প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৭৭
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
হাসপাতাল ভ্রমণের যাত্রা দীর্ঘ হয়েছিল সেবার। মীরা সুস্থ হতে না হতেই ইরাকে নিয়ে হসপিটালে এডমিট করতে হয়েছিলো। কন্যার মাতা হয়েছে আমাদের ইরাবতী । খোদা ঐ বাড়িতে প্রথম সন্তান হিসেবে কন্যা উপহার পাঠিয়েছেন। সকলের মনেই বাঁধ ভাঙা আনন্দ। সবচেয়ে বেশী খুশি মুরসালিন আর মোখলেস সাহেব। মুরসালিনের খুশি প্রথম বাবা হওয়ার জন্য হলেও মোখলেস সাহেব খুশি ছিলেন ভিন্ন কারনে।
ইরার শ্বাশুড়ি রেবেকার কন্যার মাতা হওয়ার ইচ্ছের চেয়ে মোখলেস সাহেবের কন্যার পিতা হবার ইচ্ছে বেশী ছিলো। তাই তো মীরার মেয়ে হতে চাওয়ার আবদারে তার মনের পাথর গলে পানি হয়ে গিয়েছিলো। শত্রু থেকে নির্নিমেষে হয়েছিলেন অভিভাবকহীন মীরার পিতা, শুভাকাঙ্ক্ষী। সেসব পুরাতন গল্প।
মেয়ের জন্ম হওয়ার পর দীর্ঘ হসপিটাল যাত্রা শেষে কোথায় ফিরবে ইরা তা নিয়ে দুই বাড়ির লোকেদের মধ্যে টানাটানি অবস্থা। ইরার মা জাহানারা চাচ্ছেন ইরাকে নিজের কাছে রাখবেন। কিন্তু ইরার শ্বশুর, শ্বাশুড়ি এমনকি মুরসালিন ও কেউই তাদের ইরাকে এমন অবস্থায় বাপের বাড়ি যেতে দিবেন না। দুই পরিবারের এমন টানাটানির বিবাদ মিটায় মীরা।
মীরার মেয়ে নূহার জন্মের সময় তিনি দূরে ছিলেন। তাই ইরাকে কাছে রাখার ইচ্ছেটা প্রবল জাহানারার। মীরা ওর মায়ের বালিকা সূলভ আচরনকে পাত্তা না দিয়ে তাকে বুঝালেন তাদের পরিবারে প্রথম সন্তান আগমনের এমন বাঁধ ভাঙা আনন্দ মলিন না করতে। জাহানারা পরে বুঝেছেন, মেয়ের কথা মেনেও নিয়েছেন। মুখলেস সাহেব অনুরোধ করেছেন এই কটা দিন বেয়াইন সাহেবা যাতে তাদের বাড়িতে এসে অবশ্যই থাকেন।
এজ-ইউজুয়াল ডেলিভারি শেষে চারদিনেই বাড়ি ফিরে সকলে৷ কিন্তু ইরার মেয়ের কিছু জটিলতার দরুন ওদেরকে হাপিটালে থাকতে হয়েছে বারো দিন। যেই জটিলতার মধ্যে দিয়ে বাড়ি ফিরলো ওরা, তা বলার মতো না৷ সব ঝামেলা মিটিয়ে ওরা সুস্থ ভবে বাড়ি ফিরেছে এই অনেক তাদের জন্য।
জাহানারা সব মান অভিমান ভেঙে ব্যাগপত্র গুছিয়ে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি রওনা হয়েছেন। দুই বাড়ি দৌড়াদৌড়ি তার জন্য বেশী চাপের হয়ে যাবে। এদিকে মীরারও সব কাজ শেষ করে ইরা আর নতুন বাবুকে দেখে আসতে সময় বের করতে হচ্ছে।
ইরার ডেলিভারির এত ঝামেলার মধ্যে সায়নের ব্যাপারটা একেবারেই মাথায় ছিলো না ওর। তবে ঝামেলা শেষে একদিন অফিসে এসে ডাকযোগে আসা একটা ইনভাইটেশন কার্ড দেখে চমকে যায় মীরা। সেটা খুললে দেখে একটা বড় বিদেশী অর্গানাইজেশনের ইভেন্টে একমাত্র বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মীরাকে তারা ইনভাইট করেছে। অথচ মীরা জানে ওর চেয়ে শতগুণ ভালো প্রতিষ্ঠান রয়েছে বাংলাদেশে যারা এটা পাওয়ার যোগ্য। সেদিক বিবেচনায় মীরা চুনোপুঁটি ও না। ইনভাইটেশন কার্ডটা পেয়ে মীরার মনে পরে সায়নের কথা। এটা ওরই কাজ। কার্ডাটাকে পাশে রেখে ফোন বুক থেকে একটা নম্বর খুঁজে বের করে তাতে কল করে মীরা৷ সালাম দিয়ে আন্তরিক ভঙ্গিতে তার সাথে দেখা করতে চায় ও । তিনও জানান আজ বিকেলেই তিনি ব্যাক্তিগত কাজে দেশের বাইরে যাচ্ছেন আসছে রবিবার দেশে ফিরবে। তিনি মীরাকে বললো মঙ্গলবার দেখা করতে৷ মীরার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায় একসপ্তাহের ধাক্কা। অথচ দেখ করাটা জরুরি ছিলো। উপায়ন্তর না দেখে মীরা সালাম দিয়ে ফোন রেখে দেয়। তমা জিজ্ঞেস করে-
: “কাকে ফোন করলেন?”
: “বিজিএমইএ এর সভাপতি কে”
: “ইভেন্টের প্রস্তুতি শুরু করবো?”
মীরা তমার দিকে তাকিয়ে বলে-
: “আমরা এ ইভেন্টে যাচ্ছি না”
কেন তা জানতে চাইলো না তমা, মীরা আপু যখন বলেছে ভেবে চিন্তেই বলেছে। তাছাড়া তিনি বিস্তারিত বলার প্রয়োজন মনে করলে পরে তা অবশ্যই বলবেন। তাই তমার এত চাপ নেই জানার৷ তবে একটা বিষয়ে মনে কিছুটা জিজ্ঞাসা আছে ওর। সাহসের অভাবে তা পারছে না তমা৷ তা হচ্ছে – “বৃহস্পতিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত কোথায় ছিলেন মীরা আপু?
তার এমন অবস্থাই বা হয়েছিলো কিভাবে?
এমন সময় একটা ফোন আসে মীরার। মীরা ফোনটা তমাকে রিসিভ করতে বলে। আর বলতে বলে:
: ” বলবি মীরা আপু দেশের বাইরে আছে, দেশে আসলে আপনার কথা বলবো”
তমা ফোন রিসিভ করে বলে –
: “কে?”
ও পাশ থেকে সংকোচ মাখা কন্ঠে বলে-
: ” আমি দীপা”
: “কি ব্যাপার?”
: “এটা মীরার ফোন না?”
: ” হ্যা কি ব্যাপার?”
: ” উনাকে ফোনটা দিন একটু ”
: “মীরা আপু দেশের বাইরে আছে, এ সপ্তাহ পর ফিরবেন, তিনি দেশে আসলে আপনার কথা বলবো”
বলেই তাকে কিছু বলবার অবকাশ না দিয়ে ফোনটা রেখে দেয় তমা। ফোন রেখে তমা বের হতেই মীরা ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করে –
: “জিজ্ঞেস করলি না কে?”
: “বলার হলে তো আপনি নিজ থেকেই বলতেন”
মুচকি হেসে মীরা বলে :
: “আই লাইক ইট, বোস চেয়ার টেনে ”
তমা চেয়ার টেনে বসলে মীরা বলতে শুরু করে এই ফোন কলর পেছনের গল্প-
ইরার মেয়েকে কিছু সমস্যার জন্য ঢাকা শিশু হাসপাতালের আইসিইউতে রাখতে হয়েছিলো। সেখানে দৌড়াদৌড়ি করেছিলাম আমি আর মুরসালিন। ঐদিকে ইরা ছিলো হসপিটালে। একদিন বাসায় ফিরতে সিএনজি ধরতে শ্যামলী শিশু মেলার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম । এমন সময়ে কেও একজন আলতো করে আমার কাঁধ হাত রেখে ডাকে আমাকে । চমকে ফিরে তাকালাম আমি, জীবণ আমাকে তো কম চমক দেখায় নি এটুকু বয়সে। ফিরে দেখি একটা মধ্যম গড়ণের সুন্দরী মেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে৷ মেয়েটা সংকোচে বললো-
: “মীরা আমি আপনাকে চিনি, একটু কথা বলা যাবে আপনার সাথে?”
ঢাকা শহরে এমন কথা বলতে চেয়ে অনেকেই অনেক ধরনের অকারেন্স করে, তবে স্যালাইন আর ঔষধ হাতে থাকা বিশেষত্বহীন মেয়েটাকে আমার তেমন সন্দেহ হয় না। তাই আমি বললাম-
: ” জ্বী বলুন”
: “আপনি আমাকে চিনেন না, আমি দীপা, পুরান ঢাকার নবাবপুরে থাকি”
মীরা মনে মনে ভাবে “দীপা!”
মেয়েটা ক্ষণকালের বিরতি শেষে বলে
: ” আমার স্বামী সোহরাওয়ার্দী হসপিটালে ভর্তি আজ পনেরো দিন, একটা অপারেশন করাতে হবে, সরকারি হাসপাতাল তো সিরিয়াল পেতে সময় লাগছে তাই”
এ পর্যন্ত শুনে মীরা ভাবে হয়তো সাহায্য চাইতে এসেছে ও, কিন্তু এখন তো ওর কাছে সাহায্য করার মতো টাকা নাই। এসব সাতপাঁচ ভাবতেই মেয়েটা কেঁদে ক্ষমা চায় মীরার কাছে। মীরা প্রথমে বিরক্ত হলেও ওর নিপাট কান্না দেখে আপ্লুত হয় ওর মনও। তবু্ও শক্ত খোলসটা মুখে এঁটেই রেখে মীরা জিজ্ঞেস করে –
:” কাঁদবেন না, রোগ যিনি দিয়েছেন, নিরাময়ও তিনিই করবেন”
মেয়েটা চোখের পানি মুছে বলে-
: “আমি কাঁদছি অন্য কারনে”
: “অন্য কারনে?”
: “হ্যাঁ, আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে”
: “ক্ষমা! ”
: “হ্যা ক্ষমা, আসলে আপনার মন এত বড় যে আপনার সামনে দাঁড়াতেই লজ্জা হচ্ছে, কিন্তু নিজের ভুলের ক্ষমা চাওয়ার এমন সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করতে পারলাম না, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন ”
: ” ক্ষমা কেন চাইছেন তাই বুঝলম না, তাছাড়া আমি কোন বাজে কিছু সাথে নিয়ে বয়ে বেড়াই না, যা যখন হয় তা সেখানেই ক*ব*র দিয়ে সামনে এগিয়ে যাই, তা যদি না পারতাম তাহলে আজকের আমার বেঁচে থাকাটাই দায় হতো, এসব বাদ আপনি বলুন কেন ক্ষমা চাইছেন?”
: ” আপনি আমার স্বামীর জীবণ বাঁচিয়েছেন এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ, আর আমি আমার ব্যবহারের জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি”
এবার একটু নড়েচড়ে দাঁড়ায় মীরা, ও যেন একটু একটু করে চিনতে পারছে ওর সামনের দাঁড়ানো মেয়েটাকে।
মেয়েটা মীরার হাত নিজের দুই হাতে মুঠো করে কেঁদে ফেলে৷ বলে-
: “আসলে আমাদের কিছুই তো নেই, যেটুকুই তা ওর পাবে দাদা বাড়ি থেকে। সেদিন ওর বাবার সম্পত্তির ভাগিদার বাড়বে ভেবে আপনার মেয়ের জন্ম নিবন্ধন করানোর জন্য ওর বাবার ভোটার আইডি কার্ড চেয়ে পাঠানো মহিলাকে আমি অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম, আমি এতই হীন, নীচ যে…. ”
কথাটা শেষ করতে পারে না দীপা। পথের মধ্যে কান্নায় ভেঙে পরে ও মীরার দুই হাত চেপে ধরে। মীরা ওকে স্বান্তনা দেয়, আর বলে-
: “আপনি আমার অনেক বড় উপকার করেছেন দীপা, ভালোই হয়েছে তা নাহলে শুধু একটা পরিচয় নিয়ে জীবন ভর…..। আমি চাইনা ওর ছায়া আমার মেয়ের জীবণে পরুক। আসি দীপা আপনাকে আমার মনে থাকবে”
বলেই সেখান থেকে একটা সিএনজি ডেকে উঠে পরেছিলাম আমি”
অবাক হয়ে তমা জিজ্ঞেস করে –
: “দীপা কি রাজিবের বর্তমান স্ত্রী? ”
মীরা রিভলভিং চেয়ারটায় শরীর ছেড়ে দিয়ে বলে-
: “হ্যা”
: “আচ্ছা গত মাসে বড় একটা এমাউন্ট ডোনেট করলেন এটা কি দীপার স্বামীর জন্য ছিলো?”
: “হ্যা ঐ টাকাটা নূহার বাবার চিকিৎসার জন্য দান করা হয়েছিল ”
কথাটা শুনে মীরার চোখের দিকে তাকায় তমা, মীরাকে পড়ার ব্যার্থ্য চেষ্টা করে ও। তারপর ক্ষীণ কন্ঠে বলে-
: ” অন্য কোন অনুভূতি ছিলো কি?”
: “তুই এখনো চিনিস নাই আমাকে, ও ম*রে গেলেও আমার কিছু আসবে যাবে না, ও আমার কাছে সেই নিলামের দিন থেকেই মৃ*ত”
চলবে…….
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৭৮
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
মাস হতে চললো দেশে এসেছে লোরা। এবার বেশ সময় হাতে নিয়েই ফিরেছে, রাহাত আসেনি। ও শেষের দিকে এসে ফিরবে ওদেরকে নিয়ে৷ লোরার বাড়ি তৈরীর জন্য জায়গা কিনেছে বেশ আগেই। সেখানে বাড়ির কাজ শুরু করবে। তার আগে জায়গাটা লোরা দেখাতে চায় মীরাকে। মীরা বলেছে সব হবে, আগে আমার বাসায় আসবে তুমি, সেখানেই আলাপ হবে।
মীরা ওদেরকে নিজের বাসায় দাওয়াত করেছিলো।
লোরা ওর ছেলে আর ছোট বোনকে নিয়ে আসবে মীরার বাড়িতে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে। তবে মীরা ওদেরকে ঢাকার ভাড়া বাসায় দাওয়াত করেনি। দাওয়াত করেছে ওর গাজীপুরের বাড়িতে। গাজীপুরের বাড়ির কথা শুনে খুশিই হয় লোরা। এতে করে বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি তৈরীর একটা ধারনা পাওয়া যাবে।
মীরার গাজীপুরের বাড়িটা একটু ভিতরের দিকে। গাজীপুর মাস্টার বাড়ি ছেড়ে, গাজীপুরের চৌরাস্তা থেকেও সেখানে যেতে আধঘন্টার মতো লাগে৷ তবে রাস্তাঘাট এখন বেশ সুন্দর। যখন জায়গা কিনেছিলো তখন রাস্তার বাজে অবস্থায় নাকাল ছিল ওরা। এ নিয়ে রাজিবের ও কম কথা শুনতে হয় নি ওর। তবে এত এত ভুলের মধ্যে এই কাজটা ওর জন্য বর পাওয়ার মতো । জমির দাম বেড়ে ডাবল হয়েছে এ কয় বছরে। এক বিঘার চেয়ে একটু কম এই জায়গাটা মীরা আট বছর আগে কিনেছিলো দেড় লক্ষ প্রতি কাঠা করে। যদিও পুরোটা একবারে কিনতে পারেনি ও। প্রথমে কিনেছিলো আট কাঠা। জায়গার মালিক ভদ্রমহিলা তার স্বামীর চিকিৎসা করতে খাস জমি বিক্রি করেছিলেন। ততদিনে মীরার সাথে জমির মালিক মহিলার বেশ আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ও জায়গা দেখতে গিয়ে এক-দুই দিন যাই থাকতো তাদের বাড়িতে বেড়াতো। ওরা সেখানে গিয়ে বাজার সদাই, রান্নাবান্না করে তাদের বাড়িতে বেড়াতো। বাবা-মা পরিবারহীন মীরার ওটা যেন পরিবার ছিলো। মীরার গাছের ভীষণ শখ, ও প্রায়ই এমন গিয়ে গাছপালা লাগিয়ে আসতো। তাকে বলতো এসব দেখে রাখতে। এমনি করে যেতে আসতে তাদের একজন হয়ে উঠেছিলো মীরা।
মহিলার কোন ছেলে নেই। স্বামীর মারা গেলেই তা তার ভাসুর দেবেরের ছেলেরা দখল করবে। ভদ্রমহিলার স্বামী তাই অসুস্থ অবস্থায় বেঁচে থাকতেই স্ত্রীর নামে সব সম্পত্তি লিখে দেন যাতে তার অবর্তমানে কেও সম্পদ জবরদখল করতে না পারে। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর তাদের আত্মীয়রা খুব সমস্যা করছে। ভদ্রমহিলা এখন নিজ বাড়ি ছেড়ে তার বাবার বাড়িতে থাকেন। এমন বিপদে পরে তিনি মীরাকে অনুরোধ করেছিলেন বাকী জায়গাটা ও কিনে নিতে। তিনি সবকিছু খুলেই বলেছে মীরাকে। মীরাও শুরু থেকে জানতো কিছুটা। কিন্তু মীরার এত টাকা তখন ছিলে না। মীরা বলেছে খালাম্মা আমি সবটা যে কিনবো এত টাকা আমার এখন নাই। তিনি মীরাকে বলেছেন তুমি শুধু জমি দখলে নাও, বাড়ির কাজ শুরু করো। টাকা না-হয় পরে দিয়ে দিও। কাগজপত্রও ঐ ভাবেই তৈরী করো। আমার এক মেয়ে আগের ঘরের হতে পারে কিন্তু মেয়ে দুটোর মা তো আমি-ই। ওদের একটা ভবিষ্যৎ আছে৷ ওদেরকে বিয়ে দিতে হবে৷ তোমার থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে আমার দুই মেয়ের বিয়ে দিবো। এখন তো বড়টা মাত্র কলেজে ভর্তি হবে। ছোটটা পড়ে ক্লাস এইটে আমার হাতে এখনো বছর পাঁচেক সময় আছে।
মীরা তাঁকে বলেছিলেন-
: “আপনি যে আমাকে এত ভরসা করছেন, আমি যদি চিট করি আপনার সাথে?
ভদ্রমহিলা মীরার দিকে চেয়ে থেকে বলেছিলেন-
: ” যে কষ্ট করে বড় হয় সে অন্যকে কষ্ট দিতে পারে না। কারন সে জানে কষ্টের কত যন্ত্রণা, আমি যদি জায়গাটা এখন বিক্রি করতে না পারি ওরা দখলে নিয়ে নিবে, তাছাড়া তুমি ভিন্ন কাওকে যে খুঁজবো তাও আমার পক্ষে এখন সম্ভব না। চারদিকে সুযোগ সন্ধানী।
আমার কিছু হারানোর ভয় নাই মা, আমার সবটাই চলে যেতো, তুমি যদি জায়গাটা নাও, টাকাগুলো পাই তবে এটা আমি বাড়তি পাওনা ধরে নেব”
মীরা নিষ্পলক চেয়ে ছিলো তার দিকে৷ এ যুগে এত সরল মানুষ হয়?
মীরা চিট করেনি তার সাথে। তার করা ভরসার দাম দিয়েছে ও৷ তিন বছর সময় নিয়ে বাকী দশ কাঠা জমির দাম পরিশোধ করেছে। একদাগে আঠারো কাঠা জমি কিনবার গল্প এটা।
জমি বিক্রির টাকাটা তার খরচ হয়ে যেতে পারে ভেবে মীরা দায়িত্ব নিয়ে অন্যত্র জমি কিনে দিয়েছে তাকে৷ সেখানে ঘর তুলে নিজে থাকেন ভাড়াটিয়াও আছে সাত জন। সেই টাকায় তার সংসার চলে। বড় বোনের মতো ভালো ছেলে খুঁজে বিয়ে দিয়েছেন তার বড় মেয়েকে। মীরার এমন ভালোবাসা ভদ্রমহিলার সেই সময়ে করা ভরসা দাম। এমন সুযোগ না পেলে হয়তো মীরা এক দাগে এত জমি কিনবার কথা ভাবতেও পারতো না। সে-সব পুরোনো গল্প। জীবণ মীরাকে এতটাও ঠকায়নি। এমনি কুড়িয়ে পাওয়া ভালোবাসায় মীরার জীবন পূর্ণ ছিলো। এমন পাওয়া ভালোবাসা ক’জনের ভাগ্যে জুটে?
অবশেষে লোরা ওর ছেলে আর ছোট ভাই বোনকে নিয়ে আসে মীরার গাজীপুরের বাড়িতে৷ গাড়ি পার্কিং এ রেখে লোরার চক্ষু চড়কগাছ। ছবির চেয়েও সুন্দর আর প্রাণবন্ত মীরার এই বাড়ি। মেইন রাস্তা থেকে একটু ভিতরের এই বাড়িটার মূল প্রবেশ দাঁড়ের দুই পাশে দুটি বিশাল শিমুল গাছ আগলে রেখেছে যেন গেইটটাকে৷ পুরো বাড়ির দখল যেন গাছেদের হাতে৷ গাছ দিয়ে এত সুন্দর আর যত্ন করে বাড়ির সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়েছে যে বাড়িটাতে ঢুকে চোখ যেন শান্তি পেলো। গাড়ি থেকে নেমে গাছগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে ভিতরে ঢুকলো লোরা। হাঁটা পথটা সুন্দর করে বাঁধানো। একপাশে গাড়িবারান্দা অন্য পাশে বসবার জায়গা করা হয়েছে। ভিতরে ঢুকে প্রশান্তিতে মন ছেয়ে গেছে। এত অল্প জিনিসে, এত সাধারণ আসবাবপত্রের সাথে যত্নের ছোঁয়া মিশিয়ে কি সুন্দর বাড়ি তৈরি করেছে মীরা।
ভিতরে ঢুকে আপ্যায়ন করতে সুযোগ দেয় নি লোরা মীরাকে৷ হেঁটে হেঁটে পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখেছে ও সবার আগে৷ এ বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার হচ্ছে প্রথম তলার দেয়ালের উচ্চতা। প্রাচীন আমলের বাড়িগুলোর মতো বেশ উচু প্রথম তলাটা। ছয়টা বেড রুম। চারটা বাথরুম, ড্রাইং ডাইনিং মিলে ছোট্ট একটা বাড়ি এটা। বাড়ির পেছনে সুন্দর সুইমিং পুল। পাশেই দিন শেষে বসবার ছোট্ট একটু জায়গা। খোলামেলা এই বাড়িটা পুরো জায়গাটার ঠিক মাঝখানে করায় আলো-বাতাসে ভরপুর সব ঋতুতে। গ্রীষ্মের গরম, কিংবা বর্ষার বৃষ্টি বিলাস উপলক্ষ্য যাই হোক সব সাজে সাজিয়ে নিবে সে নিজেকে।
ভিতরে ঢুকে লোরা আরো টের পায় মীরার কতটুকু যত্নে গড়া এই বাড়িটা। দেয়ালে সুন্দর সুন্দর হাতের তৈরী ক্রাফট ওয়াল পিস, মেঝের শতরঞ্জি, সাইড টেবিল, বুকশেলফের শো পিস খুবই সাধারন তবে একটু আলাদাও। এগুলো সব দেশ-বিদেশের নানান জায়গা ঘুরে ঘুরে কিনছে ও। পুরো বাড়িটাতে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের এক অপূর্ব মিশেল, আর ভিন্টেজ ভাইভ। মানুষ টাকা খরচ করে দেশি জিনিসে বিদেশি আদল তৈরী করে। এ দিকে মীরা হেঁটেছে উল্টো। ও বিদেশী জিনিস তৈরি করিয়েছে দেশীয় আদলে। আসবাব তৈরীর সময় জ্ঞান সবখান থেকে নিয়েছে, কিন্তু তৈরীর সময় তা দেশীয় আদলে বদলে দিয়েছে। ২য় তলার বিশাল বসবার ঘরের দুটো দেয়াল কাঁচের, যা ইচ্ছে মতো খোলা বন্ধ করা যায়, আর বাকী দুটো দেয়ালের একটাতে বিশাল বুকশেলফ৷ যাতে রয়েছে তিন হাজার দেশী বিদেশি বই। আরেকটাতে সেম প্যাটার্নের সেলফ ভরে আছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের এক একটা টুকরো। গ্রাম বাংলার ঢেকি, মাছ ধরার পোলো, কুলা, টেরাকোটার পুতুল, পাত্র, নকশিকাঁথার ফ্রেম, জামদানী কাপড়ের তৈরী ফটোফ্রেম। যেটাতে হাস্যজ্জ্বল মীরা, নূহা, ওর মা, ভাই, বোন, মোকলেস চাচা, তার স্ত্রী, মুরসালিন ওর বাকী তিনভাই সকলে৷ মীরা যাদেরকে ওর নিজের পরিবার মনে করে। ধর্মীয় দৃষ্টিতে ছবি ব্যাপারে নিষেধ থাকায় ছোট্ট এ ফ্রেমটায় ছবি রেখেছে ও। পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে লোরার যেন ক্লান্তি নেই। লোরার সবচেয়ে যা পছন্দ হয়েছে তা হচ্ছে মীরার বাথরুম। বিশাল সাইজের এই বাথরুমের ফিটিংস গুলো সব বাইরে থেকে আনানো। গাছেদের আধিপত্য সেখানেও রয়েছে সমানতালে। মীরার খুব ভাল লাগে লোরার এ বাড়িটা এত পছন্দ হওয়ায়। কারন ওর মনে তো ভিন্ন কিছু চলছে।
দুপুরের পর খাওয়াদাওয়া করে গল্প জুড়ে ওরা। লোরা বলে –
: “আমি দেশে ফিরে আসবো খুব শীঘ্রই। তুমি কথা দিয়েছিলে আমাদের বাড়িটা নিজে দায়িত্ব নিয়ে করে দিবে। নিজের বাড়ির মতো যত্ন নিয়ে করে দিবে, বুঝলে
এক্কেবারে তোমার এই বাড়িটার মতো করে”
মীরা খাওয়া থামিয়ে বলে –
: “যদি এ বাড়িটাই তোমাদের হয়? ”
এবার অবাক হওয়ার পালা লোরার। বলে-
: “আরে ধূর, এটা আবার হয় নাকি?”
: ” খুব হয়, তেমার পছন্দ না হলে আর তুমি ভারী বোধ না করলেই হলো”
: “আরে না না, কত যত্ন, সময় নিয়ে করেছো তুমি অপছন্দ করার উপায় আছে?”
: “তোমারটাও তো যত্ন, সময় নিয়ে করতে হবে, তারচে বরং এটাই নাও”
: ” কোন তাড়াহুড়ো নাই আমার, তুমি সময় নাও”
: “লোরা, তুমি আর রাহাত আমার জন্য যা করেছো তার বিনিময়ে এ বাড়ি কিছুই না, আজ আল্লাহ আমাকে এমন জায়গায় পৌঁছে দিয়েছেন যে আমি চাইলেই এমন একটা বাড়ি তৈরী করতে পারবো। সত্যি বলতে এ বাড়িটা আমাকে আমার অতীত মনে করে দেয়। আমি এর থেকে মুক্তি পেতে চাচ্ছি, তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে না এই অতীত থেকে মুক্তি পেতে?”
এবার যেন জব্দ হলো লোরা। মীরাকে জিজ্ঞেস করলো
: “মীরা, কত টাকার এসেট এটা?”
: “তিন লক্ষ টাকা মাত্র, যেটা রাহাত এক যুগ আগেই পেইড করে দিয়েছিলো”
খাওয়া রেখে লোরা অবাক চোখে তাকায় মীরার দিকে, মীরা মুচকি হেসে মাথা ঝাকায়, যার অর্থ সত্যি।
লোরা জানে কোন তিনলক্ষ টাকার কথা মীরা এখন বলছে। রাহাতের দেয়া মীরার ব্যাবসা শুরুর সেই তিন লক্ষ টাকা এই পুরো বাড়িটার দাম ধরেছে মীরা।
বিকেল চা নাশতা খাওয়ার সময় বাড়িতে আসে মীরার ব্যাক্তিগত এডভোকেট রামীম, সব কাগজপত্র তিনি আগেই তৈরি করে এসেছেন। লোরা অবাক হয় এমন সময়ে এডভোকেট এর আগমনে। সবটা শুনে লোরা বিরক্ত হয়ে বলে- “আর ইউ ক্রেজি মীরা? আমি এখনো রাহাতের সাথে কোন আলাপই করি নি। পাগলের মতো উকিল টুকিল ডেকে অস্থির”
মীরা হেসে বলে – “আজ জানলে তুমি! আমি যে পাগল? ”
—————–
এরপর কেটে গেছে বেশ কটা দিন। শীত পুরো খুঁটি গেড়ে বসেছে প্রকৃতির বুকে। মীরার প্রিয় ঋতু শীত, যদিও আলসেমি লাগে কাজকর্ম করতে তবুও। মীরার নিজেকে খুব হালকা বোধহয় আজকাল। কারন ওর এই জোরপূর্বক ঋণমুক্তি ওকে আরো যেন শক্তিশালী করেছে মননের দিকে। সত্যি এ বাড়িটায় রাজিব নামের একটা অংশ মিশে ছিলো। বাড়ির মূল ফটকের যে শিমুল গাছ দুটো সেদুটো রাজিবের নিজ হাতে লাগানো। সুইমিংপুলের ডিজাইন ওর রাতজাগা পরিশ্রমে তৈরী করা। দীর্ঘ দেয়াল, বসার ঘরে বেডরুমের কাঁচের দেয়াল তৈরী ওর মস্তিষ্ক প্রসূত ভাবনা। মেঝের টাইলস, বাথরুমের ফিটিংস এগুল ও ঘুরে ঘুরে করেছে।
এগুলো চাইলেও বদলে ফেলা যাবে না রাজিবের মতো। তাছাড়া রাহাত, লোরা অনেক করেছে মীরার জন্য। মানসিক, আর্থিক এমন সাপোর্ট ওদের থেকে না পেলে আজকের মীরা হারিয়ে যেতো জীবণের ঘর্ণিবাতে। কিন্তু মীরা শক্ত হাতে মোকাবিলা করেছে এসবের। সাহস, শক্তি জুগিয়েছিল এসব মানুষেরা। পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে, ঋণ মুক্ত হতে দিনরাত এক করে দিয়েছে ও।।
মীরা এখন অনেক ক্লান্ত। উদ্দেশ্যহীন এই ব্যাস্ততা কিসের জন্য? এসব প্রশ্ন খুব খোঁচায় ইদানী ওকে।
ওর একটু বিশ্রাম দরকার। কারখানায় কাজের চাপ কম থাকায় বাড়িতেই থাকে বেশীরভাগ সময়। নিয়ম করে দেখে আসে ইরার মেয়েকে। অবসরের এ দিনগুলো যত স্বস্তির ততোটাই কষ্টের। কিছু কথারা চারপাশে ঘিরে ধরে মীরাকে এই অবসরে। মনে করিয়ে দেয় তুমি এখনো ঋণমুক্ত হও নি প্রিয়। আরো বড় ঋণ রয়ে গেছে তোমার।
মীরার ভীষণ কান্না পায়, একটা মানুষের জীবণের বারোটা বছর ও গুম করে ফেলেছে। এর শোধ ও কিভাবে দিবে? আদৌ পারবে কি?
এমনি ভাবনা ঘেরা এক বিকেলে মীরার বাড়ি আসে ফিওনা। যন্ত্রণার ষোলোকলা পূর্ণ হলো যেন। ফিওনা এসেছে বিদায় নিতে ও চলে যাচ্ছে আগামীকল। অনেকের সাথে দেখা হয় নি, অনেক কাজও বাকী, তবুও সব ফেলে মীরার দরজায় এসেছে ও। মীরা খুব বুঝে কেন তুমুল ব্যাস্ততার এ সময়ে ওর কাছে এসেছে ফিওনা।
মীরা কিছু না বোঝার ভান করে উষ্ণ আন্তরিকতায় আপ্যায়ন করে ওকে। ফিওনা যেন কথা হাতরে খুঁজছে ওর শব্দভান্ডার থেকে, কিন্তু পাচ্ছে না। শেষটায় ফিওনা তুলেই ফেললো কথাটা। গলা ঝেড়ে বলল-
: “আমি জানি তুমি কি ভাবছো?”
: “কি ভাবছি?”
: “ভাবছো কেন এলাম?
: ” আরেহ্ না”
: “মীরা আমি তোমার বয়সে বড়, কিন্তু সম্পর্কের দিকে ছোট, যে সম্পর্ক তুমি না মেনে চলে গিয়েছিলে। আমি আমার ভাই দু’জনেই কিন্তু এই সম্পর্কটাকে বয়ে চলেছি, তুমি অন্য কারো স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও আমি তোমাকে আমার ভাবীই ভাবতাম। যাই হোক ঐদিন তো সবই শুনলে নিজের কানে। আমি এসব থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছি, কসম কেটেছি ভাইয়ের সাথে এসব নিয়ে আর কিচ্ছু বলবো না ওকে। কিন্তু ভাইটার কষ্টে আমার বুক ফেটে যায় জানো। তবুও এ অবস্থার একটা সমাধান না করে চলে যেতে হচ্ছে আমাকে। আমি কত অসহায় দেখেছো।
এমন অবস্থায় ঝরঝর করে কেঁদে দেয় মীরা। শ্লেষ্মা জারানো গলায় বলে-
: ” আমি অনেক ভেবেছি ফিওনা, কিন্তু কোন পথ খুঁজে পাচ্ছি না, এসব ভাবতে ভাবতে আমার মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যায়, তবুও কোন দিশা পাই না আমি, জানিনা আমি এসব ঠিক করতে পারবে কি না”
: “কেও যদি এসবের সমাধান করতে পারে সেটা একমাত্র তুমিই, তুমি পারবে মীরা অবশ্যই পারবে”
: ” আমি সব দিক ভেবে দেখেছি ফিওনা, আমার পক্ষে এত কষ্টে, শ্রমে গড়া ব্যাবসা ছেড়ে উনার সাথে গ্রামে যাওয়া সম্ভব না, যতটা না ব্যাবসার মায়া তারচে বেশী ঐখনকার পরিবেশ পরিস্থিতির কথা ভেবে। ধরো সব ছেড়ে গেলাম আমি কিন্তু গ্রামের সবাই জানে এত বছরেও উনি বিয়ে করেন নি। তারউপর আমার মেয়েটাকে নিয়ে গিয়ে সেখানে বসবাস করা, এটা অসম্ভব ফিওনা”
: ” তুমি এত মাথা মোটা কেন মীরা, এটা যে ওর অভিমানের কথা তা তো আমার মেয়েটাও বুঝবে, আর তুমি বুঝলে না, ও জানে তুমি এটা কখনোই মানবে না, তাই এটা বলেছে”
: “তাহলে?”
: “ক্লাসে যখন বাচ্চারা চেচামেচি, শোরগোল করে তখন টিচাররা কি করে মীরা? ওদের করা শোরগোলের চেয়ে বেশী শব্দ করে ওদের মনোযোগ নেয়, তোমাকেও তাই করতে হবে, ও তোমাকে ভালোবেসে অন্তরালে চলে গেছে , তুমুল ভালবাসা দিয়ে তোমাকে ওকে সেখান থেকে বের করে আনতে হবে”
কেমন একটা ঘোরলাগা চোখে তাকায় মীরা ফিওনার দিকে। ফিওনা ওর হাতটা ধরে বলে-
: ” পারবে না?”
মীরা মাথা নিচু করে ছিলো এতক্ষণ, ওর জিজ্ঞাসা শুনে ক্রন্দনরত মীরা তাকায় ফিওনার দিকে। ফিওনা মীরাকে ইশারায় আশ্বাস দেয়। কিছু না বলেও সে আশ্বাস যেন বলছে- “তুমি অবশ্যই পারবে মীরা”
এরপর আরো অনেক কথা হয় দুজনে। উঠবার আগে ফিওনা বলে- “আমি আগামীকাল চলে যাবো, পরশু আবীর ঢাকা ছাড়বে। একদিন সময় তোমার হাতে। ফেলে যেহেতু তুমিই চলে গিয়েছিলে, অভিমানী ওকে তুলে নিতে দোষ কি? ”
মীরা তখনো নতমুখী৷ এবার উঠে পরে ফিওনা। যাওয়ার আগে বলে-
“তোমাদের পূর্নমিলন হবে কি না জানি না মীরা, কিন্তু তুমি সবসময়ই আমার ভাইয়ের বৌ হয়েই থাকবে আমার কাছে। আল্লাহ তোমাদের মনের ইগো দূর করে দুজনকে আবারো এক করুক” অন্য মনস্ক মীরা অস্ফুটস্বরে বলে উঠে “আমীন”
ফিওনা হেসে দেয় ওর মুখে আমীন কথাটা শুনে৷ বেরিয়ে গিয়েও আবারো বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে মীরাকে। সহাস্য কন্ঠে বলে সুম্মা আমীন। মীরাও হেসে দেয় কি হলো তা বুঝে।
চলবে…..
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৭৯
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
বিদায় নিয়ে চলে গেলো ফিওনা। দেশ থেকে শেকড় তুলে আগামীকাল চলে যাচ্ছে ও। ফিওনা যাবার পরও বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো দড়জার চৌকাঠে। মেয়েটা ওকে চিন্তার সাগরে ভাসিয়ে গেল, কিন্ত সঙ্গে দিয়ে গেলো আশা নামের ভেলা। এই ভেলা দিয়ে দূর্গম সাগর ও পারবে কি পাড়ি দিতে? এই এক প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে ওর মাথাতে।
কিভাবে কি করবে তা ভাবতে ভাবতে মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায় মীরার। এত ভেবেও চিন্তার কূলকিনারা করতে পারে না ও। যতটা সহজে বলে গেলো ফিওনা ততোটাও সহজ না ব্যাপার গুলো। তার উপর আবীর নিজে ব্যাপারটা কিভাবে দেখে সেটাও ভাববার বিষয়। মীরা আনমনে ভাবে এসব। এমন সময় ফোন আসে ম্যানেজার ফাহাদের। ওদের পরবর্তী কাজের জন্য ব্যাংকে করা এল.সি এর আবেদন অজানা কারনে ক্লোজ করে দিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। মীরা প্রথমে উদ্বিগ্ন হলেও কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারে ব্যাপারটা। ওদের টিন সার্টিফিকেট, বিন সার্টিফিকেট সবই আপ-টু-ডেট। তারপর কেন এটা রিজেক্ট হবে তা বেশ ভালো করেই টের পায় মীরা৷ গত সপ্তাহে ও, সায়নের বাবা এবং মায়ের সাথে আলাদা আলাদা ভাবে দেখা করেছে৷ বাবা ছেলে এক জোট। তারা সবকিছুই সহজ চোখে দেখে। এসি গাড়িতে বসে সানগ্লাস চোখে দিয়ে কি রোদের তেজ কত তা বোঝা যায়? এরা বাপ-বেটা দুজনই সানগ্লাস চোখে আঁটা পাবলিক। সায়ন মীরার বয়সের পার্থক্য কম করে হলেও পাঁচ বছর বেশী, তার উপর মীরা সংসার করেছে ওদের বয়সের পার্থক্যের চেয়েও বেশী সময়। প্রায় আট বছর, মেয়েও আছে একটা। এসব কোন সমস্যাই না এদের চোখে। তার মানে এটা না যে সায়নের ভালোবাসা মিথ্যে। কিন্তু ওর ভালোবাসার গন্তব্যের উদ্দেশে হাঁটা পথটা ভুল। পিছুপিছু ঘোরা, যখন তখন ফুল পাঠানো, সবার চেয়ে স্পেশাল ভাবে মীরাকে দেখা, ভালোবাসি ভালোবাসি ফর্মেটেড কথাবার্তা, টেক্সট এ পর্যন্ত ঠিক ছিলো।
কিন্তু জোর করে ভালোবাসা আদায় করতে জিম্মি করা? আর মীরার সার্বাঙ্গে ওর শরীর লেপ্টে আলিঙ্গনরত অবস্থায় করা গভীর চুম্বন? এগুলো চরম প্রাকারের বাড়াবাড়ি ছিলো। এ পর্যন্ত ভেবে মীরার শরীরে একটা কম্পনের সৃষ্টি হয়। চুম্বন ব্যাপারটা কত মধুর যদি তার শুরুটা হৃদয় থেকে হয়। কিন্তু সায়নের ভালোবাসার শুরুটা মীরার বাইরের আদল দেখে। নিঃসন্দেহে মীরা সুন্দরী, লাস্যময়ী, নিখুঁত ওর গায়ের গড়ন। উচ্চতা, ওজন, গায়ের রঙ, মুখের আদল, চোখ, নাক, ঠোঁট এমনকি চুল ও মোহনীয় ওর। ওকে দেখলে বুকে হৃদকম্পন বাড়ে সকল পুরুষের। কৈশোর না পেরোনো মীরারকে পুত্র বধূ করতে কত ছেলের বাবা-মা আলাদা সমীহ করতো ওর বাবা-মাকে তার ইয়ত্তা নেই। এসব এড়াতে খুব ছোট থেকেই ওকে ওর বাবা স্কুল, কোচিং এসবে নিজে দিয়ে আসতো আবার নিয়ে আসতো। নিজের ব্যাবসা থাকায় এ দায়িত্ব পালনে মীরার বাবাকে বেগ পেতে হয়নি।
নিখুঁত এ সৌন্দর্যের জন্য গোপন অহংও ছিলো মীরার। বান্ধবীদের বলেছিলো ওর মতো সুন্দর কাওকে ছাড়া বিয়েই করবে না ও। সময়ের আর্বতনে দেখা হয় মীরার রাজপুত্র রাজিবের সাথে। রাজার ছেলের চেয়ে কোনদিকে কম না রাজিব। গায়ের রঙ সুন্দর, বাঙালি ছেলেদের গড় উচ্চতার চেয়েও লম্বা ছিলো রাজীব , চওড়া কাঁধ, চ্যাপ্টা শরীর, টিকালো নাক, সুন্দর মায়া ভরা একজোড়া চোখ, যেন কোন শিল্পীর হাতে আঁকা নিখুঁত ছবি মানুষ সে। বাউণ্ডুলে হওয়া সত্ত্বেও এই চোখেই ডুবে মরেছিলো মীরা। ওদের প্রেম যখন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছে ছিলো আর হুট করে মীরার বাবা অসুস্থ হলে এসব ঝামেলা এড়াতে আবীরের মা নিজ থেকে মীরাকে একমাত্র ছেলের বৌ করতে প্রস্তাব রেখেছিলেন জাহানারার কাছে। আবীর শিক্ষিত, ভদ্র, ব্যাবসায়ী ছেলে, বয়সের পার্থক্য একটু বেশী আর গায়ের রঙ কালো। এ ছাড়া সোনার টুকরো ছেলে ও। আবীরের মা তার কালো পুত্রের জন্য লুফে নিতে চেয়েছিলো সুন্দরী মীরাকে , আর মীরার মা মেয়ের গোপন কেলেঙ্কারির ঢাকতে আর এসব ঝামেলা এড়াতেই বিয়ের পরামর্শ রাজি হয়েছিলেন। জাহানারা আর আবীরের মা দুজন মিলে বুদ্ধি করে আংটি বদলের দিন বিয়ে পড়িয়ে দেয় ওদের।
কিন্তু সায়ন ওর হৃদয় স্পর্শ করার আগেই ওর শরীর স্পর্শ করে ফেলেছে আবেগের তাড়নায়। যে আবেগ ওকে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য করে দিয়েছিলো। ঐ দিনের স্মৃতিতে ঘেন্নায় আকন্ঠ তিক্ততা অনুভূত হয় ওর। অথচ চুম্বন ব্যাপারটা কত মধুর যদি তার শুরুটা হৃদয় থেকে হয়।
এই একটা বিষয় না ঘটলে মীরা হয়তো ওর ব্যাপারটা ভেবে দেখতো। অন্ততঃ আবীরের কথাগুলো নিজ কানে না শুনলে এটা অবশ্যই ভেবে দেখতো মীরা৷ মীরা ওর বাবার সাথে কথা বলার সময় ওর অপারগতা জানিয়েছে। তিনি তো নাছোড়বান্দা, তিনি মীরাকে বলেছেন-
: “যা হয়েছে বাদ দাও মামনী, তুমি গুণী মেয়ে আমার ছেলে অধম। নিজ গুণে ক্ষমা করে দাও। তোমার যে সকল এক্সকিউজ তার কোনটাই ভ্যালিড না। তোমার বয়স, মেয়ে নিয়ে সায়নের কোন সমস্যা নেই, ছেলের যেহেতু কোন সমস্যা নেই, আমারও নেই, ছেলে খুশি তো আমি খুশি।
মীরা অস্বস্তির কন্ঠে বলেছিলো-
: ” কিছু মনে করবেন না স্যার, সরি টু সে -আজ আপনার ছেলে খুশী তাই সব এক্সকিউজ ইন-ভ্যালিড মনে হচ্ছে আপনার। কাল যদি ওর মনে হয় আমি, আমার মেয়ে ওর পাশে বেমানান তাহলে ঠিক এমনি করে মরিয়া হয়ে যাবেন আমাকে ত্যাগ করতে, যতটা মরিয়া এখন গ্রহণ করতে”
তিনি সহাস্যে শরীরটা টেবিলের কাছে ঝুঁকিয়ে বলেন-
: “আমি গুণের কদর করি, তুমি গুণী মেয়ে, অনেক প্রশংসা তোমার এই ইন্ড্রাস্ট্রিতে। আমি চাই তুমি পুত্র বধূ হয়ে এই পদের ভবিষ্যৎ অধিকারী হও, উত্তরাধিকার সূত্রে না, নিজ যোগ্যতায়, আর তুমি তা পারবে। তুমি সময় নাও, ভেবে আমাকে জানাও। আমার ছেলে হাজারে একজন, আমি খুব করে চাই এটা হোক”
মীরা এরপর আর কিছুই বলেনি। বেশ কিছু সময় বসে থেকে সালাম দিয়ে চলে এসেছে।
সায়নের মায়ের সাথে দেখা করার সময় খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি মীরাকে তাকে বোঝাতে। তিনি বরং ওকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এসব থেকে পিঁছু ছাড়াতে। জানিয়েছেন মীরাকে নিয়ে তার স্বামীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। তিনি মীরাকে টোপ হিসেবে ব্যাবহার করতে চান, যাতে উনার মেয়াদপূর্তির পর মীরাকে সে জায়গায় বসাতে পারেন। ব্যাপারটা যদিও মীরা তিনি না বলতেই বুঝেছিলেন।
এত কিছুর পরও যে সায়নের সাথে কথা হবে তা বুঝতে পারেনি ও। এটা মীরার এক প্রকার অনিচ্ছাকৃত আলাপ। কিন্তু মীরা এই ঝামেলাটা বয়ে নিতে চায়নি বলেই এই বার্তার আদান প্রদান। হোয়াটসঅ্যাপে সায়ন বলেছিলো- “আমি প্রতিযোগিতা চাই না মীরা, আমি সমঝোতা চাই” মীরা উত্তরে কেবল বলেছিলো- “তুমি আমার প্রতি একসময় কৃতজ্ঞ থাকবে তোমায় ফিরিয়ে দিয়েছি বলে” এরপর সবগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্লক করে ও সায়নকে৷ জীবনসঙ্গী আর যেই হোক সায়ন তো অবশ্যই না, সে হিসেব ও কষে ফেলেছে ও। কিন্তু ও জানে এর পরিনাম খারাপও হতে পারে ওর ভবিষ্যতের জন্য। তাই বলে কি নিজের বেঁচে থাকাটা এমন নরক করবে ও? আরেক জনের ক্ষণিলের মোহ হিসেবে ধরা দিবে?
সব চিন্তার বোঝা একপাশে রেখে মীরা নূহাকে তৈরি করে গেলো ইরার বাসায় ওর মেয়েকে দেখতে। গিয়ে দেখে ওর মা জাহানারা আজ আসেনি। নতুন বাচ্চা মায়েদের দেখতে আসা লোকেরা ঘিরে রাখে। আত্মীয়দের কেওনা কেও প্রতিদিনই নিয়ম করে আসছে ইরাকে আর ওর বাচ্চাকে দেখতে।
মীরা একটা সময় ঘর ফাঁকা পেয়ে ইরাকে বললো ফিওনা আসার কথাটা । ইরা ওর দিকে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। ইরা যেন মীরার মনের গতি দেখতে চাইছে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে।
কথা বলায় দক্ষ মীরার এখনকার কথাবার্তায় অগোছালো ভাবটা ইরা দেখছে মনোযোগ দিয়ে। ওর এই ভাবটা প্রকাশ করছে আবীরের প্রতি ওর সূক্ষ্ণ অনূভুতির আবির্ভাবের বিষয়টা। ইরা বোনের এমন তালগোল পাকানো কথাবার্তায় মনে মনে খুশি খুব। ও সবসময় বোনকে সুখে দেখতে চেয়েছে। ঘাড়ত্যাড়া মীরা যে বিষয়টা নিয়ে ভাবছে এই অনেক ওর জন্য। আর আবীর ভাই নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ।
সবচেয়ে মজার বিষয় ইরা আর ফিওনা দুজন মিলেই আজকের এই দিনটার রূপকার। একদিকে ফিওনা ওর ভাইয়ের একাকিত্ব জীবনযাপনের কথা বলেছে ইরাকে, আর অন্যদিকে ইরা ওর বোনের অস্থিতিশীল জীবণের কথা শেয়ার করেছে ফিওনার কাছে। ফিওনার দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্তে তোড়জোড় বাড়ে চার হাত এক করার কর্মজজ্ঞে। ইরা ওর এই অবস্থায়ও পরপর তিনবার বাইরে দেখা করেছিলো ফিওনার সাথে। মীরার ফিওনার বাসায় যাওয়া, ঠিক ঐ সময়ে দীর্ঘ দিন না আসা আবীরের ফিওনার বাসায় আসা এসব ওদের দুজনের প্ল্যানের অংশ। লাভের মধ্যে বড়তি পাওনা টুকু যোগ করেছে সায়নের পাগলামি। ওর এমন পাগলামি ওদের দুজনের এক হওয়ার যাত্রাটাকে ত্বরান্বিত করেছে আগুনে ঘিঁ দেয়ার মতো। শাপে বর যাকে বলে। ওদের দু’জনের এত দিনকার মিলিত এই চেষ্টার ফল চোখের সামনে দেখছে ইরা।
কিন্তু সমস্যা একটা এখনো রয়েছে। সেটা হচ্ছে ইরার মা জাহানারা। তিনি বরাবরই মীরাকে বিয়ে দিতে চান, কিন্তু আবীরের ব্যাপারে তিনি কেমন যেন নিরব। ফিওনার সাথে আলাপের পর একদিন এসব ব্যাপারে আলাপ তুললে তিনি আবীরের বিষয়ে তার অনিচ্ছার কথা জানান। তিনি আর তার তিন বোন মিলে আলাপ করেছে ব্যাপারটা। আবীর নিঃসন্দেহে ভালো ছেলে কিন্তু সমাজে ওর ব্যাপারে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে। আর সেটা হচ্ছে পুরুষ হিসেবে ওর অক্ষমতা। পুরুষ মানুষ বউ থাকতে পরনারীর দিকে হাত বাড়ায়। আর আবীর কিনা একাই কাটিয়ে দিচ্ছে জীবণ। যদি এটা মিথ্যেই হতো তাহলে এত বছর একা কিভাবে কাটায় একজন পুরুষ মানুষ।
ইরার কথাটা শুনে রাগে বিরক্তি ধরে গেছে মায়ের প্রতি। একটা মানুষ যে নাকি ভালোবেসে তার মেয়েকে স্ত্রীর পরিচয়ে বয়ে গেছে, বিনিময়ে তার কাঁধে আজ মিথ্যা অপবাদের বোঝা। ইরা ওর মাকে বোঝাতে চেয়েও সফল হয়নি। তিনি বলেছেন আমার যুবতী মেয়ে, ঐ ছেলের বয়স এখন চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। আমি মীরার জন্য অন্য ছেলে দেখবো। ছেলের অভাব নাকি দেশে।
ইরা চুপ করে চেয়ে ছিলো ওর মায়ের দিকে, মানুষ কত্ত হিপোক্রেট। এই তিনিই তার কিশোরী মেয়েকে জোড় করে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়েছিলেন এই আবীরের কাছেই। তখন বয়স কোন সমস্যা ছিলো না।
অথচ আজ বয়সের পার্থক্যের উদাহরণ, অক্ষমতার
অপবাদ দিচ্ছে আবীরের কাঁধে, যে অক্ষমতার অপবাদ তার মেয়েই এঁকে দিয়েছিলো নির্দোষ আবীরের শুভ্র চরিত্রে।
পরিবার, পাত্র পাত্রী সবই এক, বদলে গেছে কেবল সময়। মীরা সময়ের ঘূর্ণনে এখন বিরাট অবস্থা সম্পন্ন ব্যাবসায়ী, আর আবীর সন্নাস জীবণে ব্রতী এক পুরুষ।
মীরা ইরাকে জানায় রাতে মায়ের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করবে। ইরা আতংকিত হয় এ কথা শুনে। ওতো সবটা খুলে বলতে পারছেনা বোনকে। আল্লাহর কি ইশারা এমন সময়েই মীরার মা জাহানারা উপস্থিত। ইরার তো মাথা গরম অবস্থা। এমন বিপদের সামাল কিভাবে দিবে ও। মনে মনে খোদাকে ডাকতে থাকে ও।
মীরা এখন সবকিছুই ওর মাকে জানিয়ে করে। অবাধ্যতার পুরষ্কার তো ও পেয়েছে এক জীবণে। আর অবাধ্য হতে চায় না ও। মীরার ধারনা মা কথাটা শুনল খুশিই হবে।
ইরার ঘরে বসে মীরা জাহানারাকে কথাটা বলে-
: “মা ফিওনা এসেছিলো আজ আমার বাসায় বিদায় নিতে, ওরা কাল আমেরিকা চলে যাচ্ছে”
: “হুম ওদের ভাড়াটিয়া মনসুরের বৌ বলেছে আমাকে”
: ” অনেক কথাই হলো ওর সাথে”
এ কথা শুনে তিনি মীরার দিকে তাকালেন। ইরার তখন মাথাঘোরা অবস্থা। একজন বুনো ওল তো অন্যজন বাঘা তেঁতুল। জাহানারার চোখ যেন জ্বলে উঠলো কথাটা শুনে। তবুও তিনি চুপ করে রইলেন ওর কাছ থেকে পুরোটা শুনতে। মীরা মাথা নিচু করে বললো-
: “আমার জীবণের প্রথম অন্যায়টা আমি আবীর ভাইয়ের সাথে করেছি। সমাজের চোখে একমাত্র আমার কারনে আজও তিনি কটাক্ষের স্বীকার । বিয়ে না করে একলা জীবণ পার করছেন কাগজপত্রে আমাকে স্ত্রী করে। আমি আমার এ অন্যায়টা সংশোধন করতে চাই। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামীকাল তার সাথে দেখা করবো”
মীরার কথা শেষ না হতেই তিনি বসা থেকে দাঁড়িয়ে যান, বাজখাঁই কন্ঠে বলেন-
: “সিদ্ধান্ত তো সব নিয়েই নিয়েছিস দুই বোন মিলে, তাহল আমাকে জানাচ্ছিস কেন? তোর জীবণ তুই যা খুশি কর। আমার কি?”
ইরা ওর মাকে উদ্দেশ্য করে বলেন-
: “মা আস্তে কথা বলো, এটা তোমার নিজের বাড়ি পাও নি”
মেয়ের কথায় সংবিৎ ফিরে জাহানারার। তিনি এখন মেয়ের শ্বশুর বাড়ি, তার এত বাজখাঁই কথাবার্তা এখানে চলবে না। তিনি যেন কিছুটা ধাতস্থ হলেন। অভিমানী কন্ঠে বললেন-
: “প্রথম ভুল করলি রাজীবের হাত ধরে গিয়ে, এখন আবার ভুল করতে যাচ্ছিস, যা। কর যা মন চায় ”
মীরা ভীষণ অবাক হয় ওর মায়ের এমন আচরণে। তারাই এতদিন ওকে বিয়ে বিয়ে করে পাগল করে দিচ্ছিলো। আজ তিনি এমন কেন করছেন? সেটা ও বুঝতে চেষ্টা করছেন মায়ের দিকে চেয়ে। কিন্তু কিছু বুঝতে পারছেন না। ইরা ওকে উদ্ধার করলো, বললো-
: “আসলে আপা, মা নাকি কি সব শুনেছে আবীর ভাই সম্পর্কে, তার নাকি কি সমস্যা আছে, এজন্য তিনি বিয়েশাদি করেন নি…”
মীরা ইরার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এ ব্যাপারটা মীরাও জানে, রাজীব ওকে রেখে ২য় বিয়েটা করেছিলো এ জাতীয় অপবাদ ওর কাঁধে দিয়ে৷ অথচ বিয়ের পর দু’চারটা কথা বলেছিলো কেবল আবীর মীরার সাথে ইন্টিমেসি তো দূরের কথা। অথচ সমাজ এদিকে আবীরের জীবণ নষ্ট করেছে বৌ না রাখতে পারার অক্ষমতা দেখিয়ে, রাজীবকে করেছে একজনের ব্যাবহৃত জিনিস নিয়ে সংসার পাতার অভিযোগ। মীরারও ঘর ভেঙেছে সেই কারনে। নোংরা সমাজ কাওকেই সব ভুলে নতুন করে বাঁচতে দেয় নি।
মীরার কাছে সব কিছু পরিষ্কার। মীরা মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবে- মা যা বলছেন হয়তো ভবিষ্যতে মীরার আবার অসুখী হওয়ার কথা ভেবে। কিন্তু মীরা তো সবটা জানে। ওর নিজেকেও তো একই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিলো একটা সময়। ও ওর মায়ের কাছে গিয়ে বলে-
: “মা, তুমি না বললে ‘প্রথম ভুল করলি রাজীবের হাত ধরে গিয়ে’ আমি সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে সেই প্রথম ভুলটাই ঠিক করতে চাই”
বলেই উঠে দাঁড়ায় মীরা। এত কথা-কাটাকাটি করার মন মানসিকতা এখন নেই ওর। সেখান থেকে বেরিয়ে মেয়েকে নিয়ে চলে যায় মীরা।
চলবে…