#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_৩৫
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
নানাজানের লাশ মহল প্রাঙ্গনে প্রবেশ করামাত্রই সবার প্রথমে একটি নারীকন্ঠ প্রচন্ড আওয়াজ তুলে কান্নায় ভেঙে পড়লো। বাকিরা স্তব্ধ। সোহিনীকে কেউ আটকে ধরে রাখতে পারছেনা। বৃদ্ধ মানুষটা মৃত্যুর দৌড় গোঁড়ায় সে জানতো। কিন্তু এভাবে নানাজানের মৃত্যু হবে তা সে মানতে পারছেনা। কেন তার কাছের মানুষগুলো এভাবে ছেড়ে চলে যায়। কতটা কষ্ট পেয়ে, কতটা ব্যাথা বুকে নিয়ে দুনিয়া ছাড়তে হলো নানাজানকে । শেরতাজ সাহেবের বুকের কাপড় খামচে ধরে সে কেঁদে যাচ্ছে চিৎকার করে। শেরতাজ সাহেব কিছু বলতে পারছেন না। হতবাক হয়ে চেয়ে আছেন লাশ তিনটের দিকে। লাশের মুখগুলি ঢাকা। লাশ দেখে সকলেই যখন দিশেহারা, স্তব্ধ, বাকহীন ঠিক তখনি ঠোঁটে কান্না চেপে অপরূপা সিংহদুয়ারে চোখ রাখতেই দেখতে পেল সাফায়াত আর শেহজাদ প্রবেশ করছে। দুজনের কোলভর্তি। সাফায়াতের কোলে থাকা মেয়েটিকে কারো চিনতে ভুল হলো না পোশাক দেখে। শেহজাদের কোলে একটি তুলতুলে বাচ্চা দেখে দ্বিগুন বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল বাকিসবাই। সোহিনী মূর্ছা গিয়েছে নানাজানের চেহারা দেখার পরপর।
তটিনীকে দেখে সায়রা, শবনম, শাহানা, খোদেজা সকলেই ছুটে এল। শাহানা সাফায়াতের নিকট ছুটে গিয়ে তটিনীকে দেখে মূক হয়ে সাফায়াতের দিকে দৃষ্টি তুললো। সাফায়াত মায়ের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে শেহজাদের কোলে থাকা বাচ্চাটির দিকে তাকালো। শাহানা তার চোখ অনুসরণ করে শেহজাদের দিকে তাকালো। খোদেজা ততক্ষণে কোলে নিয়ে ফেলেছে বাচ্চাটাকে । অশ্রুজলে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কি এনেছ এটা? ‘
শেহজাদ আবেগকম্পিত কন্ঠে বলে,
‘ ভাইজান। ‘
খোদেজা আদর করে। সায়রা জানতে চায়।
‘ আর বড় ভাইজান? কোথায় উনি? ‘
শেহজাদ হাতের কব্জি দিয়ে মুখ মুছে ধরা গলায় বলে,
‘ ওরা ধরে নিয়ে গেছে ভাইজানকে। ‘
সকলেই ওড়নার আঁচল টেনে মুখে গুঁজলো। বাচ্চাটা কেঁদে উঠলো চেঁচিয়ে। শাহানা ডুকরে কেঁদে উঠলো বাচ্চাটার সাথে সাথে। কান্নার জোয়ারে ভাসলো মহল প্রাঙ্গন। শেরতাজ সাহেবের কাছে বাচ্চাটিকে নিয়ে যায় শাহানা। হাঁটুভেঙে বসে বাচ্চাটিকে দেখিয়ে বলে,
‘ দেখো ভাইজান কে এসেছে। ‘
শেরতাজ সাহেব দুয়ারে পিলারের সাথে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। শাহানার ডাকে বুঁজে রাখা চোখ খুললেন। শাহানা দেখিয়ে বলল,
‘ তোমার নাতি। কোলে নাও। ‘
শেরতাজ সাহেব দু’পাশে মাথা নেড়ে বলে,
‘ না না আমি এই মুখ কি করে এই বাচ্চাকে দেখাবো? আমি ঘোর অন্যায় করেছি আমার ছেলের সাথে। আমি ওকে কোলে নিতে পারব না। আমি ওর বাবার সাথে অন্যায় করেছি। আমি ওকে একটা সুস্থ জীবন দিতে পারিনি। ‘
বাচ্চাটার চোখ বুঁজা। হাত পা নেড়ে কেঁদে যাচ্ছে অবিরত। শাহানা তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে আদর করতে থাকে। শবনম, আয়শা ছোট ছোট হাতগুলি ছুঁয়ে ছুঁয়ে কাঁদে। তটিনীকে মহলের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়।
শেহজাদ দুয়ারে এসে বসলো ধপ করে। কাশীমকে ডেকে বলল,
‘ দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করো। সৈন্যরা ফিরে এলে সবাইকে তৈরি হতে বলো। ওদের আমি শেষ দেখে ছাড়বো। পনের বছর পূর্বের সেই যুদ্ধ আবারও ঘটবে। আমি ছাড়বো না জানোয়ারদের।’
কাশীম মাথা নেড়ে দ্রুতপায়ে চলে গেল। নানাজান আর উনার ভৃত্য দু’জনকে গোসলের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বড়ই পাতা দিয়ে গরম জলের ব্যবস্থা করা হলো প্রাঙ্গনে আঙুল জ্বালিয়ে। তেরপাল টেনে গোসলখানার মতো টাঙানো হলো। আগরবাতির সুগন্ধে, এতিমখানার বাচ্চাদের মধুর কোরআন তেলওয়াতের আওয়াজে মহল প্রাঙ্গন মেতে উঠলো। জানাজার নামাজের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া হলো নগরের আনাচে-কানাচেতে।
তটিনীর শিয়রে বসে আছেন সকলে। পাশাপাশি তার বাচ্চাকে রাখা হয়েছে। হাত পা নেড়ে লাল টকটকে জিহ্বা দেখিয়ে উচ্চৈস্বরে সে কেঁদেই চলেছে তখন থেকে। কান্না থামছেনা। মায়ের দুগ্ধ পান করার জন্য ক্ষুদার্ত সে। কারো সান্ত্বনা, আদর মানছেনা। শাহানা বুকে জড়িয়ে তুলতুলে মুখটা নিজের গালের সাথে লাগিয়ে কেঁদে চলেছেন। কান্না থামিয়ে বললেন, ‘ খিদে পেয়েছে আমার ভাইয়ের? তোমার মা তো চোখ-ই মেলে না। ‘
বাচ্চাটা আরও জোরে কাঁদে।
সায়রা অপরূপা, অনুপমা মরিয়ম সকলেই সোহিনীর মাথার শিয়রে বসা। তার জ্ঞান ফিরছেনা। হলুদ পোড়া, রসুন পোড়া, লেবু পাতা সবকিছু দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে সবাই মিলে। তাঈফ কয়েকবার এসে দেখে গিয়েছে তাকে। এই মহলে না এলে জীবন যে এত রঙের হতে পারে তা সে জানতো না। সোহিনীর কান্না তার সহ্য হয় না। কাছে গিয়ে সান্ত্বনা দেবে এমন সুযোগও নেই। এখন জ্ঞানও ফিরছেনা মেয়েটার।
তাকে উঁকিঝুঁকি আর বারবার এদিকে আসতে দেখে সায়রা টের পেল। বাইরে গিয়ে তাকে ডাকলো। বলল, ‘সুহিকে একটু দেখতে হবে ভাইজান। ওর জ্ঞান তো ফিরছেনা। ‘
তাঈফ সাথেসাথেই বললো, ‘ আমি কি যেতে পারি ওখানে? চেষ্টা করে দেখবো। ‘
‘ হ্যা, আসুন। আপনাকে দরকার। বেশিক্ষণ অজ্ঞান থাকলে তো ক্ষতি। ‘
তাঈফ তার সাথে কক্ষে প্রবেশ করলো। সকলেই মাথায় কাপড় টানলো তাকে দেখে। তাঈফ সোহিনীর নিকটে গিয়ে বসলো।
নানাজানকে কাফন পড়ানোর সময় সবাইকে শেষবার দেখার জন্য ডাকা হলো। সোহিনীর জ্ঞান তার কিছু আগে ফিরেছে। তাঈফ সক্ষম হয়েছিল তার জ্ঞান ফেরাতে। জ্ঞান ফিরে তটিনীকে ওই অবস্থায় দেখে সে আরও ভেঙে পড়েছে। সাথে ভাইপোকে দেখে শাহানার কোল থেকে নিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে এলোপাতাড়ি চুমু দিতে দিতে কেঁদে যাচ্ছে। বাচ্চাটির কান্না তো থামার কথায় নেই। শাহানা অনেকবার চেষ্টা করেছে কিন্তু সে মায়ের দুধ পাচ্ছে না। কি হবে তা নিয়ে তিনি বড়ই চিন্তিত। খিদেয় কেমন কাঁদছে বাচ্চাটা।
সবাই নানাজানকে শেষ দেখা দেখে নিল। ভৃত্যদুজনকে নানাজানের পাশাপাশি কবর দেয়া হবে। তারা নানাজানের অত্যন্ত বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা ছিল। বিপদেআপদে ঢাল হয়ে ছিল। তাদেরও উত্তম মর্যাদা দিয়ে দাফন করা হবে এই আদেশ দিয়েছে শেহজাদ । নানাজানকে শেষবার দর্শন করে খাটিয়ায় মাথা ঠেকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সোহিনী। বলল,
‘ তুমি চলেই যখন যাবে তাহলো এতগুলো বছর পর দেখা দিলে কেন? আমার ভাইজানকে ফিরিয়ে না এনে চলে গেলে কেন? সবাই কেন আমাকে এভাবে কষ্ট দাও? আমি সবাইকে নিয়ে একসাথে থাকতে চেয়েছি, আর কিছু চায়নি। ‘
সায়রা আর শবনমও তার সাথে সাথে কাঁদতে তাকে। তাকে ধরে নিয়ে আসে জোর করে। কাঁধে খাটিয়া তুলে নেয় শেহজাদ, সাফায়াত, শাহজাহান সাহেব আর শেরতাজ সাহেব। উচ্চৈস্বরে কালেমা ধ্বনিতে মেতে উঠে মহল ও চারপাশ। সোহিনী খাটিয়ার দিকে চেয়ে থেকে বুক ফাটিয়ে কাঁদে। হামিদা তাকে জড়িয়ে ধরে রাখে বুকের সাথে। সিভান ঠোঁট ভেঙে কাঁদে বোনের সাথে সাথে।
____
চক্ষুরুন্মীলন হতেই তটিনী শুনতে পায় অবিরত কেঁদে যাওয়া একটা বাচ্চার ক্রন্ধন। সাথে হু হু করে কেঁদে যাওয়া একটি মেয়ে কন্ঠস্বর। মাথার শিয়রে মাকে দেখে। সামনে আশেপাশে, সব আপনজনেরা হা হুতাশ করছে। কিন্তু যাকে দেখার তীব্র আগ্রহ, তীব্র কৌতূহল তাকে দেখতে পায় না। ওই অন্ধকার কুটিরে সে ছিল না? প্রচন্ড ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে হঠাৎ করে চক্ষু বুঁজে নিয়েছিল ভারমুক্ত হওয়ার সাথে সাথে! সে উঠে বসার চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা। কি টনটনে ব্যাথা পুরো শরীরটা! শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। সকলেই তার কাছে ছুটে এল। শবনম তার পিঠের নীচে বালিশ রেখে বসালো। শাহানার কোলে কাঁদতে থাকা বাচ্চাটির দিকে নজর পড়তেই বুকটা আচম্বিত কেঁপে উঠে তার। পেটে হাত রাখতেই চোখদুটো বড়বড় হয়ে উঠে। শাহানা বাচ্চাটিকে এনে তার বুকের উপর রাখলো। বলে,
‘ দেখো, এটা কে? ‘
তটিনী স্তব্ধ হয়ে প্রাণভরে বাচ্চাটাকে দেখে দুচোখ মেলে। কম্পিত হাত দুটো বাড়িয়ে তুলতুলে শরীরটা ছুঁই। সাথে সাথে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে নিদারুণ সুখানুভবে। চোখের কোটরে জল জমে উঠে। সবার দিকে তাকিয়ে ভাবলো, সবাই এভাবে কাঁদছে কেন? কিন্তু জিজ্ঞেস করলো না। কেউ তাকে কিছু জানাতেও চায় না। শেহজাদ বারণ করেছে ঘটা করে না জানাতে।
শাহানা বলল,
‘ তোমার ছেলেবাবু এসেছে। দেখো কেমন কাঁদছে।’
তটিনী একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। হাত দিয়ে ছুঁই। কোলে তুলে নেয়। মুখটার দিকে চেয়ে ভাবে এইতো সে, যাকে সে তার বাবার মুক্তির উসিলায় চেয়েছে খোদাতায়ালার কাছ থেকে । এই তো সেই ভালোবাসার অস্তিত্ব, যে ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে সে বাঁচতে চেয়েছে। এ তো সেই, যার মুখ দেখার জন্য এতদিন অপেক্ষায় মুখিয়ে ছিল সে। তাকে কি তার বাবা দেখেনি, ছুঁইনি, আদর করেনি? নিষ্ঠুর মানবকে সে ভালোবেসে মানুষে পরিণত করেছিল। সে তো ভালো বাবাও হতে পারতো!
মুখের সামনে এনে অসংখ্যবার শুষ্ক ঠোঁট ছোঁয়ালো সে তার সন্তানের মুখে। ঘ্রাণ নিল। নিজের মুখের সাথে গালটা লাগিয়ে রাখলো। শাহানা বলল,
‘ একটু খাওয়ানোর চেষ্টা করো আগে। খিদেয় কাঁদছে। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি। খাওয়াতে পারছিনা। একটু চেষ্টা করো। ‘
তটিনী হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,
‘ ও কোথায় আম্মা? ‘
শাহানা থমকে গেল। সোহিনী মুখ তুলে চাইলো। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখ চেপে কাঁদলো। সকলেই মুখে কাপড় গুঁজলো। তটিনী সবার মুখদর্শন করতে করতে সন্তানকে শান্ত করলো। মায়ের বুকের দুধ পেয়ে কান্না থেমে এল বাচ্চার। মায়ের শরীরের উমে দুগ্ধ পান করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো। তটিনী চেয়ে রইলো ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে।
শাহানা বলল, ‘ ওর নাম….
তটিনী ওর মাথার চুলগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ ওর আব্বা ওর নাম দিয়ে গেছে। ওর নাম শোহরাব সুলতান। ‘
শাহানা ওর শুকনো মুখের দিকে চেয়ে থাকে। তটিনী ছেলের মুখে তার গাল লাগিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ ওকে ওরা নিয়ে গেছে না? সত্যি করে বলো আম্মা। ‘
শাহানাসহ সবাই অবাকদৃষ্টিতে তাকায়। চোখের জল লুকায়। তটিনী উত্তর না পেয়ে চোখ বুঁজে নেয়। শাহানা তার গাল মুছে দেয়। কি বলবেন খুঁজে পায় না। জিজ্ঞেস করেন,
‘ শেরহামের সাথে তোমার শেষ কি কথা হয়েছে? ‘
‘ ও ফিরে এলে কাঁদতে বলেছে। ‘
শাহানা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে। মেয়ের দুগাল আঁকড়ে ধরে বলে,’ তাহলে আর কেঁদোনা। ‘
বলতে বলতে তটিনীর সাথে উনি নিজেই ডুকরে উঠেন।
সোহিনী কেঁদে উঠে তটিনীর কাছে এসে মাথা ঠেকিয়ে পড়ে থাকে। কান্নার চোটে তার শরীর দুলে উঠে। তটিনী সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টায় রত। সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে মনে মনে আওড়ায়, ‘ তোমার আব্বা কি তোমাকে দেখেনি? আমি কত কান্না জমাবো? ‘
__________
কবরে মাটি দিয়ে সবাই মহলে পৌঁছে এল। সৈন্যরা সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে মহল প্রাঙ্গনে । গুরুত্বপূর্ণ আলাপ-আলোচনা চলছে। সৈন্যরা জানালো শেরহাম সুলতানের যে সৈন্যগুলো মারা গিয়েছে তাদের কবর দেয়া হয়েছে। এবং শেরহাম সুলতানকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কালো পাহাড়ের নীচে জংলা হাঁটার সেই ডাকাত আস্তানায়। শেহজাদ সবাইকে প্রস্তুত হতে বলে মাথার টুপি খুলে সদর দরজার দিকে ব্যস্ত পায়ে প্রবেশ করার পথে দুয়ারে বসা একটা ছোট্ট মেয়েকে দেখতে পেল কান্নারত অবস্থায়। সিভান তাকে কতকিছু জিজ্ঞেস করছে সে একটা কথারও জবাব দিচ্ছে না। নীরবে কেঁদে যাচ্ছে। শেহজাদ তার দিকে এগিয়ে যায়। মেয়েটা এত অল্প বয়স কিন্তু দুরন্তর সাহসী। তনীর সন্তান আজ বেঁচে আছে এই বাচ্চা মেয়েটির কারণে নইলে অন্য কিছু হতে পারতো। সে মেয়েটির কাছে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে বলে,
‘ তোমার দাদীজান সুস্থ হওয়া পর্যন্ত তুমি এই মহলে থাকবে। চলো, ভেতরে চলো। ‘
মেয়েটির গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। শেহজাদ লক্ষ করলো তার পায়ে ফোস্কা পড়েছে। আগুনে পোড়া ফোস্কা। সে তাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
‘ আমি তোমার ভাইজানের মতো। তুমি আজ থেকে এই মহলে থাকবে। তোমার ভাইজানের মহলে। ‘
সে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে বলে,
‘ দাদীজান কি মইরা যাইবো? ‘
‘ আল্লাহ জানেন। ‘
শেহজাদ তাকে খোদেজা আর হামিদার হাতে তুলে দেয়। সবাই দেখে ছোট্ট পুতুলের মতো মুখ তার। হিজাব পড়ায় গোলগাল মুখটা অসম্ভব আদুরে লাগছে। ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে সে। তটিনীর বাচ্চাকে নিয়ে আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিল সে; তা শুনে সবাই অবাক চোখে তার দিকে চেয়েছিল। শাহানা ছুটে এসে বুকে আগলে ধরে বলে, ‘ কেঁদোনা। এখানে অনেকে আছে। তোমার দাদী সুস্থ হয়ে যাবে। চলো, পায়ে ঔষধ লাগাই।’
তটিনী হুমায়রাকে দেখে উতলা হয়ে জানতে চায়।
‘ এই মেয়ে তুমি দেখেছ ওর আব্বাকে? নানাজানকে? দেখেছ? ‘
হুমায়রা তার কাছে এসে বসে। বাবুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘ ওর আব্বারে ধইরা নিয়া গেছে। মাথায় মারছে। তারপর হাত বাইন্ধা নিয়া গেছে। আর নানারে মাইরা ফেলছে। আমার দাদীরেও গুলি মারছে। ‘
বড়বড় ফোঁটাসরূপ জল পড়তে লাগলো ওর চোখ দিয়ে। তটিনী নির্বাক চেয়ে থাকে শাহানার দিকে। চাদর খামচে ধরে বলে, ‘ নানাজান আর নেই? চলে গেছে সবাইকে ছেড়ে। আর আমি মুখটাও দেখতে পারলাম না! শেষ দেখা দেখতে পারলাম না আম্মা। কেন এমন হলো আম্মা? কেন?’
শাহানা চোখমুখ ঢাকে আঁচলে।
******
অপরূপাকে দেখতে না পেয়ে শেহজাদের হঠাৎই খেয়াল হয় তার কথা। সে কক্ষের দিকে দ্রুত পা বাড়ায়। কক্ষে পা রাখামাত্রই পা থমকে যায় তার। অপরূপা মেঝেতে বসে আছে খাটের পায়ায় হেলান দিয়ে। চোখ বুঁজে মাথা এলিয়ে দিয়ে আছে। শেহজাদ হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কি হয়েছে? কাউকে ডাকছো না কেন? তোমার খারাপ লাগছে কাউকে বলবেনা সেটা? ‘
অপরূপা তার স্পর্শ পেয়ে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে বলে,
‘ উত্তেজিত হবেন না। আপনার কাজে যান। আপনার ভাইজানকে ফিরিয়ে আনুন। উনার কত আদুরে একটা বাবু হয়েছে। তটিনী আপু একা উনার সন্তানকে কিভাবে মানুষ করবেন? আপনি যান। ‘
শেহজাদ তাকে বুকে টেনে জড়ালো। বলল,
‘ তুমি ক্ষমা করেছ ভাইজানকে?’
‘ আমি শেরহাম সুলতানকে ঘৃণা করি। একজন সন্তানের বাবাকে নয়। আপনাকে ছাড়া যেমন আমি কিছু কল্পনাও করতে পারিনা ঠিক তেমন অন্য মেয়েও তার স্বামী ছাড়া সন্তানকে নিয়ে বাকি জীবন কাটানোর কথা কল্পনা করতে পারেনা। আপনি যান। ‘
‘ কিন্তু তুমি অসুস্থ হয়ে পড়েছ। তুমি শুয়ে থাকো। আমি ডাকছি সবাইকে। ‘
অপরূপা ব্যাথা সহ্য করে ঠোঁট কামড়ে পড়ে থাকলো। ব্যাথায় শ্বাসনালী জমে আসছে। দম আটকে আসছে। অনুপমা, হামিদা, খোদেজা সকলেই ছুটে এল। খোদেজা বলল,
‘ হায় আল্লাহ! এখন কি হবে? এসময় দাত্রী কোথায় পাব? ‘
শেহজাদ বলল, ‘ আমি ডাক্তার ডাকতে বলি। ‘
খোদেজা বলল,’ না না আঁতুড়ঘরে পুরুষ ডাক্তার আসতে পারবে না। অন্য দাত্রীর খোঁজ করো। ‘
শেহজাদ হন্তদন্ত পায়ে বেরিয়ে গেল।
বহুকষ্টে দূরান্ত হতে একজন দাত্রীর খোঁজ পাওয়া গেল। নিয়ে আসা হলো তাকে রাতারাতি। সৈন্যরা সকলেই প্রস্তুত। শেহজাদ দাত্রীকে নিয়ে হাজির হওয়ামাত্রই অপরূপার আর্তস্বরে কান্নার আওয়াজ শুনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। রওনা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়া শুরু করলো। সৈন্যরা অস্ত্র গুছিয়ে নিয়েছে। তটিনী অপরূপার কথা শুনে তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে চুপটি করে বসে আছে। কক্ষের এককোণায় শেরহামের একটা চাদর, ফতুয়া দেখা যায়। সেই চাদরে সে শেরহামের বুকের সুবাস পায়। চাদরটা নিয়ে তার গায়ে আর বাচ্চার গায়ে জড়ায়। মনে হয় সে আগলে ধরে রেখেছে তার বউ বাচ্চাকে।
তটিনী চোখ বুঁজে তাদের সুখের মুহূর্তগুলো মনে করে অশ্রুজলে হাসে। সে কি পাগলামি!
সে একটু একটু করে কান্না জমায়।
রাত্রি গভীর হয়। আর তার মাঝেই জানা যায় অপরূপার এক ছেলে সন্তান, আর মেয়ে সন্তান হয়েছে। এত এত দুঃখ, কষ্ট, ব্যাথা-বেদনার মধ্যেও কত সুখবার্তা নিয়ে এল তারা! সকলেই সুখের অসুখে কাঁদে একসাথে। দুইভাইকে একসাথে পাশাপাশি শুয়ে রাখে খোদেজা। মাঝখানে বোনটিকে।
গায়ে লৌহবর্ম পরিধান করে সন্তান ভূমিষ্ঠের খবর শুনে ছুটে আসে শেহজাদ। এসেই দেখতে পায় দুই রাজপুত্রের মধ্যিখানে এক রাজকন্যা। খোদেজা তার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে,
‘ দেখো দেখো কারা এসেছে? বেরোনোর পূর্বে সাক্ষাৎ করে যাও। ‘
শেহজাদ এগিয়ে আসে। তাদের নিকটে বসে তিনজনকেই মনভরে আদর করে। ছোট্ট ছোট্ট হাতগুলি ছুঁই। নিজের চোখে চেপে ধরে।
বেরোনোর সময় হয়ে আসে। কাশীম ডাক পাঠায়। বেরোনোর পূর্বে দুই ভাইয়ের হাত একসাথে মিলিয়ে শেহজাদ বলে,
‘ তোমরা শুধুই ভাই। কেউ সম্রাট নয়। শুধুই ভাই।
আজ থেকে রূপনগর তোমাদের। আর আমার আম্মির কাজ ভাইজানদের নজরদারি করা। আসি, আল্লাহ হাফেজ। ‘
সকলেই তাদের যাত্রার দিকে চেয়ে থাকে। অস্ফুটস্বরে বলে,
‘ ফি আমানিল্লাহ।’
চলমান….
রিচেক হয়নি