প্রিয় ভুল পর্ব-৩+৪

0
469

#প্রিয়_ভুল
লেখা: #মাহবুবা_মিতু
পর্ব: ৩
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

রাত কত হয়ে গেছে, কারো আসার কোন নাম নেই। না জবা আন্টির না রাজিবের। রাজিব এমনিতে ন’টায় বাড়ি ফিরে। আজ দেরি করছে কেন ও? মীরার খুব রাগ হচ্ছে রাজিবের উপর। বেছে বেছে আজই কেন দেরি করছে ও ?

পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ, পানির বোতলে পানি শেষ হয়ে গেছে। হঠাৎ খেয়াল হলো প্রস্রাবের বেগে তল পেট ফেটে যাচ্ছে। রুম থেকে বেরিয়ে বামে সোজা ফ্ল্যাটের শেষে বাথরুম। কিন্তু বের হতে ভরসা পাচ্ছে না । কারন রাহাত ঘরের আশেপাশে হাঁটছে। কান সজাগ থাকায় মীরা তা টের পাচ্ছে ।

কাঁচের বোতল আর গ্লাসের সংঘর্ষে টুংটাং শব্দ হচ্ছে একটু সময় পরপর। রাহাত কি তাহলে ম’দের বোতল বের করছে। খালি বাড়ি পেয়ে ও এমন করছে হয়তো। ওদের বাড়ি ও যা খুশি করতে পারে। এতে ওর বলার সাধ্য কি?

নানান উদ্ভট চিন্তায় মীরার অবস্থা খারাপ। দুঃশ্চিন্তায় আর ভয়ে মাথা দপদপ করছে ওর। মাথা ব্যাথা শুরু হলো একটু পরেই। আল্লাহকে ডাকছে মীরা। এ মুহূর্তে তিনিই শুধু পারবেন সাহায্য করতে।

ভয়ে তন্দ্রার মতো এসে পরেছিলো ওর। এমন সময় কলিংবেলের শব্দে নড়েচড়ে বসলো। কতক্ষণ পার হয়েছে? বুঝতে পারছে না । ও বের হলো না দরজা খুলতে। দেরি দেখে দ্বিতীয় দফায় কলিংবেল বাজালো দড়জার ওপাশে অপেক্ষারত’রা । মীরা ঘর থেকে বেরই হলো না গেইট খুলে দিতে। এর বেশ পরে রাহাত দরজা খুলে দিলো।

ঘরে থেকেই বুঝলো মীরা যে জবা আন্টিরা এসেছে। অন্ধকার ঘরে বুঝলো না ক’টা বাজে তখন। সে রাতে জবা আন্টিরা ফিরেছে বেশ রাতে তা আন্দাজ করলো মীরা। রাজিব এলো তারও বেশ পরে। রাজিব দরজা নক করলো-
: “মীরা… ”
দৌড়ে এসে দরজা খুললো ও। ঘর অন্ধকার দেখে রাজিব জিজ্ঞেস করলো-
: মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে কি?
: কোথায় ছিলে তুমি রাজিব…
আর্তনাদের কন্ঠে বললো মীরা।
: কি হয়েছে মীরা?
উদ্বেগের কন্ঠে জিজ্ঞাসা রাজিবের।

এতক্ষণ ধরে যে ভয়, দুঃশ্চিন্তা, উদ্বেগ ভর করে ছিলো মীরার উপর তার বাঁধ ভাঙলো যেন কান্নার জলে। রাজিব কেবল জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে কি হয়েছে?
উত্তরে মীরা কেবলই কাঁদছে। এরকম অভিজ্ঞতা ওর জীবণে এই প্রথম।
রাজিব শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে-
: বাড়ির কথা মনে পরছে?
: রাজিব আমি এখানে আর এক মুহূর্ত থাকবো না।
: কেন?
এবারো কান্না করছে ও। কথা বলতে পারছে না।
মীরার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে রাজিব বলে-
: একটা খুশির খবর আছে মীরা।
মীরাকে শান্ত করতে হয়তো কথাটা বললো রাজিব। কিন্তু মীরা কাঁদছেই। একটু বিরতি নিয়ে রাজিব বললো-
: রাহাত ভাই তার একটা দোকানে আমাকে ম্যানেজার রেখেছে। বলেছে দোকানের সামনের জায়গায় আমি চাইলে নিজে মাল তুলে বিক্রি করতে পারবো।

কথাটা শুনে মীরা এক ঝটকায় রাজিবের বুক থেকে মাথাটা তুলে তাকালো ওর দিকে। রাজিব আরো বললো-
: তিনি বেতন দিবেন দশ হাজার, আর আমার সাইডের ব্যাবসা থেকে যা আসে। এখন তো বেতন মোটে চার হাজার। এক ঝটকায় এত বেতনের চাকরীতে সুযোগ দিলো। বললো বিয়ে করেছিস এখন তো খরচ আছে অনেক। যে সুযোগ দিলেন তিনি, আমার বাবার কাজ করে দিলো জানো তো? বড় ভালো লোক তিনি।

অন্ধকারে মীরার চেহারার অভিব্যাক্তি দেখে নি রাজিব। তাহলে শেষের কথা গুলো বলতো না ও । মীরা রেগে গিয়ে বললো-
: তোমার বাবার কাজ করে দেয়া ভালো লোক কি করেছে জানো?

রাজিব ঘরের বাতি জ্বেলে দিলো। ওকে বসিয়ে বললো কি হয়েছে মীরা?
কাঁদতে কাঁদতে সব খুলে বলে মীরা। রাজিব শুনে স্তব্ধ। বললো –
: কি বলছো তুমি?
: কি বলছি শোন না তুমি?
: আমাকে ফোন দাও নি কেন তুমি?
: ফোনের টাকা ছিলো না।

রাজিব উঠে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবলো। একটু পর মিন মিন কর অস্পষ্ট কন্ঠে বললো-
: তুমি কোন ভুল করছো না তো? না মানে…

কথাটা শেষ করতে পারে না রাজিব, অগ্নি মূর্তি ধারন করে মীরা। চিৎকার করে বলে-
: ভুল হচ্ছে মানে? আমাকে তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?

চিৎকার শুনে দরজায় কড়া নাড়লো রাহাত, কিরে কি হলো এত রাতে? কোন সমস্যা?

রাজিব বলে-
: না, ভাই কোন সমস্যা না।

মীরা রাগত কন্ঠে বলে-
: যাও, তোমার বাপ আসছে।

কথাটা শুনে রেগে যায় রাজিব, জোরে একটা চড় মারে মীরাকে। কান্না ভুলে মীরা তব্দা খেয়ে যায়। কি হলো তা যেন বুঝতে পারছে না ও।

খাটের এক কোণে বসে কান্না শুরু করে মীরা। এই প্রথম রাজিব ওর গায়ে হাত তুললো। তাও অন্য একটা মানুষের জন্য, যে ওর বৌকে অসম্মান করেছে।

রাজিব বুঝতে পারে কাজটা ওর ঠিক হয় নি। খাটে উঠে মীরার কাছে গিয়ে ওর মাথা তুলতে চেষ্টা করে ও। ক্ষমা চায় ওকে চড় দেয়ার জন্য।

মীরা রাজিবের কাছে কেন জানি রাগ করে থাকতে পারে না। কোন না কোন ভাবে ও ঠিক মীরার রাগ ভাঙিয়ে দেয়।

মীরাও বুঝলো এটা রাগ করার সময় না। এখান থেকে বের হতে হবে দ্রুত। মীরা বললো রাজিব আমি আর একদিনও এখানে থাকতে পারবো না। রাজিব কেমন চিন্তায় পরে গেলো। মীরাকে শান্ত করে বললো তুমি শান্ত হও, তুমি যা বলবে তাই হবে জান। এখন হাতমুখ ধুয়ে খাবার খাই চলো।

মীরা রাজিবকে দাঁড় করিয়ে বাথরুমে গেলো। ফ্রেশ হয়ে বেরুতেই দেখে রাহাত ওর দিকে কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে জগ থেকে পানি ঢেলে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে। মীরা দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো, রাজিব তখন বাথরুমে। ভয়ে যদি রাহাত আবার আসে। যদিও এ সময়ে আসবে না রাহাত। এতটা বোকা ও না।

রাজিব রুমের সামনে এসে দেখে দরজা আটকানো। এটা দেখে রাজিব বুঝলো মীরার ব্যাপারটা সিরিয়াস। রুমে ঢুকে খেয়ে শুয়ে পরলো ওরা। মীরা ওকে কেমন আঁকড়ে ধরে শুয়ে আছে। যেন কেউ দাঁড়িয়ে দরজার কাছে, এক্ষুনি এসে ঝাপিয়ে পরবে ওর ওপর।

নানান চিন্তা ভিড় করলো রাজিবের মাথায়। এ মুহূর্তের পরিস্থিতি বিবেচনায় রাহাত ভাই ওকে অনেক বড় একটা সুযেগ দিয়েছে ঘুরে দাঁড়াতে। কিছুদিন অন্ততঃ এখানে থেকে গুছিয়ে নিক নিজেদেরকে। কারন এ মুহূর্তে রাজিবের কাছে কানা কড়িও নেই যে একটা ঘর ভাড়া করবে, ঘর ভাড়া করলেই তো হবে না, আসবাবপত্র কিনতে হবে, খাওয়া খরচও আছে, পকেটে কানা কড়ি নেই, হিসাব মিলবে কি করে। সবদিক বিবেচনা করে এই সুযোগটাকেই বড় করে দেখলো ও। জীবণে সুযোগ সবসময় আসে না। ঐ মার্কেটে দোকান থেকে বাইরে বেশী বিক্রি হয়। এ ব্যাবসার আদ্যোপান্ত ওর জানা। ঘুরে দাঁড়ানো তো ছয় মাসের ব্যাপার।
মীরার ব্যাপারটা হালকা ভাবে নিয়ে শুয়ে শুয়ে টাকা গুনতে লাগলো ও। যেন ওর হালকা ভাবে নেয়া ব্যাপারটাই সমাধান এ সমস্যার। ঐ যে একটা গল্প আছে না কাকের- যে মাংস চুরি করে এনে চোখ বুজে ছিলো, আর মনে মনে ভেবেছিলো কেও দেখছে না ওকে। সে-রকম আরকি। সবশেষে রাজিব ভাবলো পরদিন সকালে মীরাকে বোঝাবে। অথচ একবারও ভাবলো না রাহাত কোন লাভে ওকে এত বড় সুযোগ দিলো।

———
গলার আধ ভরি সোনার চেইনটা বিক্রি করে দিলো মীরা। সে টাকা দিয়েই নতুন বাসার এডভান্স দেয়া হলো। কেনা হলো চলার মতো কিছু জিনিসপত্র। একটা তোষক, দুটো বালিশ, কিছু রান্নাবান্নার সরঞ্জাম। তাসলিমা ভাবী কয়েকটা পাতিল, ভাত খওয়ার প্লেট, বাটি পাঠালেন। খুপরি ঘর হওয়া সত্ত্বেও
নতুন সংসারে মীরা খুব খুশি। ওর মধ্যে কোন গ্লানি নেই যে আবীরের বৌ হলে ও একটা পাঁচতলা বাড়ির মালিকের ব্যাবসায়িক ছেলের বৌ হতো। আর আজ ওর একটা সিদ্ধান্তে ঠাঁই হয়েছে খুপরি ঘরে। বরের পকেটে ফুটা পাই নেই। বিয়ে যে হয়েছে তা ওর আংটি বিক্রির টাকায়৷ আর আজ যে ঘর ভাড়া করলো সন্ধ্যায় তার জন্য গলার চেইন বিক্রি করতে হয়েছে ওকে। রাজিব ওর পাশে আছে সেই বড় ওর কাছে। পৃথিবীতে কোন অলংকার নেই যার মূল্য রাজিবের চেয়ে বেশী । কিন্তু মনে মনে রাজিব খুবই বিরক্ত মীরার উপর। একমাত্র ওর জন্য এত বড় সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলো।

রাতে মীরার সংসারের প্রথম রান্নাটা করে আনলো মীরা। রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে গরমে হাসফাস লাগে ওর।
যা গরম পরেছে। ফ্যানটা কেনা হয়নি রাত হয়ে যাওয়ায়। “কাল সকালে সবার আগে এ কাজটা করতে হবে ” ভাবলো মীরা।

গুছগাছের সবকাজ শেষ করে রাতে খেয়ে শুয়ে পরলো দুজন। রাজীব পাশ ফিরে শুয়ে আছে খালি গায়ে। মীরা গায়ের ওড়নাটা পাশে রেখে শুয়ে পরলো রাজিবের পাশে। পেছন থেকে রাজিবকে আলিঙ্গন করে মীরা বললো-
: জানো রাজিব আজ আমি অনেক সুখি, তুমি আমার জন্য এত বড় সুযোগ পায়ে মাড়িয়ে এলে। আমি অনেক ভাগ্যবতী রাজিব।

কোন প্রতিক্রিয়া করে না রাজিব। ভান ধরে ঘুমিয়ে পরার। মীরা ওর পিঠে আলতো করে চুমু খেয়ে বলে-

: হয়তো অনেক টাকা পয়সাওয়ালা স্বামী আমি পেতাম, কিন্তু আমি জানি তোমার মতো ভালো কেও আমাকে বাসতে পারতো না।

রাত বারোটা ঘরের আলো নিভানো, চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকায় মীরা জানতেও পারলো না কি বিরক্তি, রাগ আর ঘৃণা মিশে ছিলো রাজিবের চোখেমুখে।

চলবে…

#প্রিয়_ভুল
লেখাঃ #মাহবুবা_মিতু
৪.
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

দুই মাস তেরো দিন বিয়ের বয়স হলো আজ। রাজিব কোন কাজ জোগাড় করতে পারে নি এখনো। রাজিব আগে যেখানে চাকরী করতো, সে মার্কেটে অন্য দোকানে চাকরীর জন্য গিয়েছিলো ও। ভালো কাজ জানা সত্ত্বেও রাজিবকে কেও রাখে নি কাজে। কারন ওকে কাজে রাখলে রাহাত সমস্যা করবে। রাহাতের বাবা এ মার্কেট সমিতির সভাপতি। তাই সাবাই তাকে সামলে চলে।

রাজিব অন্যান্য কাজও খোঁজার চেষ্টা করে। বিয়ে যখন করেই ফেলেছে সংসারের দায়িত্ব ও তারই। তাছাড়া এ পর্যন্ত মীরা ওর সর্বোচ্চটুকু করেছে। বিয়ের খরচ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যত খরচ হয়েছে তা সবটাই মীরার দেয়া। এ ব্যপারটাও ওকে ভাবায়। এদিকে চেইন বিক্রির টাকাও প্রায় শেষের দিকে।

এত খারাপ খবরের মধ্যে একটা ভালে খবর হচ্ছে মীরা ওর কলেজের স্যারের সাথে দেখা করে টেস্ট পরীক্ষা না দিতে পারা সত্ত্বেও বোর্ড পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার অনুমতি নিয়ে আসে।

বিয়ের পর যে একটা সময় পার করলো মীরা। ভুলেই গিয়েছিল টেস্ট পরীক্ষার কথা। তাছাড়া বই পত্রও ছিলো না ওর কাছে। মীারার বন্ধুরা রাজিবের ফোনে ফোন করে ওর বাসা খুঁজে দেখা করে ওর সাথে। ওকে সাহস দেয়, পরীক্ষাটা দেওয়ার জন্য। মীরা বলে ওর বর্তমান অবস্থা আর কাছে বই খাতা না থাকার কথা। পরে অবশ্য বইপত্রের জন্য মীরার দুই বান্ধবী অনেক সাহস নিয়ে মীরাদের বাড়ি গেলে ওর মা বলেন- বই খাতা নাকি তারা পুরিয়ে ফেলেছেন। আশাহত হয়ে ফিরে আসে তারা। যদিও যাওয়ার আগেই এমন কিছুই ভেবেছিলো ওরা।

মীরা কষ্ট পায় না তাদের এমন আচরণে। কারন যা ও করে এসেছে তাদের সাথে, সে হিসেবে এ তো কিছুই না। পরে ওদের ক্লাসের ছেলেমেয়েরা বেশ কয়েকটা বই জোগাড় করে দেয়, সাথে বিভিন্ন নোট এর ফটোকপি। কোচিং এর স্যারও অফিস থেকে সৌজন্য সংখ্যা হিসেবে পাওয়া বই থেকে ওর প্রয়োজনীয় বই দেয় মীরাকে। পরীক্ষার বাকী আর মাত্র দুই মাস, ভালো করে পড়াশোনা করতে বলেন স্যার। যাতে ফেল না করে কোন বিষয়ে। বর্তামানে ওর যা পরিস্থিতি তাতে পরীক্ষায় ভালো করা ওর জন্য চ্যালেন্জিং। তাই স্যার ওকে সরাসরি বললো যাতে খারাপ না করে কোন বিষয়ে।

মীরা ওদের বন্ধুদের এ সাহায্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। কারন ওরা পাশে এসে না দাঁড়ালে হয়তো মীরা পরীক্ষা দেওয়ার কথা চিন্তাও করতো না।

স্বচ্ছল পরিবারে বড় হওয়া মীরা, ঘুপচি ঘরে শুরু করা সংসার জোড়াতালি দিয়ে একাই টেনে নিচ্ছিলো। ও দেখছে যে রাজিব অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও কিছুই করতে পারছে না। পড়াশোনা করেছিলো ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত। তারপর থেকে কাজ করেছে গার্মেন্টসের লোকাল কারখানার ম্যানেজার হিসেবে। শিক্ষিত, চটপটে আর সুদর্শন হওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যেই সবার মধ্যমনি হয়ে ওঠে ও। এত এত ছুটি কাটানোর পরও রাজিবকে ছাড়িয়ে দেয় না বোরহান। কারন মিষ্টিভষী রাজিব খুব সুন্দর ভাবে সব কাস্টমারের সাথে ডিল করে। বোরহান সাহেব বেতন কম দিলেও বাউণ্ডুলে রাজিবকে এদিক সেদিক ঘুরতে প্রায়ই ছুটি দিতো। এই এক সুযোগের জন্য বেশী বেতনের চাকরী পাওয়া সত্ত্বেও পরে থাকে বোরহান সাহেবের দোকানে। কারন অন্যান্য মালিকেরা এত ছুটিছাটা পছন্দ করে না।

ওর কাজ ছিলো কারখানা আর দেকানের মালপত্রের হিসাব রাখা। পাইকারি বিক্রেতাদের লেনদেনের হিসেব রাখা। এ কাজের বাইরেও কারখানায় সময় দিতো ও। ইদ-চাঁদে কাজের চাপ পরলে কখনো কখনো প্যাকেজিং, কোয়ালিটি চেকিং এর কাজও করতো ও। অতিরিক্ত এ কাজ গুলো ও করতো ছুটি মঞ্জুরের আশায় বোরহান তাই রাজিবকে পছন্দ করতো। এই ঘুরতে যাওয়ার ছুটি মঞ্জুরের জন্য এটা সেটা করতে করতে এ ব্যবসার অনেক কাজ শিখে গেছে ও। হাতের কাজ বলতে কেবল এই এক কাজই পারে রাজিব। তাই কাজ খোঁজার দুনিয়াটা ছোট ওর কাছে । ওর বন্ধুরা সবাই ভার্সিটিতে পরে। তাই ওরা কেও কোন রকম সাহায্য করতে পারে না।

চক্ষু লজ্জায় না পারে নিচু কেন কাজ করতে। তাসলিমা ভাবীর বর শাহআলম ফল বিক্রি করে বাজারের ফুটপাতের দোকানে। ফুটপাতের এই দোকান নিতেও তাকে এডভান্স করতে হয়েছে সত্তর হাজার টাকা। তাও দেকান নিয়েছে বছর পাঁচ আগে। এই টাকাটা শাহআলম জেগাড় করেছে অনেক ধার দেনা করে। রোজগার মোটামুটি ভালোই হয়। কিন্তু তার পক্ষে রাজিবকে দোকানে রাখা সম্ভব না। কারন তার দোকানের কাজ যা তিনি একাই করতে পারেন৷ তাছাড়া যদিও লোক রাখাও লাগে তাহলে ছোট কোন ছেলেকে রাখলেই হবে। তাকে দুই হাজার টাকা বেতন দিলেই হয়ে যাবে। এদিকে রাজিবকে পাঁচ হাজারের কমে রাখা সম্ভব না। বরং আরো বেশী বেতন হলে ওর জন্য ভালো হয়। তাই এ ব্যাপারে কোন সাহায্য করতে পারে না তিনি।

কোচিং থেকে ফিরে মীরা দেখে রাহাত উবু হয়ে শুয়ে আছে। ব্যাগ আর বইপত্র রেখে হাতমুখ ধুতে যায় ও। এসে ডাক দেয় রাজিবকে। দুপুরে খায় নি নিশ্চয়ই। ওকে ডেকে তুলে একসাথে খাবার খায় দুজন। রান্না বিশেষ কিছু না, দুটো ডিম সিদ্ধ করে মাঝখানে কেটে চার টুকরো করে আলু আর টমেটো দিয়ে রান্না করেছে মীরা, সাথে পাতলা মসুর ডাল। মীরা ভাজি করে না খরচ বাঁচাতে। দুপুর আর রাতে খায় তরকারি দিয়ে। সকালে অবশিষ্ট ভাত পানি দিয়ে রেখে দেয়, বাসি তরকারি কিংবা একটা ডিম ভেজে খেয়ে ফেলে দুজনে।

রাজিব আর মীরা দুজনেই ভালো পরিবারের সন্তান। দুজনের বেড়ে ওঠাই স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে। তবুও জীবণের হঠাৎ এমন ছন্দপতনে ওরা যেন মানিয়ে নিয়েছে দু’জনে। ভালোবাসা আছে তাই হয়তো সম্ভব হয়েছে তা। তা না হলে আধ-পাকা টিনের ঘরে থাকা ওদের জন্য অসম্ভব। যেখানে দিনের বেলা সূর্যের তাপে ঘরটা যেন জলন্ত আগ্নেয়গিরি হয়ে থাকে। গরম থেকে বাঁচতে ফ্যান ছাড়াবে তারও জো নেই। ফ্যান ছাড়লে সেটা টিনের চালের তাপ টেনে আনে।
খাট নেই ওদের, তোষকের ফ্লোরিং বিছানাটা এমন তেঁতে থাকে যে শুয়ে থাকাটাও যন্ত্রণার হয়ে যায়।
মীরা চালের বস্তা ভিজিয়ে বিছিয়ে রাখে মেঝেতে। তাতে লাভ কি হয় তা জানে না মীরা। পাশের ঘরের ভাবীর দেখাদেখি কাজটা করেছে ও। রাতের বেলা ঘুমানো যেন আরো কষ্টের। ঘরটার সারাদিনের তাপ যেন ধীরে ধীরে গরম নিঃশ্বাসের মতো ছাড়ে। শেষ রাতের দিকে ঠান্ডা হতে থাকে ঘর। তার কিছু পরেই আবার পরের দিনের সূর্য উঠে ঘর তাঁতানোর কাজে লেগে পরে। ওরা যে বাড়িটাতে থাকে তার আশেপাশে কোন গাছ কিংবা বিল্ডিং না থাকায় ছাঁয়া পরে না। কম টাকায় এর চেয়ে ভালো ওদের কাজে জোগাড় করা সম্ভব হয় নি। এ বাড়ির ভাড়া মাত্র পনেরোশ টাকা। এক চুলায় রান্না করে তিন জন, বাথরুম আট ঘরের ভড়াটিয়ার জন্য মাত্র একটা। তবুও দিনশেষে ওরা দুজনই বিশ্বাস করে – ওরা নিশ্চয়ই একদিন এখান থেকে ভালো অবস্থানে পৌঁছাবো।

রাতে রাজিব মীরার মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলে- তুমি আমার যোগ্যতার চেয়ে অনেক বেশী ভরসা করেছো আমায়, রাজকন্যা হলেও রানীর মতো রাখতে পারছি না তোমাকে। এখন পর্যন্ত সংসারের ঘানি একাই বইছে। এর মূল্য আমি কি দিয়ে পরিশোধ করবো তা জানি না। কিন্তু দেখো মীরা, একদিন আমাদের ড্রয়ার ভরা টাকা থাকবে, আর তুমি ইচ্ছে মতো খরচ করবে সেখান থেকে নিয়ে। তখন তোমাকে প্রতিদিন ডিম রান্না করতে হবে না, পায়ে হেঁটে এত দূরের কলেজে যেতে হবে না। তোমার নিজের গাড়ি থাকবে। তুমি রানীর মতো হাঁটবে আমার চারপাশে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখবো তোমাকে।
মীরা এর উত্তরে বলে-
” এত সুখ আমি আশা করি না রাজিব, তুমি আমার পাশে থাকলে, আমাকে আগলে রাখলে কোন কষ্টই
গায়ে লাগে না আমার। আমি সবসময় সুন্দর আর ভালো মনের একটা বর চাইতাম, না টাকাপয়সা না বাড়ি গাড়ি কিচ্ছু না। বাবা আমাদেরকে অনেক আদরে মানুষ করেছেন। কেন শখ অপূর্ণ রাখে নি। “তোমাকে ভালো বেসে বিয়ে করে ভুল করেছি”
আমার বাবা মায়ের এ ধারনাটা শুধু ভুল প্রমাণ করে দাও। আমি আর কিচ্ছু চাই না রাজিব, কিচ্ছু না….

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে