই অনেক ওর জন্য। এতদিন কথাই বলে নি, এখন বলছে বলে এরকম পরিস্থিতিতে তাকে বিরক্ত করাটাকে তিনি কিভাবে নিবেন? এসব ভাবতেই একটা ফোন আসে মীরার, ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করতে করতে ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙে আবীরের। মীরা ফোন কানে নিয়ে অপরাধীর হাসি হাসে ঘুম ভাঙার অপরাধে ইশারায় সরি বলে বারান্দায় যায় কথা বলার জন্য।
ঘুম থেকে উঠে মীরাকে দেখে চমকে গিয়েছিলো আবীর। প্রথমে ভেবেছিলো অন্য কেও। পরে মীরার অপরাধী ভঙ্গিতে হাসা আর ইশারায় সরি বলতে মুখ উঁচু করায় নিশ্চিত হয়েছে যে মীরাই। ওর সরি বালার ভাবটা এমন যেন ওরা খুব কাছের কেউ, যেন কোনদিন দুজনের মাঝে কোন দেয়াল ছিলোই না। ওর অপারাধী ভঙ্গিতে হাসা আর ইশারায় সরি বলাটাকে বেশ উপভোগ করলো আবীর। মুচকি হেসে সাবধানে বিছানা ছেড়ে নামলো হাতমুখ ধুতে। কেবিন লাগোয়া বারান্দায় হওয়ায় মীরার ফোনে বলা কথাগুলো না চাইলেও ঘর থেকেই শুনতে পাচ্ছে আবীর, মীরা বলছে-
: “ফাহাদ এমনটা আবার যে হবে না তার কোন গ্যারান্টি নেই। তুমি ওয়ার হাউজে রাতের জন্য নিরাপত্তা প্রহরী বসাও, আমি একটা জায়গা দেখে দ্রুত ওগুলো সরিয়ে নিবো”
মীরার কথপোকথন আগাগোড়া সবটাই আবীরের কানে এলো। কথা শেষ করে মীরা রুমে এসে ফোনটা রেখে আবীরের দিকে চেয়ে বিনীত ভঙ্গিতে বললো-
: ” সরি আপনার ঘুম ভেঙে দিলাম”
আবীর তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে বলে
: ” ঘুম যখন ভেঙেই গেছে,বলে আর কি হবে?”
এতক্ষণে আবীর বিছানা ছেড়ে বেসিনে মুখ ধুয়ে নিয়েছে।
মীরা মনে মনে ভাবে নরমালি অন্য কেউ হলে এরকম পরিস্থিতিতে বলতো- “আরে না, না, সরি বলার কি আছে” কিন্তু আবীর বরাবরই এমন, কাওকে ইমপ্রেস করার ধার ও ধারে না, “অলওয়েজ বি ইউর সেলফ” একটা মানুষ । মীরার আবীরের এ দিকটা পছন্দ। অতিরিক্ত চাকচিক্য নেই, পুরোটাই খাঁটি। সেই ছোট থেকে দেখছে সে বরাবর স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড, ভনিতা, পেচিয়ে কথা বলা এসব সবসময় এভয়েড করে মূল কথা বলে। মীরার আজও মনে আছে বিয়ের আগে আলাদা দেখা করার সময় আবীর সরাসরি মীরাকে জিজ্ঞেস করেছিলো- ” এ বিয়েতে তোমার মত আছে তো?” আবীর রাজিবের বিষয়টা জানতো, চাইলে তিনি প্রশ্ন করতে পারতো – “কারো সাথে এখনো কি সম্পর্ক রয়েছে তোমার? কিংবা “এখনো ভালোবাসো কাওকে?” ওকে বিন্দুমাত্র বিব্রত না করে সুন্দর শালীন জিজ্ঞাসা – “বিয়েতে মত আছে কিনা?”
এসব ভাবতেই আবীর তোয়ালে রেখে ঔষধের বাক্স খুলতে খুলতে বলে-
: “তারপর কোথায় বসছে প্রহরা?”
এরপর গতরাতের ঘটনা খুলে বললো মীরা আবীরকে। সবটা শুনে আবীর বলে-
: “তোমাকে তো বললাম এগুলো বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা না, এবং এটাই শেষ না, সামনে আরো অনেক কিছু হবে যদি না তুমি শক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়াও। তুমি হয়তো গতকালের কথাটা সিরিয়াসলি নাও নি, কিন্তু এ ছাড়া তোমার ঘুড়ে দাঁড়াবার সব পথ বন্ধ”
: “কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না”
: “না বোঝার কি আছে? ফর্স্ট অফ অল – থানায় একটা সাধারণ ডায়েরি করবে, তারপর সব পেপারস রেডি করে সংবাদ সম্মেলন করবে, তারা গত কয়েকদিন ধরে কিভাবে তোমাকে হ্যারেস করছে তার বিবরণ দিয়ে। তুমি যে ওর বাবার কাছে গিয়েও এর কোন সমাধান পাও নি, তাও বলবে, তারপর নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টা এড করবে”
: ” মনোনয়ন পত্র….”
কথাটা শেষ করতে পারে না মীরা।
: “না, আজ নেয়া যাবে না সেটা, তাহলে পাবলিক সেন্টিমেন্ট ক্যাচ করা টাফ হবে, সবাই তোমাকে স্বার্থান্বেষী ভাববে, মনোনয়ন পত্র তোলার শেষ তারিখ কবে?”
: “২৭ নভেম্বর ”
: “আজ নভেম্বর ২১ তার মানে প্রায় সপ্তাহ খানিক সময় তোমার হাতে আছে। আগে উনার বিপক্ষের শক্তি গুলোকে একত্র করতে হবে তোমাকে, তাদেরকে বোঝাতে হবে তুমি নিজেও তাদের মতো ভুক্তভোগী। তারপর এমন পরিস্থিতি তৈরী করতে হবে যাতে তারা নিজেরাই তোমাকে তাদের প্রতিনিধি ভাবতে শুরু করে। এসবের মধ্যে ওরা অবশ্যই তোমার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে কোনো না ঘটনা ঘটাবে, তখন সেটাকে পুঁজি করে ওদের সাথে লড়ার জন্য তুমি নির্বাচনে অংশ নেয়াটা বেছে নিবে, এটলিস্ট সবাই যাতে এটাই বোঝে, তবে একটা কথা না বললেই নয়, এর মধ্যে তোমাকে সাবধানে থাকা লাগবে, যে কোন সম যে কোন কিছু হতে পারে”
: “হারানোর কি আছে বলেন? এ পথে হাঁটা ছাড়া কোন উপায় নেই”
: “একটা উপায় কিন্তু আছে ?” বলেই খাবার আগের ঔষধ দুটো মুখ দেয় আবীর তারপর পানি খায় ধীরে সুস্থে।
মীরা তড়াক তাকায় আবীরের দিকে, কারন ও জানে আবীর এ কথাটা দ্বারা কি মিন করছে। মীরার তাকানো দেখে আবীর কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়।
মীরা দৃষ্টি অবনত করে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ওড়নার টারসেল নড়াচড়া করতে করতে বলে-
: ” দুনিয়াতে এক আপনার কাছেই আমি হীন, ক্ষুদ্র। বাইরের পৃথিবীতে সবাই আমাকে কঠিন মানুষ হিসেবেই চিনে। নিজের অর্জিত সব ছেড়ে শূন্য হাতে বেরিয়ে গিয়েছিলাম আমি। আমাকে সুখ, সৌন্দর্য, অর্থ, বৈভবের লোভ দেখিয়ে লাভ নেই। ঠিক ভুলের সীমানায় এখন আমার টনক প্রখর, চুন খেয়ে মুখ পুড়িয়েছিলাম তো… ”
: ” সরি আসলে কথটা…” এমন সময় চা নিয়ে কেবিনে ঢুকে সোবাহান চাচা। মীরা তাকে দেখে বলে-
: “বসেন চাচা একসাথে নাশতা করি”
চায়ের ফ্লাক্সটা রেখে তিনি বলেন, ফাইলটা দেখতে চাইছে ডাক্তার, তোমরা খাও আমি এটা দিয়া আসতাছি। বলে তিনি ফাইল নিয়ে বেরিয়ে যান।
মীরা নিজের খাবারও নিয়ে এসেছে। এরপর একসাথে ব্রেকফাস্ট করে ওরা। খেতে খেতে আলাপ হয় দুজনে। পরবর্তী করনীয়র ছকটা মাথায় সাজিয়ে নেয় মীরা। আবীর ওকে সাহস দেয় ভয় না পাওয়ার। সাথে সাবধানতা অবলম্বনে আরো কিছু পরামর্শ।
খাওয়া শেষ করে ফিরার সময় নিজের ফোন খুঁজে পায় না মীরা। ফোন খুঁজে পেতে আবীরের ফোন থেকে মীরার ফোনে কল করতে বলে আবীর। ফোন হাতে নিয়ে নম্বর ডায়েল করতেই ফোন পাওয়া গেলো তোয়ালের নিচে। ওর ফোন আর আবীরের নম্বর দুটোই পেলো মীরা, একটা খুশির স্রোত বইলো মনের মধ্যে। অবশ্য আবীরের নম্বর পাওয়া কঠিন কিছু ছিলো না মীরার কাছে, ওর মায়ের ফোন থেকেই নিতে পারতো ও। মীরা আসলে ওর নম্বরটা আবীরকে দিতে পেরে খুশি। কারন এমন মুডি ছেলের পক্ষে মীরার নম্বর জোগাড় করা ভীষণ টাফ।
এরপর বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যেতেই আবীর ডেকে বলে-
: ” God bless you with all the things you want”
মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে মীরা বলে-
: আমীন,
তারপর চোখ খুলে আবীরের চোখে চোখ রেখে বলে-
: “আল্লাহ যেন আপনার দোয়া কবুল করে আবীর”
মীরার মুখে নিজের নাম শুনে কেমন অপ্রস্তুত হয়ে যায় আবীর। সুন্দর একটা হাসির বিনিময় করে দূর্গম এক জীবণের এক বুক স্বপ্ন নিয়ে হাসপাতালের কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় মীরা।
চলবে….
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৯০
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
দুরন্ত গতিতে চলছে মীরার গত কয়েকটা দিন। যতটা দূর্গম ভেবেছিলো মীরা এ পথ তারচেয়েও দূর্গম। কত কত মানুষের কটাক্ষের স্বীকার হয়েছে ও, মুখোমুখিও হতে হয়েছে রক্তচক্ষুর। তবে ভালেবাসাও পেয়েছে অনেক। নানান নিগ্রহের স্বীকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যাবসায়ীদের অনেক ক্ষোভ, লাঞ্চনা, না পাওয়া, এ ভালোবাসার জন্ম দিয়েছে।
টেন্ডার বানিজ্য, মালামালের মজুদকারীদের বাজার নিয়ন্ত্রণ, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা, চাঁদাবাজি, এমন অনেক কারনেই দিনশেষে আয়ব্যায়ের হিসাব মিলাতেই হিমশিম খেতে হয় ব্যবসায়ীদের। অতিরিক্ত দামে মালামাল কিনে, মালামাল পরিবহন পথে জায়গায় জায়গায় চাঁদাবাজদেরকে চাঁদা দিয়েও যখন কাজ করিয়ে বড় বড় কম্পানি টাকা আটকে দেয়, কাজের ন্যায্য মূল্য পায় না তখন দিনশেষে সেভিংসে হাত দিতে হয় না মিলাতে পারা হিসাব মিলাতে। তাই মীরা তার সাথে দাঁড়ানোর জন্য অনেককেই পাশে পেয়েছে। তারা এই অরাজকতার শেষ চায়, ঝামেলাহীন ভাবে ব্যাবসা করতে চায়, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা চায়।
এদিকে সায়নের বাবা আশফাকুজ্জামান শাকিল ক্ষুণাক্ষরেও টের পাননি যে মীরাকে ইগ্নোর করার ফল এত ভারী হবে। তিনি প্রথমটায় মীরার এ খবর শুনে বিশ্বাস করেন নি। পরে অফিসে জমাকৃত মনোনয়ন পত্রের থেকে খুঁজেে মীরার কাগজের ছবি যখন গোপনে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হলো তাকে তখন তিনি নিশ্চিত হয়েছেন এ খবরে। রাগে তার মাথা গরম অবস্থা। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের ও বেশী সময় ধরে এ লাইনে তিনি জড়িত। গত দুই দু’বার নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে সাহস করেনি কেউ, বীনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গেছেন তিনি। আর আজ কিনা ত্রিশ বছরের ও কম বয়সী এক পুচকে মেয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে যাচ্ছে। “একে একটা শিক্ষা দিতেই হবে”, তার – এমন ভাবনায় পানি ঢালে তার স্ত্রী। তিনি তার পাশে বলেন
: “মাথা গরম করো না, একবার ভেবে দেখো এটা ভালোই হবে তোমার জন্য, অপেক্ষাকৃত দূর্বল প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে খেলায় জেতা সহজ। তুমি এখানকার গডফাদার, আর ঐ মেয়ে দুইদিন ধরে নেমেছে ফিল্ডে, অভিজ্ঞতার ও তো একটা দাম আছে”
এরপর দীর্ঘ সময় আলাপ হয় স্ত্রীর সাথে। স্ত্রীর কথা মনে ধরে তার। আসলেই তো, এভাবে তো ভেবে দেখে নি তিনি।
পরদিন অফিসে আশফাকুজ্জামান শাকিলের নিশ্চিন্ত ভাব দেখে তার সেক্রেটারি হতবাক। পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে তাতে তার ভীত হওয়ার কথা। তবে ব্যাপারটায় তিনি ভীত তো হনই নি বরং এনজয় করেছেন যেন এটা কোন সাপলুডু খেলা। গতকাল হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো ছবিটা তিনি তার সেক্রেটারিকে দেখিয়ে বললেন-
: ” বীনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজিএমইএ এর পরবর্তী সভাপতি “আশফাকুজ্জামান শাকিল” নির্বাচিত” এবার বোধহয় এই দূর্নাম ঘুচবে আমার”
সেক্রেটারি বিষ্মিত হয়ে বলেন-
: “এটা কি আপনার প্ল্যান স্যার”
: “নাহ,
: ” স্যার তাহলে বয়স ইস্যু দেখিয়ে মনোনয়ন বাতিল করে দিই? কি বলেন?”
: ” নাহ্, কোন দরকার নেই, বরং ওর ইলেকশনে অংশ করাটাকে আমাদের জন্য মন্দের ভালো বলতে পারো। এই মেয়েকে ভোট কে দিবে?, কি বোঝে ও বিজিএমইএ এর?
: “তাও ঠিক, তবে যেভাবে দল পাকাচ্ছে…
কথাটা শেষ করতে দেয় না আশফাকুজ্জামান শাকিল। তিনি কেমন যেন হেসে তার সেক্রেটারিকে বলেন-
: “যত গর্জে তত বর্ষে না নাদিম” তুমি বরং এক কাজ করো, তুমি ওর নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথটা মসৃণ করে দাও। ওকে কোন রকম সমস্যা যাতে ফেইস করা না লাগে সেদিকটা দেখো। সব ঘাট বেঁধে ওর সাথে আমি ভোটে বোঝাপড়া করবো। নির্বাচনটাকে শেষ হতে দাও, এরপর ওকে আমি হওয়ায় মিশিয়ে দিবো- এটা আমার প্রমিজ”
এদিকে মীরা প্রথম দিনের প্রচারণায় গতবারের সভাপতির দোষ, আর ওর সাথে করা অন্যায়ের ফিরিস্তি তুলে ধরেছে। এতে সাংবাদিকদের কৌশলী প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় ওকে। এক সাংবাদিক মীরাকে প্রশ্ন করে-
: “নিজের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয়াই কি আপনার নির্বাচনে অংশ নেয়ার মূল লক্ষ্য?”
এর উত্তর না দিতেই পাশ থেকে আরেকজন জিজ্ঞেস করে –
: “আপনার নির্বাচনী মোটিভ ব্যাক্তিগত, এতে করে ভোটারদের কি লাভ আপনাকে নির্বাচিত করে? তারা কেন ভোট দিবে আপনাকে?
মীরা ক্যামেরার সামনে কথা বলায় অনভ্যস্ত থাকায় এমন পরিস্থিতিতে কি উত্তর দিবে তা নিয়ে চিন্তায় পরে যায়। তবে অল্প কিছুটা সময় নিয়ে বলে –
: ” দেখেন নির্বাচন তো একতরফাই হয়েছে এত বছর, কোন একজনকে তো সামনে এগিয়ে আসতে হবে এ অপশক্তির বিরুদ্ধে। আমি প্রয়োজন মনে করেছি সামনে আসার, আমি আমার একার সমস্যার সমাধানে, কিংবা একার কথা বলতে এখানে আসি নি, আমি সব নিগ্রহের স্বীকার মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছি”
এরপর সাংবাদিকদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় মীরা।
গাড়িতে বসে বেস আপসেট ফিল করে ও। ওর বাবা একসময় বলতো নির্বাচনে নামতে মনের জোড় আর সাহস লাগে। কথাটা এক প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে দাঁড়িয়েই টের পায় মীরা।
বাড়ি ফিরে থুম ধরে বসে থাকে। খুবতো ভালো কাটছিলো দিন। কিভাবে কখন সবকিছু এমন এলোমেলো হয়ে গেলো।
এসব ভাবতেই আবীরকে কল করার কথা ভবাে মীরা।
মনের মধ্যে দ্বিধা দ্বন্দ্ব চলছে ফোন করবে কি-না। কিছুক্ষণ ভাবনার পর আবীরকে ফোন দিয়েই দেয় মীরা,
একবার…
দুইবার…
তৃতীয়বার রিং হতেই কলটা রিসিভ করে আবীর। কল
রিসিভ করেই আবীর বলে-
: ” তুমি ব্যাবসায় কৌশলী তা জানতাম, কথা বলায় যে এত দক্ষ তা তো জানতাম না। এত বড় কবে হলে তুমি?”
মীরা অবাক হয় আবীরের এমন কথায়, প্রথমে ভেবেছিলো কল রিসিভ করবে না আবীর, কিংবা করলেও প্রথমটায় না চেনার ভাব করবে। ঢং করে জিজ্ঞেস করবে – ” কে? ” কিন্তু সহজ গলায় যা বলতেই ও কল করেছে, নিজ থেকেই তা বলছে, ছেলেটা কি জানতো যে কল করবো আমি- মনে মনে ভাবে মীরা। মীরা অবাক হওয়ার দমক সামলে বলে-
: “ধূর, এসব হবে না আমাকে দিয়ে, কথাটাই দেখলেন, আমার চেহারার কি বেহাল দশা ছিলো তা দেখেছিলেন?”
: “সবটাই দেখেছি আমি, এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দিতেই চোখ ছোট হয়ে গেছে তোমার, পরেরবার তো… ”
মুচকি হাসে মীরা, আসলেই প্রথম সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দিতেই চোখ ছোট গেছে ওর, দ্বিতীয় জনের প্রশ্ন শুনে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছিলো ও চিন্তিত ভঙ্গিতে। এ কথাটা ভদ্রতার খাতিরে বলতে গিয়েও চেপে গেলো আবীর।
এরপর আবীর বললো-
: “তোমার ট্র্যাক ঠিকাছে, তুমি তো আর রাজনীতিবিদ নও। ঠিক হয়ে যাবে সব। ঢেঁকির নিচে মাথা দিয়ে এখন পাড়ের ভয় করলে চলবে? গো এহেড….
পরদিন নির্বাচনী প্রচারনায় পূর্ববর্তী সভাপতির দোষ ত্রুটির ফিরিস্তির পাশাপাশি এ খাতে নতুন কি কি করা যায় সেদিকে ফোকাস করেছে মীরা। উন্নত বিশ্বের কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা, সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে আলোচনা করেছে। যে দেশের কর্মচারীরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কেই জানে না তাদের জন্য এসব বিলাসিতা, এমন আবেগী কথাও বলে মীরা। মোটকথা ওর কৌশলী বক্তৃতা সকলকে মুগ্ধ করে।
এদিকে আবীরের পায়ে ইনফেকশন হয়ে খুব বাজে অবস্থা হয়ে গেছে। এক সপ্তাহের মধ্যেই এই ইস্যুতে দুইবার হাসপাতালে যেতে হয়েছে। ফোনের টুকরো টুকরো কথোপকথনে আবীর এসবের কিছুই বলে নি মীরাকে। বেচারী এমনিই পেরেশানীতে আছে ওকে বাড়তি টেনশন দিয়ে লাভ কি।
অবশেষে নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসে। আগের দিনের বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা বাদে পরিবেশ মোটামুটি স্বাভাবিক। চারদিকে উৎসব উৎসব রব। মীরা খুব সকালে নির্বাচন স্থলে পৌঁছে যায়। যাওয়ার আগে মীরা তিনটা ফোন করে। প্রথমটা মা’কে, দ্বিতীয়টা মুখলেস সাহেবকে, তৃতীয় কলটা করেন আবীরকে। মা দোয়া করে দিয়েছেন। বলেছেন হার জিত যাই হোক মনে সাহস রাখবি সবসময়।
মুখলেস চাচা মীরার নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারটায় নাখোশ। কিন্তু তিনি মীরার বর্তমান পরিস্থিতির সবটা জানেন না। তার শরীরের অবস্থা ভেবে সবটা জানায়ও নি মীরা। তবুও তিনি নাখোশ কারন আসফাকুজ্জামান শাকিল ভয়ংকর লোক। প্রথম বার নির্বাচনের দিন প্রতিদ্বন্দ্বীকে আটকে রেখে, তার এজেন্টদেরকে বের করে ভোট কারচুপি করে জয়ী হয়েছিলেন। এখানেই শেষ নয়। লোকটার ব্যাবসা, বানিজ্য, বাড়িঘর সব নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। আজ চার বছর ধরে তিনি নিখোঁজ। বেঁচে আছেন কি ম*রে গেছে তাও জানে না তার পরিবার। এমন ভয়ংকর লোকের বিপরীতে তাই কেও দাঁড়ানোর সাহস পায় না, না পারে তার বিরুদ্ধে কিছু বলার। তবে মীরা যখন সাহস করে দাঁড়িয়েছে না জিতুক মীরা তবুও ও মানুষের মনে নির্বাচন হওয়ার আগেই জিতে গে। এটাই কম কি?
এর পরের কলটা করে মীরা আবীরকে। আবীর বলে-
: ” আমাদের জন্মের আগেই আমাদের জন্মকুণ্ডলী লিখে ফেলেছেন খোদা। এটা তুমি জানো?”
মীরা ছোট্ট করে একটা শব্দ করে-
: “হুম”
: ” তুমি দেশের ইতিহাসে বিজিএমইএ এর সর্বকনিষ্ঠ
সভাপতি হতে যাচ্ছো। এটা তোমার জন্মেরও বহু আগে লিখে ফেলেছেন খোদা৷ তোমার কাজ হচ্ছে সেখানে গিয়ে নিজের কুরসিটা বুঝে নিয়ে আসা”
উত্তরে স্মিত হাসে মীরা। এরপর আবীর বলে-
: “বেস্ট অফ লাক মীরা”
আবীরের মুখে নিজের নাম শুনে বুকে কেমন এজটা কমৃপন অনুভব করলো যেন মীরা। এমন না যে জীবনের প্রথম ওর নাম ধরলো আবীর। দুই বাড়ির মানুষ একত্রে হলেই দেখা হতো ওদের। কত কত দিন এটা সেটা জিজ্ঞেস করতে আবীর ডেকেছে ওর নাম ধরে। তবে গত বারো বছরে আবীরের মুখে এ নামটা প্রথম শুনেছিলো ফিওনার বাসায়। আর দ্বিতীয়বার।
মনের সুনামিকে দমিয়ে রেখে বিদায় নেয় মীরা। আবীর বলে- “আপডেট জানিও, আমি অপেক্ষায় রইলাম “ছোট্ট করে “আচ্ছা ” বলে ফোন রাখে মীরা।
মীরা পৌছে দেখে পুরো হল ভর্তি মানুষে। একে একে আসে ওর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলে। সকাল নয়টা থেকে শুরু হয় ভোট গ্রহণ। উৎসবমূখর পরিবেশে দুপুর তিনটা পর্যন্ত টানা ভোটগ্রহণ চলে। চারটায় শেষ হয়ে শুরু হয় ভোট গননা। দুপুর তিনটা থেকেই আবীর টিভির সামনে বসা। যদিও এটা সংসদ নির্বাচন না যে ফলাও করে প্রচার হবে খবর। কিংবা ভোট গননার আপডেট জানাবে। তবুও খবরটা জানতে বসে আছে মীরা ব্রেকিং নিউজের টাইটেল বারে।
খবর চলছে টিভিতে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলোর সাথে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেরোস। দেশের একঝাঁক বিজ্ঞানীদের নিরলস পরিশ্রমে এ সাফল্য অর্জন করেছে দেশ। নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় খবর এটি। ফলাউ করে প্রচার করা হচ্ছে এ খবর।
এই খবর সেই খবর কত খবর হচ্ছে কিন্তু বিজিএমইএ এর নির্বাচনের কেন খবর নেই। পা-টা ভালো থাকলে ও ঠিল চলে যেতো সেখানে। কিন্তু নিজের পায়ে এখনো যে হাঁটতে পারে না তার জন্য এমন ইচ্ছে বিলাসিতা।
জগ থেকে পানি ঢালতেই নিউজ প্রেজেন্টর খবর পড়ে-
” উৎসব মুখর পরিবেশে শেষ হলো বিজিএমইএ এর দ্বিবার্ষিক নির্বাচন। দ্বিবার্ষিক এই নির্বাচনে ৭৬ শতাংশ ভোট পড়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে সবচেয়ে বেশি ভোট (১১৮০) পেয়েছেন সম্মিলিত ফোরামের “জিনিয়া আবেদীন মীরা” তার প্রতিদ্বন্দ্বী আসফাকুজ্জামান শাকিল পেয়েছেন ৪৬৭ ভোট। “জিনিয়া আবেদীন মীরা” বিজিএমইএ এর ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ সভাপতি হতে যাচ। আগামী ১২ ডিসেম্বর তিনি আগামী দুই বছরের জন্য সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করবেন”
খবরটা শুনে কেমন যেন তব্দা খেয়ে গেলো আবীর। অস্ফুটে বললো “আলহামদুলিল্লাহ ”
চলবে…
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৯১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
এত বড় খবরটা কাওকে নিজ থেকে বলতে হয় নি মীরাকে। একে একে প্রায় সবাই-ই অভিনন্দন জানাতে খোঁজ নিয়েছে মীরার। মীরা কারো কারে ফোন পেয়ে বেশ আবাক হয়ে যায়। কপট বিরক্ত হয়ে মীরা বলে- “এদেরকে খবর দিলো কে?”
তমা মিষ্টি হেসে মীরার দুই গাল টেনে বলে-
: ” আকাশে চাঁদ উঠলে কাওকে বলে দিতে হয় না, সকলেই দেখতে পায়”
মীরা মজা করে অবাক ভঙ্গিতে বলে-
: “দিনের বেলায় চাঁদ!”
তমা মীরাকে জড়িয়ে ধরে বলে-
: “আর কেন কোন স্বপ্ন ছোঁয়া বাকী তোমার মীরাপু”
উত্তরে মীরা লাজুক হাসি হাসে। মনে মন জপ করে একটা নামের।
সেখানকার সব কাজকর্ম শেষ করে বের হতে হতে রাত হয়ে যায়। সকালের সাথে ফোনে কথা হলেও একজন এখনো অভিনন্দন জানায়নি মীরাকে। সেই একজনটা হচ্ছে আবীর। ওর খুব ইচ্ছে করে এত রাত হওয়া সত্ত্বেও পুরান ঢাকায় গিয়ে আবীরের সাথে দেখা করে। যাবে কি-না তা ভেবে মনের মধ্যে দ্বিধা দ্বন্দ্ব। এত রাতে যাওয়া ঠিক হবে কি? এদিকে এত রাত হওয়া সত্ত্বেও রাস্তায় প্রচুর জ্যাম, এখান থেকে বেরুতেই অনেকটা সময় পার হয়ে যাবে। হঠাৎ মীরার চোখ যায় রাস্তার ধারের ফুলের দোকানের দিকে। গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বের হয় মীরা। পাশে থাকা তমা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ফুলের দোকানের দোকানির সাথে কথা বলা শুরু করে মীরা। তমা ভাবতে থাকে “এত এত ফুলের বুকে গাড়ির ডিকিতে, তাও ফুল কিনতে নামলো কেন সে? ”
ফুল কিনে গাড়িতে আসতেই তমা জিজ্ঞেস করে –
: “টিউলিপ কি আবীর ভাইয়ার প্রিয় ফুল?”
মুচকি হেসে মাথা নাড়ে মীরা। এরপর আর কোন প্রশ্ন করে না তমা, রাত হওয়া সত্ত্বেও যেতে চায়না মীরার সাথে। কারন তমা জানে পুরান ঢাকার ঐ বাড়িটা মীরার জন্য ওর মায়ের পরে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা।
তমা বাড়ির কাছাকাছি নেমে গেলো বাসা থেকে। ওকে বাসার কাছে ছেড়ে মীরা ড্রাইভারকে বললো তাকে শেয়ার করা লোকেশনে যেতে।মিনিট পনেরো পর মীরা পৌঁছে গেলো আবীরের বাড়িতে। সিঁড়ি বেয়ে উঠে মীরা বসার ঘরে বসলো, মিষ্টি আর ফুল পাশে রেখে সেবাহান চাচাকে দিয়ে খবর পাঠালো ওর আসার। একটু পরেই আবীর হুইল চেয়ারে করে নিজেই এলো মীরার কাছে। আবীরের এ অবস্থা দেখে মীরা হতবাক। বিস্ফারিত চোখে তাকায় মীরা আবীরের দিকে। খুব সম্ভবত ও মনে মনে বলছে “হুইল চেয়ার?”
মীরার মন পড়ে আবীর বলে-
: “এত অবাক হওয়ার কিছু নেই, ইনফেকশন হয়েছিল, অনেকটা সেরে গেছে”
: “আমাকে বললেন যে সবকিছু ওকে”
: “কেন ওকে মনে হচ্ছে না তোমার?”
: “বসে পরে মীরা ”
আবীর পাশে এসে বলে
: “এত হাইপ কেন হচ্ছো?”
: “আপনি আামকে মিথ্যা বলেছেন”
: “মিথ্যা বলিনি তো, সত্যি গোপন করেছি”
: “ঐ একই”
: “না এক না, আচ্ছা এসব বাদ দেও, এত রাত করে কেন এলে?”
: “আজকের এই দিনে কত কত লোক অভিনন্দন জানালো আমাকে, এক আপনিই…”
: “ওরা আজ জেনেছে বলে আজ অভিনন্দন জানিয়েছে, আমি তো আমাদের শেষ দেখা হওয়ার দিনই বলে দিলাম ‘নিজের ঐ পদটা গিয়ে বুঝে নাও ”
উত্তরটা শুনে মীরা সোজা তাকায় আবীরের দিকে। আবীর মাথা নেড়ে সায় দেয় যে ও সত্যি বলছে।
মীরা পাশে থাকা টিউলিপের বুকেটা বাড়িয়ে দিলো আবীরের দিকে। তারপর বললো-
: “এটা আপনার জন্য ”
স্মিত হেসে সেটাকে গ্রহণ করলো আবীর। মীরা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো সেই হাসিটা। এই ছেলেটা এত সুন্দর করে হাসে কিভাবে?
গন্ধহীন ফুলের গন্ধ নেয়ার ভঙ্গিতে মুখের কাছে নেয় বুকেটাকে৷ যেন ফুল দিয়ে নাক ছোঁয়ানোর খেলা৷ যেন ফুল না আবীর নিচ্ছে মীরার স্পর্শ। ঠিক এই সময় মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় চার চোখের। দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয় মীরা। আবীর মীরার দৃষ্টি গোটানোর তারাহুরো ভঙ্গি দেখে হেসে দেয়।
মীরা হঠাৎ অস্বস্তিতে পরে যায় যেন। আবীর এই অস্বস্তিটা কাটাতে বললো-
: “যাক অনেক বড় কাজ শেষ হলো তোমার”
কিছু সময় চুপ থাকে মীরা। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে-
: “এরচেয়ে বড় কাজ বাকী আছে একটা”
জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে আবীর অবাক হয়ে বলে-
: “কি কাজ?”
উত্তরে কেমন একটা চোখে আবীরের দিকে তাকায় মীরা। আবীর ওর তাকানো দেখে যেন কেঁপে উঠে হঠাৎ কিছু মনে পরার ভঙ্গিতে।
কিছু সময় মৌন থেকে মীরা বিদায় নিতে চাইলে আবীর ওকে রাতে খেয়ে যাওয়ার জন্য বলে। মীরা উত্তরে বলে “দাওয়াতটা তোলা থাকলো”
রাত বেশী হওয়ায় আবীরও আটকালোনা মীরাকে। বসার ঘরের জানালা দিয়ে ওর গাড়িটার চলে যাওয়া দেখলো একমনে।
———————-
নির্বাচিত হওয়ার পর বেশকিছু ঝামেলায় পরতে হয় মীরাকে। বয়স, যোগ্যতা, অনভিজ্ঞতা, থাকা সত্ত্বেও
আশফাকুজ্জামান শাকিল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে
যতটা হালকা ভাবে নিয়েছিলো মীরাকে ঘটনা তার বিপরীতে ঘটে গেছে। নির্বাচনের আগে কোনরকম অভিযোগ না করলেও নির্বাচন পরবর্তী বেশ কিছু অভিযোগ আনেন তিনি জয়ী প্যানেলের বিরুদ্ধে। যদিও এসবের কিছুই ধোপে টিকে নি। কারন পৃথিবীর ইতিহাসে কোন পরাজিত প্রার্থীকেই বলতে শোনা যায় নি যে নির্বাচন সুষ্ঠ হয়েছে।
নির্বাচিত হওয়ার পর নিজ কাজের পাশাপাশি বেশ কিছু দায়িত্ব বেড়ে গেছে মীরার। নিজের ব্যবসায়িক কাজের চেয়ে এখন ওর পাওয়া পদবীর কাজটাই মূখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ওর জন্য। কারন নতুন কর্মক্ষেত্রের এ দুনিয়াটা ওর জন্য এক্কেবারে নতুন। যদিও মীরার সেক্রেটারি নাদিম মীরাকে অভয় দিয়েছে সব কাজ ওর জন্য সহজ করে দেয়ার।
ওয়েটা..
সেক্রেটারি নাদিম!
একটু অবাক হচ্ছেন তো?
অবাক হওয়ারই কথা। পালাবদলের খেলায় এত বড় প্রতিষ্ঠানের সভাপতি বদলে গেলেও সেক্রেটারি বদলায় নি। কারন সাবেক সভাপতি আসফাকুজ্জামান শাকিলের সেক্রেটারি নাদিম মাহমুদকে মীরা তার পদে বহাল রেখেছেন। কারন মীরার এই নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পেছনে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে লোকটা। বলা ভালো ওর অবদান অনস্বীকার্য।
পূর্ববর্তী সভাপতি আসফাকুজ্জামান শাকিলের ক্ষমতার অপ-ব্যাবহারের শিকার শুধুমাত্র ব্যাবসায়ী মহলই নন। বরং বিজিএমইএ এর সংশ্লিষ্ট সকলের ভাগ্য বিধাতা যেন ছিলেন তিনি। কোন ব্যাপারের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিবেচনার কৌশলী হওয়ার চেয়ে বেশী প্রাধান্য পেতো তার এবং তার ছেলের মন মর্জি। মনে মনে তাই এখানকার সকলেই ক্ষুব্ধ তার প্রতি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে এতদিন টিকে থাকায় চাইলেও কেউ মুখ খুলতে পারে নি। তার প্রতি সকলের জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ এই নির্বাচনের ফলাফল৷ সকলেই পরোক্ষ ভাবে চেয়েছে মীরার জয়। এত গুলো মানুষের দোয়া, পরোক্ষের চেষ্টা খোদা বিফলে যেতে দেন নি। সম্মানের সাথে জয়ী হয়েছে মীরা। অর্জন করেছে বিজিএমইএ এর সর্বকনিষ্ঠ সভাপতির খেতাবও।
আমাদের দেশের অর্থনীতিতে পোশাক খাত অনেক অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। বলা ভালো অর্থনীতির চাকা চালিয়ে রাখতে যতগুলো সেক্টর রয়েছে তার মধ্যে পোশাক খাত থেকে আয় হয় সিংহ ভাগ।
সেক্ষেত্রে এত বড় পদে যোগ্য লোক দায়িত্ব পালন করলে সে ক্ষেত্র উত্তোরোত্তোর উন্নতি হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে উন্নতিতো হয়ই না উল্টো এর অবনতি হচ্ছে প্রতিনিয়নত। এমনকি অযোগ্য লোক গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হলে তার ধ্বংস যে অনিবার্য তা উধাহরন হিসেবে গত কয়েক বছরের ড্যাটাই যথেষ্ট। এটা শুধু বিজিএমইএ এট সভাপতির ক্ষেত্রে না, বরং দেশের নেত্রীত্ব স্থানীয় পদগুলোর বেলাতেও পূর্বে এমন শত শত উধাহরন ছিলো। আমাদের ইংরেজি সাহিত্যে পড়া অর্থমন্ত্রী ছিলো, বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) এর চেয়ারম্যান পদে ছিলো কৃষিবিদ। অযোগ্য লোকের ছড়াছড়ির ফিরিস্তি দিতে গেলে রাত কাবার হবে। সে গল্প করে লাভ নেই। যুগের হাওয়া বদলে গেছে। সেসব গল্প এখন পুরোনে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের পথে। এখনকার মানুষ সচেতন, নিজ অধিকার সম্পর্কে সোচ্চার। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার দিন শেষ। তবে দেশের সকল সেক্টর এখনো দূর্নীতি মুক্ত হয়ে ওঠেনি। একসময় মানুষ উন্নত দেশের চেয়ে দূর্নীতি মুক্ত একটা বাংলাদেশের স্বপ্ন বেশী দেখতো। সে স্বপ্ন এখন পূরণের পথে। সেই দিন আর দূরে নেই যেদিন এই দেশ যোগ্য লোকের শাসনে নিজের যোগ্যতায়, শিক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে৷
এক সময় দেশের পোশাক খাত রপ্তানির শীর্ষে অবস্থান করেছিলো। কৌশলগত কিছু ভুল সিদ্ধান্তে সে স্থান হারাতে বসেছিলো দেশ। টেন্ডার বানিজ্য, এলসি ওপেনিংএ ব্যাংকি জটিলতা, চাঁদাবাজি, সহ এমন নানান জটিলতায় এ খাতের ব্যবসায়ীরা হুমকির মুখে পরেছিলো। এসকল বিষয় সামনে রেখে বেশ কিছু চ্যালেন্জ রয়েছে মীরার। তবে পূর্ববর্তীর করা ভুল থেকে শিক্ষা নিতে চায় মীরা। সকালের সাথে প্রভু-প্রজা সম্পর্ক না, করতে চায় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। যেখানে প্রত্যকের মতামত সমান ভাবে ভেবে দেখা হবে। তাহলেই তাদের সমস্যা গুলোকে সমাধান করতে পারবে। মীরা এসব চ্যালেন্জ মাথায় রেখেই পরবর্তী কর্মপন্থা সাজিয়েছে।
সে প্ল্যানের প্রথম কাজ হিসাবে মীরা জয়ী হওয়ার পর দেখা করেছে ওর পূর্বসূরির সাথে। কথা বলেছেন খোলাখুলি, যেন ওদের মধ্যে কোন শত্রুতা কোনদিনই ছিলো না।আশফাকুজ্জামান শাকিল মীরার আগমন প্রত্যশা করেননি। তবুও মীরা তার সাথে দেখা করেছে, বিনয়ের সাথে অভিজ্ঞ হিসেবে পরামর্শ এবং সহযোগীতা চেয়েছেন তার কাছে। এমন ঘটনা সচরাচর দেখা যায় না। মীরা তার সাথে সাক্ষাৎ এর সময় বলেছে- আপনার সাথে আমার কোন ব্যাক্তিগত শত্রুতা নেই। ক্ষমতার পালাবদল নতুন কিছু না, তবে প্রতিপক্ষকে শত্রু ভাবার মতো বোকা আমি নই। প্রতিহিংসার মনোভাব কখনোই দেশ ও দশের উন্নয়ন করতে পারে না। ব্লেইম গেইমের শেষ এখানেই হোক৷
আশফাকুজ্জামান শাকিল ঠান্ডা গলায় বললো-
: “আমি কোন গেইম খেলি নি, তুমিই বলো তুমি কি এ পদের যোগ্য? ”
মীরা আত্নবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বলে-
: “আপনি নিজেই কিন্তু এ স্বপ্নটা দেখেছিলেন একদিন। পার্থক্য শুধু তখন আমাকে অনুগ্রহ করতেন, এখন আমি নিজের যোগ্যতায় এ পদে বসেছি। আপনিই তো চেয়েছিলেন আমি এ আসনে অধিষ্ঠিত হই। এখন বলুন আপনি আপনার মামনিকে দোয়া করবেন না?”
আশফাকুজ্জামান শাকিল কেমন চিন্তিত হয়ে পরলেন। মীরা তাকে ভাবনার মধ্যে ডুবিয়ে রেখে ই বললো-
: “আগামীকাল আমি সভাপতি হিসেবে অফিসিয়ালি দায়িত্ব গ্রহণ করবো। আমি আপনার দোয়া চাই ”
আশফাকুজ্জামান শাকিল কেমন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো মীরার এমন কথায়। তার মনের পাথর যেন গলতে শুরু করলো মীরার এমন আচরণে।
শত্রু বশীকরণে বেশ আগে থেকেই মীরা যে সিদ্ধ হস্ত।
এ আর নতুন কি। দিন শেষে একটু শান্তিতে থাকতে মীরার এ চেষ্টা ।
তার সাথে সাক্ষাৎ শেষে অফিসে ফিরলে সেক্রেটারি নাদিম বলে-
: “ম্যাডাম আমি আপনার জন্য নিজে কালার হয়ে গেলাম, আর আপনি গিয়ে দোয়া চেয়ে আসলেন? দিস ইজ নট ফেয়ার ”
রিভলভিং চেয়ারটায় হেলান দিয়ে মীরা বলে-
: ” তার কাছে দোয়া,সহযোগিতা চেয়েছি কিন্তু তাকে তার অন্যায়ের শাস্তি দিতে আমার কোন সাহায্য দরকার হলে আমি তা করবো না তা তো বলিনি”
সময় কাওকে ক্ষমা করে না নাদিম। তাকে শাস্তি দেয়ার আমি কেউ না, তবে ন্যায়ের পক্ষে থাকতে পিছুপা হবো না আমি।
সম্পর্ক উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতায় ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম সপ্তাহেই সকল ব্যাবসায়ীদের সাথে কুশল বিনিময়ের জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন মীরা৷
যথাসময়ে সেই সভা অনুষ্ঠিত হয়। পোশাক খাতে বর্তমান চ্যালেন্জের বিষয়ে আলাপ হয়, আলাপ হয় এ খাতের সম্ভাবনা নিয়েও। ব্যাবসায়িক সুষ্ঠু পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে কি কি প্রতিকূলতা পাড়ি দিতে হয় সে বিষয়েও জানায় ব্যবসায়ীরা। মীরা সকলকে অনুরোধ করে সমস্যা আর চ্যালেন্জ গুলোকে লিখিতভাবে জমা করতে। তাতে করে এসব বিশ্লেষণ করার সুযোগ থাকবে। সবশেষে মীরা এখানে নতুন হওয়ায় সকলের পরামর্শ এবং সহযোগীর আহ্বান করে।
উক্ত সভায় মীরার বিনি পয়সায় কেনা শত্রু মিলন ও ছিলো। সভায় একেবারে পিছনে বসেছিলো ও। যাতে ওকে না দেখায়। একসময়কার সহকর্মী, একসাথে যারা বিভিন্ন কনফারেন্সে যোগ দিতো তাদের অনেকের সাথে দেখা হলো। তবে এত মানুষের মাঝে মিলনের নিজেকে আড়াল করার ব্যাপারটা মীরার চোখ এড়ায় নি। অপর দিকের সারিতে বসা ফ্লোরাও উসখুস করছে। ফ্লোরাকে মনে আছে আপনাদের?
ঐ যে গত কনফারেন্সে মীরাকে ছোট করতে চাওয়া উদ্যোক্তা মেয়েটা। ফ্লোরা যেন ঠিক মীরাকে এখানে মানতে পারছে না।
সভা ভাঙলে মীরা তার সেক্রেটারিকে দিয়ে মিলনকে ডেকে পাঠায়। সভা শেষে অনেকেই মীরার সাথে পার্সোনালি পরিচিত হতে এগিয়ে আসে৷ এদের মধ্যে রয়েছে ফ্লোরাও। ও নিজ থেকে এসে ক্ষমা চায় মীরার কাছে ঐদিনকার আপত্তিকর কথাবার্তার জন্য। মীরা ওকে হাগ করে বলে তুমি এসেছো আমি খুশি হয়েছি। আর ঐসব আমি কবে ভুলে গেছি। তুমিও ভুলে যাও বলে মীরা বাকীদের সাথে কুশল বিনিময় করে এগিয়ে যায় মিলনের দিকে।
মিলন বেচারা যেন গুটিয়ে গেছে ভেতর থেকে। ওকে এখন দেখে মনে হচ্ছে মাথা শরীরে ঢুকে গেছে। এমন ধাক্কা বোধহয় বেচারা জীবণেও খায় নি। কাছে দিয়ে মীরা একটা হাসি হেসে বলে-
: “কেমন বোধ করছেন মিলন ভাই”
মিলন মীরার দিকে চেয়েই চোখ নামিয়ে নিলো। যেন মীরা কোন দৃপ্তিমান সূর্য যার দিকে খলি চোখে তাকানে যায় না।
স্মিত হেসে মীরা বললো-
: “আপনাকে ধন্যবাদ”
বলে কিছু সময় মৌন থেকে মীরা আবারো বললো-
: “কেন জানেন? ” আপনারা জোট বেঁধে আমাকে টেনে নামাতে এতটা উদ্ধত না হলে আজ হয়তো এখানে থাকতে পারতাম না আমি ”
এবার মিলন কিছু একটা বলবার তাগিদ অনুভব করলো। মাথা অবনত রেখে ক্ষিণক্ষিনে গলায় বললো-
: “আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি খুবই দুঃখিত ”
: “ঠিক কোন কোন কারনে আপনি দুঃখিত মিলন ভাই?
আমার সংসার ভাঙার জন্য?
আমাকে ধ্বংস করার জন্য? নাকি
শেষ পর্যন্ত সায়নের সাথে যুক্ত হয়ে একটা নিরপরাধ মানুষকে এসবের মধ্যে জড়ানোর জন্য?
ক্ষণকালের বিরতির পর মীরা বলে-
: ” এক কাজ করুন মিলন ভাই, আপনি বরং নিজের কাছেই ক্ষমা চান। একটা অসহায় মেয়েকে টেনে নিচে নামানোর খেলা খেলতে খেলতে আপনি আপনার মনুষ্যত্ব খুইয়ে ফেলেছেন”
অসহায় চোখে তাকায় মিলন মীরার দিকে। আবারো ক্ষণকালের বিরতির নামে হল ঘরটায়। বেশ কিছু পর মীরা বলে-
: “আমার সাথে করা একের পর এক অন্যায়ের জন্য আপনাকে কঠিন শাস্তি দিবো আমি”
কথাটা শুনে চমকে যায় মিলন। কারন সত্যি সে ক্ষমতা মীরার এখন আছে। মুচকি হেসে মীরা বলে-
: “এমন শাস্তি দিবো যেন আপনি আমাকে ভুলতেও ভুলে যান”
মাথা নত করে রাখে মিলন। চোখ বন্ধ করে ভবাতে থাকে মীরার প্রতি ওর করা ভুলের আমলনামা।
মীরা নিজের কন্ঠে কোমলতা এনে বলে-
: ” আমার অনেক কিছু করবার যুক্তিসঙ্গত কারন এবং ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম, আপনি ভালো থাকবেন ”
বলেই ঘুরে হাঁটা দিতে নেয় মীরা। অস্ফুটে মিলন মীরাকে উদ্দেশ্য করে বলে-
: “আপনার কথা আমার মনে থাকবে মীরা”
ঘুরে মীরা মিলনের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি হাসে। তারপর বেরিয়ে যায় সভাস্থল থেকে। মীরা চলে যাবার পরও মিলন আনমনে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে অনেকটা সময়। সেখানকার স্টাফ ক্লিনিং এর জন্য এসে দেখে একটা ভাঙাচোরা, বিপর্যস্ত মনের লোক আনমনে দাঁড়িয়ে আছে।
চলবে…
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৯২
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
কাজকর্মে ডুবে আছে যেন মীরা। নিজের ব্যবসা, নতুন দায়িত্ব, মেয়ের স্কুল ভর্তির প্রস্তুতির তদারকি সবকিছু মিলিয়ে নিঃশ্বাস নেয়ার সময় নেই যেন ওর। অন্যদিকে
আবীরের ও খোঁজখবর নিতে হয় সময়ে সময়ে। মীরা আর আবীরের বেশীরভাগ কথাবার্তাই হয় টেক্সটে।কথা বলে জেনেছে পা’টার ইনফেকশন সেরেছে অনেকটা। হাঁটতে পারছে এখন আবীর।
সারা সপ্তাহ কাজে ব্যাস্ত থাকলেও শুক্রবারটা সময় পেলে যেতে চেষ্টা করে মীরা আবীরের পুরান ঢাকার বাড়িতে। গত শুক্রবার নূহা যেতো বায়না ধরায় যাওয়া হয়ে উঠেনি ঐদিকটায়। এসব শুনে আবীর অবশ্য বলেছিলো ওকে নিয়ে আসতে, কিন্তু মীরা কি এক অজানা কারনে নূহাকে নেয়না আবীরের বাড়িতে। এখন পর্যন্ত আবীর অনেকবার নূহাকে দেখতে চেয়েও সামনাসামনি দেখতে পারেনি নূহাকে।
মায়ের বাড়িতে মীরা-ইরা দু’বোন বেড়াতে যাওয়ার সময় একদিন ওদের মা জাহানারা আবীরকে দেখতে যাওয়ার সময় নিজ থেকে চেয়েছিলেন নূহাকে আবীরদের বাড়ি নিয়ে যেতে। কিন্তু মীরা নূহাকে যেতে দেয় নি। বেড়াতে না যেতে পেরে নূহার সে কি কান্না! বিরক্ত হয়ে ইরা জিজ্ঞেস করেছিলো-
: “সমস্যা কোথায় ঐ বাড়িতে গেলে? বাচ্চা মানুষ কিভাবে কাঁদছে… ”
মীরা তখন ইরার প্রশ্নের কোন উত্তর দেয় নি। তবে রাতে ইরা শান্ত ভবে মীরাকে প্রশ্নটা আবার জিজ্ঞেস করলে মীরা ইরার চোখে চেয়ে ঠান্ডা গলায় বলে-
: “নূহা যদি জিজ্ঞেস করে আবীর কে? কি উত্তর দিবো আমি? বলবো যে আবীর তোমার আঙ্কেল? ”
বলেই উঠে সেখান থেকে নিজের ঘরে চলে যায় মীরা। ইরা ওর বোনের এই অর্ধেক কথার আগামাথা কিছুই না বুঝলেও বোন যে রেগে গেছে তা ঠিক বুঝে যায় ইরা, তাই ব্যাপারটা চেপে যায় ও।
কিন্তু মীরা মায়ের বাড়িত ওদের ঘরে এসে মনে মনে আওড়াতে থাকে “আরেহ্ শেষ পর্যন্ত আবীর যদি কন্ভেন্স হয় তাহলে? একবার বলবো আবীর তোমার আঙ্কেল হন, আরেকবার বলবো তোমার বাবা হন” এসব স্টুপিডিটির কোন মানে হয়। তাছাড়া নূহা যে ইঁচরে পাকা, ওকে যা না বলা হয় তাই বের করে ফেলে আর এসব….। সবকিছু সমাধানের সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায় নি, এত সহজে ওকে ছেড়ে দিবো আমি? ” যেন কথাগুলো মনে মনে বলছে না মীরা, জবাবদিহি করছে কাল্পনিক ইরার সাথে। সে রাতটা ওরা আড্ডায়, গল্পে ওর মায়ের বাড়িতেই কাটালো।
পরেরদিন খুব সকালে মীরার ঘুম ভাঙে। দিনটা রৌদ্রজ্জ্বল হলেও শুরু হয় একটা খারাপ খবর শুনে। ওর ফ্যাক্টরির ম্যানেজার ফাহাদ খুব সকালে কল করেছে ওকে, এত সকালে ফোন করার জন্য ক্ষমা চেয়ে ও-ই মীরাকে দিলো খবরটা। আর খবরটা হচ্ছে – “পিংক ক্লোজেট” ফ্যাক্টরির মালিক “মিলন মাহমুদ ” আ*ত্ন*হ*ত্যা করেছেন। খবরটা শুনে মীরা কেমন তব্দা খেয়ে যায়। বলে কি? নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না যেন মীরা৷ বারবার মনে হচ্ছে ভুল শুনছে ও। কিংবা ইনফরমেশনে কোন গড়মিল রয়েছে। নামে নামে তো কত বিভ্রট হয় দুনিয়ায়৷ লোকটা ওর শত্রু তবুও তারতাজা একটা মানুষ এমনি হুট করে?
মীরা ফাহাদের কল রেখে কল করে মুনিয়া আপুকে। মুনিয়া আপু “রিদম অফ লাইফ” গ্রুপের চেয়ারম্যান। তিনি জানান গত রাতেই তিনি খবরটা পেয়েছেন। তিনি জানালেন – মিলন সাহেবের স্ত্রী তার বাবার বাড়িতে ছিলেন। দুই দিন পর বাড়ি ফিরে দেখেন এ অবস্থা। এ কাজটা তিনি কখন করেছেন তা জানে না কেও। গত দুইদিন ধরে তিনি করো ফোন রিসিভ করছিলো না। পো*স্ট*ম*র্টে*ম করলে হয়তো মৃত্যুর আসল রহস্য জানা যাবে। পুলিশ তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে গেছে।
এদিকে সন্দেহজনক কিছু না পাওয়ায় পুলিশ মিলনের স্ত্রীকে আটকের পরদিনই ছেড়ে দেন। খবরটা পেয়ে মেয়েটার সাথে মীরা দেখা করতে যাবে যাবে করেও ব্যাস্ততায় যেতে পারে না। তবে দিন যত পার হতে থাকলো মৃ*ত্যু সংক্রান্ত কথাবার্তা ততো জানা গেলো চারপাশ থেকে। মীরার এক সময়কার সহকর্মী নিলুফার আপা গতকাল মীরাকে ফোন করে বললেন- কিছুদিন যাবৎ মিলন নাকি অপ্রকৃতস্থের মতো ছিলো। কাজকর্ম বাদ দিয়ে বাসায়ই থাকতে সারাক্ষণ। কি যেন ভাবতো আনমনে”
মীরা তখন তাকে বললো-
: “স্বামীকে এমন অবস্থায় ফেলে মহিলা বাবার বাড়ি কেন গেলেন? না গেলেই কি হতো না?”
নিলুফা আপা বললেন-
: আরে বৌটার বাবা অসুস্থ, এখন যায় তখন যায় অবস্থা। তাই বাধ্য হয়ে গিয়েছিলো বাবার বাড়ি। তা কি আর কাছেপিঠে? সেই নেত্রকোনা, আসলে ওর ম*র*ন এভাবেই লেখা ছিলো, তা নাহলে….
এরপর নানান চিন্তায় মীরার দুটো দিন কেটে যায়। কেন জানি নিজেকে অপরাধী মনে হয় মিলনের এই দূর্ঘটনার জন্য। খুব খারাপ লাগতে থাকে মিলনের স্ত্রী ইভার জন্য। দোনোমোনো করেও অবশেষে মীরা দেখা করতে যায় মিলনের স্ত্রী ইভার সাথে। সম্পর্কের বর্তমান পরিস্থিতি যা-ই হোক ওরা পূর্বপরিচিত৷ এবং মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক ছিলো এককালে। কিন্তু মাঝখানে রাজীব, মিলন৷ লোভ, লালসা আর কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সম্পর্কটাকে নষ্ট করে দিয়েছে। সব ভুলে মীরা সেখানে গিয়েছিলো মানবতার কারনে।
মীরা সে বাড়িতে গেলে দরজা খোলে মিলনের স্ত্রী ইভা। অনিন্দ্য সুন্দরী ইভার সৌন্দর্য মীরার চেয়ে কম না। দুজনের পার্থক্য কেবল উচ্চতায়। মীরা বাঙালি মেয়েদের গড় উচ্চতার চেয়েও লম্বা। পাঁচ ফুট সাত, আর ইভা পাঁচ ফুট এক কি দুই হবে।
মীরাকে দেখে আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসলে ইভা। যেন মীরা ওর আপন কেউ আর মীরা যে আজ আসবে তার অপেক্ষায়ই ও বসেছিলো এতক্ষণ।
বসার ঘরটায় বসলো মীরা, ইভা নাশতা এনে মেহমানের মতো আপ্যায়ন করলো। এরপর মীরাই আলাপ শুরু করলো। ইভা কাছের লোকের মতো সবটা খুলে বললো মীরাকে। কিছুদিন ধরে মিলনের কথাবার্তা, চালচলনে অসংলগ্নতা, ওর বাবার হঠাৎ অসুস্থ হওয়া, হুট করে ওকে রেখেই বাড়ি যাওয়া, ওকে ফোনে না পাওয়া, পরদিন ঢাকায় ফিরে এসে এসব দেখা সব।
এরপর ওদের দু’জনের কথাবার্তা হলো আরো অনেক সময় ধরে । মীরা বললো কম, শুনলোই বেশী। কঠিন মনের মীরা যতটা ভঙ্গুর ভেবে স্বান্তনা দিতে এসেছিলো ইভাকে ততটাই ভঙ্গুর হয়ে ফিরলো ও সেখান থেকে। ইভার মধ্যে কোন দুঃখ, শোক তাপ কিছুই ছিলো না।
ওকে দেখে মনে হচ্ছে ও এখনো বুঝতেই পারে নি কি হয়ে গেছে ওর জীবণে। মিলন আর যাই হোক স্ত্রীকে ভালোবাসতো। তবে ইভার সাথে কথা বলে এতদিনে আজ মীরা উত্তর পেয়েছে –
মিলন কেন ওকে এত অপছন্দ করতো?
মিলন কেন রাজিবকে উচ্ছন্নে পৌছে দিয়ে ওদের সংসার ভেঙেছিলো?
কেন মীরার অসহায়ত্ব দেখাই মিলনের এক মাত্র ইচ্ছে ছিলো?
কেন ওকে টেনে পথে নামাতে মরিয়া ছিলো মিলন?
দুই-দুটো দিন ঘোরের মধ্যে থাকে মীরা এসব। নিজের সৌন্দর্য নিয়ে যার এতদিন গর্ব হতো সেই সৌন্দর্যের প্রতি ঘৃণা হতে শুরু করলো ওর। ঐ প্রশ্নের উত্তর গুলো ভাবতেই অনেক অসহায়বোধ করে মীরা। খুব করে মনে হয় সত্যি একজন মানুষ যত সফলই হোক একা জীবণ পাড়ি দিতে পারে না। মনের কথা বলার জন্য হলেও একজন মানুষ চাই তার।
আবীরের কথা খুব মনে পরে ওর। শুক্রবার হতে আরো দুইদিন বাকী৷ টুকটাক কথা হলেও প্রায় পনেরো দিন হতে চললো দেখা হয়না দুজনের। এদিকে কত কাজ জমে আছে ওর দুদিন বাড়িতে থাকার কারনে। এখনি ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে মীরার। দরকার পরলে ঘেরাটোপে থাকা কথা গুলোকে সরাসরি বলবে ও আবীরের কাছে – “আপনার কাছে আমি একটু ভরসার আশ্রয় চাই, আমার আপনাকে বড্ড প্রয়োজন”
সারাদিন কাজে ব্যাস্ত থাকলেও ডুবে থাকে ঐ ভাবনায়। দিনশেষে মন খুলে কথা বলার একজনের,
একটা নিরাপদ আশ্রয়ের। ঘড়ির কাটার মতো সময়টাকে যদি টেনে নিতে পারতো কিংবা কাস্টমাইজড করতে পারতো ফোনের তারিখ সেটিংস এর মতো, কত্ত ভালো হতো!
অবশেষে কাঙ্খিত দিনটি এসে উপস্থিত মীরার জীবণের দোরগোড়ায়। মনে চাপা উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষায় ছিলো ও এই দিনটার। আজ একটা কিছু হবেই হবে। হয় এপাড় নায় ওপাড়। এমনি দোদুল্যমান রাখবে না ও আর দুজনের সম্পর্কটাকে। আজ ও আবীরের সম্মতি আদায় করে আনবেই আনবে।
মাজেদা খালা নূহাকে নিয়ে ওর মায়ের বাড়ি গেছে সকাল সকাল। ওর একটা কাজ আছে বলে তাদের পাঠিয়েছে মীরা।
তাদের বিদায় দিয়ে আলমারী খুলে লেভেন্ডার রঙের একটা সুতি শাড়ি বের করে ও। সাথে সাদা ব্লাউজ। কোন সাজসজ্জার ধার ধারে না ও। সুন্দর করে শাড়িটা পরে নেয়। মীরা ওর অবাধ্য চুল গুলোকে সোজা সীঁথি করে খোঁপা করে নেয়। চোখে কাজল আর ঠোঁটে হালকা কালারের লিপস্টিক দেয় ও। কপালে ছোট্ট কালো টিপ পরে ও সাজসজ্জার সমাপ্তি ঘটায় ও। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে জুতার কাবার্ড থেকে স্লিপার একজোড়া স্যান্ডেল পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে পরে মীরা।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে রিকাশায় বসে দুজনের কথোপকথন কল্পনা করতে থাকে ও। কি বলবে? কিভাবে বলবে তার মহড়া চলে মনে মনে। এসব ভাবতেই একটু পরে পর হাসছে ও। কৈশরে প্রেমে পরার অনুভূতির মতো একটা অনুভূতি তোলপাড় করে দিচ্ছে ওর ভিতরটাকে৷ অথচ এই লোকটাকে ও ত্যাগ করেছিলো একদিন।
এসব ভাবনায় ডুবতে ভাসতে ও পৌঁছে গেলো ওদের বাড়ির কাছে। রিকশার ড্রাইভারকে গলির ডিরেকশন বলে দিয়ে ফোনের স্ক্রিনে চুল, টিপ চেক করলো ও।
বাড়ির কাছে পৌঁছে ভাড়া মিটিয়ে নেমে পরলো ও। বাড়ির ভিতরে ঢুকে চোখ বুলালো গাছ, পাতা, আঙিনা আর টানা বারান্দাটা। সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উঠলো দোতলায়৷ প্রিয় সেই লোকটা কয়েক মূহুর্তের তফাৎ এ বসে আছে। কেমন চমকে যাবে ও মীরাকে দেখে। এসব ভাবতেই বসার ঘরের দিকে যায় মীরা। সোবহান চাচার মুখোমুখি হয় মীরা সেখানে যাবার আগেই। মীরাকে দেখে তিনি ভীষণ চমকে যান। ব্যাস্ত ভঙ্গিতে বলেন-
: “মামনি আপনে?”
: “এত চমকে যাচ্ছেন কেন চাচা, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি ভূত দেখছেন, আপনার চাচাকে খবর দেন, বলেন আমি আসছি”
সোবাহান চাচা অবাক ভঙ্গিতে বলে-
: “আবীর চাচায় আপনেরে বলে নাই কিছু?”
মীরা হাস্যজ্জ্বল ভঙ্গিতে বলে-
: “কি বলবে”
: “হেয় তো চিটাগাং গেছে আজ নয় দিন চললো, আপনে কিছু জানেন না?”
কথাটা শুনে মীরার পৃথিবী যেন দুলতে শুরু করলো। মনে মনে বললো- “কিহ্ আবীর ঢাকা ছেড়েছে আজ নয় দিন!? ”
চলবে…..