প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৬৯
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
দুজনে তারও আধ ঘন্টা পর পৌঁছুলো ভ্যানুতে। ভাড়া মিটিয়ে হলে প্রবেশ করলো দুজনে। তমা গেলো রেম্প ইভেন্টের ড্রেসিং রুমে ওদের পোশাক পরে রেম্প হয়ে গেছে কিনা তার খবর নিতে। আর মীরা প্রবেশ করলো মূল ফটকের লাল গালিচা দিয়ে।
ওকে রিসিভ করবার জন্য কেও না থাকলেও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হল ভর্তি সাকলে তখন মঞ্চের নাচ দেখা রেখে দেখছে অনিন্দ্য সুন্দরী মীরাকে। আলো-আঁধারি হলের মধ্যে পথ চিনিয়ে নিতে কেও না থাকলেও মীরার আগমনে একটা স্পটলাইট পথ দেখাচ্ছে ওকে। মনে মনে হাসে মীরা, কারন ও জানে এটা কার কাজ। ধীর পায়ে সামনের দিকে এগোয় ও। তারপর ভিতরে গিয়ে ইন্টারপ্রেরিওরদের জন্য রাখা নির্ধারিত আসনে বসে মীরা। আশেপাশে পরিচিত জনদের সাথে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করে ও। সকলে মুগ্ধ হয়ে দেখে মীরাকে। এত সুন্দর মীরা এত সুন্দর ড্রেস পরেছে চোখ ফেরানো দায় ওর থেকে।
পরিচিতদের মধ্যে সুজানা আপু জিজ্ঞেস করলো –
: “হেই, এত দেরী কেন করলে?”
: “আরে আপু, সব দোষ ঐ বিদেশী কূটনৈতিকের”
পাশে বসা ফ্লোরা আপু বললেন-
: “কূটনৈতিক পর্যন্ত পৌঁছে গেছো, বাহ বেশ লম্বাতো তোমার হাত”
মীরার হাসছিলো সুজানা আপুর সাথে, কথাটা খোলাসা করতে, ফ্লোরার এমন নোংরা ইংগিত পূর্ণ কথা শুনে ওর চোখ সরু হয়ে যায়, এই বদ মহিলা শুরু থেকেই মীরাকে অপছন্দ করে, সবসময় মুখিয়ে থাকে কোন একটা বাহানায় কিছু একটা শোনানো যায় কিনা। এমন মানুষ দুনিয়ার সব জায়গাতেই থাকে। যখন আপনার সাথে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, পরিশ্রম দিয়ে পাল্লা দিতে পারে না, তখন তারা হিংসার আগুনে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে মুখিয়ে থাকে অন্যকে ঐ আগুনে জ্বালাতে।
এরা সব কিছুর ভালো দিক, সৌন্দর্য দেখার আগে জহুরী চোখ দিয়ে খুঁজে বের করে খুঁত গুলোকে। মাঝে মাঝে মনে হয় এদের বেহেশতে নিলেও এরা সেখানকার খুঁত বের করে ফেলবে (আল্লাহ মাফ করুন)। এরা জীবণেও ভালো হবার নয়। এদের অন্তরে খোদা মোহর মেরে দিয়েছেন। কিন্তু পুড়ে পুড়ে খাটি হওয়া মীরাকে ভাঙা এতো সোজা? আগে এসবের শক্ত উত্তর দিতো, সেরের উপর সোয়া সের যাকে বলে। তবে আজকাল মীরা তা করেনা, নিজেকে ঠিক প্রমাণ করার চেয়ে চুপ থাকাকে শ্রেয় মনে করে। তাই মীরা এসব এড়িয়ে চলে, তবে আজকের ইংগিতটা কুৎসিত, নোংরা। ওর মজা করে বলা কথাটার যে এমন মানে তিনি বের করবেন মীরা তা ভাবতেও পারেনি। মীরা চোখ সরু করে কিছু বলতে যাবে এমন সময় তমা এসে বলে-
: “হ্যা আপু, ঠিক বলছেন মীরাপুর হাত বেশ লম্বা, তা না হলে দেশের সবচেয়ে বড় ম্যাগাজিনের কভারে আসা চাট্টি খানি কথা? আর আগামী মাসে থাইল্যান্ডে আন্তর্জাতিক ইভেন্টে আমাদের যোগ দেয়ার কথা না হয় বাদই দিলাম। আপনি তো বদ্ধ কুয়াতেই পরে আছেন, তাই নদীর আর সমুদ্র আপনার ধরাছোঁয়ার বাইরে। এজন্যই হুঁশ করে একটা কথা বলে ফেললেন। কোন কথার কি মানে তা আপনি ভেবেই বলেছেন, আর আমরাও হাত দিয়ে ভাত মেখে খাই, আমরাও বুঝি। যদিও আপনাকে দোষ দেয়া যায় না, আপনার জ্ঞানের দৌড় যতটুকু আপনি তো ততটুকুই বলবেন”
ফ্লোরা আমতা আমতা করতে থাকে, মীরা এখন মুখচোরা হলেও তমা বরাবর মুখপোড়া। মীরা তমাকে কপট ধমক দিয়ে বলে আরেহ্ এই কথায় এত কথা, ধূর, আসলে আপা হয়েছে কি বিদেশি কূটনীতিকের বিদায়ে পূর্ব ঘোষণা ব্যাতীত রাস্তা বন্ধ ছিলো বেশ কিছু সময়ের জন্য , তাই দেরি হয়ে গেলো, আর এ কথার কত মানে করে ফেলেছো তোমরা। তমা তুই বস তো।
পেছনের সিটে গিয়ে বসে তমা, ফ্লোরার দিকে মুখ নিয়ে ফিসফাস করে বলে-
: ” থাইল্যান্ডের ইভেন্টের পর তুরষ্ক যাবো আমরা, একটা শো এটেন্ড করতে। গতকালই ভিসার জন্য এপ্লাই করতে গিয়েছিলাম গুলশানের তুর্কি এম্বাসিতে, কে বলতে পারে বলুন, আগামী বছর হয়তো আমাদের পোষাক নিয়েই যোগ দিবো আমরা সেই ইভেন্টে। আপু স্রোতহীন কুয়া থেকে প্লিজ বের হন, তা না হলে স্রোতহীন কূয়ার পঁচা পানিতে থেকে আপনি-ও একদিন পঁচে যাবেন। দেখতেই পারবেন না, বাইরের দুনিয়াটা কত বড়, কত সুন্দর, কত রোমাঞ্চকর”
ফ্লোরা চোখমুখ শক্ত করে শোনে কথাগুলো। মীরা তখন কথা বলছে মুনিয়ার সাথে, সে এখানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ডের ওনার, অথচ তার কথাবার্তা, সাজপোশাকে কোন আড়ম্বরতা নেই, কত মিশুক আর আন্তরিক তিনি। তমা জানে আজ তিনজন এওয়ার্ড পাওয়াদের মধ্যে একজন মুনিয়া। মীরাকে নিয়েও আশবাদী ও। তবে চান্স 50/50। বাকীটা দেখা যাক কি হয়।
ইভেন্ট ইনভাইটেশন কার্ডে দেয়া অনুষ্ঠান সূচীতে একটু পরিবর্তন হয়েছে। মীরার আসতে দেরী হওয়ায় রেম্প শো পেছানো হয়েছে। ব্যাপারটাতে ভিষন অবাক হয়েছে ও সাথে বিরক্ত ও। কারন এতে সবাই অন্য মানে খুঁজে বের করবে। ব্যাপারটা জানার পর থেকে এওয়ার্ডটা আজ না পাক ও এমনটাই দোয়া করছে মনে মনে। তা নাহলে সকলের ওর এওয়ার্ড পাওয়াটাকে পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে বলতে একটুও বাঁধবে না। যদিও ওর ড্রেস, প্রাইজ রেঞ্জ, পেইজের ফলোয়ার সংখ্যা, মেলায় বিক্রি হওয়া এমাউন্ট সব কিছুর বিবেচনায় ও মনোনয়ন এ এসেছে। ঐ একজনের ঐ এক কাজের জন্য মীরার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। পার্স থেকে ফোন বের করে মীরা হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট করেন একজনকে-
: ” এমনটা না করলেই ভালো হতো, মানুষ এর অন্য মানে খুঁজে বের করবে”
: “লোকে কি বলবে তা ভাবার লোক তো আপনি নন”
: ” আমার নিজরই অস্বস্তি হচ্ছে, তেমার এসব কাজে আমার পরিশ্রম, মেধাকে মানুষ অবমূল্যায়ন করবে পক্ষপাতিত্তের তকমা লাগিয়ে”
: “ইশ্ তা যদি পারতাম আমি! ধন্য মনে করতাম নিজেকে,
: “দিস ইজ টু মাচ সায়ন”
: “আপনি হ্যা না বলা পর্যন্ত এমন চলতেই থাকবে”
: “তুমি বয়সে কম করে হলেও পাঁচ বছরের ছোট আমার, আমার একটা মেয়ে আছে তাও তুমি জানো, এ বিষয়ে আর একটা কথা হলে আমি তোমাকে ব্লক করবো”
: “আমাদের নবী (সাঃ) এর প্রথম বিবি খাদিজার সাথে তার বয়সের পার্থক্য কত ছিলো জানেন? পনেরো বছরের, আর এদিকে আমি মাত্র পাঁচ বছরের ছোট, তাও আপনার হিসেবে। দুজনের ডেথ অফ বার্থ
মিলালে এত হবে না বলে আমি শিউর”
: “তোমাকে ভদ্র বলে জানতাম, ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতাম, দিনশেষে তুমিও সবার কাতারে দাঁড়িয়ে গেলে”
: “সবার কাতার মানে? আমি কি বলেছি আপনার সাথে প্রেম করবো, বা লিভ ইন? আমি সরাসরি বলেছি আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই? এমন সাহস ক’জনের আছে বলুন তো”
: “বাজে কথা রাখো, আজ যেন আমাকে কোন এওয়ার্ড দেয়া না হয়, এটুকু অনুরোধ তুমি রাখো আমার, আমি মানুষের নোংরা কথা নিতে পারবো না”
: “এখানে আমার কোন হাত নেই, সত্যি! জুড়ি বোর্ড যদি মনে করে আপনি এওয়ার্ডের উপযুক্ত, আপনি পাবেন, না মনে করলে পাবেন না, এখানে আমার কোন এখতিয়ার নেই, তবে সেরা দশজনের থেকে চারজনের নাম কাটা পরার পরও আপনার নাম আছে, এটুকু কেবল দেখেছি আমি”
: “শোন ছেলে তুমি আমাকে আর কখনো ফোন কিংবা টেক্সট করবে না”
: “আপনি যে বাড়িতে থাকেন তার অপজিটের বাড়ি ভাড়া নিবো আমি, আপনার ফ্যাক্টরির পাশে নিজের ব্যাবসার ওয়ার হাউজ বানাবো, আপনার যে আউটলেট বসুন্ধরা আর ধানমন্ডিতে সেখানেও আউটলেট করবো দরকার হলে, পালায়ে কই যাবেন আপনি?”
: “দিস ইজ টু মাচ”
: “এ কথা আপনি আগেও বহুবার বলেছেন”
: ” তোমার টাকা আছে বলে টাকার বড়াই করছো? কিন্তু এসব করে কোন লাভ নেই”
: ” এটাকে টাকার বড়াই মনে হলো আপনার? এটা টাকার বড়াই নয়, এটা আপনার প্রতি আমার ভালোবাসার বড়াই”
ম্যাসেজটা দেখে সবগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্লক করে ওকে মীরা। এওয়ার্ডটার উপযুক্ত হওয়ার পরও মনে মনে প্রার্থনা করে এটা যেন না পায় ও। ফ্লোরার মতো মানুষের অভাব নেই, তাছাড়া নিজের কাছেই তো নিজেকে ছোট মনে হবে। দশবার যদি নিজেকে এর উপযুক্ত মনে হয়, অন্ততঃ একবার মনে হবে এটা কারো অনুগ্রহ। বহু পাগলের পাল্লায় পরেছে ও, কিন্তু এর পিছুটান ছাড়াতেই পারছে না ও।
এইসব ভাবনার ঘোর কাটলো রেম্প শোর এনাউন্সমেন্টে। একে একে প্রদর্শিত হলো অংশগ্রহণারী সকলের ড্রেস। মিরার টোটাল চারটা ড্রেস ছিলো। চারটা ড্রেসই গাউন ছিলো। অন্য সকলে যেখানে ড্রেসের মধ্যে কামনীয় ভাব ফোটাতে ব্যাস্ত, ব্যাস্ত শরীরের স্প*র্শ*কা*তর ভাজগুলো ফুটিয়ে তুলতে
মীরা সেদিকে মূল ফোকাস রেখেছে সৌন্দর্যে। যাতে ওর ড্রেস পরিধেয় কাওকে আব*দন*ময়ীর চেয়ে সুন্দর, স্নিগ্ধ লাগে। এ নিয়ে টিপ্পনী কম শুনেনি ও। কারন দুনিয়াটা নিজেকে আবেদ*নম*য়ী দেখাতে ব্যাস্ত, স্রোতের বিপরীতে হাঁটা মীরা প্রাধান্য দিয়েছে ড্রেস ফেন্সি হতে হবে নট সে*ক্সি। মডেলদের অনেকই এমন ড্রেস পরতে নাকচ করেছে। মীরা সেদিক বিবেচনায় তুলনামূলক কম পপুলার মডেলদের পেয়েছে ওর ড্রেস পরে পারফর্ম করানোর জন্য। তবুও সন্তুষ্ট মীরা। তবে কালার কম্বিনেশন, এক্সেসরিসের ব্যাবহার, ড্রেস ব্যাবহারে কম্ফোর্ট ফিল, প্রাইজ রেঞ্জ এসব দিকে ওর ড্রেস গুলো নজর কারে সকলের। প্লাস সাইজের একজন মডেলের ড্রেসটা সবচেয়ে বেশী নজর কারে সকলের। স্থুলকায় কেও যে রেম্পের মডেল হতে পারে এমন কনসেপ্ট মীরার মনেই বোধহয় প্রথম এসেছে। ও ওর ফ্যাক্টরির এক প্লাস সাইজ স্টাফকে বেছে এনেছে এখানে পারফর্ম করার জন্য। টানা এক সপ্তাহ ট্রেইন করা হয়েছে ওকে হাঁটার ধরন রপ্ত করতে। মেয়েটা বেশ চটপটে ছিলো, অল্প সময়ের মধ্যেই ও শিখে নিয়েছে রেম্পে হাঁটার বেসিক জ্ঞান। মীরা ওকে সাহস দিয়েছে, বলেছে তুই কেবল হেঁটে চলে যাবি বাকীটা আমি সামাল দিবো। এই এক ভিন্ন চিন্তা সকলের থেকে মীরাকে অনন্য করে তুললো সকলের কাছে। বিজনেস ক্লাসের প্রথম সারির মুনিয়াকেও প্রশংসা করতে দেখা গেলো ভিন্ন কনসেপ্ট নিয়ে কাজ করার দরুন। ভবিষ্যতে তিনিও প্লাস সাইজের মডেল নিয়ে কাজ করবে বলে আশা প্রকাশ করে মীরার কাছে । মীরা অকপটে এপ্রিশিয়েট করেন তাকে।
হঠাৎ উপরের দর্শক সারীতে একজনে চোখ আটকে গেলো মীরার, দূর থেকে তাকে দেখা যায় থামস আপ করে মীরাকে এপ্রিশিয়েট করতে। মীরা মুহূর্তেই মুখ ফিরিয়ে নেয় সেদিক থেকে। মীরার এমন আচরণে হাসতে দেখা যায় তাকে। মনে মনে সে বলে ” আপনাকে আমার হতেই হবে মীরা, এটা এখন আমার জীবনের একমাত্র গোল”
চলবে…..
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৭০
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
একে একে তিন ধাপে মঞ্চে উঠে বাকী সকলের ড্রেস। ক্রিয়েটিভিটির কত রূপ তা এখানে এলে দেখা যায়। একেক জনের ভাবনাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে একেক জন। রেন্ডম কিছু মডেল ক্যাটওয়াক করে স্টেজে আসছে তাদের মধ্যে থেকে একজন একজন করে সামনে এগুচ্ছে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছে তাদের পরিহিত ড্রেসের বহর।
জুরি বোর্ডের মেম্বাররা পয়েন্ট এড করছে মডেলদের নম্বর ট্যাগ দেখে । একেকটা পোশাকের আইডেন্টিটি তাদের ট্যাগ নম্বর। কে কোনটার ওনার তা জানার কোন উপায় নেই। একমাত্র উদ্যোক্তারা নিজেই চিনছে নিজেদের ড্রেস গুলোকে। সেই হিসেবে কোন মডেল যদি বেশী এপ্রিসিয়েশন পায় তখন তাদেরকে সহকর্মীরা অভিনন্দন জানাচ্ছে। এদের মধ্যে বেশ কয়েকটা ড্রেস নজর কারলো সবার। তার মধ্যে একটা মডেলের পরা গাউনে চোখ আটকে গেলো সকলের। খোদ মীরাকেই তাক লাগিয়ে দিলো সেটা।
জামদানী কাপড়ের তৈরী গাউন! জামদানী জিনিসটার প্রতি আমাদের বাঙালির ফ্যাসিনেশন আছে। জামদানি শাড়ি ঘরের মেয়ে বৌদের পছন্দের তালিকায় প্রথমে। স্বদেশী জিনিসের প্রতি অপত্য মমতা সকলেরই থাকে, এটা ভিন্ন কিছু না। আর আজ সেই জামদানী কাপড়ের গাউন উঠে এসেছে মঞ্চে। বলতেই হয় ইনক্রেডিবল! অফ হোয়াইট কালারের বেসের উপর গোল্ডেন জরির কাজ। আনারকলি স্টাইলের এ গাউনটার দুটো অংশ। ভিতরেরটা মূল গাউন, উপরে লং কোটি। এতে ব্যবহৃত জামদানী কাপড়টা গাউন তৈরির জন্যই বুনন করানো হয়েছে। তা না হলে আনারকলি জামা কাটিংয়ে নিচের পাড়ে এলোমেলো হয়ে যেতো। কোটিটা সবচেয়ে সুন্দর৷ ইচ্ছে করলে আলদা ভাবে পরা যাবে। মডেল একেবারে সামনে এসে মুভ-অন করার আগে কোটিটা খুলে ছেলেদের ব্লেজারের মতো হাতে ভাজ করে রাখলো। যেন অর্ধেক পথেই তার গরম লেগে গেছে। আসলে এ কাজটা তিনি ইচ্ছে করেই করেছেন ড্রেসটার স্পেশালিটি বোঝাতে। সকলে দারুণ এপ্রিসিয়েট করলো এ কাজকে। মীরাও তালি দিতে দিতে রুমানাপুকে জিজ্ঞেস করলো এটা কার ড্রেস আপা, রুমানা আপু চোখ মঞ্চে নিবন্ধ রেখেই উত্তর দিলো এটা “পিংক ক্লোজেট” -এর ড্রেস৷ পিংক ক্লোজেট? মীরার হাসিমুখ মূহুর্তেই ফ্যাকাসে হয়ে যায়। চোখ রোমানা আপুর থেকে দ্রুত ফিরিয়ে নেয় সেই জামদানী গাউনে। দূর থেকে যতটুকু দেখা সম্ভব দেখে নিলো মীরা। কারন “পিংক ক্লোজেট” এর ওনার মীরার বিনি পয়সায় কেনা চিরশত্রু “মিলন মাহমুদ” এর। মীরা সকলের তালে নিজেও হাততালি দেয়৷ আর মনে মনে ভাবে এত সুন্দর আইডিয়া মিলনের মাথায় এলো? তৃতীয় স্লটে চমৎকার কিছু ড্রেসের ক্যাটওয়াক দেখা গেলো। কিন্তু তা দেখাতে মন নেই মীরার। একটা ভাবনা মনে খুত খুত করছে। এমন প্যাটার্নের ড্রেস আগে ওরা তৈরী করতো একসময়। বিশাল ঘের, হাতের ডিজাইন, কোমরের কাছটায় এডজাস্টেবল এলাস্টিক, থ্রি কোয়ার্টার হাতায় ছেলেদের শার্টের মতো কাপ স্টাইলিস একটা ভাইব দেয়া, ক্লাসিক আনারকলির সাথে নতুন ট্রেন্ডের সংযোজন। তখনকার সময়ে মেয়েদের ছেলেদের মতো পোশাক পরার ট্রেন্ড বেড়ে গিয়েছিল। সবকিছু সেম টু সেম, “মীরা ফ্যাশন” এর ঐরকম দেখতে ড্রেসটার ডিজাইন পুরোপুরি রিডেক্ট করেছিলো রাজিব। মীরা রাজিবের এমন মাতব্বরিকে প্রশ্রয় দিয়েছিলো, কারন নতুন কাজ তোলার চেয়ে ডিজাইন কাস্টমাইজ বেশ ভালো হতো ওর। মীরা কোন খসড়া ডিজাইন তুললে তাতে কিছু সংযোজন বিয়োজন করে সুন্দর কিছু দাঁড় করাতে পারতো রাজিব। তবে এত ড্রেসের মধ্যে ঐ ড্রেসটা মনে থাকার কারন হচ্ছে হাতের এমন ডিজাইন নিয়ে বেশ হাসাহাসি ও হয়েছিল মীরা আর রাজিবের মধ্যে। রাজিব বলেছিলো দেখো এটাই এই ড্রেসের স্পেশালিটি হবে, রাজিবের কথা সত্যি হয়েছিল। ওদের ঐ ড্রেসটা তখনকার সময়ে টপ সেলিং ছিলো। এমনও হয়েছিল যে অনেকে অর্ডার করার সময় বলেছিলো- “ঐ যে একটা ড্রেস আছে না আপনাদের, যেটার হাতায় শার্টের মতো কাপ ডিজাইন করা, ঐটা” সত্যি এটাই এর ডিজাইনারকে মনে করিয়ে দিলো । পিংক ক্লোজটের এই ড্রেসে অতিরিক্ত যা এড ছিলো তা হচ্ছে কোটিটা। মানে এটা মীরা ফ্যাশনের আগেরকার ডিজাইন ড্রেস এর নতুন সংস্করণ।
মীরা মনে মনে ভাবে – আচ্ছা অনেক আগে একবার শুনেছিলো রাজিব মিলনের ম্যানেজার হিসেবে জয়েন করেছে, ও কি এখনো আছে সেখানে? এমন সব ভাবনায় বুদ মীরার সংবিৎ ফিরলো কফির আগমনে৷ মীরা হাসিমুখে ওয়েটারের কাছ থেকে কফি নিলো৷ এমন বিদখুটে মূহুর্তে ধোয়া উঠা এক কাপ গরম কফি ওর মানসিক চাপ কিছুটা মন্থর করলো। এরপর ইভেন্টের একে একে সবগুলো পার্ট সুন্দর ভাবে শেষ হলো। মীরার এখনকার সবচেয়ে ভালোলাগার সেগমেন্ট হচ্ছে বিজনেস সারভাইভাল স্টোরি। এই সেগমেন্টে পাঁচ মিনিট সময়ের মধ্যে সবাই তাদের বিজনেস সারভাইভাল স্টোরি শেয়ার করেন। এককেটা সারভাইভাল স্টোরি যেন একেকটা মহাকাব্য। যদিও পাঁচ মিনিট খুব অল্প সময় তবুও একেকটা গল্প যেন অনুপ্রেরণা দেয় উদ্দ্যোমী, সাহসী, আর পরিশ্রমী হওয়ার। মীরাও ওর সারভাইভের গল্প বলে। তবে স্বজ্ঞানে এড়িয়ে যায় ওর জীবণের প্রথম ইনিংসের সারভাইভাল স্টোরি। যা বলা হলে আমরা নিশ্চিত নির্দ্বিধায় ও জিতে নিতে বেস্ট সারভাইভাল এওয়ার্ড।
এই সেগমেন্টের পর এনাউন্সমেন্ট হলো লাঞ্চে যাওয়ার অনুরোধ। লাঞ্চের পরপর এওয়ার্ড সেরেমনি হবে। লাঞ্চে বসে খাওয়া-দাওয়ার ফাঁকে সকলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে কোন কোন ড্রেস বেস্ট হতে পারে। সকলের মধ্যে চাপা উত্তেজনা। ফলাফল প্রকাশের আগে তো সকলের মনেই বেস্ট হওয়ার সম্ভাবনাময় স্বপ্ন ঝুলে থাকে, তা হোক রেম্পে কিংবা লাইফের অন্য কোন পরীক্ষায়। মীরা নিজেও ভীষণ চিন্তিত। গতকালের একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর প্লাস সাইজ নিয়ে কাজ করাটাই শেষ ভরসা ছিলো। এবং এটাকে তখন পর্যন্ত এক্সট্রা অর্ডিনারী ভেবে বসেছিলো ও। কিন্তু কেও যে ওকে বিট করার জন্য আগে থেকেই তৈরীই ছিলো তা ও ভাবেনি। নিজেকে গ্রান্ড ভাবলে যা হয় আরকি। মনে মনে ও বকলো নিজেকে। আর ভাবলো শত্রুকে কখনো দূর্বল ভাবা ঠিক না। বেশ কিছু দিন আগে ও শ্রী গোপীনাথ গোস্বামীর সম্পাদিত চাণক্য নীতি নামে একটা বই পড়েছিলো, যেখানে অনেক বিষয়ে চাণক্যর নীতি সম্পর্কে আলোচনা করা আছে। তার একটা অংশে চাণক্য শত্রুদের সম্পর্কে সর্বদা তটস্থ থাকতে বলেছেন। যে ব্যক্তি শত্রুদের ক্ষেত্রে অসতর্ক হয়ে পড়ে তার ক্ষতি হতে পারে। চাণক্য নীতি অনুসারে মানুষের দু’ধরণের শত্রু রয়েছে। একজন শত্রু যিনি উপস্থিত হন এবং অন্যটি যিনি দূর থেকে শত্রুতা করেন। এই উভয় ধরনের শত্রু সম্পর্কে এক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিকে সর্বদা সজাগ এবং সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া রয়েছে চাণক্যের সেই নীতিতে। কারণ শত্রুরা কেবল তখনই আক্রমণ করে যখন সে অসতর্ক বা দুর্বল থাকেন। চাণক্যের মতে শত্রুকে কখনোই দুর্বল মনে করা উচিত না। শত্রুকে শত্রু হিসাবেই বিবেচনা করা উচিত এবং তাকে ছোট এবং দুর্বল হিসাবে ভাবা অনুচিত । শত্রুর প্রতিটি ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ করা, শত্রু কী করছে সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞাত থাকা উচিত। প্রতিক্রিয়া না জানাতে পারলেও, শত্রুর ক্রিয়াকলাপকে কখনোই উপেক্ষা করা উচিত না। মীরার ভুলটা করেছে এখানেই। প্রতিপক্ষকে ছোট ভেবেছে। পুরাতন শত্রুকে ও ভুলে গেলে কি হয়েছে, শত্রু তো ওকে ভুলে নি। যার প্রমাণ হাতেনাতে পেয়েছে ও গতরাতে।
এমন সময় মীরার একটা ফোনকল আসে। এক রেগুলার কাস্টোমারের কল। ওপাশ থেকে একরাশ কথা শোনান তিনি মীরাকে। তার কথার সারমর্ম এই যে- আজ রাতে তার এ্যানিভার্সেরী পার্টি। তার অর্ডার করা ড্রেস গতকাল পৌঁছানোর কথা ছিলো, আজ এত বেলা চলে যাবার পরও সেটা কেন পৌঁছালো না। মীরা এত চাপ মাথায় নিয়েও যথেষ্ট কুল থেকে তার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। মীরা বলেছে-
: “গতকাল একটা সমস্যা হওয়ার কারনে ড্রেস ডেলিভারি ডিলে হয়েছে। আপনি কোন চিন্তা করবেন না আপু, সন্ধ্যার মধ্যেই ড্রেস পৌঁছে যাবে”
কল কেটে ঘড়িতে দেখে মীরা। আড়াইটা বাজে এখন। অনুষ্ঠান পাঁচটার মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। অনুষ্ঠান স্থল আর ডেলিভারি পয়েন্টের মধ্যে মনে মনে দূরত্বের একটা ছক কষে মীরা। এমন সময় তমা আসে মীরার কাছে৷ মীরা বলে তুই বস, আমি একটু আগেই খাওয়া শেষ করলাম। তমা কার কল ছিলো জানতে চাইলে মীরা বলে-
: “গ্রীণ রোডের সেই রিপিট কস্টমারটা”
: “কি বললেন তাকে?”
: “কি আর বলবো, যা ছিলো কপালে তা তো হয়েছেই, শুধু শুধু রেগুলার এই কাস্টোমারের নেগেটিভ রিভিউ নিয়ে লাভ কি? বলেছি সন্ধ্যার আগে পৌঁছে দিবো ড্রেস”
: “পারবেন?”
: “পারবো মনে হয় ”
: “গতকালের ঘটনাটা কে ঘটিয়েছে আপনি কাওকে সন্দেহ করেছেন? ”
: “নাহ্ ওটা একটা এক্সিডেন্ট ছিলো”
: “আপু ওটা মোটেই এক্সিডেন্ট ছিলো না, ওটা প্রি-প্ল্যান করা কাজ। আমার গুবরে মাথায় এটা বুঝলাম আর আপনি ইন্টেল্যাকচুয়ালি স্মার্ট হয়েও বুঝেননি এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন আপনি?
উত্তরে ড্রিংকস পানরত মীরা একটা রহস্যময় হাসি হাসলো৷ এ হাসিটা ও ঠোঁট দিয়ে না, হাসলো চোখ দিয়ে। যার মনে হচ্ছে কিছু একটা লুকাচ্ছেন তিনি ওর কাছে।
তমা ব্যাপারটা নিয়ে আর ঘাটলো না, এমন সময় পাশে দাঁড়ানো ফ্লোরার হাত থেকে ড্রিংকস গড়িয়ে পড়ে মীরার গাউনে, দ্রুত দাঁড়িয়ে পরে মীরা। ট্যিস্যু দিয়ে ড্রেস মুছতে থাকে। ফ্লোরা সরি বলেই কেটে পরে সেখান থেকে। যেন সরি বলেই তার অ*প*কর্মের সব দায় শেষ হয়ে গেলো।
মীরা দৌড়ে ওয়াশরুমের দিকে যায়। এত চাপ, এত উটকো ঝামেলা, এত শত্রু এরা কি জীবণেও পিছু ছাড়বে না ওর? ড্রেস পরিষ্কার করা রেখে ও ওয়াশরুমের দামী মার্বলে পাথরের বেসিনে দুই হাতে সব ভর ছেড়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই এসব ভাবতে থাকে । একটু পরে মাথা তুলে আয়নায় তাকায় ও । অনিন্দ্য সুন্দরী, সাকসেসফুল বিজনেস উমেন, গোছানো ক্যারিয়ার এমন সব বিশেষণে মোড়া ওর নাম। সকলে বলে – “ভাগ্যের জোড় আছে মেয়েটার, তা নাহলে এ বয়সে এত কিছু?” অথচ এত এত সাকসেসের সাথে কত যন্ত্রণা যে পাশাপাশি জায়গা করে আছে ওর জীবণে তা কেও জানে না। ওর একটা দুর্ভাগ্যের কথাই কেবল সকলে জানে। তা হচ্ছে রাজিবের সাথে ওর ডি*ভো*র্স। তবে সমাজ পুরোটা জানে না, জানতেও চায় নি কখনো, সমাজ মোটাদাগে তকমা লাগিয়ে দিয়েছে “মেয়ে মানুষের কামাই থাকলে জামাই লাগে না” মীরার ইচ্ছে করে, এমন ভাবা প্রতিটি মানুষকে ও ধরে ধরে বলে কেন এত ভালোবেসেও ওদের বিয়েটা টিকলো না, কিন্তু আফসোস ও তা পারেনা। এসব ভাবতেই ফ্ল্যাশ ব্যাকে চলে যায় মীরা গত রাতে –
“গতপরশু ড্রেসিং রুমে সকালেই তাদের ড্রেস গুলো এনে জমা করেছিলো মূল ইভেন্টের জন্য। মডেলদের ড্রেস বুঝিয়ে দেয়ার পর, ট্রায়াল চলে, সন্ধ্যার দিকে সব কাজ শেষ হওয়ার সময় ভেন্যুতে কি এ বিষয়ে ছোটখাটো ঝামেলা বাঁধে। তাই সকলে সেখানে দৌড়ে যায়, সকলের সাথে সাথে মীরাও যায় কি হয়েছে তা দেখতে। পরদিন ইভেন্ট থাকায় সেখান থেকেই জলদি ফিরে যায় বাড়িতে।
সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো ইভেন্টের প্রথম দিন। মীরা সারাটা সময় মেলায় ব্যাস্ত ছিলো। এদিকে ফোন আসে মীরার এক মডেলের, ফাইনাল ট্রায়াল দিতে গিয়ে দেখে ওর ড্রেসটা নাকি ছেড়া। একেবারে বুকের কাছটায় ব্লে*ড/এন্টি*কা*টা*র জাতীয় কিছু দিয়ে পোচ দেয়া। মীরা দ্রুত সেখানে গিয়ে ড্রেস হাতে বসে পরে সোফাতে। কারচুপি কাজ করা ফ্লপি এই ড্রেসটা সবচেয়ে দামী এবং সুন্দর ড্রেস ছিলো ওর সবগুলো ড্রেসের মধ্যে, এবং শুধুমাত্র এই ড্রেসটাকেই রেম্পের জন্যই তৈরি করা হয়েছিলো টানা একমাস কাজ করে। এটাকে সংশোধন করবে তার সময় কিংবা মন মানসিকতা কোনটাই নেই ওর। রেম্পের একদিন আগে মন ভেঙে যায় মীরার। উপায় না পেয়ে ঐ মডেলের বডি সাইজ অনুযায়ী ড্রেস খুঁজে ওয়ার হাউজে রাখা স্টক থেকে। ৩৬” সাইজের একটা ড্রেসও নেই সেখানে ইভেন্টে পরার মতো, যা আছে তা অতি সাধারণ মানের। এসব ভেবে হঠাৎই ওয়ার হাউজের মেঝেতে বসে পরে ও। এখন অন্য কোন ড্রেস মানে অন্য মডেল। এত অল্প সময়ে মডেল খোঁজা, তাঁকে ট্রায়াল দেয়া এসব অসম্ভব। উপায়ন্তর না দেখে কাস্টমারের ডেলিভারির জন্য প্যাকিং করা একটা ড্রেস প্যাকেট খুলে বের করে। যেটা আজ গ্রীণ রোডের ঐ কাস্টমারের এ্যানিভার্সেরি পার্টিতে পরার কথা ছিলো। ডেলিভারি আগামীকাল দেয়ার কথা। ইভেন্ট শেষে ও নিজে সেটা পৌঁছে দিবে ভাবে মনে মনে। এটুকু রিস্ক নেয় মীরা, এছাড়া উপায় নেই। সেই আপুটাই ওকে কল করেছিলো একটু আগে। শুনিয়েছেন এক রাশ কথা।
এসব ভাবতেই মুনিয়া আপু আসেন ওয়াশরুমে। মীরাকে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন –
: “মীরা তুমি কি কোন কারনে চিন্তিত? ”
: “না, আপু, এমনিই মাথা ধরেছে”
কথাটা শুনে তিনি ব্যাগ থেকে প্যারাসিটামল বের করে দিলেন ওকে, ধন্যবাদ দিয়ে মীরা দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো। আরেকটু দাঁড়ালে হয়তো মুনিয়া আপু ওর চোখের পানি দেখে ফেলবে সে ভয়ে। দুনিয়ার কাছে মীরা আয়রন লেডি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ও যে কত্ত ভঙ্গুর তা কেও জানে না, কাওকে ও তা জানতেও দেয় না ও। কারন যারাই জেনেছে তারাই পরবর্তীতে তার সুযোগ নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা শোনাতে ছাড়ে নি। তাই আয়রন লেডির মুখোশটা মুখে এটে রাখে ও। কি হবে এদেরকে দুঃখ বলে? শক্ত থাকার অভিনয়ের ফলশ্রুতিতে মানুষকে ও বলতে শুনেছে, “এত কঠিন মানুষ হয়?” তখন মনে মনে হাসে মীরা। আর বলে কত শক্ত যে আমি, তার সাক্ষী কেবল আমার ঐ জায়নামাজ।
হল রুমে ফিরে এসে দেখে এওয়ার্ড এনাউন্সমেন্ট এর জন্য চিফ গেস্ট বিজিএমইএর সভাপতি অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছেন। দ্রুত নিজ আসনে বসে মীরা। একে একে তারা তাদের বক্তব্য রাখেন। প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে তা নিয়েও মেয়েদেরকে এপ্রিসিয়েট করলেন। কথা দিলেন পাশে থাকার। তারপর এলো সেই মহেন্দ্রক্ষণ। এখনি একে একে ঘোষণা হবে –
বেস্ট ফ্যাশন হাউজ এওয়ার্ড
বেস্ট এক্সিলেন্সি এওয়ার্ড
বেস্ট বিজনেস সারভাইভার এওয়ার্ড
সরগরম হলটা মুহূর্তেই নিশ্ছিদ্র নিরবতায় ছেঁয়ে গেলো। প্রথমে বেস্ট ফ্যাশন হাউজ এওয়ার্ড ঘোষণা হবে। অনেক গল্প কথার পর এওয়ার্ড প্রদানকারী গেস্ট জানালেন এবারের ইভেন্টে বেস্ট ফ্যাশন হাউজ এওয়ার্ড পেয়েছেন মুনিয়া আপুর “রিদম অফ লাইফ ফ্যাশন হাউজ”
মীরা ভীষণ খুশি হয় মুনিয়াপু এ এওয়ার্ড পাওয়ায়৷ যেন ওর খুব কাছের কেও এটা পেয়েছে। উনি এটার একমাত্র উপযুক্ত বলে মনে করে মীরা। মুনিয়া আপু তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে নিজের মনোভাব জানালেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের সকলের প্রতি, আরো কৃতজ্ঞতা জানালেন সকল সহকর্মীদের প্রতি যাদের থেকে প্রতিনিয়তই তিনি শিখছেন।
এরপর ঘোষণা হবে- “বেস্ট এক্সিলেন্সি এওয়ার্ড ”
এ ক্যাটাগরিতে তিনজনকে পুরষ্কৃত করা হবে। এওয়ার্ড দিতে মঞ্চে এলেন স্বনামধন্য ফ্যাশন হাউজ ওনার “সালমান মুরশেদ ” তিনি স্বল্প কথায় তার বিজনেস স্টোরি শেয়ার করলেন সকলের সাথে। তারপর ঘোষণা করলেন একে একে তিনজনের নাম-
তিনজনে মধ্যে –
© প্রথমে ঘোষণা করা হলো-
” মুনিয়া শেহতাজ ” দা ওনার অফ “রিদম অফ লাইফ ফ্যাশন হাউজ” তিনি মনোনীত হয়েছেন প্রথম বারের মতো সোনালী আঁশ খ্যাত পাট -এর তৈরী সুতার পোষাকের জন্য।
© দ্বিতীয় জন হচ্ছেন
“মিলন মাহমুদ ” দা ওনার অফ “পিংক ক্লোজেট”
তিনি মনোনীত হয়েছেন দেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) (GI- Geographical Indication) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া জামদানির পোষাকের নতুন ধরন নিয়ে কাজ করায়।
© তৃতীয় জন হচ্ছেন
“জিনিয়া আবেদীন মীরা” দা ওনার অফ “মীরা ফ্যাশন” তিনি কাজ করেছেন ফ্যাশন সচেতনতায় পিছিয়ে পরা প্লাস সাইজের সম্প্রদায়ের জন্য।
একে একে তিনজনকে মঞ্চে আসার অনুরোধ করেন উপস্থাপক। মীরার এই সাকসেস এ ওকে কনগ্রচুলেট করে তমা। মীরা আনন্দের অনুভূতি ভাগ করে নেয় তমাকে আলিঙ্গন করে, তমাও উষ্ণ অভিবাদনে যুক্ত করে ওকে। তারপর উইনার তিনজন পৌঁছায় মঞ্চে।
“রিদম অফ লাইফ ফ্যাশন হাউজের পক্ষে – মুনিয়া”
“মীর ফ্যাশনের পক্ষে – মীরা” এবং
“পিংক ক্লোজের পক্ষে – রাজিব”
হ্যা সেই “রাজিব” যে মীরার জীবণ গল্পে এক সময় ঘোড়ায় চড়া রাজকুমার ছিলো। তবে আজ সে যে মঞ্চে উঠেছে জীর্ণ, মলিন বেশে, নিতান্ত অনিচ্ছায়, অপারগতায়, মালিকের আজ্ঞাবহ হয়ে, কিংবা কে বলতে পারে এত বছর পর মীরার সামনে দাঁড়ানোর এ সুযোগটা হাতছাড়া না করতে ।
আজ অনেক বছর পর রাজিবের সাথে দেখা হলো মীরার। নিলামের ঐদিনের পর থেকে রাজিব আর একবারও ওর সামনে আসার সাহস করেনি। মীরার অবর্তমানে মেয়েকে দেখে গেছে বাসায় এসে। মীরা কড়া নিষেধ করে দিয়েছে মাজেদা খালাকে ওকে যেন আর ঢুকতে দেয়া না হয়। এরপর আর আসে নি ও। সন্তর্পণে মেনে নিয়েছে ওর পরাজয়, খর্বিত করা বাবার অধিকার। আজ অনিচ্ছুকভাবে মুখোমুখি হয়ে গিয়েছিলো দুজনে। মীরার হঠাৎ অস্বস্তি হতে থাকে রাজিবকে দেখে। স্মৃতির বাক্স হতে মীরার চোখের সামনে ভাসতে থাকে ওদের প্রথম প্রেমে পরা, পালিয়ে বিয়ে, ওর সাথে কাটানো সুন্দর আর অ*ন্তর*ঙ্গ সব মুহূর্ত গুলো। মীরা সামনে তাকিয়ে দেখে মিলন মাহমুদ তার আসনে বসে পায়ের উপর পা তুলে থুতনিতে হাত রেখে রহস্যময় হাসি হাসতে। মীরার আর বুঝতে বাকী থাকে না যে মিলন ওকে কুপোকাত করতেই রাজিবকে মঞ্চে পাঠিয়েছে।
মাঝখানে মুনিয়া আপুকে রেখে রাজিবের অপর প্রান্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় মীরা হাস্যজ্জ্ব্যল মুখে। অনেক ভেঙে গড়া মীরা আজ আর ভাঙবে না। জীবণ উপন্যাসে দুএকটা খারাপ গল্প হয়তো থাকে, তাতে গোটা জীবণটা খারাপ হয়ে যায় না, রাজিব তেমনি মীরার জীবণ উপন্যাসের একটি খারাপ গল্প মাত্র।
একে একে তিনজনের হাতে তুলে দেয়া হয় “বেস্ট এক্সিলেন্সি এওয়ার্ড ” মীরার সাথে হ্যান্ডশ্যক অবস্থায় বিজিএমইএর সভাপতি মীরাকে বলেন- আই নো ইউ মীরা, ইউ আর এ ব্রেভ গার্ল। তিনি সহাস্যে বিজয়ীদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে এত অল্প বয়সে এত বড় জায়গায় পৌছানোর জন্য স্পেশাল কনগ্রেচুলেশন জানায় ওকে৷ মীরা একটু ঘাবরে যায় তার “আই নো ইউ মীরা” কথাটা শুনে। কারন তিনি সেই অসভ্য, অভদ্র সায়নের বাবা, আর সায়ন তার একমাত্র পুত্র …
চলবে…..
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৭১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
প্রোগ্রাম শেষ করে গ্রীণরোডে ডেলিভারির ড্রেসটা নিয়ে তমাকে রেখেই বেরিয়ে পরে মীরা। তমা আর ফাহাদ সবকিছু গুছিয়ে ফিরবে। উবার কল করে ও যখন গাড়িতে উঠে ঘড়িতে তখন সাড়ে পাঁচটা। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা থাকলেও, আকাশ ছিলো মেঘলা। বৃষ্টি নামি নামি করছে, মীরা মনে মনে ভাবে লোকেশনে পৌঁছানোর আগে বৃষ্টি না হলেই হলো। গাড়িতে বসে মীরা প্রথমে কল করেন মুখলেস চাচাকে৷ তিনি ওর জীবণে যতটুকু করেছেন ততটুকু করবার সুযোগ ও ওর নিজের বাবাকেও দেয়নি। লোকটাকে খোদা নিজে পাঠিয়েছেন ওর জীবণ গুছাতে। নাহলে মিলনের আগে তার লাগার কথা ছিলো মীরার পিছনে। মুখলেস চাচা ভীষণ খুশি হন এমন খবরে। বলেন “আমি ত আগে থেইক্কাই জানতাম এটা তুমি পাইবা, যাক গা মিষ্টি খামু মা জননী, মিষ্টি ছাড়া কোন কথা হইবো না” মীরা হেসে বলেছে ও নিজে মিষ্টি নিয়ে আসবে তাদের বাড়িতে। তারপর মীরা ওর মাকে কল করে জানায় সু-খবরটা। ওর মা ভীষণ খুশি হয়, ওর এই খবরে। বলেন এ খুশি উপলক্ষ্যে রাতে তার বাসায় খেতে। ইরা আর মুরসালিনদের পরিবারের সবাইকে ও আসতে বলবেন তিনি। এমন সময় ইরার ম্যাসেজ আসে, অভিনন্দন জানিয়ে, মীরা ভাবে ও নিশ্চয়ই খবর পেয়েছে তমার কাছ থেকে। ব্যাগ থেকে এওয়ার্ডটা বের করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে মীরা। সেটাতে চুমু খেয়ে স্বপ্ন বুনে এরচেয়ে ভালো কিছু অর্জনের। এমন সময় সায়নের ম্যাসেজ আসে ফোনে –
“এটি প্রথম বিজয় হতে পারে,তবে এটিই শেষ অর্জন নয়, অভিনন্দন প্রিয়। আরো অনেক কিছু অর্জন করার বাকী”
মীরা উত্তরে ধন্যবাদ জানায় সায়নকে।
প্রত্যোত্তোরে সায়ন লেখে- “আপনার এয়ই পথচলায় আমাকে নেন না সঙ্গী করে”
ম্যাসেজটা নোটিফিকেশন বার থেকেই পড়ে মীরা। সওয়্যাইপ করে মুছে দেয় আন-সিন ভাবে। এ ছেলের সব কথার শেষ কথা এই এক কথায়ই। দুনিয়ায় মেয়ের অভাব? এত সুন্দর পোলা তুই, তোর বাবার এত টাকাপয়সা, এত অল্প বয়সে ব্যাবসায় স্যাটেল হয়ে গেছিস, তোর মেয়ের অভাব হবে? তোকে কেন বিয়াইত্তা, বয়সে বড়, এক বাচ্চার মাকে বিয়ে করতে হবে? ফাজিল ছেলে। এর কথা শুনলেই গা জ্বলে, ভাব ভালোবাসা এসব তো বহু পরের ব্যাপার। মনে মনে বকে মীরা সায়নকে। “ফালতু ছেলে কোথাকার ”
এসব ভাবনাকে একপাশে সরিয়ে মীরা এওয়ার্ডটার একটা ছবি তুলে পাঠায় সুদূর লন্ডনে থাকা লোরা, এবং কানাডায় থাকা টুম্পাকে। এওয়ার্ডটাকে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের মেঘলা আকাশে আনমনে চেয়ে থেকে মনে করতে থাকে প্রোগ্রামে রাজিবকে দেখতে পাওয়ার ঘটনাটা। এত বছর পর শুধু একটি বারের জন্য দৃষ্টি বিনিময় হয়েছিলো দুজনের, তারপর আর একবারও না। জীবন কত অদ্ভুত! কত কাছে থাকা দুটি মানুষের মধ্যে সময়ের আবর্তন কত দূরত্ব সাজিয়ে দেয় নিপুন হাতে। গাড়ির জানালায় মুখ রেখে চোখ বন্ধ করে রাখে মীরা। ভাবে ওরা দুজন একসাথে পরিশ্রম করলে আজ কোথায় পৌঁছে যেতো “মীরা ফ্যাশন”। বাতাসের বিপরীতে ছুটছে গাড়ি, মীরার ভীষণ ভালো লাগছে, চলন্ত গাড়ির স্পিড ওর চুল উড়িয়ে দিচ্ছে তাই । আনমনে মুখের কাছে আসা চুলগুলো পেছনে গুঁজে দিচ্ছে ও, অবাধ্যের মতো তারা আবারো সামনে এসে পরছে, বিরক্ত করতে মীরাকে৷
গাড়িটা ফাঁকা রাস্তা পেয়ে অল্প সময়েই পৌঁছে গেলো ঠিকানায়, মীরা অনেক বছর পর ঠিকানা খুঁজে ডেলিভারি পৌঁছে দিতে এলো কাস্টমারের দোরগোড়ায়।
কলিংবেল শুনে দরজা খুলে মেয়েটা এমন অবস্থায় মীরাকে দেখে তাজ্জব। ডেলিভারি পৌছুতে দেরি হওয়ার জন্য সরি বলেছে মীরা, কাস্টমার মেয়েটা নিজেও খুব লজ্জিত তার ঐরকম ব্যাবহারের জন্য। মীরা নিজে আসবে ড্রেস নিয়ে এটা কল্পনাও করেনি ও। সংকোচ মীরার ও ছিলো, নিতান্ত অনিচ্ছায় একবার পরা ড্রেস দিতে হলো তাকে, আর কোন উপায় ছিলো না ওর। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত এই ভুলের জন্য মীরা ড্রেসটার দাম নেয় নি তার কাছে। মীরা ড্রেসটা তাকে তার এনিভার্সেরির গিফট হিসেবে উপহার দিয়েছে ৷ তিনি মীরাকে দেখেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়৷ কে এসেছে, কি হচ্ছে, কি বলছে, কি বলবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। সে যেন একটা ঘোরে আটকে গেছে স্বয়ং মীরাকে দেখে, যে মীরা এত বড় একটা প্রতিষ্ঠানের ওনার সে তার বাড়ির দোরগোড়ায় তা ভাবতেই পারছেনা সে।
মীরা তাকে ঘোরের মধ্যে রেখেই বেরিয়ে পরলো। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। কিছু মুহূর্ত কি একটা ভাবলো মীরা। তারপর একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে পলিথিন চেয়ে ওয়ালেট, ফোন পেঁচিয়ে নিলো ও, যদিও ব্যাগটা ওয়াটারপ্রুফ, বাড়তি সতর্কতা হিসেবে করলো ও কাজটা । তারপর রিকশা ডাকলো একটা, গাউনের ঘের আগলে উঠে পরলো সেটাতে। ড্রাইভার পিলিথিন দিলে সাটাকে ফিরিয়ে দিলো। তোলা হুডটাকে নিজ হাতে নামিয়ে দিলো নিচে। এসব দেখে ড্রাইভার ওর দিকে কেমন বিরক্ত চোখে দেখলো একবার। রিকশা চলতে শুরু করার পর গাড়ির গতির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে গলো বৃষ্টির বেগ। আশেপাশের অনেকেই ঔৎসুক দৃষ্টিতে দেখছে লাল টুকটাকে এক পরীকে। সে যেন একটু আগে টলটলে জলে অবগাহন করে এসেছে, যাচ্ছে নিরুদ্দেশের যাত্রায়। বৃষ্টির পানিতে মুহূর্তেই ভারী গাউনটা শরীরে লেপ্টে গেছে। মীরার গাল, কাঁধ, খোলা চুল চুইয়ে চুইয়ে পরছে বৃষ্টির ধারা। প্রকৃতি যেন ওকে গোসল করিয়ে দিচ্ছে নিপুন হাতে। এক হাত উঁচিয়ে বৃষ্টির পানিকে ধরার চেষ্টায় ব্যাস্ত মীরা। এমন একটা দৃশ্য যে কারো মাথা খারাপ করার জন্য যথেষ্ট। মীরা তো এমনিতেই সুন্দরী, তারউপর এমন সাজপোশাকে বৃষ্টিতে অবগাহন করবার দৃশ্য আগুন ধরাবে মস্তিষ্কের প্রতিটি স্নায়ুকোষে। মীরার এমন উদ্দেশ্য ছিলোনা মোটেই। ও ওর অর্জনকে এভাবেই সেলিব্রেশন করতে চেয়েছে। তাই এমন আনন্দ, একটু ফুরসত, মেঘলা আকাশ আর ঝুম বৃষ্টিতে ভিজবার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি ও।
মীরা মনে মনে ভাবে “দুঃখের ক্ষত সারাতে সময় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঔষধ” আজ রাজিবকে এত বছর পর দেখেও কত স্বাভাবিক ও। যেন রাজিব কোন আগন্তুক, তাই ওর সাথে হঠাৎ দেখা হওয়াটা একটুও বিচলিত করেনি ওকে। কত শক্ত হয়েছে মীরা মনের যত্নে। মীরার বরং হাসি পেয়েছে কেঁদেকেটে একসার করা সেইসব দিনগুলোর কথা ভেবে। কত বোকা ছিলো ভেবেই হাসি পেলো। যারা প্রেমের বিরহে আ*ত্ন*হু*তি দেয়ার কথা ভাবে তাদেরকে পেলে মীরা নিজের জীবণ থেকে পাওয়া এ শিক্ষাটা দিতো । যে ভাই ছ্যাকা খেয়ে ম*র*বে ডিসিশন নিয়ে ফেলেছো বেশ ভালো কথা,
তবে আমার কথা হচ্ছে ডেটটা পিঁছিয়ে দেও৷ এক সপ্তাহ, এক মাস, কিংবা এক বছর, এরপর ফেসবুকে অনলি মী করে একটা পোস্ট দেও, যে আমি অমুকের সাথে বিচ্ছেদের কষ্ট সইতে না পেরে আগামী অমুক তারিখে আত্ম*হুতি দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এরপর দিন যেতে থাকলে জীবনকে ভালোবেসে এসব ডিসিশনের কথা ভুলে যাবে তুমি, বছর ঘুরলে যখন তোমার ফেসবুক মেমরীতে সেসব পোস্ট আসবে, তখন মনে হবে সেই গাঁ*জাখু*রি ডিসিশনের কথা তখন এমন একটা কাজের জন্য তুমি লজ্জিত থাকবে, তোমার বোকামি দেখে তোমার হাসি পাবে।
তবে এত বছর পর দেখা হয়ে মীরার কষ্ট হয়নি বলা ঠিক হবে না, কষ্ট হয়েছে, মিলন যখন মীরার সামনে রাজিবের সাথে দূর্ব্যবহার করলো, ত্রস্ত হয়ে পরে যাওয়া কাপড়গুলো তুলতে থাকা রাজিবের মুখটা দেখে ভীষণ কষ্ট হয়েছে মীরার। কাজটা মিলন মাহমুদ মীরাকে কষ্ট দিতেই করেছেন তা ও ঠিক জানে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়েছে মীরা। অকারনেই ব্যাগের ভিতরে কিছু খোঁজার বাহানায় না দেখার ভান করে দ্রুত পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেছে ওদেরকে মীরা ভ্যেনু থেকে। সময় তার আপন যত্নে মীরার মনের ক্ষতের নিরাময় করে দিয়েছে৷ কৃতজ্ঞতা জানায় মীরা খোদার প্রতি, সাথে সেইসব মানুষদের প্রতি যারা ওকে ভেঙে গড়ে উঠতে পাশে ছিলো ছায়ার মতো৷ আগলে রেখেছিলো পরম মমতায়।
এমন ভাবনার ঘোর কাটে একটা বাইক থেকে ক্রমাগত হর্নের শব্দে। মীরা চেয়ে দেখে ওর পাশের বাইকে থাকা একটা ছেলে বাজাচ্ছে হর্ণ। মীরা তাকালে ছেলেটা ওকে ইশারায় কি যেন বললো। মীরা কিছু বোঝার আগেই বাইকটা পাশ কাটিয়ে গেলো ওদের রিকশাকে। পরক্ষণে মীরা বুঝতে পারে ছেলেটার কোন বদ মতলব নেই, ওর ফ্লপি গাউনের ঘের বাইরে ঝুলে আছে বলেই সতর্ক করতেই হর্ণ দিয়ে তার এই মনোযোগ আকর্ষণ। পুরো দুনিয়া যখন চোখ দিয়ে নিরাভরণ করে দেখে মীরাকে তখন ব্যাতিক্রম এদেরকে ভালো লাগলো মীরার। একটা মুচকি হাসি হাসলো ও। মনে মনে দোয়া করে বিনিময় করলো কৃতজ্ঞতা।
হঠাৎ উত্তুরে বাতাসে কাপন ধরলো ওর শরীরে। মুভি/ছবিতে দেখেছে মীরা এমন পরিস্থিতিতে নায়করা তার কোট এগিয়ে দেয় ঠান্ডা থেকে বাঁচাতে। মীরার এমন কেও নেই যে ওকে বাঁচাবে। কত কত জায়গায় সিঙ্গেল হওয়ায় ঝামেলায় পরতে হয়েছে ওকে তার ইয়ত্তা নেই।
হঠাৎ ইরার একটা কথা কানে বাজলো, এসব ঝামেলা শেষ হলে এসব ভেবে দেখতে বলেছিলো ও। এসব না ভাবার জন্য ঝামেলা কিংবা কাজের চাপই কি একমাত্র কারন? নিজেকে প্রশ্ন করে মীরা। হঠাৎ রিকশা থেমে যায় এরিয়ার বড় গেইটের সামনে। মীরা তাকে আরেকটু ভিতরে যেতে বলে। অবশেষে মাগরিবের আজানের সাথে সাথে বাড়ি পৌছুলো মীরা। কাপড় বদলে দ্রুত গোসল করে ও। রান্নাঘরের ক্যাবিনেট থেকে স্যুপ বের করে স্যুপ তৈরী করে, আরেক চুলায় বসায় চা৷ যে ভিজা ভিজেছে আজ হাঁচি শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। তাই চা আর স্যুপই ভরসা।
খাওয়া শেষ করে একটা ট্যাবলেট খেয়ে ঘুম দিলো ও। গত কয়েকটা দিন খুব প্রেসারের মধ্যে দিয়ে গেছে ও। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে ওর। মুহূর্তেই ঘুমে বুদ হয়ে গেলো মীরা। মায়ের বাড়ি যাওয়ার আগে একটু ঘুমানো যাক কয়েক ঘন্টা।
চলবে…..
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৭২
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে মায়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো মীরা। মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌঁছে গেলো সেখানে। গিয়ে দেখে ওর আগেই সকলেই পৌঁছে গেছে সেখানে। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় জলদি পৌঁছানো মীরা আজ লেট।
কথাবার্তা শেষ করে টেবিলে বসলো সকলে খাবার খেতে। টেবিলের কাছে গিয়ে মীরা দেখে টেবিলে বিশাল কেক। ভীষণ অবাক হয় ও। সেই কখন এসেছে ও, এ কেকের খবর এতক্ষণ অবধি পায়নি ও। এমনকি নূহাও বলেনি। মীরার বিস্মিত মুখ দেখে সকলের মতো নূহাও হাসছে মিটমিট করে। কেক আসার সময় মুরসালিন নিয়ে এসেছে। ইরার শ্বশুর শ্বাশুড়ি আসতে পারেননি। মুখলেস সাহেবের শরীর অসুস্থ থাকায়। কেক কেটে মীরা প্রথমে বড় টুকরো করে কেটে বাক্সে তুলে রাখলেন। তারপর সবাইকে খাইয়ে দিলেন। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর ড্রইং রুমে আড্ড বসলো সকলে মিলে। এ কথা,ও কথার পর নেক্সট ডেসটিনেশন কি তা জানতে চাইলো মুরসালিন। মীরা ওর পরবর্তী ডেসটিনেশন কি তা এখনো ঠিক করে নি, তবে ধারদেনা শোধ করে ও এখন স্বাধীন ভাবে ব্যাবসায় বসতে চায়, সে কথাই বললো মীরা। মুরসালিন নিজের বিজনেস প্ল্যান নিয়ে আলোচনা করলো মীরার সাথে। আসছে মাসে একটা কারখানা কিনতে যাচ্ছে সে বিষয়েও আলাপ করলো মীরার সাথে। মীরা কারখানা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিটেইল বললো ও। ডিটেইল শুনে হঠাৎ মীরার মুখটা পানসে হয়ে গেলো।
খাওয়া আড্ডা শেষে রাত এগারেটায় বের হলো ওরা। কেকের বক্স হাতে রিকশায় করে প্রথমে নিকটবর্তী মিষ্টির দোকানে গেলো মীরা, তারপর মিষ্টি নিয়ে গেলো মুখলেস সাহেবের বাড়িতে। রাত বেশী হওয়ায় খুব অল্প সময় বসলো ওরা। অনেক রাত হওয়ায় মুখলেস সাহেব ওদেরকে তাদের বাসায় থাকতে বলেন রাতটা, কিন্তু মীরা কুশলাদি বিনময় করে বেরিয়ে যায়৷ আজকের এ আনন্দের ভাগিদার তিনিও, তাই মীরা তাকে ভুলেননি। দেরি হওয়া সত্ত্বেও পৌঁছে গেছে তার সাথে খুশি ভাগ করতে।
রিকশায় বসে নূহা ফিরবার পথে বললো মা এটাই ঢাকা তো? চুপ করে থাকে মীরা ওর এই প্রশ্নে। কারন মীরা জানে এরপর নূহা কি বলবে। এই মেয়েটা না এমনি, ছোট্ট তবুও হঠাৎ হঠাৎ এত বড় হয়ে যায় বলার মতো না। এইতো সেদিন ও মীরাকে জিজ্ঞেস করলো-
: “মা তুমি কিন্তু একটা ভুল কথা বলেছো আমাকে?”
: “ভুল কথা!”
: ” হ্যা ভুল কথা, তুমি বলেছো আমার বাবা বিদেশে থাকেন, কিন্তু ছোট নানু সেদিন বড় নানুকে জিজ্ঞেস করলো নূহার বাবা এখন কোথায় থাকে? আর নানু বললো ঢাকায়ই থাকে”
মীরা হতবাক হয়ে গেছে ওর কথা শুনে। ওর মা জাহানারার সাথে রাগারাগি ও করেছিলো এসব ব্যাপারে যখন তখন কথা বলার কারনে। জাহানারা তার ছোটবোন পারভীন জিজ্ঞেস করাতে সেদিন এ কথা বলেছিলো। এমনিতে এ বাড়িতে এ বিষয়ে কখনো কথা হয় না। ঐ ঘটনার পর ইদানীং নূহার এই এক জিদ, ওর বাবার কাছে যাবে। তাই মীরা বুঝে গেছে এরপর কি বলবে নূহা। এতবছর এসব চেপে গেছে ও, এখন? আর ওর বাবা? সে তো নিজেই আছে কত পেরেশানিতে। ঐ যে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে এসেছে মীরা ওকে, এরপর আর দাঁড়াতে পারেনি সে। তাই সে-ও মেনে নিয়েছে সন্তানের প্রতি তার অধিকার খর্ব করার ব্যাপারটা। বেচারার মেয়ের ভালো চেয়েই হয়তো এ মেনে নেয়া। দূর্মূল্যের এ বাজারে কারখানার ম্যানেজারি পোষ্টের এত অল্প বেতনে তার নিজের জীবণ ধারণ করাই তো কষ্টের হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারউপর বিয়ে করেছে, বাচ্চা হয়েছে একটা। তাই আগ বাড়িয়ে ঝামেলা বাড়াতে চায়নি সে। মীরার খুব জানতে ইচ্ছে হয়, ওর কি নূহাকে দেখতেও ইচ্ছে হয় না? আবার মনে পরে বাবার অধিকার যখন ছিলো, তখনো সে কি ওর বাবা ছিলো?
ওর বাবার বর্তমান সম্পর্কে এসব কথা মীরা না জানতে চাইলেও জানে। আশেপাশের এমন অনেক কাজের লোক আছে মীরার, যারা বিনেপয়সাতে এত ভালো সার্ভিস দেয় ওর জন্য যে বলার মতো না।
মীরা তাই রাতের ফাঁকা ঢাকাকে ওর ব্যাগে পুরে রাখলো সেখান থেকে একটা টয় বের করে। খেলনাটা একটা টায় ব্যাংক, একটা কুকুর ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে পয়সা নিয়ে যায়। ছোটবেলায় মীরারও ঠিক এমন একটা খেলনা ছিলো। সেটা দেখেই চোখ আটকে গেছে মিষ্টির দোকানের সামনের গিফট শপে দেখে। ভেবেছিলো বাড়িতে গিয়ে দিবে ওকে, উপায়ন্তর না দেখে সেটা এখনি দিলো ও, মেয়ের মুখ বন্ধ করতে। কিন্তু কতদিন পারবে তা জানেনা মীরা।
পরদিন সকালে মীরা ফেসবুকের ব্লক লিস্ট থেকে ফিওনার আইডিটা খুঁজে আনব্লক করে। ম্যাসেজে গিয়ে একটা “হাই” লিখে। মাত্র পাঁচ মিনিট আগেই একটিভ ছিলো ফিওনা। এরপর প্রাত্যহিক কাজে ব্যাস্ত হয়ে পরে ও ৷ বিকেলের দিকে ম্যাসেজ আসে ফিওনার থেকে। কুশলাদি বিনিময়ের পর ফিওনা জানালো সামনের মাসের শেষের দিকে ওরা পুরো পরিবার মিশিগান চলে যাচ্ছে। ওর বর থাকে সেখানে, ওকে নিয়ে যাবে তার কাছে। মনে মনে ভাবে মীরা দেশের সবাই চলে যাচ্ছে বিদেশে। ফিওনা মীরাকে খুব করে বলে যাওয়ার আগে অবশ্যই একদিন দেখা করতে। মীরা জানায় ও অবশ্যই আসবে একদিন।
ফিওনা মেয়েটাকে ভীষণ ভালো লাগে মীরার। কত ভালো ওর মন। মীরা নিজেকে জিজ্ঞেস করে- ওর নিজের ভাইয়ের জীবণ যদি কেও এমনি ভাবে নষ্ট করতো, ও কি পারতো তার সাথে এভাবে হাসিমুখে কথা বলতে? না, কখনোই পারতো না। কিন্তু ফিওনা সেই শুরু থেকে একইরকম। আন্তরিক, হাস্যজ্জ্বোল, প্রানবন্ত। প্রতিটি মানুষেরই কিছু বিশেষত্ব থাকে। ফিওনার এটাই হয়তো বিশেষত্ব, অতীত মুছে ফেলার, ক্ষমা করে দেয়ার এমনি ক্ষমতা মীরার থাকতো যদি! মীরা যে কথা জিজ্ঞেস করতে কথা শুরু করেছিলো তা চেপে যায় ও। জিজ্ঞেস করতে পারেনা। ভাবে ওর বাড়িতে গিয়ে দেখা হলে কথার এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করে নিবে, যে এত সুন্দর সাজানো-গোছানো ব্যাবসা গুটিয়ে দিচ্ছেন কেন তিনি?
এরমধ্যে একবার ইন্ডিয়া যায় মীরা। মালপত্রে একটা ঝামেলা বাঁধে ওর, ইদানীং প্রায়ই ভুল মাল পাঠচ্ছেন তারা৷ ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত ভুল। সেটার বিষয়ে আলাপ করতে এবং প্রয়োজনে নতুন সেলারের খোঁজ নিবে ও।এরমধ্যেই ফিওনা দুইনার নক দিয়েছে ওকে। ও বলেছে ও ইন্ডিয়া আছে এখন, দেশে ফিরলে অবশ্যই নক দিবে তাকে। সেখানকার কাজ শেষ করে দেশে ফিরে মীরা চারদিনের দিন। তমার আজমির শরীফ খুব দেখর ইচ্ছা, একবার বলেছিলো কথাটা মীরাকে। মীরা কথাটা মনে রেখে পরদিন রওনা দেয় দিল্লি। অথচ এয়ারপোর্টে প্লেনে উঠার আগ পর্যন্ত তমা জানত না আজমির শরীফ যাচ্ছে ওরা সে কথাটা। ওকে সেখানে নিতে গিয়ে খরচ হয়ে গেলো তিনদিন। খুব ভালো সময় কাটে ওদের সেখানে। ঐ তিনদিন মীরা মাজার শরীফে মোনাজাতরত অবস্থায় কেবল নিজের মাঝে নিজেকে খুঁজেছে। এখানে অনেকেই তার মনের অভিলাষ নিয়ে আসে, আল্লাহ নাকি এখান থেকে খালি হাতে কাওকে ফেরান না৷ মীরা নামাজের পর মনে মনে ভাবে কি চাইবে ও? হঠাৎ ওর মনে ভাসে মুখলেস চাচার কথা, এখানে আসার আগে তিনি ওকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। মীরা সৌজন্য সাক্ষাৎ ভেবে গেলেও সেখানে কোন সৌজন্যতা ছিলো না। বেশ কিছু শক্ত কথা তিনি মীরাকে শুনিয়েছেন সেদিন একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে । মীরা মাথা নিচু করে শুনেছে সব। সব ঠিক বলেছেন তিনি। ওর বাবা থাকলেও এভাবেই বলতেন হয়তো৷ কিন্তু ঐ ঘটনায় মীরার কোন দোষ ছিলো না। হ্যা একটা দোষ অবশ্যই ছিলো। মীরা সুন্দরী এবং সিঙ্গেল মাদার। এই মীরার দেষ।
সবকিছু বাদ দিয়ে তিনি মীরাকে বিয়ের ব্যাপারটা ভাবতে বলেন। মাথার উপরে কেও থাকলে এমনটা হতো না। সব সত্যি, তবে মীরা ওর পারসোনালিটি , ইমোশন, স্ট্যাটাস এগুলোকে পাশ কাটিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো কাওকে আপন করার কথা ভাবতে পারেনা। ও নিজের কথা ভাবে না, যে কেও ওকে বিয়ে করে ঘরে তুলতে চাইবে, সায়নের মতো ছেলে মীরা বলতে অজ্ঞান, এমন হাজারো সায়ন মেনে নিবে ওকে ওর সৌন্দর্য আর কৃতিত্বের বিচারে। কিন্তু মীরা জীবনসঙ্গী হিসেবে নিজের জন্য স্বামী চায় না, নূহার জন্য বাবা চায়। কে আছে এমন যে মীরার স্বামী হওয়ার আগে নূহার বাবা হতে চাইবে। ও জানে এমনটা হওয়া সম্ভব না। তাই এ নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না ও। কিন্তু মুখলেস সাহেব মীরার ভালো চায় বলেই তিনি নিজে দায়িত্ব নিয়ে বিয়ে দিতে চায় ওকে৷ মীরা খুলেই বলেছে ওর মনে যা ছিলো। তার সাথে লুকোচুরির সম্পর্ক না মীরার। তিনি সব জানেন মীরার। আত্নসমর্পণ করেছে বাবাতুল্য এ মানুষটার কাছে। অঝোরে কেঁদেছেন ঐ অপমানের কথা ভেবে।
স্বান্তনা দিয়েছেন তিনি, সাহস দিয়েছেন পাশে থাকার।
তবুও ভাবতে বলেছেন বিষয়টা নিয়ে। তিনি বলেছেন- তুমি মত দাও মা , আল্লাহ নিশ্চয়ই এমন কাওরে মিলায়্যা দিবো, আমরা ছবাই মিল্লা খুঁজমু । ইরা চা দিতে এসে ফাঁক দিয়ে কি এক কথা তুলতে চেয়েছিলো সেখানে, মুখলেস সাহেব ইশারায় থামিয়ে দেয় ওকে। এ কথার পর মীরা হ্যা না কিছুই বলেনি। চুপচাপ বসে থেকে চলে আসে সেখান থেকে। বরাবরের মতো মৌনতাকে সম্মতির লক্ষণ ধরে নেন মুখলেস সাহেব সহ সকলে।
মীরা জানে এসব ওর মা জাহানারা আর বোন ইরার কাজ। এরা জানে মীরা সবার সাথে গাইগুই করলেও এই এক জায়গায় মীরা পার পাবে না।
মীরা এখন মুনাজাতে দোয়া করে, আমাকে তুমি শক্তি দাও খোদা, আমি যে আর সইতে পারছিনা। পরের রাকাতে সিজদায় গিয়ে আবারো অঝোরে কাঁদে মীরা।
মীরার কান্নার একটা গোপন কারন আছে, মীরা এতদিন নিজেকে অনেক স্ট্রং ভাবতো, ঐ এক ঘটনা মীরাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মীরা কত দূর্বল। কারন একটাই মীরা মেয়ে মানুষ। এ সমাজে পুরুষ শব্দটা পৌরুষ বহন করলেও মেয়ে মানুষ শব্দটা একটা গালি, একটা অবজ্ঞা, একটা তাচ্ছিল্ল্যের শব্দ।
প্রথম জীবণে রাহাতের করা অপমানজনক ঘটনাটাই ছিলো ওর একমাত্র ভয়ংকর অতীত। আর এবারের ঘটনাটা ছাড়িয়ে গেছে মীরার অতীত জীবণের সব ভয়ংকর ঘটনার রেকর্ডকে। মুনাজাতে সে কথা মনে করে অঝোরে কাঁদেতে থাকে মীরা।
চলবে…