প্রিয় ভুল পর্ব-১০৩+১০৪

0
421

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ১০৩
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

ভালেবাসা আর দুজনের মিষ্টি বোঝাপড়ায় কেটে গেছে ওদের দিন, মাস, বছর। ওর ব্যাবসা গত কয়েক বছরে এমন স্থানে পৌঁছে গেছে যে ওকে এখন আর আগের মতো সময় দিতে হয় না। দেশের নামী দামী সব ডিজাইনার কাজ করে ওদের ব্র্যান্ডের সাথে। বিজিএমইএ এর সভাপতি হিসেবে কাজ করার বদৌলতে দেশ এবং দেশের বাইরে অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে ওর। না তার মানে এই না যে নিজে সভাপতি হওয়ার ফায়দা নিয়েছে ও৷ কাজের চাতুর্যতায় ও এমনটা পেরেছিলো, সভাপতির পরিচয় ছিলো বাড়তি পাওনা। বিদেশী বায়াররা পণ্যের গুণগত মানকে, কাজকে মূল্যায়ন করে কাজের মালিকানাকে নয়। তবে এটা সত্যি যে এ পদ ওকে এমন জায়গায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে যেখান থেকে বিজনেসটাকে ও দেখতে পেরেছে অন্য এঙ্গেল থেকে, যা ওকে পৌঁছে দিয়েছে অন্য লেভেলে। একেকজনের সমস্যা, প্রতিকূলতা দেখে শিখেছে মোকাবিলার ধরন, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকার অনুপ্রেরণা, সৃজনশীলতা সহ অনেক কিছু।

কাজের দায়িত্ব ভাগাভাগি করে দিলেও এখনো মীরা ডিজাইন রিচেক, ফাইনাল টাচ্ দিতে ভুলে না। তবে সবদিক দেখে সারাদিনের কাজকর্মে ক্লান্ত মীরা কখনোই সংসারের দায়িত্বে অবহেলা করে নি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সংসারকে গুরুত্ব না দিয়ে সংসারের ফাঁকে ফাঁকে কাজকে শিডিউল করে নিয়েছে। ঘর সামলানোর জন্য মাজেদা খালা এখনো আছেন ওর পাশে। আগে বিজনেস, সংসার, সন্তান মীরাকে সবটা দেখতে হয়েছে এখন আবীর আসার পর থেকে সেটা সহজ হয়েছে। আবীর ওর জীবণে আসার পর দুঃসাহসী মীরা হয়েছে আরো অপ্রতিরোধ্য। আগে যখন মালামাল কিনবার ব্যাপার হোক, কিংবা কোন মিটিং এ এ্যাটেন্ড করা সবার আগে ভাবতে হতো কতগুলো শকুনের দৃষ্টি থেকে নিজের আত্নরক্ষায় ব্যাপারটা। একটা বিবাহিত মেয়ের জায়গা সকলের চোখে আলাদা সম্মানের। কারন তখন সকলের মাথায় বাজিয়ে দেখি একটু! – এ চিন্তাটা থাকে না। ফিওনার প্রতি মীরা কৃতজ্ঞ। সামাজিক স্থিতির এ দিকটা ওর অবগত ছিলো না যেন। চোখের উপরে আত্মসম্মানের নামে অহং, আর অজ্ঞতার যে পর্দা ছিলো তা সরিয়ে দিয়েছে ও এক নিমেষে।

মীরা বিজিএমইএ এর দায়িত্ব পালনের দ্বিতীয় অর্ধেকের দিকে হঠাৎই পড়াশোনায় মনোনিবেশ করে। দুই বছর সুনাম আর নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন শেষে পুরোপুরি মনোযোগ দিয়েছে পড়াশোনা আর সংসারে।
একটা পুরো বছর ডেডিকেটেড পড়াশোনার পর ওর স্বপ্ন হয়েছে সত্যি। দেশের বাইরে ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়াশোনা করার ইচ্ছে থেকে শুরু হওয়া স্বপ্ন শেষ হয়েছিলো পৃথিবী বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনিং প্রতিষ্ঠান এফ.আই.টি এ পড়ার সুযোগের মধ্য দিয়ে। মীরা নিজেও এতটা আশা করে নি। মেন্টরের পরামর্শে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন ফ্যাশন ডিজাইনিং স্কুলে এপ্লাই করলেও পৃথিবী বিখ্যাত এফ.আই.টি এ পড়ার সুযোগ পাবে তা ও ভাবে নি। ইচ্ছে ছিলে লন্ডন ‘কলেজ অফ ফ্যাশনে’ পড়বে। লন্ডন শহরটা ওকে বেশ টানে। কিন্তু আমেরিকার এফ.আই.টি এ পড়বার সুযোগ প্রত্যাশার পারদের সর্বোচ্চ সীমানা ছুঁয়ে ওকে করেছে ধন্য। সবকিছু ঠিক থাকলে আসছে জুনে দেশ ছাড়ছে মীরা নিউইয়র্কের উদ্দ্যেশ্যে। প্রাপ্তির মুকুটে যুক্ত হবে সাফল্যের আরো একটি পালক। দেশে ছাড়ার আগে ব্যাবসার সবটা ফাহাদ আর আবীরকে বুঝিয়ে দিয়ে পাড়ি জমাবে ও। মীরার সফর সঙ্গী ছোট্ট নূহা। ওরা উঠবে আবীরের বোন ফিওনাদের বাড়িতে৷ ওরা এখন নিউইয়র্ক এর পার্শ্ববর্তী শহর ফিলাডেলফিয়ায় থাকে। খোদার কি লীল! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাণ কেন্দ্র নিউইর্য়কে ও যাবে এটা সত্যি আগে থেকেই নির্ধারিত ছিলো। তাই হয়তো ফিওনার বর প্রোমোশন পেয়ে উনার কোম্পানির ফিলাডেলফিয়ায় ব্রাঞ্চে শিফট হয়েছে আজ দুই বছর। আপাততঃ মীরা সেখানেই উঠবে। সত্যি বলতে বাধ্য হয়েছে ও সেখানে উঠতে৷ ফিওনা এত কাছাকাছি থেকে মীরাকে অন্য কোথাও উঠতে দিবে না। আবীরের ও যাওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু ব্যবসাটাও দেখা জরুরি ভেবে আবীরের দেশে থকাটাকেই বেশী গুরুত্ব দিয়েছে ওরা। একটা মোটে বছর কেটে যাবে দেখতে দেখতে।

অবশেষে নূহাকে নিয়ে মীরা রওনা দিলো নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে। এয়ারপোর্ট থেকে ফিওনা আর ওর বর রিসিভ করেছে ওকে। সেখানকার পরিবেশ, নিয়মকানুন, রাস্তাঘাট সবই নতুন ওর কাছে। ফিওনা নিজে মীরাকে পথঘাট, নিয়মকানুন সম্পর্কে দীক্ষা দিয়েছে। ইউনিভার্সিটির প্রথম দিনে নিজে ড্রাইভ করে পৌঁছে দিয়েছে মীরাকে। নূহাও ফুফু, ফুফাতো ভাই বোনদের সান্যিধ্যে প্রাণবন্ত। কথায় কথায় ও একদিন আক্ষেপ করে ওরা ভাইবোন একসাথে খেলে, ওর নিজের একটা ভাই থাকলে ভালো হতো। নূহার কথাটায় মীরা অস্বস্তি ফিল করলেও ফিওনার বর রুহুল আমীন বিষয়টা লাইটলি এভয়েড করে। রাতে ফিওনা মীরাকে এ ব্যাপারে ওদের কোন প্ল্যান আছে কি-না জানতে চায়। ফিওনা বলে-
“দেখো মীরা ব্যাপারটা যদিও তোমাদের ব্যাক্তিগত তবুও বলবো এবার মনে হয় তোমাদের এ বিষয়টা নিয়ে ভাবা উচিত”

কথাটা শুনে মীরা চিন্তিত মুখে বলে-
: “আমরা সত্যি চেষ্টা করছি, সবটা আল্লাহর হাতে”
ফিওনা মীরার মুখ বিবর্ণ হওয়ায় জিজ্ঞেস করে –
: “এ বিষয়ে কথা বলায় তুমি কি কিছু মনে করেছো মীরা?”
: “না ফিওনা, আমার কিছু সমস্যার দরুন দেরী হচ্ছে, কিন্তু সমাজ আবীরের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে”
: “ডাক্তার কি বলেছেন?”
: “বলেছেন সময় লাগবে”
: “তোমারা চেষ্টা করতে থাকো, দেখো কি হয়”
: “এখন তো আবার বছরের দূরত্ব হয়ে গেলো”
: “ভেবো না,দেখতে দেখতে চলে যাবে সময়, এসব নিয়ে আমরা ভাবছি না, আমার ভাই স্ত্রী কন্যা নিয়ে ভালো আছে এতেই আমরা সুখী”
মীরার ভীষণ ভালো লাগে নূহাকে নিয়ে ওদের ভাইবোনদের এমন পজেসিভ কথাবার্তায়। যেন নূহা সত্যি আবীরেরই অংশ।

নতুন পরিবেশ, পড়াশোনা, নানা দেশের নতুন বন্ধুবান্ধব সবকিছু মিলিয়ে এক অন্য ভূবণে নাম লিখিয়েছে ও। জীবণ ভুল সময়ে ভুল মানুষ এসে পরায়
হাসি, আনন্দে এক্সপ্লোর করার সময় ছাত্রজীবনটাকে পার করতে হয়েছে নজরবন্দী থেকে, তারপরের অংশটুকু জীবণের সাথে যুদ্ধ করে। নতুন এ জীবণটাকে ও খুব করে উপভোগ করছে নতুন করে৷ কলেজের পরীক্ষার বইগুলো জোগাড় করে দিয়েছিলো ওর বন্ধু আর কোচিং এর ভাইয়ারা। সে সব কথা, সে সব দিন ভুলেনি মীরা।

ক্লাসে হঠাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে যায় মীরা। ক্লাসের মাঝখানেই টিচারকে জানায় ওর অসুস্থতার কথা। একা মীরা বাড়িতে যেতে পারবে কিনা তা জিজ্ঞেস করে টিচার, প্রয়োজনেফ সাথে কাওকে দিবে। মীরা তাকে বলে ও কমনরুমে কিছুক্ষণ রেস্ট করে তারপর বাসায় যাবে। কিছুটা গুড ফিল হওয়ায় একাই বাসায় পৌঁছে যায় ও। ভেবেছে হোম সিকনেস হয়তো। এ দেশে এসে মীরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে ওর জীবণের, ওর অস্তিত্বের ঠিক কতটুকু বেদখল হয়ে গেছে আবীরের কাছে। প্রেম করার সুযোগ হয়নি ওদের, সময় আর স্থানের দূরত্ব সে আক্ষেপ ঘুঁচিয়েছে এবার। আবীর রয়েছে ৭৮৬৩ মাইল দূরের দেশে, সময়ের হিসাবও দুই দেশে দুই রকম, রাত জেগে কথা বলার কারনে মীরার ঘুম হয়না ঠিকঠাক। মীরা ভাবে বাসায় গিয়ে ঘুম দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বাসায় গিয়ে ওর শরীর আরো অসুস্থ হয়ে পরে। এই অসুস্থতা, এমন খারাপ লাগাটা যেন মীরার পরিচিত। সন্দেহের বর্শবর্তী হয়ে ফিওনাকে ব্যাপারটা বলে মীরা। ফিওনা পাত্তা দেয় না, কারন ওর অসুখের কথাটা এই সেদিনই মীরা বলেছে ওকে। এসব ব্যাপারে উৎসাহ দেখালে পরে নেগেটিভ কিছু হলে কষ্ট পাবে বেচারী তাই তেমন উৎসাহ দেখায় না ও। বলে ডাক্তারের কাছে এ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে রাখবো। পরদিন থেকে শরীর আরো খারাপ হয়, গা-গোলানো ভাবটায় পুরোপুরি নিশ্চিত হয় মীরা। ফিওনা মেডিকেল শপ থেকে প্রেগন্যান্সির কিট এনে দেয় মীরাকে। বাথরুমে ঢুকে চেক করার পর কীট হাতে অনেকক্ষণ বসে থাকে মীরা। নূহা দরজা নক করে ডাকতে থাকে মাকে। ওর ডাকেই সংবিৎ ফিরে যেন ওর। বের হয়ে দেখে নূহা বসে আছে বাহিরে। খুশির এ খবরটা সবার আগে মীরা নূহাকেই জানায়৷ নূহাকে আগলে ধরে মীরা বলে- “নূহা বড় বোন হিসেব তুমি প্রমোশন পেতে যাচ্ছো”

মীরার জটিল এ কথার কিছুই বুঝে না ছোট্ট নূহা, মায়ের হাতে কীটটা দেখে জিজ্ঞেস করে “এটা কি”
উত্তরে মীরা বলে- “তোমার প্রোমশন-পত্র”
কিছু না বুঝেই দৌড়ে যায় নূহা ফুফুর কাছে, প্রোমোশন শব্দটার সাথে পরিচয় আছে ওর, ব্যাপাটা পজেটিভ কিছু তাও জানে ও। ফিওনা একটু পরেই আসে মীরার কাছে, মীরার চোখেমুখে অন্যরকম আভাই সবটা যেন বলে দিলো ফিওনাকে৷ মীরাকে জড়িয়ে ধরে ফিওনা কেঁদে দেয়। দোয়া করে- “ছেলে মেয়ে যাই হোক, সুস্থ একটা বাচ্চা আসুক তোমাদের ঘর আলো করে এই দোয়াই করি। ভাইয়াকে খবরটা বলেছো?

দুপাশে মাথা নেড়ে না বলে মীরা, ফিওনা আবার মীরার কাছে গিয়ে বলে ” খুশির এ খবরটা জলদি জানাও তাকে”

মীরার চোখ-মুখে লাজুকতা ছেঁয়ে গেলো। ফিওনা বললো-
: “খবরটা কি আমি দিবো”
চোখ তুলে তাকায় মীরা ফিওনার দিকে, ফিওনা ঘড়িতে তাকায়, দেশে এখন সময় ভোর চারটা, এখন জানানো ঠিক হবে না ভুল তা না ভেবেই ফিওনা কল করে আবীরকে৷ মীরার হঠাৎ এ অসুস্থতার কথা জানে আবীর। তবে এ অসুস্থতা যে ওর অক্ষমতার কুয়াশা দূর করতে আবির্ভূত হয়েছে তা হয়তো ভাববার অবকাশ দুজনের কেউই পায়নি। গত একটা বছর ধরে চেষ্টা করছে দুজনে। আবীরের এ বিষয়ে তেমন মাথাব্যাথা না থাকলেও মীরা ছিলো মরিয়া৷
মিরাকল হ্যাপেনস্।

ফিওনার সাথে কথা শেষ করে আবীর কল করে মীরাকে। লজ্জায় মীরা কথাই বলতে পারছেনা, উত্তর দিচ্ছে হু-হা তে। আচ্ছা এতে লজ্জার আছে কি? সব মেয়েরাই এ ব্যাপারটায় কেমন যেন লজ্জায় গুটিয়ে যায়।

এর ঠিক একমাসের মাথায় একদিন সকালে (সেদিন মীরার কোন ক্লাস না থাকায় মীরা বাড়িতেই ছিলো) কলিংবেলের শব্দে ফিওনা ব্যাস্ত থাকায় দরজা খুলতে যায় মীরা। দরজা খুলে ভীষণরকম অবাক হয় ও, কারন ওর সামনে হাস্যজ্জ্বল মুখে লাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওর অনাগত সন্তানের পিতা আবীর!

চলবে……

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ১০৪.১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

মীরা বিশ্বাসই করতে পারেনি যে সত্যি আবীর ওর সামনে দাঁড়ানো। চৌকাঠে দাঁড়ানো মীরাকে তৎক্ষনাৎ উষ্ণ আলিঙ্গনে আবীরের জড়িয়ে ধরাটা যেন সংবিৎ ফেরায় ওর।

সেদিন রাতে ”না জানিয়ে হঠাৎ কেন এলো এখানে? মীরার এমন প্রশ্নে আবীর বলেছে- “টাকাপয়সা, কাজ তো আসবে যাবে জীবণে কিন্তু এই সময় আর আসবে না মীরা। আমি আমাদের এই যাত্রাটাকে উপোভোগ করতে চাই, দেখতে চাই কাছ থেকে। তাছাড়া এ সময়ে আমার পাশে থাকাটাও কম জরুরী না। শেষের কথাটা একটু গর্বের ভঙ্গিতে বলে আবীর, মুচকি হেসে মীরা নাক টিপে দেয় ওর।

এ অবস্থায় ফিলাডেলফিয়া থেকে মীরার ক্লাস করতে যেতে সমস্যা হবে ভেবে আবীর ওর ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে। খরচা একটু বেশী হলেও সেখানে গড়ে ওঠে ওদের তিনজনের নতুন সংসার। বড় বোন হলে তাও কথা ছিলো, কিন্তু ছোট বোনের বাসায়, সত্যি বলতে আবীরের ভালো লাগছিলো না ফিওনাদের বাসায় থাকাটা। ওর একটু প্রাইভেসি দরকার ছিল। একটা দীর্ঘ সময় থাকা হবে যেহেতু সেখানে তাই আলাদা বাসা নেয়াটাকেই শ্রেয় মনে করেছে ও। তবে ওদের নতুন বাসা ফিওনা যথাসম্ভব গোছগাছ করে দিয়ে গেছে। ফোনে খোঁজখবর নিচ্ছে নিয়মিত।

এরপর পরবাসে কাটানো দিনগুলোতে প্রেম নেমে এসেছিলো মীরা-আবীরের জীবণে। এই প্রেম যেন দু’জনকে নতুন করে চিনে নেবার, নতুন করে জানার। কারন জীবণের দৌঁড়ে এতটা ফুরসত পায়নি ওরা এর আগে। একটা ঘটনা বললে পরিষ্কার হবে বিষয়টা- আবীর নিজেদের ফ্ল্যাটে আসার পর একদিন গোসল শেষে টাওয়ালে সব চুল মুড়িয়ে নিয়ে আবীরের সামনে দাঁড়ায় মীরা, ব্যাস্ত ভঙ্গিতে জানতে চায় – “বলুন তো আমার চুলের রঙ কি?” যেন কঠিন কোন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো ও আবীরের দিকে। প্রশ্ন শুনে আধশোয়া থেকে উঠে বসে আবীর, চোখমুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায় ওর, ভাবসাব দেখে হাল ছেড়ে দেয়া ভঙ্গিতে হাত ছাড়িয়ে নেয় মীরা। মুখ বাকিয়ে বলে- “জানতাম পারবেন না আপনি” বলেই কাপড়গুলো আমারিতে তুলতে যায় ও। উঠে আবীর মীরার কাছে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বলে-

: “তোমার চুল স্ট্রেইট এবং ন্যাচারাল শাইনি। কুচকুচে কালো নয়, কালো আর বাদামী রঙের মিশেল, ”

বলেই চোখ খোলে আবীর, যেন চোখের পাতা বন্ধ করে সেখানটায় থাকা লেখাটা দেখে বলে দিলো ও। তারপর কপট ত্রস্ত ভঙ্গিতে বলে- “কি ঠিক হয়েছে?”

যেন উত্তর ঠিক না হলে কঠিনতম শাস্তির বিধান রয়েছে ওর জন্য স ভয়ে ও ত্রস্ত।

উত্তর শুনে মুচকি হাসে মীরা। ওর কাছে এসে চুল পেচিয়ে রাখা তোয়ালেটা আবীর খুলে ফেলে সযত্নে। তারপর বলে- “আমাকে জব্দ করা এত সোজা না বুঝলে মীরা, তুমি অন্ততঃ তোমার সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করো না, সেই ছোট্ট বেলা থেকে দেখছি, তোমাকে আমি তোমাকে তোমার চেয়েও বেশী চিনি”

কথাটা অতিরঞ্জিত শোনালেও সত্যি। বিবাহিত জীবণের গত তিনটা বছরে মীরা প্রমাণ পেয়েছে এ কথার সত্যতা।

নতুন ফ্ল্যাটে অনেক ভালো সময় কাটে ওদের। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় কেটেছে মীরার এখানে। আবীরও তাই।

এখানে আসার পর আবীরের কাজকর্ম বলতে তো কেবল ফোনে খোঁজ নেয়া, বাকীটা সময় দুজনে মিলে সামলায় তিনজনের সংসারটাকে। নূহাও আবীরের দেখাদেখি মায়ের সেবা করে। বাপবেটি দুজনে যেন মীরার সেবায় ব্রতী। অনাগতের জন্য তাদের উচ্ছাসের শেষ নেই।

বাপবেটি দুজনে প্রায়ই গুটুর গুটুর করে। দেখলে মনে হবে নূহা না কোন বিশিষ্ট ব্যাক্তির সাথে কথা বলছে আবীর। এমনি মনযোগ এবং গুরুত্ব থাকে ওর নূহার কথায়। একদিন মীরা লুকিয়ে শোনে ওদের দু’জনের কথা, ওদের কথার বিষয়বস্তু “নূহা ভাই চায় না বোন” যেন নূহার চাওয়ার উপর নির্ভর করছে সব। নূহা বললো ওর একটা ভাই চাই। ভাই-ই কেন চাই? এমন প্রশ্নের উত্তরে নূহা বলেছে- ও ওর ভাইকে যত্ন করবে, গোসল করাবে, খাবার খাইয়ে দিবে, ঘুম পাড়াবে।

একটু ভেবে আবীর বললো- এটা তো তুমি বোনের বেলাও করতে পারবে। ভেবে দেখো বোন হলে ভালো হতো না? তুমি তো আমাদের মেয়ে আছোই, তোমার আরো একটা বোন আসলে ভালো হতো না?

একটু ভেবে নূহা বলে-

: “বোন থাকা ভালো কিন্তু ফিহা (ফিওনার ছেলে) ওর বোনকে ধরে মারে, ওর সব জিনিস, জামাকাপড় নিয়ে নেয় এইজন্যই তো আমার বোন পছন্দ না। শুনে আবীর হাসতে থাকে৷ আর বলে-

: ” ভাই-ই চাই তোমার?”

: “হ্যা বাবা, ভাই-ই চাই,

: “কি আর করা আমরা তাহলে আল্লাহকে বলি তিনি যেন একটা ভাই পাঠান তোমার জন্য”

: “তাই করছি আমি নামায পড়র সময়”

হেসে আবীর বলে-

: “কাল থেকে আমিও করবো ”

আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে মীরা দোয়া করে খোদার কাছে। ওদের ইচ্ছে যেন পূরণ হয়।

পুরোটা সময় আবীর মীরা আর নূহার খেয়ালে মগ্ন। মীরার শারিরীক কিছু সমস্যার জন্য বাড়তি যত্ন আবীরের মীরার প্রতি। সময় মত খাওয়া, হাঁটা, বিশ্রাম, মেডিটেশন, সবকিছু রুটিনে বেঁধে দিয়েছে আবীর। সাথে দেখছে নূহার পড়াশোনার দিকটাও। নানান ঘাটে পোড় খাওয়া মীরা সত্যি অবাক হয় ওর স্বামী ভাগ্যে। অথচ নূহা পেটে ছিলো যখন, কি নিদারুণ কষ্টে কেটেছে ওর সে সময়টা। প্রেগ্ন্যাসির পুরো জার্নিটাতে গোটা দিন কারখানায় সময় দিতে হয়েছে ওকে, রাতে ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসতে চাইতো। না পেয়েছে অবসর, না যত্ন। ক্লান্তিতে ঘুমোতে যেতো ও উঠতো ক্লান্তি নিয়ে। টেককেয়ার করবে তো দূরের কথা,ডাক্তার দেখানোর ব্যাপারটায়ও সময় দিতে পারতো না রাজিব।

এসব ভাবনায় যখন মন পুড়ে মীরার, সময় তখনি কোত্থেকে হাজির করে আবীরকে। ওর যত্ন ভালোবাসা মীরার সব দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দেয়।

এদিকে সময় ঘনিয়ে আসে নতুন অতিথির আগমনের।

নূহা আছে বলে মীরা মনেপ্রাণে চাইছে ওর একটা ছেলে হোক। অবশেষে জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহে আবীর মীরার ঘর আলো করে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়।

পুত্রকে প্রথম বারের মতো কোলে নিয়ে মীরার চোখের পানির বাঁধ ভাঙে। এ মানবশিশু কেবল ওদের সন্তানই না, এটা আবীরের অক্ষমতা নিয়ে সমাজের করা কটুক্তির জবাব। এ বিষয়ে আবীরের কেন হেলদোল নেই। ছোট বাচ্চা কোলে নেয়ায় ওর বেশ ভয়। তবুও ওখানে থাকার সময়টা আবীর মধূ্ুর করেছে ওর যত্নে ভালোবাসায়।

দুই পরিবারের সবাই খুশি মীরার ছেলের খবরে। সকলে অপেক্ষায় রয়েছে কবে দেশে ফিরবে ওরা। মীরার ছেলের জন্য একেকজন একেকটা নাম রেখেছে। তবে শেষ পর্যন্ত মীরার রাখা নামটাই

টিকে সকলের বিপরীতে। “ফালাক”

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ১০৪
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

মীরা বিশ্বাসই করতে পারেনি যে সত্যি আবীর ওর সামনে দাঁড়ানো। চৌকাঠে দাঁড়ানো মীরাকে তৎক্ষনাৎ উষ্ণ আলিঙ্গনে আবীরের জড়িয়ে ধরাটা যেন সংবিৎ ফেরায় ওর।

সেদিন রাতে ”না জানিয়ে হঠাৎ কেন এলো এখানে? মীরার এমন প্রশ্নে আবীর বলেছে- “টাকাপয়সা, কাজ তো আসবে যাবে জীবণে কিন্তু এই সময় আর আসবে না মীরা। আমি আমাদের এই যাত্রাটাকে উপোভোগ করতে চাই, দেখতে চাই কাছ থেকে। তাছাড়া এ সময়ে আমার পাশে থাকাটাও কম জরুরী না। শেষের কথাটা একটু গর্বের ভঙ্গিতে বলে আবীর, মুচকি হেসে মীরা নাক টিপে দেয় ওর।

মীরার এ অবস্থায় ফিলাডেলফিয়া থেকে মীরার ক্লাস করতে যেতে সমস্যা হবে ভেবে আবীর ওর ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে। খরচা একটু বেশী হলেও সেখানে গড়ে ওঠে ওদের তিনজনের নতুন সংসার। বড় বোন হলে তাও কথা ছিলো, কিন্তু ছোট বোনের বাসায়, সত্যি বলতে আবীরের ভালো লাগছিলো না ফিওনাদের বাসায় থাকাটা। ওর একটু প্রাইভেসি দরকার ছিল। একটা দীর্ঘ সময় থাকা হবে যেহেতু সেখানে তাই আলাদা বাসা নেয়াটাকেই শ্রেয় মনে করেছে ও। তবে ওদের নতুন বাসা ফিওনা যথাসম্ভব গোছগাছ করে দিয়ে গেছে। ফোনে খোঁজখবর নিচ্ছে নিয়মিত।

এরপর পরবাসে কাটানো দিনগুলোতে প্রেম নেমে এসেছিলো মীরা-আবীরের জীবণে। এই প্রেম যেন দু’জনকে নতুন করে চিনে নেবার, নতুন করে জানার। কারন জীবণের দৌঁড়ে এতটা ফুরসত পায়নি ওরা এর আগে। একটা ঘটনা বললে পরিষ্কার হবে বিষয়টা- আবীর নিজেদের ফ্ল্যাটে আসার পর একদিন গোসল শেষে টাওয়ালে সব চুল মুড়িয়ে নিয়ে আবীরের সামনে দাঁড়ায় মীরা, ব্যাস্ত ভঙ্গিতে জানতে চায় – “বলুন তো আমার চুলের রঙ কি?” যেন কঠিন কোন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো ও আবীরের দিকে। প্রশ্ন শুনে আধশোয়া থেকে উঠে বসে আবীর, চোখমুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায় ওর, ভাবসাব দেখে হাল ছেড়ে দেয়া ভঙ্গিতে হাত ছাড়িয়ে নেয় মীরা। মুখ বাকিয়ে বলে- “জানতাম পারবেন না আপনি” বলেই কাপড়গুলো আমারিতে তুলতে যায় ও। উঠে আবীর মীরার কাছে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বলে-

: “তোমার চুল স্ট্রেইট এবং ন্যাচারাল শাইনি। কুচকুচে কালো নয়, কালো আর বাদামী রঙের মিশেল, ”

বলেই চোখ খোলে আবীর, যেন চোখের পাতা বন্ধ করে সেখানটায় থাকা লেখাটা দেখে বলে দিলো ও। তারপর কপট ত্রস্ত ভঙ্গিতে বলে- “কি ঠিক হয়েছে?”

যেন উত্তর ঠিক না হলে কঠিনতম শাস্তির বিধান রয়েছে ওর জন্য সে ভয়ে ও ত্রস্ত।

উত্তর শুনে মুচকি হাসে মীরা। ওর কাছে এসে চুল পেচিয়ে রাখা তোয়ালেটা আবীর খুলে ফেলে সযত্নে। তারপর বলে- “আমাকে জব্দ করা এত সোজা না বুঝলে মীরা, তুমি অন্ততঃ তোমার সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করো না, সেই ছোট্ট বেলা থেকে দেখছি, তোমাকে আমি তোমাকে তোমার চেয়েও বেশী চিনি”

কথাটা অতিরঞ্জিত শোনালেও সত্যি। বিবাহিত জীবণের গত তিনটা বছরে মীরা প্রমাণ পেয়েছে এ কথার সত্যতা।

নতুন ফ্ল্যাটে অনেক ভালো সময় কাটে ওদের। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় কেটেছে মীরার এখানে। আবীরও তাই। সঙ্গিহীন সেই বিমর্ষ জীবণ যেন এখন গল্প।

এখানে আসার পর আবীরের কাজকর্ম বলতে তো কেবল ফোনে খোঁজ নেয়া, বাকীটা সময় দুজনে মিলে সামলায় তিনজনের সংসারটাকে। নূহাও আবীরের দেখাদেখি মায়ের সেবা করে। বাপবেটি দুজনে যেন মীরার সেবায় ব্রতী। অনাগতের জন্য তাদের উচ্ছাসের শেষ নেই।

ওরা দুজনে প্রায়ই গুটুর গুটুর করে। দেখলে মনে হবে নূহা না কোন বিশিষ্ট ব্যাক্তির সাথে কথা বলছে আবীর। এমনি মনযোগ এবং গুরুত্ব থাকে ওর নূহার কথায়। একদিন মীরা লুকিয়ে শোনে ওদের দু’জনের কথা, ওদের কথার বিষয়বস্তু “নূহা ভাই চায় না বোন” যেন নূহার চাওয়ার উপর নির্ভর করছে সব। নূহা বললো ওর একটা ভাই চাই। ভাই-ই কেন চাই? এমন প্রশ্নের উত্তরে নূহা বলেছে- ও ওর ভাইকে যত্ন করবে, গোসল করাবে, খাবার খাইয়ে দিবে, ঘুম পাড়াবে।

একটু ভেবে আবীর বললো- এটা তো তুমি বোনের বেলাও করতে পারবে। ভেবে দেখো বোন হলে ভালো হতো না? তুমি তো আমাদের মেয়ে আছোই, তোমার আরো একটা বোন আসলে ভালো হতো না?

একটু ভেবে নূহা বলে-

: “বোন থাকা ভালো কিন্তু ফিহা (ফিওনার মেয়ে) ওর বোনকে ধরে মারে, ওর সব জিনিস, জামাকাপড় নিয়ে নেয় এইজন্যই তো আমার বোন পছন্দ না। শুনে আবীর হাসতে থাকে৷ আর বলে-

: ” ভাই-ই চাই তোমার?”

: “হ্যা বাবা, ভাই-ই চাই,

: “কি আর করা, আমরা তাহলে আল্লাহকে বলি তিনি যেন একটা ভাই পাঠান তোমার জন্য” নুহা শান্ত গলায় বলে-

: “তাই করছি আমি নামায পড়র সময়”

হেসে আবীর বলে-

: “কাল থেকে আমিও করবো ”

আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে মীরা দোয়া করে খোদার কাছে। ওদের ইচ্ছে যেন পূরণ হয়।

পুরোটা সময় আবীর মীরা আর নূহার খেয়ালে মগ্ন। মীরার শারিরীক কিছু সমস্যার জন্য বাড়তি যত্ন আবীরের মীরার প্রতি। সময় মত খাওয়া, হাঁটা, বিশ্রাম, মেডিটেশন, সবকিছু রুটিনে বেঁধে দিয়েছে আবীর। সাথে দেখছে নূহার পড়াশোনার দিকটাও। নানান ঘাটে পোড় খাওয়া মীরা সত্যি অবাক হয় ওর স্বামী ভাগ্যে। অথচ নূহা পেটে ছিলো যখন, কি নিদারুণ কষ্টে কেটেছে ওর সে সময়টা। প্রেগ্ন্যাসির পুরো জার্নিটাতে গোটা দিন কারখানার কাজে সময় দিতে হয়েছে ওকে, রাতে ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসতে চাইতো। না পেয়েছে অবসর, না যত্ন। ক্লান্তিতে ঘুমোতে যেতো ও উঠতো ক্লান্তি নিয়ে। টেককেয়ার করবে তো দূরের কথা,ডাক্তার দেখানোর ব্যাপারটায়ও সময় দিতে পারতো না রাজিব।

এসব ভাবনায় যখন মন পুড়ে মীরার, সময় তখনি কোত্থেকে হাজির করে আবীরকে। ওর যত্ন ভালোবাসা মীরার সব দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দেয়।

এদিকে সময় ঘনিয়ে আসে নতুন অতিথির আগমনের।

নূহা আছে বলে নুহার মতো মীরাও মনেপ্রাণে চাইছে ওর একটা ছেলে হোক। অবশেষে জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহে আবীর মীরার ঘর আলো করে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়।

পুত্রকে প্রথম বারের মতো কোলে নিয়ে মীরার চোখের পানির বাঁধ ভাঙে। এ মানবশিশু কেবল ওদের সন্তানই না, এটা আবীরের অক্ষমতা নিয়ে সমাজের করা কটুক্তির জবাব। এ বিষয়ে আবীরের কেন হেলদোল নেই। ছোট বাচ্চা কোলে নেয়ায় ওর বেশ ভয়। তবুও ওখানে থাকার সময়টা আবীর মধূ্ুর করেছে ওর যত্নে ভালোবাসা দিয়ে।

দুই পরিবারের সবাই খুশি মীরার ছেলের খবরে। সকলে অপেক্ষায় রয়েছে কবে দেশে ফিরবে ওরা। মীরার ছেলের জন্য একেকজন একেকটা নাম রেখেছে। তবে শেষ পর্যন্ত মীরার রাখা নামটাই

টিকে সকলের বিপরীতে। “ফ্বালাক”

প্রবাসে খুব সুন্দর ভাবেই শেষ হয় মীরার পড়াশেনার পর্ব। শেষের দিকে অবশ্য ফ্বালাক এর জন্য একটু টাফ হয়ে গিয়েছিলো পড়াশোনায় কনসেন্ট্রেট করতে। এসাইনমেন্ট, গ্রুপ ওয়ার্ক, ফিল্ড ওয়ার্কে সময় দিতে হতো। তবে অনভিজ্ঞ আবীর সামলে নিতে পেরেছে, সাহায্য নিয়েছে বোন ফিওনার৷

দীর্ঘ দেড় বছরের কর্মযজ্ঞ শেষে ডিগ্রি এবং নয় মাসের ফ্বালাক কে নিয়ে দেশে ফিরে ওরা৷ দেশে ফেরার পর আনন্দের যেন সীমা নেই সকলের ফ্বালাককে পেয়ে, যেমনি রাজকন্যা নূহা, তেমনি রাজপুত্র ফ্বালাক। নূহার পরে মায়ের সবটুকু রূপ শুষে নিয়ে নিয়েছে যেন সে। ওকে দেখলে কখনো মনে হয় ও আবীরের মতো দেখতে, তো কখনো মীরার মতো। কিন্তু নূহা বলে ফ্বালাক নাকি ওর মতো হয়েছে দেখতে। সকলে তাই মানে। স্কুল শেষে ও ভাইয়ের যত্ন করে৷ ওর কাপড় ভাজ করে, খাবার খেতে সাহায্য করে, ঘুম পাড়ায়। ফ্বালাক যেন জীবন্ত পুতুল ওর কাছে। দ্বিতীয় সন্তান এলে প্রথম জনকে একটু কম মনোযোগ, একটু কম এটেনশন দেওয়ার দরুন তাদের মধ্যে হীনমন্যতা তৈরি হয়। ব্যাপারটা নূহার বেলায়ও হয়েছিলো। কিন্তু মীরা সুন্দর করে এটাকপ হ্যান্ডেল করেছে। বলেছে ওকে যত আদরই দেয়া হোক না কেন, সবসময় মনে রাখবে তুমি ওর সাত বছরের বড়, আর সাত বছর তুমি বেশী আদর পেয়েছো। তাছাড়া তুমি ওর বড় বোন, ওকে দেখে রাখা, ওকে আদর করা তোমারও দায়িত্ব। বোঝানোর ব্যাপারটায় কাজ হয়েছে ম্যাজিকের মতো। তবে সময় লেগেছে ভাইবোনের মধ্যে ভালোবাসা ব্যালেন্সে। আবীর ওর স্বত্ত্বার অংশ ফ্বালাককে ভালোবাসলেও নূহা এখনো ওর ফার্স্ট প্রায়োরিটি। ফ্বালাকের জন্মের পর মীরা একটু ভীত ছিলো আবীরের ভালোবাসায় মত্ত নূহার প্রতি টান বুঝি কমলো আবীরের। কিন্তু মীরার এই চিন্তাকে অমূলক প্রমাণ করেছে আবীর।

দেশে ফিরে ওদের অনুপস্থিতিতে ঝিমিয়ে পরা “মীরা ফ্যাশন”-কে চাঙ্গা করার কাজে লেগে পরে দুজনে। পড়াশোনায় নতুন করে অর্জিত জ্ঞানের সবটুকুকে কাজে লাগিয়েছে মীরা ওর ব্যাবসায়। সংসারে মাজেদা খালা তো আছেই, তার সাথে মীরার মা জাহানারা সারাদিন সময় দেয় মীরার ছেলেকে। যদিও অল্প কিছুদিনের মধ্যে ট্র্যাকে ফেরে সব কাজ, ফলে কাজের পাশাপাশি সংসারটা, সন্তানকে ব্যালেন্স করে নেয় মীরা। এমনি করে কাটছে ওদের জীবণ।

অনেক বছর পর একদিন নূহার সংস্কৃতিক স্কুলে প্রদর্শনীর সমাপনী অনুষ্ঠানে মীরা আবীর দুজনেই উপস্থিত। নূহার আঁকা ছবি সেরা নির্বাচিত হয়ে প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। অনুষ্ঠান শেষে মেডেল আর সার্টিফিকেট দেয়া হয় বিজয়ীদের। নূহার একটা দলীয় নাচও ছিলো। কী সুন্দর সেজেছে নূহা। চোখে টানা কাজল পরা, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক, ওর দীর্ঘ চুলগুলো খোঁপা করা, গাজরা ফুল গোঁজা তাতে। হালকা আসমানী রঙের শাড়ি পরেছে ও, গা ভর্তি ব্রোঞ্জ রঙের গহনা, কানে দুল মাথায় টিকলি। শাড়ির আঁচল মাথায় তোলা, যেন গায়ের বধূ সে। আলতা রাঙা হাত ভর্তি চুড়িতে। নূহা তে এমনিতেই সুন্দরী, এই সাজে আজ ওকে আরো সুন্দর দেখাচ্ছে। সত্যি যেন কল্পনা রাজ্য থেকে উঠে আসা পরি সে।

মেয়ের এমন অর্জনে খুশি ওরা দুজনেই। শত ব্যাস্ততায়ও ওরা দুজনে চেষ্টা করে সন্তানদেরকে কোয়ালিটি টাইম দিতে। মানুষের যত কাজকর্ম, রোজগার, সঞ্চয় সবই তো পরিবারের জন্যই। তাই ওরা জীবণের জন্য কাজকে সাজিয়েছে, কাজের জন্য জীবণকে নয়। যদিও এসব কথা সবার জন্য প্রযোজ্য না, এখনো অনেককে হাড়ভাংগা খাটুনি খাটতে হয়, তারপরও পরিবারের তিনবেলার খাবারের সংস্থান করতে পারে না। কিন্তু মীরার পরিশ্রম ওকে এমন একটা জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে যে ও না গিয়েও কাজের সবটা ঠিকঠাক চালাবার ব্যাবস্থা আছে। কাজের এমন পরিস্থিতি তৈরীতে সময় লেগেছে দেড় যুগেরও বেশী। তবে মীরা কৃতজ্ঞ খোদার প্রতি। তাইতে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে বেশ কিছু কাজ হাতে নিয়েছে ও। যদিও সেসব কাজ প্রাইমারী স্টেপে রয়েছে এখনো। তাই এগুলো আড়ালেই থাকুক।

তো সে অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার পথে একটু গিয়েই গাড়ি নষ্ট হয়ে যায় ওদের। ওরা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার উপর। গাড়ির যা সমস্যা তাতে গ্যারেজে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। মাথার উপর কড়া রোদ, একটুও ছায়া নেই কোথাও। উপায় না দেখে আবীর দ্রুত উবার কল করে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গাড়ি এসে হাজির হয় ওদের সামনে। ফ্বালাক কাঁদছে গরমে, গাড়ি আসতেই শশব্যাস্তে গাড়িতে উঠে পরে মীরা। একপাশে আবীর বসা, মাঝখানে নূহা, মীরার কোলে ফ্বালাক, ওকে শান্ত করতেই ব্যাস্ত মীরা।

বেশ কিছু সময় পর গাড়ি সচিবালয়ের সামনে জ্যামে পরে। মীরা খেয়াল করে ড্রাইভার গাড়ির ভিতরকার লুকিং গ্লাসে বারবার পিছনে দেখছে। মীরার কেমন অস্বস্তি হলো৷ ব্যাপারটা পাত্তা না দিয়ে আলাপ শুরু হলো ওর পুরস্কার নিয়ে। নূহা খুব খুশি প্রধান অতিথি ওকে অনেক আদর করেছে, ওর সাথে ছবি তুলেছে। জ্যাম ছাড়লে গাড়ি চলতে শুরু করে আবার। তবুও বারবার পেছনে তাকিয়ে দেখছে লোকটা। না মীরাকে না নূহাকে দেখছে সে। মীরা ভাবলো এমন সাজগোছ করে আছে বলে দেখছে বোধহয়। কারন তার দৃষ্টিতে

নোংরা কিছু নেই। দয়াগন্জ সিগনালে আবার জ্যাম। পুরান ঢাকায় থাকার এই এক জ্বালা। যদিও জ্যামের রাজত্ব সব রাস্তাতেই, এখানটায় যেন একটু বেশী।

অবশেষে ধুপখোলা মাঠের সামনে গাড়ি থেকে নামলো। আবীর মানিব্যাগ থেকে টাকা দিতে গেলে ফ্বালাক ওকে টেনে নিয়ে যায় কনফেকশনারিতে

আইসক্রিম খাবে বলে। মীরা তখন ওকে বলে-

: “আচ্ছা তুমি যাও, আমি ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি”

আবীর চলে গেলে মীরা ব্যাগ খুলে টাকা বের করতে। ড্রাইভার নূহার মাথায় হাত রেখে বলে-

: “কেমন আছো নূহা?”

কথাটা শুনে টাকা খোঁজা রেখে চকিতে তাকায় কন্ঠের উৎসে, নূহাও কিছুটা বিমূঢ় লোকটার কথা শুনে। মীরার মস্তিষ্ক তখন কন্ঠ আর চেহারায় মিল খুঁজছে কিছু একটার। একটা বার কেবল চোখে চোখ রাখে মীরা, না মীরা না দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সে-ই। সে মীরাকে রেখে নূহাতে মনোযোগী। এবার প্রশ্ন-

: “কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?”

যেন অনেক জানার আছে তার নূহার ব্যাপারে। মীরা দ্রুত পাঁচশো টাকার নোটটা দিয়ে নূহার হাত ধরে হনহন করে চলে যায় বাড়ির দিকে। আবীরের তখনো আইসক্রিম কেনা পর্ব শেষ হয় নি। মীরাকে এমনি চলে যেতে কিছুটা চিন্তিত দেখায় ওকে। দ্রুত টাকা পরিশোধ করে মীরার পিছু যায় সেও।

বাড়িতে ঢুকে নূহা জিজ্ঞেস করে –

: “লোকটা কে মা?”

একটু ভেবে মীরা বলে-

: “আমি তাকে চিনি না মা”

: “আমাকে চিনলো কিভাবে সে?”

রেগে মীরা বলে-

: “আমি কি জানি তার?”

আবীর ঘরে এসে ঘটলো না আর মীরাকে। ও জানে এখন ওকে কিছু জিজ্ঞেস না করাই ভালো। মাথা ঠান্ডা হলে ও নিজ থেকেই বলবে ব্যাপারটা কি।

রাতে খাওয়া শেষে বাসন গুলো সিংকে রাখছিলো মীরা। ভাত, তরকারির বোল হাতে আবীর যায় মীরার পিছু পিছু। মাজেদা খালা গ্রামে গেছেন, তাই এগুলো নিজেই সরিয়ে রাখছে মীরা।

আবীর মীরার মনের অবস্থা মেপে জিজ্ঞেস করলো –

: “বিকেলের ঘটনাটা কি?, নূহা বললো লোকটা নাকি চিনে ওকে? কে ছিলো সে? রাজীব কি?”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে