প্রিয় ভুল পর্ব-১০১+১০২

0
449

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ১০১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

বাড়ি ফিরে নুহা কোন মতে আবীরকে জুতা খুলবার সুযোগ দিয়ে ওর হাত ধরে পুরো বাড়ি ঘুরে দেখাতে নিয়ে যায়। যেন এ বাড়ির ট্যুর গাইড সে। কথা যেন ফুরায়ই না ওর, ওদের ঘর, লাগোয়া বারান্দা, বারান্দার সকল গাছ অপরাজিতার কোন গাছটায় নীল ফুল ফোটে কোনটায় সাদা, কোন গাছটার বয়স ওর চেয়েও বেশী তা বলে এক-এক করে। গাছ পর্ব শেষ হলে বারান্দা থেকে হাত ধরে টেনে আনে লিভিং রুমে। এরপর একুরিয়ামের মাছগুলো কোনটার কি নাম তা বলে এক এক করে। ছোট্ট নুহা একে একে পরিচয় করিয়ে দেয় লিও, স্যাম, পাপি, ম্যাড এর সাথে। কোন লিও, বা কোনটা পাপি এক রকম দেখতে সব গোল্ড ফিস গুলোর মধ্যে সব কেমন গুলিয়ে ফেলে আবীর। মীরা এক-আধবার ধমক দিয়েছে, বলেছে-
: “আহ্ নূহা কতদূর জার্নি করে এসেছেন তিনি, কেন একটু রেস্ট করতে দিচ্ছো না উনাকে?
আবীর কেমন চোখে ইশারা করে মীরাকে, যার অর্থ- ‘কেন বাঁধা দিচ্ছো?”

মীরা নাশতা খেতে ডাকলে আবীর ওকে কোলে করে নিয়ে বলে-
: “মা তোমার ক্ষুধা লাগেনি? আমার কিন্তু লেগেছে, চলো খেয়ে আসি, তারপর না হায় বাকী গল্প করবো কেমন?

নূহা হাত ধরে আবীরকে খাবার টেবিলের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসে । তারপর দৌড়ে ওর ঘরে গিয়ে ওর ড্রাইং খাতা দেখাতে নিয়ে আসে। আবীর ওকে ওর পাশের চেয়ারটাতে বসিয়ে দিলে নূহা এক এক করে ছবির গল্প বলে ওকে। আবীরের নূহার সাথে আই কনটাক্ট করতে সমস্যা হওয়ায় নূহাকে তুলে বসায় খবার টেবিলে তারপর খাবার খায় আর নূহার আঁকা ছবির গল্প শোনে। নূহার কথার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে এটা সেটা প্রশ্ন করে আবীর। যাতে ওর মনোযোগের অখন্ডতা স্পষ্ট প্রকাশ পায়৷

অপরপ্রান্তের চেয়ারে বসে মীরা ভাবে নূহাটার বকবকে
আবীর না আবার ধৈর্য হারায়। জ্ঞান হওয়ার পর প্রথম বাবাকে পেয়ে মেয়েটা আনন্দে আত্মহারা। বাবাকে কাছে পাওয়ার উত্তেজনায় বেচারী কোনটা রেখে কোনটা বলবে দিশা পাচ্ছে না যেন। এই ছবির গল্প করছে আবার ওর কোন বন্ধু ওর রঙ পেন্সিল ভেঙে ফেলেছে তার নালিশ ও করছে। আবার হয়তো ওর পছন্দের ফুল পাখি আর রঙের গল্প বলছে। মীরার ভয় হয় আবীরের না বিরক্তি ধরে যায় নূহার এমন আচরণে। মীরা ভাবনাকে পাশ কাটিয়ে তাই নূহাকে ডেকে বলে –
: “খাওয়ার সময় এত কথা বলে না মা”
মায়ের কথা শুনে চুপচাপ থাকে নূহা।

খাওয়া দাওয়ার পর ঘন্টাখানেক রেস্ট নিয়ে ওরা মীরার মায়ের বাড়ি যায়। সেখানে ইরা ওর বরও যোগ দেয় ওদের সাথে। দুপুরের ভরপুর খাওয়াদাওয়া হয় সকলে। বিকেলে চা আড্ডা জমে। তবে সন্ধ্যায় ওদের সবাইকে ঐ বাড়িতে রেখে মীরা আর আবীর যায় মুখলেস চাচার সাথে দেখা করতে।

সেখানে যাওয়ার পর ওদেরকে একসাথে দেখে কান্নায় ভেঙে পরে মুখলেস চাচা। এ কান্না মীরাকে সুখি দেখে যেতে পারার আনন্দ উৎযাপনের। মন ভরে আবীর মীরাকে দোয়া করেন তিনি। রেবেকা আন্টি অসুস্থ থাকায় মীরা উঠে রান্নাঘরে চা বানাতে গেলে মুখলেস চাচা আবীরকে বলে –
: “বাবা মাইয়্যাটা বড়ই দুঃখী। দছ বছর ধইরা ওরে চিনি আমি, কোন দিন একটু ভালো থাকবার দেখি নাই। কোন না কোন ঝুট ঝমেলা লাইগাই ছিলো ওর আশপাশ। জীবণটা অনেক দুঃখ কষ্টের ভিতর দিয়ে পার করছে, সব দুঃখ, কষ্ট একা হাতে সামাল দিছে, খোদা তোমারে ওর ঢাল বানায়া পাঠাইছেন। আমি জানি তুমি অনেক ভালো পোলা। মাইয়্যা হিছাবে মীরাও সোনার টুকরা। আমি মন থাইক্যা দুআ করি আল্লাহ তোমাগো সুকি করুক। মাথা নত করে মুখলেস সাহেবর সব কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো আবীর। ওদের প্রতি তার দোআ শুনে আবীর অস্ফুটে বলে –
” আমীন”

সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে রাত হয় ওদের। রেবেকা আন্টি অবশ্য খেয়ে যেতে জোড় করে অনেক। কিন্তু তিনি অসুস্থ থাকায় তাদেরকে এ ঝামেলায় ফেলতে চায় না মীরা। মীরা বলেছে- “আগে সুস্থ হন আপনি, একদিন সকাল সকাল এসে সারাদিন বেড়াবো আপনাদের এখানে।

মুখলেস চাচা ওদের বিয়েতে না যেতে পারলেও আবীরকে প্রথম দেখে উপহার হিসেবে দামী একটা ঘড়ি উপহার দেয় ওরা যাবার আগে। এটা তিনি আগে থেকেই আনিয়েছিলেন মুস্তাকিমকে দিয়ে। আবীর সানন্দে সেই উপহার গ্রহণ করেন।

সেখন থেকে ফিরতে সাড়ে আটটার মতো বাজে। সবার জন্য কিছু খাবার কিনে আবীর যেতো পথে। নাশতা টাইপ। গিয়ে দেখে আবার রান্নার ধুম পরেছে বাড়িতে৷ মীরার খালা পারভীন, তার বরও এসেছে আবীরকে দেখতে। আবীরকে দেখে কান্নায় ভেঙে পরেন মীরার ছোট খালা পারভীন৷ তিনি অসুস্থ থাকায় যেতে পারেন নি ওদের বিয়েতে। আবীর তাকে শান্ত করায়। তিনি আবীরের হাত ধরে বলে-
: “এক তোমার সাথে অন্যায় হওয়ার দরুন এত বছরেও আমি আমার ভাগনীর সাথে কথা বলি নি, ওর মুখ পর্যন্ত দেখি নি। সব ভুলে তুমি ওকে ক্ষমা করে দাও বাবা”

তার কথা শুনে মনে হয় যেন তার বলবার অপেক্ষায় মীরাকে এখনো ক্ষমা করেনি আবীর “মনে মনে হাসে আবীর তার কথা, আর বাচন ভঙ্গী দেখে। মীরার খালাতো বোন রূহি বলে, আহা মা…

মীরার খালু আবীরকে পাশে ডেকে বলে-
: ” কিছু মনে করো না বাবা, অসুস্থ হওয়ার পর থেকে পারভীন এমন বোকা বোকা কথা বলে যে একেবারে অস্বস্থিতে পরে যাই, ওকে নিয়ে তাই বের হই না কোথাও তেমন একটা। সবাই তো আর ওর অসুখটা বুঝবে না, কে কখন কি মনে করে ফেলে, তাই ওকে নিয়ে যাই নি তোমাদের বিয়েতে।

দূর থেকে আবীর লক্ষ্য করে পারভীন আন্টির পাশে পাশেই থাকছেন তিনি, পানি খেতে হাত বাড়ালে পানি এগিয়ে দিচ্ছেন, নিজে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন ওয়াশরুমে। হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছেন এ ঘর থেকে ও ঘরে। সত্যিকারের ভলোবাসা হয়তো এমনি হয়। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত যার টান থাকে একে অপরের প্রতি । সেদিন অনেক রাত হয়ে যায় খাবার খেতে খেতে। জাহানারা তাদের বাড়িতে ওদের থাকতে বললেও রাতের খাবার খেয়ে নিজেদের বাসায় ফিরে আসে মীরা৷ আগামীকাল চট্টগ্রাম থেকে ওর শ্বশুর বাড়ির সকলে আসবে এ বাড়িতে। সে কাজকর্ম ও কিছুটা এগিয়ে রাখা লাগবে।

মেহমানদের আয়োজনের জন্য রান্নাবান্নার বাজার সব সন্ধ্যায় করে দিয়ে গেছে ফাহাদ। মাজেদা খালা কি মশলাপাতি আনা বাদ গিয়েছে তা আনতে গেছে দোকানে। নিজেই তালা খুলে বাড়িতে ঢুকলো মীরা।

বাজার-সদাই সব গুছগাছ করে ফ্রেশ হয়ে ঘুমাবার আয়োজন করছে মীরা। নূহা এখনো ওর বাবার সাথে আঠার মতো লেগে আছে। খাট জুড়িয়ে ফেলেছে সে গল্পের নানান বইয়ে৷ এতদিন ওর মা গল্প পড়ে শুনাতে৷ আজ হতে বাবার কাছ থেকে শুনবে বলে এসব হাজির করেছে ও। মীরা কাপড় বদলে ধমক লাগায় ওকে। বলে-
: “আজ অনেক ক্লান্ত আমরা, বাবা কাল শোনাবে গল্প, এখন ঘুমাও মা”
বাবার পাশে শোয়া নূহা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে-
: “আমি ঘুমাবো কেন?”
নূহার কথা শুনে হেসে দেয় আবীর। মীরাকে কপট ধমকের গলায় বলে-
: “ঠিকই তো বলেছে নূহা, ও “ঘুমাবো কেন?”
মেয়ের পক্ষ নেয়ায় আবীরের দিকে কুশন ছুড়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পরে মীরা। উল্টো হয়ে শুয়ে থাকলেও মীরার কানটা ওদের দুজনের মাঝখানেই পরে ছিলো।

আবীর রূপকথার গল্প পড়ে শোনাচ্ছে নূহাকে। তা যেমন তেমন ভাবে না কন্ঠকে কখনো উঁচুতে নিয়ে যাচ্ছে তো প্রয়োজনে খাদে নামাচ্ছে পরিস্থিতির ভয়াবহতা ফুটিয়ে তুলতে, গল্প বলার ধরন দেখে পাশ থেকেই গল্প শুনে মীরা। বেশ কিছু সময় গল্প বলার পর আবীর নূহাকে বলে-
: “মা আমি অনেক ক্লান্ত আজ, তুমি কি আমার মাথাটায় হাত বুলিয়ে দিবে?”

শোয়া থেকে উঠে নূহা ড্রেসিং টেবিলের থেকে মাথা ঠান্ডার তেল এনে আবীরের মাথায় দিতে চায়, আবীর বলে আজ সকালে শ্যাম্পু করছি মা, আজ তেল দিবো না, তেল দিলে আমাকে পঁচা দেখায়৷

নূহা বলে-
: “বাবা এ তোল দিলে মাথা ব্যাথা, কেলান্তি সব চলে যাবে দেখো… চিন্তা নাই কাল আমি চুল ধুয়ে দিবো তোমার”

বলেই তেলের বোতলের ছিপি খুলে একগাদা তেল দিয়ে দেয় আবীরের মাথায়। তারপর তেল আর চুল নিয়ে দু’হাতে বেশ কিছুক্ষণ কর্মযজ্ঞ চালায় নূহা। চুলে বিলি কাটা ছোট ছোট আঙুলের স্পর্শে আরামে চোখ বুজে আসে আবীরের। নিচ থেকে চোখ তুলে নূহার দিকে চেয়ে মনে মনে বলে-
: ” এত সুখ অপেক্ষায় ছিলো আমার? একি স্বপ্ন না সত্যি? ”
নূহার দিকে তাকাতেই ভুলবেন ভুলানো হাসি হাসে নূহা।
আবীর ওকে বলে-
: “মা একটা চিমটি কাটো তো”
মুচকি হেসে নূহা মাথা নামিয়ে এনে বাবার কপালে একটা চুমু খায়। নিজের অজান্তেই চোখ গড়িয়ে পানি পরে আবীরের। মেয়ের থেকে তা লুকাতে দ্রুত চোখ মুছে ফেলে ও। ফ্ল্যাশ ব্যাকে ভেসে ওঠে কষ্টে থাকা সেইসব প্রতিটি দিনের কথা। কত কষ্ট কত যন্ত্রনার ভিতর দিয়ে গিয়েছে ও প্রতিটা মুহুর্তে। বাবা মা চলে যাবার পর একা কাটানো এক একটা দিন যেন দুঃখের পাহাড় ডিঙিয়ে পরের দিনের ভোর দেখার মতো। ওর
এই সুখ সেই সব কষ্টের দিনগুলোর দামে কেনা।

তবে যুগ ঘুরে ওদের দুজনের এই এক যে হওয়া, নূহার মতো মিষ্টি মেয়ের বাবা হওয়া এসব সত্যি মিরাকল। আবীর ভাবে খোদার প্রতি যতই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর হোক ততোটাই কম হবে। এ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা জানা নেই ওর। আবীরের ভাবনার জাল কাটে নূহার কর্মযজ্ঞে৷ পাশে থাকা চিরুনি নিয়ে যত্ন করে চুল আঁচড়ে দিচ্ছে সে ৷ মাথা নুইয়ে ঝুঁটি করে দিবে কি না তাও জানতে চায় বাবার কাছে। গলা ধরে আসা আবীর মাথা নেড়ে না করলে মুখ কালো করে অভিমান করে সে। তখন নূহাকে তুলে হেসে আবীর জিজ্ঞেস করে –
: ” চুল বাঁধতে দিলে খুশি?”
মুচকি হেসে নূহা মাথা হ্যা সূচক ঝাঁকায়। আবীর ইশারায় বলে ওকে দেন, বাঁধো চুল।

দৌড়ে খাট থেকে নেমে নূহা ওর রাবার ক্লিপের বক্স নিয়ে চুল বাঁধতে বসে আবীরের। মোট তিনটা ঝুটি করে ও আবীরের মাথায়। পাশ ফেরা মীরাকে নূহা ডাকে বাবার চুল বাঁধা দেখাবে বলে। পাশ ফিরে মীরা বাপবেটির এমন কান্ড দেখে প্রথমটা তব্দা খেয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায় মীরা। নূহাও বাবার কোলে লুকিয়ে লাজুক হাসি হাসে ওর মায়ের এমন হাসি দেখে৷ আবীরও যোগ দেয় ওদের সাথে। পাশ থেকে ফোন নিয়ে ঝুঁটি সহ তিনজনের সেলফি তুলে আবীর। তাতে মীরা চোখ বন্ধ করে হাসছে, নূহা বাবার কোলে বসে হাসছে ভি সাইন দিয়ে, এটা নূহা নতুন শিখেছে। ইদানীং ছবি তুলতে ক্যামেরা ধরলেই হাত উঁচিয়ে ভি-সাইন দেয় ও। ছবিতে দুজনের সাথে হাসছে আবীরও।

ছবিটা সিলি আর কাওকে দেখানোর মতো না হলেও ওদের প্রথম পারিবারিক ছবিই হয় সেটি। পাশের ঘর থেকে ওদের হাসাহাসি শুনতে পান মাজেদা খালা৷ তিনি তখন জায়নামাজ এ বসে এশার নামাজের মোনাজাত করছিলেন। ওদের ঘর থেকে আসা হাসির কল্লোলে মোনাজাতের একাগ্রতা নষ্ট হয় তার। নামাজে ব্যাঘাত তার অপছন্দ। তবুও আজ মোনাজাতরত অবস্থায় মুচকি হাসেন তিনি। মন থেকে দোয়া করেন খোদার কাছে- “যে পরিবার তিনি ঝড় ঝাপটা সামলে গড়ে দিয়েছেন তা যেন সকল অনিষ্ট থেকে রক্ষা তিনিই করেন”

চলবে…..

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ১০২
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

নুহার ঘুমাতে ঘুমাতে বেশ রাত হয় সেদিন। ঘড়িতে সময় তখন দেড়টা। আবীরের বাহুতে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পরেছে মেয়েটি। ওয়াশরুম থেকে ফিরে মীরা দেখে আবীরও অপরদিকে মুখ করে ঘুমানো। বেচারার অনেক ধকল গেলো আজ, হুট করে লোকটা কেমন ঝামেলায় পরে গেলো। আচ্ছা, এসবে ও ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হচ্ছে না তো?

কিছু সময় খাটে বসে এসব ভাবতে থাকে মীরা,এরপর অপরদিকে থাকা পানির বোতল আনতে উঠে দাঁড়ায় মীরা। আবীরের দিকে গিয়ে বোতল হাতে ওর পাশে বসেই গ্লাসে পানি ঢেলে পানি পান করে ও। পানি পানরত অবস্থায়ই মীরার চোখ যায় আবীরের দিকে, ওকে বসতে দেখে পাশ ফিরে চোখ মুছছে আবীর। তৎক্ষণাৎ গ্লাস রেখে হাত ধরে ওর দিকে ঘুরায় আবীরকে। তখনো চোখ মুছছে আবীর। আবীরের আরো কাছে গিয়ে মীরা জিজ্ঞেস করে –

: “কি হয়েছে আবীর? আপনি কি কাঁদছেন?”

মুখে ‘না’ বললেও ওর স্বর যেনো বলছে সত্যটা। না উত্তর দিলেও তখনই মীরাকে জড়িয়ে ধরে রাখে আবীর। মীরার চুপ থেকে আবীরের ভেতরকার ঝড় বোঝার চেষ্টা করে।

নিচু হয়ে মীরা আরো দৃঢ় করে সে আলিঙ্গন। কিছুটা সময় এমনিই পরে থাকে ওরা। আবীরের একপাশের বাহুতে নূহা, অন্যহাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে সে মীরাকে। আবীরের বুকে ভর দিয়ে মাথা উচু করে মীরা। কিছুটা সময় চুপ থেকে মন পড়ার চেষ্টা করে আবীরের, তারপর ক্ষীণ কন্ঠে বলে-

: ” কি হয়েছে আবীর? ” উত্তর দেয়ায় ব্যাস্ততায় না গিয়ে আবীর সাবধানে নূহার মাথা নামায় ওর বাম বাহু থেকে। মীরাও সরে বসে, তারপর আধশোয়ার মতো বসে আবীর। পাশ থেকে পানি এগিয়ে দেয় মীরা ওকে। সেটা শেষ করে একটু যেন ধাতস্থ হয় আবীর তারপর বলে-

: “নূহা বোধহয় বাবা হিসেবে মেনে নিয়েছে আমাকে, সেই খুশিতে…” বলেই চোখ সরিয়ে নেয় ও। আবীরের পাশে এসে ওর কাঁধে মাথা রেখে বসে মীরা, তারপর বলে-

: “আমি ভাবলাম কি না কি?”

কিছু সময় মৌন থেকে আবীর বললো-

: “জানো জীবণের ঠিক এই পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে জীবন সত্যি সুন্দর”

মুচকি হেসে মীরা বলে-

: “এদিকে আমি কেবলি ভাবছিলাম – সবকিছু আপনার উপর চাপিয়ে দিচ্ছি না-তো?”

: “না মীরা, সত্যি নিজেকে অনেক সুখী মনে হচ্ছে নূহাকে পেয়ে”

বাহু লগ্ন হয়েই মাথা উঁচু করে আবীরের দিকে চোখ রেখে মীরা বলে-

: “আর আমাকে?”

মুচকি হেসে মীরাকে জড়িয়ে রাখে আবীর। মীরার এমন প্রশ্নের উত্তর ভাষায় বর্ণনার ধার ধারলো না ও। মুচকি হাসি আর আলিঙ্গনেই যেন মিটিয়ে দিলো সে প্রশ্নের উত্তর।

মুখচোরা আবীর মীরাকে ওর সেইসব কষ্টের গল্প বলায় ব্যাস্ত। ও ওর জমে থাকা কথা বলায় যেন শান্তি পাচ্ছে। নূহার মতোই হয়তো দিশেহারা অবস্থা ওর, কোনটা রেখে কোনটা বলবে। মীরা মনোযোগ দিয়ে শুনছে কেবল। চুপ থাকাটা শ্রেয় মনে করছে ও, কারন কি বলতে গিয়ে কোনটা বলে ফেলে কষ্ট দেয় বেচারাকে, তাই একনিষ্ঠ মনোযোগী শ্রোতা হয়েছে ও আবীরের।

আবীর একে একে বলে মীরার প্রতি ওর ভালোবাসা, অন্যত্র বিয়ে করাতে সবার পিড়াপিড়ি, বিয়ে না করতে পারার কারনের সেই সব গল্প। না, তার মানে এই না যে ও মীরার এমনি ফিরবার অপেক্ষায় থেকেছে, দোয়া করেছে মীরার এমন দূর্ভাগ্যের জন্য। ও কেবল চেয়েছে “মীরা ভালো থাকুক, ভালো থাকুক ওর ভালোবাসা”

সবটা শুনে মীরা ক্ষমা চাইতে একটু কার্পণ্য করে না, ঠিক কতবার ক্ষমা চাইলে ওর ক্ষমা ঠিকঠাক হবে তা জানে না মীরা৷ আর আবীরও কার্পন্য করে না মীরাকে ভালোবাসতে।

তবে আবীরের এই হঠাৎ পাওয়া সুখের দিনগুলোর প্রতিটি মুহূর্তকে রঙিন করতে মীরার সত্যি যেন ক্লান্তি নেই। নিজের সুখে আত্নস্থ হওয়া আবীরকে মীরা যেন নতুন সুখের দিগন্ত দেখাতে চায় ।

চোখে চোখ রেখে দুজনে পলকহীন চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ। যেন “এত দেখি তবুও মন ভরে না ” দু জোড়া চোখ কথা বলে নিজেদের ভাষায়। হুট করেই আবীরের দিকে মুখ এগিয়ে নেয় মীরা। অন্যবারের মতো নিজেকে গুটায়নি আবীর, চেয়ে ছিলো মীরারই চোখের দিকে। কি ঘটে তার সাক্ষী হতে হয়তো। আবীরকে জড়িয়ে ধরে ওর কানের নিচে চুমু খায় মীরা। বাতিটা নিভিয়ে দেয় আবীর। যেন আলোরা না দেখে ওদের। আলো নিভে থাকা ঘরে বারান্দার বাইরে ল্যাম্পপোস্টোর ক্ষীণ রশ্মির বদৌলতে ভেসে উঠে এক জোড়া মানব-মানবীর মোশন পিকচার, যাতে দেখা যাচ্ছে – চুলের মুঠি ধরে নিজের ঘাড়ে আটকে থাকা মেয়েটিকে ছাড়িয়ে তার ঠোঁটে ডুব দিলো ছেলেটা, মেয়েটির হাত দু’টো সাঁতার না জানার মতো হাবুডুবু খেয়ে আঁকড়ে ধরে আছে ছেলেটির চওড়া পিঠে। যেনে নিচে পরে যাওয়া ঠেকাতে এই আপ্রাণ চেষ্টা তার।

এতোদিনকার অপেক্ষার শোধ মিটিয়ে দিতে মীরা বন্য, কিন্তু ভালেবাসার আদায়ে কোন তাড়া নেই আবীরের। ও মীরার মতো বন্য ভালোবাসায় পারদর্শী না৷ তবে ও নিজের মতো করে ভালোবাসে ও মীরাকে, খুব সাবধানে, অনেক যত্ন করে।

মীরা এমনিভাবে ভালোবাসায় অভ্যস্ত, ভালোবাসা কি? তা জানার শুরু থেকে এমনি দেখে আসছে ও। আক্রমনাত্মকতা আর বন্যতা। কিন্তু আবীর যেন ভালোবাসার এক শিল্পী, ওর কাছে টানা, জড়িয়ে ধরা, আলিঙ্গন কিংবা চুমু খাওয়া সবকিছুতে শান্ত একটা ভাব। কোন তাড়া নেই ওর, চোখে তাকাবে, মুখের কাছে আসা চুল সরাবে, গালে আদর করবে, মন পড়ার চেষ্টা করে যেন সে তখন মীরার। সাবধানে কাছে টেনে নিজের ঠোঁট জোড়া দিয়ে ডুব দিবে মীরার ঠোঁটে।

এমনি করে রাত থেকে দিন হয় সেই দিন মিলায় গিয়ে রাত। আবীরের রঙহীন জীবণ মীরার ভালোবাসা আর যত্নে ওর নামের স্বার্থকতা পায়। নূহা আর মীরাকে পেয়ে কানায় কানায় ভরে ওঠে ওদের জীবণ। মীরার মনে থাকা ভয়কে অমূলক প্রমাণ করে আবীর ওদের প্রতি ভালোবাসা দিয়ে।

নিজেদের কেনা এপার্টমেন্ট বিক্রি করতে চায় মীরা পরের মাসেই, এলাকা বদলে ফেলবে ও, ঐখানে সবকিছুর সুবিধা থাকা সত্ত্বেও। কেন? এর উত্তরে মীরা সবটা খুলে বলে আবীরকে। আবীর ওদের পুরান ঢাকার বাড়িতে উঠতে বললেও মীরার মন মানে না। কারন যে ভয়ে এখান থেকে শেকড় তুললো ও, সে ভয়টা তাহলে থেকেই যাবে। আবীর ওকে ভরসা দেয়া সবটা সামলে নেবার, নিজেদের এত সুন্দর বাড়ি থাকতে ভাড়া বাসায় ওঠা কেন?

মীরার মনে খুঁতখুঁত থাকলেও আবীরকে না করতে পারে না ও। অবশেষে পুরান ঢাকার নিজের বাড়িতে সব আসবাবপত্র নিয়ে উঠে মীরা। ওদের সে বাড়িতে উঠার পর বাইরে থেকে মনে হয় যেন প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে এ বাড়ির। ল্যাম্প পোস্টের নিয়ন আলো যতটুকু আলো দিতো বাড়িটাকে ততোটুকুই আলো থাকতো সে বাড়িটায়। জনমানুষহীন সে বাড়িটায় আলো না যেন প্রাণ ছিলো না এতদিন।

আবীর নিজের পরিচয়ে জন্ম নিবন্ধন তৈরী করে নূহাকে স্কুলে দেয়, মীরার কাজ সব নতুন ঢাকার দিকে।

আবীরের বাড়ি ব্যাবসা সব পুরাণ ঢাকার দিকে হওয়ায়

নতুন ব্যাবসার কাজে ব্যাস্ত থাকলেও আবীর নিজের কাজের পাশাপাশি মেয়ের দায়িত্ব পালন করে নিষ্ঠার সাথে। নিজের কাজের রুটিনের মধ্যে নূহাকে দেখভাল করার এ কাজটা ও আবীর এড করে নিয়েছে।

ওকে স্কুলে পৌঁছে দেয়া, স্কুল থেকে বাড়িতে আনা,

একদিন এক মজার ঘটনা ঘটে, সারা সন্ধ্যা নূহা কান্না করতে থাকে, আবীর বাসায় ফিরেও দেখে কাঁদছে নূহা। কেন তা জিজ্ঞেস করলে মীরা বলে- ওর আঁকা ওদের পারিবারিক ছবিটার ফ্রেম ভেঙেছে বলে ও কাঁদছে। মীরা আবীরের দিকে চোখ টিপে ফিসফিস করে বলে-

: “বোঝান আপনার মেয়েকে, বলেন যে কেঁদো না ভাই এনে দিবোখন” বলেই হেসে রান্নাঘরের দিকে যায় মীরা। আবীর কিভাবে কি বলে ঠান্ডা করেছে নূহাকে ও-ই জানে ভালো। দুর থেকে দুজনের দুষ্টামি দেখে মীরা। দুজনের মধ্যে কে বেশী বাচ্চা তার হিসাব চলে ওর মনে মনে।

রাতের বেলা ব্যাপারটা নিয়ে আবীরের সাথে কথা বলে মীরা। ও এ ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াস। আবীর হেসে না বোঝার ভান করে বলে-

: “কি বলছো ক্লিয়ার করে বলতো.. ”

: “বোঝেন না আপনি হুহ্ ন্যাকা”

আবীর ওর গাল টেনে বলে-

: ” কি বুঝবো আমি আমি তো বাচ্চা মানুষ, তুমিই তো বলো”

: “নূহার ভাই লাগবে একটা”

: “যদি আরেকটা নূহা আসে”

: “যাই হোক আমি দেখে নিবো”

: “সোজা করে কেন বলছো না? ”

: “আর সোজা করে বলতে পারি না আমি”

: “এত তাড়া কিসের, কত ব্যাস্ত থাকো তুমি, এত বড় দায়িত্ব পালন করছো, এসব কমুক একটু তারপর নাহয়”

: “নাহ আর অপেক্ষা না”

: “সহজ করে কেন বলছো না মানুষের মুখে ঝামা ঘঁষে

দিতে চাও তুমি, যারা যারা পিঠ পিছনে আমার অক্ষমতার প্রশ্ন তোলে তাদের উত্তর দিতে চাও”

: “আরেহ এমন কিছু না”

: “এটাই সত্যি মীরা, কেন মিছে লুকানোর চেষ্টা করছো? আমার সসসক্ষমতা অক্ষমতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তুমি। এক যুগ আগেই তা জানো তুমি, আমাদের মধ্যে কিছুই ছিলো না, আর এক যুগ পরও উত্তর পেয়েছো তুমি। মানুষের চোরখে আমি সক্ষম নাকি অক্ষম ইটস ডাসেন্ট ম্যাটার, অনেক বড় দায়িত্ব পালন করছো তুমি, তোমার একটু সময় দরকার নিজেকে প্রমাণ করার। আর তো মোটে কয়েকটা দিন। তারপর সব বাদ দিয়ে না হয় ব্যাবসাটাই দেখবো দুজনে”

মীরার চোখে পানি চলে আসে, সত্যি এত এত চাপের মধ্যে ও মানুষের মুখে কুলুপ এঁটে দিতেই এমনটা ভেবেছে ও। আবীর কিভাবে ওর সবটা বুঝে যায়?

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে