#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_৩৮
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
সমাপ্তি সমাপ্তি সমাপ্তি
দাউদাউ করে পুঁড়তে থাকে বাসভবনের দরজাটি। শেহজাদের সৈন্যরা পরাস্ত করেছে ডাকাত সৈন্যদের। দুপক্ষের অনেকের মৃত্যু ঘটে গেছে। গণহত্যা চালিয়েছে কাশীম। তারপর নিজেকে আড়াল করে নিয়েছে মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায়। তাকে খুঁজেফিরে চলেছে সকলে। চন্দ্রলাল যা ভেবেছে সবকিছুর হীতে বিপরীত হচ্ছে। প্রাণভিক্ষা পাওয়া শেহজাদের পক্ষ হয়ে কাজ করা সেই ডাকাত সৈন্যগুলোর জন্যই মূলত শেহজাদ সুলতানের সৈন্যরা পথ পেয়েছে। তাদের অবস্থান বুঝে নিয়েছে। চালাকি ধরে ফেলেছে।
শেহজাদ সুলতান কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলছে সুকৌশলে। ভবনের ভেতরে তারা তিন ভাই সবাইকে কু*পিয়ে মারছে। চন্দ্রলাল খেপে উঠলো। জাদুবলে তাদের জিম্মায় আনতে হবে। কিন্তু জাদু করার জন্যও নূন্যতম সময় সুযোগ প্রয়োজন। যা তারা পাচ্ছে না। শতাধিক সৈন্য মৃত, বাকিরা শেহজাদ সুলতানের সৈন্যদের হাতে ও বাসভবনের ভেতর।
দরজা পুড়তে পুড়তে ধসে পড়ে। বন্দুকের সাহায্য আঘাত করতে করতে দরজা একেবারে ফেলে দেয় সবাই। সাথে সাথে চোখে পড়ে মরদেহ, কাটা হাত পা। আশেপাশে কাউকেই দেখতে পায় না তারা। কোথায় ওরা তিন ভাই? ‘
এইবার সতর্কতা সহিত সোপান বেয়ে উপরে উঠতে থাকে সকলে। নীচে, উপরে, দ্বিতল ভবনের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে থাকে বুকে। অস্ত্রের সেই কামরার পথে রক্তমাখা পায়ের ছাপ দেখে সকলেই থামে। দরজা ভাঙার প্রয়াস চালায়। সকলে মিলে দরজা ভাঙতে থাকে একসাথে। চন্দ্রলাল আর গুলজার মস্তবড় ধামা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। হাতের মুঠোয় নেয় সবুজরঙা পাউডারের মতো কিছু দ্রব্য বিশেষ। আজ ওদের মৃত্যুযজ্ঞের সমাপ্তি এখানেই।
জমিয়ে রাখা অস্ত্রের কক্ষের একটি অংশবিশেষে বসে দ্রুত হাত চালায় শেরহাম। তার দিকে প্রয়োজনীয় জিনিস বাড়িয়ে দেয় শেহজাদ আর সাফায়াত। অস্ত্র কুড়িয়ে নেয়। দূর থেকে গোলাগুলি, চেঁচামেচি ভেসে আসছে ক্রমশ, সাথে তলোয়ারের শব্দ, সৈন্যদের আর্তনাদ। শেরহাম দ্রুতবেগে কাজ চালায় অর্ধপ্রস্তুত কৃত বারুদে।
শেরহাম দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দক্ষ হাতে বিস্ফোরকের অভ্যন্তরের প্রয়োজনীয় হাতে তৈরি বিভিন্ন ধাতব পদার্থ, কেসিং, ডেটোনেটর, শ্র্যাপনেল এবং ট্রিগারিং মেকানিজমের শক্তির রাসায়নিক বিক্রিয়ার মিশ্রণে বারুদ তৈরির কার্য সম্পাদন করতে থাকে খুবই দ্রুতগতিতে। সৈন্যরা দরজা ভাঙতে থাকে সবাই মিলে। হাতের মুঠো সমান বারুটদটা তুলে নেয় শেরহাম। শেহজাদ আর সাফায়াত তাকিয়ে দেখে। সাফায়াত জিজ্ঞেস করে
‘ এখন কি করবেন ভাইজান? ‘
শেরহাম মোটা পলিথিনে সেটি মুড়িয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় ভাঙতে থাকা দরজার দিকে। শিকারী চোখদুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠে। বিশাল কামরাটির চারপাশে তাকায়। অসংখ্য কঙ্কালের মূর্তি, পশুর হাঁড় দিয়ে তৈরিকৃত অস্ত্র, অবৈধ অস্ত্রের সমাহার কক্ষটিতে। লোহার শিক দিয়ে বন্ধ করা জানালা দেখা যায়। শেরহাম সেদিকে পা বাড়ায়। বলে, এটা ভাঙতে হবে। তাড়াতাড়ি আয়।
শেহজাদ আর সাফায়াত ছুটে আসে। ত্রিশূল তুুলে কপাটের পাশের দেয়ালে আঘাত করতে থাকে। মাকড়সার জাল তাদের গায়ের উপর এসে পড়ে। নিজেদের মুক্ত করে নেয় তারা। দেয়াল ভাঙতে থাকে পুনরায়। জানালার শিক ভেঙে পড়ে যায়। এদিকে দরজাও ভাঙার বদলে খুলে যায়। অর্ধভাঙা দরজাটা কোনোমতে দাঁড়িয়ে থাকে। শেহজাদ আর সাফায়াত দেয়াল ভাঙছিলো সৈন্যদের আগমনে তারা ফিরে তাকায়। তাদের দিকে তেড়ে আসে সৈন্যরা। শেহজাদ, সাফায়াত রুখে দাঁড়ায়। তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। তিন ভাই লড়তে থাকে প্রাণের ভয় ছেড়ে। তাদের বিধ্বংসী হামলায় পরাস্ত হতে হয় সৈন্যদের। এত আঘাত পাওয়ার পরও তিনভাইকে কেউ রুদ্ধ করতে পারে না। তীক্ষ্ণ চিৎকার, রক্তের ঢেউয়ে ভাসে বিশাল কামরার শক্ত মেঝে। বড় বড় বিষাক্ত মাকড়সাগুলি রক্তের গন্ধ পেয়ে নেমে পড়ে মাটিতে। উন্মাদের মতো একে একে গর্দান কাটে তারা। গায়ে লোহবর্ম থাকায় তাদের গায়ে তলোয়ারের আঘাত পড়েনা। শেহজাদ, শেরহামকে সরিয়ে সরিয়ে রাখে। ভাইজানের গায়ে লোহবর্ম নেই। এমনিতেই তার শরীরে ক্ষতের অভাব নেই।
নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটে যায় কামরাটিতে। একে একে ডাকাত সৈন্যগুলো লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। প্রবল আক্রোশে পুরো ভবন ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে শেরহামের দিকে তেড়ে আসা একজনের মাথা উড়িয়ে দেয় শেহজাদ। শেরহামের হাতের মুঠোয় থাকা বারুদটি উত্তপ্ত হয়ে উঠে ধীরেধীরে। শেরহাম সাফায়াতকে বলে,
‘ তোরা পালা এইদিকে। দ্রুত কর। বারুদ বিস্ফোরণ হবে শীঘ্রই। তাড়াতাড়ি কর। ‘
শেহজাদ সাফায়াত দুজনেই দ্বিধাগ্রস্তের মতো চেয়ে থাকে। আর তারমধ্যেই বিশালদেহী গুলজার আর চন্দ্রলাল প্রবেশ করে। প্রবেশ করে তার বিশ্বস্ত সৈন্যগুলো। তারা অতি শক্তিশালী, ভয়ংকর দেখতে, অতি পাষাণ, বর্বর । তারা ধরে বেঁধে নিয়ে আসে কাশীমকে। কাশীমের গায়ে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। রক্তাক্ত চেহারা। গলা উঁচু করে চিৎকার করে বলল,
‘ আমার কথা ভাববেন না। আপনারা আপনাদের কাজ চালিয়ে যান। ওরা আমার কিচ্ছু করতে পারবে না। ‘
শেহজাদ ডেকে উঠে, ‘ কাশীম!’
কাশীম চোখ তুলে তাকায়। বলে,
‘ থামবেন না। আপনাদের কাজ করুন। এদের সব কটাকে শেষ করুন। ‘
বন্দুক দিয়ে তার পিঠে মারা হলো পুনরায়। গুলজার এগিয়ে আসে কাশীমের দিকে বড়সড় তলোয়ার তাক করে রেখে বলে,
‘ যদি একে বাঁচিয়ে রাখতে চাস তবে বারুদটা দিয়ে দে আমার হাতে। ‘
শেরহাম ক্ষুরধার চোখে চেয়ে থাকে। চন্দ্রলাল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। তার সাথে সাথে হাসতে থাকে সবাই। হঠাৎই হাসি থামিয়ে দেয় চন্দ্রলাল। রুক্ষ স্বরে বলে,
‘ কোনো কথা ছাড়াই গর্দান নে। ‘
গুলজার তলোয়ার তুলে কো**প বসাতে উদ্যত হতেই শেরহাম বলে উঠলো,
‘ বারুদ দিলাম। ওকে ছাড়। ‘
সকলেই তার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। শেহজাদ চেয়ে রয় তার মুখপানে। গর্বে তার বুক ফুলে উঠে। চোখের সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে তাদের ভাইজান। সেই পূর্বের ভাইজান। কাশীম চিৎকার করে বলে,
‘ না দেবেন না। আমার চিন্তা করবেন না। নিজেদের বাঁচান। ‘
শেরহাম কথা শোনেনা। গুলজার হাত বাড়িয়ে দেয়। শেরহাম বলে,
‘ আগে ছাড়। তারপর বারুদ। ‘
কাশীমকে শেরহামের হাতে তুলে দেয় গুলজার। শেরহাম বারুদটি দিয়ে ফেলে। গুলজার সেটি পেয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে চন্দ্রলালের সাথে। হাতের মুঠো শক্ত হয়ে আসে শেহজাদের। সে রাগ সংবরণ করতে না পেরে পরোয়া না করে চন্দ্রলালকে টেনে এনে মাথা ধরে দেয়ালে ছুঁড়ে মারে। গুলজার খেপে যায়। শেহজাদের দিকে সে এগিয়ে আসে, তার সৈন্যগুলোও এগিয়ে আসে। শেহজাদ আর সাফায়াত চন্দ্রলালকে মারতে থাকে। কাশীম সৈন্যদের সাথে লড়ে। শেরহাম গুলজারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই সুযোগে। বারুদটি কেড়ে নেয়ার জন্য মারতে থাকে। গুলজার ছাড়েনা বারুদটি। চন্দ্রলাল মার খেয়েও দাঁড়িয়ে পড়ে। তার শরীরে যেন প্রাণ আরেকটুর জন্য আটকে আছে। ঢলতে ঢলতে আচম্বিত খঞ্জর ছুঁড়ে মারে সাফায়াতের বুকে তার পরপরই শেহজাদ তার মুখে লাথি মারে। চন্দ্রলাল হাসতে থাকে। তার দাঁত দেখা যায় না রক্তের জন্য। সাফায়াতকে দেখে চিৎকার দিয়ে উঠে শেহজাদ। চন্দ্রলালের দিকে তেড়ে গিয়ে একনাগাড়ে চা**কু বসায়। চন্দ্রলালের মুখ দিয়ে রক্তের বুদবুদ বের নয়।
সাফায়াত দেয়াল চেপে বসে পড়ে। শেহজাদ সাফায়াতের দিকে এগিয়ে যায়। চন্দ্রলাল চোখ মেলে শেহজাদের পানে তাকায়। পাশ থেকে খঞ্জর তুলে ছুঁড়ে মারে শেহজাদের পিঠে। শেহজাদ পিঠ চেপে ধরে। কাশীম খঞ্জর তুলে সেই খঞ্জর চন্দ্রলালের গালের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। শেহজাদও সাফায়াতের পাশে দেয়াল চেপে বসে পড়ে।
এদিকে শেরহাম গুলজারকে গায়ের নীচে চেপে ধরে বারুদ নিয়ে নেয়। কাশীমকে বলে,
‘ ওদের বাঁচাও। পালাও কপাট দিয়ে। তাড়াতাড়ি করো। শেহজাদ যাহ। বিস্ফোরণ ঘটবে এখন। ‘
বারুদ গরম হয়ে আসায় গুলজারও চিৎকার দেয় সৈন্যদের। বারুদ ছুঁড়ে মারবে এই ভয়ে সৈন্যগুলো সব শেরহামকে চেপে ধরে। শেহজাদ বহুকষ্টে দাঁড়ায়। শেরহামকে চেপে ধরা সৈন্যদের পিঠের পোশাক টেনে খঞ্জরের আঁচড় বসায়। শেরহাম গুলজারকে চেপে ধরা অবস্থায় বলে
‘ খোদার কসম করে বলছি। পালা তুই। যাহ। ‘
কাশীম সাফায়াতের নিথর দেহ কাঁধে তুলে নিয়ে শেহজাদকে ডাকতে থাকে। শেহজাদ সৈন্যদের হাত থেকে শেরহামকে মুক্ত করতে চায়। বলে,
‘ না না আমি তোমাকে একা রেখে যাব না। ‘
গুলজারের গলা চেপে ধরে অন্য হাতে বারুদ চেপে ধরে সৈন্যদের তলোয়ারের নীচে পড়ে থাকে শেরহাম। শেহজাদের হাত চেপে ধরে কাশীম। বলে
‘ চলুন রক্তপাত হচ্ছে আপনার। সবাই অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্য। ‘
শেহজাদ শেরহামের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। শেরহাম রক্তলাল চোখদুটো তুলে তাকায় ভইয়ের দিকে। বারুদ উত্তপ্ত হয়ে আসে। হাতে জ্বলে যাচ্ছে এমন উত্তাপে। ভাই ভাইয়ের দৃষ্টি মিলনে দুজনের অন্তঃপুরে রক্তক্ষরণ হয়। শেহজাদ যন্ত্রণা ঠোঁট কামড়ে সহ্য করে ডেকে উঠে, ‘ ভাইজান এভাবে কি করে যাই?’ ‘
শেরহাম চেয়ে রয় চোখ তুলে। বলে,
‘ খোদার কসম। তুই না গেলে সবাইকে পুড়ে মরতে হবে। যাহ। ‘
‘ না। আমি যাব না। ‘
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে শেহজাদের। সৈন্যদের দিকে এগিয়ে আসার শক্তি পায় না আর। শেরহাম বলে উঠে,
‘ আর কয়েকটা মুহূর্তে! ‘
কাশীম খপ করে শেহজাদের হাত ধরে। টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় কাশীম। দপদপ পায়ের শব্দ তুলে ভাঙা জানালার উপর ডিঙিয়ে তারা অদৃশ্য হয়। শেহজাদ বারংবার ফিরে ফিরে তাকায় পেছনে। অস্ফুটস্বরে ডাকে, ভাইজান ফিরে এসো!’
শেরহামের গায়ের নীচে চাপা পড়া গুলজার বারুদটা নিয়ে ফেলার চেষ্টায় রত। কিন্তু নিতে পারেনা। সৈন্যরা ভয় পেয়ে যায়। না বারুদ বিস্ফোরণ হলে তারা বাঁচতে পারবে না। তাদের বাঁচতে হবে। এদের ধ্বংস করতে হব।
আর কোনো উপায়ান্তর না দেখে সৈন্যগুলোও শেরহামকে মারা বন্ধ করে উঠে পড়ে। শেহজাদ আর কাশীম যেদিকে পালিয়েছে সেদিকে পালানোর পথ ধরে প্রাণ বাঁচাতে । পিঠের উপর হতে তারা সরে পড়ায় শেরহাম ভারমুক্ত হয়। বড়সড় একটা দম বেরিয়ে আসে। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে।
শেহজাদের হাত ধরে সাফায়াতকে কাঁধে নিয়ে অত উঁচু হতে নীচের ঝোপের উপর থাকিয়ে আকাশের দিকে একবার তাকায় কাশীম। খোদাতায়ালাকে স্মরণ করে। আল্লাহ সহায় বলে লাফ দেয়। তার বিশালদেহ ঝাঁপিয়ে পড়ে ঝোপের মধ্যে। তারপরের কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধতায় কাটে। শাঁ শাঁ বাতাসের শব্দ কানে আসে।
আচমকা ভবন হতে গুলজারের তীক্ষ্ণণ চিৎকার ভেসে আসে। জানান দেয় অপয়াশক্তির বিনাশ। এই বিনাশে ধরণী কেঁপে উঠে। আধভাঙা দরজাটি বিকট শব্দ তুলে ধসে পড়ে। সৈন্যগুলো কাশীমের দেখাদেখি লাফ দেয়ার পূর্বেই বিকট শব্দে কেঁপে উঠে পৃথিবী। দপ করে আগুন ছলকে উঠে। চামড়া পুড়িয়ে দেয়। শ্বাস রোধ করে নেয় ধোঁয়ায়, আগুনের তীব্রতা। তাদের পাশ দিয়ে উল্কার গতিতে কি যেন ছুটে যায়। প্রলংকরী আগুনের গনগনে তাপে পুড়ে ছাঁই হয়ে যেতে থাকে সবকিছু। ঠাসঠাস শব্দে কি যেন ফুটতে থাকে । আকাশ লালচে হয়ে উঠে। কালো কালো ধোঁয়ার রাশি কুন্ডলী পাকিয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে। আগুনের মাত্রাও ছড়াতে থাকে। পাতাবিহীন গাছগুলো মড়মড় শব্দে ভাঙতে থাকে। পুড়তে থাকে। বহুদূরব্যাপী লেলিহান অগ্নিশিখা ছড়িয়ে পড়ে। কালো পাহাড়গুলি আগুনের ধোঁয়ায় ঝাপসা হয়ে আসে। আকাশ আর পাহাড়ে রঙ মিলেমিশে একাকার হয়ে।
শেহজাদের যখন জ্ঞান ফিরে তখন সে দেখতে পায়ে তার পাশে সাফায়াতের দেহ। সে মাথা তুলে হাতটা রাখে সাফায়াতের গালে। দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা বাসভবনের দিকে তাকিয়ে রয়। ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। খুকখুক করে কাশতে কাশতে আবারও মাথাটা ফেলে দেয় মাটিতে। চোখ বুঁজে। অস্ফুটস্বরে ডাকে, ‘ ভাইজান!’
কাশীম তাদের মাথার শিয়রে এসে বসে। ঘনকৃষ্ণ বর্ণ ধোঁয়ার রাশির দিকে চেয়ে থাকে নিষ্পলক।
____________________
মরা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে তাঈফ নাদির সকলেই দেখে দাউদাউ মড়মড় শব্দ করে পুড়ছে ওই অদূরের একটা ভবন। স্পষ্ট দেখতে না পেলেও আওয়াজ শুনে তারা বুঝতে পেরেছে সেখানে বিস্ফোরণ হয়েছে। আগুনের মাত্রা, তীব্রতা দেখে বুঝা যাচ্ছে সেটি যে সে বারুদ নয়। আগুনের তাপে আকাশ থমথমে হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। মরা নদীর পানিরও যেন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। মফিজ আর কালাম ফিরে এল জাহাজে।
এমন বিধ্বংসী আগুনের আগুনের কথা জানাতেই খোদেজা, শাহানা সকলেই জাহাজ থেকে নেমে এল। নেমে এল বোনেরাও। অপরূপা শোয়া থেকে উঠে বসলো। সবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। অনুপমা দু’পাশে মাথা নেড়ে বলল,
‘ না না কথা বলো না এখন। কারো কিছু হয়নি। তোমাকে জানাবো আমি। ‘
অপরূপার কথা বলার শক্তিটুকু নেই। কিন্তু সে শুঁতে পারে না। জাহাজ থেকে নেমে খোদেজা, শাহানা, হামিদাসহ সায়রা সোহিনীরা সকলেই ছুটতে থাকে। তটিনী শোহরাবকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার চোখ বুঁজে এসেছিল। সবার চেঁচামেচি কান্নার শব্দে ঘুম ছুটে যায় তার, সাথে আয়শা, সিভান আর হুমায়রার। অপরূপার বাবুরা সায়রা শবনমের হাতে। তটিনীর বাবু তার কোলে। এত চেঁচামেচি শুনে সে কান্না শুরু করে দিয়েছে। তটিনী বাচ্চাকে কোলে জড়িয়ে পাথর চোখে চেয়ে দেখে সবার ছুটে যাওয়া। চোখের জল চোখে টলটল করতে থাকে। গড়িয়ে পড়েনা তারা।
অপরূপা অনুপমাকে সরিয়ে দেয়। পেটে একহাত চেপে দাঁড়িয়ে পড়ে। অনুপমা মরিয়ম তাকে ঝাপটে ধরে বলে,
‘ না না এক পাও হেঁটোনা তুমি। মরে যাবে। বাচ্চাগুলোর কথা ভাবো। ‘
অপরূপা তাদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জাহাজের বাইরে বেরিয়ে আসে মাথা ওড়না ঢেকে খালি পায়ে। তটিনীও পা বাড়ায় তার পিছু পিছু। তার পা এগোতে চায় না। শরীরে শক্তি কুলোয় না। কোমরে ব্যাথা অনুভব হয়। শোহরাব কাঁদছেই।
জঙ্গলের শেষের সাদা বালির মাটি কামড়ে হেঁটে দৌড়ে সকলেই ছুটে যায় অদূরে মরা নদীর পাড়ের দিকে। হৃদপিণ্ড লাফিয়ে গলার কাছে এসে থামে। উত্তেজিত, উৎকন্ঠিত, উতলা মন ব্যাকুল হয়ে থাকে তাদের খবর শোনার জন্য।
নদীর পাড়ের কাছাকাছি গিয়ে অপরূপা আর শ্বাস নিতে পারেনা। বসে পড়ে। তাকে সবাই এসে ধরে। অপরূপা মাথা এলিয়ে দেয় খোদেজার কাঁধে। বাচ্চাগুলো চেঁচিয়ে কাঁদছে। তটিনী সিভানের সাথে লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে আসছে। শরীর একটুও সায় দিচ্ছে না তাকে, তারপরও সে হাঁটছে মনের জোরে। শোহরাবের গালে ঠোঁট চেপে চুমু খায়। অদূরে রঞ্জিত অন্তরীক্ষের দিকে দৃষ্টি পড়তেই সে মরা নদীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখে। মরা নদীর কালো রঙের পানিও আজ যেন আগুনবর্ণে সেজেছে। অপরূপাকে ঘিরে বসে সকলেই। পানি খাওয়ায়, হাত পা মালিশ করে, সান্ত্বনা দেয়।
নাদির তাঈফ সায়রা, শবনমের হাত থেকে বাবুদের কোলে তুলে নেয়। সায়রা অপরূপার কাছে ছুটে আসে। সকলেই অপরূপাকে ঘিরে দাঁড়ায়। অপরূপার হাঁপানি থেমে যায় হঠাৎ। জড় পদার্থের ন্যায় অদূরে চেয়ে থাকে দৃষ্টি স্থির করে। সকলেই তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকায়। আগুনের মাত্রা নদীর কাছাকাছি ঝোপঝাড়ের চলে এসেছে। যেন নদীর পানিতেও আগুন ধরে যাবে এমনদশা। সেই নদীর বুক ছিঁড়ে পাড়ে এসে থামে কয়েকটা নৌকা। বিশালদেহী কাশীমের পেছন পেছন অর্ধমৃতপ্রায় দুজন লোক হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসছে। তাদের হাঁটা দেখে মনে হয় তারা খুঁড়ে খুঁড়ে হাঁটছে। সকলেই স্তব্ধ চোখে চেয়ে থাকে। হৃৎস্পন্দন থমকে যায় সকলের। মশালের রক্তিম আলোয় দেখা যায় তাদের বদনখানি। বালি কামড়ে তারা আর বেশিদূর এগোতে পারে না। অপরূপাকে আর কেউ ধরে রাখতে পারেনা। তাকে দেখে থমকে যায় শেহজাদ। অপরূপা তার অবস্থা দেখে চেয়ে থাকো আলাভোলা হয়ে। শেহজাদ থমকে থমকে হাঁটে। অপরূপা ছুটে গিয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। শক্তি না থাকায় শেহজাদ বালি মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসে যায়। অপরূপাকে জড়িয়ে ধরে। থেমেথেমে বড়সড় দম ফেলে ডাকে,
‘ আমার বেগম। ‘
অপরূপা আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে।
অপরদিকে সায়রা সাফায়াতের মাথাটা কোলে নিয়ে অশ্রু বিসর্জন করে। সাফায়াত আরামে চোখ বুঁজতে বুঁজতে চোখের কোণে জল আর অধর কোণে হেসে ডাকে
‘ আমার বানু।’
সায়রা গা কাঁপিয়ে কেঁদে উঠে। তার চোখের জল সাফায়াতের মুখ ভিজিয়ে দেয়।
শীতল বাতাস গায়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। তটিনী শোহরাবকে তার বুকের সাথে চেপে ধরে রাখে। ওড়না দিয়ে তার মুখ ঢেকে দিয়ে ঘনঘন চুমু খায়।
তপ্ত নদীর পানির উর্ধ্বে ধোঁয়া উড়ছে। কুয়াশার জালের মতো ধোঁয়াশা হয়ে আছে সেই সরু নদী। তটিনী সেপথে চেয়ে থাকে। নদীর পাড়ে হঠাৎ একটি মশাল জ্বলে উঠে। দীর্ঘদেহী একটি ছায়ামানবের আবির্ভাব ঘটে। তটিনী সেটিকে উদ্দেশ্য করে হেঁটে যায়। তার চোখের জল আর বাঁধা মানে না। কোলের বাচ্চাটিও যেন তালে তাল মিলিয়ে কাঁদতে থাকে।
আগামী দিন নতুন ভোর হবে, নতুন সূর্য উঠবে, তার নতুন জীবনে নতুন মানুষের আগমন ঘটবে, পৃথিবীটা সেজে উঠবে নতুন করে, নতুন নিয়মে, নতুন সাজে, নতুন ছন্দে। তাই তটিনীর আর কোনোদিনও কাঁদার দরকার পড়বে না। সে বালিমাটি কামড়ে হেঁটে এগিয়ে যায়। নিকটে গিয়ে ছায়ামানবকে উদ্দেশ্য করে অস্ফুটস্বরে বলে,
‘ যতবার তুমি ধ্বংসের দিকে এগোবে আমি ততবারই তোমাকে জীবনের দিকে টেনে নিয়ে আসব। তুমি আমার টানে বারবার ফিরে আসতে বাধ্য। ‘
সমাপ্ত সমাপ্ত সমাপ্ত
আমি আজকে আর কিছু বলতে পারছিনা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যারা পাশে ছিলেন, ভালোবাসা দিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন তাদের আমার অন্তর স্থল থেকে কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। ❤️❤️❤️❤️
পরিশেষে একটা প্রশ্ন #প্রিয়_বেগম প্রিয় হতে পেরেছে আপনাদের?
গল্পটা এককথায় অসাধারণ হয়েছে লেখিকার কাছে একটা অনুরোধ থাকবে যেন এটার ৩য় সিজন বের করে হোক সেটা ছোট করে কিন্তু যেন ৩য় সিজনটা আনে আর সেখানে যেন তটিনী-শেরহাম রূপা-শেহজাদের একটু সুখের মূহুর্ত বর্ণনা করে আসলে গল্পের শেষের দিকে তাদের এত বিপদ আর বিপর্যয় দেখার পরে এখন তাদের পরবর্তী সুখের জীবনটাও দেখতে ইচ্ছে করছে গল্প তো অনেকই পড়ি কিন্তু এই প্রথম কোন গল্প পড়ে কমেন্ট করলাম লেখিকা যদি কষ্ট করে এই অনুরোধ টুকু রাখে তাহলে অনেক খুশি হব আর হ্যা অনেক ধন্যবাদ লেখিকাকে এত সুন্দর একটা গল্প এত সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করার জন্য
দারুন দারুন দারুন একটা গল্প,,,,,, কোনো গল্পের জন্যই এতোটা আগ্রহে থাকি নাই যতটা আগ্রহ নিয়া অপেক্ষা করছি এই গল্পটার জন্য,,,,,,,, প্রিয় গল্পগুলোর মধ্যে ‘ প্রিয় বেগম ‘ গল্পটাও যোগ হলো,,,,,,,,, শেরহাম আর তটিনীর জুটিটা খুব বেশি পছন্দ হইছে,,,,,,,,,,,,,,,,
অনেক দিন পরে একটা ভালো গল্প পড়লাম। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শক্ত বান্দুনি তে গাঁথা ছিলো। অসংলগ্ন লাগেনি। কোনো নেগেটিভিটি ছিলো না গল্পে। বেশ ভালো লাগলো পড়তে।
এই গল্পের আরেকটা জিনিস ভালো লাগছে,,,, তা হলো, চরিত্রের নাম এবং জায়গার নাম গুলো,,,,, কিছু কিছু গল্পে প্রধান চরিত্রের নাম গুলো এত্তো পঁচা হয় যে,,,,,, গল্প পড়ার ইমেজ টাই নষ্ট হয়ে যায়,,,,,,, দারুণ একটা গল্প