প্রিয় ভুল পর্ব-৭৩+৭৪+৭৫+৭৬

0
408

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৭৩
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

দেশে ফিরে নতুন প্রোডাক্টের লাইভ আর মালামাল গোছগাছ করতে করতে দুদিন গন। দেশে ফিরার তিনদিনের দিন মীরা নিজেই কল করে ফিওনাকে। জানায় ওর দেশে আসার কথা৷ ফিওনা মীরাকে বলে তুমি তো মহাব্যাস্ত, আগামী শুক্রবার সকালে এসে পরো, সারাদিন থেকো। কিন্তু ব্যাস্ত মীরার এত সময় কই? মীরা বলে ও অবশ্যই আসবে তবে সকালে না বিকেলে। ফিওনা তাতোই রাজি হয়।

বৃহস্পতিবার ওর আউটলেট থেকে বের হওয়ার সময়
আড়ং থেকে বেশ কিছু শো পিস কিনলো মীরা। বিদেশে সিফ্ট হয় যারা তাদের জন্য আড়ং এর শো পিস আদর্শ গিফট। আড়ংয়ের এক একটা শেপিস যেন এক টুকরো বাংলাদেশ। কাজ শেষে বাসায় ফিরে গুছগাছ করে মায়ের বাসায় যায় মীরা। দুপুরে খেয়ে সেখান থেকে ফিওনার বাসায় যাবে বলে ঠিক করে।

পরদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরপরই মীরা বের হয় বাসা থেকে। নূহাকে সাথে নিবে ভেবেছিলো ও। কিন্তু নূহা ভাতঘুমে ডুব দেয়ায় ওকে আর সাথে নিতে পারে নি ও। বাসা থেকে বেরিয়ে বেকারী থেকে কিছু খাবারের আইটেম নিয়ে রিকশায় চড়ে রওনা দেয় মীরা। মনের মধ্যে কেমন যেন উচাটন ভাব ওর। এই মেয়েটা দেশ ছেড়ে চলে গেলে আবীরের সম্পর্কে জানাশোনার পথও বন্ধ হয়ে যাবে। দুই বন্ধবীর তৈরী করা সম্পর্ক নষ্ট করেছিলো মীরা। কিন্তু ফিওনা ঝড়ো বাতাস সত্ত্বেও নিভে যেতে দেয় নি সে প্রদীপের আলো, আগলে রেখেছে অনেক কষ্টে। অথচ সম্পর্কটা অন্যরকম হতে পারতো, আর জীবণটাও। এসব ভাবনাকে একপাশে রেখে দিলো ও। এসব ভেবে এখন কি হবে? সবকিছু তো এত সহজ না।

রিকশা অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলো বেইলী রোড। শুক্রবার হওয়ায় রাস্তা ফাঁকা। ওদের বাড়িটা মীরার আগেরই চেনা। ড্রেসে ডেলিভারিতে এসেছিলো বহু আগে একদিন। সোজা পথ, সহজ ডাইরেকশন। গলির সামনে স্বপ্নের বিশাল আউটলেট। বামে ঢুকে বিশাল বাগানবিলাস গাছের ঝোপ ওয়ালা বাড়িটাই ওর শ্বশুরবাড়ি। ধীর পায়ে মীরা পৌঁছে গেলো ফিওনার বাড়ির সামনে। কলিংবেল চাপতেই একটা মেয়ে এলো দরজা খুলতে। মীরা মুচকি হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলো-

: “ফিওনা আছে?”

: ” আপনি মীরা আন্টি?”

: “হ্যা”

: “আসুন, মামী ভিতরে আছে”

জুতা খুলে বসার ঘরে ঢুকতেই মীরা দেখলো ফিওনা এসেছে ওর রুম থেকে। মীরাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো ওকে ফিওনা। ফিওনার সাথে সাথে মিষ্টি একটা সুগন্ধ ও অভ্যর্থনা জানালো মীরাকে। মীরা হুট করে জড়িয়ে ধরায় প্রথমে অস্বস্তি ফিল করলেও, ওর আন্তরিকতায় মীরা ঐ অস্বস্তি উবে গেলো। মীরাও গভীর মমতায় চোখ বন্ধ করে ওকে আলিঙ্গন করাটাকে উপভোগ করলো। মীরার হঠাৎ ভীষণ কষ্ট হতে লাগলো, এই মেয়েটা ওর কত্ত আপন হতে পারতো তা ভেবে।

ফিওনা ওকে বসিয়ে সফ্ট ড্রিংকস আনতে গেলো। নাশতা সব আগেই তৈরী করা। ফিওনা বললো-

: “তারপর কেমন আছো মীরাপু?”

মনে মনে হাসে মীরা, এটা ওর সিগনেচার আস্ক। একই ধরন, একই চলনে উচ্ছাস নিয়ে সবার আগে এই কথাটাই জিজ্ঞেস করবে ও, যতবার দেখা হবে। কথাটা ভেবে হেসে দেয় মীরা। মীরার হাসি দেখে অবাক হয়ে ফিওনা জিজ্ঞেস করে –

: “হাসলে যে”

: ” তুমি একটুও বদলাওনি তাই ভেবে”

: “বদলে যাওয়ার কথা ছিলো কি?”

উত্তরে মৌণ থাকে মীরা, এই মৌণতাই এমন প্রশ্নের সঠিক জবাব হয়তো।

গুমোট ভাব বিরাজ করলো চারপাশে, দুজনের প্রত্যেকেরই জানা আছে সব, তবুও সব ভুলে মিলিত হয়েছে দুজনে৷ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মীরা বলে

: “বাসায় কেও নেই?”

: “ফুফাতো ভাইয়ের বিয়ে ছিলো আজ, ছোট মেয়েটা ঘুমিয়ে পরলো তাই আমি চলে এসেছি, বাকীরা সব সেখনেই আছে”

: ” আমার জন্য চলে আসতে হলো?”

: “আরে আজ আকদ ছিলো, আমি আর থেকে কি করতাম, অনুষ্ঠান হবে দুই সপ্তাহ পরে, তাই আফসোস করা লাগবে না তোমার ”

: ” কেমন আছো তোমরা সবাই?”

: “সবাই বলতে আমরা ভালোই আছি, বাবা গতবছর মারা গেছেন, ভাইয়া ব্যাবসা বাণিজ্য গুটিয়ে ফেলেছেন, গ্রামের বাড়িতে চলে যাবেন বলে”

মীরার প্রশ্ন করার আগেই ফিওনা যেন উত্তর দিয়ে দিলো ওর জিজ্ঞাসার। মীরা অবাক হওয়ার ভান করে বললো-

: ” কেন?”

যেন এই প্রথম ও শুনলো খবরটা। যদিও এ খবর ও বেশ কিছুদিন আগেই পেয়েছে। ফিওনা এড়িয়ে গেলো প্রশ্নটাকে নাশতা আনার বাহানায়, বুঝতে পেরে মীরাও চেপে গেলো ব্যাপারটা। মীরা ফিওনাকে জিজ্ঞেস করলো-

: “তোমার বড় মেয়ে?”

: “ও রয়ে গেছে অনুষ্ঠানে”

: “তোমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি, তারাও কি যাবেন সাথে?

: ” না, এই বাড়িঘর ছেড়ে তারা কোথাও যাবে না”

: “ওহ্, সবাই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে ”

: “হুম, কি করবে বলো, আমি সবসময় আমার বরের সাথে থাকতে চাই, সেটা হোক দেশ, কি বিদেশ, আমি কেবল ওর সঙ্গ চাই, তাইতে চাকুরীবাকরি সব ছেড়ে ছুড়ে ছুট লাগিয়েছি। দিনশেষে পরিবারই তো সব তাই না?

মীরার কেমন অস্বস্তি হয় কথাটা শুনে। ও তো বানের জলে ভাসা এখন। আচ্ছা ওর মেয়ে আর ও দুজন মিলে কি পরিবার হয় না? হয় বোধ-হয়। মনে মনে ভাবে মীরা৷ ফিওনা মীরাকে বলে –

: ” তুমি কত সুন্দর হয়ে গেছো মীরাপু, আমাকে একটু টিপস দিও রোগা হওয়ার”

কথাটা শুনে হাসে মীরা। তারপর বলে-

: ” যত সুন্দর আমি, ততোই মন্দ আমার ভাগ্য”

: “হুম, আমার খুব আফসোস হয়, আমার কাছে অতীত মুছবার ক্ষমতা থাকতো যদি, আমি তোমার পালিয়ে যাওয়াটা আটকাতাম”

মীরা মনে মনে ভবে- “আমিও”

: “তারপর তোমার মেয়ের ছবি দেখি, ওকে সাথে আনলে না কেন? ”
ফোনের গ্যালিরি খুলে ছবি দেখিয়ে বলে-

: ” আসার সময় ঘুমিয়ে পরলো”

: “কফি খাবে?”

: ” হুম, খাওয়া যায়”

ফিওনা কফি তৈরি করতে গেলে মীরা ওর নিজের ফোনে ব্যাস্ত হয়ে পরে। মিনিট সাতেক পর কফির মগ হাতে ফিওনা ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলো-

: “বিয়ে করছো না কেন?”

মীরা যেন অবাক হয়ে গেলো ওর এমন প্রশ্নে। কফিতে চুমুক দেয়া অবস্থা চকিতে তাকালো ফিওনার দিকে৷ অন্যমনস্কতায় গরম কফিতে জিহ্বা পুড়ে গেলো হয়তো। ফিওনা নিজেকে সামলে বলে-

: “সরি অকওয়ার্ড প্রশ্ন করে ফেললাম”

: ” ইট’স ওকে, এসব শুন আমি অভ্যস্থ, আসলে এসব নিয়ে ভাবছি না”

: ” না ভাবলে তো চলবে না, ভাবতে হবে, একটা
কথা তেতো হলেও সত্য, কমবয়সী বিধবা বা সিঙ্গেল মাদারেরা তাদের সমাজের স্থিতিশীলতা, সামাজিক মূল্যবোধ এবং সাংসারিক জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। তুমি নিশ্চয়ই বুঝছো যে আমি কি বলছি?

মীরা একটু নড়েচড়ে বসে, ফিওনা এ বিষয়ে এভাবে বলবে ও কল্পনায়ও ভাবতে পারেনি, তাই ওর অবাক হওয়াটা যেন একটু বেশীই। কফির মগ সেন্টার টেবিলে রেখে সোজা হয়ে বসে মীরা৷ এটা ওর উত্তর ভাবার প্রস্তুতি যেন।

ফিওনা ওর কোন জবাব না পেয়ে বললো-

: আমি তোমার সাহস, আত্ননিয়ন্ত্রণক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তোমাকে অসম্মানিত করছি না। নিঃসন্দেহে তুমি সাহসী, বুদ্ধিমতি, আত্মনির্ভরশীল একজন, তোমার মতো পরিস্থিতিতে পরা মেয়েরা নিজেকে শেষ করে দেয়ার কথা ভাবে, কিন্তু তুমি ঘুড়ে দাঁড়িয়েছো।

আমি শুধু অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই আলোচনা করছি। জৈবিক চাহিদা অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়, এর বিরুদ্ধাচারণ করাটাই বরং প্রকৃতিবিরুদ্ধ। এবং তোমাকে ইন্ডিভিজুয়াল ধরে জাজ করার সময় কারোই নেই। আর তুমি না চাইলেও পুরুষরা তোমাকে অসহায় ভেবে নিয়ে তোমার প্রতি আকৃষ্ট হবেই। এসব নি:সন্দেহে নোংরামি, তবে মানবপ্রকৃতি এভাবেই কাজ করে। তুমি নিজেকে সামলাতে পারবে, কিন্তু তোমাকে দুর্বল ভেবে তোমার প্রতি লোভের হাত বাড়ানো কয়টা পুরুষকে তুমি সামলাবে?” – কথাগুলোই একটানা বলে ফিওনা, মীরাকে হয়তো ধাতস্থ হতে সময় দিলো।

মীরা সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে থাকলো কফির মগের দিকে। ফিওনার কথা শুনে সদ্য ঘটে যাওয়া নোংরা ঘটনাটা মনে পরে গেলো ওর। সত্যি এ ঘটনাটা ওকে বুঝিয়ে দিয়েছে যত শক্তিশালীই হও তুমি মেয়ে, পুরুষের আগে তুমি কিচ্ছু না! নাথিং!

ফিওনা যেন ওকে সম্মোহন করবার এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলো না। মীরাকে এমন ভাবনায় রেখেই ও আবারে শুরু করলো-

: “মীরাপু দু:খজনক হলেও সত্য, আমাদের সোসাইটি এখনও ওরকম নয় যে একজন কমবয়সী বিধবা/ সিঙ্গেল মাদার সেখানে ইজ্জত রক্ষা করে সম্মানের সাথে একা বাঁচতে পারে। তুমি প্রাপ্তবয়স্ক, সিদ্ধান্ত অবশ্যই তোমার। সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখানোর বিশ্রী প্রতিযোগিতায় মানুষ এমনটা ভাবে, যে আমি সবার ভাবনার বিপরীতে আলাদা কিছু করবো।
কিন্তু সমাজকে অস্বীকার করে কোন মানুষ স্বস্তিতে বাঁচতে পারে না। দেখো সমাজ, সমাজের লোক তোমার জীবণ যাপন করবে না, তোমার জীবণের কঠিন দিনগুলো, সাফারিং গুলো তোমাকেই ভোগ করতে হবে। তাহলে তাদেরকে দেখানোর জন্য, তাদের চোখে নিজেকে আলাদা প্রমাণের চেষ্টা কেন?
তুমি আবার ভেবো না কথাগুলো তোমাকে কোন ইনটেনশন থেকে বলেছি, আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী, কাজ, ব্যাস্ততা, খ্যাতি এসবে ডুবে থাকা তুমি জীবণের এই হিসেবটা করার সময় পাচ্ছো না হয়তো। কিন্তু বাস্তবতা অনেক কঠিন”

এতক্ষণ পরে মুখ খুললো মীরা-

: “তুমি এসব বলতেই আসতে বলেছো তোমার বাসায়?”

: “ছিহ্ আপু, এই চিনলা তুমি আমাকে? সত্যি বলোতো আমি যা বলছি এক বিন্দু মিথ্যা আছে তাতে?”

মীরা আর্দ্র চোখে তাকায় ফিওনার দিকে, কথা গুলো ওভর ডোজ হয়ে গেছে ভেবে ফিওনা মীরার পাশের সোফতে এসে ওর হাতটা ধরে বলে –

: ” তোমাকে কষ্ট দেয়ার কোন ইন্টেনশন আমার নাই, আর আমার ভাইয়ের হয়েও কথাগুলো বলছি না, ওকে অনেক বুঝিয়েছি লাভ হয় নি, ওর হিসাব বাতিল খাতায়। সোজা বলে দিয়েছে বিয়ে ও করবে না। আমি কোন স্বার্থোদ্ধারেও কথা গুলো বলছিনা, বিশ্বাস করো”

: ” ফিওনা মিথ্যা বলবো না যে এসব নিয়ে আমি ভাবি না, বাসা থেকেও উঠতে বসতে মাথা খাচ্ছে সকলে,
এখনো কেন বিয়ে করিনি?, কেন করছি না? এটা নিয়ে আমার চেয়ে অন্যের দুঃখ বেশি । কোথাও কারো সাথে দেখা হলে ইনিয়েবিনিয়ে এসব কথাবার্তা বলে। এখন তাই এদেরকে এড়িয়ে চলি। এই এড়িয়ে যাওটাকে মানুষ নাম দিয়েছে অহংকার। আগে কষ্ট পেলেও ইচ্ছে করেই এখন এসব পাত্তা দেই না । মানুষ একটা সহজ বিষয় বোঝে না যে দিন শেষে কেউই একা থাকতে চায় না । বিয়ে, সংসার, সন্তান, সুস্থতা, সম্পদ এগুলো ভাগ্যে থাকা লাগে । কেউই শখ করে একা থাকে না ”

: “চেষ্টা তো করতে হবে? জীবণকে আরেকটা সুযোগও দিতে হবে। কত বয়স তোমার? মেরেকেটে ২৬ কি ২৮? এ বয়সে অনেকে বিয়েও করে না। আমার এক ক্লাসমেইট ৩০+ এখনো ওর বিয়েই হয় নি, তো ও কি হাল ছেড়ে দিয়েছে? দেয় নি, জীবণের এই পথটা অনেক বড়, দুদিন পর মেয়ে বড় হবে, ওকে বিয়ে দিবে, তখন হয়ে যাবে একা। এত এত ব্যাস্ততা হঠাৎ যখন ফুরিয়ে যাবে তখন? শোন জৈবিক চাহিদাটা নাহয় সরিয়েই রাখলাম, দিনশেষে মন খুলে কথা বলারও তো একজন থাকা লাগে তাই না? জীবণের উপর এমন অন্যায় তুমি করো না মীরাপু। যাকেই হোক বিয়ে করে সুখী হও।

: “ফিওনা আমি যতটা না আমার জন্য ভাবছি তার চেয়ে বেশী ভাবছি মেয়েটার কথা। ওর বাবাকে ও এখনো চিনে না, এদিকে ওর বাবা ওর দায়িত্ব নিবে না, আমি আমার মাথার উপর ছাদ চাই না ফিওনা, মেয়েটার মাথার উপর হাত রাখার এক জনকে চাই। বলো কে আছে এমন যে আমার আগে আমার মেয়েকে প্রাধান্য দিবে। আমি অনেক সেকেন্ড ম্যারেজ দেখেছি, যেখানে আগের ঘরের ছেলেমেয়ে নিয়ে অশান্তি হয়, কলহ বাঁধে, আমি আমার সুখের জন্য মেয়ের জীবণ নরক করতে পারবো না। বলা সহজ ফিওনা, বাস্তব অনেক কঠিন”

এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠে। কে এলো ভাবতেই ফিওনা ডোর হোলো চেয়ে দেখে দারজার ওপাশে ওর একমাত্র ভাই আবীর ওর বড় মেয়েকে নিয়ে দাঁড়ানো। হাত-পা হিম হয়ে যায় ওর। আতংকিত চোখে ফিওনা তাকায় ড্রইংরুমে থাকা মীরার দিকে। মীরারও ফিওনার তাকানো দেখে শীতল একটা স্রোত বয়ে যায় শীরদাঁড়া বরাবর। আতংকে মীরা হঠাৎ উঠে বারান্দায় চলে যায়। ফিওনা কিছু না বললেও মীরা বেশ বুঝে নেয় দরজার ওপাশে কে দাঁড়ািয়ে!

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৭৪
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠে। কে এলো ভাবতেই ফিওনা ডোর হোলো চেয়ে দেখে দারজার ওপাশে ওর একমাত্র ভাই আবীর ওর বড় মেয়েকে নিয়ে দাঁড়ানো। হাত-পা হিম হয়ে যায় ওর। আতংকিত চোখে ফিওনা তাকায় ড্রইংরুমে থাকা মীরার দিকে। মীরারও ফিওনার তাকানো দেখে শীতল একটা স্রোত বয়ে যায় শীরদাঁড়া বরাবর। আতংকে মীরা হঠাৎ উঠে বারান্দায় চলে যায়। ফিওনা কিছু না বললেও মীরা বেশ বুঝে নেয় দরজার ওপাশে কে দাঁড়িয়ে!

মীরাকে নিরাপদ দূরত্বে দেখে দরজা খুলে ফিওনা, দৌড়ে ঘরে ঢুকে মা’কে জাপটে ধরে রোদেসী। তখনো দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে ফিওনা, এমতবস্থায় আবীর মুচকি হেসে বলে-

: “কিরে ভিতরে আসতে দিবি না?”

: ” কেন আসছিস তুই আমার বাসায়? ”

: “বাপ্রে রাগ এখনো কমে নাই দেখি ”

: “তুই আমার কে যে তোর উপর রাগ করবো, মানুষ আপন লোকদের উপর রাগ করে, আমি তোর কিছু হই বল?”

বলেই দরজাটা ছেড়ে বসার ঘরে এসে বসে ফিওনা। আবীর ঘরে ঢুকে মেইন ফটক আটকে বসে ফিওনার ঠিক বিপরীত সোফাতে। যেখানে একটু আগে বসে ছিলো মীরা। গা এলিয়ে বসে আবীর, তারপর ভাগ্নী রোদেসীকে বলে-

: “তোর মা আমার উপর পুরো ক্ষ্যাপা, একটু বোঝা তোর মাকে”

রোদেসী মুচকি হেসে বলে-

: “কি বোঝাবো মামা, আমাকে শিখিয়ে দাও”

: ” তুই তোর মাকে বল- তোর নিরিহ মামার সাথে এমন না করতে”

রোদেসী আজ্ঞাবহের মতো বলে-

: ” মা তুমি আমার নিরিহ মামার সাথে এমন করো না”

ফিওনা মাথা নিচু করে কাঁদছিলো এতক্ষণ। একমাত্র বড় ভাইয়ের জীবণ এমন হলে কাঁদবারই তো কথা। মেয়ের কথা শুনে দুই হাত দিয়ে চোখ মুছে, তারপর রোদেসীকে বলে-

: ” তুমি ভেতরে যাও মা, আমি তোমার মামার সাথে কথা বলবো”

রোদেসী চিন্তিত মুখে বলে-

: ” মামাকে বকবে নাতো?”

যেতে বলেছি না মা, বড়দের কথার মাঝে থাকতে হয় না, তুমি যাও তোমার মামাকে বকবো না”

: “প্রমিজ? ”

: “হুম প্রমিজ”

আবীরের কাছ ঘেঁষে দাঁড়ানো রোদেসী ভিতরে যাওয়ার আগে বলে-

: “আমাকে তুমি পিৎজা খাওয়াতে নিবা বলছো কিন্তু, মনে থাকে যেন” বলেই চলে যায় রোদেসী। ও যাওয়ার পর ফিওনা যথাসম্ভব গম্ভীরমুখে আবীরকে বলে-

: ” সেদিন তো খুব রাগ দেখিয়ে চলে গেলি, আজ কেন এসেছিস তুই?”

শান্ত কন্ঠে আবীর বলে-

: ” সেদিন তোর সাথে ঐভাবে রিয়্যাক্ট করা উচিত হয় নি, আসলে মেজাজ খারাপ ছিলো তখন। আজ আমি তোকে সরি বলতে এসেছি”

: ” সরি বললেই কি না বললেই কি? তুই তো তোর সিদ্ধান্তে অটল, নিজের জীবণ নিয়ে তুই যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াচ্ছিস। আজ বাবা-মা বেঁচে থাকলে তুই এমন করতে পারতি?”

: “ইমোশনাল কথাবার্তা বাদ দে, এসব বিষয়ে কথা বলতে আমার আর ভালো লাগে না, বেশ তো আছি আমি, আমার কোথায় দুঃখ দেখিস তুই আমি বুঝি না। একা থাকা যে কি শান্তির তা তোকে কে বোঝাবে”

: ” জীবণে চলার পথে কত মানুষের কত কিছু হয়, তাই বলে কি মানুষের জীবণ থেমে থাকে? তুই সেই এক যুগ আগেই পরে আছিস, সময় কিন্তু পরে নেই, সময় কিন্তু ঠিকই চলছে তার নিজস্ব গতিতে। একটা মেয়ে তোকে বিয়ে করে পরদিন পালিয়ে গেলো, এতে তোর দোষ কোথায়? তুই কেন মুভ অন করতে পারছিস না, কেন সেখনেই আটকে আছিস?”

: ” আটকে আছি কে বললো? বেশ তো আছি, তখন বয়স ছাব্বিশ ছিলো এখন আটত্রিশ ”

: ” আটকে যদি না-ই থাকিস তবে কেন তুই এত বছরেও বিয়ে করলি না? কেন তোর সব পেপারস্ এ ম্যারেইটাল স্ট্যাটাসে ম্যারেইড লিখা, কেন তোর পাসপোর্টে স্পাউসের জায়গায় “জিনিয়া আবেদীন মীরার নাম? বলবি আমায়?

: ” এ বিষয়ে এর আগেও বহুবার কথা হয়েছে, নতুন করে কিছু বলার নাই”

ফিওনা রাগান্বিত কন্ঠে বলে-

: ” আজ শেষ বারের মতো জানতে চাই আমি বল কেন? ”

বোনের অগ্নিমূর্তির সামনে কেমন নড়বড়ে হয়ে যায় আবীর। কিছু সময় মৌন থেকে আবীর বলে-

: ” তুই জানিস আমি খুবই সাদামাটা, নির্বিবাদী মানুষ,
বিয়ে জীবনে একটা করতে হয় করেছিলাম, বিয়ের পরদিন গিয়েছিলাম পাসপোর্ট তৈরি করতে। সেখানে স্পাউসের নাম দিতে হয়, দিলাম, সবকিছু শেষ করে বাড়িতে ফিরে শুনি এ কাহিনি। বল তখন কি করতাম আমি ওকে খুঁজতাম নাকি পাসপোর্টে ম্যারেইটাল স্যাটাস আর স্পাউসের নাম সংশোধন করতে যেতাম”

: “সে তো নূহ নবীর আমলের কাহিনী তুই ইয়ার্কি করবি না আমার সাথে, আমি মোটেও ইয়ার্কি করার মুডে নাই। এর পর তুই পাসপোর্ট রিনিউ করছিস দুই বার। এবারও কেন স্পাউসের নাম রেখে দিছিস তুই”

ফিওনার এমন যুক্তিযুক্ত কথার বিপরীতে চুপ করে বসে থাকে আবীর। এর উত্তর নেই ওর কাছে।

: ” কথা বলছিস না কেন? কেন তুই এত বছরে ও মুভ অন করলি না?, কেন ঐ মীরাতেই আটকে রইলি তুই?”

ফিওনার মুখে মীরার নাম শুনে কেমন যেন চমকে যায় আবীর। এর আগে ওদের মধ্যে কথাবার্তা হলে কখনো ওর নাম মেনশন করা হতো না। এমনকি ওদের মা বেঁচে থাকতেও মীরার নাম কেও তুলতো না বাড়িতে। ফিওনা
চুল খোঁপা করতে করতে বলে-

: “তোকে বললাম মীরাতেই আটকে আছিস যখন আমি ওর পরিবারের সাথে কথা বলি, নাহ্ সেইখানেও তোর সমস্যা ”

আবীর মুচকি হেসে বললো-

: ” তুই একটা মাথা মোটা, সহজ হিসেব বুঝিস না, ও যখন আমাকে ছেড়ে চলে গেলো ওর বয়স তখন মাত্র ষোলো ছিলো, ষোলো বছরেই আমাকে মানতে পারে নি, আর এখন ওর বয়স আটাশ, তাছাড়া শুনেছি ও এখন মিলিয়নিয়ার, বিশাল ব্যাবসায়ী মানুষ। ওর কি বরের অভাব হবে? ও কোন দুঃখে নিঃস্ব আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে? বুঝা আমাকে”

: ” তুই নিঃস্ব?! তোর এটাই সমস্যা, তুই নিজেকে নিঃস্ব মনে করিস। আল্লাহর রহমতে এখনো যা আছে তা দিয়ে তোর জীবণ পার হয়ে যাবে হেসেখেলে। এসব ভুগিজুগি কথা তুই বাদ দে”

প্রসঙ্গ এড়াতে আবীর বলে –

: “আচ্ছা ভেবে জানাবো তোকে”

: “কোন ভাবাভাবি নাই, এক্ষণ বলবি তুই”

একটা রহস্যময় হাসি হেসে বলে-

: ” এমন ভাবে বলছিস যেন আমার হ্যা/না এর উপর ঝুলে আছে ব্যাপারটা”

: ” অনেকটা তেমনই, ইরার সাথে আমার কথা হয়েছে, ও বলেছে ওর মেয়েকে বাবার মতো ট্রিট করবে এমন কাওকে খুঁজতে বলেছে মীরা। মেয়েটা এখনো দেখেইনি ওর বাবাকে? ওকে বলা হয়েছে ওর বাবা বিদেশ থাকেন। বাচ্চাকাচ্চা তোর অনেক পছন্দ, এটা কোন সমস্যা না সেটা আমি জানি। আর তুই না বললেও আমরা ঠিকই বুঝি এখনো তুই মীরাতেই আটকে আছিস। আবেগ লুকাতে গিয়ে জীবণের সবচেয়ে সুন্দর সুযোগ হারাতে বসেছিস তুই। আবার তোদের এক হওয়ার এ সুযোগটা হারাস না ভাই আমার, হয়তো খোদাও তাই চায়। তোদের দুজনকে আরেকটা সুযোগ দিতে।

: “তাঁর সাথে (আল্লাহর) আমার অনেক অভিমান বুঝলি, আমি কখনো কারো সাথে ফ্লার্ট করি নি, কারো টাকাপয়সা মেরে খাইনি, কারো সাথে খারাপ ব্যাবহার করি নি। তিনি এর উপহার হিসেবে জীবণে সব দিলেন। আবার কেড়েও নিলেন। মায়ের পছন্দে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম তা সত্যি কিন্তু ছোট থেকেই ওকে আমার ভীষণ ভালো লাগতো। যেদিন আমাদের বিয়েটা হলো সেদিন আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের একজন ছিলাম। কিন্তু তিনি আমার সুখ সহ্য করলেন না, পরদিনই সব এলোমেলো করে দিলেন”

: “যা হওয়ার তা হয়েছে, এতেই হয়তো তোদের দুজনের মঙ্গল ছিলো। সে-সব বলে মন খারাপ করে সময় নষ্ট করার দরকার কি বল? আমি তাহলে তাদের সাথে কথা বলি?”

আবীর ফিওনার দিতে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে, তারপর এলিয়ে দেয়া শরীরটাকে সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে টেবিলে রাখা পানির গ্লাস ঘুরাতে ঘুরাতে বলে-

: “তুই না বললি তিনি(আল্লাহ) হয়তো চান আমরা আবার এক হই, আমি মেয়ে সহ-ই বিয়ে করবো ওকে। ওর মেয়েকেও আমি আমার পরিচয়ে বড় করবো, তবে আমার একটা শর্ত আছে”

: “কি শর্ত?”

: ” আমি সবকিছু গুটিয়ে নিয়েছি গ্রামের বাড়ি চলে যাবো বলে, ও যদি সব ছেড়ে ছুড়ে আমার সাথে সেখানে যেতে পারে আমার কোন আপত্তি নেই”

ফিওনা স্তব্ধ হয়ে যায় ওর কথা শুনে, বসা থেকে দাঁড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বলে-

: “তুই জানিস কি বলছিস? ”

: “আমি যা বলেছি ভেবেই বলেছি, তিনি যদি সত্যি চান আমরা আবার এক হই তাহলে এটাই আমার শর্ত”

ফিওনা রেগে বলেন-

: “তুই ফাতরামি শুরু করছিস আমার সাথে? এটা তো পাগলও বুঝবে যে- ওর এত কষ্ট, পরিশ্রমে তৈরী ব্যাবসা, যা এখন সাফল্যের শীর্ষে দাঁড়িয়ে তা ফেলে ও তোর সাথে যাবে না”

কিছু সময় স্তব্ধ বসে থেকে ফিওনা আবারো বলে-

: “আমি বুঝে গেছি ভাই যা বোঝার, তোর লাইফ তোর ডিসিশন, এটলিস্ট আমার কোন গিল্ট থাকবে না, কারন আমি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছি তোর জীবণ স্যাটেল করার। আমি বাকী জীবণে আর কোনদিন এ বিষয়ে কোন কথা বলবো না, খোদার কসম করে বললাম। তুই যা এখন”

: ” রাগ করলি? আচ্ছা যাচ্ছি এক কাপ কফি হবে?”

চোখের পানি মুছে ফিওনা রান্নাঘরের দিকে যায় আবীরের জন্য কফি আনতে৷ এদিকে আবীর থুম মেরে বসে থাকে। জটপাকানো মাথার তার খুলতে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট জ্বলাতে বারান্দায় যায়। ও তো জানে না মীরা সেখানেই দাঁড়িয়ে। ওকে আসতে দেখে ভীত মীরা বারান্দার আরো পিছনের দিকে চলে যায়। রোদে শুকাতে দেয়া কাপড় আড়াল করে রাখে মীরাকে আবীরের কাছ থেকে । মিষ্টি একটা গন্ধে বারান্দাটা ভরে গেলো ওর আগমনে। ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে লাইটার দিয়ে আগুন ধরায় আবীর। নিকোটিনের গন্ধ দখল নেয় বারান্দার বাতাসের। দূর থেকে শুকাতে দেয়া কাপড়ের ফাঁক থেকে লুকিয়ে তা অবলোকন করে মীরা।

আবীর!
কতোদিন পর দেখলো মীরা ওকে। কত দিন না ঠিক কত বছর! ওদের বিয়ের দিন রাতে শেষ দেখা হয়েছিল মুখোমুখি দুজনের। আবীর বলেছিলো শীঘ্রই আমাদের দেখা হচ্ছে। না সে দেখা হয় নি আর দুজনের। এমনকি ডিভোর্সের দিনও আসেনি আবীর।

এত ভালোবাসা বুকে তবু্ও শর্ত কেন মুখে? জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় মীরার। না কোন ভালোবাসা থেকে এ জানতে চাওয়া না, এত বছর নিজেকে মীরার বিবাহিত স্বামীর পরিচয় বয়ে নেয়ার তরে এ জানতে চাওয়া মীরার। মীরা খুব বুঝতে পারে শর্তের আড়ালের অভিমানকে। কিন্তু অভিমান ভাঙার মতো শক্তি, সাহস, সামর্থ্য কোনটাই নেই ওর।

জ্বলন্ত আগুন সিগারেট শেষ করার আগেই দিনের আলো শেষ হয়ে সন্ধ্যা নামে চারপাশে। সন্ধ্যার লালচে আলোয় কেমন যেন অসহায় দেখায় আবীরকে। মীরার ইচ্ছে করে কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইতে৷ কিন্তু যা ভাবা যায় তা করা কি এত সহজ?

মীরার নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়। এই সাদামাটা, নির্বিবাদী মানুষটার জীবণ নষ্টের জন্য ও একমাত্র দায়ী। মাগরিবের আজান পরে চারপাশে একযোগে। মীরা চেখ বন্ধ করে মনে মনে বলে- খোদা তুমি যা জানো তা আমি জানি না, যদি এতেই আমার কল্যান থাকে তবে এই পাপ মোচন করার একটা সুযোগ তুমি আমাকে দাও”

সিগারেট শেষ করে আরো কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকে আবীর। দমকা একটা বাতাস বারান্দার কাপড় গুলোকে নাড়িয়ে যায়। নাহ্ এতে আবীরের দৃষ্টি গোচর হয় নি মীরা। নিকোটিনের গন্ধ গুলো সরিয়ে নিতে এসেছিলো তারা। এরপর ধীরে ধীরে আবারো আবীরের শরীরের আতরের সু-মধুর গন্ধে ভরে উঠে চারপাশ। মীরা মনে মনে ভাবে এটা কি নিছক একটা ঘটনা নাকি কোন কিছুর ইঙ্গিত?

চলবে……

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৭৫
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

সেদিন ফিওনাদের বাসা থেকে বের হয়ে মীরা সোজা চলে যায় ওর নিজের বাসায়। রাতে মায়ের বাসা থেকে খেয়ে ফিরবার কথা থাকলেও রিকশা নিয়ে ও নিজের বাসায় পৌঁছে যায় ৷ ভরাক্রান্ত মন নিয়ে রুমে ঢুকে জুতা, ব্যাগ সবকিছু রাখার পর নিজের ঘরে ঢুকে বিছানার সম্মুখ প্রান্তে থুম মেরে বসে থাকে ও৷

একা ঘরে তখন যেন প্রতিধ্বনিত হতে থাকে ফিওনা আর আবীরের বলা কথা গুলো একে একে।

ফিওনার একটা কথা ওর মনের ভিতরে যেন তীরের ফলার মতো বিঁধে আছে এখনো “আমার কাছে অতীত মুছবার ক্ষমতা থাকতো যদি, আমি তোমার পালিয়ে যাওয়াটা আটকাতাম” এত সব সমস্যা, বিপত্তির ঐ একটাই কারন। একটাই সমাধান যেন।

ওদের দুই ভাইবোনের মধ্যে ফিওনা সুন্দর, আর আবীর কালো, ফিওনা মোটা, আবীর এখনো আটত্রিশ বছর বয়সেও নিজের ফিটনেস ধরে রেখেছে। আবীর লম্বা, ফিওনা খাটো। দুই ভাইবোনের এমন হাজারো অমিলের মধ্যে একটা মাত্র মিল হচ্ছে “ওদের কথা বলার সহজ ভঙ্গি” কোন কপটতা নেই, রাখ ঢাক নেই, সহজে ওরা কত কঠিন আবেগকে শব্দে রূপান্তর করে বলে ফেলে সামনে থাকা মানুষটাকে। এমন অনেকেই আছে যারা সহজ কথা, সহজ আবেগটাও প্রকাশ করতে পারে না অপর দিকের মানুষটার কাছে, এজন্যই হয়তো একসাথে বছরের পর বছর থেকেও চেনা যায় না কাছের জনকে৷ যেমন মীরা নিজে চিনতে পারেনি একই বিছানা ভাগ করে নেয়া রাজিবকে। এরা দু’ভাইবোন কত কঠিন বিদ্যা আয়ত্ত করে বসে আছে তা হয়তো নিজেরাও জানে না।

মীরা ঠিক বুঝে ফিওনা ওকে ইন্টেনশনালি বলে নি কথাগুলো। সবকিছু একপাশে রেখে ও মীরার ভালো চায়। এজন্যই হয়তো ফিওনা ওকে বোঝানোর সময় বলেছিলো- “ভাইয়ের হিসাব বাতিলের খাতায়” তার মানে এসব নিয়ে বেশ আগে থেকেই যুদ্ধ হচ্ছে দু’ভাইবোনে। মীরা নিজের কানে না শুনলে হয়তো বুঝতেই পারতো না আবীরের জীবণটা কতটা এলোমেলো করে দিয়ে ও বের হয়েছিলো বিয়ের পরদিনের মধ্য দুপুরে। ভাবনার ঠিক এই মুহুর্তে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো মীরা। চোখ বন্ধ করতেই চোখে ভেসে উঠলো বিয়ের রাতের সেই ক্ষণেক দেখা করার মুহূর্তটা। ধ্বংসস্তুপের মতো এককোণে বসে থাকা নবোঢ়া মীরার সামনে লাজুক দৃষ্টিতে দূরত্ব রেখে বসেছিলো ওর স্বামী আবীর! হ্যা মীরার স্বামী আবীর।

না কাছ ঘেঁষে বসার চেষ্টা, না কোন ছুতোয় হাতধরা, না চোখে চোখ রেখে তাকানো। দূরত্ব রেখে বসে নব বিবাহিতা স্ত্রীকে বলেছিলো ভালোবাসার আবেগমাখা প্রথম উক্তি – “খুব শীঘ্রই আমাদের দেখা হচ্ছে”

কত সরল বিবৃতি সদ্য বিয়ে করা স্ত্রীর প্রতি।

রাগে ঘৃণায় বুদ থাকা মীরা একবারও তাকিয়ে দেখেনি আবীরের দিকে। তবে আজকের গোধূলির রহস্যময় আলোতে দেখা আবীরের চেহারা ভাবতেই দুই চোখ গড়িয়ে পানি পরে মীরার। এতদিন ও জানতো যে আবীর বিয়ে করেনি, কিন্তু আজ যা জানলো, নিজ কানে যা শুনলো তাতে ও আবীরের জীবণ শুধু এলোমেলোই না, ধ্বংসস্তূপও করে দিয়েছে তা খুব বুঝেছে ও। নিজের সুখ খুঁজতে গিয়ে ও অন্য একজনকে শেষ করে দিয়েছে। এতদিন ধরে দেখেছে মেয়েরা শত অবহেলা, বঞ্চনা, সহ্য করেও স্বামীর পরিচয় নিয়ে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয়৷ কিন্তু আবীর! একটা ছেলে হয়ে নিজে বিবাহিতের তকমা লাগিয়ে, পাসপোর্টে স্পাউসের নাম রেখে দিয়ে নিরবে লালন করেছে মীরার প্রতি ওর অকৃত্রিম ভালেবাসার।

সংসার করলে কিংবা বন্ধুত্বে, এমনকি মা-মেয়েতেও, দুটো মানুষ যখন একসাথে থাকে খুব স্বাভাবিক ঝগড়া, অভিমান হয়েই থাকে। তখন একে অপরকে মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শত্রু। কেও কারো ছায়াও মাড়ায় না, কখনো কখনো তো খু*ন করার কথাও ভাবে। কিন্তু এতবড় ক্ষতি করার পরও আবীর মীরাকে ওর জীবণের অংশ করে বয়ে বেড়িয়েছে সন্তর্পণে।

মীরার হঠাৎ মনে পরে আবীরের বলা ঐ শর্তের কথা। মীরা খুব টের পায় এমন শর্তের তলে এত বছরকার জমানো অভিমানের। কিন্তু যা ও করে এসেছে এক যুগ আগে তাতে আবীরের কাছে যাওয়াটাই তো শক্ত, ওকে বোঝানো, ওর অভিমান ভাঙানো তো অসম্ভব মীরার পক্ষে। তার উপর ফিওনার থেকেও কোন প্রকার সাহায্য পাবে না ও। কারন ফিওনা কসম কেটে বলেছে এসব বিষয়ে ও আর একটা কথাও বলবে না ও কোনদিন। তাহলে?

বিছানা ছেড়ে উঠে বসে মীরা৷ চোখ মুছে ভাবে চমৎকার ঐ মানুষটা এমন বিশ্রী লাইফ ডিজার্ভ করে না। ঠিক এমন সময় বাসার কলিং বেল বেজে উঠে। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দরজার ডোর হোলে চেয়ে দেখে কেও নেই। মাজেদা খালা নূহাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলে ওকে খুশি করতে এমন করে মাঝে মাঝে। ভাবতেই দরজার সামনের কেচি গেইটের তালা খুলে৷

দরজা খুললে মীরা কাওকে দেখেনা আশেপাশে। হঠাৎ ওর চোখ পরে দরজার সামনে একটা ফ্লাওয়ার বুকের দিকে। অসম্ভব সুন্দর এই বুকের সবগুলো ফুল সাদা টিউলিপ। যেন শান্তির বার্তা নিয়ে এসেছে সে। ফুলগুলো দেখে উচাটন মনের পারদ কেমন দপ করে নিন্মমুখী হয় মুহূর্তেই। তবে আশেপাশে কেও নেই। কে দিলো? ভুল করে এখানে এনে রাখেনি তো? এসব

ভাবতেই বুকেটা তুলে নেয় মীরা।

দরজা আটকে কে পাঠালো ভাবতে ভাবতে সেখানে থাকা কার্ডটা খুলে দেখলো সেখানে কার্সিভ হ্যান্ডরাইটিং এ লেখা – Sorry…

ছোট্ট একটা শব্দই এর প্রেরকের ঠিকানা যেন ঘোষনা করলো নিঃশব্দে। তখনই মীরা বুঝে গেলো এটা ভুল না ঠিক ঠিকানায়ই পৌঁছেছে। ফুলের বুকেটা বিছানার উপর রেখে সোফায় বসলো মীরা৷ শরীর এলিয়ে দিয়ে ও চলে গেলো ফ্লাশ ব্যাকে….

এওয়ার্ড অনুষ্ঠানের পর পরই বার্ষিক বনভোজনের এক অনুষ্ঠানে দাওয়াত পায় মীরা। ওদের ব্যাবসায়িক কমিউনিটিতে প্রতিবছরই এমন আয়োজন করে। প্রত্যেকের নিজ নিজ বায়ারদের মেইন কন্ট্রাক্ট সবমিটেরর পর বছরের এ সময়টা সবারই প্রায় মন্দা চলে। অনেকে অবশ্য এখান ওখান থেকে সাব কন্ট্রাক্টের কাজ দিয়ে স্টাফদের এঙ্গেজ রাখে৷ টানাটানির এ কাজে লাভ হয় না তেমন, তবে স্টাফদের বেতন, কারখানার আনুসাঙ্গিক খরচ উঠে যায়। তাই এ সময়টা নিজেদেরকে চাঙা রাখতে অনেকেই এমন প্যাকেজ ট্যুরের আয়োজন করে। মাঝে মাঝে কারখানায় হয় চড়ুইভাতি। এবারও তার ব্যাতিক্রম না।

মীরা প্রতিবারই যাবার চেষ্টা করে। এবারও যাবে বলে মন ঠিক করে। মা, মাজেদা খালা, নূহা আর মীরা এ চারজনের জন্য টিকিট বুক করে মীরা। তমা, ফাহাদ দুজনের কেওই যাবে না। তমার পরদিন পরীক্ষা আর ফাহাদের নিজের বিয়ের জন্য পাকা মেয়ে দেখার কথা আছে৷

এবারকার বনভোজনটা বনে হবে না, হবে নদীতে। ঢাকা – চাঁদপুর – ঢাকা। সে অনুযায়ী সবকিছু প্রিপ্রেয়ার করছিলো মীরা। আগের দিন হিসাবপত্র করতে বেশ রাত হয় মীরার৷ আউটলেট গুলোর হিসেব ও দিনেই শেষ করেছে। কারখনায় নতুন মালপত্র ঢুকেছে তাই বাড়তি এই ঝামেলার জন্য এত দেরি হলো আজ। কারখানা থেকে বের হতে হতে সাড়ে দশটার মতো বেজেছে। বাড়ি ফিরবার পথে ফাহাদ বলেছিলো মীরাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা। মীরা নিষেধ করে বলেছে ও একা যেতে পারবে, ও বরং তমাকে যেন ওর বাড়িব অবধি পৌঁছে দেয়।

যেই ভাবা সেই কাজ। মীরা পরদিন পরার জন্য ড্রেস তৈরী করেছিলো, ভেবেছে চাঁদপুর নেমে কয়েকটা ছবি তুলে নিবে। বনভোজন ও হবে সাথে ফটোশুট ও।

সেই ব্যাগটা নিয়ে রিকশা নিয়ে নেয়৷ রিকশা কিছুদূর চলতেই চানখারপুল মোচরে একটা মাইক্রোবাস এসে দাঁড়ায় ওদের রিকশার সামনে। রাত সাড়ে দশটা বাজে, এ জায়গাটা রাতেরবেলা নিরিবিলিই থাকে। প্রায়ই দেখা যায় নেশাখোরদের আড্ডা। মীরা ভাবে গাড়িটা ইউটার্ন নিবে হয়তো। কিন্তু গাড়ির দরজা খুলে যখন দুটো ছেলে তেড়ে এলো ওদের রিকশার দিকে তখন মীরা সেকেন্ডের ভগ্নাংশেই যেন বুঝে গেলো সব। কি করবে তা ভাবার আগেই যা হওয়ার তা হয়ে গেলো। মীরাকে গাড়িতে তুলে নিলো ওরা, গাড়িতে উঠেই সেন্স লেস হয়ে গেলো মীরা৷ চোখ টেনে মেলে রাখতে পারছে না মীরা, নিশ্বাসের সাথে কিছু একটা শরীরে ঢুকে ক্রমশ অবচেতন করে দিচ্ছে ওকে। প্রাণপণে চেষ্টা করে ও চোখ খুলে রাখার। কিন্তু একটা সময় মীরার সব চেষ্টা যেন ম্লান হয়ে ওরে। চোখ বন্ধ করার আগে মীরা দেখলো গাড়িটা সেখান থেকে মুভ করে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে উঠে দ্রুতবেগে চলছে।

শীতের রাতে অন্ধকার ঐ রাস্তায় কেও জানলোও না

কি হয়ে গেলো। মধ্যবয়সী রিকশা ড্রাইভার কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে আছে। সংবিৎ ফিরলেই ঝামেলা এড়াতে দ্রুত সেখান থেকে কেটে পরেন তিনি। রিকশায় রয়ে গেলো মীরার নডুন ড্রেস ভর্তি ব্যাগটা।

যখন মীরার জ্ঞান ফিরলো তখন ওর সময়জ্ঞান নেই। ঠিক কতক্ষণ পর ওর ঘুম ভাঙলো ও তা জানে না। একটা সুসজ্জিত ঘরে শুয়ে ছিলো ও। মাথায় হালকা ব্যাথা অনুভূত হয় ওর। ঐদিন রাতের ঘটনাটা মনে পরতেই ব্রেইনকে যথাসম্ভব ফোর্স করলো ও।

কে সে?

যার নির্দেশে ও এখন এইখানে ?

ভীত সন্ত্রস্তা মীরা বিছানা ছেড়ে ধীর পায়ে খাট থেকে পা দুটোকে নামলো। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। পানির কথা ভাবতেই সাইড টেবিলের গ্লাসের দিকে চোখ গেলো মীরার। গ্লাসটা হাতে নিয়ে পানি সবটুকু পানি খেলো এক নি:শ্বাসে। গ্লাসটাকে সেখানে নিঃশব্দে রেখে উঠে দাঁড়ালো ও। ভয়ের দখল তখনো ওর মন জুড়ে।

পা টিপে টিপে জানালার কাছে গেলো ও। ভারী পর্দা সরাতেই দেখলো বাইরে খোলা জায়গা। একপাশে যত্ন করে তৈরী করা বাগান, আর অন্যপাশে বসার জন্য কটেজ টাইপ ব্যাঙের ছাতার আকৃতির বিশাল ঘর। যার চারপাশই খোলা। সেখানে কম পাওয়ারের আলো জ্বলছে। চারপাশের ঘন অন্ধকার আর নিশ্ছিদ্র স্তব্ধতা জানান দিচ্ছে এখন মধ্যে রাত। কান পেতে দূর থেকেও কোন শব্দ শুনতে পেলো না ও। পর্দা ছেড়ে সময় দেখতে ঘরে ঘড়ি আছে কিনা তা খুঁজতেই চোখ আটকে গেলো কিং সাইজ লাক্সারিয়াস ফ্লোর বেডের উপরের বিশাল দেয়ালে থাকা নিজের ছবির ওপর। ছবিটা ল্যান্স স্কেপে তোলা । সাইড টেবিলে রাকা ল্যাম্পের আলোটা এমন ভাবে রাখা যেন ছবিটাকে দেখাতেই সব চেষ্টা তার। দ্রুত পায়ে ছবিটার কাছে গেলো মীরা। লাল টুকটুকে গাউন পরে রিকশায় বসে হুড ফেলে দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজছিলো মীরা, তখনকার তোলা ছবি এটি। এটা যে প্রোগ্রামের দিনকার তোলা ছবি, তা বুঝে গেলো ও মুহূর্তেই। মীরার দিকে ফোকাস করে তোলা ছবিটার ব্যাকগ্রাউন্ড ব্লার করা। ও যে রিকশায় বসে ছিলো তা একটুও বোঝা যাচ্ছে না। ছবিটায় এত সুন্দর করে তোলা এবং এডিট করা যে তাতে প্রোফেশনাল কাজের ছাপ স্পষ্ট, এবং ছবিটা দামী লেন্সে তোলা।

ছবিতে মীরা বাম হাত উঁচু করে বৃষ্টিকে ছুঁয়ে দিতে চেষ্টা করছে। এত আবেদনময়ী লাগছে ছবিটা যে মীরার নিজেরই নিজেকে নিয়ে গর্ব হলো। এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে গ্রীক পুরাণের নার্সিসাস মনে হলো। যে নিজের সৌন্দর্যে এত গর্বিত ছিল যে যারা তার প্রেমে পড়ত তাদেরকে সে প্রত্যাখ্যান করে দিত। পার্থক্য কেবল নার্সিসাস পুরুষ আর মীরা মহিলা।

ছবিটার কাছে গিয়ে ভুল ভাঙে ওর। এটা কোন ফটোগ্রাফ না, বিশাল ক্যানভাসের উপর হাতে আঁকা পেইন্টিং এটি। নিচে লেখা সিগনেচারে গতকালকের তারিখ দেয়া। তারমানে এটা আঁকা শেষ হয়েছে গতকাল।

ছবিটায় হাত বুলায় ও। শিল্পীর কি সুন্দর আঁকার হাত! সেখানে দাঁড়িয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে পুরো ঘরটা দেখলো মীরা। দামী আসবাবে ঘেরা চারপাশ। ব্লেজার রাখার জায়গা, ড্রেসিংটেবিলের সামনে থাকা প্রসাধন দেখে রুমটা যে কোন পুরুষের তা খুব বুঝতে পারলো মীরা। এতক্ষণ এটাকে কোন রিসোর্ট ভাবলেও এখন ও বুঝে গেছে এটা কোন ভাড়া করা রিসোর্ট না। এটা করো ব্যাক্তিগত বাংলো বাড়ি।

পা টিপে দরজার কাছে যেতেই দেখলো দরজাটা খোলা৷ দরজা খুলতেই মীরা দেখে হলরুমের বিশাল টিভিতে মানি হাইস্ট সিরিজ দেখছে কেও। পর্দাতে ভেসে আছে হাত-পা বাঁধা টোকিওর ভয়ার্ত মুখ। এ যেন মীরার আরেক রূপ। ভয়ার্ত টোকিওকে টিভির স্ক্রিনে রেখেই সেখান থেকে চোখ সরিয়ে পুরো রুমে তাকায় মীরা। পুরো রুমটা অন্ধকার এবং ফাঁকা। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে অন্ধকার ঘরটায় টিভির দিকে মুখ করে রাখা সোফায় একটা মাথা জেগে উঠলো এদিক ফিরে শব্দের উৎস দেখবে বলে। ঐ জেগে উঠা মাথাটা এদিকে ফিরে দেখার আগেই মীরা দরজা আটকে ফেলে ভিতর থেকে…

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৭৬
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

পা টিপে দরজার কাছে যেতেই দেখলো দরজাটা খোলা৷ দরজা খুলতেই মীরা দেখে হলরুমের বিশাল টিভিতে মানি হাইস্ট সিরিজ দেখছে কেও। পর্দাতে ভেসে আছে হাত-পা বাঁধা টোকিওর ভয়ার্ত মুখ। এ যেন মীরার আরেক রূপ। ভয়ার্ত টোকিওকে টিভির স্ক্রিনে রেখেই সেখান থেকে চোখ সরিয়ে পুরো রুমে তাকায় মীরা। পুরো রুমটা অন্ধকার এবং ফাঁকা। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে অন্ধকার ঘরটায় টিভির দিকে মুখ করে রাখা সোফায় একটা মাথা জেগে উঠলো এদিক ফিরে শব্দের উৎস দেখবে বলে। ঐ জেগে উঠা মাথাটা এদিকে ফিরে দেখার আগেই মীরা দরজা আটকে ফেলে ভিতর থেকে।

টিভির শব্দ হঠাৎ থেমে গেলো। ভয়ে মীরার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। একটা শব্দ ক্রমাগত দরজার কাছে আসছে। থপ, থপ, থপ, থপ…

এ যেন পায়ের শব্দ না, মীরার হৃদয়ে হাতুড়ি পেটা করছে কেও। দরজার সাথে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মীরা। একেবারে দরজার কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো কেও। দরজায় কড়া নাড়লো। এমন ভয়, ত্রস্ততার অভিজ্ঞতা এর আগে হয়নি মীরার। কি করবে কিছুই ভাবতে পারছে না ও। রুমের চারপাশে তাকিয়ে ওর ফোন খোঁজার চেষ্টা করলো মীরা। ফোনটা বিছানার পাশেই ছিলো। দৌড়ে গিয়ে ফোনটাকে তুলে নিলো ও।

ফোনটা সুইচঅফ করা। ফোনটা খুলতে খুলতে আশেপাশে খুঁজে দেখতে চেষ্টা করলো এটা কোথায়, কিংবা কে ওকে তুলে এনেছে তা জানতে কোন ক্লু পায় কি-না তার খোঁজে । আলমারীর দরজা খোলার শব্দের সাথে আরো একটা দরজা খোলার শব্দ এলো পেছন থেকে।

যে দরজাটায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো ও কিছুক্ষণ আগে সেটা আলমারি যে দেয়ালে সেখনেই, এবং সে দরজাটা ওর চোখের সামনে বন্ধ। খোঁজাখুঁজি রেখে থমকে দাঁড়ালো মীরা, ওর হৃদপিণ্ড বন্ধ হবার জোগাড়। পিছন ফিরে যে দেখবে তারও সাহস নেই। ধীর গতিতে পায়ের শব্দটা কাছে আসছে ওর। পেছনে কে তা দেখার ইচ্ছা এবং ভয় দুটো অনুভূতির যুদ্ধ চলছে তখন মনে। শেষমেশ ইচ্ছাটাই জিতলো। ঘুড়ে দাঁড়ালো মীরা। টিশার্ট আর থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পরে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সায়ন!

সায়ন!? ওকে দেখে ভয়, ত্রস্ততা সব উবে গিয়ে

মেজাজ বিগড়ে যায় মীরার। ও বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলে-

: “তুমি?”

সায়ন মুচকি হেসে বলে-

: “কেন অন্য কাওকে আশা করেছিলে?”

মেজাজ আরো খারাপ হয় মীরার, কত বড় অভদ্র বয়সে বড় কারো অনুমতি না নিয়েই তুমি করে বলছে। মীরা রাগী কন্ঠে বলে-

: ” এসবের মানে কি?”

সায়ন ধীর পায়ে কাছে আসতে আসতে বলে-

: “আমি যায় চাই তা-ই পাই, আর আমি যদি তা না পাই, তাহলে কেও-ই তা পায় না”

ওর কথা বলার ভঙ্গিতে মনে ভয় ধরে যায় মীরার। যেন কিছু ভর করেছে ওর উপর। এ সায়নকে মীরা চিনে না। চোখেমুখে কিসের যেন একটা আদল, তখনো ধীর পায়ে কাছে আসছে ও। আলমারি ছেড়ে দরজার কাছে যেতে চায় মীরা। যাতে ও এখান থেকে বের হতে পারে। কিন্তু সায়ন ওর কাছাকাছি এসে পরলে মীরা ওকে সেখানেই থামতে বলে। সায়ন আজ্ঞাবাহের মতো থামে,

: “কি চাও তুমি? এসব কেন করছো?”

: ” সেই কবে থেকে বলছি আমি তোমাকে নিজের করে পেতে চাই” বলে আবারো মীরার কাছে আসতে থাকে সায়ন।

: ” আর এক কদমও আসবে না তুমি”

সায়ন মীরাকে যেন শুনতে পেলো না, ও তখনো আসছে মীরার কাছে। মীরা বুঝে গেছে রাগারাগি , বিরক্তি দেখিয়ে কোন লাভ হবে না। তখন মীরা সাহস করে কপট রাগী কন্ঠে ওকে বলে-

: ” দেখো সায়ন তুমি আমার থেকে কম করে হলেও পাঁচ বছরের ছোট, তাছাড়া আমি তোমাকে আমার ছোট ভাইয়ের চোখে দেখি৷ তুমি এই মুহূর্তে আমাকে আমার বাসায় পৌঁছ দিয়ে আসবে”

: “যদি না দিই”

এবার মীরার যেন ধৈর্যচ্যুত হয়, রাগে ওর শরীর কেঁপে ওঠে, ও সায়নের কাছে তেড়ে গিয়ে বলে-

: ” এসব করে তুমি কি প্রমাণ করতে চাও, তুমি বিশ্ব প্রেমিক? ফালতু ছেলে কোথাকার, নাক টিপলে এখনো দুধ বের হয় সে ছেলেপেলের এটিটিউট, সাহস দেখে বিরক্ত লাগে, তুমি এই মুহূর্তে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিবে” বলেই আলমারির কাছে পরে যাওয়া ফোনটা তুলতে যায় মীরা। এমন ভাব যেন ওর কথা মেনে নেয়া ছাড়া সায়ন নিরুপায়।

মীরার মুখে ঐ কথাটা শুনে চোখ দুটো জ্বলে উঠলো যেন সায়নের। ও মীরার দিকে তেড়ে এসে মীরাকে ওর দিকে ঘোরায়, মীরা কিছু বোঝার আগেই মীরার দুই কান চেপে ধরে। কি হতে যাচ্ছে তা বুঝতে পেরে মীরা ঝাড়া দিয়ে ওর হাত সরিয়ে তৎক্ষনাৎ সায়নের গালে একটা থাপ্পড় দেয়।

তারপর ফোন হাতে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে নেয় ঘর থেকে। সায়ন গালে হাত রেখেই পিঁছু নিয়ে অন্য হাত দিয়ে মীরার হাত চেপে ধরে। এবার মীরা সত্যি ভয় পায়। সায়ন টেনে মীরাকে কিছুমাত্র ভাবার অবকাশ না দিয়ে মীরার দুই হাত চেপে ধরে আলমারীর গায়ে৷ একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ও মীরার চোখে। মীরা নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সায়নের সাথে পেরে উঠে না। সায়ন রাগি গলায় বলে-

: “আমার নাক টিপলে এখনো দুধ বের হবে না, আমি খোকা! ”

তারপর কি ভেবে হুট করে গভীর চুমু খায় সায়ন মীরার ঠোঁটে। সায়নের কাছ থেকে বাঁচতে দুই হাত দিয়ে ওকে দূরে সরাতে চেষ্টা করে মীরা। কিন্তু শরীরের সব শক্তি এক করেও মীরা ওর থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারেনা। সায়ন গভীর চুমু একে দেয় মীরার ঠোঁটে। ততক্ষণে ওকে আটক রাখা হাত দুটোর একটা মীরার পিঠে আরেকটা মীরার মাথায় রেখেছে সায়ন। মীরা ছাড়া পেয়ে দুই হাতে সরাতে চাইছে ওকে।

দীর্ঘ চুমু খাওয়া শেষে সায়ন যখন মীরাকে ছাড়ে মীরা জড় পদার্থের মতো আছড়ে বসে পরে মাটিতে। যেন ভুমিকম্পে আছড়ে পরেছে কোন ইমারত।

বেসামাল মীরার হাত লেগে সেখানে থাকা কাঁচের ল্যাম্পশেড পরে ভেঙে যায়। কাঁচের একটা টুকরোতে হাত কাটে মীরার। সায়নের এসবে খেয়াল নেই। ওর খাটে বসে সায়ন বলে-

: ” আমি জানি না কোন দিকে আপনার আমাকে অযোগ্য মনে হয়? আমি সত্যি আপনাকে ভালোবাসি মীরা৷ আর আমি কেবল আপনার জীবনসঙ্গীই না, নূহার বাবাও হতে চাই”

মীরা যেন এসব কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। ও দুই হাতে মুখ চেপে কাঁদছে। সায়ন মীরার কাছে এসে সরি বলে ওর দিকে তাকাতেই দেখে মীরার হাত দিয়ে দরদর করে রক্ত পরছে। মীরার হালকা গোলাপী রঙের জামা রক্তে লাল হয়ে গেছে। কাঁচের টুকরোটা অর্ধেক ওর হাতে গাথা বাকীটা বাইরে।

সায়ন ওর হাত টেনে দেখতে চাইলে একটা বড় কাঁচের টুকরো নিয়ে নিজের গলার কাছে ধরে মীরা। সায়নকে বলে ওর থেকে দূরে সরতে। সায়ন পাগলের মতো করতে থাকে রক্ত দেখে, ওকে হসপিটালে নিতে চায় ও। কিন্তু মীরা এসব কিছুই শোনে না। ওকে সরে যেতে বলে মীরা, যাতে ও এখান থেকে বেরুতে পারে। সায়ন সেখান থেকে সরে বারবার ক্ষমা চায় ওর এমন আচরণের জন্য। মীরা অনেক কষ্টে টালমাটাল ভাবে উঠে দাঁড়ায়। সায়ন ওর এ অবস্থা দেখে কাঁদছে। বলছে মীরা আপনাকে হসপিটালে নিতে হবে, প্লিজ আমার কথা শুনুন। আমি ক্ষমা চাইছি আমার আচরণের জন্য আপনি যা শাস্তি দিবেন আমি তাই মাথা পেতে নিবো৷ আপনি প্লিজ হাত থেকে ওটা ফেলে দিন।

মীরা টালমাটাল ভাবে হাঁটতে থাকে দরজার দিকে। একটু হাঁটতেই শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে মুখ থুবড়ে পরে দরজার চৌকাঠে।

পরদিন মীরার জ্ঞান ফিরে হাসপাতালের বেডে।ওর সামনে বসা মীরার মা, মাজেদা খালা। ওর জ্ঞান ফিরার খবর শুনে ডাক্তার আসে রুমে, দরজার বাইরে কাঁচের দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সায়ন। ভিতরে ঢুকবার সাহস কিংবা শক্তি কোনটাই নেই ওর।

সেবার মীরার হাতের কব্জিতে ল্যাম্পের মোটা কাঁচের টুকরো গেঁথে গিয়ে দুটো ধমনী ছিড়ে যায়। ক্রমাগত রক্তক্ষরণে মীরা সেদিন জ্ঞান হারিয়েছিলো। আছড়ে পরায় মাথাতেও চোট লাগেছিলো সামান্য।

জ্ঞান ফিরার পর ওর মা জাহানারা বলেন-

: “এ ছেলে সময় মতো তোকে হাসপাতালে না আনলে শরীরের সব রক্ত বের হয়ে তুই মারা যেতিরে মা। এ ছেলে সাক্ষাৎ খোদা প্রেরিত দূত”

মীরা শান্ত কন্ঠে বলেছে-

: “তোমার দূতকে জিজ্ঞেস করলে না আমাকে কোথায়/ কিভাবে পেলো?”

জাহানারার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তারপর ও জোড়াতালি ভাবে বলে-

: “তখন জিজ্ঞেস করার মতো পরিস্থিতি ছিলো না”

পাশ থেকে ইরা বলে-

: “বুঝলি আপা গতকাল এর বাবা-মা হাসপাতালে এসেছিলো।তোর প্রতি দেখানো সমবেদনার এক ফাঁকে ওর মা তার ছেলের তোকে পছন্দ তা বলেছেন মাকে। মা তো দুই পায়ে রাজি আমি বলেছি আগে আপার সাথে কথা বলে তারপর না হয়… ”

ইরাকে থামিয়ে দিয়ে জাহানারা বলেন-

: “তুই চুপ থাক, বেশী কথা বলে, দুইটা দিন ধরে ঐ বেঞ্চটাতে শুয়ে-বসে কাটিয়েছে, কতবার বলেছি বাড়ি চলে যাও, যায় নি। কাজ, নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে বসে আছে। আজকাল দিনে এমন ছেলে হয় না মা”

: “তুমি ঠিকই বলেছো এমন ছেলে যে হয় না তা আমার চেয়ে ভালো কে জানে, যাই হোক আজ কি বার?

ইরা উত্তর দেয়-

: ” মঙ্গলবার ”

মনে মনে ভাবে মীরা- তারমানে রবিবার হসপিটালে এডমিট করা হয়েছে।

: “শোন মা, ওকে তুমি ২টো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে- বৃহস্পতিবার থেকে মীরা কোথায় ছিলো? আর কোত্থেকে পেয়ে ও আমাকে হাসপাতালে এনেছে?

যদি এর উত্তর ও দিতে পারে তাহলে ও যেন আমাকে মুখ দেখায়। মা আর কিছুই বলে নি, ওর শরীরের অবস্থা ভেবে। তবে পরে বোন ইরার কাছ থেকে ও জানতে পারে তারা সরাসরি জাহানারাকে বলেছে মেয়ে না নিতে পারার কথা। একমাত্র ছেলে ডিভোর্সিকে পছন্দ করেছে তাতে রাজি হয়েছে কিন্তু মেয়ে মেনে নেয়া সম্ভব না, মা ও গদগদ গলায় বলেছেন – সমস্যা নেই নূহাকে তিনি তার কাছে রেখে দিবেন।

এসব শুনে মীরার মাথায় আগুন ধরে যায়। রাতে ওর মাকে ঠান্ডা গলায় বলেন-

এ বিষয়ে তুমি কিছু না বললেই আমি খুশি হবো, আমার জীবণ সিদ্ধান্ত যা নেয়ার তা আমিই নিবো।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে