প্রিয় ভুল পর্ব-৮৫+৮৬+৮৭+৮৮

0
441

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৮৫
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

দীর্ঘ একুশ দিন কাজকর্ম সবকিছু ছেড়ে একটানা হাসপাতালে ছিলো মীরা। যদিও ওর থাকাটা এত সহজ ছিলো না, ওর চাচীরা প্রথমে ওকে এলাউ করে নি। একটা অচেনা অজানা মেয়ে। ও যে আবীরের স্ত্রী ছিলো তা জানতেন না। তারা তাই মীরাকে চিনতে পারেনি। পরে মীরার মা জাহানারা বলেন –

: “দেখুন আমরা ওদের প্রতিবেশী ছিলাম। ওদের পরিবারের সাথে আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো। আবীর আমার নিজের ছেলের মতো”

পরে ফিওনা তাদের থাকার পারমিশন দেয়ায় তারা মেনে নেয় তাদের থাকার ব্যাপারটা। তবে এ মেনে নেয়াটাতেও তাদের একটা গোপন উদ্দেশ্য ছিলো। আবীর ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি, আর তাদের ঘর সংসার, ছেলেমেয়ে পরে আছে চট্টগ্রামে”, আর এমন ধরনের চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার৷ ঘর সংসার ছেড়ে এত দীর্ঘ সময় এখানে পরে থাকা তাদের সম্ভব না। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতেও পারছে না।

আবীরকে ভর্তি করার ১ম দিনে বুকের জ*খ*মের অপারেশন হয়। রক্তের প্রয়োজন পরে চার ব্যাগ। ফোন করে দুই ঘন্টার মধ্যে রক্ত জোগাড় করে মীরা। নানান জায়গা থেকে এদেরকে এক করতে বিশাল হ্যাপা পোহাতে হয় ওকে। যদিও মার্কেটের অনেকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছে মীরাকে। তারা চট্টগ্রামের মানুষ এখানে পরিচিত কেউ না থাকায় এ ব্যাপারে কিছুই করার ছিলো না আবীরের দুই চাচার। এই এক ব্যাপারেই মীরার অবস্থান শক্ত হয়ে যায় তাদের কাছে।

দ্বিতীয় দিনেও যখন আবীরের জ্ঞান ফিরলো না তখন তারা নড়েচড়ে বসলেন। এখানে থাকতে এলাউ না করা অচেনা মেয়ের প্রতি ব্যাবহারের সুর হঠাৎ বদলে গেলো তাদের। আবীরের বড় চাচী ইনিয়ে বিনিয়ে জাহানারাকে বললেন তার স্বামীর সামনে ইলেকশন এ সময় বাড়িতে কত লোকজন আসে, তার এখন বাড়িতে থাকা কতটা জরুরি। আর ছোট চাচী বললেন তার মেয়ের সামনে এইচএসসি পরীক্ষা, ছেলেমেয়ে তো এমনিতেই ফাঁকিবাজ। শেষ সময়ের প্রস্তুতি খারাপ হলে রেজাল্টেও প্রভাব পরবে৷ এসব কথার বাহানায় তারা অচেতন আবীরকে একা মীরা আর জাহানারার হেফাজতে রেখে সত্যি সত্যি চট্টগ্রাম ফিরে যায় শুধুমাত্র তাদের বাড়ির কাজের ছেলে বিপুলকে হসপিটালে রেখে। তাদের অজুহাত ছিলো শক্ত আর মীরার জন্য তাদের এসব অজুহাত ছিলো ব্লেসিং। তারা থাকলে হয়তো আবীরের কাছেই ঘেঁষতে পারতো না মীরা।

তারা চলে যাবার পর হাসপাতালের কেবিনটাকেই নিজের ঘর বানায় মীরা। সারাদিন হসপিটালে থাকে, আর রাতে ওর মা থাকে আবীরের কাছে থাকে।

এমনিতেই একজন রোগীর সাথে দুজন লোক থাকা লাগে। তবে আবীরের দাদা বাড়ির কাজের ছেলে বিপুল নিতান্তই ছোট ষোল-সতেরো বছর বয়স। ওকে দিয়ে ঔষধ পত্র কেনা যায় কিন্তু দীর্ঘ দেহী আবীরকে যখন স্ট্রেচারে তুলে এক্সরে রুমে কিংবা টেস্ট করাতে এদিক-সেদিক নিতে হয় তখন মীরা আর বিপুলের পক্ষে তা সম্ভব হয় না। যেদিন কোন টেস্ট কিংবা পরীক্ষা করানোর থাকতো সেদিন মীরা আগেভাগেই ফাহাদকে ডেকে পাঠাতো।

হাসপিটালের পুরো জার্নিতে ফিওনা অল টাইম কানেক্টেড ছিলো মীরার সাথে। ও নতুন একটা পরিবেশে গিয়েছে মাত্র কিছু দিন হলো। বেবী ডেলিভারির ডেটও নিকটবর্তী। তবুও দেশে আসতে চেয়েছে ও ভাইয়ের এ অবস্থা দেখে। তবে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ অবস্থায় ওকে আসতে নিষেধ করলো মীরা। যদিও মীরা ফিওনার অসুস্থতার চেয়ে বেশী জোড় দিয়েছে বর্তমান পরিস্থিতিতে ওর দেশে না আসার গুরুত্বতে । বুঝিয়েছে যে ও যদি এখন ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য দেশে আসে তাহলে মীরার উপস্থিত অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে। ফিওনা মীরার কথাগুলো বুঝতে পেরে দেশে আসার ব্যাপারটা স্থগিত করে। তবে ওর বুক ফেটে যায় ভাইয়ের এমন দূরাবস্থা দেখে।

মীরা ওকে শান্ত করে, ভরসা দেয় পরিস্থিতি যাই হোক আবীরের এ অবস্থায় ওর পাশে থাকার। প্রতিনিয়ত আপডেট জানায় আবীরের শরীরের অবস্থার।

টানা দুটো দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে মীরা। তারা সকলেই যে সত্যি সত্যি এ অবস্থায় ওকে ফেলে চলে যাবে তা প্রথমটায় বিশ্বাস করে নি। ভেবেছিলো বড়দের কেউ অন্ততঃ থাকবে। পুরোটা সময় একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো মীরা। সাথে অনিশ্চয়তা ও ছিলো ওর বাঁচা ম*রা নিয়ে। একটা চাপা অস্বস্থিকর অপরাধবোধ কুড়ে কুড়ে খেয়েছে ওকে।

অবশেষে তিনদিন পর জ্ঞান ফিরে আবীরের। কিন্তু জ্ঞান ফিরার পর আবীরের মীরাকে দেখে হজম করাটা কষ্টের ছিলো ৷ জ্ঞান ফিরার পর মীরাকে পাশে দেখে চোখমুখ কেমন হয়ে যায় আবীরের। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় ও মীরার থেকে। যেন ওকে দেখবে বলে আশা করে নি।

কথা বলার শক্তি না থাকলে কি হবে তেজ ছিলো তার টইটম্বুর। আবীরের মীরাকে দেখে বিপুলকে ক্ষীণ কন্ঠে বলা প্রথম কথাটা ছিলো-

: “ও এখানে কেন?”

এটুকু কথা বলতেই সব শক্তি খরচ হয়ে গেলো যেন ওর। মুখ খানা সাধ্যমতন শক্ত করে বিপুলকে জিজ্ঞেস করে –
: “ফোন কোথায় আমার?”

ফোনটা ওর হাতে দেয় বিপুল। বাম হাতে ব্যান্ডেজ। কিরকম একটা লোহা দিয়ে সোজা করে রাখা হাতটা। পায়ের হাড়ে রড দিয়ে টানা দেয়া। এক হাত দিয়ে ফোনটা ধরতে গিয়েও ফেলে দেয় আবীর। এমন সময় জাহানারা আসে কেবিনে। এখন মীরার বাড়ি ফিরার সময় হয়েছে। দিশেহারা মীরা মাকে দেখে যেন দিশা পেলো। ওর সজ্ঞানে আসাতে যতটা উৎফুল্ল হয়েছিলো, ততোটাই মুষড়ে পরেছিলো ওর দৃষ্টি সরিয়ে নেয়াতে। মাকে কেবিনে ঢুকতে দেখে তরিঘরি করে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো মীরা কেবিন থেকে।

জাহানারা হাসিমুখে কাঁধের ব্যাগটা রেখে বিপুলের উদ্দেশ্যে বললো-

: “জ্ঞান ফিরলো কখন”

বিপুল আবীরের এমন আচরন আর মীরার তৎক্ষণাৎ কেবিন ত্যাগে ভ্যাবাচেকা খেয়ে উত্তর দিতে ভুলে গেলো। তিনি বোরকা খুললেন, তারপর আবীরের মাথার কাছে বসে ওর মাথায় হাত রাখে জিজ্ঞেস করেন –

: “কেমন আছো বাবা?”

জোড়াতালি মৃদু হেসে ভালো থাকার উত্তরটা দেয় আবীর। জাহানারা সস্নেহে আবীরের চুলে হাত বুলিয়ে বলে-

: “তিনদিন পর তোমার জ্ঞান ফিরলো, জমে-মানুষে টানাটানি এর আগে আমি কখনো দেখিনি বাবা। তোমার চাচাতো কিছু করার সুযোগই দিলেন না আমাকে, হুট করে চলে গেলেন”

: “আপনারা অনেক কষ্ট করলেন…” যন্ত্রণায় আবীর অস্ফুট স্বরে বলা কথাটা শেষ করতে পারে না।

জাহানারা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন-

: “কোন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য আমরা এখানে আসিনি বাবা। তোমার মা আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলেন, সে পরিচয়ে আমারা এখানে এসেছি। তোমার মা আমাদের সকল দুঃসময়ে আমাদের পাশে ছিলেন, আজ ও নেই, তাই তোমার এমন দুঃসময়ে পাশে থাকার তাগিদ অনুভব করছি বাবা ”

অস্ফুট স্বরে আবীর বলে-

: “কোন কৈফিয়ত চাইনি আমি চাচী, আপনি থাকুন কিন্তু ও যেন…” কথাটা শেষ করতে পারেনা ও। অনভ্যস্ততায় হাত নড়ে ব্যাথা অনুভূত হয় ওর। ব্যাথার যন্ত্রণায় চোখমুখ কুঁচকে যায় ওর। জাহানারা ওর হাতটা সোজা করে দেন।

হসপিটালের সেই রাতটা কোন মতে কাটে ওর। পরদিন সকাল হতেই আবীর কল করে ওদের ঢাকার বাড়ির দেখাশোনা করা সোবাহান চাচাকে। দুপুরের দিকে তিনি হসপিটালে এলে আবীর তাকে একটা লোক ঠিক করে দিতে বলেন, দিনের বেলায় এখানে থাকার জন্য। অথচ মীরা ওকে দেখাশোনা করার জন্য অপর প্রান্তের সোফায় বসে আছে তীর্থের কাকের মতো। এরকম পরিস্থিতিতে ও একটা জলজ্যান্ত মানুষকে কত সুন্দর উপেক্ষা করছে আবীর। মীরা যেন নো-বডি। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর এই উপেক্ষা করাটা নির্বিকার দেখে মীরা। মীরা যে নো-বডি আবীরের কাছে তার প্রমাণ এসব কথাবার্তা।

অথচ ওর চাচীরা চট্টগ্রাম ফিরে যাবার পর অচেতন আবীরের পাশে বসে পুরো একটা রাত কটিয়ে দিয়েছে মীরা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওর যন্ত্রণা কাতর মুখ দেখেছে। হাত দেখেছে, চোখ দেখেছে, চুল দেখেছে, আসীম মমতায় ওর মাথার চুলে হাত বুলিয়েছে। ডান হাতটা ধরে কেঁদেছে আবীরের এমন অসহায় অবস্থা দেখে। মীরার কেবলি মনে হয়েছে আজকের এ পরিস্থিতির জন্য ও-ই একা দায়ী। ওর প্রতি সায়নের থাকা সব ঘৃণা, নিরপরাধ আবীরের বুকে উপর্যুপরি ছু*রিকাঘা*তে ঝড়ে পরেছে। আবীর যদি তা জানতে পারে? কখনো কি ক্ষমা করবে? এ মীরাই যে ওর জীবণের সকল যন্ত্রণার উৎস্য। নিজেকে অনেক অপরাধী মনে হয় মীরার, আবীর যেন ওকে বলছে- “Why me?

এত বছর গ্রামে থাকা সোবাহান চাচা তার পরিচিত এক মহিলাকে এনে দিয়েছিলেন আবীরের দেখাশোনা করতে। জাহানারা নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু আবীর তাকে অনুরোধ করে এ বিষয়ে নিষেধ না করতে।

ভদ্রমহিলার নাম জরিনা, বয়স পঞ্চাশ কি পঞ্চান্ন এর মধ্যে হবে। হাড়জিরজিরে শরীর, রোগীর চেয়েও বেশী রোগী দেখায় তাকে৷ দিনরাত পান চাবান আর যখন তখন ধুমসে ঘুমান। কাজের কাজ একটাই করেন, আবীরের ফুটফরমাশ খাটা, ঔষধ, খাবার নিয়ম করে খাওয়ানো।

আবীরের উগ্র আচরণ, মীরা থাকার পরও ওর সেবার জন্য নতুন লোক নিয়োগ সত্যেও মীরা কিন্তু কেবিন ছাড়ে না, ও ঠিকই থেকে যায়। সারা সারা দিন হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি ছাড়া করার কিছু না পেয়ে কেবিনের সোফায় বসে নতুন ড্রেসের ডিজাইন করে মীরা। এতে যদি আবীরের অগ্রাহ্যতা ভুলতে পারে কিছুটা।

আবীরের জ্ঞান ফিরার পর কাজ ফুরায় মীরার, ডাক্তার এলে ওর বর্তমান পরিস্থিতির আপডেট দেয়া, রিপোর্ট সময়মত বুঝে এনে চেক করানো, আবীরের খাবার ঔষধ সব রেডি করে জরিনা খালার হাতে দেয়া। এই ওর কাজ পুরো দিনে। না একটা কথা না একটু দৃষ্টির বিনিময়, কোনটাই হয় না দুজনের মধ্যে।

আর জরিনা খালা ধরফর করে ঘুম থেকে উঠে তৈয়র ডালে বাগার দেয়ার মতো আবীরকে সময় মতো খাবার আর ঔষধ পরিবেশন করে। এত কিছুর পরও মীরা এখানে থেকে যাওয়ায় আবীরের চোখেমুখে টানা বিরক্তি দেখে মীরার এক-আধবার মনে হয়ে বেরিয়ে যায় এখান থেকে। কিন্তু পরোক্ষনেই মন শান্ত করে, বেচারার এ অবস্থার জন্য ওই দায়ী এটা ভেবে।

অবশেষে একুশ দিনের চিকিৎসা শেষে ডাক্তাররা রিলিজ দেয় ওকে। বুকের কাছে যে ক্ষতের জন্য চট্টগ্রামের চিকিৎসকেরা ইমিডিয়েট ঢাকায় পাঠিয়েছিলো আবীরকে তা সহজেই সেরে গেছে এন্টিবায়োটিক এর ফুল ডোজে। চা*কুর উপর্যুপরি আঘাতে জ*খ*ম*টা মারাত্মক ছিলো, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে জ্ঞান হারিয়েছিলো ও। কয়েক ব্যাগ রক্ত ওকে দিতে হয়েছিলো ওকে। অপারেশনের পরও টানা তিনদিন সেন্স লেস ছিলো ও। ডাক্তাররা বলেছেন : “হৃদপিণ্ডের খুব কাছ থেকে ঘেঁষে গেছে চাকুটা, একটুর জন্য হৃদপিণ্ডে ক্ষত হয় নি, পেশেন্টের লাক ভালো যে বাই এয়ারে করে সময় মতো হসপিটালে তাকে আনা হয়েছে, তা নাহলে রোগীকে বাঁচানোই মুশকিল হতো। ইশ্বর তাকে দ্বিতীয় জীবণ উপহার দিয়েছেন”

সত্যি এ যাত্রায় বেঁচে গেলো আবীর। তবে বা হাতের একটা হার ভেঙে গিয়েছিলো ওর, পায়ের হাড়েও ফাটল ছিলো, সেটা জোড়া নিতেই সময় লাগবে আরো৷ ডাক্তার ঔষধ গুলো নিয়মিত নিতে বলেছে আর অতি-প্রয়োজন ছাড়া হাঁটাহাটি নিষিধ করেছে।

দীর্ঘ একুশ দিনের চিকিৎসা শেষে নিজ বাড়ি ফিরছে আবীর। হসপিটাল থেকে জাহানারা তার বাড়িতে নিতে চেয়েছিলো আবীরকে। এতদূর থেকে ওকে দেখাশোনার জন্য আসা যাওয়াটা তার শরীরের জন্য ভারী হয়ে যাবে। কিন্তু আবীর বলেছে –

: “তার দরকার নেই চাচী, অনেক করলেন আপনি, আপনার এ ঋণ শোধ করবার না”

জরিনা খালা অস্ফুটে বলে – “হাসপাতালে রাইতে আর কাম কি, সব কাম তো দিনের বেলা। হেয় আইয়্যা তো খালি ঘুমাইছে, দৌড়াদৌড়ি সব তো ঐ আফায় করছে”

জরিনা খালার এ কথা শুনে চোখ কটমট করে তাকায় আবীর তার দিকে, এসব দেখে তিনি চোখ ফিরিয়ে নেন। জাহানারা ওর বিছানাপত্র রেখে চলে যান, মীরা বলে-

: ” ইরার মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিবে, তুমি ইরার বাসায় যাও মা, খালাকে ঔষধ গুলো বুঝিয়ে দিয়ে আমি একটু পরে আসছি”

জাহানারা বেরিয়ে গেলে মীরা খালাকে নিয়ে বাড়িঘরের ধুলো পরিষ্কার করে। আবীরের যাতায়াতের কোন সমস্যা যাতে না হয় সে অনুযায়ী আসবাবপত্র গোছগাছ করে।

সব কিছুর গুছগাছ করতে বিকেল হয়ে এলে খালাকে পাঠায় বাইরে থেকে খাবার আনতে। খালা জানান খাবারের ব্যাবস্থা না থাকায় বাইরে থেকে খাবার আনিয়েছে আবীর। মীরা বের হওয়ার আগে তাকে বললেন-
: “তাহলে উনাকে খাবার খাইয়ে বিকেলের ঔষধ দিয়ে দিয়েন, আমি যাই”

এদিকে ও বেসিনে মুখ ধুয়ে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পরে। দুপুর পেরিয়ে গেছে সেই কখন, সকালেও তারাহুরোয় কিছু খেয়ে আসেনি ও। গেইট আটকাতে সোবাহান চাচাকে ডাকলে তিনি এসে বলেন-

: “আন্টি, আবীর চাচায় আপনারে ডাকছে”

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না মীরা, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ও চাচার দিকে৷ কথাটা বলে বাইরে চলে যান তিনি কি যেন কিনতে। মীরা মনে মনে ভাবে- “আবীর ওকে ডাকছে!”

অপমান করে তাড়িয়ে দিতে কি? নাকি
আর যেন না আসে মীরা এ বাড়িতে এটা বলতে?

মীরা মৃদু হাসে, এসব ওর পাওনা, মনে মনে ভাবে মীরা আবীর বলার আগে ও নিজেই বলে দিবে- “চিন্তা নেই আমি আর কখনো আসবে না এ বাড়িতে….”

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৮৬
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

সব কিছুর গুছগাছ করতে বিকেল হয়ে এলে খালাকে পাঠায় বাইরে থেকে খাবার আনতে। খালা জানান খাবারের ব্যাবস্থা না থাকায় বাইরে থেকে খাবার আনিয়েছে আবীর। মীরা বের হওয়ার আগে তাকে বললেন-

: “তাহলে উনাকে খাবার খাইয়ে বিকেলের ঔষধ দিয়ে দিয়েন, আমি যাই”

এদিকে ও বেসিনে মুখ ধুয়ে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পরে। দুপুর পেরিয়ে গেছে সেই কখন, সকালেও তারাহুরোয় কিছু খেয়ে আসেনি ও। গেইট আটকাতে সোবাহান চাচাকে ডাকলে তিনি এসে বলেন-

: “আন্টি, আবীর চাচায় আপনারে ডাকছে”

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না মীরা, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ও চাচার দিকে৷ কথাটা বলে বাইরে চলে যান তিনি কি যেন কিনতে। মীরা মনে মনে ভাবে- “আবীর ওকে ডাকছে!”

অপমান করে তাড়িয়ে দিতে কি? নাকি

আর যেন না আসে মীরা এ বাড়িতে এটা বলতে?

মীরা মৃদু হাসে, এসব ওর পাওনা, মনে মনে ভাবে মীরা আবীর বলার আগে ও নিজেই বলে দিবে- “চিন্তা নেই আমি আর কখনো আসবে না এ বাড়িতে….”

কিছুটা সময় নিলো ও ধাতস্থ হতে তারপর পা থেকে কেডস জোড়া খুলে ধীর পায়ে গেলো ভিতরের দিকে। মেইন ফটক হতে আবীরের ঘরের দূরত্ব বড়জোর পঞ্চাশ ফুট হবে, তবুও ওর মনে হলো অনন্তকাল ধরে ও হাঁটছে আবীরের কাছে পৌঁছানোর জন্য। অবশেষে ওর ঘরের দরজার কাছে পৌঁছে থমকে দাঁড়ালো ও, এই পৃথিবীতে মীরা কোন মানুষের পরেয়া করে না,

একমাত্র এই মানুষটার কাছে নিজেকে এত ছোট মনে হয়, ও মেনেই নিয়েছে এ লোকটার কাছে ও নো-বডি।

ঠিক যেন আবীর মহাজন আর মীরা ঋণগ্রস্থ প্রজা।

কিছুক্ষণ পর দীর্ঘ শ্বাস চেপে ঘরে ঢুকে মীরা, দেখে আবীর টি-টেবিলে খাবার নিয়ে পা ঝুলিয়ে খাটে বসে পানি ঢালছে গ্লাসে, একটা গ্লাস ভরা আরেকটা ভরছে। মীরাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই টি টেবিলের প্লেটটা অপর দিকে ঠেলে দিতে দিতে বলে-

: “বসো এখানে ”

দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রণ করছে আবীর মীরাকে! শান্ত, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। যেন প্রায়ই একসাথে খপতে বসে ওরা।

মীরা আচ্ছন্নের মতো তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। যেন আবীর কি বলছে ও বুঝতে পারছে না। মীরাকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবীর মাথা উঁচু করে ওর দিকে তাকিয়ে বলে –

: “বসো, এত কাজ করলে না খেয়ে কোথায় যাচ্ছো? ”

মীরা তখনো দাঁড়িয়ে। আবীর ওর দিকে তাকিয়েছে, ওকে ওর সামনে বসতে বলছে, দুপুরে খেয়ে যেতে বলছে এটা বিশ্বাসই হচ্ছে না ওর। আবীরের দিকে দৃষ্টি রেখেই টি-টেবিলের বিপরীতে রাখা চেয়ারটাতে আজ্ঞাবহের মতো বসে মীরা। আর কোন ভুল করতে চায় না মীরা ওকে নিজের করে পাওয়ার পথে।

মীরার দিকে থাকা প্লেটে ভাত বেড়ে, নিজের প্লেটটাও টেনে নেয় আবীর। মাথা নিচু করে কাঁদছে মীরা, আবীরের ওর দিকে তাকানো, ওর সাথে সামান্য কয়েকটা কথা বলা ওর মনে কি অনাবিল শান্তির ফোয়ারা বইয়ে দিচ্ছে, তা ভাষায় বর্ননা করা ওর সাধ্যের বাইরে। ওর মনে হচ্ছে এ মুহূর্তে ও যদি ম*রে যায় ওর কোন আফসোস থাকবে না জীবনের প্রতি। যদিও এ ভাবনাটা খুব ছেলেমানুষী শোনাচ্ছে, কিন্তু এটাই সত্য।

আবীর স্বাভাবিক ভাবেই খাবার খাচ্ছে। একটা হাত ভাঙা তাই অন্য এক হাতেই ভরসা হওয়ায় তালগোল পাকিয়ে ফেলছে আবীর। মীরা প্লেট সামনে রেখে মাথা নিচু করে কাঁদছে। ব্যাপারটা খেয়াল করে আবীর রূঢ় গলায় বলে-

: “এই মেয়ে, কাঁদছো কেন তুমি? ”

মীরা হাতের উল্টোদিকে চোখ মুছে, এটা ওর ছোটবেলার অভ্যাস। ওর হাতের উল্টোদিক দিয়ে চোখ মোছা দেখে হেসে দেয় আবীর। দ্রুত সেটা গোপনও করে সামনে বসা মীরার কাছ থেকে। তারপর বলে-

: ” খাবার সামনে নিয়ে কাঁদতে হয় না”

একটু সাহস সঞ্চিত করে মীরা বলে-

: ” জীবণে কান্না অবিচ্ছেদ্য যার তার খাবার সময়ই কি আর ঘুমের সময়ই কি? ”

চোখ তুলে তাকায় আবীর মীরার দিকে। মীরার দৃষ্টি তখন প্লেটের দিকে, সবজি দিয়ে ভাত মাখাচ্ছে ও।

এরপর পিনপতন নীরবতা ঘরজুড়ে। পানির গ্লাস নিতে নিয়ে সেটা হাত ফসকে পরে গেলো আবীরের হাত থেকে। কাঁচের ঝনঝন শব্দ ঘরটার গুমোট ভাব কাটিয়ে দিলো। মীরা দ্রুত প্লেট নামিয়ে বললো-

: “আমি দেখছি আপনি বসুন”

বলে কাঁচের টুকরো গুলো সাবধানে তুললো। সেগুলো সরিয়ে হাত ধুয়ে আবার খেতে বসলো মীরা। আবীরের এক হাত এখনো জোড়া লাগেনি পুরোপুরি। তাই এক হাতেই সব করতে হচ্ছে ওকে। মীরাকে বিব্রত না করতে পানি খাওয়া স্থগিত রাখে আবীর, কারন ওর এখন পানি খেতে হলে নিজে খেতে পারবে না, কারুর সাহায্য নিতে হবে। আর কাছেপিঠে মীরা ছাড়া দ্বিতীয় কেও নেই। এ অস্বস্তিটা ও মীরাকে দিতে চায় না ।

খাওয়া শেষ করে বসে আছে আবীর, মীরার ক্ষুধা মরে গেছে, কোনমতে খাওয়া শেষ করে ও। আবীর উঠে হাত ধুতে উঠতেই যাবে এমন সময় মীরা বলে-

: ” হাত ধুতে উঠতে হবে না, আমি…. ”

আবীর ব্যাস্ত ভঙ্গিতে বলে-

: “না বসো তুমি, খাওয়া শেষ করো আমি পারবো যেতে”

বলেই আবীর উঠতে গিয়েই চোট পেলো হাতে। ও কারো সাহায্য না নিয়ে এখন চলতে পারে না। মীরা প্লেট নিচে রেখে বলে-

: “সবসময় জিদ করা ঠিক না”

বলেই রান্নাঘরে যায় ও হাত ধোয়ার জন্য পাত্র আনতে। আবীর মনে মনে বলে-

:”জিদ করলাম কই? একটু পরে আমাকে যে একলা করে চলে যাবে তুমি তখন তো সব একাই করা লাগবে…”

মীরার আনা সে পাত্রে হাত ধোয় আবীর। মীরা দ্রুত খাওয়া শেষ করে টি-টেবিলের সব কিছু সরিয়ে নেয়।

এবার ওকে যেতে হবে। খালাকে ডেকে ঔষধ পত্র সবকিছু খালাকে বুঝিয়ে দেয় ও। এন্টিবায়োটিক ঔষধ যেন কোন ভাবেই মিস না হয় তাও বার বার বলে দেয় ও। খালা ভাবলেশহীন ভাবে বলে-

: “পানের বাডা এখন রাইখা, একটু বাদেই ভুইল্লা যাই, আমি এতকিছু কেমনে মনে রাখমু? ”

মীরা জানে তার ব্যাপার, তাই বললো-

: “অন্ততঃ ঔষধ খাওয়ার কথাটা মনে করিয়ে দিতে পারবেন তো? ”

খালা পান খেয়ে লাল করা দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলেন – ” হ, তা পারমু”

মীরা চাচাকে – আবীরের জন্য ডাক্তারের সাজেস্ট করে দেয়া ব্যায়াম, দুবার হাঁটানো এসব তাকে বুঝিয়ে দেন। সবকিছু দেখিয়ে দিয়ে মীরা ভদ্রতাসূচক আবীরের কাছ থেকে বিদায় নিতে যায়, মাথা নিচু করে বলে-

: “আমি যাই তাহলে, ভালো থাকবেন”

ঘর বসে মীরা কথা সব শুনেছে আবীর এতক্ষণ ধরে, মীরা বিদায় নিতে ঘরে ঢুকলে জানালার দিকে দৃষ্টি রেখে ও মীরাকে প্রশ্ন করে –

: “কেন তুমি আর আসবে না এ বাড়িতে? ”

কি উত্তর দিবে মীরা এ প্রশ্নের?

কোন উত্তর না পেয়ে আবীর মৌন কন্ঠে বললো-

: “তোমার সাথে অনেক হিসেব আছে আমার, আর যেহেতু আসবে না সেগুলো এখনি করে ফেলা ভালো হবে৷ বসো তুমি। নাকি কোন তাড়া আছে?”

শেষের প্রশ্নটা আবীর ট্রিক করে বললো। মীরা যদি এসব থেকে পালাতে চায় তাহলে ওকে এখান থেকে চলে যাওয়ার স্কোপ করে দিলো ও।

কিন্তু মীরা ওকে অবাক করে দিয়ে ব্যাগটা টি-টেবিলে রেখে ধীর ভাবে বসলো। কিছুটা সময় নিয়ে আবীর বললো-

: “সত্যি আর আসবে না?”

মাথা তুলে তাকায় মীরা আবীরের দিকে, মনে মনে বলে- আমি সারাজীবনের জন্য আসতে চাই, নিন না আপন করে”। মীরা তাকাতেই চোখ সরিয়ে নেয় আবীর, কেমন একটা সংকোচ কাজ করে ওর।

: ” দেখলে তো?

আমি কত লাইফ-লেস একটা মানুষ। জীবন-মৃ*ত্যুর সন্ধিক্ষণে পাশে দাঁড়াবার ও কেউ নেই আমার। তোমারা না থাকলে আমার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরাটা এত সহজ হতো না। ধন্যবাদ আমার এত বাজে ব্যাবহারের পরও শেষ পর্যন্ত আমার পাশে থাকার জন্য”

মীরা এখনো ওর দিকেই তাকানো নির্বিকার ভাবে। ও যেন আরো কিছু শুনতে চাচ্ছে আবীরের কাছে। তারপর ক্ষীণ কন্ঠে বললো-

: “করলাম আর কই? আমাকে তো কিছু করার সুযোগই দেন-নি আপনি”

মুচকি হাসে আবীর মীরার কথা শুনে৷ মীরা মাথা নীচু রেখেই আঁড়চোখে দেখে আবীরের নদীর মতো শান্ত হাসি। মনে মনে বলে-

“সর্বনাশ, এ ছেলের হাসি এত সুন্দর? ”

হাসি মুছে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবীর বলে-

: “আমি জানি এটা তোমার বিনয়, ডাক্তার নার্স সবাই বলেছে আমার সুস্থতায় তোমার ভূমিকা কতটুকু। আমি আমার বিহেভিয়ার এর জন্য সরি”

: “আমি কিছুই মনে করি নি, এরচে বেশী আমার প্রাপ্য”

: ” ঐসব কথা থাক, তুমি ভালো থাকো

এই দোয়া করি”

এবার আবীরের চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মীরা বলে-

: ” সত্যি আপনি চান আমি ভালো থাকি?”

কেমন অস্বস্তিতে পরে যায় আবীর। নিজের হাতের আঙুল খুঁটছে ও, মীরা তাই দেখছে চেয়ে। ওর মনের ভিতরকার দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয় এতে।

তারপর ঘর জুড়ে নিরবতাদের দখল। দুজনেই অনেক কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না হয়তো। ঘরের ভিতরের এ অস্বস্থি কাটানোর দায়িত্ব নিলো মীরা। উঠে দাঁড়িয়ে বললো-

: “আসি তাহলে…”

আবীর মীরার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো। এই প্রথম আবীর একটানা মীরার চোখে তাকিয়ে রইলো। এবার আর সংকোচ, লজ্জা, বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো না যেন নিরব থেকেই চোখ দিয়ে বলতে চাইছে অব্যাক্ত কথা। মীরাও আসি বলে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ম্লান একটা হাসি হেসে বেরিয়ে গেলো মীরা। আবীর চেয়ে কেবল ওর চলে যাওয়া দেখলো। কেমন একটা কষ্ট বুকের ভিতরে পাক দিয়ে উঠলো৷

সোবাহান চাচা রুমে এসে বললো –

: “মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো কেন?”

: ” ভবিষ্যতে যেন না কাঁদতে হয় তাই”

কথাটা বলে খুব সাবধানে শুয়ে পরলো আবীর। চাচা সবকিছু ঠিক জায়গায় রেখে বেরুতেই আবীর চাচাকে বললো যাওয়ার আগে লাইটটা বন্ধ করে দিতে৷ চাচা বললো-

: “সন্ধ্যা বেলা ঘর অন্ধকার রাখতে হয় না”

কাপালে হাত রেখে চোখ ঢেকে রাখা অবস্থায় আবীর বললো-

: “অন্ধকার যার জীবনের পাড়ায় পাড়ায় তার সন্ধ্যাই কি আর রাতই কি?”

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে লাইট বন্ধ করে বেরিয়ে গেলো সোবাহান চাচা। তিনি যাবার পরই আবীর ওর কপালের উপরে রাখা হাত সরিয়ে বোবা কান্নার জল গুলো মুছলো। মনে মনে বললো-

: “তুমি ভালো থাকো মীরা” অতীতেও চেয়েছি, আজও চাই, সারাজীবন এটাই চাইবো। আমার মতো পঙ্গু, সহায়সম্বলহীন লোকের সাথে গাঁট ছাড়া কেন বাঁধবে তুমি। কত সুন্দর ভবিষ্যৎ সামনে পরে রয়েছে তোমার। আজ আবীর বুঝতে পারলো- “ভালোবাসা মানে কেবল নিজের করে পাওয়ার জন্য আঁকড়ে ধরা না, কখনো কখনো নিঃস্বার্থ ভাবে মুক্ত করে দেওয়া”

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৮৭
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

আবীরের বাসা থেকে বের হয়ে সোজা ইরার বাসায় যায় মীরা। কান্নায় আছড়ে পরে বোনের বুকে। ইরা স্তম্ভিত, শেষ পর্যন্ত আবীর ওকে ফিরিয়ে দিবে তা ভাবতে পারেনি ও। ইরা চুপ থেকে বোনকে কাঁদতে দিয়েছে। কাঁদুক ও, কেঁদে মনের ভার হালকা করুক। ইরা সেদিন বোনকে ওর কাছেই রেখেছে। মুরসালীন গিয়ে নূহা আর মাজেদা খালাকে নিয়ে এসেছে। রাতে ফোন করেছে আবীরকে। আবীর ইরার ফোন রিসিভ করে নি। এতে আবীরের উপর চরমভাবে ক্ষেপেছিল ইরা। এত দেমাগ কেন লোকটার? ভুল একটা হয়েছে, বুঝতে পেরে সে ভুল স্বীকার করে তা সংশোধন করতে আবীরের জীবনের একজন হতে চেয়েছে। মীরার জন্য কি ছেলের অভাব হবে দেশে?

সেদিন রাতটা থেকে পরদিনই নিজ বাড়িতে চলে গেছে মীরা৷ বুকে পাথর বেঁধে ফিরেছে স্বাভাবিক ব্যাস্ততা মূখোর জীবণে। জীবণের সকল ঝড়ের মতো এবারেও সামলে উঠেছে মীরা, তবে কোথায় যেন একটা গভীর ক্ষত রয়ে গেছে বুকের ভিতরে । যে ক্ষত দেখ যায় না, কিন্তু অনেক যন্ত্রণার উদ্রেক করে মনে।

মীরার মা প্রথম প্রথম প্রতিদিন একবার করে দেখতে যেতো আবীরকে। পরে আবীর কিছুটা সুস্থ হলে তাকে প্রতিদিন এত কষ্ট করে এতদূর আসতে নিষেধ করে। জাহানারা এখন প্রতিদিন না গেলেও ফোনে খোঁজ নেয় নিয়মিত। ধীরে ধীরে সবাই যার যার জীবণে স্বাভাবিক, আবীর, মীরা, ইরা, জাহানারা।

আবীরের উপর হামলার ঐ ঘটনার বিস্তারিত বিপুলের কাছে জানার পর মীরা আবীরের অপারেশন এর পরপরই গিয়েছিলো সায়ানের কাছে। ওকে অবশ্য বাড়ি পায় নি মীরা, ওর মা বলেছে দুদিন আগে নাকি ব্যাংকক গিয়েছে ও। তার মানে ঘটনার পরদিন দেশ ছেড়েছে ও। এতে করে এ ঘটনা যে সায়নেরই কাজ তা পরিষ্কার হয় মীরার কাছে। সায়নের মা মীরাকে স্বান্তনা দিতে চাইলেও মীরা কিছু চলে গেছে সেখান থেকে। এরপর মীরা সোজা গিয়েছে সায়নের বাবার অফিসে। মীরা তাকে সব খুলে বলে তাকে, সাথে এ-ও বলে যে এ ঘটনার একটা বিহিত তাকে করতে হবে, এবং তিনি কোন দৃশ্যমান পদক্ষেপে না হলে আইনের দারস্থ হতে বাধ্য হবে ও তাও বলে মীরা।

তিনি মীরার সবটা শুনে সায়নের উপর রেগে আগুন হয়ে যান। তার সামনে ইলেকশন, এর মধ্যে এসব ঝামেলা। তিনি শান্ত হয়ে মীরাকে কথা দেন ব্যাপারটা তিনি নিজে দেখবে। মীরা তাকে সাতদিন সময় বেঁধে

দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়।

চট্টগ্রামে ঐ আতর্কিত হামলার জন্য অজ্ঞাত ব্যাক্তিকে

দায়ী করে সেখানে মামলা করে আবীরের চাচারা। এত বড় ঘটনা ঘটে গেলো, হাসপাতালেও থাকতে পারলো না কেও, মামলাটা করে তারা তাদের দায়িত্বের সবটুকু পালন করে ফেলেছে যেন। যদিও এসব মামলা করতে নিষেধ করেছিলো আবীর। কারন এ ঘটনার সাথে মীরাও জড়িত, এতে করে মীরার সমস্যা হতে পারে ভেবে আবীর সব জেনেও ব্যাপারটা চেপে গেছে। একটু সুস্থ হওয়ার পর চাচাকে অনুরোধ করে মামলা তুলে নিতে বলেছিলো আবীর৷ আবীরের দুই চাচা খুব হম্বিতম্বি করলো ওর এমন অনুরোধে। বাড়ি বয়ে এসে এত বড় ঘটনা ঘটিয়ে যাবে, আর তারা বসে থাকবে? সাথে এও বলে কার ঘাড়ে কয়টা মাথা তা তারা দেখে নিবে।

সত্যি বলতে আবীরের চাচারা এ ঘটনাটাকে বিরোধীদলীয় লোকেদের কার্যকলাপ বলে পাবলিক সেন্টিমেন্ট তাদের দলের পক্ষে নিতে চাইছিলো। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আবীর খুব কষ্ট পায়, সবাই সবার স্বার্থ নিয়ে ব্যাস্ত৷ এদিকে অসুস্থ আবীরকে দেখার লোক নেই কিন্তু ঐদিকে এই মামলার ব্যাপারে থানায় যেয়ে এসে দিন কাটছে তাদের।

সত্যি কত্ত অসহায় আবীর!

আবীর এখন দেয়াল ধরে ধরে একা হাঁটার চেষ্টা করছে। বুকের ক্ষত পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে। হাতের হাড় জোড়া ধরেছে।পায়ের হাড় জোড়া নিতেই সময় লাগছে। শরীরের সব ভর বহন করে কিনা তাই তাকে বশ মানাতে সময় লাগছে আবীরের। তবুও হাল ছাড়ে না আবীর। চেষ্টা চালিয়েই যায়। নিয়ম করে দু’বেলা হাঁটে ও।

এদিকে মীরার এলসি সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যাংকে যায় মীরা। যাবতীয় কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকলেও সমস্যা কেন হচ্ছে তা জানতে চায় ও। তার এর কোন সদুত্তর দিতে পারেন নি। ঐদিন মীরা ব্যাংকে থাকা অবস্থায়ই ব্যাংক ম্যানেজারের কেবিনে একজন লোক আসে। ম্যানেজার বসা থেকে দাঁড়িয়ে তেলতেলে গলায় বসতে বলেন তাকে। পাশে তাকিয়ে মীরা দেখে লোকটা আর কউ নয় রাজিবের বন্ধু মিলন।

মীরাকে দেখে কেমন একটা হাসি হাসে মিলন, সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে উঠে দাড়ায় মীরা তখনই নিচু গালায় মিলন বলে-

: “শুনলাম ঢাকা থেকে লোক চট্টগ্রামে গিয়ে তোমার স্বামী, আইমিন তোমার প্রথম স্বামীর উপর নাকি এ্যাটাক করেছে? ”

অগ্নিদৃষ্টি চেয়ে থাকে মীরা মিলনের দিকে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে- “আপনিও আছেন এসবের মধ্যে ?”

ক্রুর হাসি হেসে মিলন বলে-

: “তুমি বলেছিলে না আমাকে তোমার মনে থাকবে, আমি তো সেই ব্যাবস্থাই করছি” কথাটা শুনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে মীরা মিলনের দিকে, তারপর আর এক মূহুর্তও দাঁড়ায় না মীরা। চেয়ারে রাখা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পরে সেখান থেকে।

সেখান থেকে বের হতেই ফাহাদের কল আসে ওর ফোনে। ফাহাদ মীরাকে জলদি কারখানায় আসতে বলে। মীরা কল কেটে আচ্ছন্নের মতো রিকশায় করে কারখানার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়৷ ফাহাদ না বললেও ওর কন্ঠস্বর খারাপ কিছুর আভাস দিচ্ছে ওকে। কারন ইদানীং ওর বাইরের প্রোডাক্ট সেলিং বিজনেসটা ভালো চললেও ম্যানুফ্যাকচারিং বিজনেসটা ডাল যাচ্ছে। এলসি সমস্যার জন্য সময়মতো মালামাল আনতে পারছে না বাইরে থেকে, তারজন্য দেশ থেকেই বেশী দামে কিনতে হয়েছে কাঁচামাল, রয়েছে তৈরী মালামাল বায়ারদের কাছে পৌঁছানোর অনিশ্চয়তাও সবকিছু মিলিয়ে মীরা দিশেহারা যেন।

কারখানায় পৌঁছে মীরা জানলো ওদের সুইজারল্যান্ড ইউরোপের স্বনামধন্য একটা কম্পানি যা ওদের কারখানার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ডিল ছিলো সেটা ক্যান্সেল হয়ে গিয়েছে। মাথায় বাজ পরে মীরার। এই কাজটার জন্য স্পেসিফিক কাপড় রিলে রিলে কিনে স্টক করেছে ওদের কারখানার স্টোর রুম, বাসার অফিসঘর সহ দুটো রুমে। এমনকি মীরার বাসার ডাইনিং ও দখল সেই কাপড়ের রিলে।

তৎক্ষনাৎ মীরা কল করে ঐ কাজ যার মাধ্যমে পেয়েছিলো তাকে। আনোয়ার সাহেব জানান পার পিস মাত্র ২৫ পয়সা রেটের পার্থক্যে কাজটা হাতবদল হয়ে গেছে।

মীরা রাগারাগি করে বলে দেখেন ব্যাপারটা ২৫ পয়সার না, ব্যাপারটা ভরসার, বিশ্বাসের। এত কম টাকার পার্থক্য এ যাবৎকালে আমি দেখি নি। অফিসিয়ালি কাজটা আমি পেয়েছি, এটা তো আমারই করার কথা। লোকটা রাগান্বিত কন্ঠে বলে-

: “টেন্ডারের কাজটা আমি পেয়েছিলাম মীরা, আমি যেখানে কম পাবো সেখান থেকেই করাবো, তুমি দেখছো ২৫ পয়সা, আর আমি এটাকে গুন করছি ৭ ডিজিটের সংখ্যা দিয়ে”

মীরা শান্ত গলায় বলে-

: “পার পিছ ২৫ পয়সা লাভ করে কত আয় হবে আপনার? আমার স্টক করা মালামালের দাম তারচে বেশী এবং কাজটা না পেলে ক্ষতির অংকটা দাঁড়াবে তারচেয়েও বেশী”

: “দেখো মীরা আমার এতকিছু বোঝার দরকার নাই, তুমি কাজটা পাচ্ছো না এটাই ফাইনাল ”

: “আমি ৩০ পয়সা কম নিবো আমার দেয়া রেটের থেকে, কাজটা আপনি আমাকেই দিন”

: “মীরা তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে, আশাকরি বুঝবে ব্যাবসার অনেক কিছু আমাদের হাতের বাইরে থাকে। ৩০ পয়সা কেন, অর্ধেক কম মজুরিতেও কাজটা পাবে না তুমি, বাকীটা বুঝে নিও, আর আমাকে ভুল বুঝো না”

বলেই কলটা কেটে দেয় আনোয়ার, মাথায় বাজ পরে যেন মীরার। এই কাপড় গুলো ও স্পেসিফিক এই কাজটার জন্য কিনেছিলো। এই এত এত জার্সি কাপড় দিয়ে মীরা কি করবে? ওর নিজের কারখানার কাজও লেডিস ড্রেস নিয়ে সেখানে এসব কাপড়?

আর কত পরীক্ষা নিলে খোদার পরীক্ষা নেয়া শেষ হবে

ভাবতেই চোখ ফেটে পানি পরে ওর। কোনকিছু না বলেই বাড়ি ফিরে যায় ও। বাসায় ফিরে দেখে নূহা মাজেদা খালার সাথে মেঝেতে বসে পান খাচ্ছে। ওকে অসময়ে দেখে ভড়কে গেলো নূহা। কারন নূহাকে এসব চা-পান খেতে মীরা নিষেধ করে দিয়েছে আরো আগে থেকে। নূহা খুব বুদ্ধিমতী কন্যা মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাকে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো নিজের দোষ ঢাকতে। ব্যাপারটা বুঝেও হজম করলো মীরা। ভিতরকার কষ্ট দূর করতে জড়িয়ে ধরলো মেয়েকে আষ্টেপৃষ্টে। চোখ ভেঙে পানি বেরুলো ওর। জীবণে সবকিছু পেয়ে এভাবে যখন নষ্টই হবে তবে কেন এলো এসব আমার জীবণে? মনে মনে ভাবে ও।

মেয়ের কাঁধে গরম পানির স্রোত বয়ে যাওয়ায় মেয়ে মীরাকে ছেড়ে বলে-

: “মা, তুমি দুঃখ পেয়েছো? আমি আর পান চাইবো না মাজেদা আপার থেকে, তুমি আমাকে মাফ করে দাও মা”

মীরা মেয়ের কপালে চুমু আঁকে, তারপর নূহাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে থাকে কিছুক্ষণ। মাজেদা খালা অপরাধী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে দূরে। মীরা মেয়েকে কোলে করে নিজের ঘরে চলে যায়। যাওয়ার আগে মীরা খালাকে বলে-

: “এসব ওকে দিয়েন না খালা”

মাজেদা খালা এতক্ষণ ভয়ে ছিলো মীরার কথাটা অস্বাভাবিক ঠেকলো তাঁর কাছে৷ তারচে বরং সবসময়ের মতো রাগারাগি করলে বোধহয় শান্তি লাগতো তার। সবকিছু ভুলে বিকেলে মায়ের বাসায় যায় মীরা। ইরাও আসবে আজ। খাওয়া দাওয়ার পর ব্যাবসার বিষয়ে আলাপ করতেই ইরা বলে-

: “ওরা তোকে একা পেয়ে এমন নাচনটা নাচাচ্ছে, ভেবেছে মেয়ের বাপ নেই, বড় ভাই নেই, স্বামী নেই এর সাথে যা খুশি করা যায়। আজ যে কাজটা আনোয়ার করলো তা নিঃসন্দেহে অন্যায়। কিন্তু প্রতিবাদ করার জন্য মীরার একার কন্ঠ এত লোকের ভীড়ে ক্ষীণ শোনাবে। মুখলেস চাচা অসুস্থ হপয়ায় তাকেও এসব জানাতে চায় না মীরা। অনেক তো করলো লোকটা না চাইতেই। আর জ্বালাতন করতে চায় না ও তাকে।

মীরা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চায়ের কেটলির দিকে, তারপর বলে-

: ” আমি আমার অনিবার্য পতন দেখতে পাচ্ছি ইরা, সাইড বিজনেস না থাকলে আমি এতদিনে 0 হয়ে যেতাম৷ নদীতে থেকে পানি নিয়ে সমুদ্রে ঢেলছি। যতই ঢালছি অদৃশ্য হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে তা লবণাক্ত পানির ভীড়ে। আমি এখন কি করবো বল? সব টাকা এই কাপড় কেনায় ইনভেস্ট করেছি আমি এখন শূন্য”

: “বিপদে সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে শান্ত থাকা, মাথা ঠান্ডা রাখ, আল্লাহ নিশ্চয়ই একটা ব্যাবস্থা করে দিবেন”

মীরা কাপ হাতে তখনো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তুর্কি সিরামিকের সাদা নীল বাহারী কাজ করা কেটলির দিকে।

সেদিন বেশ কিছু বিষয়ে নিয়ে কথা হয় মীরার ইরার সাথে, নূহার কথা বলার ধরন, বাজে অঙ্গ ভাঙ্গি, চা-পান খাওয়া লক্ষ্য করে মীরা। সবটা শিনে ইরা বলে

এতদিন নূহা ছোট ছিলো এখন ও বড় হচ্ছে, তার মানে এই না যে মাজেদা খালার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।

নূহাকে নিজে সময় দেয়ার পরামর্শ দেয় ইরা। মীরাও এমনটাই ভাবছিলো যে নূহাকে আর পুরোপুরি মাজেদা খালার জিম্মায় রাখা ঠিক হবে না, দুদিন পর স্কুলে যাবে এমনটা হতে দিতে থাকলে ভবিষ্যতে পস্তাতে হবে। মীরার সব কূলই তো গেলো। অন্তত মেয়েটাকে মানুষ করতে পারলে মীরার সব দুঃখ ঘুঁচে যাবে।

কথায় কথায় আবীরের প্রসঙ্গ উঠলো মীরা বললো- : “আমি কিছু শুনতে চাই না ইরা”

ইরা বলতে গিয়েও চুপ হয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ মৌণ দুজনেই, তারপর স্তব্ধতা ভেঙে মীরা বলে-

: “ইগো কি আমার কম ছিলো বল? আমার নিজেকে খুব হীন মনে হয় এ মানুষটার সামনে তার ঐ ইগোর জন্য ”

ইরা বারন সত্ত্বেও বললো-

: ” এটা তার ইগো না আপা৷ আমি কল করেছিলাম তাকে, তিনি বলেছেন –

‘তিনি সহায়সম্বলহীন, পঙ্গু মানুষ, তুই তারচেয়ে ভালো

ডিজার্ভ করিস'”

আবীর মীরার ভালো চাচ্ছে, কিন্তু মীরাকে চাচ্ছে না।

মীরা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় ইরার দিকে, একটু পর ইরা দেখলো মীরার চোখে নিচটা চিকচিক করছে, কিন্তু মীরার তাতে লুকানোর কোন চেষ্টা নেই। শেষটায় ইরাই মীরার সামনে থেকে উঠে বারান্দায় চলে গেলো। মীরা সোফাতে আর ইরা বারান্দার গ্রীলে হাত রাখা, দুই বোনেরই চোখে জল।

চলবে……

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৮৮
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

কিভাবে যেন মীরার ব্যাপারটা মোখলেস সাহেবের কান অবধি পৌঁছে যায়। তিনি ব্যাপারটা নিয়ে আনোয়ারের সাথে কথা বলেন। আনোয়ার মোখলেস সাহেবকে সমীহ করে তবে এ বিষয়ে কোন কিছু জিজ্ঞেস না করতে তাকে অনুরোধ করে তিনি। ফোন রাখার আগে তিনি মুখলেস সাহেবকে বলেন –

: “মেয়েটার সাথে এমন হচ্ছে, ভাবতেই খারাপ লাগছে কিন্তু কিছু করতে বা বলতে পারছি না, অদৃশ্য শেকলে হাত বাঁধা বলে। তবে ওকে আপনি সাবধান করে দিয়েন, সামনে ওর অনেক বিপদ”

মোখলেস সাহেব চিন্তায় পরে যান। তিনি নিজে বিছানায় পরা, তার ছেলেরাও শান্তি প্রিয় কারো কোন সাতে পাঁচে কখনোই থাকে না। এ ব্যাপারে ওরা কিছু করতে চাইলেও কেও ওদের কথা আমলে নিবে না। মেয়েটা এত কষ্ট করে এতদূর অবধি পৌঁছে আজ হেরে যাবে কিছু দুষ্ট লোকেদের বিপরীতে?

মীরাকে এসবের কিছুই বলেন না তিনি। ওর প্রতি হওয়া অন্যায়টাকে চেপে গিয়ে উল্টো ভরসা আর সাহস দেন লোকসান সামলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। লাভ লোকসান মিলিয়েই ব্যবসা, তাই তো খোদা হালাল করেছেন ব্যাবসাকে। মীরা বুঝে যে এ পথের যাত্রায় ও একা।

সেদিনই মীরা সব কাগজপত্র আর মালামাল স্টকের প্রমাণ নিয়ে সায়নের বাবার কাছে যায় এসবের সুরাহা চাইতে। তিনি এই সকল প্রতিষ্ঠানের ভালোমন্দ দেখভাল করার লোক বলে না, বরঞ্চ তিনি ওর অনিষ্টকারী সায়নের পিতা বলে। প্রথমটায় সবকিছু দেখে তিনি ব্যাপারটা দেখবেন বলে এড়িয়ে যান, আজ নাকি বিজিএমইএ এর সভাপতি নির্বাচনের মনোনয়ন পত্র সংগ্রহ করা শুরু হবে। প্রথম মনোনয়ন পত্রটা তাকেই নিতে হবে, তাই তার এতো তাড়া। কথাটা শুনে রেগে যায় মীরা, বলে-

: “আজ সবে শুরু মনোনয়ন পত্র সংগ্রহের, আরো দশ দিন সময় আছে তা সংগ্রহ করার, এমন তো না যে প্রথমটা নিলে কিছু ভোট বেশী পাবেন আপনি। আগের ব্যাপারটাও আপনি দেখছি বলে হোল্ড করে রেখেছেন, আপনি আপনার দিকটাই কেবল বুঝছেন, বুঝেছি আপনার সাথে কথা বলে কোন লাভ হবে না, আমাকে যেখানে গেলে লাভ হবে সেখানেই যেতে হবে”

মীরার এমন কথায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন তিনি। বলেন-

: “কতোবড় স্পর্ধা তোমার, তুমি জানো কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছো?”

মীরা চড়া কন্ঠে জবাব দেয় –

: “হ্যা আমি জানি, আমি বিজিএমইএ- এর সাবেক সভাপতির সামনে দাঁড়িয়ে আছি, যে তার মানসিক বিকলাঙ্গ ছেলের সকল অপকর্মের প্রশ্রয়দাতা”

মীরার রাগান্বিত মুখ দেখে তিনি তরল সুরে বলেন-

: ” বুঝতে কেন পারছো না সামনে ইলেকশন, এসব দেখাবার সময় এখন আমার নেই, আমাকে সময় দিয়ে সাহায্য করো, নির্বাচন হোক তারপর…. ” কথাটা তাকে শেষ করতে না দিয়ে মীরা বলে-

: “সাবেক সভাপতি হয়েই সময় নেই ছেলের অপকর্মের সুরাহা করবার, সভাপতি নির্বাচিত হলে যে আপনি বদলে যাবেন না তা কে জানে?”

: ”মীরা তুমি বাড়াবাড়ি করছো, আমি তোমাকে স্নেহ করি বলে এখান অবধি আসতে পারো তুমি। তা নাহলে এতক্ষণে… ”

: “ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতেন তো?”

: “ইউ ক্রস ইউর লিমিট, গেট লস্ট ফ্রম হিয়ার। আর হ্যা ঠিক ধরেছো কিছুই করবো না আমি, যা পারো করো গিয়ে”

বলেই মীরাকে তার কেবিনে রেখেই বেরিয়ে পরেন তিনি। মীরা যেন চোখে অন্ধকার দেখে। এমন শত্রুর সাথে লড়বে সে শারিরীক কিংবা আর্থিক সামর্থ্য ও ওর নেই।

বাড়ি ফিরে মীরা কেবল এসবই ভাবতে থাকে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করবে কিনা ভাবে তা-ও। কিন্তু তাদের সাথে লড়বে কিভাবে ও?

এমনি ভাবনয়া জর্জরিত মীরার কাছে পরদিন ফোন আসে জাহানারার, তিনি জানান যে এখন তিনি আবীরকে দেখতে হসপিটালে আছেন। আবীর নাকি পরে গিয়ে ভাঙা পায়েই চোট পেয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দুদিন আগে, আজ কিছুটা সুস্থ হয়ে খবরটা জানাতে ফোন করেছে নাকি ও জাহানারাকে।

মীরা মনে মনে হোয়াটস্ নেক্সট?

জাহানারা মেয়ের কথা না বুঝে জিজ্ঞেস করলো

: ” কিহ্?”

মীরা কিছু নাহ্ বলে ফোন রেখে যায়।

মায়ের ফোন রাখতেই মীরার বাসায় পুলিশ আসে, প্রথমটা ঘাবড়ে যায় মীরা৷ পুলিশ যেন ওকে ঘাবড়ে দিতেই এসেছিলো। এতদিন ধরে ব্যবসা করছে, কেউ কোনদিন ট্রেড লাইসেন্স, টিন সার্টিফিকেট দেখতে কারখানায় আসে নি, আজ সোজা ওর বাসার ঠিকায় পুলিশ এসেছে এসব দেখতে। মীরা বুঝে এসব ওকে হয়রানি করা ছাড়া কিছুই না।

সেদিন মন বিক্ষিপ্ত থাকায় কোথাও যায় না মীরা৷ পরদিন সকালে মীরা মাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে কোন হসপিটালে আছে আবীর । মায়ের সঙ্গে কথা শেষ করে বাসা থেকে বেরিয়ে মীরা আবীরকে দেখতে হসপিটালে যায়।

হাসপাতালে মীরাকে আসতে দেখে মুচকি হাসে আবীর, যার মানে হয়তো-

: ” এসেছো তুমি?”

মীরাও কোন কিছু না বলে উত্তরের বিনিময় করে হাসিতেই। একটু দূরে থাকা চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করে-

: ” হাসপাতালে কি খুব ভালো লাগে থাকতে যে আবার চলে এলেন তারাহুরো করে? ” উত্তরে আবীর স্বাভাবিক ভাবে বলে-

: “হ্যা খুব ভালো লাগে, আমার সেবার কারার একজন, খাবার খাওয়ানোর জন্য একজন, ডাক্তারের কাছে দৌড়ানোর জন্য একজন রয়েছে, এত লোক আমাকে আগলে রাখার তাই প্যাম্পারিং পিরিয়ডটা বাড়াতেই..”

: “হুম, বুঝেছি” বলে মৌণ হয়ে যায় মীরা।আসলে আবীরের যে দেখার কেউ নেই তাই যেন ওর কথায় ফুটে উঠলো করুন ভাবে।

আবীর বিষয়টা বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ এড়াতে মীরাকে জিজ্ঞেস করে –

: তারপর কি অবস্থা ব্যবসার ”

উত্তরে মীরা বলে-

: ” আমার বিগ 0 হওয়ার কাউন্টডাউন স্টার্ট হয়ে গেছে”

ব্যাপারটা শুনে কেমন চমকে উঠে যেন আবীর। তারপর বলে-

: “ব্যাপারটা কি জানতে পারি কি? ইফ ইউ হ্যাভ নো প্রবলেম ”

কোমল দৃষ্টিতে তাকায় মীরা আবীরের দিকে। তারপর একে একে সবটা খুলে বলে ওকে। পুরোটা মনোযোগ দিয়ে শোনে আবীর। মাঝখানে কোন কথা বলে না, সবটা শুনে তারপর বলে-

: “নিঃসন্দেহে ওরা পাওয়ারফুল লোক, তা না’হলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গিয়ে একজনকে এভাবে মেরে আসতে পারে? ”

এবার একটু নড়েচড়ে বসে মীরা, মীরার ডিটেইলিং এ আবীরের উপর হামলার ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে মীরা। লোকটার সামনে ও এমনিতেই নিজেকে ছোট অনুভব করে তাই ব্যাপারটা চেপে গেছে। কিন্তু হাতে নাতে ধরা পরে মীরা যেন আরো একটু গুটিয়ে গেলো নিজের মধ্যে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আবীর বললো-

: “হুম, বুঝেছি”

: ” গতকাল বাসায় পুলিশ এসেছিলো”

অবাক হয়ে আবীর জিজ্ঞেস করলো –

: “কেন?”

মীরা হেসে উত্তর দিলো-

: “ট্রেড লাইসেন্স দেখতে”

উত্তর শুনে আবীর ও হেসে দেয়, তাতে যোগ দেয় মীরাও।

: “শোন ব্যাপারটা ফানি হলেও এসব ঘটনা আদতে অন্য কিছুর ইঙ্গিত। আমার মনে হয় তোমার সামনে এখন দুটো পথ খোল-

১. ওদের কাছে ধরা সায়ী হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া, আর

২. নিজেকে ওদের চেয়ে বেশী শক্তিশালী গড়ে তোলা৷

মীরা অবাক হয়ে বলে- ১ম পথটা আমার জানা, কিন্তু ২য় পথটা অসম্ভব, আমি ফিন্যন্সিয়ালি পুরোপুরি ব্রোকেন অবস্থায় আছি, সামনের মাসে স্টাফদের বেতন কারখানা ভাড়া জোগাড়েই ঘাম বেড়িয়ে যাবে আমার।

মুচকি হেসে আবীর বলে-

: ” এত এত বিপদ দেখছো তুমি? আর আমি দেখছি একটা গ্রেট অপার্চুনিটি”

: “গ্রেট অপার্চুনিটি?”

: “ইয়েস”

মুখ তুলে আবীরের দিকে মীরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে-

: ” কি সেটা?”

: “হোয়াই আর ইউ নট পার্টিসিপেটিং ইন ইলেকশন?”

: “হোয়াট? মাথা ঠিকাছে আপনার?”

: “আপাততঃ এই পা-টা ছড়া বাকী সবই ঠিক আছে আমার”

মীরা হেসে দেয় আবীরের ফানি কথা শুনে, তারপর বলে-

: ” এই নির্বাচনে মানুষ কেন আমাকে ভোট দিবে?”

: ” সাবেক সভাপতির দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, টেন্ডার বাণিজ্য, তার ছেলের ক্ষমতার অপব্যবহার এসব সকলের জানা। মনে মনে সবাই ক্ষুব্ধ তাদের প্রতি,
তাদের এসব উইক পয়েন্ট গুলো তুলে ধরা আর তোমার সাথে করা অন্যায় হাইলাইট করলে ভোটাররা তোমার পক্ষে যাবে। আরেহ্ আমার পা ভাঙার ভুয়া ইস্যু দিয়ে বড় চাচা ইলেকশনে জিতে গেলো আর তোমার সাথে করা সত্যি অন্যায়টাকে ঢাল করে লড়তে পারবে না? সবাই সবটা জানে, বীনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি গতবারও জিতেছে, এবারও সম্ববতঃ তুমি না দাঁড়ালে বীনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাবেন তিনি”

মীরার হঠাৎ মনে পরে তার স্ত্রী বলেছিলেন -ছেলের পুত্রবধূ হওয়ার পর এই চেয়ারে মীরাকে বসাতে চান তিনি” দ্যাটস মীন মীরার মধ্যে সে কোয়ালিটি আছে”

তখনি আবীর বলে-

: “দেখো এতগুলো টাকা লোকসান খেলে, প্রতিনিয়ত ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছো তাদের দ্বারা, তোমার আর হারাবার আছে কি? নিজের ব্যবসার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তোমার শেষ চেষ্টাটা অনন্ত করো উচিত।

আবীরের চোখে তাকায় মীরা। আবীর মাথা ঝাঁকিয়ে ভরসা দেয় ওকে, যে তোমার এটা অবশ্যই করা উচিত।

মীরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে

: ” আচ্ছা আমি ভেবে দেখবো”

এরপর সন্ধ্যা হতেই আবীরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে মীরা। সন্ধ্যার পরের সময়টুকু এখন থেকে মেয়ের জন্য বরাদ্দ বলে ঠিক করেছে মীরা। তবে মেয়ের সাথে ব্যাস্ত থাকলেও আবীরের পরামর্শ মাথায় খেলতে থাকে অঙ্কের মতো।

এর দু’দিন পর মাঝ-রাতে মীরার কাছে খবর আসে কারখানায় কিভাবে যেন আগুন লেগে গিয়েছে। মীরার তে হাত-পা ঠান্ডা অবস্থা। ওরা মীরাকে শান্ত হতে বলে জানায়- কারখানায় রাতে থাকা কর্মচারীরা আগুণ তৎক্ষনাৎ দেখে ফেলায় এ যাত্রায় আগুন নিভাতে সক্ষম হয় ওরা। কথাগুলো শুনে ভিতরকার কাঁপন স্বাভাবিক হলেও রাগে শরীর কাঁপতে থাকে, দাঁত কিড়মিড় করে বলে-

: ” তোদের বাপ-ছেলেদের সত্যি আমি দেখে নিবো, আমার হারাবার কিছুই নাই, সব শেষ করে দিয়েছিস তোরা এবার হয় তোরা ধ্বংস হবি নাহয় আমি”

চলবে…………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে