প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৮১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)।
পুরো রাতটা এক রকম নিদ্রাহীন কেটেছে মীরার। নিজের সাথে দ্বন্দ্ব চলে পুরোটা সময় জুড়ে। একটা দিন কেটে গেলো নানান ব্যাস্ততায়। আবীর আগামীকাল ঢাকা ছাড়বে, এটাই অবশিষ্ট সুযোগ ওর হাতে।
হঠাৎ করে ওর নানীর বলা একটা কথা মনে পরে। তিনি বলতেন ভাল কাজে অনেক বাঁধা। আবীরের মুখোমুখি হতে তাই হয়তো এত কাঠখড় পোহাতে হচ্ছে ওকে। ভাগ্য ওকে নিয়ে যতই খেলুক এর শেষ দেখতে চায় মীরা।
শেষরাতে তন্দ্রার মতো অনুভূত হয় ওর। তবুও ঘুমায়না ও, এই ঘুম কাল হয় যদি। আবীর কাল যাবে এটা জানে, কিন্তু কখন যাবে তা জানে না৷ শত চেষ্টা করেও মীরা ফিওনার সাথে কনটাক্ট করতে পারে নি, এ বিষয়ে জানতে। দূরদেশে পৌঁছাতে দীর্ঘ সময়ের যাত্রা।
তাই মীরা কোন প্রকার রিস্ক নিতে চায় না। সকালটা কোনমতে হলেই আবীরের বাসায় যাবে ও। এটা ওকে পারতেই হবে। আবীরের উত্তর হ্যা/না যাই হোক শেষ অবধি ওর মুখোমুখি না হতে পারলে সারাজীবন একটা গিল্টি ফিল কুড়ে কুড়ে খাবে ওকে। উত্তর যদি না ও হয়, মনে স্বান্তনা থাকবে নিজের সামর্থের সবটুকুো চেষ্টা করেছে ও।
আরো একটা রাত ভোর হওয়ার অপেক্ষায় ও। ফজরের আজান হতে এখনো বাকী ভেবে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে ও। মনে গোপন ভীতি থাকার কারনে এর আগে কখনো তাহাজ্জুদ পড়া হয় নি ওর। কোন জ্বী*ন নাকি আসে তাহাজ্জুদ পড়ার সময়। তবে ও এটাও
শুনেছে যে তাহাজ্জুদ এতোই মর্যাদাপূর্ন যে, এ নামাজ পড়া ব্যাক্তির দোয়া লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। আল্লাহ তাআলা তাহাজ্জুদ পড়া ব্যক্তির ডাকে সাড়া দেন। তার দোয়া কবুল করেন।
ভগ্নহৃদয় নিয়ে আল্লাহ মুখী হয় মীরা। নামাজের সিজদায় কান্না করে সব যন্ত্রনার কথা ভেবে। আল্লাহর সাহায্য চায় ও এসব থেকে পরিত্রান পেতে। নামাজ শেষ হতেই ফজরের আজান শুরু হয় চারিদিকে। মীরা ফজরের নামাজ শেষ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে সকাল হওয়ার। ভোরের প্রথম আলো ফুটলে ঘরের ঘড়ির দিকে তাকায় ও। সকাল সাড়ে পাঁচটা বাজে। তৎক্ষনাৎ মাজেদা খালাকে মেয়ের পাশে থাকতে বলে বেরিয়ে পরে ও। রিকশা কিংবা সিএনজি খুঁজে সময় নষ্ট করতে চায় না ও। তাই গ্যারেজে নিজের স্কুটিটা নিয়ে বেরিয়ে যায় আবীরের বাড়ির উদ্দেশ্যে। মীরা থাকে ধানমন্ডি, আবীরদের সাবেক বাড়ি পুরান ঢাকায়।
নিউ মার্কেট, নীলক্ষেত, ঢাকা মেডিকেল কলেজ পরিয়ে, একে একে বংশাল, নয়াবাজার, ইংলিশ রোড, ধোলাইখাল পেরিয়ে কাঠের পুলের দিকে গেলো স্কুটিটা। সেখান থেকে ধুপখোলা বাজার, ধুপখোলা মাঠ ছেড়ে ১৩ নম্বর বাস স্ট্যান্ডের কাছে পুকুর পাড়ের দিকে মুভ করলো। শীতের সকাল, পথে কোন প্রকার ঝামেলা পোহাতে হলো না ওকে। তাই ইচ্ছে করেই অনেকটা পথ ঘুরে এলো ও। কত বছর পর এলো এদিকটায়। মীরার ভীষণ অবাক লগলো ১৩ নম্বর বাসস্ট্যান্ড না দেখে। একজনকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন বাস স্টপিস নাকি অনেক বছর হলো উঠে গেছে এখান থেকে।
রাস্তা বেশ ফাঁকা বিশ মিনিটের মধ্যে ও পৌঁছে গেলো আবীরের এলাকায়। এখানে কত এসেছে ও মায়ের হাত ধরে মনিকা আন্টিদের বাসায় বেড়াতে, সে অনেক বছর আগের কথা, কত বদলে গেছে চারপাশ।
গলি পেরিয়ে রাস্তার বাঁক ঘুরতেই বিশল ঝোপের বাগানবিলাস ওয়ালা একটা গেইট দেখলেই ওরা বুঝতো যে মনিকা আন্টিদের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ওরা। ঐ বাগান বিলাশ গেইট বিশিষ্ট বাড়িটা ছিলো ওদের কাছে ল্যান্ডমার্ক। এখন সেখানে উঠেছে বিশাল বিল্ডিং। মীরা কেমন ভড়কে যায়। ওর স্মৃতিতে থাকা মনিকা আন্টির বাড়িটা ভেঙে যদি নতুন করে কোন বিল্ডিং তৈরি করা হয় তাহলে তো মীরা নতুন বাড়িটা চিনতে পারবে না। স্কুটি একটা বিশাল সাইড করে রেখে হাঁটতে থাকে মীরা। ঘড়িতে সময় এখন ছয়টা। একটু হাঁটতেই মীরা পেয়ে গেলো মনিকা আন্টিদের বাড়ি। খুশিতে পানি চলে আসলো চোখে যেন বাড়ি খুঁজে না ও পেয়ে গেছে আবীর নামের গোটা মানুষটাকে। ওর এ আনন্দ অমূলক না। খুব কাছের কোন বন্ধুর সাথে অনেক বছর পর দেখা হলে আপনি যখন দেখবেন বন্ধুটি আগের মতোই রয়েছে, একটুও বদলায় নি, তখন ঠিক এই আনন্দটাই আপনার হবে।
তবে একটা জিনিস বেশ ভালো লাগলো ওর, জায়গাটা
আধুনিকতায় ছেয়ে গেলেও এখনো বেশ নিরিবিলিই আছে আগের মতো।
আশেপাশের অনেক জৌলুশ পূর্ণ বাড়ির ভিড়ে এ বাড়িটা যেন নির্মোহের প্রতীক। সামনে বিশাল জায়গা রেখে তৈরী করা বাড়িটা এখনো তেমনি রয়েছে। অথচ অনেকেই এরচেয়ে কম জায়গায়ও পাঁচ তলা বাড়ি বানিয়ে বসে আছেন।
এত বছর পরেও বাড়িটাকে আগের মতোই দেখবে ভাবেনি ও। কাছে গিয়ে লোহার ফটকটায় হাত রাখলো ও। আগে এই দরজাটা হলুদ রঙের ছিলো। এখন এতে ধূসর রঙ দিয়ে পেইন্ট করা হয়েছে।
দরজা ঠেলতেই দেখে বাড়ির মেইন দরজা খোলা। মীরা ভীত মন নিয়ে পকেট গেইটটা খুলে ঢুকলো বাড়িটাতে।
একটা দমকা বাতাসের সাথে আসা মিষ্টি গন্ধ এসে অভ্যর্থনা জানালো ওকে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে ও, চোখ বুলাতে থাকে পুরো বাড়িটায়। দোতলা বাড়ি, মস্ত পাকা উঠোন, আর বিশালাকার গাছগুলো।
আগে বাড়ির সামনের অংশটায় বাগানের মতো ছিলো। মনিকা আন্টির গাছ ভিষণ পছন্দ ছিলো৷ এখন তিনি নেই তাই বাগান যে থাকবে না তা তো সোজা হিসেব । তবে বিশালকার আমগাছটা এখনো মাথার উপরে দাঁড়ি আছে ছায়া হয়ে। আম গাছটার কাছে গিয়ে মীরা গাছটাকে আলতো করে ছুয়ে দিলো ও আঙুল দিয়ে৷ অনেকদিন পর কাছের কাওকে দেখে ছুয়ে- “কিরে? কেমন আছিস? “- জিজ্ঞেস করার মতো। একটু এগুতেই পেয়ারা গাছ। এ গাছটা খুব ছোট ছিলো, মীরা যখন এসেছিলো। কিশোরী বয়স ছিলো তার, এখন সে মধ্যবয়সী পৌঢ় যেন। উত্তুরে বাতাসের দমকে ডাল পাতাগুলো নড়ে উঠলো, কেমন একটা শব্দ হলো তাতে, ঠিক যেন ষোড়শী তরুণীর খিলখিল হাসি।
সামনে এগুতেই মীরা দেখলো বাড়ির ভিতরের দরজা হাট করে খোলা, দেখে মীরার মনটা উচাটন হয়ে উঠলো, এত সকালে দরজা খোলা? চলে গেলো না তো? দ্রুত দরজায় কড়া নাড়তেই ভিতর থেকে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। এর কথা ফিওনা বলেছে মীরাকে। তিনি আবীরের দূর সম্পর্কের আত্নীয়। আবীরের বাবা মারা যাবার পর বৃদ্ধ ছেলেদের কাছ থেকে বিতারিত হয়ে তিনি এ বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছেন। তার দায়িত্ব এ বাড়ি আর আবীরের দেখাশোনা করা।
মলিন মুখ নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন-
: “কাকে চাই?”
মীরা তোতলানো স্বরে বলে-
: “আ…আবীর ভাইয়া আছেন?”
: ” হুম, আসুন ভিতরে আসুন….”
মীরা ভয় পেয়ে ছিলো কেন, কি দরকার এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন, কিন্তু সহজে বসার ঘর অবধি পৌঁছে মনে সাহস জন্মালো ওর। বৃদ্ধ বললেন –
: “আপনি বসুন আবীর মর্নিং ওয়াক শেষে গোসলে গেছে এক্ষুনি এসে পরবে”
এত শীতের মধ্যেও মীরার ঘাম হতে শুরু করে, সেন্টার টেবিলে থাকা পানির জগ থেকে পানি নিয়ে পুরোটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে মীরা। বুকের মধ্যে ধুকপুকানির শব্দ ও শুনতে পাচ্ছে যেন। মনটাকে অন্য দিকে ডায়ভার্ট করে ও। খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে ঘরের আসবাব। আদিকাল থেকেই আবীরের পরিবার বনেদি ছিলো। আবীরের বাবার প্রেসের ব্যাবসা ছিলো।
তখনকার সময় থেকেই সব আধুনিক জিনিস, আসবাবপত্র দেখা যেতো ওদের বাড়িতে।
মা বলতো এদিকটায় যখন ভাড়া থাকতেন তারা একমাত্র ওদের ঘরেই রঙিন টিভি, ফ্রিজ, এসি, টেলিফোন ছিলো। দূরে দূরের লোকেরা এসে জড়ো হতো টিভি দেখতে৷ জত কত লোক বিদেশ থেকে ফোন দিতো ওদের ফোনে। আবীরের মা ছিলেন খুবই মিশুকে। সবার সাথে আন্তরিক সম্পর্ক ছিলো তার। তাই আভিজাত্যের তফাৎ কখনওই সম্পর্কের জন্য দেয়াল হয়নি মীরা দের সাথে।
হঠাৎ মীরার মনে হলো ২য় তলার এ বসার ঘরে বসে জানালা দিয়ে পুকুর দেখা যেতো আগে। কথাটা মনে হতেই সেদিকটাতে তাকালো ও। না, এখন আর আগের মতো পুরো পুকুর দেখা যায় না। বিশালাকার আম গাছের একটা অংশ এ ঘর থেকে দেখতে পাওয়া পুকুরটাকে ঢেকে দিয়েছে এত বছরে একটু একটু করে।
বসার ঘরের বড় দেয়ালে নানান ওয়ালম্যাটের পাশাপাশি পারিবারিক ছবি টানানো, ফিওনার বিয়ের সময়কার ছবি। হাস্যজ্জ্বল বধূ বেশী ফিওনার দুই পাশে বাবা মা, আর পেছনে মৃদু হাসিতে আবীর দাঁড়ানো বোনকে আগলে ধরে আছে। কি সুন্দর পারিবারিক ছবি। কিন্তু ছবির তিনজনই আবীরের কাছ থেকে এখন অনেক দূরে। আবীরকে একলা করে দেয়ার খেলাটা শুরু হয়েছিল মীরাকে দিয়ে, তারপর মনিকা আন্টি চলে গেলেন এক বর্ষার রাতে। আবীরের বাবা বেশ কিছু বছর সঙ্গ দিয়েছে ছেলেকে। যখন মা*রা গেলেন, বয়স নব্বই বছর ছুঁইছুঁই, আর কত? তিনিও চলে গেলেন অগ্যস্ত যাত্রায়। ফিওনা চলে গেলো স্বামীর কাছে। আবীর একা এত বড় বাড়িটায় থেকে কি করবে? তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামে চলে যাওয়ার। আপনজন কেও নেই এখানে, এত বড় শহরটা খুব ভারী হয়ে গেছে তার জন্য।
ব্যাবসা গুটিয়ে কেন যাচ্ছে? এমন প্রশ্নে এই উত্তর ছিলো ফিওনার। এমন সময় হঠাৎ বাথরুমের দরজা খেলার শব্দ কানে এলো। সামান্য এ শব্দেই সোজা হয়ে বসল মীরা। এক জোড়া পা চলে গেলো ভিতরের দিকের ঘরে। দুজন লোকের কথোপকথনের টুকরো আলাপ ম্লান ভাবে শোনা গেলো এখানে বসেই। তারপর অপেক্ষা করতে থাকলো মীরা কয়েক গজ দূরের আবীরের জন্য।
মীরার মাথার শিরা দপদপ করছে ওর, হাত-পা ঘামছে বারবার। একটু পরপর ও মুখ মুছছে, ঘোমটা টানছে। এ এক অন্য রকম ভীতি। “পৃথিবীর সকল ভীতি দুষ্ট লোকেদের বিপরীতে হয়, কিন্তু ভালো লোকের বিপরীতে যে ভীতির উদ্রেক হয় তা ভীষণ কঠিণ আর ভয়ংকর। এর বর্ননা করার ভাষার জন্ম পৃথিবীতে আজও হয়নি।
আরো এক গ্লাস পানি ঢাললো মীরা। মনের অস্থিরতায় হাত কেঁপে টেবিলের উপর পানি পরে গেলে খানিকাটা। মীরা সেটা অগ্রাহ্য করে পানির গ্লাস মুখে দিতেই দরজায়র চৌকাঠে দাঁড়ালো থ্রি – কোয়ার্টার প্যান্ট আর টি শার্ট পরা আবীর৷ পানি খাওয়া রেখে উঠে দাঁড়ালো মীরা৷
আবীর!
“খুব তারাতাড়ি দেখা হবে আমাদের ” বলা সেই আবীর। অথচ জীবণ দুজনকে মুখোমুখি করতে সময় নিলো বারো বছর, মানে এক যুগ!
বেশ চমকানো দৃষ্টিতে মীরার দিকে কিছু ক্ষণ তাকিয়ে রইলো আবীর, দৃশ্যপট যে কোন ভ্রম নয় তা নিশ্চিত হতেই আবীর জিজ্ঞেস করলো-
: “কি ব্যাপার?”
চলবে….
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৮২
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
মীরার মাথার শিরা দপদপ করছে ওর, হাত-পা ঘামছে বারবার। এ এক অন্য রকম ভীতি। “পৃথিবীর সকল ভীতি দুষ্ট লোকেদের বিপরীতে হয়, কিন্তু ভালো লোকের বিপরীতে যে ভীতির উদ্রেক হয় তা ভীষণ কঠিণ আর ভয়ংকর। এর বর্ননা করার ভাষার জন্ম পৃথিবীতে আজও হয়নি।
আরো এক গ্লাস পানি ঢাললো মীরা। মনের অস্থিরতায় হাত কেঁপে টেবিলপর উপর পানি পরে গেলে খানিকাটা। মীরা সেটা অগ্রাহ্য করে পানির গ্লাস মুখে দিতেই দরজায়র চৌকাঠে দাঁড়ালো থ্রি – কোয়ার্টার প্যান্ট আর টি শার্ট পরা আবীর৷ পানি খাওয়া রেখে উঠে দাঁড়ালো মীরা৷
আবীর!
“খুব তারাতাড়ি দেখা হবে আমাদের ” বলা সেই আবীর। অথচ জীবণ দুজনকে মুখোমুখি করতে সময় নিলো বারো বছর। মানে এক যুগ!
বেশ চমকানো দৃষ্টিতে মীরার দিকে কিছু ক্ষণ তাকিয়ে রইলো আবীর, দৃশ্যপট যে কোন ভ্রম নয় তা নিশ্চিত হতেই আবীর জিজ্ঞেস করলো-
: “কি ব্যাপার?”
মীরা উত্তর দেয়া ভুলে গিয়ে তাকিয়ে আছে আবীরের দিকে। ওর চৌকাঠে পা দেয়ার সাথে সাথে মিষ্টি একটা সুবাস পুরো ঘরের দখল নিয়েছে। সদ্য গোসল শেষ করা আবীরের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে কপালের দিকে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে চুলগুলো ভালো ভাবে মোছা হয়নি, এখনো ভেজা।
দীর্ঘদেহী আবীরের দাঁড়ানো দৃঢ়, দৃষ্টি স্বচ্ছ, চোয়াল শক্ত, চোখেমুখে বিরক্তি ভাব এতই প্রকট যে চেহারায় বিরক্তির চেয়ে রাগি ভাব ফুটে উঠেছে বেশী মাত্রায়।
অপর প্রান্তে কোন প্রকার উত্তর না পেয়ে দরজায় টোকা দিলো আবীর। সেই শব্দে সংবিৎশক্তি ফিরে পেলো যেন মীরা। কাচুমাচু করে, দৃষ্টি স্থানান্তর করলো আবীরের থেকে মাটিতে। যেখানে আজ নিজের ব্যাক্তিত্ব, সম্মান গুড়িয়ে পরেছে আবীরের সামনে। কি বলবে মীরা উত্তরে? তার খোঁজ চালায় মনের গভীরে। ঘরে দিকে এক কদম এগিয়ে আবীর চোখমুখ কঠিন করে বললো-
: ” তুমি এখানে?”
এবার কিছু না বললেই নয়, মীরা ওর থেকে চোখ সরিয়ে তোতলানোর মতো করে বলে-
: “আপনি নাকি ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন আজ?”
আবীর চোখমুখ আগের মতোই শক্ত রেখে বলে-
: “তো?”
এবার মীরার মন ক্ষুন্ন হয় একটু, এ প্রশ্নেই উত্তর হওয়া উচিত ছিল হ্যা কিংবা না। তা না বলে উনি বললেন “তো…?”
মীরা আবীরের এমন এটিটিউট হজম করে বলে-
: ” আসলে….
আমি আপনার সাথে কিছু কথা বলতে এসেছি ”
: ” তোমার সাথে আমার কোন কথা নেই”
: ” বেশী সময় নেবো না, অল্প কিছু কথা…”
কথাটা শেষ করতে পারে না মীরা৷ আবীর চোখমুখ আগের চেয়েও শক্ত করে বলে-
: “তোমার সাথে কথা বলার ইচ্ছে, সময় কোনটাই আমার নেই। সাড়ে আটটায় আমার ট্রেন। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে”
এক ফাঁকে ঘড়ি দেখে নেয় মীরা, সকাল ০৬:৫০ বাজে ঘড়িতে। মীরা অসহায় মুখ করে আবীরের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু আবীরের দৃষ্টি অন্যদিকে।
আবীরের মীরার দিকে না তাকানোর সামান্য এই কাজটুকুতে যে ওকে কত্তখানি অগ্রাহ্য মিশানো তা ঠিক টের পায় মীরা। এসবের জন্য আগে থেকেই তৈরীই ছিলো ও । এগুলো ওর ঋণ, আবীরের কাছে। মনে সাহস রেখে মীরা আবীরের দিকে তাকিয়ে বলে-
: “আমি জানি, আমি যা করেছি তাতে আমার প্রতি আপনার এই বিরক্তি যৌক্তিক। কিন্তু আমি আপনাকে অনুরোধ করছি আমার কথাগুলো প্লিজ একটু শুনুন”
আবীর দাঁড়ানো থেকে ঘরের ভিতরে ঢুকে মীরার ঠিক বিপরীতে সোজা হয়ে বসে। তারপর বলে-
: “বলো, কি বলবে তুমি?
আমার ভুল হয়েছে,
আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন?
এগুলোই তো?
তোমার মতো মেয়ের প্রতি কোন রাগ, ঘৃণা, অভিমান কিছুই নেই আমার। আর ক্ষমার কথা বলবে তো, সেটার তো প্রশ্নই আসে না, কারন তুমি ক্ষমার অযোগ্য। তুমি একজনকে বিয়ে করলে, তাকে ডিভোর্স না দিয়েই অন্য আরেক জনকে বিয়ে করলে পরদিন, যা মনে চাইলো তাই করলে। ঠিক ভুল, ন্যায়, অন্যায় কিছুই চিন্তা করলে না। চাইলে আমি আইনি জটিলতার ফাঁদে ফেলে তোমার জীবন নরক করে দিতো পারতাম। কিন্তু আমি তা করি নি। আমি তো দয়া করেছিলাম তোমাকে”
কথাটা শুনে আবীরের দিকে তাকায় মীরা। এত শক্ত কথা জানে আবীর? জানবে নাই বা কেন? কতকিছু ফেইস করতে হয়েছে ওকে, এক মীরার জন্য। ক্ষণকালের বিরতি শেষে আবীর আবারো বলে-
: “আমি বিয়ের আগে দেখা হওয়ার সময় বার বার তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- তোমার এ বিয়েতে মত আছে কিনা? উত্তরে কি বলেছিলে তুমি আমাকে? বলো?
মীরার মনে পরে সে দিনের কথা। উত্তরে কি বলেছিলো স্পষ্ট মনে পরে তা-ও।
আবীর তখনো বলতে থাকে-
: “তোমার মনে যখন অন্য কিছু ছিলো তাহলে কেন তুমি বিয়েটা করলে?, কেন আমার জীবণটা নষ্ট করলে? কেন সমাজের চোখে হেয় করলে আমাকে? আজ বারো বছর পর তোমার মনে হলো তুমি ভুল করেছো, তোমার ক্ষমা চাওয়া উচিত? তুমি এলে আর আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিবো ভেবেছো? হুহ্”
তাচ্ছিল্য মাখা এই ধ্বনিটা উচ্চারিত করে আবীর মনের উচাটন দূর করতে পুকুর দেখতে পাওয়া সেই জানালার দিকে তাকায়, পরিষ্কার, শান্ত পুকুর। ক্রমাগত বাতাস তার গায়ে আলপনা এঁকে দিচ্ছে যত্ন করে। অপরপ্রান্তে বসে মীরা তখনো কাঁদছে মাথা নত করে। আজ ওর শুনবার পালা যেন।
একটু পর আবীর বলে-
: ” তোমার জন্য ঐ বিয়েটা ছিল নাথিং ,
কিন্তু কখনো কারো দিকে না তাকানো আমার কাছে ঐ বিয়েটাই ছিলো এভরিথিং” তুমি চলে যাও, আমার কোন কথা নেই তোমার সাথে, ক্ষমা চাইতে এসেছে তো? যাও দিলাম ক্ষমা করে। সুখে থাকো তুমি”
ক্রন্দনরত কন্ঠে মীরা বলে-
: “আমি জানি যে আমি আপনার কাছে সত্যি লুকিয়ে অনেক বড় অন্যায় করেছি। কিন্তু আমি বলতে চেয়েও বলতে পারি নি। বাবা-মা ইচ্ছে করেই আমাদের দেখা করার দিনে ইরাকে সাথে দিয়েছিলো যাতে আমি কি বলি তা তারা ইরার কাছে শুনতে পারে। আর আমি যদি সেদিন সত্যিটা বলতাম ও বাবা-মাকে সব বলে দিতো। সে ভয়ে আমি….. কান্নার দমকে কথাটাও শেষ করতে পারে না মীরা। নিজেকে সামলে নিয়ে ও আবারো শুরু করে-
: “আমার বাবা-মা আমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বিয়েতে রাজি করিয়ে ছিলো। কিন্তু বিশ্বাস করেন আমি আপনার জীবন নষ্ট করতে চাই নি।
কথাটা শুনে যেন আবীর জ্বলে উঠলো। বিরক্ত কন্ঠে বললো-
: ” কি বললে? জীবন নষ্ট করতে চাই নি! হুহ্
কিন্তু করেছো তো? একটা নির্দোষ মানুষের জীবণ থেকে সব রঙ কেড়ে নিয়েছো তুমি। কোন অপরাধ না করেও সমাজের কাছে আমাকে, আমার পরিবারকে কত ছোট হতে হয়েছে, কত কথা শুনতে হয়েছে তা তুমি জানো? কেন? কি অপরাধ ছিলো আমার? আমার পরিবারের? বলো?, জবাব দাও?” রাগে আবীরের চোখমুখে যেন আগুন বেরুচ্ছে৷ কপালের কাছের শিরা ফুলে গেছে।
মীরা কাঁদতেই থাকে৷ সত্যি একটা নির্দোষ মানুষের জীবণকে নরক করে দিয়েছে ও। এ ভুল ক্ষমার অযোগ্য। তবুও মীরা আত্মপক্ষ সমর্থনে বলে-
: “ঐ রাতে শুধু আংটি পরানোর কথা ছিলো, পর দিন আমি পালিয়ে যাবো৷ কিন্তু আপনার মা কাজী ডেকে এনে সেদিন রাতেই বিয়েটা করিয়ে দিলেন। বিয়েটা যে এত জলদি হয়ে যাবে আমি তা ক্ষুণাক্ষরেও টের পাইনি”
দুই হাতে মুখ চেপে মীরা বলতে থাকে-
: “যে ভুল আমি করেছি তার চেয়ে হাজার গুন শাস্তি আমি পেয়েছি, এখনো পাচ্ছি। আপনাকে কষ্ট দিয়ে আমি নিজে ও কখনো সুখী হইনি, না পেয়েছি সম্মান, না ভালোবাসা। আপনার সাথে করা অন্যায়ের শাস্তিস্বরূপ পরিবার থেকেও পরিবার ছাড়া হয়ে ভেসে বেরিয়েছি। সংসার বলতে যা ছিলো তা একাই টেনে নিতে হয়েছে আমাকে। যার জন্য এতকিছু করেছি তার প্রতারণর স্বীকার হয়েছি। এখানেই শেষ নয় এসবের শাস্তি স্বরূপ নিজের বাবাকেও শেষ বারের মতো দেখতে দেয়া হয় নি আমাকে। এরচেয়ে বড় শাস্তি কি আছে পৃথিবীতে? ”
এবার যেন একটু থমকে গেলো আবীর। সত্যি মীরার জীবণের উপর দিয়ে কি ঝড় গেছে তা তো আবীরের অজানা নয়। দূর থেকে সবই জানে ও।
মীরা কান্না থামিয়ে ওড়না দিয়ে চোখ মুছে। আবীর এবার মীরার দিকে তাকায় একপলক। ওর যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার গল্প আবীরের জানা। আটপৌরে পোশাক পরিহিত মীরার চোখেমুখে রাজ্যের ক্লান্তি, চোখের নিচে নিদ্রাহীনতার ছাপ স্পষ্ট । তবুও এসব খুঁত যেন ম্লান মীরার সৌন্দর্যের কাছে। হঠাৎ আবীরের নজর পরে মীরার ওড়না দিয়ে চোখ মোছা হাতে। কিছুক্ষণের জন্য সময় যেন থমকে যায় ঐ হাত জোড়ায়।
গতকাল এয়ারপোর্টে ফিওনার বর বিদায় নেয়ার আগে আবীরকে বলেছিলো – “মীরা আপনার জীবণে ফিরে আসতে চায়। ও এলে ওকে ফিরিয়ে দিয়েন না। ইগো, আত্মসম্মান এসবের তলে ভালো থাকা, সুখে থাকাটাকে চাপা পরতে দিয়েন না। কতদিন আর একা থাকবেন বলেন? মানুষ বাঁচে কতদিন? ” উত্তরে আবীর কিছুই বলেনি। সত্যি বলতে পারে নি বলতে।
মীরা যে সত্যি ওর জীবণে ফিরতে চায় তা না বলেও বলে দিচ্ছে ওর হাতের চুড়ি গুলো। আটপৌরে এমন জামার সাথে এ চুড়ি বড্ড বেমানান। তাছড়া এ চুড়ির বেশ চল ছিলো এক যুগ আগে। এখন এমন চুড়ি পাওয়া যায় না, কাওকে পড়তেও দেখা যায় না। বিয়ের দিন প্রথম দেখা হওয়ার উপহার হিসেবে দেয়ার জন্য নিজের পছন্দে শাড়ি আর চুড়ি কিনেছিলো আবীর। সেই চুড়ি গুলো চিনতে ভুল হয় না আবীরের। মীরার মায়ের বাড়ির আলমারিতে এতদিন অযত্নে পরে ছিলো চুড়িগুলো। প্যাকেট পর্যন্ত খোলা হয় এতদিনেও। ফিওনার সাথে দেখা করতে যাওয়ার দিন মায়ের বাড়ি আসবাবপত্র গোছগাছের সময়ে জিনিসটা নজরে পরে মীরার। সেদিনই ও ব্যাগে করে নিয়ে নিয়েছিলো চুড়ি জোড়া। আবীরের সঙ্গে অনাকাঙ্খিত সেই দেখা হওয়ার সময়ে চুড়ি গুলো মীরার ব্যাগেই ছিলো।
চুড়ি গুলো দেখে সব রাগ যেন পানি হয়ে যায় আবীরের। আনমনে বলে ফেলে-
: কেন করলে তুমি এমন, কি লাভ হলো এসব করে?
কেও তোমাকে ভালোবাসা দিতে চেয়েছিলো, কিন্তু তুমি বেছে নিয়েছো দয়া”
চোখ মুছে মীরা মাথা নত করেই বলে-
: ” আরেকটা বার না হয় দয়া করুন আমাকে, নিজের ভুলটাকে শুধরে নিতে, যা শাস্তি দিবেন মাথা পেতে নিবো আমি”
আত্মসম্মানে দৃঢ় মীরার এ আত্মসমর্পণ ওর অসহায়ত্ব না, বরং অনেক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে আবীরের নিখুঁত ভালোবাসার কাছে বশ্যতা স্বীকার।
মীরার চোখে চেয়ে থাকে আবীর। যেন মীরার মনের ভিতরটা দেখবার চেষ্টা করছে ও।
চলবে…..
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৮৩
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
চুড়ি গুলো দেখে সব রাগ যেন পানি হয়ে যায় আবীরের। আনমনে বলে ফেলে-
: কেন করলে তুমি এমন, কি লাভ হলো এসব করে?
কেও তোমাকে ভালোবাসা দিতে চেয়েছিলো, কিন্তু তুমি বেছে নিয়েছো দয়া”
চোখ মুছে মীরা মাথা নত করেই বলে-
: ” আরেকটা বার না হয় দয়া করুন আমাকে, নিজের ভুলটাকে শুধরে নিতে, যা শাস্তি দিবেন মাথা পেতে নিবো আমি”
আত্মসম্মানে দৃঢ় মীরার এ আত্মসমর্পণ ওর অসহায়ত্ব না, বরং অনেক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে আবীরের নিখুঁত ভালোবাসার কাছে বশ্যতা স্বীকার।
মীরার চোখে চেয়ে থাকে আবীর। যেন মীরার মনের ভিতরটা দেখবার চেষ্টা করছে ও। সে চাহনিতে ভিন্ন কিছু ছিলো। বেশীক্ষণ চোখে চোখ রাখতে পারে না মীরা, ডুবে যাওয়ার ভয়ে সরিয়ে নেয়। কিছুক্ষণ বসে থেকে মীরা বলে-
: ” আমি জানি আমার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য, আপনাকে পরামর্শ দেবার যোগ্যতাও নেই আমার। জোড় করে যে আপনার যাওয়া আটকাবো সে অধিকারও নেই। তবে যদি আপনি সুযোগ দেন আমার মতো অধমের করা ভুলে আপনার জীবণটা এভাবে যে এলোমেলো হয়ে আছে সেটাকে গুছাতে চাই আমি”
কপাল কুঁচকে আবীর রূঢ় কন্ঠে বলে-
: “তোমার জন্য জীবণ এলোমেলো তা কে বললো তোমাকে?”
: ” না, মানে…. ”
: ” তুমি কি ভেবেছো? তোমার দেয়া কষ্ট নিয়ে আমি দেবদাস হয়ে বসে আছি?”
: ” না, না, তা না”
মুখে না বললেও মীরা আবীরের দিকে চেয়ে মনে মনে বলে “আমি জানি আবীর আপনার সব কাগজপত্রে স্পাউসের জায়গায় এখনো আমিই আছি, কাগজপত্রে তো জায়গা দিয়েই রেখেছেন, এবার মনে একটু জায়গা দিলেই হয়”
: “বিয়ে একটা করতে হয়, করেছিলাম, এরপর কি হয়েছে তা আমার চেয়ে ভালো জানো তুমি, এখনো একা আছি এটা আমার চয়েজ”
এরপর ঘর জুড়ে নিরবতার দখল। শব্দের উপস্থিতি যা আছে তা উত্তুরে বাতাসের। হুহু করো বাতাস আসছে জানালা দিয়ে। জানালার থাই গ্লাসগুলো তিরতির করে কাঁপছে বাতাসের দমকে।
মীরা সুতির একটা জামা পরে এসেছে, তারাহুরো করে আসায় গরম কাপড় গায়ে দিতে ভুলে গেছে বেচারী। আর এতক্ষণ ভয়, জড়তায় ডুবে থাকা মীরার হুঁশ ছিলো না শীত গরমের। এখন জানালা দিয়ে আগত বাতাসে কেঁপে উঠে মীরা। বাতাস থেকে বাঁচতে গায়ের ওড়নাটা সাবধানে টেনে নিলো গায়ে। আবীরের চোখ এড়ায় না মীরার বাতাস থেকে বাঁচার ব্যাপারটা।
কিছু সময় পর সোফা থেকে উঠে গিয়ে জানালাটার গ্লাস টেনে দেয় আবীর। ওর হাত গ্লাসে থাকা অবস্থায়ই মীরা বেহায়ার মতো বলে-
: ” এখানকার বাতাস থেকে নাহয় রক্ষা করলেন আমাকে, কিন্তু বাইরের সবকিছু থেকে…?”
সেখানে দাঁড়িয়েই আবীর অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় মীরার দিকে। না বলেও সে দৃষ্টি যেন বলছে অনেক কথা, বিবরণ দিচ্ছে অনেক অতীতের। মীরা তা দেখে মাথা নিচু করে ফেলে।
সেখান থেকে এসে সোফায় বসে আবীর। ঘড়ি দেখতে দেখতে ঝাঁঝালো গলায় বলে –
: “শেষ হয়েছে তোমার কথা? আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মীরা। যত বেহায়াপনাই করুক, নিজেকে যত নিচেই নামাক, আবীরের দৃঢ় মন যে এক চুলও গলে নি তার টের পায় ওর কথার ঝাঁঝে। এখনো মাথা নিচু ওর। বেশ কিছুটা সময় পর মীরা ক্ষীণ কন্ঠে বলে-
: ” জীবণে সত্যের মুখোমুখি হয়ে একা থাকার সিদ্ধান্ত আমিও নিয়েছিলাম, কিন্তু একা থাকার চয়েজ আপনার জন্য যত সহজ তা আমার জন্য ততোটাই কঠিন। সৎ, সাহসী, আত্মনির্ভরশীল হয়েও আমার দিকে বাড়ানো লোভী, নোংরা হাত গুলোকে আমার প্রতিহত করতে হয়। ইদানীং এসব নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল এসব এড়িয়ে চলতে চলতে বড্ড ক্লান্ত আমি। নিজেকে ঐ লোভী মানুষগুলোর বিপরীতে এত ছোট, হীন মন হয় যে মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় নিজেকে নিঃশেষ করে দিই। মেয়েটার কথা ভেবে তা পারি না”
কথা গুলো বলে চুপ করে থাকে মীরা। সায়ানের অভদ্রতার কথা মনে করে চোখ উপচে পানি পরে ওর।
এসব নিয়ে সত্যি ও ভীষণ ডিসটার্ব আজকাল। নিরব কান্নার জল মুছে মীরা আবারো বলতে শুরু করে-
: “সবাই জানে আমি একজন সফল মানুষ, এ বয়সে আট-দশ জনের চেয়ে অনেক বেশী কিছু অর্জন করেছি আমি। এতকিছু পেয়েও ভিতরে ভিতরে যে আমি কতটুকু অপূর্ণ তার খোঁজ কেও রাখে না,
কথাগুলো শুনে আপনার নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে আমি ভীষণ স্বার্থপর, এত বছর পর আজ নিজের প্রয়োজনে আপনার দুয়ারে এসেছি। ভাবতে পারেন, অনেক কে পাবো আমি আমার পাশে দাঁড়ানোর জন্য কিন্তু আমার মনে হয় আমার জীবণ পাজল এর মিসিং পার্টটা আপনার কাছে, আমি আপনাকে আমার পাশে চাই”
কথাটা বলে আবীরের দিকে তাকায় মীরা। কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেন্টার টেবিলে রাখা শো পিসটার দিকে। ঠিক যেন অতীতের সবকিছু দেখতে পাচ্ছে ও সেখনটাতে। এত নিরবিচ্ছিন্ন মনযোগী সেখানে যেন মীরার কোন কথাই ও শুনতে পাচ্ছে না।
কিছুনসময় চুপ থেকে কেমন একটা ঘোরলাগা চোখে তাকায় আবীর মীরার দিকে, শান্ত মৌন কন্ঠে ও বলে-
: ” বিয়ের পরদিন তোমার মনে চাইলো তুমি চলে গেলে, এক যুগ পর এসে বললে আমার জীবণ পাজলের মিসিং পার্ট আপনার কাছে, মানে তোমার যখন যা ইচ্ছে হচ্ছে তাই করছো, জীবণকে তুমি কি মনে করো? কোন খেলা? যে খেললে খেললাম না খেললে নাই? ঠিকই বলেছো তুমি আসলেই একটা স্বার্থপর। এতটা বছরে একটা বারও কি তোমার মনে পরেছে যে কেমন আছি আমি? আজ তুমি দুঃখ,কষ্টে আছো বলে আমাকে তোমার মনে পরেছে, আজ যদি ঐ ভদ্রলোকের সাথে সুখে থাকতে? তাহলে আমার কথা ভাবতে তুমি? কখনোই না। তাহলে আমি কেন তোমার ইচ্ছার পুতুল হবো বারবার?
কিছুটা সময় চুপ থাকলো আবীর, চোখ জোড়া আবার সেই শো পিস এ নিবন্ধ করে বললো-
: “আমার জায়গায় তুমি নিজেকে বসাও তো,
তুমি কি এত সহজে পারতে ব্যাপার গুলো মেনে নিতে। মাথা দুপাশে নেড়ে বললো- ” পারতে না” এত বছরে আমি আমার জীবণকে গুছিয়ে নিয়েছি, ঐখানে তোমার কোন জায়গা নেই”
কথাগুলো শেষ হতেই একটা লোক এসে দাঁড়ায় দরজার চৌকাঠে, লোকটা আবীরকে বলে
: “স্যার গাড়ি রেডি”
মীরাকে আর কিছু বলতে সুযোগ না দিয়েই উঠে পরে আবীর। ড্রাইভারকে বলে লাগেজ দুটো গাড়িতে তুলতে, বলেি নিজের রুমে গিয়ে তৈরী হয় বেরুবার জন্য।
মীরা সেখানেই বসে কাঁদতে থাকে মুখ ঢেকে৷ ড্রাইভার আবীরের লাগেজ দুটো গাড়িতে তোলে। মিনিট তিনেক পর তৈরী হয়ে বের হয় আবীর৷ জিন্সের সাথে কালো হুডি পরেছে সে। পায়ে সাদা ক্যাজুয়াল কেডস। হাতে ওয়ালেট আর ঘড়ি, ঘড়িটা সম্ভবতঃ গাড়িতে বসে পরবে বলে হাতে নেয়া।
চাচাকে সব চাবি বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় জানাচ্ছে ও। এমন ভাবে কথাগুলো বলছে যেন আবীর আর চাচা বাদে তৃতীয় কেউ নেই পুরো বাড়িতে। মীরা অপলক তাকিয়ে দেখে আবীরকে, আপাদমস্তক ব্যাক্তিত্ববান একজন মানুষ, এতকিছুর ভিতর দিয়ে গেলো ঐ ঘরে কিন্তু কত শান্ত মৌন ভাবে কথা বলছে সে চাচার সাথে।যেন কিছুই হয় নি। খুব কষ্ট হয় মীরার এই ভেবে যে এ মানুষটা ওর নিজের হতে পারতো। কিন্তু ও নিজেই এই ছেলেটাকে রিক্তহস্তে ফেলে এসেছে বিয়ের পরদিন-ই সেই এক যুগ আগে।
আবীরকে অপলক দেখতে দেখতে এসব ভাবছে মীরা। ও জানে যতটুকু ক্ষত ওর মনে এখন তারচে বেশী ক্ষত নিয়ে এতবছর একা আছে আবীর।
কথা শেষে চাচাকে আলিঙ্গন করে আবীর বিদায়ের আগে। বৃদ্ধ ঐ লোকটাকে ভীষণ হিংসে হয় মীরার। তার জায়গায় কল্পনা করে নিজেকে। কত ভাগ্যবান সে আবীর তাকে আলিঙ্গন করে বিদায় নিলো। এসব দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই যেন মীরার। তবে আশা একটা বার দয়া করে তাকায় যদি আবীর ওর দিকে…
কিন্তু………..
শেষ বারের মতো আবীর তাকায় ও না মীরার দিকে। কথা শেষ করে গটগট করে নেমে যায় সিঁড়ি বেয়ে। এ যেন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার শব্দ না, মীরার মনের নদীর পাড় ভাঙার শব্দ।
শেষ আশাটাও যখন ভেস্তে গেলো ওর, ও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। বেবা কান্নায় ফেটে গেলো বুকটা। তবুও অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ায় ও ৷ ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি একধাপ নেমে দেখলো আবীরকে স্টেশনে পৌঁছে দিতে আসা ফিওনাদের গাড়িটা বেরিয়ে গেলো মূল ফটক দিয়ে। চাচা গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বিদায় দিচ্ছে ওকে। তার চোখেও পানি। সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই তা দেখলো মীরা। এ দৃশ্য দেখার পর সিঁড়িতেই বসে পরলো ভাঙা ইমারতের মতো । জীবণের একমাত্র ভুলটাকে সংশোধন করার চেষ্টায় এতদূর এসেও ও তা পারলো না।
“মানুষটা কোন সুযোগই দিলো না ওকে”।
বিরবির করে বলতে থাকে মীরা- “এটাই তোর শাস্তি মীরা, এই ভুলের বোঝা বয়ে চলবি তুই সারাজীবন।
এটাই তোর শাস্তি নিরপরাধকে কষ্ট দেবার, একটা পরিবারকে সমাজের চোখে হেয় করার”
বেশ কিছু সময় পর উঠে দাঁড়ায় মীরা, এখানে থাকলে ওর দম বন্ধ হয়ে যাবে। আবীরের চলে যাবার দৃশ্য কুড়ে কুড়ে খাবে ওকে। তাই সাহস করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে পরে ও। মেইন ফটক দিয়ে বেরুতে ধাক্কা খায় ও, শীতের দিন, তবুও তেমন ব্যাথা অনুভত হয় না ওর।
কাঁপা হাতে স্কুটিটাকে আনলক করে মীরা। জলদি বাড়ি যেতে হবে ওকে, জলদি। স্কুটিটা ধীর বেগে চলছে বাড়ির দিকে। মীরার চোখের দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছছে ঘন ঘন। মনের দ্বিতীয় স্বত্বাটা বলছে ওকে- “এত কাঁদার কি আছে? আবীরকে ছেড়ে আসার দিন তো খুব বিজয়ীর হাসি হেসেছিলে তুমি, তবে আজ কেন ওকে না পেয়ে কাঁদো? একযুগ আগের মতো আবীরও আজ তোমাকে রিক্তহস্তে ফিরিয়ে দিলো। এবাড বুঝো কিসের ভিতর দিয়ে গেছে ও, আর দুটো পরিবার।
গত কয়েক দিনের ক্লান্তি আর ঘুমহীন রাতের ধকলের সাথে আবীরের অবজ্ঞাটা যেন খুব ভারী হয়ে গেলো মীরার পক্ষে। যার ফলাফল হাটখোলা রোডে গাড়ি টার্ন নিতে গিয়ে বাসের সাথে ধাক্কা লেগে মাটিতে পরে গেলো ও। কোন যন্ত্রণাই হলো না ওর, পিচঢালা রাস্তায় পরে গিয়ে কেবল দেখলো কলকলিয়ে আসা গরম র*ক্তে*র সরু একটা স্রোত বয়ে যাচ্ছে কানের কাছ দিয়ে। চোখ দুটি বন্ধ হয়ে এলো ওর। শত চেষ্টায় ও চোখজোড়া খুলে রাখতে ব্যার্থ হলো ও।
চলবে…..
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৮৪
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
দীর্ঘ ঘুম ভাঙার পর মীরার যখন জ্ঞান ফিরলো ও নিজেকে তখন হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করলো। বিছানার পাশেই মেঝেতে ওর মা নামায পড়ছেন। সময় কত তা বুঝতে চেষ্টা করলো মীরা।
চারপাশের নিস্তব্ধতায় মনে হচ্ছে ওর মা ফজরের নামাজ পড়ছেন। মীরা শোয়া থেকে উঠে বসতে চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। মাথা উঁচু করতেই তীক্ষ্ণ একটা যন্ত্রণা অনুভূত হতে লাগলো ওর মাথার বামপাশে, চারপাশ ঘুরতে শুরু করলো, শরীরটাও কেমন গুলিয়ে উঠলো, মীরা আর বসে থাকতে পারলো না, শুয়ে পরলো সাথে সাথে। বিছানায় শুয়েই মীরা ব্যাথার উৎস্য খুঁজতে মাথায় হাত দিলো। বুঝতে পারলো মাথায় ব্যান্ডেজ করা।
শুয়ে পরে মীরা সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেলে ও চারপাশের ঘূর্ণন থামাতে৷ কিছুক্ষণের তাকিয়ে থাকাই মনের উপর চাপ বাড়িয়েছে ওর। কিছু মনে পরছে না ওর। কি ? কেন? কিভবে? এই প্রশ্নের খোঁজ চলছে মনে মনে। একটু বাদেই সবটা মনে পরতেই চোখ গড়িয়ে নোনাধরা বয়ে যায়। অস্ফুটস্বরে বলে উঠে –
: “আবীর….!”
নামাজ শেষ করে ওর মা দ্রুত মীরার কাছে আসে, মেয়ের মুখে,শরীরে হাত বুলিয়ে কেঁদে দেন তিনি।
দ্রুত যান ডাক্তার ডাকতে। ওর কেবিনের বাইরে অপেক্ষায় থাকা লোকটা মীরার জ্ঞান ফিরার কথা শুনে কেবিনে ঢুকে। মীরা বিছানায় শুয়েই দেখতে পায় তাকে। ধীর পায়ে কাছে আসে সে। তাকে আসতে দেখে মৃদু হাসে মীরা। সে হাসিতেও যন্ত্রণা অনুভব হয় ওর মাথায়। তবে মীরা সে হাসি থামায় না। হাসতে হাসতে চোখ বেয়ে পানি পরে। মীরার শিয়রের কাছে দাঁড়ায় সে, মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে-
: ” আমি সরি মীরা”
মীরা মাথায় রাখা হাতটা ধীরে টেনে ওর দুইহাতে চেপে গালের সাথে ধরে রেখে বলে –
: “আপনি কেন সরি বলছেন? সরি তো বলবো আমি?” আই এম সরি আবীর! আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন, সত্যি আমি….” কথাটা শেষ করতে পারে না মীরা। মাথার যন্ত্রণায় চোখমুখ কুচকে পাশ ফিরে ও।
ক্ষীণ কন্ঠে বলা কথাগুলো শুনে মীরার শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা সায়নের চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়। মীরার হাসি দেখে ওর মনের বোঝা হালকা হয়ে গিয়েছিলো এই ভেবে যে আবীরের কাছে কষ্ট পেয়ে সায়নকে বুঝি মেনে নিলো মীরা, কিন্তু অর্ধচেতন মীরা ওকে আবীর ভেবে কাছে টেনে নিয়েছে! হাত ছেড়ে সরে দাঁড়ায় সায়ন। যেন ৪৪০ ভোল্টের শক খেয়েছে । দূর থেকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ও মীরার যন্ত্রণা কাতর মুখের দিকে।
এমন সময় ডাক্তার আসেন কেবিনে। ভোর রাত হওয়ায় ডাক্তারকে ডেকে তুলে আনতে সময় লাগলো কিছুটা। ডাক্তার এসে মীরাকে পরীক্ষা করে, প্রেশার মাপতে মাপতে মীরাকে জিজ্ঞেস করেন- ব্যাথা এখনো আছে কিনা? মীরা ইশারায় ব্যাথার কথাটা জানালো ডাক্তারকে। ডাক্তার আবার জিজ্ঞেস করলো খুব বেশী নাকি সহনীয়? মীরা মাথায় হাত রেখে কেমন একটা মুখভঙ্গি করলো, যাতে ডাক্তার স্পষ্ট বুঝতে পারলো যন্ত্রণার তীব্রতা। নার্সকে কি একটা বলে ওর মা জাহানারাকে জানালো প্রেশার ঠিক আছে, টেনশনের কিছু নেই, ব্যাথা লাঘবে হালকা ঔষধ দিয়ে দিচ্ছে। আরেকটা দিন উনি থাক এখানে, আগামী পরশু আপনারা তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন। বলেই ডাক্তার চলে গেলো কেবিন ছেড়ে। তার আগেই বেরিয়ে গেলো সায়ন, ব্যাপারটা হজম করতে পারছে না ও।
মাথায় ব্যান্ডেজ করায় ওকে দেখতে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।
কানের কাছে মাথায় আাঘতে ফেটে গেছে মীরার, রক্তক্ষরণ হয়ে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিল ও। দীর্ঘ আঠারো ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরলো মীরার। ওর চেহারা ফুলে গেছে, চোখেমুখে যন্ত্রণা আর ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু এমন তৃপ্তির ঘুম মীরা শেষ কবে ঘুমিয়েছে তা ও জানে না। বেশ ভালো লাগছে ওর। মাথার যন্ত্রনাটা না থাকলে ও এখনি চলে যেতো বাড়িতে।
ডাক্তার চলে গেলে মীরার মা ফোন করে ইরাকে জানায় মীরার জ্ঞান ফিরার খবর। মীরা চোখ বন্ধ রেখেই ক্ষীণ কন্ঠে ওর মাকে নূহার কথা জিজ্ঞেস করলো। জাহানারা বললো- “নূহা মাজেদার কাছে আছে। হাসপাতালে ওকে আনা হয়েছিলো, তোকে ব্যান্ডেজ পরা দেখে আতংকিত নূহা ভয় পেয়ে গিয়েছিল, তাই ওকে বাসায় রাখা হয়েছে”
মীরা কিছুটা স্বস্তি পেলো, একমাত্র মাজেদা খলাার কাছে থাকলেই মীরা নিশ্চিন্ত থাকে। কারন নূহা খাওয়া, ঘুম নিয়ে মাঝেমাঝে খুব মর্জি করে। এত মর্জি সহ্য করে কেও ওকে খাওয়াতে কিংবা ঘুম পাড়াতে পারে না, এক মাজেদা খালা ছাড়া।
সকাল হতেই হালকা খাবার খেয়ে ঔষধ খেলো মীরা। কিছুক্ষণ পরেই আবার ঘুমিয়ে গেলো ও। শরীরে রাজ্যের ক্লান্তি, এ ক্লান্তি উপেক্ষা করার শক্তি ওর নেই। এরমধ্যে সকালে মুখলেস চাচা, তার স্ত্রী, ইরা এসে দেখে গেলো ওকে। ইরা আর জাহানারার মধ্যে টুকটাক কথা কাটাকাটি হলো কেবিনের বাইরে। তাদের কথার বিষয়বস্তুু – “মীরার স্বামী হিসেবে আবীরের যোগ্যতা”
পক্ষের বক্তা মীরার একমাত্র বোন ইরা, আর বিপক্ষের বক্তা হিসেবে রয়েছেন মীরার মা-জননী জাহানারা। তিনি আবীরের অযোগ্যতা, দাম্ভিকতা, আর মীরাকে ফিরিয়ে দেয়া নিয়ে প্রশ্ন তুললেন, আর ইরা বললেন এত বছর পর গিয়েছে ওকে নিয়ে নাচবে নাকি? ঠিকই করেছে ফিরিয়ে দিয়েছে, তুমি হলে তোমার ছেলেকে দিতে এমন মেয়েকে এত বছর পর মেনে নিতে। পরের বেলায় বলা সহজ, নিজেকে ঐ জায়গায় বসাও। তাহলেই উত্তর পাবে সব প্রশ্নের। এমন সময় সায়ন এসে পরায় দুই মা-মেয়ে চুপ মেরে যায়। সায়নে দেখে ইরার পিত্তি জ্বলে যায়। মনে মনে বলে-
: “এখানে এই আপদ এলো কোত্থেকে? ”
আবীরের মীরাকে ফিরিয়ে দেয়ার এ ঘনটানর পর জাহানারা পারেন তো সেন্সলেস মীরাকে এ অবস্থায়ই বিয়ে দিয়ে তুলে দেয় সায়নের হাতে৷ কিন্তু ধর্মে বিধিনিষেধ আছে এ বিষয়ে। বিয়ের সময় পাত্রপাত্রী দু’জনকেই বিয়েতে সজ্ঞানে সম্মতি দিতে হবে। কেবিনে তারা আছেন আর সায়ন ওয়েটিং রুমে।
এদিকে মোখলেস সাহেবও অসুস্থ, তবুও মীরার জ্ঞান ফিরবার কথা শুনে ঘরে থাকতে পারেন নি ইরার শ্বাশুড়ি রেবেকা । সাত সকালেই দৌড়ে চলে এসেছেন এ রোগী ঘরে রেখে। তবে খোঁজখবর নিয়ে ইরার শ্বাশুড়ি জাহানারার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। ইরা এসব সহ্য করতে না পেরে হাসপাতালে থাকার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও চলে যায় শ্বাশুড়ির সাথে। জাহানারা আটকায় না মেয়েকে। তিনি বরং পারলে এগিয়ে দিয়ে আসেন ইরাকে। ইরা বুঝতে পেরে খুব বিরক্ত হয় মায়ের প্রতি।
গতরাত থেকে হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে সায়ন।সেখানে বসে মীরার খোঁজ খবর নিয়েছে ও। অপেক্ষা করেছে মীরার জ্ঞান ফিরবার৷ মীরার মা কিছুই লুকায় নি ওর কাছে। কোথায় গিয়েছিলো ও? কিভাবে কি হলো? সব। ব্যাপারটাতে জাহানারার একটা চালাকি আছে, তিনি এসব বললেন যাতে সায়ন ওকে অসহায় ভেবে আগলে ধরে মীরাকে। সায়নও মনে মনে খুশি ছিলো আবীর মীরাকে ফিরিয়ে দেওয়ায়। গোপন কৃতজ্ঞতাও ছিলো ওর আবীরের প্রতি। এবার মীরাকে পেতে ওকে আর ঠেকায় কে?
কিন্তু এসব কি হলো?
মীরার মনে এখনো আবীর?
খুব চিন্তিত দেখায় সায়নকে। কিছুক্ষণ বসে থেকে জাহানারাকে বলে বেরিয়ে যায় সায়ন।
———-
পর দিন বাড়ি ফিরে মীরা। শরীরের ধকল সামলে উঠলেও মনের ধকল এখন সামলে উঠতে পারেনি ও।
কাজে না ফিরলেও ফোনে ফাহাদ আর তমাকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে নিয়মিত। বাসায় রেস্ট নেয়ায় মীরার শরীর কিছুটা স্টেবল এখন।
বাড়ি ফিরার বেশ কিছুদিন পর মীরাকে ফোন করে ফিওনা। এতদিন এসব কোনমতে ভুলে ছিলো ও। ফিওনার ফোন যেন লুকিয়ে রাখা বেদনার পাহাড় উন্মোচিত হলো ওর সামনে। অঝোরে কাঁদে মীরা ফিওনার সাথে কথা বলার সময়। মীরাকে স্বান্তনা দেবার ভাষা জানা নেই ফিওনার। ফিওনা জানায় এ বিষয়ে আবীরের সাথে কোন কথাই বলেনি ও। কারন ও প্রতিজ্ঞা করেছে এ বিষয়ে আর কোন কথা কোনদিন বলবে না। ফিওনা মীরাকে শক্ত হতে বলে। আর বলে ওর কথা বাদ দাও তুমি, দেশে কি ছেলের অভাব নাকি? মীরা উত্তরে ফিওনাকে কান্নারত অবস্থায় বলে-
: “তোমরা কি পেয়েছো আমাকে? একবার বলো আমি পারবো, আবার বলো দেশে কি ছেলের অভাব নাকি? আমি কি এত সহজে হার মানবো ভেবেছো? ঢাকা ছেড়ে গেছেন তিনি, দেশ তো ছেড়ে যায় নি, আর দেশ ছেড়ে গেলেই কি? আমি ঠিক তাকে খুঁজে নিবো ”
মীরার এ কথা শুনে এবার ফিওনার কান্নার পালা। কেঁদে কেঁদে ফিওনা বলে-
: “ঐ বেয়াদবটা তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে, আর তুমি ওর কথা ভেবে কাঁদছো? ”
: “ফিওনা উনি এখনো আমাকে ভালোবাসে, আমি তা জানি”
: “এটা তো সবাই-ই জানে, এ আর নতুন কি? ভালো না বাসলে কেউ কারে জন্য এত বছর অপেক্ষায় থাকে? ”
: “তুমি একটু খাস মনে দোয়া করো আমার জন্য, তার অভিমানের দেয়াল আমি যেন ভাঙতে পারি”
ফোন রেখে থুম মেরে বসে থাকে মীরা। কিছুতেই মনের অস্থিরতা কাটছে না যেন।
সেদিন সন্ধ্যায় মীরাকে দেখতে ওর বাসায় আসে সায়ন। সায়নকে দেখে ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। মীরা ওকে রূঢ়ভাবে বলে বাসা থেকে চলে যেতে। সায়ন মাটি কামড় দিয়ে বসে থাকে। সায়নের মীরাকে জি*ম্মি করার ঐ ঘটনার পর এটাই ওদের প্রথম দেখা হওয়া। মীরা মনের রাগ ক্ষোভ সব ঝাড়ে ওর উপর।
সায়ন নিজেকে কুল রেখে মীরার সব কথা শুনে। শেষে কেবল একটা কথাই বলে- “মীরা সব সত্যি, কিন্তু আমি আপনাকে ভালোবাসি, আপনাকে বিয়ে করতে চাই এটাও সত্যি ”
এ কথা শুনে মীরা আর ধৈর্য রাখতে পারে না। বলেই ফেলে-
: “আমি আর যাই করি, তোমাকে কোনদিন বিয়ে করবো না এটা তুমি জেনে নাও। এখন বের হও আমার বাসা থেকে ”
এবার সায়ন আউট অব কন্ট্রোল হয়ে যায়, সেন্টার টেবিলে থাকা ফুলদানি ফেলে দিয়ে বলে-
: “মাথা ঠান্ডা রেখে অনেক কথা হয়ে, এবার খেলা হবে, হয় তুমি আমার হবা নয়তো তোমার জীবণ আমি জাহান্নাম বানিয়ে দিবো”
: ” তোমার যা মন চায় কোরো, এখন আমার বাসা থেকে বের হও”
বলেই দরজা খুলে দাঁড়ায় মীরা। সায়ন বাসা থেকে যাওয়ার আগে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মীরার দিকে। মীরা ওর মুখের উপর দরজা আটকে দেয়। এতকিছুর মধ্যে সায়নকে মেনে নিতে পারছে না। এমনিই ও আকণ্ঠ ঝামেলায় ডুবে।
এরমধ্যে সায়ন!
পরদিন মীরার ব্যাংকে একটা জরুরি কাজ থাকায় ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও বের হতে হয় ওকে। কাজ শেষ করে ফিরতেই ফোন আসে ফিওনার। কলটা রিসিভ কারা যাচ্ছে না, বারবার কেটে যাচ্ছে। মীরা ভাবে নেটওয়ার্কে সমস্যা হচ্ছে যেহেতু বাড়ি গিয়ে ওয়াইফাই দিয়ে কল করবে। কিন্তু বাড়ি গিয়ে দেখে বাসায় ইরার ওর মা এসেছে, তারা আসবে বলে রেখেছিলো গতকাল। মীরা বাসায় এসে কোনমতে ফ্রেশ হয়ে নাশতা তৈরি করছে তাদের জন্য। ভুলেই যায় ফিওনারকে কল ব্যাক করার কথা।
এমন সময় কার একটা কল এলে ফোনটা হাতে নেয় মীরা। কথা শেষে ফোন রাখতে গিয়ে দেখে হোয়াটসঅ্যাপ এ ম্যাসেজ এসে লোড হয়ে আছে। ভিতরে ঢুকতেই মীরার চোখ চড়কগাছ। ঘন্টা দুয়েক আগে এক গাদা ম্যাসেজ দিয়ে রেখেছে ফিওনা। জিব কামড়ে সেগুলো সীন করে মীরা। ম্যাসেজগুলো দেখে ওর পায়ের নিচের মাটি যেন সরে গেলো।
ম্যাসেজে ভাসছে র*ক্তা*ক্ত আবীরের ছবি, কে বা কারা যেন আবীরকে মেরে র*ক্তা*ক্ত করে ফেলে গেছে একা বাড়িতে। এসবই লেখা আছে তাতে। আবীরের অবস্থা গুরুতর দেখে ওকে ওর চাচারা আকাশপথে ঢাকায় আনছেন উন্নত চিকিৎসার জন্য। মীরা চুলা বন্ধ করে ফোন করে ফিওনাকে৷ ফিওনার ফোন এ্যাঙ্গেজ। ফোন করতে করতে মীরার কানে একটা কথা বাজতে থাকে- “হয় তুমি আমার হবা নয়তো তোমার জীবণ আমি জাহান্নাম বানিয়ে দিবো”
সায়ন!
চলবে……