প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ২৩
তিন দিন ঘোরাফেরা শেষে সিলেট থেকে ভালোয় ভালোয় ঢাকায় ফিরে ওরা। সকালে দুই ঘন্টা ঘুমিয়ে নিয়েই রাজিব চলে যায় কারখানায়। তিনদিনের অবকাশের পর ব্যাস্ত হয়ে পরে কারখানার কাজে আর মীরা ঘরের কাজে। ঘরদোরের ধুলো ঝারা, ময়লা কাপড় ধোয়র জন্য বুয়াকে বুঝিয়ে দেয়া।
এক জায়গায় থেকে ঘুরে ফিরলে সপ্তাহ লেগে যায় জমে যাওয়া কাজ শেষ করতে।
তার মধ্যে ওরা ঢাকায় ফেরার পরদিনই বড় মামার মেয়ে লাবনী তার ছোট ছেলেকে নিয়ে এসে হাজির। তিনি এসেছেন ছোট ভাই আসদের বিয়ের কেনাকাটা করতে। তারা বিশাল লিস্ট করে নিয়ে এসেছেন। মীরাকে লাবনী বলে-
: ” ঢাকায় আইছি তোগরে নিয়া যাইতে, হের লগে
ছোডর বিয়ার শপিং ও কইরা নিয়া যামু”
: ” ঠিকাছে আপা, আগামীকাল সকালে কাজকর্ম শেষ করে নিয়ে যাবো নি আপনাকে”
: ” হুন মীরা, অনেক বড় ঘরের মাইয়্যা আনতাছি, বুঝলি? এমন কেনাকাটা কইরা দিবি জানি বেগ্গলের চোখ কপালে উডে। ট্যাকা পয়সা কোন সমস্যা না”
: ” ঠিক আছে আপা, আপনি এখন ফ্রেশ হয়ে আসেন টেবিলে খাবার দিয়েছি”
তারা সকাল সকাল আসায় রাজিব বাইরে থেকে নাশতা কিনে দিয়ে গেছে তাদের জন্য। নশতা খেয়ে মীরা রান্নাঘরে গেলো তাদের জন্য খাবারের আয়োজন করতে। রান্নার ফাহিমা খালা গেছেন বাড়িতে। তিনি আসবেন আগামী পরশুদিন।
সেদিন রান্না আর গল্পে কটলো ওদের পুরোটা দিন। সাথে করে আনা হাঁস, কেটে বেছে রান্না করে দিলেন তিনি। মীরা হাঁস বাছতে পারে না তাই। ব্লেন্ডারে চাল গুড়ো করে সিদ্ধ করে রুটি বানালেন। মীরার ছোট্ট মেয়ে, তাই ওর হেসেলের পুরো দায়িত্ব নিলো লাবনী। একেক রকমের দেশি রান্না করে করে শিখাচ্ছেন তিনি। রতার হাবভাবে একবারও মনে হয় না তিনি এবারই প্রথম এসেছেন এ বাড়িতে। মনে হচ্ছে তিনি মীরার আপন ননাশ, যে প্রায়ই বেড়াতে আসেন এ বাড়িতে।
রাতের বেলা সবাই মিলে চালের রুটি আর হাঁসের গোশত দিয়ে রাতের খাবার সেরে নিলো। কে বলবে সে আগের রাত জার্নি করে এসেছেন? প্রাণশক্তিতে ভরপুর এই মানুষটার মনে অনেক কষ্ট। হাসতে হাসতে এমন কথা বললেন যে মীরার হৃদয় এফোড় ওফোড় হয়ে গিয়েছিলো দুঃখের ভারে। অথচ তার বলার ভঙ্গিতে মনে হয় কি মজার কথা বললেন তিনি। অনেক কথা হয় দু’জনে। গ্রামের কথা, সংসারের কথা, ছেলে মেয়ে আর স্বামীর বহুগামিতার কথা। তিনি এমন অকপটে সব বললেন যেন বড় বোন তার দুঃখের কথা বলছে ছোট বোনের কাছে। মীরাও ধৈর্যশীল শ্রোতার মতো শুনলো সব। এত সুন্দর তিনি তবুও বেঁধে রাখতে পারেন নি স্বামীকে৷ মজার জিনিস দেখানোর কথা বলে তিনি তার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রীর ছবি দেখালেন। কোন দিক দিয়েই তার সাথে ঐ মেয়ের তুলনা হয় না। না রূপে, না গুণে না পারিবারিক অবস্থানে। মানুষের মন কত বিচিত্র। এত সুন্দর স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও লোকটা বিয়ে করেছে তার চেয়ে দেখতে অসুন্দর, অশিক্ষিত এক মেয়েকে। তবুও হাসছেন তিনি, বাঁচেন নিজের মতো করে। স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকে স্বামীর সাথে কোন সম্পর্ক নেই তার। না তিনি তার সংসার ছেড়ে আসেন নি, তার সংসারেই রয়ে গেছেন, তার ছেলেমেয়ে মানুষ করছেন জমিজিরাত সব দেখাশোনা করছেন, শুধু মনের যে সম্পর্ক দিয়ে ঐ সংসারে বসবাস শুরু হয়েছিল তাদের তা শেষ হয়ে গেছে। ক্ষমা চেয়েছিলেন তার স্বামী, ক্ষমা করেও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিছানা ভাগ করে নিতে পারেন নি আর। কত শক্ত মানসিকতার মানুষ হলে এমনটা সম্ভব? সমাজে এখনো রাতের বেলা স্বামীর আহ্বানে না বলতে পারাটা শক্ত করে প্রচলিত হয় নি, সেখানে তিনি নিজেকে ঘিরে রেখেছেন অদৃশ্য দেওয়াল দিয়ে। কত কষ্ট, অভিমান আর দৃঢ়তা মনে থাকলে এমনটা সম্ভব তা তার দিকে তাকিয়ে ভাবে মীরা।
মীরা প্রথমে অসময়ে আগমনে বিরক্ত হলেও তার মন মানসিকতাকে ভালোবেসে ফেলে৷ হাসিমুখে দুই দিন লাগিয়ে সমস্ত কেনাকাটা করে দেয়। সাথে বৌভাতে পরার জন্য ওর এনে রাখা লেহেঙ্গাটাও দিয়ে দেয় উপহার হিসেবে। বয়সের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও লাবনী খুবই মিশুক একজন মানুষ হওয়ায় মীরার ভীষণ ভালো লাগে তাকে। যাওয়ার দিন তো মীরাকে নিয়েই যাবে সাথে করে। মীরার না যাওয়ার এই সেই কত বাহানা। তবে শেষ পর্যন্ত তাকে কথা দিতে বাধ্য হয় মীরা, যে ওরা অবশ্যই আসাদের বিয়েতে যাবে।
তারা চলে যাবার পর নূহা অসুস্থ হয়ে যায়। রাজিব বলে দেখো ওর শরীর যদি ঠিক না হয় তাহলে তো যাওয়া সম্ভব না। কিন্তু নূহার শরীর পরদিনই ভালো হয়ে গেলো। রাজিব পরদিন সকালে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলে-
: ” এই দাওয়াতে যাবো না বলে সিলেট ঘুরে এলাম, অসুস্থ মেয়েও সুস্থ হয়ে গেলো, না যেয়ে আর উপায় রইলো না, কি আর করা, ব্যগপত্র গোছগাছ করে নাও”
মীরার মনে একটু সংকোচ, খুতখুত ভাব। গ্রামের মানুষের কথাবার্তা কেমন যেন। তারা হাসতে হাসতে এমন কথা বলে। হঠাৎই মনে হলো মীরার সেই দূর সম্পর্কের খালা শ্বাশুড়ির কথা। রাতে মীরা রাজিবকে বলে-
: ” গ্রামে যেতে সংকোচ একটাই বুঝলা, হুট করে কেও ঐ সম্পর্কে… ”
: ” কথাটা শেষ করতে দেয় না রাজিব, দীর্ঘ চুমো এঁকে দেয় মীরার ঠোঁটে”
ব্যাপারটায় বিরক্ত হয় মীরা, ওকে ধাক্কা দিয়ে পাশে ফেলে দিয়ে বলে-
: ” সব সময় এমন ভাল্লাগে না রাজিব, আমি সিরিয়াস একটা কথা বলছি”
: ” আমিও কি কম সিরিয়াস? নূূহার ঘুমানোর অপেক্ষা করছি সেই কখন থেকে। এখন তো তুমি আমার থেকে নূহারই বেশী”
: ” আমি কি বলেছি তুমি বুঝেছো? ”
: ” কে কি বললো দেখার টাইম নাই আমার, আমার বৌয়ের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব আমার, দুটো বেজে গেছে আর দেরি করায়ো না, আসো তো”
: ” আজকে আমার ভালো লাগছে না রাজিব, আমি অনেক ক্লান্ত ”
: ” তোমার ক্লান্তি দূর করে দিচ্ছি সোনা”
: ” উফ্ রাজিব, সরো তুমি! ”
: ” এতক্ষণ অপেক্ষায় রেখে এসব বাহানা চলবে না আমার জান” বলেই রাজিব ডুব দেয় মীরাতে। মীরার যেন রাজিবের সাথে তাল মেলানো ছাড়া আর কিছুই করার রইলো না।
অনেক দিন আগে এক রাতে মীরা ফিরিয়ে দিয়েছিলে অর্ধ মাতাল রাজিবকে। সে রাতে রাজিব টুম্পার দুয়ারে কড়া নেড়েছিলো নোংরা মন নিয়ে৷ এরপর বহদিন দূরে ছিলো দুজনে৷ তারপর যখন আবার এক হলো দুজনে তখন থেকে আর কখনোই রাজিবকে ফিরায় না মীরা। যত খারাপ লাগা, অস্বস্তি আর ক্লান্তি থাকুক না কেন কখনো না বলে নি ও । আজ অজপাড়াগাঁয়ের লাবনী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে মীরাকে ওর মন কতো নড়বড়ে।
রাজিব সব সময়ই বিছানায় একটু বেশীই এগ্রেসিভ। মীরা একটা সময় এটাকে ওর ভালোবাসা প্রকাশের ধরন হিসেবে দেখতো। কিন্তু টুম্পার ঘটনার পর মীরা টের পেতে শুরু করলো রাজিবের এই বেপরোয়া ব্যাপারটা ভালোবাসা না। শরীরের ডাকে ওর বিপরীত কাওকে দরকার, সেটা হোক মীরা কি টুম্পা কিংবা রাস্তার কেন মেয়ে, তাতে কিছু যায় আসে না।
লাবনী আপুর সাথে বিয়ের মার্কেট করতে যাার সময় একটা পাগল মেয়েকে দেখেছিলো মীরা নীলক্ষেতের পেট্রোল পাম্পের সামনে বসে থাকতে। মেয়ে না ঠিক তার বয়স ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশের ঘরে হবে। তার জামা ভেদ করে পেটটা যেন বেড়িয়ে আসতে চাচ্ছে। জানান দিচ্ছে শরীরের অস্বাভাবিকতার খরব। জ্যাম থাকায় মীরা লক্ষ্য করে ছিলো তাকে। তার গায়ের জামাটা আঁটসাঁটে, অনেক দিন গোসল না করার কারনে শরীরে ময়লা, চুল আর হাত-পায়ে ময়লার আস্তরণ, মুখ দিয়ে ও লালা পরে। অথচ পেটটা ফোলা৷ মেয়ে হওয়ার সুবাদে ও জানে বুকের কাছ থেকে পেট এমন গোলাকারে ফুলে উঠে কোন কারনে, মহিলাটি অন্তঃসত্তা। এর পেছনের কারন ভাবতে গিয়ে মীরার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। নিশ্চয়ই তাকে রাতের আঁধারে কামুক কোন জানোয়ার…. আর ভাবতে পারে না ও।
কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে এর সাথে মিলন অসম্ভব। এরা এমন শ্রেণির লোক, যাদের কা*ম কমাতে একটা শরীর চাই শুধু। ভালোবাসা বলে তাদের কিচ্ছু নেই। মীরা মনে মনে ভাবে প্রযুক্তি কত উন্নত হচ্ছে দিন দিন, এমন কোন যন্ত্র কি আবিষ্কার হবে কোনদিন যাতে এমন পাগলদের গর্ভের সন্তানের বাবাকে পরিচয় সহ খুঁজে পাওয়া যাবে?
চলবে…
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ২৪
অবশেষে বরিশাল যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো। মীরা, রাজিব, নূহা গেলো টুম্পা গেলো ওদের গ্রামের বাড়িতে। ওদের সাথে বরিশাল যাওয়ার জন্য পিড়াপিড়ি করলেও টুম্পা কি মনে করে যেতে চাইলো না। একই সাথে রওনা দিলো দুজন দুই প্রান্তে। ওরা চললো দক্ষিণের বরিশাল আর টুম্পা উত্তরের গাইবান্ধায়।
লঞ্চ টার্মিনালে এসে এত এত লঞ্চের ভিড়ে রাজিব চেষ্টা করলো ভালো একটা লঞ্চের কেবিন ভাড়া করতে। মীরা এর আগে কখনো লঞ্চে ভ্রমণ করে নি। তাই ওর প্রথম লঞ্চ ভ্রমণের সুন্দর স্মৃতি উপহার দিতে রাজিবের এই বাড়তি চেষ্টা। অবশেষে ওর উঠলো পারাবাত-১৮ নামের লঞ্চে। ভাগ্য ভালো যে ওরা অনায়াসেই বিজনেস ক্লাসের একটা কেবিন পেয়ে যায়। সপ্তাহান্তে এই লঞ্চের কেবিন পাওয়া টাফ। সেদিকে ওরা ভাগ্যবান। মীরা কেবিনে ঢুকেই কাঁধের ব্যাগটা রেখে পুরো কেবিনটা ঘুরে দেখলো। পুরো কেবিনে ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন চোখে পরার মতো। এমনকি বাথরুমেও সিলিং এ লাইট দিয়ে ডেকোরেশন করা৷ এ ব্যাপারটা আধিক্য মনে হয়েছে ওর কাছে। এমনি তে কিং সাইজ খাট, ওয়াল মিরর, সোফা, সবকিছুই ছিলো গুছানো। রুমে ঢুকে নূহাকে রাতের খাবার খাওয়ায় মীরা। একটু পরেই ঘুমিয়ে পরে ও। তারাহুরোয় কিছু খেয়ে আসতে পারে নি ওরা। তাই রাজিব বাইরে থেকে হালকা কিছু খাবার নিয়ে নিয়েছিলো সাথে। সেটাই ওরা দুজন মিলো খায়। “সাড়ে আটটায় লঞ্চ ছাড়ার কথা থাকলেও নয়টা বাজে এখনো লঞ্চ ছাড়ার কোন নাম গন্ধ নাই” – বার্গার খেতে খেতে কথাটা বললো মীরা।
খানিক বাদে লঞ্চটা শব্দ করে উঠলো, মীরা টের পেলো লঞ্চটা চলতে শুরু করেছে। ঘড়িতে সময় তখন নয়টা দশ। লঞ্চ ছাড়ার পর কেমন যেন রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয় মীরার। বাইরে দেখার জন্য সামনের দেয়ালের পর্দা সরাতেই মীরা দেখে রুমের সাথে এটাচ একটা বারান্দা। খুশিতে একটা লাফ দিলো যেন ও। গ্লাস খুলে বারান্দায় ঢুকে দেখলো সেটাকে। ছোট্ট একটা বারান্দা, একটা বেসিনও দেয়া আছে পাশে একটা চেয়ার রাখা। এটা যেন ওর বাড়তি পাওয়া, রুমে ঢুকে আধশোয়া রাজিবকে টেনে নিয়ে যায় সেখানে। রাজিব ওর খুশি দেখে নিজেও খুশি। সেখানে রাখা চেয়ারে বসে নদী দেখছে মীরা, মনের উচ্ছাস প্রকাশ পাচ্ছে ওর কথায়।
রাজিব ওর পেছনে দাঁড়ায়, দেখে মনে হচ্ছে মনযোগ দিয়ে শুনছে ও মীরার কথা কিন্তু হাত নেড়ে নেড়ে বলা মীরার কথার কিছুই যাচ্ছে না ওর কানে, ও দেখছে আনন্দিত মীরাকে। আলোআঁধারির এ রহস্যময় জায়টায় দাঁড়িয়ে অবাক চোখে দেখছে ওর প্রিয়তমাকে। সাথে ভাবছে – “এত অল্পতেই খুশি হয় মীরা” ব্যাপারটা মন ভালো করে দেয় ওর।
মৃদুমন্দ বাতাসে মীরার খোলা চুলগুলোও খুশিতে নাচছে যেন ওরই মতো । সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাজিব হঠাৎ ওর কাঁধে হাত রাখে। লম্বু রাজিবকে দেখতে মাথাটা উচুতে তুলে ও, কি ভেবে যেন ওর দিকে হেসে বলে-
: “থ্যাংকস্ ফর এভরিথিং মাই ডিয়ার”
রাজিব মীরাকে চেয়ার থেকে নামিয়ে দাঁড় করায়, হঠাৎ কি হলো বুঝে উঠে না মীরা। তারপর দেখে ওকে দাঁড় করিয়ে নিজে চেয়ারটাতে বসেছে রাজিব, তারপর ছোট্ট বাচ্চার মতো ওর কোলে টেনে নেয় মীরাকে। মাথার অবাধ্য চুলকে বশে আনতে হাত বুলিয়ে গুছানোর চেষ্টা করে রাজিব। কিন্তু মীরার লম্বা, ঝরঝরে চুল গুলো বশ মানে না রাজিবের। হেরে যাওয়ার ভঙ্গিতে ওর অবাধ্য চুলে ডুব দেয় রাজিব। কানের কাছটাতে আলতো করে কামড় দেয়। হঠাৎ এমন আচরণে কেমন যেন কেঁপে উঠে মীরা। এ ছেলেটা এমনি, কখন কি করে বসে বোঝা মুশকিল। মীরা ঘুরে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাজিবকে, গুটিশুটি মেরে লুকিয়ে পরে রাজিবের প্রশস্ত বুকে। এ যেন বাঁচার জন্য লুকানো।
এমনি করে ওরা বসে ছিলো অনেকক্ষণ। ধীরে ধীরে লঞ্চটি লোকালয় ছেড়ে অন্ধকারের ডুবে থাকা কোন এক অঞ্চলে প্রবেশ করলো। ছোট ছোট আলোক বিন্দু ভেসে আছে নদীর যত্রতত্র । আলোক বিন্দু গুলো কি জানতে চাইলে রাজিব বলে এগুলো মাছ ধরার নৌকা। অন্ধকার, খোলা বারান্দা, পানিতে গলে যাওয়া চাঁদ আর নদীর মিতালী দেখছে দুজনে।
মীরা কোল থেকে নিচে নেমে বাইরের দিকে উকি দিলেই দেখে জোছনা রাতের চকচকে চাঁদ ও যাচ্ছে ওদের সাথে সাথে। অপার্থিব দৃশ্য একেই বলে হয়তো। ঐদিনের চাঁদটা কেমন অন্য রকম লাগে ওর। এটা চোখের ভ্রান্তি নাকি সত্যি সেদিকে মাথা ঘামায় না ও। জীবনে প্রথম বারের মতো দেখে চাঁদের অপরূপ সৌন্দর্য্য। চাঁদ নিয়ে কোন গান বা কবিতাকে বারাবাড়ি ভাবতো ও এতদিন। আজ নিজে ভুল প্রমাণিত হয়ে কেমন আনন্দ লাগছে। এ আনন্দ প্রকৃতিতে নিজেকে আত্নসমর্পণ করার আনন্দ।
নদীতে ছোট-বড় নৌকা দেখা যাচ্ছে। বালু বোঝাই স্টিমারও দেখা যাচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ। রাত একটার দিকে রাজিব মীরাকে বলে চলো লঞ্চের ইলিশ ভাজা দিয়ে ভাত খেয়ে আসি। মীরা নূহার কথা ভেবে যেতে চায় না। পরে ঘুমন্ত নূহাকে ক্যারিয়ার ব্যাগে রাজিব ওর কোলে নেয়। তারপর রুম লক করে যায় খাবারের দোকানের দিকে। সেখান থেকে আলু ভার্তা, ইলিশ মাছ ভাজা আর ঘন ডাল দিয়ে পেট পুরে ভাত খায় ওরা। খাওয়া শেষে লঞ্চের ছাঁদে উঠে দুজনে । ছাদে উঠে মীরার বিষ্ময়ের শেষ নেই। দুই দিকে কেবল অথৈ পানি। কোন দিকে কোন কিনারা চোখে পরলো না ওদের। পরে ওরা জানতে পারে লঞ্চ এখন দেশের গভীর ও প্রশস্ততম নদী মেঘনার বুক চিড়ে এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যের দিকে।
বেশ কিছু সময় থাকার পর ওরা রুমে চলে আসে নূহারে জেগে যাওয়ার দরুন । রুমে এসে মীরা ব্যাস্ত হয়ে পরে নূহাকে নিয়ে। আর রাজিব বারান্দায় গিয়ে সিগারেট টানতে থাকে। নূহা ঘুমিয়ে পরলে মীরা রাজিবের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, মীরার উপস্থিতি টের পেয়ে সিগারেট টা ফেলে দিয়ে
কোলে তুলে নেয় ওকে। তারপর রুমে এনে খাটে শুইয়ে দেয়। আধশোয়া মীরা রহস্যময় হাসি হেসে বলে-
: ” তুমি কি ভালো হবা না”
রাজিব ওর কাছে এসে ফিসফিস করে বলে-
: ” নাহ্”
রাতটা কাটলো দুজনের ভালোবাসায় ডুবে, আর গল্প করে। হাসি, মজায় কাটলো প্রথম লঞ্চ ভ্রমণের স্মরণীয় রাতটি। শেষ রাতে ঘুমিয়ে পরলো দুজন। ভোর ছ’টায় লঞ্চ পৌঁছালো তার গন্তব্য। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে নেমে পরে ওরা। বাস যোগে পৌঁছে গেলো রাজিবের মামা বাড়ি। ওদেরকে দেখে সবাই ভীষণ খুশি হয়। রাজিবের মামীরা এলো রাজিবের বৌকে দেখতে। মীরাকে দেখে সবাই অবাক। এত সুন্দর বউ রাজিবের। এদের এত অবাক হওয়ার কারণ বোঝে না মীরা। তারা নিজেরাও অনেক সুন্দর। ধান, নদী, আর খালোর জন্য বিখ্যাত বরিশালের মেয়েগুলো ও অসম্ভব সুন্দর হয়। তা আগেই জানতো মীরা। তারপরও ওকে দেখে তাদের অবাক হওয়াটা মানতে পারে না ও।
সকালের নাশতা শেষে বিয়ের আয়োজন দেখতে যায় ওরা। ননদদের সাথে হলুদের ডালা নিয়ে যায় বৌদের বাড়ি। রাজিব এখানে এসে যেন বহু ব্যাস্ত হয়ে পরেছে। বন্ধু, ভাইব্রাদার নিয়ে মশগুল ও। মীরা অবশ্য ব্যাপারটাকে সহজ ভাবেই নেয়। ও যখন ওর বন্ধুদের সাথে থাকে তখন ফোন দিয়ে বিরক্ত করে না ও। বিয়ে হয়েছে বলে কি পার্সোনাল স্পেস ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেছে? তবে রাজিবের ব্যাপারটা উল্টো, কই যাও? কেন যাও? যেতেই হবে নাকি? না গেলে হবে না? ইত্যাদি প্রশ্নে জর্জরিত করে ও মীরাকে৷ তবুও মীরা ওর বেলায় এমনটা করে না। যাতে ও বুঝে যে মীরা ওকে ওর স্পেস দেয়, ও যেটা দেয় না মীরাকে। কিন্তু রাজিব এটাকে পুরুষ হিসেবে ওর পাওনা মনে করে। ব্যাপারটা অনেক পরে বুঝেছে ও।
গ্রামের বিয়ে মানেই অনেক আনন্দ আর মজা। বিয়ের রীতিনীতি, রঙ দিয়ে খেলা, সব কিছু অন্য রকম লাগে মীরার। এদের আন্তরিকতা ও মুগ্ধ করে মীরাকে। সবাই ভীষণ ভালো মনের মানুষ। এত সরল যে অবাক হয় মীরা এি ভেবে যে এ যুগেও এমন মানুষ আছে। এই সরলতাটাই এদের অসাধারণত্ব। এদিকে এখানে আসার পর নূহার সব দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে আসাদের ছোট বোন সুরভী। ওকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, গোসল করানো সব ওই করে । এ বাড়িতে ছোট কোন বাচ্চা না থাকায় ওরা সবাই নূহাকে যেন লুফে নেয়। রিতীমত কাড়াকাড়ি অবস্থা। মীরা তাই মন মতো উপভোগ করতে পারছে আনন্দ অনুষ্ঠান।
সন্ধ্যা হতেই ননদদের লাইন লেগে যায় মীরার কাছে সাজবে বলে। মীরা ধৈর্যের সঙ্গে সবাইকে পরিপাটি করে দেয়। শেষে নিজেই ঠিকঠাক তৈরি হতে পারে না। ঐদিকে অনুষ্ঠান শুরু করতে ওর জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। মন মতো সাজতে না পেরেও মন খারাপ করে না ও। এতগুলো মানুষ খুশি, এই কি কম পাওয়া? শেষে হলুদের জন্য নির্ধারণ করা শাড়ি পরে চুলটাকে কোনমতে খোপা করে ও। ঝটপট হালকা একটা সাজ সাজে ও। মুখে ফেস পাউডার বুলিয়ে ভ্রু একে, চোখে কাজল, আর ঠোঁটে গাঢ় রঙের লিপস্টিক দিয়ে চলে যায় হলুদের স্টেজে।
হালকা একটা সাজ দিয়েছে ও, তবুও মীরার সৌন্দর্য চোখে পরার মতো। এক ননদ ওকে দেখে বলে- ” ভাবী তুমি তেমন সাজো নি, তাতেই এ অবস্থা, আর সাজলে কি অবস্থা হইতো?”
বাকীরা সবাই হেসে যোগ দিলো ওর সাথে। অবশেষে মীরা যাওয়া পর অনুষ্ঠান শুরু হয়। একটু পরে
সেখান থেকে সরে গিয়ে মীরা ভিড়ের মধ্যে রাজিবকে খোঁজে। কোথাও নেই ও, তাই একটা কল করে ওকে। ফোনটা কেটে দিচ্ছে ও। মীরা ভাবে এখানেই আসছে তাই হয়তো ফোন কেটে দিচ্ছে রাজিব। এটা ভাবতেই হঠাৎ পুরো উঠোন অন্ধকার হয়ে যায়। জেনেরেটরের কোন সমস্যা হয়েছে হয়তো ভাবতেই কে যেন মীরার মুখ চেপে ধরে ওকে একপাশে সরিয়ে নেয়। ভয়ে জমে যায় মীরা। এ আবার কোন বিপ! চেষ্টা করে মুখে রাখা হাত টেনে সরাতে, কিন্তু পারে না। মাথায় কেবল একটাই প্রশ্ন দপদপ করছে ওর –
কে টেনে নিচ্ছে ওকে?
কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
চলবে….
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ২৫
অবশেষে মীরা যাওয়া পর অনুষ্ঠান শুরু হয়। একটু পরে সেখান থেকে সরে গিয়ে মীরা ভিড়ের মধ্যে রাজিবকে খোঁজে। কোথাও নেই ও, তাই একটা কল করে ওকে। ফোনটা কেটে দিচ্ছে ও। মীরা ভাবে এখানেই আসছে তাই হয়তো ফোন কেটে দিচ্ছে রাজিব। এটা ভাবতেই হঠাৎ পুরো উঠোন অন্ধকার হয়ে যায়। জেনেরেটরের কোন সমস্যা হয়েছে হয়তো ভাবতেই কে যেন মীরার মুখ চেপে ধরে ওকে একপাশে সরিয়ে নেয়। ভয়ে জমে যায় মীরা। এ আবার কোন বিপ! চেষ্টা করে মুখে রাখা হাত টেনে সরাতে, কিন্তু পারে না। মাথায় কেবল একটাই প্রশ্ন দপদপ করছে ওর –
কে টেনে নিচ্ছে ওকে?
কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
খুব দ্রুত ঐ ভয়ংকর সময়ের সমাপ্তি হলো। মীরার মুখ থেকে হাত সরিয়ে পাশে দাঁড়ালো লোকটা। বাচ্চাদের চুপ করানোর মতো মুখে তর্জনী ধরে স্ স্ স্ শব্দ করলো, যার মানে চুপ থাকার নির্দেশ। তারপর মুখ থেকে তর্জনী নামিয়ে সামনে ঐ হাত দিয়েই একটা ঝোপের দিকে দেখিয়ে দিলে। মীরা তখন অন্ধকারের ঐ মূর্তি দেখায় ব্যাস্ত, মস্তিষ্ক হিসাবনিকাশ করছে তাকে চিনতে পারার জটিল অংক। জমাট বাঁধা অন্ধকারে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না শুধু তার দৈহিক অবয়ব ছাড়া। তারপর একটা কন্ঠে ভেসে এলো-
: “মোরে কি দেহ, যেইয়্যা দেহাইতে আনছি হেইয়া দেহ, মোরে পরেও দেখতে পারবা”
দৈহিক গঠন আর কন্ঠ পুরোপুরি বিপরীত। শারীরিক সামর্থ্য আর দৈহিক গঠণ পুরোদস্তুর পুরুষের মতো, কিন্তু কন্ঠ মেয়েলি। বলিষ্ঠ হাত আর ওকে পুরো তুলে নিয়ে এতদূর পর্যন্ত তুলে নিয়ে আসায় মীরা একবারও ভাবে নি যে তাকে তুলে এতদূর বয়ে আনা মানুষটা কোন পুরুষ না। তার দেখিয়ে দেয়া নির্দেশ অনুসরণ না করায় ধমকানোর সুরে ফিসফাস করে বললো-
: ” আহ্ ভাবী তুমি এত বোকা ক্যা এ্যা, মোরে দেখার কিচ্ছু নাই, যেইয়্যা দেহাইতে আনছি হেইয়া দেহ”
এবার মীরা নিশ্চিত হলো ওকে বয়ে আনা মানুষটা একটা মেয়ে। মেঝো মামার ছোট মেয়ে পলি। ভাবী ডাকায় ও নিশ্চিত হলো এ ব্যাপারে। অনূর্ধ্ব উনিশ ফুটবল দলের খেলোয়ার সে। তাই শারীরিক সামর্থ্য আর বলিষ্ঠতা একটা গড়পড়তা মেয়ের চেয়ে উন্নত।
এরপর দ্রুত মুখ ফিরিয়ে চোখ নিবন্ধ করলো ওর দেখিয়ে দেয়া স্থানে। কেও একজন গাছের নিচে এক পায়ে ভর করে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো। একটা মেয়ে দাঁড়ানো পাশে, পাশে দাঁড়ানো ব্যাক্তি যে একটা মেয়ের তা শাড়ির অবয়বে বোঝা যাচ্ছে। চাঁদনী রাত হওয়ায় তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মেয়েটার হাত ধরে আছে গাছে হেলান দেয়া ব্যাক্তি। মেয়েটাকে দেখা গেলেও ছেলেটা কে তা বোঝা যাচ্ছে না। কারন ছেলেটা মীরা দের দিক থেকে একটু বেঁকে দাঁড়ান, তাছাড়া এখানে কেও আসতে পারে, ওদের দেখতে পারে তা হয়তো ক্ষুণাক্ষরেও টের পায় নি ওরা।
মীরা অবাক কন্ঠ পলিকে জিজ্ঞেস করলো –
: ” এরা কারা পলি?”
: ” দেহ দি চিনো কি না?”
: ” অন্ধকারে তো তোমাকেই চিনি নি, তুমি চিনছো এদের?”
: ” যার লগে এত বছর ঘর করলা তারে চিনলা না?”
মীরা যেন কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। বেশ কিছু সময় মৌণ থাকে মীরা। ঘটনার আকস্মিকতা হজম করতে বেগ পেতে হচ্ছে হয়তো ওকে। বেশ কিছু সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে দু’জন। ঝিঁঝি পোকার ডাক, আর বাতাসে ডালপালা নড়ার শব্দ নিরবতাকে আরো গাঢ় করে তুলে। মৌণ হয়ে মীরা জিজ্ঞেস করে –
: ” রাজিবের সাথে মেয়েটা কে?”
কন্ঠে কোন বিস্ময় ছিলো না মীরার। এসব অনেক দেখেছে ও এমন একটা ব্যাপার ছিলো ওর কন্ঠে। পলি মীরার দৃঢ়তা দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। এরচেয়ে বেশী কিছু ঘটবে বলে ভেবেছিলো ও হয়তো। পলি বললো
: ” ছোড কাকার লাউঙ্গা মাইয়্যা সাথী, হেয় তো তোমার শ্বশুড়বাড়ি থাইক্যা পড়ালেহা করতো, আমরা তো জানি ওরেই বিয়া করবো রাজিব ভাইয়ে, এতদিন পর পুরাতন প্রেমিক দেইখ্যা প্রেম উতলায়া উঠছে, বে*শ্যা মাগী একটা”
: ” চলো পলি”
: ” ওগো হাতে নাতে ধরবা না”
: ” পলি আমি এতদিন ধরে ভাঙা ডিমে তা দিয়ে আসছিলাম, তবে মজার ব্যাপার কি জানো? আমি জানতাম কি করছি আমি, সবকিছু জেনেও না জানার, দেখেও না দেখার ভান করতে করতে আমি এখন অভ্যস্ত”
: ” ভাবি কি কও এগুলা, তোমার কথার আগামাথা কিছুই তো বুঝলাম না”
মীরা পলির থুতনি ধরে বলে-
: ” বুঝতে হবে না, এসব নিয়ে এখন হুলস্থুল করলে বিয়ে বাড়িতে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। অনুষ্ঠান গুলো শেষ হোক ভালোয় ভালোয়। তারপর এ ব্যাপারে…”
: ” তুমি ভাবী খুব শক্ত মাইয়্যা, মুই হইলে দাও দিয়া এট্টা কোঁপ দিতাম, পরে যা হইতো দেইখ্যা নিতাম”
মীরা আর পলি সন্তর্পণে চলে আসে বাড়ির পেছনের এই জংলা মতো জায়গাটা হতে। সেখান থেকে বের হতে হতে কল করে মীরা রাজিবকে। তখনো ফোনটা কেটে দিচ্ছে রাজিব। মীরা তারপর বাড়িতে ঢুকে পলির হাত ছেড়ে অনুষ্ঠানের মানুষগুলোর ভিড়ে মিশে যায়। পলি কোমড়ে হাত দিয়ে মাথা চুলকায় ব্যাপারটা হলো কি তা ভেবে।
বাড়ির পিছন থেকে বাড়ি ফিরবার পথ দু’টো। একটা সরাসরি বাড়ির দিকে, আরেকটা ঢাল বেয়ে নেমে ঘুরে আসবার। সে রাতে রাজিব ফিরে বেশ দেরি করে। তবে আগে সেখান থেকে বের হয় সাথী। মীরা সেই পথটাতেই চেয়ার নিয়ে বসে ছিলো। সাথী মীরাকে দেখে কেমন থতমত খেয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে- ভাবী অনুষ্ঠান রেখে আপনি এখানে বসে কেন?
কথা বার্তা স্পষ্ট এবং আঞ্চলিক টান বিবর্জিত। দাঁড়িয়ে ওর কাছে গিয়ে মুচকি হাসে মীরা বলে
: ” তোমার আসার অপেক্ষায় বসে আছি”
কথাটা শুনে ভূত দেখার মতো চমকে গেলো সাথী। মীরা ওকে সহজ করতে ওর হাত ধরে বললো-
: ” এত চমকালে কেন? মজা করলাম, ওখানে এত লোক, গরম লাগছিলো তাই এখানে বসেছিলাম, তুমি ওখানে কোত্থেকে বেরুলে”
তোতলানো কন্ঠে সাথী বললো-
: ” আমার বান্ধবীকে এগিয়ে দিতে গিয়েছিলাম, এত রাত হয়ে গেছে তাই”
: ” তোমাকে কে এগিয়ে দিয়ে গেলো?”
: ” আমি একাই চলতে পারি, গ্রামের মেয়ে আমি”
: ” বান্ধবী বুঝি শহরের?”
এমন সময় রাজিব বেরুলো সেখান থেকে। ওরা যে এখানে তা বুঝতে পারে নি ও, মীরার কাছে এসে বললো
: ” আরে এতদিন পর এলাম তাই…”
রাজিবকে কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে মীরা বললো-
: ” তাই এত দেড়িতে ছাড়লো বুঝি?”
: ” হ্যা ”
মজার ভঙ্গিতে বললো রাজিব।
মীরা সাথীর সামনে থেকে সুন্দর করে রাজিবের হাত আগলে ধরে চলে গেলো। সাথী বরফের মতো জমে থাকলো ঐখানটায়।
হলুদের খাবার দেয়া হয়েছে। মীরা আর রাজিব পাশাপাশি চেয়ারে খেতে বসেছে। সাথী নির্লজ্জের মতো ওদের বিপরীতে রাখা চেয়ারটাতে বসলো। সম্ভবত রাজিবের একটু আগে বলা কথা আর স্ত্রীর সাথে রাজিবের আচরণ দুটোর অনুপাতের অংক করতে বসেছে ও। রাজিব স্বাভাবিক ভাবেই বিরিয়ানি খাচ্ছে। স্বভাবিক মীরাও, মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছে, রাজিবকে দিয়ে সালাদ আনাচ্ছে, পানি ঢেলে দিতে বলছে। রাজিবকে খাইয়েও দিচ্ছে দুএকবার। সাথী আড়চোখে দেখছে এসব। ওদের এক মামাতো ভাই ট্রে তে করে আরো বিরিয়ানি নিয়ে আসে। সাধে মীরাকে, মীরা বলে-
: ” এক চামচ দাও পলাশ বেশী দিও না”
রাজিবকে সাধতে গেলে রাজিব বলে-
: ” আরে আর দিস না”
: ” আরে ওর খাওয়া নিয়ে চিন্তা করিও না পলাশ, ও ক্রাশ খেয়ে বসে আছে”
পলাশ মুচকি হাসে মীরার কথা শুনে, রাজিব খাওয়া রেখে তাকায় মীরার দিকে। মীরা সুন্দর একটা হাসি হেসে বলে-
: ” এত সুন্দর শাড়ি পরেছি, তুমি ক্রাশ খাওনি বলো?”
রাজিব কিছুটা শান্ত হয়, ওর কথাবার্তা কেমন বেখাপ্পা লাগে ওর কাছে, যদিও সাথীর সাথে কি কথা হয়েছে তা জানে না রাজিব। তা জানলে তো কিছু একটা ঠিক বুঝবে। মীরা বুদ্ধি করে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করলো যে ও বুঝিয়ে দিলো ও জানে, আবার তা বললোও না স্পষ্ট করে। রাতে নূহাকে ঘুম পারাতে আগেই ঘরে চলে যায় মীরা। রাজিব তখনো বাইরে ছিলো। হয়তো কথা ও হয়েছে সাথীর সাথে।
মীরা শাড়ি খুলে, ফ্রেশ হয়ে অপেক্ষায় ছিলো রাজিবের মুখোমুখি হওয়ার। ও অবাক হচ্ছে যে এত বছরেও রাজিব কখনোই সাথীর ব্যাপারে একটা কথাও কোনদিন বলে নি। পলিকে ম্যাসেজ দেয় মীরা। সাথীর নম্বর চেয়ে। সাথে সাথে ম্যাসেন্জারে নম্বর পাঠায় পলি। নম্বরটা মুখস্থ করে ম্যাসেজটা ডিলিট করে দেয় মীরা। আজ রাতে রাজিবের ফোনে চেক করবে নম্বরটা সেভ করা আছে কি না। মীরার ভিতরের কষ্টটা রাতের বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকলো সমান তালে। অপেক্ষা শুধু রাজিবের ঘরে ফেরার।
দেড়টা বাজতে চললো রাজিব আসার নাম নেই। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে উঠে বসে মীরা। উঠে দরজা খুলে দেয় মীরা। দরজা খুলে দেখে সেখানে রাজিব না অন্য কেও দাঁড়িয়ে। মীরা বলে-
: ” তুমি এতো রাতে পলাশ”
: ” ভাবী একটু বাইরে আসবেন?”
:” কেন কোন দরকার?”
: “একটা জিনিস দেখাবো আপনাকে”
: “নূহাকে একা ঘরে রেখে..”
মীরা আসলে এত রাতে পলাশের সাথে যেতে চাইছে না।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে পলাশ বলে-
: ” ভয় নাই ভাবী, পলি বাইরে দাঁড়ায়া আছে, ও বড় কাকার ঘরে আসে না, তাই আমিই ডাকতে আসলাম আপনাকে”
মীরা উঁকি দিয়ে দেখে পলি বাইরে দাঁড়ায়ি আছে। মীরাকে দেখে দূর থেকে হাত নাড়ে পলি। আসলে বড় কাকাদের সাথে ওদের সম্পর্ক ভালো না তাই এদের ঘরে আসে না পলি দের পরিবারের কেও। পলির খেলাধুলার ব্যাপারে ওর বড় কাকা অনেক কথা শুনিয়েছিলো সেসব নিয়ে অনেক ঝগড়া হয়েছিল তাদের মধ্যে। সেই থেকে তাদের কথা বন্ধ। এমনকি একই উঠোনে ঘর হওয়া সত্ত্বেও পলিদের পরিবারের কেও আসে নি আসাদের হলুদের অনুষ্ঠানে।
মীরা দরজা আটকে ধীর পায়ে বের হয় ঘর থেকে। পলাশ ঘর থেকে বেড়িয়ে চলে যায় পুকুরের দিকে। যেন ডেকে আনা পর্যন্তই ওর কাজ ছিলো। কাজ শেষ তাই চলে যাচ্ছে। পলি বলে –
: “তুমি ব্যাডি বালা লোক না, হাতে নাতে ধরার সুযোগ পায়েও ধরলা না ”
: ” পলি, পলাশ জানে কিছু?”
: ” জানে মানে! পলাশই তো আমারে কইলো জিনিসটা তোমারে দেহাইতে”
অবাক হলো মীরা। ওর চোখে ভেসে উঠেলো খাবার সার্ভ করার সময়কার হাসির কথাটা। মীরা বললো-
: ” এত রাতে ডাকলা?”
: ” সবাই মিল্লা ঢলাঢলি করতাছে স্টেজে, তুমি গিয়া তোমার জামাইরে নিয়া আস”
মীরার কপালে চিন্তার ভাঁজ পরলো। মীরা ভেবেছিলো শেষ পর্যন্ত দেখবে কখন ঘরে আসে রাজিব। এতক্ষণ বিয়ে বাড়িটা আলোয় ঝলমলে ছিলো তাই হঠাৎ আলো বন্ধ হওয়ায় কেমন অন্ধকার লাগছে চারপাশ। মীরা পলিকে রেখেই অন্ধকারে রওনা দিলো স্টেজের উদ্দেশ্যে। পলি দেখলো অন্ধকারে কেমন মিলিয়ে গেলো একটা মানব মূর্তি। যার দৃঢ়তা ওকে কেমন গুড়িয়ে দিচ্ছে ভিতর থেকে। কতটা পুড়লে এত ধৈর্য হয় তার হিসাব করতে ব্যার্থ হয় টিনএজের দাড় প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া পলি। অংকে ও বরাবরই ভীষণ কাঁচা।
চলবে…
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ২৬
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
সব অনুষ্ঠান ভালো ভাবে শেষ করে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা করে ওরা। যেই পথে এসেছিলো সেই পথেই ফিরে যাচ্ছে ওরা। বাড়ির সামনে থেকে বাস, বাস থেকে নেমে লঞ্চ। ফিরবার সময়ও বিলাসবহুল একটা লঞ্চে রওনা করে ওরা। কিন্তু যে মন নিয়ে এসে ছিলো মীরা তার ভাঙাচোরা টুকরো গুলো অনেকে কষ্টে কুড়িয়ে কোন মতে তা বয়ে চলছে ও। ওর ভিতরকার অনুভূতির কোন নাম খুঁজে পায় না ও। এটা কি ঘৃণা, নাকি বিরক্তি, লজ্জা নাকি ভালোবাসা হারাবার ভয়? ফেরার পথে যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করেছে মীরা। রাজিব ওর থুম ধরে থাকা দেখে জিজ্ঞেস করলো –
: ” কি ব্যাপার? বাইরে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের মতো মুখ কেন আমার বউয়ের? ”
: ” মাথা ব্যাথা করছে”
: ” দাও নূহাকে ঘুম পারাই আমি, তুমি একটু রেস্ট নাও”
এক পলক তাকায় মীরা রাজিবের দিকে। কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে পরে মীরা। নানা হিসাবে ব্যাস্ত ওর মস্তিষ্ক আর ভাঙাচোরা মন। কি করবে, কি করা উচিত, তার কিছুই বুঝতে পারছে না ও। নূহাকে ঘুম পারিয়ে রাজিব রাতের খাবারের জন্য ডাক দেয় মীরাকে। সজাগ থাকা সত্ত্বেও মীরা সারা দেয় না, পাশ ফেরা অবস্থায় পরে থাকে৷ রাজিব বাইরে থেকে গেইট আটকে খাবারের দোকানের দিকে রওনা দেয়। মীরা সাথে সাথেই বিছানা ছেড়ে নিচে নামে। এ কেবিনটার কোন বারান্দা নেই। তবে বড় একটা জানালা আছে। মীরা সেখানে গিয়ে বাইরে তাকায়।
ওরা বরিশাল আসার সময় চাঁদটা তার পূর্ণ রূপে আবির্ভূত হয়েছিলো আকাশে। আজ পাঁচ দিন পর চাঁদটা ক্ষয়ে গিয়েছে সত্যি কিন্তু সৌন্দর্য তাতেও কমে নি, এটা আলাদা এক সৌন্দর্যে মেলে ধরেছে নিজেকে।
জীবণটাকে অর্থহীন মনে হয় মীরার । একবার ভাবে লাফ দেয় লঞ্চের বারান্দায় গিয়ে। এত ভুল যার জীবণে তার বেঁচে থাকা মানে ভুলের ইমারতে আরেকটা ইট যোগ করা, যার কোন মানেই হয় না। চোখ দুটো ভিজে যায় ওর। এত ভালোবাসা, বিশ্বাস, ত্যাগ এসবের কোন দামই নেই।
এমন ভাবনার সাথে সাথেই নূহা কেঁদে উঠে ঘুম থেকে।
ওড়না দিয়ে চোখ মুছে মীরা, চিন্তার জাল গুটিয়ে মেয়ের কাছে আসে ও ৷ পিঠে আলতো হাত বুলিয়ে দিলে আবার ঘুমিয়ে পরে নূহা।
আবার ভাবনার বুননে মন দেয় মীরা। ছোট্ট এ জীবণে ধাক্কা তো কম খেলো না ও, তবে গত কয়েকটা দিন যার ভিতর দিয়ে গিয়েছে ও তা ভেঙে ফেলেছে পূর্বের সকল ধৈর্যের রেকর্ড। ওর জীবনে ও সবচেয়ে যাকে ভালোবেসেছে, আগলে রেখেছে, যাকে আবর্তন করে ঘুরছিলো মীরার জীবন নামের গ্রহ, সে আবর্তিত হচ্ছে অন্য কাওকে কেন্দ্র করে। কি মজা না ব্যাপারটা!?
রাজিবের প্রতি নূন্যতম ঘৃণাও অবশিষ্ট নেই মীরার। কারন ও ঘৃণা পাবারও অযোগ্য। ঘটনার সবটুকু যখন জেনেছিলো মীরা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে নি। এ কানটাকে যে এ জীবণে কত বার দ্বিধায় ফেলেছে মীরা রাজিবের ব্যাপারে শুনে তাই এখন আর আগের মতো বেগ পেতে হয় না ওকে ঘটনার আকস্মিকতায়। বরং তা সামলে উঠে হামলে পরে তার সমাধান খুঁজতে। মীরার অভিযোজিত এই ব্যাপারটায়ই ভড়কে গিয়েছিলো পলি। কারন গড়পড়তা মেয়েরা স্বামীর এমন কথা শুনে ভেঙে পরে, দিশেহারা হয়ে যায়। কিন্তু মীরা এক্কেবারে ভিন্ন।
নূহা জন্মের আগেই মীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো এটাই শেষ সুযোগ রাজিবের । কিন্তু মহামতি রাজিব মীরার শেষ সুযোগের আলটিমেটাম ঘোষনা করার আগেই এমন কিছু করেছে যা মীরার টিকে থাকার ভীতকে নাড়িয়ে দিয়েছে। মীরার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল রাজিবকে ওর জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের সেইসব দিন গুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় নিজেকে বিক্রির বিনিময়ে ওকে সারিয়ে তোলার সেই সব ঘটনা। মানুষ এত দ্রুত অতীত ভুলে কিভাবে?
মীরার মনে আছে ডিমের তরকারি ছিলো ওদের সংসারে গরুর গোশতের তরকারির সম মর্যাদার খাবার। সেই রাজিব এখন বুফে ডিনার করে একেকদিন একেক রেস্টুরেন্টে। কিন্তু মীরা তা জানে ও না। রাতে বাড়ি ফিরলে বলে বন্ধুদের সাথে এখানে সেখান গিয়েছে, সেখানেই সবাই মিলে খাওয়াদাওয়া করে এসেছে।
মীরা এখনও ইন্ডিয়ায় বাই এয়ারে না গিয়ে বাসে ঝুলে ঝুলে সারাদিন খরচ করে যশোর গিয়ে বেনাপোল বর্ডার হয়ে, হাজার হাজার মানুষের সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে বাই রোডে ইন্ডিয়া যায়। আর সেই রাজিব ঘুরে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে, থাইল্যান্ডের পাতায়ায়, মালেইশিয়া কিংবা সিঙ্গাপুর। অথচ সেই বুফের ডিনার কিংবা বিলাসবহুল প্রমোদ ভ্রমণে ঠাঁই হয় নি ওর দুঃসময়ের সঙ্গী, ওর সহধর্মিণী মীরার। ব্যাপার গুলো এত কষ্টের, যে বুক ভারী হয়ে নিশ্বাস নিতে ভুলে যায় ও মাঝে মাঝে। এত কষ্ট কেন ওর? কেন এত মানিয়ে নেয়া সত্ত্বেও একছত্র ঠাঁই হলো না রাজিবের মনে?
মীরা একটা বারের জন্য ও বুঝতে পারে নি এই নূহার জন্মের আগেই রাজিবের ঐ গদগদে ভালোবাসা ওর নীলনকশার অংশ। মীরার কেমন ঘিনঘিন লাগে রাজিবের ভালোবাসার ভান ধরে করা আদর, স্পর্শ, আর আলিঙ্গনের কথা ভেবে। এত সব জেনে, শুনে, দেখে মীরার কেবল একটা কথাই বের হয় ভেতর থেকে। অনেক হয়েছে মীরা আর না…
কিন্তু এলোমেলো এ জীবণ গোছানো তো খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার চেয়েও কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে । কারন রাজিবের একছত্র অধিপত্যে ওর তিল তিল করে গড়ে তোলা ব্যাবসা। মিছে ভালোবাসায় গদগদ মীরা সবকিছু থেকে গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। আর রাজিব অন্যায় ভাবে রাজ্য দখলের চেয়েও নোংরা খেলা শুরু করেছে বেশ আগে থেকেই।
বরিশাল না এলেই ভালো হতো। এত কিছু দেখতো ও না, জানতো ও না। যা জেনেছে ও কি হতে পারে তা অনুমান করতে পারবেন আপনারা? যা হয়েছে তা মীরার অনুমানেরও বাইরে। আর আপনাদের ও?
মীরা প্রথমে ভেবেছিলো এসব মিথ্যা। কিন্তু সাথীর ফেসবুক আইডি ওর বড় বড় হোটেল, রেস্তোরাঁয় চেক ইন, দামী দামী পোশাক( যা মীরাদের প্রতিষ্ঠানে তৈরী) এসব তো আর মিথ্যা না। তার উপর সাথীর থাকা বাসা, ওর লাইফস্টাইলের খরচ দেয়া সম্ভব না ওর বাবার পক্ষে। কোত্থেকে আসে এসব? একটা অবিবাহিত মেয়ে ঢাকায় একা কোথায় থাকে তারও হদিস জানে না ওর বাবা মা। কি ভাবছেন? লিভ-ইন করছে রাজিব সাথী। আরে নাহ্ ব্রো!
বলছি, ওয়েট এ সেকেন্ড।
সাথী রাজিবের বিবাহিতা স্ত্রী। যাকে রাজিব সময় দেয় দিনের বেলা। মাল কেনা, তাগাদার কথা বলে বিদেশ ঘুরিয়ে আনে, বন্ধুদের সাথে ঘুরার কথা বলে চেক ইন দেয় শহরের নামকরা সব পানশালায়। এটা যে কত বড় ধাক্কা মীরার জন্য তার কিছুটা দুলুনি টের পেয়েছেন আপনারা ও। মীরার হাতে পলাশ যখন ওদের কাবিন-নামাটা দিয়েছিলো মীরার হাতটা তখন থরথর করে কাঁপছিলো। ওকে দেখে মনে হয়েছিলো হাতের কাগজটা ওর মৃত্যু পরোয়ানা যেন। চোখ থেকে দু’ফোটা পানি ও গড়িয়ে পরেছিলো কাবিন নামার সেই ফটোকপিটাতে। পলাশকে তখন মীরা বলেছিলো-
: ” এখন এসব আমাকে দেখানোর মানে কি? ”
কোন কথাই বলতে পারে নি পলাশ। মাথা নিচু করে বসে ছিলো অপরাধীর ভঙ্গিতে। বেশ কিছক্ষণ নিরব থেকে মীরা যখন চলে আসতে উঠে দাঁড়ালো পলাশ বলেছিলো –
: “আমি আপনার ব্যাপারে এতসব জানতাম না, বড় আপা ( বড় মামার বড় মেয়ে লাবণী) যখন ঢাকা থেকে ফিরে এলো, আপনার ব্যাপারে এত এত প্রশংসা করতে লাগলো যে ভাইয়ার বলা আপনার বিরুদ্ধে কথাগুলো যে অপবাদ তা টের পেলাম আমি। তার পর থেকে অনুশোচনায় ভুগছি । আমার অপরাধ গ্লানি বেশী কারন ঐ বিয়েতে আমি ছিলাম সাক্ষী হিসেবে, তাই এসব জানালাম আপনাকে যদি এতে পাপ কিছুটা মোচন হয়”
: ” সাথী জানতো না যে রাজিব বিবাহিত? ”
: ” হুম”
: ” তারপরও…”
: ” আসলে ভাইয়া এমন একটা কথা বলেছিলো যা আমি আপনাকে এখন বলতে পারবো না”
: ” তাহলে অর্ধেক কেন বললে? খুব তো ভালো ছিলাম আমি মিথ্যা মায়ায় ডুবে”
: ” আপনার ভালোর জন্য বলেছি”
: ” আমার যে ভালো করে দিয়েছো সাক্ষী থেকে, তোমার এ ঋণ আমি ইহ জনমে ভুলতে পারবো কি না তা জানি না, বলবে কি , কি অভিযোগ ছিলো ওর আমার প্রতি? ”
বেশ কিছু সময় মৌন থেকে পলাশ বলে-
: ” আপনার আগে নাকি বিয়ে হয়েছিল, ঐ ছেলের সাথে….”
: ” থাক, বুঝেছি আমি বলতে হবে না আর পুরোটা।
দুই হাতে মুখ চেপে অনেক কাঁদে মীরা। কার জন্য কি করলো সেই দুঃখই পোড়াচ্ছে ওকে। পলাশ সময় দিলো মীরাকে৷ কাঁদুক তিনি, না হলে দম আটকে মরে জাবেন তিনি। পলাশ যেন স্বান্তনার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কান্না থামার অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই নেই করবার।
বেশ কিছু সময় পর কিছুটা শান্ত হয় মীরা, চোখ, নাকের পানি ওড়নার কিনারে মুছে, শ্লেষ্মা জড়ানো কন্ঠে বলে-
: ” শোন পলাশ সে রাতে কাবিন হয়েছিল আমার আর আবীরের, আমি আর আবীর সে রাতে যার যার বাড়িতে ছিলাম। কালিমার বিয়ে ছাড়া আমাদের মধ্যে আর কিছুই ছিলো না। ও কোনদিন এসব আমাকে জিজ্ঞেস করে নি, করলে হয়তে ওর ভুল ধারনাটা পরিষ্কার হয়ে যেতো। যাক গে তোমাকে এসব বলে লাভ কি?”
: ” আমাকে ক্ষমা করবেন ভাবী ভাইয়া যা বলেছে তা ছেঁকে মার্জিত ভাবে যেটুকু বলা যায় সেটুকুই বলেছি আমি”
: ” একটা উপকার করবে আমার? ”
: ” একবার বলে দেখেন ভাবী, আমার এ পাপ মোচনে সব করতে প্রস্তুত আমি”
: ” তোমার কোন পাপ নেই পলাশ, তুমি সাক্ষী না দিলেও ওদের বিয়েটা আটকে থাকতো না। আমি যে সব জানি তুমি এটা ওদেরকে বলো না। সবদিকে ভেঙে পরেছি আমি, আমি একটু সময় নিয়ে দাঁড়াই, নিজেকে সামলে নিয়ে চলে যাবো ওদের জীবণ থেকে”
কথাটা বলে সেদিন ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল মীরা।
মীরা সে রাতে ঘুমুতে পারে নি। এক এক করে রাজিবের সব চাল মনের দরজার সামনে আসে ওর। দাওয়াতে আসবে না বলেও মীরাকে শেষ পর্যন্ত বিয়ের দাওয়াতে নিয়ে আসাটাও রাজিবের পরিকল্পনারই একটা অংশ। রাজিব মীরাকে এসব জানাতেই নিয়ে এসেছে এখানে। যাতে কষ্ট করে ওকে কিছু বলতে না হয়। হয়তো সাথীর পক্ষ থেকে চাপ ছিলো ওর প্রকাশ্যে আসার।
রাজিব ও তাই ওর আখের গুছিয়ে নিয়েছে। ব্যাংকে যে যৌথ একাউন্ট ছিলো ওদের দুজনের নামে, তাও ব্যাংকিং ঝামেলার কথা বলে ক্লোজ করে দিয়ে নিজের নামে একা একাউন্ট খুলেছে, মীরা জানে এ ব্যাপারটা। এমনকি পুরাতন কর্মচারী ছাঁটাই করাটাও ছিলো রাজিবের একটা চাল। পুরাতন সবাই জানতো এ প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে মীরার কি ত্যাগ আর পরিশ্রম ছিলো। তাইতো ভবিষ্যতে কোন ঝামেলা যাতে না হয় তাই সব কর্মী ছাটাই করে দিয়েছে রাজিব। মিথ্যা ভালোবাসায় অন্ধ মীরা স্বামীর কৃত্রিম ভালোবাসা কিনেছে এসব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার বিনিময়ে। দিন শেষে না রইলো স্বামীর ভালোবাসা না ওর ব্যাবসা। এতটা খারাপ মানুষ হয় কি করে?
কি করবে ভেবে পাচ্ছে না মীরা। অনেক চিন্তা ভাবনার পর একটা সিদ্ধান্তে আসে মীরা। যুদ্ধে নামার আগে প্রতিটা যোদ্ধা জানে – ” হয় মা’রো নয় ম’রো। যুদ্ধ বিদ্যা না জানলেও এটা বুঝতে পেরেছে মীরা ঠিকই। এ যুদ্ধ নিজের অস্তিত্ব বাঁচানোর যুদ্ধ।
এমন সময় কেবিনের দরজা খোলার শব্দ কানে আসে মীরার। মীরা মুচকি হেসে বলে-
: ” কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”
: ” এই তো রাতের খাবার নিয়ে এলাম”
মীরার ওড়না বিছিয়ে খাবার নিয়ে বসে দুজন। রাজিব মনোযোগ দিয়ে ইলিশ মাছের কাঁটা বেছে খাচ্ছে। আর মীরার মনোযোগ রাজিবের দিকে। একটা মানুষ এত সুন্দর অভিনয় করে কিভাবে? মনে মনে ভাবে মীরা। হঠাৎ মীরা বলে-
: ” জানো ছোটবেলায় ক্লাস সিক্সে থাকতে একক অভিনয়ে জাতীয় পর্যায়ের পুরস্কার পেয়েছিলাম আমি ”
রাজিব খাওয়া বন্ধ করে তাকায় ওর দিকে। তুলে নেয়া হাত নামিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে –
: ” হঠাৎ এ কথা কেন?”
: ” মনে পরলো এ কথাটা তুমি জানো না, বলা হয় নি কখনো, তুমি স্কুলে থাকতে সবচেয়ে ভালো কিসে ছিলে? ”
: ” তীরন্দাজে”
মীরা এবার খাওয়া থামিয়ে তাকিয়ে থাকে রাজিবের দিকে। তারপর হঠাৎ কেমন একটা হাসি হাসে মীরা। হঠাৎ মীরার এমন হাসি দেখে ভড়কে যায় রাজিব। কি হলো মেয়েটার মনে মনে ভাবে রাজিব। আর মীরা ভাবে –
: ” তোমার খেলা শেষ রাজিব, তুমি যেভাবে সব কেড়ে নিয়েছো আমার থেকে তা হারানোর কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেলো আজ থেকে”
চলবে….