প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
গ্রীষ্মকাল শেষ ক্যালেন্ডারের হিসেবে বর্ষাকাল চলছে। তবুও সূর্যের যে তেজ তাতে মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীটাকে সে ঝলসে ফেলতে চাচ্ছে তার তাপে। রাস্তাঘাট মোটামুটি জনমানব শূন্য। যারাও আছে সবাই দোকানের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে এসব দেখছিলো মীরা। গতকাল রাতে ওর জীবণটা এক ঝটকায় ৩৬০° ঘুরে গেছে। ওর মা এমন কিছু করবে তা ও জানতো। কিন্তু যা ঘটেছে গতরাতে তা ওর মায়ের ভাবনাকেও ছাড়িয়ে গেছে। ওর মা নিজেও হয়তো এতটা আশা করেন নি। অনেক ভেবে একটা বুদ্ধি বের করে ও। যে করেই হোক বাসা থেকে ওকে বের হতেই হবে। এবং তা আজকের মধ্যেই। তা না হলে সব শেষ হয়ে যাবে। এরপর আর কিছুই করার থাকবে না ওদের।
বাসা থেকে কোচিংয়ের কথা বলে বের হয়েছে মীরা।সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। যদিও এখন তার বের হওয়া এক প্রকার নিষিদ্ধ তবুও মীরা মাকে বলেছে স্যারকে বলে আসবো যে ও সামনের কয়েকদিন আসতে পারবে না। কোচিং-এর সীটগুলো যেন ওর জন্য স্যার আলাদা করে রাখেন। কথাটা শুনে মীরার মা জাহানারা কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকালো মীরার দিকে। সন্দেহ, আর অবিশ্বাস মিশে ছিলো সে দৃষ্টিতে। যেতে দেওয়াটা রিস্কি কিন্তু, না যেতে দেওয়াটাও ঠিক হবে না। যত যাই হোক পড়াশোনা তো চালিয়ে যেতে হবে। কি একটা ভেবে তিনি বললেন-” দ্রুত আসবি, আধঘন্টা সময় দিলাম। তোকে নিয়ে মার্কেটে যাবো তুই ফিরলে।”
ওর মা জাহানারার মুখ থেকে কথাটা শুনে বুক থেকে পাথর নামে ওর। কথাটা যে কাজে দিবে ভাবতেই পারে নি ও। মীরা দ্রুত কি যেন চিন্তা করে ওর জরুরী কাগজপত্র গুলো ব্যাগে নিলো। মা বাথরুমে, বের হওয়ার ব্যাস্ততায় তার সাথে দেখাও হলো না শেষবারের মতো। ছোট বোন ইরার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বেরিয়ে গলো মীরা। ইরা অবাক হয়ে তাকালো বোনের দিকে। বোন এত ভালো কবে থেকে হলো। সারাদিন দুবোনে ঝগড়া লেগেই থাকে। আজ হঠাৎ কি হলো? ইরার ভাবুক চেহারাটা ব্যাস্ততায় লক্ষ্যই করলো না মীরা। ছুটলো যেন উল্কার বেগে।
এখন দিনের মধ্যভাগ। বাসা থেকে বের হয়ে সোজা বামে হাঁটা ধরলো ও কিন্তু ওর কোচিং যেতে হয় ডানের পথ ধরে। গরমে নাস্তানাবুদ অবস্থা ওর। তারাহুরায় ছাতাটাও আনতে ভুলে গেছে ও। ছাতা ছাড়া ও কখনো চলাফেরা করে না। চারপাশে তাকিয়ে মাথায় লম্বা করে ঘোটমটা টেনে নিলো ও। এরপর দ্রুত হাঁটা ধরলো। যা করার জলদি করতে হবে। সময় অনেক কম ওর হাতে।
প্রথমে ওদের এলাকা থেকে দূরের একটা ফোনের দোকানে গেলো মীরা। ও যে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে তা রাজিবকে জানাতে হবে। রিং বাজলো কয়েকবার। রাজিব ফোনটা ধরলো না। আরেকবার চেষ্টা করতেই ওপাশ থেকে একটা কন্ঠ ভেসে এলো-
: “হ্যালো মীরা”
: ” হ্যাঁ, তুমি কিভাবে বুঝলে আমিই ফোন করেছি? ”
কাতর কন্ঠে রাজিব বলে-
: ” কাল রাত থেকে আমি অনেক চিন্তায় আছি, এত দ্রুত সব শেষ হয়ে যাবে আমি বুঝতে পারি নি”
: ” বুঝতে কি আমি পেরেছি, তুমি এত ভেঙে পরছো কেন? আমার বিয়ে হয়ে গেছে তাই তুমি কি আমাকে এখন ভালোবাসো না?”
: ” ব্যাপারটা তা না মীরা, খবরটা পেয়ে আমি ভেবেছিলাম সব শেষ হয়ে গেছে”
: ” আমি সব ছেড়ে ছুড়ে চলে এসেছি তোমার কাছে, তুমি এখন এসব বলছো। আমি কি চলে যাবো তাহলে?”
কথাটা বলতেই মীরা লক্ষ করলো দোকানী ওর দিকে কেমন চোখে যেন তাকাচ্ছে। একটু দূরে সরে গেলো মীরা। বাকী কথাগুলো বললো সাবধানে গলা খাঁদে নামিয়ে । রাজীব ওকে কি একটা বললো। এ পাশ থেকে তা বোঝা গেলো না কিছু।
মীরা একটা রিকশা নিলো তাঁতীবাজারের। রিকশায় উঠে নানান চিন্তা ভর করলো ওর মনে। হাতের আংটিটার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো ও। সেটাকে হিং*স্র ভাবে খুলে ফেললো এক মুহূর্তে। যেন এ আংটিটা ওর শত্রু। যাকে ও ঘায়েল করে ফেলেছে ।
আংটিটা বিক্রি করে সাত হাজার টাকা পাওয়া গেলো। এটাই যক্ষের ধন ওদের কাছে। জুয়েলার্সের দোকান থেকে বেরিয়ে আরেকটা রিকশা নিলো ও। হুডটা তুলে দিতে বললো ড্রাইভারকে। হুড তোলা সত্ত্বেও মীরার শরীর পুরে যাচ্ছে যেন গরমে। ব্যাগ থেকে পানি বের করে খেলো ও। হঠাৎ মনে পরলো সকাল থেকে ও না খাওয়া। ক্ষুধাটা এর পর থেকেই পেট এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে।
রিকশা থামিয়ে একটা বেকারীর সামনে নামলো ও। একটা স্যান্ডুয়েচ আর কোক কিনলো সেখান থেকে। তারপর রিকশা চলতে শুরু করলো। রিকশায় বসেই স্যান্ডুয়েচ আর কোক খেলো মীরা। কোক শেষ করে বোতলটাকে রিকশা থেকে দূরে ছুড়ে ফেললো ও। মুখে যুদ্ধ জয়ের হাসি। মনে মনে ভাবছে আমাকে আর পায় কে? যতক্ষণে জানবে সবাই ততক্ষণে আমি মিসেস রাজিব হয়ে যাবো। ওর চোখেমুখে খুশির আভা, কোন অপরাধবোধের ছিটেফোঁটাও ছিলো না।
মিনিট পনেরো পর ও পৌঁছে গেলো রাজিবের বলা ঠিকানায়। সেখানে পা দিতেই ওর যুদ্ধ জয়ের মনোভব ম্লান হয়ে গেলো। তাসলিমা ভাবী ওকে দেখে দ্রুত ঘরে ঢুকিয়ে বললো-
: ” আসছো ভইন? ঐ দিকে তো ঘটনা রইট্যা গেছে। ”
: “মানে?”
: ” আবীর তো তুমাগো বাড়িত গেছিল, হেয় জানলে কমতে তুমি যে পালাইছো?”
কথাটা শুনে দপ করে বসে পরে মীরা। ওর মুখে কোন রা নেই। ভাবী ওকে বাকী কথা বলতে লাগলো-
: “তোমার মামা আর বাবা রাজিবের দোকানত গেছে, আমারে ফোন করি সব কইলো রাজিব একটু আগে ”
মীরা ভাবতে লাগলো ওর ভাগ্যটা এমন কেন। কাঁদতে থাকে মীরা। ভাবী স্বান্তনা দিলে বলে-
: “আল্লাহই জানে ভাবী, কি চলছে ওর উপর দিয়ে”
: ” আল্লারে ডাকো ভইন, আল্লারে ডাকো।
——————–
গতকাল এ সময়ে মীরাদের ড্রইংরুম ভর্তি মানুষ ছিলো। সবার চোখেমুখে হাসির ঝিলিক ছিলো চোখে পরার মতো। এত সুন্দর বর-বৌ, যেন মানিক জোড়। চব্বিশ ঘণ্টা না পেরুতেই তা উবে গেছে কর্পূরের মতো। বিয়ে বাড়িটা কেমন যেন শোকের বাড়িতে পরিণত হয়েছে।
সবার মুখেও একই কথা। গেলিই যদি বিয়ের আগেই যেতি, অন্ততঃ ছেলেটার কলঙ্ক হতো না। যত যাই হোক, মানুষ কিন্তু ঠিকই বলবে ছেলের বিয়ে হয়েছিল একবার। বৌ বিয়ের পরদিনই পালিয়ে গেছে।
মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে আবীর।
যে জীবণ গত রাতে ও শুরু করে গিয়েছিল এ ঘরটাতে আজই তা শেষ হয়ে গেলো। আল্লাহর হুকুম ছাড়া গাছের পাতা নড়ে না। এ কেমন হুকুম তার। এ জীবণে কখনো ও কারো ক্ষতি করে নি। বড়দের সম্মাণ, ছোটদের স্নেহ, করতো। মেয়েদের থেকে নজর বাঁচিয়ে চলতো, সম্মান করতো মেয়েদেরকে। সবদিকে সমান নজর ওর বিদ্যা, বুদ্ধি, টাকা,পয়সা সব দিকে অলরাউন্ডার। পুরো পরিবারটাকে ধরে রেখেছে ও এক অদৃশ্য বাঁধনে। খালা কি ফুফু সবার খোঁজ খবর রাখে নিয়মিত। আজ পর্যন্ত কোন মেয়েকে বাজে কথা বলে নি কখনো। সিগারেট, নেশা এসব ছুঁয়ে ও দেখেনি কোনদিন। সারা জীবন এত ভালো হয়ে চলার এ পুরস্কার আল্লাহ দিলো ওকে। সৃষ্টিকর্তার প্রতি অভিমান হলো ওর।
বিয়ের আগে ও বারবার ওর মাকে জিজ্ঞেস করেছিলো মেয়ে রাজি কি না। ওর মা বলেছিলো –
: ” মেয়ে কিরে মেয়ের চৌদ্দগুষ্টি রাজি, আমার ছেলে লাখে একটা”
: ” মেয়ের চৌদ্দ গুষ্টিকে আমি বিয়ে করবো না, মেয়েকে করবো, আপনি ভালোভাবে খবর নেন। ”
ছেলের ফুপু খুব গরম হয়ে গেছেন। কথা শুনাচ্ছেন মেয়ের মা-বাবা কে। তিনি বলেন- আমার সোনার টুকরা ছেলের এমন বেইজ্জতি। আমি এদের দেখে নেবো। আজকের মধ্যে ডিভোর্সের কাগজ দিয়ে দিবেন আমাদের। আমরা এক সপ্তাহের মধ্যে আমার ছেলেকে এরচেয়ে ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দিবো।
আবীরের বাবা সুলতান তার বোনকে থামান। বলেন- আহা কি শুরু করলি সাহানা।
বড় ভাইয়ের ধমকে কিছুটা শান্ত হয় সাহানা। আবীরের মা স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। ছেলেকে বিয়ের জন্য খুব পিড়াপিড়ি করে রাজি করিয়েছিলেন তিনি। ছোট বোনকে বিয়ে দিয়ে বিয়ে করবে বলেছিলো আবীর। তিনিই তার বান্ধবী মমতাজের মেয়েকে ছেলের বৌ বানাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। কালো ছেলের জন্য পরীর মতো বৌ আনবে এই এক স্বপ্ন ছিলো তার। আর কেন চাওয়া পাওয়া ছিলো না তার। কালো হলে কি হবে আবীর দেখতে খুবই সুদর্শন আর মায়াবী ছিলো।
স্কুলে স্যাররা ওকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড বলতো।
ক্ষুনাক্ষরেও ভাবে নি আবীর এমন কিছু হবে ওর জীবণে। ওর খুব ইচ্ছে করে মাকে চিৎকার করে বলতে – “দেখো মা, তোমার লাখে একটা ছেলের ভাগ্য কতো সুন্দর… ”
ছেলেরা কাঁদতে পারে না। ওর কান্না গুলো হয়তো একটু পরপর দীর্ঘশ্বাস রূপে বেরিয়ে যাচ্ছে। কারন ইতোমধ্যেই একটু একটু করে ওর মনে স্বপ্ন বুনা শুরু হয়েছে মীরাকে নিয়ে।
ড্রইংরুম থেকে উঠে বেরিয়ে যায় আবীর। মনে মনে বলে- অনেক ভালো থেকো তুমি মীরা।
চলবে…
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ২
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
পরদিন বিকেলে মীরার বড় খালার বাসায় আবীর আর মীরার ডিভোর্স হলো। ছেলেদের পক্ষের ছেলের মা আর বাবা আর ফুফু এসেছিলেন, আর মীরার পক্ষের শুধু মীরার বাবা মোজাম্মেল সাহেব। এক কোণে দুই হাতের উপর ভর দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন তিনি। এই নিরীহ গোবেচারা মানুষটার মাথা উঁচু রাখার অধিকার তার মেয়ে কেড়ে নিয়েছে গতকাল। কত ভালোবাসেন তিনি মেয়ে দুটেকে। একমাত্র ছেলেটা সবার ছোট হওয়া সত্ত্বেও মেয়েদেরকে তিনি বেশীই ভালোবাসেন। ছোটবেলা তার মা মারা গেলেন। মায়ের ভালেবাসার অভাব তাকে খুব কষ্ট দিতো। পরিবারে মা, মেয়ে, স্ত্রী কত গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতেন তিনি। স্ত্রী জাহানারা যখন অন্তঃস্বত্বা হলো নামজের বিছানায় তিনি কেবল দোয়া করেছেন যেন একটা মা আসে তার ঘরে।
আল্লাহ তার ইচ্ছা পূরণ করেছেন। জাহানারার অনেক শারীরিক জটিলতা শেষে মীরার জন্ম যেদিন হলো, গোবেচারা এই মানুষটার সে কি কান্না। খুশির আনন্দের আর দোয়া কবুলের সে কান্না দেখে কেঁদেছিলো প্রতিবেশীরাও । বিবাহিত জীবণের ষোলোটি বছর পর জন্ম হয়েছিল মীরার। কত লোক বলেছিলো – জাহানারা বন্ধ্যা। ওর কোনদিন বাচ্চা হবে না। মোজাম্মেলের চাচা-চাচীরাও ২য় বিয়ের ব্যাপারে বলতো ইনিয়ে বিনিয়ে। কিন্তু মোজাম্মেল তার ধার ধারতো না। আল্লাহর উপর ভরসা ছিলো তার। সাধ্য মতো সবরকম চিকিৎসা তিনি করিয়েছেন স্ত্রীর। একসময় বিরক্ত হয়ে জাহানারা ডাক্তার দেখানে, ঔষধ খাওয়া বন্ধ করে দিনরাত আল্লাহর কাছে একটা সন্তান চাইতেন। ষোলো বছরের দীর্ঘ সাধনার ফল এই- ” মীরা ”
নতুন মায়েরাও অনেকসময় দেখা যায় নিজের সদ্যজাত বাচ্চাকে ঠিকঠাক কোলে নিতে পারে না, ভয় পায় এই বুঝি পরে গেলো। কিন্তু মোজাম্মেল সাহেব সেই ছোট্ট মীরাকে কি সুন্দর করে কোলে নিতেন। চল্লিশ দিন না পেরুলে ছোট বাচ্চা বাইরে বের করা নিষেধ এমনি চল ছিলো গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু তিনি সদ্যজাত মীরাকে সকলে ঘুম থেকে উঠলেই সুন্দর করে তৈরী করে কোলে নিয়ে ঘুরতে বেরুতেন । যাতে এই ফাঁকে তার স্ত্রী ঘরের সকল কাজ সেরে ফেলতে পারেন। সেই অভ্যাসটা রয়ে গেলো বড় বয়স পর্যন্ত। কোথাও যেতে হলে বাবাই মীরার একমাত্র ভরসা। জামা কিনবে কি বই, খাতা, কলম। বাবাই ওর সব সময়ের সঙ্গী। সেই মীরা এমন একটা কাজ করার সময় একটুও ভাবলো না ওর বাবার সম্মানের কথা। তিনি ঠিক মীরার বিপরীতে বসা। কিন্তু মীরার দিকে একবারও তাকান নি এ ঘরে ও ঢোকা পর্যন্ত।
আবীরের ফুফু অনেক কথা শুনচ্ছে মীরা আর রাজিবকে।
: ” এতই যদি ভালোবাসা তাহলে কেন বিয়ের আগেই চলে গেলো না। কেন আমার ভাতিজাকে কলঙ্কিত করলো ও”
যেন জবাব চাইছেন তিনি মীরার কাছে। মীরা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে, রাজিবের পিছনে। যেন রাাজিব ওর ঢাল, কথার আঘাত থেকে বাঁচার জন্য।
আবীরের আসার কথা থাকলেও আবীর আসে নি। লজ্জা, ঘৃণা আর অপমানে হয়তো। আবীরের সই পরে নেয়া হবে। কর্কশ ভাবে আবীরের ফুপু সাহানা বললো-
: “এই নির্লজ্জ মেয়ে সই করো এখানে, তুমি আমার মেয়ে হলে, তোমার চামড়া তুলে লবণ দিতাম আমি, অসভ্য মেয়ে কোথাকার ”
এত সব শুনেও মীরা যন্ত্র চালিত পুতুলের মতো সই করে দিলো উকিলের দেখনো জায়গায়। সই করার পরই তারা চলে গেলো দ্রুত ঘর ছেড়ে। মীরার খালা পারভীন বললো- “কি ভুল যে করলি একদিন ঠিক বুঝবি, কিন্তু তখন বুঝেও কোন লাভ হবে না” কথাটা শেষ করেই তিনি চলে গেলেন অন্য ঘরে। ঘরে কেবল রইলো মীরা, রাজিব আর মাথা নত করা মোজাম্মেল সাহেব।
রাজিব মীরাকে কি একটা ইশারা করে। মীরা দৌড়ে ওর বাবার পায়ে পরে। কান্না জড়ানো গলায় বলে “বাবা আমরা ভুল করে ফেলেছি, তুমি আমাদের ক্ষমা করে দাও। মীরার বাবা তেমনি বসে। দু’হাতে মুখ ঢেকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা তার। এ মুখ আর মেয়েকে দেখাবেন না তিনি। কোন উত্তর না দিয়েই দাঁড়িয়ে যান তিনি। গলা উঁচু করে বলেন- পারভীন, পারভীন…
: ” জ্বী ভাই, ”
: ” শোন, আজ থেকে আমার বড় মেয়ে মৃত, আমি
এক মেয়ে এক ছেলের বাবা”
: ” চুপ করেন ভাই, আপনার উত্তেজিত হওয়া বাড়ন।
: ” মৃ’ত্যু যন্ত্রণায়ও হয়তো এর চেয়ে কম কষ্টের, যতটা কষ্ট আমি এখন পাচ্ছি, তুমি হয়তো ভাবছো রাগে কষ্টে কি না কি বলছে দুলাভাই, দুদিন পর সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না, আমি বেঁচে থাকতে এ সম্পর্ক কোন দিনও মেনে নিব না ”
বলেই পারভীনের বাসা থেকে চোখ মুছতে মুছতে
বেরিয়ে যান মীরার বাবা মোজাম্মেল সাহেব । দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা পারভীনকেও দেখা গেলো ওড়নার কিনারা দিয়ে চোখ মুছতে। সে অবস্থায়ই তিনি কর্কশ গলায় বললো –
: ” বের হ তুই, আমার ফেরেশতার মতো দুলাভাইকে লোক সমাজে হাসির পাত্র বানিয়েছিস তুই। এত কিছুর পরও এত বোঝালাম, তাও যখন বুঝলি না, আমাদের কাছেও তুই তাহলে মৃ’ত। যা তোর এই পাপী চেহারা দেখাবি না আমাদের কেন দিন।”
এমন সময় পারভীনের স্বামী লিটন বললেন-
: ” কি শুরু করলা তুমি পারভীন? বাচ্চা মানুষ না বুঝে ভুল করে ফেলেছে”
আগের চেয়েও কঠিন গালায় পারভীন বললো-
: ” যে বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও এমন স্বীদ্ধান্ত নিতে পারে
সে আবার কিসের বাচ্চা। ওর হয়ে তোমার তোমার দালালী করা লাগবে না” এরপর মীরা আর রাজীবকে উদ্দেশ্য করে পারভীন বলে-
: “এই বের হ আমার বাড়ি থেকে, তোকে দেখলেই আমার হাত পা জ্বলে ”
অসহায় চাহনিতে তাকিয়েও কোন লাভ হলো না মীরার। তাদেরকে বের করে অনেক জোরে দরজাটা আটকে দিলেন পারভীন। মীরা কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলো, রাজিবের চোখমুখ শক্ত। এত অপমান এর আগে কোন দিন কেও করে নি ওকে। আবীরের ফুফু মহিলাটাকে চাবিয়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয় ওর। আর এই মহিলাও কম কি, মীরার আত্মীয় বলে চুপচাপ সহ্য করলো সব তা নাহলে……
মীরার জীবণে দুঃসময় শুরু হয়েছে তা মীরা ঠিক টের পেয়েছে। গতকাল বিকেলে মীরা আর রাজীব কোর্টে বিয়ে করে তারপর সোজা গিয়েছিল রাজিবদের বাড়িতে। ততক্ষণে তাদের সব জানা হয়ে গেছে ছেলের খবর। রাজিবের মা ওদেরকে বাড়িতে উঠতে দেয় নি। কারন মীরা রাজিবের অযোগ্য তা না, রাজিবের বড় ভাই এখনো অবিবাহিত। তাকে রেখে রাজীব বিয়ে করেছে এটাই ওর অপরাধ। তিনি অশ্রাব্য ভাষায় কিছু কথা শোনালেন মীরাকে। যেন সব দোষ মীরার। মীরা নাকি তার ছেলের মাথা খারাপ করেছে। আর মীরার যে আগে বিয়ে হয়েছিল আবীরের সাথে তা আর তাদের অজানা নেই রাজীবের বোন এসে আরো কথা শেনালো ওদেরকে। ভাইকে এও বললেন- দুনিয়াতে কি মেয়ের আকাল পরছে যে বিয়াইত্তা মেয়ে বিয়ে করা লাগবে তোর? হারামজাদা। এই মা*গী আমার ভাইকে কি দেখিয়ে ভুলাইছে আল্লাহ জানে”
এতকিছুর পরও ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো ওরা দুজন। যদি একটু জায়গা দেয় ওদেরকে। কিন্তু সে আশার গুরে বালি। রাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকেও ঢুকতে দেয়া হয়নি দুজনের কাওকেই।
রাত এগারোটা,
রাস্তায় হাঁটছে দুজন, কি করবে কোথায় যাবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না ওরা। রাজিবের আত্নীয় স্বজন ঢাকায় তেমন নেই বললেই চলে। আর মীরার কোন আত্নীয় ওকে ঠাঁই দিবে না তা জানে মীরা। উপায়ন্তর না দেখে রাজীব ওর মালিকের বাসায় যায়। তাসলিমা ভাবির বাসায় এখন যাওয়াও সম্ভব না। কারন আজ সকালে তাদের বাড়িতে মেহমান এসেছে গ্রাম থেকে। এজন্য ভাবি ওদের বিয়ে তে থাকতে পারে নি।
ওর মালিকের বাড়ি বংশাল। একটা রিকশা নিয়ে রওনা হলো দুজনে। সাড়ে এগারোটা নাগাদ পৌঁছে গেলো ওরা সেখানে। মালিক ওদেরকে দেখে অখুশি হলো। তার দোকানে মীরার বাড়ির লোকজন এসেছিলো গতকাল। সেদিন রাজিব অস্বীকার করেছিলো মীরার খোঁজের কথা। এমনকি তারা চলে যাবার পরও মালিক বোরহান ওকে জিজ্ঞেস করেছিলো। তখনো রাজিব অস্বীকার করেছে। তাহলে আজ এসবের মানে কি। রাজিব বোরহানের হাতে ধরে। বলে – ওদের যাওয়ার কেন জায়গা নাই।
মালিকের স্ত্রী জবার মায়া হলো ওদেরকে দেখে। তিনি ওদেরকে বাড়িতে রাখতে অনুরোধ করলো তার স্বামীকে। বোরহান সাহেব কপট রাগ দেখিয়ে স্ত্রী জবাকে বললেন- করো তোমার যা মনে চায়। আজকের রাতটাই শুধু। কাল সকালে চলে যাবা। আর হ্যা তোমাকে আমি চাকরিতেও রাখবো না। রাজিব চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো৷ একটি কথাও বললো না। ও জানে মালিক রাগী হলেও মানুষ ভালো।
পরদিন ওদের চলে যাবার কথা থাকলেও আজ পনেরো দিন হয় ওরা মালিকের বাড়িতে আছে। রাজিব কাজে যাচ্ছে নিয়মিত। মীরা এদিকে জবাকে ঘরের কাজে টুকটাক সাহায্য করে। ক্লাস এইটে পড়ুয়া ছোট মেয়েটাকে পড়ায় বিকেলে । জবার বড় ভালো লাগে মীরাকে। একদিন কথায় কথায় বলে-
: ” তুমি কি দেখে এ ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে পরলে বলো তো? আকাইম্মা ভাদাইম্মা গুলা কি সুন্দর মেয়ে পটিয়ে বিয়ে করে ফেলে। আর আমার ছেলের জন্য মেয়েই পাই না বিয়ে করাবো। মেয়ে সুন্দর হয় তো ফ্যামেলি ভালো না, ফ্যামেলি ভালো হয় তো মেয়ে সুন্দর না। জানো আমি তোমার মতো একটা বৌ খুঁজছি রাহাতের জন্য”
কথাটা শুনে প্রথম বারের মতো জবাকে খরাপ লাগে মীরার। কথাটা কেমন কানে বাজে ওর।
তবুও ভালোই চলছিলো ওদের নতুন জীবণ। খাওয়া পরার চিন্তা নেই। যেন নিজের বাড়িতেই আছে। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় বাড়িতে কেও ছিলো না। জবার ননদের বাচ্চা হয়েছে সবাই মিলে তাকে দেখতে গিয়েছে। মীরা বাড়িতে একা। এমন সময় বাড়ির কলিং বেল বাজে৷ ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে সাড়ে ছ’টা বাজে, মীরা ভাবে রাজীব আসবে রাত ন’টা নাগাদ।
আজ এত জলদি রাজিব এসে পরলো ?
গেইট খুলে দেখে জবার বড় ছেলে রাহাত। রাহাতকে দেখে মীরা দ্রুত ওর ঘরে চলে যেতে নেয়। ও মীরাকে জিজ্ঞেস করে –
: বাড়ির সবাই কোথায়?
মীরা হাঁটা থামিয়ে উত্তর দেয় –
: “আপনার ছোট ফুফুর বাড়িতে গেছে ”
: ” ও”
রাহাত ছেলেটাকে কেমন যেন পছন্দ হয় না মীরার। কেমন কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যখনি মীরা ওর দিকে তাকায় তখনি দেখে রাহাতের দৃষ্টি হয় ওর বুকে না’হয় কোমরে। মীরা হাঁটতে হাঁটতে ওড়না মেলে পুরো শরীরটাকে আবৃত করলো ওর দৃষ্টি থেকে বাঁচতে।
মিনিট দশেক পর, ওর রুমের দরজায় নক করলে রাহাত, “চোর হলেও ইমানদার” ভাব। বললো ওকে চা করে দিতে৷ অনন্যোপায় মীরা গেলো রান্নাঘরে। কোনমতে চা তৈরী করে ওকে দিতে ঘুরতেই দেখে রাহাত ওর পিছনে দাঁড়িয়ে।
মীরা কেঁপে উঠে ওকে এখানে দেখে। থতমত খেয়ে বলে-
: “আপনার চা ”
চায়ের কাপ ধরতে গিয়ে মীরাকে ছুঁয়ে দেয় রাহাত। মীরার গা রি রি করে। সেখান থেকে বের হতে চেষ্টা করতেই চায়ের কাপ পাশে রেখে পিছন থেকে মীরার হাত ধরে রাহাত, বলে-
: ” এমন রূপ নিয়ে কেন ঐ হতচ্ছাড়াকে বিয়ে করলে তুমি, ও কি তোমার যোগ্য? আমাকে দেখো, আমার বাবার গাড়ি বাড়ি সব আছে। দুদিন পর এ সব কিছুর মালিক হবো আমি। তুমি ওকে ডিভোর্স করে দাও, আমি তোমাকে বিয়ে করবো”
: ” ছাড়েন আমাকে? অসভ্যের মতো কি করছেন, কি বলছেন? হাত ছাড়েন না হলে আমি কিন্তু চিৎকার করবো”
: ” ছাড়তে বললে ছেড়ে দিলাম, তুমি যা বলবে, তাই হবে। চিৎকার করবে বললে। এ বাড়ির চারপাশে কত জায়গা ফাঁকা পরে আছে দেখোনি। কেউ শুনবে না তোমার চিৎকার। আমার তোমাকে ভালো লেগেছে। তাই বিয়ে করবো বলছি। এ মুহূর্তে ইচ্ছে করলে আমি কিন্তু সব পেতে পারি, এতে তোমার অনুমতিও নিতে হবে না আমাকে। কিন্তু আমি ভদ্র ছেলে, তোমাকে ভদ্র প্রস্তাব দিলাম। কালকের মধ্যে জানাবা আমায়। বাকী সব কিছু আমি ম্যানেজ করবো। মা’র তোমাকে বেশ পছন্দ হইছে, বাবাকে ম্যানেজ করতে না পারলে তোমাকে বিয়ে করে আলাদা বাসায় থাকবো। ”
মীরার এসব শোনার ইচ্ছে না থাকলেও শুনতে হচ্ছে, কারন রান্নাঘরের দড়জা আগলে দাঁড়িয়ে আছে রাহাত। মীরা অধৈর্য্যের মতো বললে- ” পথ ছাড়ুন ”
পথ ছাড়তেই দৌড়ে যেতে লাগলো মীরা। রাহাত ল্যাং মেরে ফেলে দিলো ওকে। এরপর হাত বাড়িয়ে দিলো সাহায্যের ভনিতায়। বললো-
” ল্যাং কেন মারলাম জানো? তুমি বা তোমরা দুজন কতো অসহায় তা প্রমাণ করতে”
মাটিতে ভর দিয়ে উঠে দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে দড়জা আটকে দিলো মীরা। কাঁদতে লাগলো ভয় পেয়ে। মনে মনে বলতে লাগলো রাজিব তুমি জলদি বাড়িতে আসো, আমি আর এক মুহূর্ত ও থাকবো না এ বাড়িতে।
চলবে…
Matro 2 porbo prlm,,,,,105 ta porbo,,,,,r ki ki vuul jani ache,,,,allah jane,,,,,🙄🙄🙄
Allah pura golpo porar dhoirjo deo,,,,,,,,