প্রিয় ভুল
লেখা- মাহবুবা মিতু
পর্ব : ২৭
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
খুব সকালে বাড়ি ফিরে ওরা। রাজিব একটু ঘুমিয়ে নেয়। ঘুমাবার আগে বলে দশটার দিকে ওকে ডেকে দিতে। মীরা এসে লাগেজের কাপড় বের করা শুরু করে। এটা যত না জমে যাওয়া কাজের তাগাদা তারচে বেশী নিজেকে ব্যাস্ত রাখার বাহানা। বিশাল বালতিতে লাগেজের সব কাপড় সাবান গুলে ভিজায় ও। কল ছেড়ে এক এক করে ধোয় সেগুলো। কাপড় ভেজানো বালতি থেকে এক এক করে কাপড় নামায়। ময়লা জায়গা গুলো ব্রাশ দিয়ে ঘষে ময়লা তুলে। কিছ সময় কেচে পানি দিয়ে ধুয়ে এক এক করে সবগুলো কাপড় ধুয়ে নেয় ও। এত কাপড় ধুতে কতক্ষণ লেগেছিল ওর তা জানে না ও। তবে থমকে যাওয়া সময়ের গতি লব্ধি হয় বাথরুমের দড়জায় টোকা পরার শব্দে, দরজাটা ধোয়া কাপড়ের বালতিতে ভিড়ানো ছিলো। ত্রিশ লিটার পানির বালতিটা ভরে গেছে ধোয়া কাপরের স্তুপে। এখানে বেশীরভাগ কাপড়ই নূহার। ছোট বাচ্চাদের এই এক সমস্যা। প্রচুর কাপড় চোপড় নষ্ট করে এরা।
অনেক কষ্টে দরজা ভিড়িয়ে রাখা বালতিটা সরিয়ে দরজা খুলে দেখে নতুন ছুটা কাজের মেয়ে সুরমা ভীত মুখে দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে কেমন বোকা হাসি হাসে মীরা, যেন ওর ধোয়ার জন্য কাপড়গুলো না রেখে নিজে ধুয়ে ফেলায় অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছে নিজে । ওর হাসি সেই সেই অন্যায় লাঘবের সামান্য প্রবোধ।
: “আফা কি হইছে আফনের?”
মীরা কেমন অপ্রকৃতস্থের মতো হাসে। সেখানে দাঁড়িয়ে ও শুনছে রাজিব চিৎকার চেচামেচি করছে। এতক্ষণ ও যেন ঘোরের মধ্যে ছিলো। রাজিবের চিৎকারে ওর চেতনা ফিরে। মীরা মনোযোগ দিয়ে শোনে রাজিবের কথাগুলো।
রাজিবের চিৎকারের সারমর্ম হচ্ছে – দশটায় ডাকার কথা, এগারো টা বেজে গেলো, তবুও কেন ডাকলো না ওকে। ওর ঘুম ভেঙেছে সুরমার আসার কলিং বেলের শব্দে। বাথরুম থেকে দৌড়ে যায় মীরা ঘরে, গিয়ে দেখে রাজিব গোসল করতে বাথরুমে ঢুকেছে। দৌড়ে বাধ্য স্ত্রীর মতে স্বামীর জামাকাপড়, ঘড়ি, মানিব্যাগ সব সামনে বের করে রাখে। জুতার কাবার্ড থেকে জুতা গুলো ও বের।
বাথরুমে থেকে বের হয়ে রাজিব আরেক দফা রাগ ঝাড়ে মীরার উপর। মীরা কেমন বেকা চাহনিতে চেয়ে থাকে ওর দিকে৷ যেন ভীনদেশী ভাষায় কথা বলছে রাজিব যা বোধগম্য হচ্ছে না মীরার। কাপড় চোপড় পড়ে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায় রাজিব ।
ততক্ষণে সুরমা মীরার ধোয়া সব কাপড় পুরো ছাদ জুড়ে মেলে দিয়ে এসেছে। ব্যাবহৃত ক্লিপ টান পরায় রান্না ঘরের কাবার্ড থেকে নতুন দুই পাতা ক্লিপ নামিয়ে নিয়ে গেছে ও।
পুরো বাড়ির ফার্নিচারের ধুলো ঝেড়ে ঘর ঝাড়ু দিয়ে ঝড়ের গতিতে ঘর মুছে চলে যায় সুরমা। মীরা ভেজা জামা পরেই বসে আছে মেঝেতে।
সুরমা কাজ শেষ করে চলে যাওয়ার সময় বলে-
: ” যাইগা আফা”
মীরার কোন ভাবান্তর হয় না সুরমার কথায়। দরজা ভেতর থেকে লক করে চলে যায় সুরমা। মীরা যেন একলা হওয়ার অপেক্ষায়ই ছিলো এতক্ষণ ধরে। ঘরের সব জানালা বন্ধ করে ড্রইং রুমের মেঝেতে বসে আয়োজন করে গগন বিদারী চিৎকার শুরু করে মীরা। রাজিবের সদ্য খুলে রেখে যাওয়া টিশার্ট ধরে কান্নায় লুটিয়ে পরে ও। এই প্রথম স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে কান্নার সময় পেলো ও। তাই তো কান্নার এত গভীরতা, এত প্রখরতা। কাঁদতে কাঁদতে মীরার মনে পরে সেই সব দিনের কথা, ভুলের কথা। বার বার মনে পরে বাবার শেষ কথাটা, খালা আর আত্মীয়দের করা ভবিষ্যৎ বানীর কথা। কতটা স্বচ্ছ ছিলো তাদের ভাবনা আর কতোটা অন্ধ মীরা। তাই তো সম্পর্কের এতসব ফাঁকফোকর দেখে ও তা মেরামতে ব্যাস্ত রেখেছে নিজেকে। কিন্তু ওর অগোচরে ও যে তৈরী হতে পারে ফাঁকফোকর তা একবারও ভাবতে পারে নি ও।
কি সীমাহীন বিপদ ধেঁয়ে আসছে ওর জীবণের উপকূলে তার আভাস ও পেয়ে গেছে ইতিমধ্যে। যে
বিপদের বুনন অনেক যত্ন করে তৈরী করছে ও নিজেই।
একজন সন্তান বিপদে পরে সবার আগে কার কথা মনে করে? নিশ্চিয়ই বাবা-মায়ের, নিজের পরিবারের, আত্নীয়ের । কিন্তু মীরার এই পথটা মীরা নিজেই চির জীবনের মতো শেষ করে দিয়ে শুরু করেছিলো রাজিবের সাথে পথচলা । নিজের সবটুকু উজার করে ভালবেসে ছিলো রাজিবকে, গড়ে তুলেছিলো নিজেদের ভালো থাকার একমাত্র অবলম্বন ফ্যাশন ব্র্যান্ড “মীরা”। এ নামটাও ভালোবেসে রাজিবের ই দেয়া। ভালেবাসা..!
এ শব্দটার প্রতি কেমন ঘৃণা জন্মে গেছে ওর।
বাবা, মা, ইরা, আর ছোট্ট ভাই নাজিবের কথা আজ খুব মনে পরছে ওর। সবারর চেহারাগুলো চোখে ভাসছে স্লাইডের মতো। চোখ বন্ধ করে তাদের দেখছে মীরা। হাস্যজ্ব্যল একেকটি মানুষ, আর প্রিটি মানুষকে নিয়ে একটি সুখী পরিবার। সত্যিকারের সুখী জীবণের শেষ স্মৃতি দেখতে দেখতেই চোখ বন্ধ অবস্থায় কখন যেন মেঝেতেই ঘুমিয়ে পরে ক্লান্ত মীরা।
দেড়টার দিকে রান্নার খালা মাজেদা আসে ওদের ফ্ল্যাটে। তার কাছে একটা চাবি থাকে সব সময়। সে চাবি খুলে ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকে। বারোটার দিকে আসার কথা ছিলো তার। এখন বাজে দেড়টা। ছেলের সাথে দেখা করতে ছেলের মাদ্রাসায় গিয়েছিল সকালে। আসতে আসতে দেরি করে ফেলেছেন তিনি।
মাজেদা খালা এখন মীরাদের বাসায়ই থাকেন। রান্নার কাজ আর নূহার দেখাশোনা করেন। তার স্বামীর অত্যাচারের মাত্রা অসহনীয় হওয়ায় মাস ছয়েক আগে মাজেদা খালা অসহায় অবস্থায় সাহায্যের জন্য আসে মীরার কাছে। মীরা সব শুনে এত বছর কেন ছিলো এই বদ লোকটার সাথে, আর কেন তাকে বহু আগেই ছেড়ে চলে আসে নি তাই তাকে গালমন্দ করে নিয়ে আসে ওদের বাড়িতে। সে থেকে এ বাড়ির একজন তিনি।
গেইট খুলে মাজেদা খালা দেখে মীরা মেঝেতে অচেতন অবস্থায় পরে আছে। দৌড়ে গেইট খুলে মীরার কাছে যান তিনি। নূহা ও ডাকে-
মা…
মা……
মাজেদা খালাও ডাকে মীরাকে। মীরা জেগে মাজেদা খালাকে দেখে হঠাৎ কেমন যেন আবেগী হয়ে আবার কান্না শুরু করে তাকে জড়িয়ে ধরে। মাজেদা খালা জিজ্ঞেস করে-
: ” ও খালা, কান্দেন ক্যান? খালা, কি হইছে, ভাইয়ে কিছু কইছে?
উত্তরে মীরা কেবল কাঁদে আর কাঁদে।
নূহা ওর মাকে কাঁদতে দেখে কেমন ভড়কে যায়। কিছুক্ষণ পর নূহাও কান্না জুড়ে দেয় মাকে পাগলের মতো কাঁদতে দেখে।
নূহাকে শান্ত করান মাজেদা খালা। মীরাকে বলে-
: ” খালা মাইয়্যাডা ভয় পাইতাছে, কান্দন থামান। না কইলে বুঝুম কন দেহি? ও খালা কি হইছে কন না ক্যান? ”
মীরা তখন নূহাকে কোলে নিয়ে আর্তনাদের সুরে বলে –
: ” খালাগো আমার সব শেষ ”
: ” কি হইছে খালা, কি শ্যাষ? ”
: ” নূহার বাবা বিয়ে করছে আজ আড়াই বছর”
মাজেদা খালা যেন বুঝতে পারছে না মীরা কি বলছে। কিংবা নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না তাই নিশ্চিত হতে আবারো জিজ্ঞেস করে মীরাকে-
: ” কি কইলেন খালা?”
: ” খালা আপনি যা শুনছেন তাই বলছি আমি, নূহার বাবা ওর মামাতে বোনকে বিয়ে করছে”
কথার সত্যতা প্রমাণের পর মাজেদা খালা উবু হওয়া থেকে বসে পরলো। মনে হলো যেন মীরার সাথে নড়ে গেছে তার নিজেরও ভিত। মাথায় হাত দিয়ে বললো-
: ” কি কন আপনে এগুলা, যে ভাই আপনেরে এত ভালেবাসে সে এমন একটা কাম কেমনে করলো?
: ” ভালোবাসা না খালা ওটা ওর অভিনায় ছিলো আমাকে সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে ফেলার”
বেশ কিছু সময় মৌন মাজেদা খালা। ঘনটার আকস্মিকতা হজম করতে সময় লাগছে তার।
মীরা তখনো কাঁদছে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ।
বেশ খানিকটা পর জমাট বাঁধা নিরবতা ভেঙে মাজেদা বলেন-
: “খালা আপনে আমারে আগুনের তে বাঁচাইয়া আপনের ঘরে জায়গা দিছেন। আপনার তো মা-বাপ আত্নীয় স্বজন কেও নাই যার কাছে আপনি যাইবেন। কি করলো এইডা ভাইয়ে? কেমনে করলো? হের বুকটা একটু কাইপ্পা উঠলো না কামডা করার সময়?
থুম মেরে বসে থাকে মীরা সেখানে, কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরা নূহাকে মীরার কোল থেকে নিয়ে পাশের সোফায় শুইয়ে দিয়ে আসে মাজেদা খালা। তারপর মীরার কাছে আসেন তিনি, একেবারে সামনাসামনি বসেন। ঘটনার পুরোটা জানতে চান মীরার কাছ থেকে। মীরা একে একে সব বলে – গত ছয় দিনের সব ঘটনা।
মাজেদা খালা নূহার জন্মের সময় মীরার সাথে হসপিটালে ছিলো। দীর্ঘ আটদিন একটানা, একসাথে থাকার ফলে নিজেদের অনেক কথা, গল্পের বিনিময় হয়েছিল সেখানে। সেই সুবাদে মীরার সব ঘটনা জানে মাজেদা খালা। মাজেদা খালাও তার সব বলেছিলো মীরাকে। তাই এসব বলতে কোন দ্বীধা হয় না মীরার। বরং কাওকে কথাগুলো বলতে পেরে হালকা লাগে ওর। সব শুনে তিনি মীরাকে বলেন-
: “খালা আমার জীবণে দেখা সবচেয়ে শক্ত মাইয়্যা হইলেন আপনে। এহন ভাইঙ্গা পরলে কাম চলবো?
আপনেরে আরো শক্ত হইতে হইবে”
: ” স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতারচ্ছি এ পথচালার শুরুর দিন থেকে। আমি আর পারছি না খালা। আমি অনেক ক্লান্ত, চোখ বুজে আসছে আমার ক্লান্তিতে। মনে হচ্ছে জীবণ মৃ’ত্যু’র সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি আমি”
: ” কতো মানুষরে বাঁচার আশা দেন, সাহস দেন, আর আপনিই এত ভীতু। এই মাইয়্যাডার দিকে তাকায় দেহেন তো? সোফায় ঘুমিয়ে থাকা নূহার দিকে ইঙ্গিত করে খালা।
: “এর কি দোষ? এর তো কোন ভুল নাই। ভুল করছেন আপনারা, ওয় কেন তার ভোগান্তি পায়াইবো?”
নূহার দিকে ফিরে সোফাটা ধরে আবার কাঁদতে শুরু করে ও। যেন সেই সোফাটাই ওর একমাত্র অবলম্বন। কিছুসময় পর মীরা ঘুমন্ত নূহার চুলগুলো মুখ থেকে সরাতে সরাতে বলে-
: ” মারে তোরে আমি পয়মন্ত ভাবছিলাম, তোর উছিলায় তোর বাবা শুধরে গেছে এটাই মেনে বসে ছিলাম আমি। কিন্তু তুই কত্ত দূর্ভাগা। আমার জীবণের এই ঝড়ের প্রভাব তোর জীবণেও পরবে রে মা, এর জন্য আমিই দায়ী, আমি না পারলাম ভালো সন্তান হতে না পারলাম ভালো মা হতে। আমারে তুই ক্ষমা করিস না মা, কোন দিনও ক্ষমা করিস না”
মাজেদা খালাও নিশ্চুপে কেঁদে যান। দুনিয়ায় কত্ত ভাষা, তবুও এই অসীম ধৈর্যের শক্ত মেয়েটাকে স্বান্তনা দেওয়ার কেন ভাষাই খুঁজে পাচ্ছে না সে।
চলবে…
প্রিয়_ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ২৮
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
ঐ ঘটনা জ্ঞাত হওয়ার পর থেকে কেমন যেন হয়ে গেছে মীরা। ইদানীং ওর অগোছালো ভাব, ওর বিহ্বলতা ঠিক যেন খাপ খায় না আগের প্রাণ-শক্তিপূর্ণ মীরার সাথে। যেখানে বসে থাকে বসেই থাকে, খাওয়ার ঠিক নাই, গোসলের ঠিক নাই, বাইরে যায় না, মেয়ের যত্ন করে না। ওকে দেখে মনে হয় ওর অতি প্রিয় কেও মা’রা গেছে। যার বিয়োগের শোক, পুরোনো মধুর স্মৃতি ওকে তাড়িত করছে ক্ষণে ক্ষণে, যা ভুলে স্বাভাবিক হতে পারছে না ও। কিভাবেই বা পারবে এই সেই রাজিব যে ওকে না পাওয়ার ভয়ে আ’ত্ন’হননের পথ বেছে নিয়েছিলো। অনেক গুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে মৃ’ত্যুকে আপন করে নিয়েছিলে মীরাকে হারিয়ে। মীরা অনেক চেষ্টা করেও ব্যার্থ হয়েছিল যখন বাবা-মা কে বোঝাতে তখন বাবা-মায়ের কথা ভেবে সরে আসতে চেয়েছিলো এ সম্পর্ক থেকে। যার ফলাফল ছিলো রাজিবের ঐ আ’ত্ন’হ’ননের চেষ্টা।
লুকিয়ে মীরা হসপিটালে গিয়ে যখন জিজ্ঞেস করেছিলো-
: ” কেন এমন করেছিলে?”
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আধ ম’রা রাজিব উত্তরে বলেছিলো-
: ” আমি, আমার জীবণ, আমার নিঃশ্বাস তোমার নামে, তুমিই যদি না থাকো তাহলে এ জীবণ দিয়ে কি হবে?”
হসপিটালে বসে রাজিবের হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছিলো মীরা –
: “এর দাম আমি আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মনে রাখবো, বেঁচে থাকতে আমি তুমি ব্যাতিত কাওকে গ্রহণ করবো না”
সে দিনটা মীরার কাছে সবচেয়ে সুখের দিন ছিলো। টিন সেটের ঐ খুপরি ঘরের দিনগুলোতে কষ্ট যখন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখে ছিলো ওকে। অভাব, এমন দমবন্ধ পরিবেশে অভিযোজিত হওয়ার কষ্ট, স্বামীর অসুস্থতা এসব যখন নিত্য দিনের সঙ্গী ছিলো-
চোখ বন্ধ করে ও কেবল সেই দিনটার কথা ভাবতো। দমবন্ধ ঐ জীবণে মনটা ভরে উঠতো ঠান্ডা এক হাওয়ার দাপটে।
আচ্ছা রাজিব কি ভুলে গেছে ওকে বাঁচিয়ে রাখতে, ওর চিকিৎসার জন্য যখন অনেক টাকার প্রয়োজন ছিলো তখন এক একটি দিন কিভাবে পার করতো মীরা? কত ছলনা, কত নিচ হতে হয়েছিলো মীরাকে। রাহাতের ব্যাপারটা না হয় ও জানে না আর বাকী সব? বাঁচানোর মালিক খোদা কিন্তু এই যে ও বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে এখন, এর আয়োজন করতে কেও কিন্তু ওর পাশে ছিলো না সেসব দিন গুলোতে। না ওর বাবা-মা-ভাই-বোন।
আর এই সাথী?
কোথায় ছিলো সে?
সেকি জানে রাজিবের হৃদয়ের ঐ দুটি ফুটা মীরার জোড়া দেয়া? আর রাজিব, এত বদলে গেলো ও, এত বড় সিদ্ধান্ত নিলো। একটা বার বুক কেঁপে উঠেছিলো ওর? বিয়ের রেজিস্টারে সই করার সময় হাত কেঁপে উঠে নি ওর?
অথচ এই রাজিব যার জন্য এত এত মেয়ে পাগল থাকা সত্ত্বেও বিয়ে করেছিলো বিবাহিত মীরাকে, এ বিষয়ে কথা তুললে রাজিব মীরাকে থামিয়ে দিতো, ভুলে থাকতে বলতো ঐসব কথা। মীরাকে বিয়ে করে ঘর ছাড়া, সমাজ ছাড়া হয়েছিলো। বিবাহিত মেয়েকে বিয়ে করে কত লোকের কটু কথাও কম শুনতে হয়নি ওকে। এটাও কি কম ত্যাগ? তারপরও শক্ত হাতে আগলে ধরেছিল সে মীরাকে। রাহাতের দেয়া এত বড় সুযোগ ও ছেড়ে এসেছিলো ওর কথাকে মূল্যায়ন করতে। ঠিক কবে মীরাকে আগলে রাখার এই বাঁধন আলগা হয়ে গেলো? কবে থেকে বদলে গেলো রাজিব? জানতে খুব ইচ্ছে হয় মীরার। এক একবার মনে হয় ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করে এসব। কিন্তু সামলে নেয় আবার নিজেকে। তাই এসব ভুলে থাকতে ওকে মৃ’ত ভাবা ছাড়া উপায় আছে কি।
সত্যি বলতে মীরার ভাবনাটা অনেকটা এমনই, রাজিব নামের মানুষটার প্রাণ বায়ু এখনো উপস্থিত, সে দিব্যি খাচ্ছে, ঘুমুচ্ছে, কাজকর্ম ও করছে ঠিকঠাক। তবুও ওর মনের ছোট্ট ঘর জুড়ে রাজিব নামে যে সত্তা ছিলো তা এখন বিলীন হয়ে গেছে। ওর কাছে রাজিব নামের মানুষটা মৃ’ত’ই।
যারা মীরার ভিতর থেকে গুড়িয়ে যাওয়ার খবর জানে না তারা ওকে এ অবস্থায় দেখে টিপ্পনী কাটে। দ্বিতীয়বার মা হওয়ার আশংকা করে, স্মিত হাসে মীরা। নূহা না থাকলে ঠিক খু’ন করতো ও রাজিবকে। তারপর যদি জেলেও গিয়ে থাকতে হতো কেন আপত্তি থাকতো না ওর। কিন্তু নূহার কারনে এসব সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে মীরা। সরে আসে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ভাবনা থেকেও।
মৃত্যু শোকও মন্থর হয়ে আসে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। মীরাও চেষ্টা করছে সব কিছু ভুলে ঘুরে দাঁড়ানোর। মেনে নেয়া, মানিয়ে নেয়া জিনিসটা সহজ না যদিও। যাকে ভুলে থাকবে সে যদি চারপাশে ঘুরঘুর করে সেটা যে কি যন্ত্রণার তা কেও জানে না ভুক্তভোগী ছাড়া। তবে মানিয়ে নেয়াটা সহজ হয়েছে মাজেদা খালার দরুন। তিনি মীরার ভেতর থেকে ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়া মনের এক একটি টুকরো খুঁজে খুঁজে দিচ্ছে মীরাকে। মীরাও সেই টুকরো জুড়ে জুড়ে পাজল মিলিয়ে নিচ্ছে। অনেক ভেবেছে ও, রাজিবকে শেষ করে দেয়ার কথাও যে ভাবে নি তা নয়। তবে যা কিছু কেড়ে নিয়েছে রাজিব ওর থেকে, তা না ফিরিয়ে কিছু করবে না ও। ঠান্ডা মাথায় সব করতে হবে। ভালোবাসা দিয়ে ও সব নিয়েছে। মীরাও ভালোবেসেই মে’রে ফেলবে ওকে। তাই রাজিবের সাথে ও স্বাভাবিক থাকে মীরা। আগের মতোই কারখানার খোঁজ নেয়। রাতের খাবারের টেবিলে আলাপ হয় দেশের পরিস্থিতি নিয়ে। আমেরিকার আসন্ন নির্বাচনে কে জিতবে তা নিয়েও বাজি হয় দুজনে। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় সুখি একটা পরিবারের ছবি এটি। মাজেদা খালা মাঝপ মাঝে মীরার এমন আলগা ভাব দেখে ভুরু কুঁচকে ফেলে। মাঝপ মাঝে সেও বুঝতে পারে না মীরার মনে আসলে কি চলছে।
মাঝে মাঝে ওদের কেনা জমির উপর যে বাড়ি বানাবে ওরা তার নকশা ঠিক করে দুজন মিলে। মীরা কপট ঝগড়া করে কমদামি টাইলস ব্যাবহারের জন্য।
কোন কোন দিন দুজন মিলে বাড়ির বারান্দা কিংবা
ঘরের সিলিং এর ডিজাইন অথবা একটা কিছু ঠিক করে। ইদানীং কেন কোন ব্যাপারে কিছু আলাপ হলে পরদিন এসে তা সংশোধন করিয়ে নেয় রাজিব। মীরার বুঝতে বাকী থাকে না সে সংশোধনের কারন। সাথীর মতামত ও যে ওর কাছে গ্রহণযোগ্য তা প্রমাণের প্রমাণ হিসেবে সংশোধন ফাইলের ছবি তুলে নিয়ে যায় রাজিব। মীরা সব বুঝতে পেরে মুচকি হাসে৷ ও রাজিবকে বাঁধা দেয় না। কারন ও চায় না রাজিব সতর্ক হোক। জেনে যাক যে ও সব জানে। তাই ইদানীং রাজিবের এমন অসংলগ্ন আচরণে মজা পায় মীরা। ন্যাটা মেয়েটার দম আছে বলতে হবে। কেমন পোষ মানিয়েছে বদমেজাজি রাজিবকে।
মীরা সব বুঝেও বুঝে না, দেখেও দেখে না। রাজিবের শরীরের আঁচড়ের দাগ, অন্য পারফিউমের গন্ধ এসব নিয়ে কোন মাথাই ঘামায় না মীরা। তবে রাজিবকে রাখে দৌড়ের উপর। শরীরে আঁচড়ের দাগে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে – কিসের দাগ এটা, ওহ্ নূহার নখ বড় হয়ে গেছে। কেটে দিতেই মনে থাকে না। ভিন্ন পারফিউমের গন্ধ সম্পর্কে কথা ও বলে স্বাভাবিক কন্ঠে। রাজিবকে দিশেহারা করে ও-ই পথ দেখিয়ে দেয়। ইদানীং এ জিনিসটায় খুব মজা পায় মীরা। রাজিবের মুখভঙ্গি তখন হশ দেখার মতো। মীরা মানসিক ভাবে ওকে টর্চার করে। তবে অশান্তি করার সুযোগ থাকলেও করে না। কারন ও জানে কোন রকম অশান্তি মীরার প্ল্যানের পক্ষে ক্ষতিকর। তাই অনেক সুতো ছাড়ে মীরা, উড়ুক ঘুড়ি ইচ্ছে মতো। সময় হলে তা গুটিয়ে নিবে ও।
তবে আজকাল মীরার সবচেয়ে বেশী কষ্ট হয় রাজিবের সাথে একই খাটে পাশাপাশি শুতে। রাজিবের শরীরের সাথে মীরার শরীরের যখন ছোঁয়া লাগে তখন মীরার গায়ে আগের মতো শিহরণ খেলে না। শরীরের রক্ত গুলো জমে যেতে শুরু করে। কেমন যেন ঘেন্না লাগে ওর, যেন রাজিব অস্পৃশ্য। নোংরা লেগে আছে রাজিবের গায়ে। অন্তরঙ্গ হওয়া তো আরো বিশ্রী ব্যাপার। সেখানে না থাকে কামনা, না থাকে সুখ।
আজ মাথা ব্যাথা, কাল ভাল্লাগছে না, পরদিন ক্লান্তির বাহানা দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখে মীরা রাজিবের কাছ থেকে। রাজিব ওকে ঘাটে না তেমন। মীরার সাথে অন্তরঙ্গতার ওভারটাইমের কাজটা থেকে ছুটি পেয়ে সেও যেন শান্তির ঘুম ঘুমোয়। ঐ বাড়ি হয়ে এসে এমনিতেই চোখ বুজে আসে রাজিবের। সারাদিন ধকল তো কম যায় না। একটা সংসার একটা বউ পালতেই কত কষ্ট, এদিকে দু-দুটি সংসার, বউ সামলনো মুখের কথা। তার উপর সাথী ইদানীং খুব প্যারা দিচ্ছে প্রকাশ্যে আসতে চেয়ে। রাজিব কোনমতে ভুলিয়ে ভালিয়ে দিন আর রাত পার করছে। ছোট্ট মেয়ে তো ভোলাতে কোন বেগ পেতে হয় না ওকে। যখনই এ প্রসঙ্গে কথা উঠে রাজিব সাথীকে শপিং করতে টাকা দিয়ে, নতুন কোন রেস্টুরেন্টে যাওয়ার কথা বলে ভুলিয়ে দেয়। এত দিক সামলে বাড়ি ফিরে মেয়েকে সময় দিতে হয়। মীরার সাথে আহ্লাদ করা লাগে। বিছানার যে ব্যাপার এটা এখন উপরি পাওনা রাজিবের। নূহা পেটে আসার পর থেকেই মীরার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় চলে রাজিব। বোকা মীরা স্বামীর এই কামের উপোসকে সমুন্নত করেছিলো উচ্চ আসনে। অথচ তার কতো আগেই রাজিব সাথীর সাথে সম্পর্কে ছিলো। এসব ভেবে ঘনিষ্ঠতা যখন একেবারেই এড়াতে পারে না, তখন চোখ ঢেকে রাখে। যেন চোখ ঢাকলেই এড়িয়ে যেতে পারলো ও এসব থেকে।
অনেকের কাছে মীরার এ ব্যাপার গুলে অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে। তারা বলতে পারে – আরে তোমার স্বামীই কি পৃথিবীতে প্রথম দ্বিতীয় বিয়ে করেছে?
না করে নি। প্রথম স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে বিয়ে করতে ধর্মে কোথাও বলে নি। তার উপর রাজিব ওর নিজের গড়া ব্যাবসা থেকে বের করে দিচ্ছে ওকে। যাতে বাকী জীবণ নতজানু হয়ে থাকে মীরা সবকিছু জানার পরও। এত কিছু হওয়ার পরও সব হজম করা সত্যি কি এত সোজা?
সত্যি কি মীরার এসব উদ্বেগ, কষ্ট অতিরঞ্জন?
শ্রান্ত রাজিব ঘুমিয়ে গেলে পাশে শুয়ে মীরা তাকিয়ে থাকে রাজিবের দিকে। এই কি সেই রাজিব?
মনে মনে বলে-
কিভাবে শেষ করবো তোমায়?
ধীরে ধীরে, নাকি একবারেই ?
চলবে….
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ২৯
বরিশাল থেকে আসার পর মীরা নিয়মিত যোগাযোগ করে মামী শ্বাশুড়ি আর ননদ দেবর দের সাথে। ঐ কটা দিনেই খুব আপন করে নিয়েছিলে ও সবাইকে।
তাই তারা তাদের সংসার, সুখ, দুঃখ সব মীরার সাথে ভাগ করে নিতে দ্বিধা বোধ করে নি। মীরাও বরাবর ধৈর্যশীল মনোযোগী শ্রোতা। এই গুনটা এক নম্বর গুন মানুষের কাছে প্রিয় হবার। কারন সব সময় সব যুগেই মানুষ অপরের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকতে চায়। নিজের সুখ, দুঃখ, গল্প, কথা শুনাতে ভালোবাসে, ভালোবাসে যে তাকে মনযোগ দেয় তাকেও।
শুধু মামীরাই না, মামারাও ভীষণ ভালোবেসে ফেলে ওকে। হাটে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করে কি খেতে পছন্দ, বিয়ের শত ব্যাস্ততায়ও সকাল, বিকাল, চা, নাশতা ঠিকমতো দেয়া হচ্ছে কি না তার খোঁজ রাখতো। কার থেকে কে বেশী খাওয়াবে, কার থেকে কে বেশী ভালোবাসবে নিরবে একটা প্রতিযোগিতা চলেছে চার ঘরে। খুব ভালোই লেগেছে তাদের এমন সরল ভালোবাসা। ফিরবার সময় প্রত্যেক মামী একটা করে শাড়ি উপহার দিয়েছিলেন মীরাকে।
এমনকি ওর বড় মামা শ্বশুর যাকে সবাই সামলে চলে তার সাথে ও বেশ শখ্যতা গড়ে উঠে মীরার। অথচ তাকে এখনো এলাকা সুদ্ধ মানুষ ভয় পায়, এই বড় মামা আসছেন শুনলেই নাকি পুরো বাড়ি হয়ে যেতো ভূতের বাড়ি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে যদিও এসবের তীব্রতা কমে এসেছে। তবুও সবাই সমীহ করে চলে তাকে। বাকী তিন ভাই ও, মূলত সবাই তারা তাকে সম্মান করে।
এলকার বিচার আচার এখনও তিনিই করেন। তিনি বাড়ির মেয়ে বউদের সাথে কথা বলেন না। সেই মামা মীরার সাথে তার মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর গল্প করে। দুঃখ প্রকাশ করে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ছেলেদেরকে পড়াশোনা করাতে না পারায়। কত মানুষের চাকরীর তদবির তিনি করে দেন। অথচ নিজের একটা ছেলেকেও স্কুল পাশ করাতে পারলন না, কোন চাকরীতে ঢুকিয়ে দিতে পারলেন না সেই আক্ষেপ ও প্রকাশ করেন তিনি।
সেঝো মামী মীরার এমন আপন করে নেয়ার দক্ষতা দেখে বলেছিলেন- “তুই তো জাদুকন্নি, মোর খুব ইচ্ছা অয় কোন মায়ের পেডে তোর জন্ম তারে দেখতো, আবার আইলে হেরে লইয়্যা আইবি”
এমন আপন করে নিয়েছিলো যারা তাদের সাথে যেগাযোগ না রাখে কেমনে। তাছাড়া মীরার শ্বশুড়বাড়ির দিকের আত্মীয় বলতে কেবল তাদেরকেই চিনে মীরা। তাই নিয়মিত কথা হয় তাদের সাথে।
বরিশাল থাকতে সব মামীদের সাথেই ভালো সম্পর্ক হয়েছিল মীরার। ছোট মামীর চারটা মেয়ে, ছেলে নেই কোন৷ মামাও অসুস্থ হয়ে বিছানায় বেশ কয় বছর। তাই তিনি মীরাকে বলেছিলেন- ঢাকায় তো মীরার কত জানাশোনা। এত বড় ব্যবসা দেখাশোনা করে ও, তার মেয়েদের জন্য যেন ঢাকায় ভালো পাত্র খুঁজে দেয় মীরা। পরপর দুই বোন বিয়ের উপযুক্ত হয়ে গেছে, বড় মেয়ে সাথী কে বিয়ে না দিলেই না। মীরা তাকে বলেছিলো-
: “মামী আপনি একদম চিন্তা করবেন না। সাথীর বিয়ের দায়িত্ব আমি নিলাম, এত সুন্দর ও ইনশাআল্লাহ ভালো ঘর আর ভালো বর খুঁজে দিবো আমি” (মীরা কি তখন জানতো ওর নেয়া দায়িত্ব বছর খানিক আগেই ওর স্বামী পালন করে ফেলেছে)
একে একে সবার সাথে কথা বলে ছোট মামীকে কল করলো যখন তখন তিনি স্মরণ করে দেন ওর নেয়া দায়িত্বের কথা৷ মীরার মনে হয় কথাগুলো বলে দিতে পারতো যদি।
তখন মীরার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে। সত্যি একটা ছেলে ঠিক করবে কি ও সাথীর জন্য। এটা নিয়ে রাজিবকে বাজিয়ে দেখলে কেমন হয়। মীরার কথা শুনে গলা শুকাক দুজনের। আতংকে কাটুক কিছু দিন।
পরে আবার ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করে মীরা। হিতে বিপরীত হবে না তো, থলের বিড়ার বেরিয়ে আসবে না তো আবার?
সেদিন দুপুরে সবার সাথে কথা বলে ফোনে রাখার একটু পরেই ফোন করে পিয়াসস। ফোন পেয়ে কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত দেখায় ওকে। মীরা নূহাকে টুম্পার কাছে রেখে বেরিয়ে পরে।
কোথায় যাচ্ছে কখন ফিরবে কিছুই বলে না ও। টুম্পাও কিছু জিজ্ঞেস করে না। মাঝখানে সন্ধ্যায় একাবর ফোন করলে মীরা বলেছিলো ওর আসতে ঘন্টা খানিক লাগবে। ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে মীরা বাড়ি ফিরে রাত দশটাও পরে। নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে গেইট খুলে ভিতরে ঢুকে ও। নূহার ঘুম ভাঙার ভয়ে রাতের বেলা কলিংবেলে বাজানো নিষেধ এ বাড়িতে। তাই এই বিকল্প ব্যাবস্থা৷ রুমে ঢুকে গোসল করে মীরা, কিছুনা খেয়ে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দেয় বিছানায়৷ একটু ঘুমের বড্ড দরকার ওর।
সেদিন বেশ রাত করে রাজিব বাসায় এলো । রাত দেড়টা কি দুটো হবে। ঘুমে মগ্ন মীরার উঠতে দেরি হয়। রাজিব প্রচন্ড রেগে যায় দেরি করে গেইট খোলায়। রাজিবের মাথা গরম অবস্থা দেখে ঘুম পালায় মীরার চোখ থেকে। বাড়িতে মাজেদা খালা নেই, তিনি তার বোনের বাড়ি গেছেন অসুস্থ বোনকে দেখতে। রোগীর অবস্থা খারাপ হওয়ায় রাতে ফিরেন নি তিনি। ফোন করে বলেছেন কাল সকাল সকাল এসে পরবেন। মীরার তাই খেয়াল ছিলো না গেইট খোলার কথা। রাতের বেলা সব সময় তিনিই খোলেন গেইট।
ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে রাজিব, চোখেমুখে রাজ্যের শ্রান্তি। ইদানীং অনেক পেরেশানি যায় ওর। নতুন ডিজাইনার খালি ভুল করে। ডিজাইনের কাজ মীরা ছেড়ে দেওয়ার পর পেরেশানি বেড়েছে রাজিবের। আগে মীরা ডিজাইন বিল্ডআপা, তা স্যাম্পল ম্যানকে বুঝিয়ে দেয়া, ডিজাইনের ড্রেস তৈরি হলে তা সংশোধন সবই করতো যখন তখন। ছুটি, মাপা ওয়ার্কিং আওয়ার এসব ও কখনোই হিসেব করতো না। ভবাতো নিজেদের কাজ। কিন্তু যারা টাকার বিনিময়ে কাজ করে তাদের কেন এত সব দায়। ডিজাইন তৈরীর জন্য টাকা, তা ঠিকঠাক না হলে আবার সংশোধন করার সময় টাকা৷ টাকা কোন বিষয় না রাজিবের কাছে, কাজটার পারফেকশনই এই ব্র্যান্ডের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক।
মীরা সেই দিকের সুতোটাই আলগা করে দিয়েছে। বরিশাল থেকে ফিরে আসার পরপরই। এবার বাছাধন বোঝো মীরা কি জিনিস। রাজিবের শক্তিশালী দিক মার্কেটিং, আর মীরার ডিজাইন এবং ম্যানেজম্যান্ট। রাজিব তো কবে থেকে ওকে সরাতে চাইছে, কিন্তু মীরা ওকে দেওয়া অবসরকে ভালোবাসা ভেবে ওয়ার্ক ফ্রম হোম যখন চালুও হয় নি তারও আগে থেকে ঘরে বসে কাজ করে যাচ্ছিলো। এসব ঘটনা জানার পর নিজেকে ঘুরে দাঁড় করানোর যে কাজ হাতে নিয়েছে মীরা এটা তার একটা অংশ।
গ্লাসে পানি ঢালার শব্দে সংবিৎ ফিরে মীরার। যদিও মীরা জবুথবু হয়ে বসে আছে ওর পাশের চেয়ারে, কিন্তু দুই মনের দুরত্ব এখন পৃথিবীর দীর্ঘ সাগর সমান। ঐ যে বলেছিলো একসময় মীরা ওকে তুমি আমার পাশেই আছো, তবুও তোমাকে ছুঁতে পারছি না আমি। সেই সব দিনে রাজিবের ভেতরকে না ছুঁতে পারার কারন এখন জানে মীরা।
এসব ঘটনা না জানলে এ সময় হয়তো অভিমান করতো ও । কিন্তু এ রাজিবের সাথে “অভিমান” বড়ই বিলাসী শব্দ। কষ্ট পেয়েছে এটা সত্যি কিন্তু এর কোন স্বান্তনা কিংবা মান ভাঙানো এসব আশা করে না মীরা। কিন্তু ওর এতটুকু বোঝা উচিত মেয়েটা অসুস্থ। নূহা অসুস্থ হলে সারাদিন কোলে করে রাখতে হয় ওকে। নাওয়া, খাওয়া, ঘুম হারাম হয় যায় তখন। সংসারের প্রতি উদাসীন রাজিব শুরু থেকেই। ঘরের টুকটাক কাজ কিংবা বাজার সবসময় হয় ও নিজে করেছে না হলে ম্যানেজারকে দিয়ে করিয়েছে। মেয়ের অসুখ, মাসের বাজার, বিভিন্ন বিল, এসব শব্দের সাথে জানা শোনা রাজিবের আদৌ কোনদিন ছিলো কি না তা ভাবতে পারে না মীরা। খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে উঠে রাজিব বল-
: ” আগামীকাল ইন্ডিয়ায় যাচ্ছি আমি, মালেক সাহেব যাবেন, তার সাথে আমিও যাবো তিন-চারদিন থাকবো হয়তো”
মীরা শুনেও না শোনার ভান করে বাসনপত্র গুছিয়ে নেয়৷ সবকিছু গুছানো হলে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে দেখে রাজিব ঘুমে বেহুশ। নিজেকে নিজেই স্বান্তনা দেয় মীরা। মনে মনে বলে-
: ” নতুন করে কষ্ট পাওয়ার কি আছে মীরা, এ আর নতুন কি?”
চোখ বন্ধ করে ভাঙা ঘুমটাকে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করে ও। ক্লান্তিতে তন্দ্রার মতো একটা আবেশ গ্রাস করে পুরো শরীরকে। হঠাৎ কি মনে করে যেন উঠে বসে মীরা। সাইড টেবিলের উপর থেকে ফোনটা নেয় ও। ফেসবুকে ঢুকে দ্রুত লগইন করে ওর ফেইক ফেইসবুক একাউন্ট “ব্রোকেন এ্যান্জেল” এ, যেটা দিয়ে “সাথী” কে নিয়মিত ফলো করে মীরা৷ ঢুকে দেখে সাথী শপিং টাইম ক্যাপশনে ছবি পোস্ট করেছে আধ ঘন্টা আগে। ছবি গুলো দেখে অবাক হয় না মীরা। এ আর নতুন কি? কিন্তু শেষের কয়েকটা ছবিতে রাজিবও আছে, তবে তা পাশ থেকে তোলা, মুখ না দেখা গেলেও মীরার একটু বুঝতে বাকী থাকে না যে এটাই সেই রাজিব যার হৃদয় জোড়া লাগিয়ে দিয়েছিলো মীরা কোন একদিন, আর তার বিনিময়ে প্রতিনিয়ত মীরার হৃদয় ভাঙার খেলায় মত্ত সেই রাজিব। যেন মীরার হৃদয় সস্তা কোন খেলনা, চাইলেই ভাঙা যায়, এটা ভাঙা খুব বেশী দোষের কিছু না।
সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হচ্ছে ছবিগুলো “মালদ্বীপ ট্যুর” নামের এলবামে রাখা। তার মানে কি- ওরা মালদ্বীপ যাচ্ছে কাল? সংসারের কাজকর্ম, অসুস্থ মেয়ের জ্বালা, সাথী সংক্রান্ত মানসিক নিপিড়ন তার সাথে ওদের প্রমোদ ভ্রমণের এই আগাম খবরটা যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো মনে হয় মীরার কাছে। অথচ কয়েকদিন আগে গ্রুপ ট্যুরে মানালি যেতে চেয়েছিলো মীরা। রাজিব বলেছিলে সামনে সিজন এবসময় যাওয়াটা ঠিক হবে? মীরা প্রশ্নটার উত্তর নিজই খুঁজে নিয়েছিলো৷ তাই এসব নিয়ে আর কথা বাড়ায় নি । অথচ কাল ওরা যাচ্ছে মালদ্বীপে। ঘুম, ক্লান্তি উড়ে গেছে মীরার কাছ থেকে। অনিদ্রার সাথে মিতালি পাতিয়ে সাইড টেবিলের পাশে বসে এসবই ভাবছিলো মীরা। একটা সময় মীরার ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে যায়। রাগ, অভিমান, কষ্ট, ভালেবাসা, কিচ্ছু নেই সেখানে। অনুভূতিহীন মীরা কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে সাইড টেবিলের পাশে, নিজেই জানে না।
ভোরের দিকে রাজিব ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় দেখে মীরা দুই হাঁটুর উপর মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে। বাথরুমের কাজ সেরে পাঁজা কোলে মীরাকে খাটে শোয়ায় রাজিব। রাতের ব্যাবহারের জন্য বৌ হয়তো অভিমানে ওখানে বসে আছে- এটাই ভেবে নেয় ও । এ অভিমান দীর্ঘায়িত করা যাবে না ভেবে অভিমান ভাঙানোর জন্য ওর কাছে থাকা একমাত্র ঔষধ প্রয়োগ করে মীরার উপর। অনেকদিন পর রাজিব ভীষণ যত্ন করে কাছে টেনে নেয় মীরাকে৷ ঘুমন্ত মীরার না জাগলেও ওর শরীর জেগে উঠে সেই ডাকে। মীরার অন্তঃসারশূন্য মন সব ভুলে আগের মতো মেতে উঠে আদিম ভালোবাসায়।
চলবে…
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ৩০
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
দীর্ঘ সে রাত শেষে সকালে যখন ঘুম ভাঙে রাজিবের বেষ্টনীতে নিজেকে আবিষ্কার করে মীরা। পর্দার ফাঁক গলে দিনের প্রথম আলো ঢুকে অন্ধকার ঘরটা আলোয় ভরে উঠায় ঘুম ভেঙে গেছে ওর। সাবধানে পাশ ফিরে মীরা, অপলক দৃষ্টিতে দেখতে থাকে রাজিবকে। কি মায়াময় চেহারা রাজিবের! অথচ কি নির্দয় ভাবে শান্তি কেড়ে নিয়েছে ও মীরার। প্রতিনিয়ত অভিনয়ের মোড়কে মুড়ে রেখেছে নিজেকে মীরার কাছ থেকে। ধীরে ধীরে বের করে দিতে চাচ্ছে ওর নিজের গড়া ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান থেকে। আচ্ছা ওর কি মনে নাই এই যে আজকে মহীরুহ হলো এই ব্যাবসা তাতে মীরার অবদান কতটুকু ছিলো। সেই সব কষ্টের দিনের কথা ভাবলে গা কেঁপে উঠে ওর। সেই সকাল থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত চলতো ওর কাজ। কারখানার শুরু হলো যখন এতগুলো কর্মচারীকে বাজার করে একা হাতে কেটে বেছে রান্না করে খাইয়েছে। ওদের বাসায় গ্যাস থাকত না। তাই ফজরের নামাজের পর রান্নাবান্না শুরু করতো ও। ঘরের কাজ শেষ করে কারখানার কাজে সাহায্য করতো । কোন কাজ না জানা সত্ত্বেও এই কাজ সেই কাজ করেছে। অল্পদিনে শিখেছে মেশিন চালানো। কাজের চাপ বাড়লে দিনরাত এক করে দিতো কাজ করে করে। কর্মচারীদের ছুটি, ওয়ার্কিং আওয়ার ব্যাপারটা ছিলো। কিন্তু মীরার সার্ভিস ছিলো অল টাইম। দিনে গড়ে ঘুমাতো পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা। তবুও নিরলসভাবে কাজ করে যেতো ও, ভাগ্যের চাকা ঘুরবার জন্য। ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে ঠিকই, সাথে সাথে ঘুরে গেছে রাজিব ও।
একটা সময় কত গর্ব হতো ওর – এত সুন্দর স্বামী পেয়ে। কত কত মানুষের ভীড়ে সবাই ওদেরকে দেখতো, কেও কেও বলতো রাজযোটক। মনের আনন্দ গোপন করে এমনি ভাব করতো মীরা যেন -“এ আর এমন কি? এতো ওর পাওনাই ছিলো।
ফেসবুকে ছবি দিলেই লাভ রিয়্যাক্ট আর কমেন্ট বক্স ভরে যেতো সুন্দর সুন্দর মন্তব্যে। কেও কেও বলে- লাভলি কাপল, কেও বলে মেইড ফর ইচ আদারস্, আসলেই কি ওরা লাভলি কাপল? কিংবা মেইড ফর ইচ আদারস্?
ছোটবেলায় অনিন্দ্য সুন্দরী মীরাকে মজার ছলে নানী-দাদী শ্রেণির প্রায় সকলে বলতো- ” এত সুন্দর তুই, তোর কপালে দেখিস কালো বর আছে” নাক সিটকানো মীরা বিরক্ত হতো এসব কথায়। ভবিষ্যৎ স্বামী হিসেবে চাওয়া-পাওয়ার অভিলাষ ওর খুবই সীমিত ছিলো সেই থেকেই । সুন্দর-সুদর্শন একজনকে স্বামী হিসেবে চায় ও, ব্যাস।
এতই একনিষ্ঠ ছিলো সে চাওয়া যে – খোদা ওকে ফিরালেন না। মনের খবরের হেলদোল না থাকা মীরা খুশি কেবল সুদর্শন বর পেয়ে। জীবণ যে শুধু রূপে চলে না, আর সুন্দর হওয়া যে কোন যোগ্যতা না তা কি কখনো ভাবার সময় পেয়েছিলো মীরা? পায় নি হয়তো।
কুচকুচে কালো আবীরের সাথে বিয়ের দিন মীরা মনে মনে শাপ দিয়েছিলো তাদের প্রত্যেককে যারা খুব ছোটবেলায় ওকে বলেছিল – ” তোর কপালে দেখিস কালো বর আছে ”
তারপরের গল্প সবার জানা। গর্ব আর অহংকারে অন্ধ মীরা বুদ হয়ে ছিলো মিছে ভালোবাসায়। ওর গোপন যে অহং ছিলো রাজিবকে নিয়ে তার ভিত পতনের জন্য সাথীর আবির্ভাব হয়েছে ওর জীবণে। আচ্ছা ও যদি এমন অহং বা গর্ব না করতো, দুনিয়ায় থেকে লুকিয়ে রাখতো রাজিবকে, ফেসবুকে ছবি না দিতো তাহলে মনে হয় আল্লাহ এ শাস্তিটা দিতো না। নানান হাবিজাবি ভাবনা ভিড় করে মীরার মনে। ভাবনার অগোছালো ভাব দেখে হেসে দেয় মীরা, এটা হবারই ছিলো। ও নিজের ঘাড়ে দোষ নিচ্ছে রাজিবকে সাধু সাভ্যস্ত করার জন্য। ওর দোষ কি এতে?
হ্যা দোষ একটা আছে মীরার, সেটা হচ্ছে রাজিবকে ও নিরেট ভালোবেসে ছিলো। যে ভালোবাসায় কোন ফাঁকফোকর ছিলো না, ছিলো না অবিশ্বাস। মনে মনে জিজ্ঞেস করে –
“কেন আমার সাথে এমন করলে রাজিব?
আমার অপরাধ কি ছিলো?
চোখ থেকে পানি গড়িয়ে কানে ঢুকে যায় মীরার। কানের পানি মুছে মীরা।
মীরার উপর রাখা রাজিবের হাতটা সাবধানে সরায় ও, তারপর বিছনা থেকে উঠার সময় পেছন থেকে মীরার হাত ধরে রাজিব। ভীত চিত্তে মীরা পিছন ফিরে তাকায়, ওর মনের কথা শুনে ফেলেনি তো রাজিব? বোকা মীরা পিছন ফিরে দেখে রাজিব মুচকি হেসে ওর হাত ধরে এখনি যেতে নিষেধ করছে।
অন্য সময় মীরার কাছে এটা হতো রোমান্টিক কোন মুভি থেকে তুলে আনা মিষ্টি এক দৃশ্য। কিন্তু রাজিবের সবজান্তা মীরা অনেক কষ্টে একটা মুচকি হাসি হেসে রাজিবের – “কিছুক্ষণ আর না’হয় রহিতে কাছে ” – আবেদনটি নাকচ করে নেমে পরে খাট থেকে।
বাথরুমে ঢুকে অনেক সময় নিয়ে গোসল করে ও। শরীরে সাবান মাখতে মাখতে ভাবে- জীবণ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওকে? ও কি গা ভাসিয়ে দিচ্ছে এই প্রতিকূল স্রোতে? নাকি শক্ত হাতে ভেসে থাকছে স্রোত শান্ত হওয়ার অপেক্ষায় ? কি ভেবে যেন দ্রুত গোসল শেষ করে ও।
গোসল শেষে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে দেখে মীরা। আলো ঝলমলে সকাল এখন, তবুও এ আলো দূর করতে পারছে না ওর মনের অন্ধকার। অনেকক্ষণ কাঁদে মীরা। মনে পরে রাজিবের সাথে ভালোবাসায় ডুব থাকা সেই সব দিন গুলোর কথা। যেই স্মৃতিই ছিলো স্বজনহারা এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অবলম্বন, আর রাজিবের ভালোবাসা ছিলো মীরার ভালো থাকার রসদ।
মনে মনে বলো- নিজেকে আরো শক্ত করতে হবে মীরা, ওকে বুঝতে দেয়া যাবে না তুমি সব জানো। তাহলে রাজিব তো গেছে বহু আগেই, বাকী সব যাবে তোমার। মেয়েকে নিয়ে দাঁড়াবার পথ থাকবে না। চোখের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে মীরা। এত ভাঙলে চলবে কেন ওর।
লম্বা করে শ্বাস নেয় ও, যেন প্রকৃতি থেকে
চার্জ শেষ হওয়া মনের ব্যাটারিতে কিছুটা চার্জ নিলো । তারপর ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেলে বারান্দার রেলিং এ পিঠ দিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় ও। নিশ্বাঃসের সাথে যেন বের করে দেয় ভেতরকার সকল কষ্ট, দুঃখ, যন্ত্রণা। এরপর মনের গভীরে রাজিবের প্রতি অবশিষ্ট ভালোবাসার উৎস্যমুখ বন্ধ করে দেয় ওরই করা অবহেলায় তৈরী দেয়াল দিয়ে। সেখান থেকে ফিরে রান্নাঘরে গিয়ে নাশতা তৈরী করে মীরা। রাজিবের পছন্দের বউয়া-ভাত আর নানান পদের ভর্তা। অনেক হ্যাপার কাজ এটা জানে মীরা, তবুও মাঝে মাঝে তৈরি করে ও। এর মধ্যে রয়েছে কাঁচা রসুন, পটলের খোসা, কুমড়োর বিঁচি, কালো জিরা, ইলিশ মাছের কানকো, আর চ্যাপা শুটকির ভর্তা। রাজিবের ঘুম ভাঙে চ্যাপা শুঁটকির গন্ধে। ঘুম থেকে উঠে ও সোজা চলে যায় রান্না ঘরে। গিয়ে দেখে মীরা চুলোয় শুটকি আর মরিচ, পেয়াজ দিয়ে ব্লেন্ডারে তৈরী করা পেস্ট চুলোয় ভাজছে। রাজিব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে –
: ” আহা..! সকাল সকাল এতো কষ্ট করতে গেলে কেন? এমনিতেই রাতে ভালো ঘুম হয় নি তোমার”
উত্তরে মীরা ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি হাসে।
: ” কাল রাতের জন্য সরি”
মুচকি হেসে মীরা বলে-
: ” ঠিক কোন কারনে?”
: ” মানে!”
: ” অনেক কারন জমা হয়ে আছে তোমার সরি হওয়ার জন্য, ঠিক কেন কারনে তুমি সরি, আমি বুঝতে পারছি না”
রাজিব নিশ্চুপ হয়ে যায় মীরার এ কথা শুনে। মীরা গম্ভীর এ পরিস্থিতি উৎরে দিতে হেসে ওকে বলে-
: ” কাল নুহাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিলো আমাদের, তোমার মনে ছিলো? কি এমন জরুরি কাজে ব্যাস্ত ছিলে তুমি যে আসতে পারলে না?”
: ” আসলে…”
: ” থাক, আসল নকল হিসেব পরে হবে, এখন যাও গোসল শেষ করে জলদি আসো” -বলেই রাজিবকে ঘুরিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে তাগাদা দেয় ও। রাজিব চলে যেতেই মীরা ভাবে আসলে যে কি তা জানি আমি রাজিব। তারপর নিজেকে স্বান্তনা দেয়- মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে শপিং-এ যাওয়া বেশী জরুরি যার কাছে, সেখানে আমি কি? আমার জায়গা কোথায়?
একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে খাবার গুলো টেবিলে জমা করে মীরা৷ সুন্দর করে সাজিয়ে বাথরুম থেকে ফিরলে নিজ হাতে বেড়ে খাওয়ায় রাজিবকে। মীরা বসে বসে ওর তৃপ্তি করে খাওয়াটা দেখে। খাওয়া শেষে রাজিব বলে-
: ” অনেক দিন পর পেট পুরে খেলাম, ভাল্লাগছে ভীষণ।
খাবারগুলো টেবিলে রেখেই রাজিবকে তৈরী হতে সাহায্য করতে গেলো মীরা। মীরা সব কাজ ফেলে রাজিবের লাগেজ গোছায়। আলমারি থেকে তোলা কাপড় বের করে দেয়। কেডস্, সানগ্লাস, ঘড়ি, সাজিয়ে রাখে। রাজিব বাথরুম থেকে বের হয়ে এসব দেখে বলে-
: “আরেহ্ এসব কি করছো?”
: ” শোন জীবণ ভরে তো হুড়োহুড়ি করে কাজই করলা, এবার দু-একটা দিন এদিক সেদিক ঘুরো”
: ” ঘোরাঘুরির সময় কই?”
মীরা কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে। রাজিব কেমন চুপসে যায় সে দৃষ্টির বিপরীতে। মীরা হেসে বলে- এদিকটা না হয় আমিই সামলাবো, তোমার কেন চিন্তা নেই” রাজিব বলে-
: ” আরেহ্ না, তার দরকার নাই, আমি ম্যানেজারকে সব বুঝিয়ে বলে দিয়েছি। তোমার পেরেশানির কেন দরকার নাই, দু’টো মাত্র দিন। তাছাড়া নূহাও অসুস্থ। তুমি ওকে সময় দাও”
হঠাৎ ফোন আসায় ফোনে ব্যাস্ত হয়ে পরে রাজিব। মীরা এ ফাঁকে কোন টিশার্ট, কেন প্যান্ট পরবে ও তা নিয়ে বেশ কিছু সময় এক্সপেরিমেন্ট চললো রাজিবের উপর, আসল ব্যাপার হচ্ছে কি কথা বলে তা শোনা। ওপাশ থেকে কি বলছে তা শোনা যাচ্ছে না, তবে রাজিব ক্রমাগত বলে যাচ্ছে- ” এই তো আর আধঘন্টার মতো লাগবে” কথাটা যতটা না ফোনের ওপাশের ব্যাক্তিকে শুনাচ্ছে রাজিব, তারচেয়ে বেশী মীরাকে।
অবশেষে রাজিব তৈরি হলো। মীরা নিজ হাতে তৈরী করে দিলো ওকে সতীনের সাথে প্রমোদ ভ্রমণে যেতে। সানগ্লাস ম্যাচিং করে দিলো, ঘড়িটা পরিয়ে দিলো।
বারবার ঘড়ি দেখার ব্যাপারটায় রাজিব যেন নিরবে মীরাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো দেরি হয়ে যাচ্ছে।অস্থিরতায় বোঝা যায় আজ ওর অনেক তাড়া।
মীরা তাই দেরি করালো না আর ওকে। মেয়েকে কোলে দিয়ে সুন্দর মতো বিদায় দিলো। যাওয়ার আগে রাজিব মীরাকে জড়িয়ে ধরে নূহার কপালে চুমো খায় একটা। মীরা মনে মনে ভাবে – ছল করা এত সহজ? আচ্ছা মীরার কি কান্না করা উচিত এ সময়ে?
: “সাবধানে থেকো” – রাজিবের এ কথায় ধ্যান ভঙ্গ হয় মীরার। অনেক দূর পর্যন্ত বিছিয়ে দেয়া আবেগের জাল গুটিয়ে মীরা সরে গেলো ওর সামনে থেকে। পানির বোতল এগিয়ে দিলো ওর হাতে। তারপর ওর বের হওয়ার আগে বললো-
: ” তুমিও সাবধানে থেকো, পৌঁছে কল দিও”
: ” তুমি কোন চিন্তা করবে না, আমি পৌঁছে জানাবে”
দরজা আটকে মীরা ডাইনিং টেবিলের সামনে যায়। নূহাকে মাজেদা খালার কোলে দিয়ে কি ভেবে যেন ঘুরে দাঁড়ায় দেয়ালের দিকে। হঠাৎ কি মনে করে নির্মম ভাবে দেয়ালের সাথে নিজের মাথা ঠুকে ও। একবার, দুবার, পরপর তিন বার। হঠাৎ করে মীরার এমন আচরণে ভরকে যায় মাজেদা খালা, নূহাকে সোফায় বসিয়ে যতক্ষণে যায় সে মীরার কাছে ততক্ষণে মীরার কপাল বেয়ে গাঢ় রক্ত পরছে চুইয়ে চুইয়ে । মাজেদা খালা মীরাকে জোরে ধাক্কা দিয়ে বলে-
: ” পাগল হইছেন আপনে খালা?”
মীরা দু হাতে মুখ চেপে কান্না করতে থাকে। রাগান্বিত কন্ঠে মাজেদা খালা বলেন-
: ” শয়তান মাথারী, জামাইরে সাইজাইয়া গুছাইয়া পাঠায়া এহন ঢং করে ”
দৌড়ে গিয়ে ফাস্টএইড বক্স এনে ক্ষত জায়গায় তুলা চেপে ধরেন তিনি। মীরা উদ্ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে থাকে তার দিকে। ও যেন কান্না ভুলে গেছে এখন। যে যন্ত্রণার ও বুকে বয়ে চলেছে গত কয়েকটা দিন ধরে তার চেয়ে মাথার এ ক্ষত যে কত তুচ্ছ তা কিভাবে বোঝাবে মীরা মাজেদা খালাকে?
কিছুতেই রক্ত বন্ধ না হওয়ায় মাজেদা খালা নূহাকে টুম্পার কাছে দিয়ে মীরাকে হসপিটালে নিয়ে যায়। দীর্ঘ দিন গ্রামে থেকে গতকাল রাতে ঢাকায় ফিরেছে টুম্পা। ও এসবের কিছুই জানে না এখনও। তাই ঘটনাটা হজম করতে কষ্ট হয় ওর। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে না ও এসবের ।
হাসপিটালে পৌঁছে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে যখন মীরার মাথার চুলগুলো কেটে ক্ষত স্থানে সেলাই করছিলো ডাক্তার, রাজিব তখন সাথীর হাত ধরে সদ্য উড়া বিমান থেকে ঢাকা শহর দেখাচ্ছিলো সাথীকে। অসীম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন চোখ জোড়া এত উঁচু থেকে জায়গার বিবরণ দিতে পারা সত্ত্বেও মীরার বেলায় খুব কাছে থেকে ওর এই একই চোখ জোড়া যেন ক্ষীণদৃষ্টি সম্পন্ন হয়ে যায়। এই যে অনিহা, অবহেলা, উপেক্ষা এগুলোর হিসাব মিলাতে পারবে কি রাজিব?
চলবে…