প্রিয় বেগম ২ পর্ব-৩৩

1
1278

#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_৩৩:১
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

দিনটা শুক্রবার।
ফজরের নামাজ আদায়ের জন্য বয়স্করা উঠে গিয়েছিলেন। রসাইঘরে কাজ শুরু করেছে ফুলকলি, মতিবানু আর টুনু মিলে। কুমুদিনীর বাচ্চা নষ্ট হওয়ায় সে শারিরীক ভাবে দুর্বল। শুয়ে-বসে দিন কাটায়। শুরুর দিকে সামাদের সাথে সে সংসারে আগ্রহী থাকলেও এখন সেই আগ্রহ নেই। সে এখন মরতে চায়। রূপা আর তটিনীকে দেখলে তার রাগে গা জ্বলে যায়। এতদিনে তার বাচ্চা দুনিয়ার আলো দেখতো। এরা সবাই মিলে তার বাচ্চাটাকে মেরে ফেলেছে। সে মনে মনে এদের ধ্বংস চায়। ইচ্ছে করে সবকটাকে মেরে কোথাও পালিয়ে যেতে কিন্তু সে সুযোগ পায় না। সাহস পায় না। কিন্তু মনে মনে দ্বেষ পুষে রাখে। এদের সে ছাড়বে না। দেখে নেবে।
নানাজান নামাজ কালাম শেষ করে জিকিরে বসেছিলেন। বাড়ির সকলেই ফজরের নামাজ আদায় করে মসজিদ থেকে সবেমাত্র ফিরেছে। যদিও শেহজাদ আর সাফায়াত এখনো ফেরেনি। নাদিরের আজকে চলে যাওয়ার কথা। তাঈফের বাবা আর ফজল সাহেবের সাথে বসে সদরকক্ষে আলাপ সাড়ছিলো। শেরতাজ সাহেব আর শাহাজাহান সাহেবও বসা ছিলেন। আলাপের একফাঁকে হঠাৎ ঘোড়ার গাড়ির শব্দ শুনে সকলেই হতচকিত হলো। নানাজান বলে উঠলেন

‘ নাতবৌ এসেছে মনে হয়। ওদের খবর দেও কেউ।’

শাহজাহান সাহেব সকলকে ডেকে পাঠালেন। নামাজ কক্ষে বসা ছিল সায়রা, সোহিনীরা সকলেই। মরিয়ম আর অনুপমা বসে গল্প টুকটাক কথা সাড়ছিলেন। হঠাৎ ডাকাডাকি শুনে ছুটে এল সকলে। সোহিনী দ্বিতল চত্বরে দাঁড়িয়ে রেলিং ধরে ঝুঁকে তাকালো। তাঈফের চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিল দ্রুত। শেরতাজ সাহেব বললেন,

‘ গাড়ি এসেছে বোধহয়। তাড়াতাড়ি এসো। ‘

সায়রা, সোহিনী, শবনম কেউ দেরি করলো না। নেমে এল একসাথে। ঘোড়ার গাড়ি মহলের সিংহদুয়ার পার করে এসে থামলো। কোচোয়ান গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। গাড়ির ওপাশে শেরহাম নেমে গেছে। সকলেই তার মুখ না দেখলেও পা দেখছে। সকলেই হতভম্ব। সে মহলে এসেছে!
নানাজান নিজেও হতভম্ব। কাল শেরহাম উনাকে বলেছে সে মহলে ফিরবে না। তনীকে পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু তাকে ফিরতে দেখে খুশিমনে প্রসন্ন হাসলেন উনি। বউয়ের কথায় এসেছে নিশ্চয়ই। গাড়ির পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল তটিনী। শেরহাম বলল,

‘ নাম। ‘

তটিনী অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ হাতটা ধরো। ‘

শেরহাম তাকে হাত ধরে নামালো। সোহিনী সবার আগে ছুটে এসে দাঁড়ালো শেরহামের পেছনে। শেরহাম পায়ের শব্দ পেয়ে ঘাড় ফিরাতেই সোহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরে ডাকলো, ‘ ভাইজান। তুমি ফিরে এসেছ? ‘

শেরহাম সরাসরি কঠোর গলায় বলল,

‘ না। তনীকে দিতে এসেছি। ‘

সোহিনী মাথা তুলে তাকায় টলটলে চোখে। ক্রমেই শেরহামের দৃষ্টি শীতল হয়ে আসে। তটিনীর দিকে একপলক তাকায়। তটিনী চোখ রাঙিয়ে তাকায়। বোনের সাথে ভালো করে কথা বলা যায় না? অথচ এই বোন ভাইজান ভাইজান করে গলার পানি শুকিয়ে ফেলে। ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে ভাইয়ের বউ আর অনাগত সন্তানের জন্য কত চিন্তিত সে। আর ভাইয়ের ব্যবহার দেখো। এমনও না যে বোনের জন্য তার মন পুড়েনা। কাল তো স্বীকার করলো তার কাছে যে, বোনকে সে দূর হতে নিকাহ পড়ানোর সময় দেখছিল । সামনে আসেনি ইচ্ছে করে। তার সদ্য শ্বশুরবাড়ি মানুষের মুখোমুখি হতে চায়নি বলে। তাহলে এখন এত রুক্ষতা, কঠোরতা দেখানোর কি দরকার? যেখানে বোনটা তাকে আগাগোড়া চিনে। তার মনের কথা বুঝতে পারে। উপরকার কাঠিন্যেতা দেখে তো সে কষ্ট পায়, সেটা বুঝেনা পাষাণ লোক? এত গোয়ার্তমির জন্যই তো আজ এই দশা! নিজের একরোখা জেদের জন্যই তো জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দোদুল্যমান লতার মতো ঝুলছে। কবে বোধগম্য হবে সবকিছু তার?

শেরহাম তার দৃষ্টির উপর হতে চোখ সরিয়ে নরম কন্ঠে বলে,

‘ তনীকে নিয়ে যাহ ভেতরে। তোর নিকাহের সময় আমি ছিলাম। ‘

সোহিনী চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তারপর ছেড়ে দিয়ে বলে,

‘ আমি জানতাম তুমি থাকবে। তুমি আমার ভাইজান, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। আপু চলো। ‘

তটিনীর দিকে এগিয়ে যায় সে। তটিনী সাবধানে পা বাড়ায়। শেরহামের পানে চেয়ে থাকেন শেরতাজ সাহেব। তাইয়্যেবা বেগম আর আফজাল সাহেব অবাক চক্ষে চেয়ে থাকেন সেদিন জাদুনগরীতে দেখা কঠোর মানবের মুখপানে। সে কি করে সংসারী হয়? জ্বলন্ত মশাল হাতে সম্মুখে এসে দাঁড়ানো জাদুনগরীর হিংস্র রাজা আর সংসারী পুরুষের মধ্যে যে আকাশপাতাল ব্যবধান থাকে। ওরাও কি সংসারী হয়? ওদেরও হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা থাকে, ওদের হৃদয় সরোবরেও পুষ্প ভাসে? অথচ তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই তারও হৃদয় আছে, একটা পুষ্পতূল্য সুন্দর মন আছে। সেও কাউকে ভালোবাসতে পারে। যে ভালোবাসা দুনিয়াবি সকল ছলাকলা, প্রতারণার উর্ধ্বে। এই নশ্বর পৃথিবীতে সেই ভালোবাসা অবিনশ্বর, শ্বাসত, ধ্রুব সত্য। এর উপর আর কোনো সত্য নেই।

শেরহাম সবার দিকে একঝলক তাকিয়ে গায়ের চাদর খুলে হাতে নিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে মহলে প্রবেশ করে। সদর কক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা সকলেই পথ থেকে সরে দাঁড়ায় তাকে এগোতে দেখে। শাহানা এগিয়ে যায় তটিনীর কাছে। শেরহাম যেতে যেতে তাঈফকে একনজর আগাগোড়া দেখে নেয়। তাঈফ তার যাওয়া দেখে।
সুলতান মহলে আগমন পরবর্তীকালে একবারও এই মানুষটার সাথে তার কথা হয়নি, তার চোখে দেখা সরল দুনিয়ায় এই ধরণের মানুষগুলোকে চেনা বড়ই দুঃসাধ্য, তাদের রোগ নির্ণয় করা বড়ই জটিল, দুর্বোধ্য।

তটিনী শেরহামের গমন দেখে সবার মুখদর্শন করে। শাহানা এসে জিজ্ঞেস করে, ‘ এইসময়টাতে তোমার কত সতর্ক চলতে হবে জানো না? কোথায় ছিলে রাতে? কোথায় গিয়েছ ওর সাথে? তুমি জানোনা কত মন্দ বাতাস আছে চারপাশে? ও না বুঝে তোমাকে নিয়ে গেল আর তুমিও চলে গেলে? ‘

তটিনী নিশ্চুপ। নানাজান বলে,

‘ ছেড়ে দাও এখন। খেয়েদেয়ে আরাম করুক। বোন নিয়ে যাহ। ‘

সোহিনী মাথা দুলিয়ে বলল, ‘ হ্যা। চলো আপু। ‘

তটিনী ধীরেধীরে হেঁটে মহলে প্রবেশ করলো। সিঁড়িপথের দিকে চলে গেল। তটিনী এক সিঁড়ি উঠে অপর সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকে। সায়রা জিজ্ঞেস করে,

‘ তোমার কি খারাপ লাগছে? ‘

তটিনী হাঁপিয়ে উঠে বলল,

‘ না। তোমার ভাইজানের জন্য গরম খাবার পাঠিয়ে দাও কক্ষে। ‘

সোহিনী বলল,

‘ ভাত দেব? কাল বিয়ের রান্না আছে। ভাইজান তো খায়নি কাল। গরম ভাত বসানো হয়েছে। ‘

‘ হ্যা, পাঠিয়ে দাও। আর পোড়াদাগের ঔষধটাও পাঠিয়ে দিও। ‘

সায়রা বলল, ‘ আচ্ছা আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। তোরা আপুকে নিয়ে যাহ। ‘

সায়রা রসাইঘরের উদ্দেশ্য চলে গেল।
সোহিনী তটিনীকে নিয়ে হাঁটা ধরলো। তটিনীর হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। শেরহাম কক্ষে কিছু না পেয়ে বেরিয়ে এসে দেখতে পেল তটিনী বহুকষ্টে এক-পা এক-পা এগোচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে বলল,

‘ কি হয়েছে? ‘

সোহিনী আর শবনম সংকুচিত হয়ে চোখ নামিয়ে নিল। তটিনী বলল, ‘ কিছু হয়নি। ‘

‘ তাড়াতাড়ি আয়। ‘

সোহিনী বলে উঠলো, ‘ আপু হাঁটতে পারছেনা ভাইজান।’

বলেই শবনমের হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে গেল। শবনম যেতে যেতে তার বাহুতে কিল বসিয়ে বলল,

‘ ডাক্তার সাহেব কি ম্যাজিক জানে? ‘

সোহিনী চোখ গরম করে জিজ্ঞেস করে,

‘ কেন? ‘

‘ না মানে, তুই কি করে বুঝলি ভাইজান আপুকে কোলে নিয়ে কক্ষে নিয়ে যেতে পারে? ‘

‘ এটার সাথে ডাক্তার সাহেবের কি সম্পর্ক? ‘

‘ না, আমার তো ওটা মাথায় আসেনি। ‘

‘ আপুকে ভাইজান অনেকবার কোলে নিতে দেখেছি। আর তাছাড়া বউকে বর কোলে নিতেই পারে। যেমন আমাকে কাল.. ‘

বাকিটুকু বলতে দিল না শবনম। হিহি করে হেসে উঠে বলল,

‘ তারমানে তুই, কোলে চড়ে ফেলেছিস। হায় হায়। সায়রাকে বলে আসি। এই সায়রা শোন ওতো কাজ সেড়ে ফেলেছে….

সোহিনী রেগেমেগে তাকাতেই সায়রাকে ডাকতে ডাকতে একদৌড় দিয়ে চলে গেল শবনম। সোহিনী রাগে ফুঁসতে লাগলো। কার উপর রাগ হচ্ছে সেটা বুঝতে পারলো না সে। তবে রাগের সিংহভাগই ওই ডাক্তারের উপর। ওই বেয়াদব ডাক্তারকে সে তার ধারেকাছেও আসতে দেবেনা আর। অভদ্র লোক। চেনা নেই, জানা নেই নিকাহ হয়েছে বলে কোলে তুলতে হবে? আরও বলে, কেউ আটকে দেখাক। যত্তসব।

শেরহাম তটিনীকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,
‘ এত নাটক করার কি আছে? গাড়ি থেকে নামার সময় বললেই তো হতো আমি হাঁটতে পারব না। তোরা মেয়েমানুষের নাটকের শেষ নেই। ‘

‘ হ্যা, আমরা অভিনেতা। তুমি ভালো দর্শক হও। ‘

‘ ফালতু কথা রাখ। ‘

তটিনী ফিক করে হেসে উঠলো তার বিরক্তি ঝড়ে পড়া মুখের দিকে তাকিয়ে। ফিসফিস করে বলল,

‘ একটা কথা জিজ্ঞেস করব তোমাকে? ‘

শেরহাম কক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে,

‘ কি কথা? ‘

‘ তুমি আমাকে যে উদ্দেশ্যে নিকাহ করতে চেয়েছ সেটা থেকে সরে পড়েছ কেন? ‘

শেরহাম নির্বাক চেয়ে থাকে। এই প্রশ্নের উত্তর কি তার জানার কথা নয়? কোনো উত্তর দেয় না সে।

কক্ষে প্রবেশ করে বিছানায় বসিয়ে দিল তটিনীকে। বসিয়ে চলে যাওয়ার আগমুহূর্তে তটিনী তাকে নিজের দিকে টেনে ধরে । বলে, আমি জানি তারপরও জিজ্ঞেস করলাম। বলতে বলতে সে বিছানা থেকে নামলো। শেরহাম বলল,

‘ আবার নামছিস কেন?’

‘ তুমি গোসল নিয়ে আসো। ফতুয়া দিচ্ছি। আমি খাবার আনতে বলেছি ওদের। ‘

তটিনী আলমিরা খুলে একটা ছাইরঙা ফতুয়া বের করে দিল। শেরহামের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

‘ নাও। তাড়াতাড়ি যাও। খড় লাগায় আমারও হাত পা চুলকাচ্ছে । গোসল করতে হবে। ‘

শেরহাম ফতুয়াটা কাঁধে নিয়ে ঘাড় মালিশ করতে করতে বলল,

‘ আটটা নাগাদ বেরিয়ে যাব। কাজ আছে। ‘

তটিনী তার দিকে ফিরে রেগে বলে, ‘ আমি তোমাকে থাকতে বলেছি? ‘

শেরহাম চলে গেল। তটিনী তার গমন দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
গোসল করতে চলে গেল। ফিরে এসে দেখলো সিভান মসজিদ থেকে চলে এসেছে। তটিনীকে দেখে খুশিতে বাকুম-বাকুম করে বলল,

‘ বড় ভাইজানকে দেখতে এসেছি। কোথায় বড় ভাইজান? ‘

তটিনী হাসলো। ভেজা তোয়ালে রেখে মাথা ঢেকে এগিয়ে এল তার দিকে। গাল টেনে দিয়ে বলল,

‘ এসেছে তো। বাইরে গিয়েছে গোসল সেড়ে। তুমি বসো। তোমার ভাইজান আসুক। ‘

‘ আচ্ছা।’

অতি সাবধানে সামাদ আর মুরাদ এসেছে শেরহামের সাথে কথা বলতে। শেরহাম তাই অতিথি-শালার পেছনে গিয়েছে। তারা জানালো গুলজার আর বেঁচে ফিরা তান্ত্রিক সব একজোট বেঁধে রওনা দিয়েছে রূপনগরের দিকে। তারা পাহাড়ারত আছে। রূপনগরে প্রবেশের সময় তারা বাঁধা দেবে। শেরহাম বন্দুক নিল তাদের কাছ থেকে। তারা তাকে আশ্বস্ত করে ফিরে গেল। শেরহাম তাদের সাথে কথা বলা শেষে মহলে ফিরতেই দেখতে পেল শেহজাদ আর সাফায়াত দাঁড়িয়ে কথা বলছে। হয়ত তার সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার জন্যই এইখানে দাঁড়িয়েছিল। তাকে দেখে দুই ভাই ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। শেরহাম চলতে চলতে তাদের দিকে তাকালো চোখ তুলে।
পাশ কাটিয়ে চলে যাবে তক্ষুণি সাফায়াত ডেকে উঠলো,

‘ ভাইজান! ‘

শেরহাম থামলো তবে ফিরে তাকালো না। শেহজাদ তার গমনপথে চেয়ে রইলো অনিমেষ। বুকের উপর হতে মস্তবড় একটা পাথর সরে গেল এই ভেবে ন’মাস পর ফিরে আসা ভাইজান আর দীর্ঘ পনের বছর পর ফিরে আসা ভাইজানের মধ্যে বিস্তর ফারাক। তনী সেই কঠোর,হিংস্র, পাষাণ অমানুষকে একটু একটু করে পরিবর্তন করে ফেলেছে। দীর্ঘ অবহেলা, অনাদর, প্রতিহিংসা আগুনে জ্বলতে জ্বলতে যে হৃদয়ে পঁচন ধরেছিল সেই হৃদয় হতে এখন খুশবু ছড়ায়।
নিজ ভুলের কারণে চক্ষুলজ্জায় ভাইজান তাদের উপেক্ষা করে চলে গেলেন ঠিক তবে ভুল যে গোঁড়া থেকে হয়ে এসেছে তা স্বীকার করে শেহজাদ। দাদাজান ভাইজানকে ভালোবাসতেন বাকি সবার মতো তবে ভাইজানের ক্ষেত্রে ভালোবাসার ধরণটা ভিন্ন হওয়া উচিত ছিল। একটু বেশি যত্ন, সময়, আদর-মহব্বত, তার কথা মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করলে, সঙ্গ দিলে ভাইজান এমন হতো না।
দাদাজানের অপারগতা, বড় চাচার একরোখা সিদ্ধান্ত ভাইজানের পথভ্রষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ। সে যেমন শুধু মা খোদেজার কারণে সবার ভালোবাসা পায়নি, তেমনি শুধু মা সোফিয়ার কারণেও ভাইজানের অবহেলা পাওয়াটা উচিত হয়নি। সেদিন পালিয়ে না গিয়ে ভাইজান যদি সম্মুখযুদ্ধ করতো তার অতিপ্রিয় ভাইয়ের সাথে তাহলে এতদূর অব্দি তার পাপের শিকড় গড়াতে পারত না। এখন যেমন সত্যের সংস্পর্শে এসে উনার জীবনের সবচাইতে বড় মিথ্যেটা ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে ঠিক তেমনটা আরেকটু আগে হলে কি মন্দ হতো? অন্তত খুনী, প্রতারক শব্দগুলো তো যেত না উনার সাথে। ভাইয়ে ভাইয়ে এত মনোমালিন্য, এত দূরত্ব কি মানায়? মুখের উপর তো কতকিছু বলে ফেলা যায়। কত মারামারি তো নিজেদের ভেতর। কারো বুকে কেউ তলোয়ার চালাতে পেরেছে কি?

শেরহাম কক্ষে ফিরে আসামাত্রই সিভান দাঁড়িয়ে পড়ে। হাতে বন্দুক দেখে এগোতে সাহস পায় না। শেরহাম তার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকায়। তটিনী বলে,

‘ যাও, এসেছে তোমার ভাইজান। ‘

সিভান নখ কাটে দাঁত দিয়ে। তটিনীর পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। তটিনী বলে,

‘ ও তোমাকে দেখতে চলে এসেছে। দেখেছ রক্তের টান! যতই হোক ভাই তো তোমার। তোমার চেহারা পেয়েছে ও। ও লাল্টু মিয়া তুমি কালামিয়া।’

শেরহামের কপালে দ্বিগুণ ভাঁজ পড়ে। সিভান ততক্ষণে খিক খিক করে হাসিতে ফেটে পড়েছে।
‘ কালামিয়া। বড় ভাইজান কালামিয়া। ‘
শেরহাম ধমকালো।
‘ চুপ। ‘
সিভান চুপ হয়ে গেল। পালানোর জন্য দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই শেরহাম তার হাত ধরে ফেললো খপ করে। সিভানের মুখ লাল হয়ে এল আতঙ্কে। শেরহাম তার মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে সত্যিই তো! তারপর আচমকা ছেড়ে দিল। সিভান ছাড়া পেয়ে একছুটে দরজার কাছে পালিয়ে গেল। উঁকি দিয়ে বলল,

‘ ভাইজান কালামিয়া। সিভান লাল্টুমিয়া। ‘

তটিনী হাসলো। সিভান দৌড়ে পালিয়ে গেল। শেরহাম তটিনীর দিকে ফিরে বলল,

‘ তুই আমাকে ওরকম বলেছিস কেন?’

তটিনী গরম ভাত বাড়ছে বাসনে। বলল,

‘ কি বলেছি? তুমি কি কালো না? ‘

শেরহাম চুপ করে থাকলো। কেদারায় বসে কোলে নিজের এক পা তুলে পায়ের তলার ক্ষতচিহ্নে কি যেন দেখতে দেখতে জবাব দিল,

‘ তোর বাচ্চা যদি কালো হয়?’

তটিনী থমকায়। কষা মাংস বেড়ে নেয় পাতে। বলে,

‘ ও কালোই হবে। তোমার মতো। আসো। ভাত বেড়েছি।’

শেরহাম এল। বন্দুক পাশে রেখে বিছানায় পা তুলে বসলো। কপাল উঁচিয়ে বলল,

‘ কালো হলে তোর খারাপ লাগবে না? তুই তো কালো নোস। ‘

তটিনী লোকমা বাড়িয়ে দিয়ে তার চোখাচোখি তাকিয়ে বলল,

‘ আমি কালো মানুষের সন্তানের মা, মনে আছে? ‘

শেরহাম চিবোতে চিবোতে মাথা নাড়ে। তটিনী নিজেও খেয়ে নেয় সাথে। বেশ খিদে পেয়েছিল। খাওয়া শেষ হতেই সোহিনী আসে। থালাবাসন নিয়ে যায়। পোড়ার মলমটা রেখে যায়। শেরহাম উপুড় হয়ে শুয়ে বন্দুকের নলে গুলি ভরতে ভরতে জিজ্ঞেস করে,

‘ সোহির শ্বাশুড়ি ঝামেলা করছিল না? এখন কি হলো?’

‘ উনার ছেলে বুঝিয়েছে বোধহয়। চলে যাবে বলছে। সোহিকে যেতে বলছে। যাবেনা বলায় খেপে আছে। ‘

‘ ওহহ। ‘

তটিনী কাত হয়ে পড়ে বলল,

‘ কোথায় পুড়েছে দেখাও। মলম লাগাই। আমাকে রসাইঘরে যেতে হবে। ‘

‘ দরকার নেই। তুই তোর কাজে যাহ। ‘

তটিনী বলল,

‘ আমাকে এত কথা বলিওনা। তাড়াতাড়ি দেখাও। মুখটা ফেরাও এদিকে। ‘

বন্দুকটা ঠেলে সরিয়ে দিল তটিনী। তার দিকে ফিরিয়ে আনলো মুখটা। শেরহাম মলমটা ছুঁড়ে ফেলে বলল,

‘ কাল কামড়ে দিয়েছিস আবার এখন মলম লাগাচ্ছিস। ওরেহ নাটক। ‘

তটিনী হতভম্ব। রেগেমেগে কিছু বলে উঠার আগেই শেরহাম তাকে ফেলে ঝুঁকে পড়ে বলল,

‘ ভাইরে আর চিল্লাচিল্লি করিস না। আমার ক্ষত এমনি শুকিয়ে যাবে। আমি যাচ্ছি। ‘

তটিনী চোখবুঁজে রাগ সংবরণ করলো। না না এই লোকের সাথে রাগা যাবে না।
শেরহাম উঠে যাচ্ছিলো তটিনী তার পোশাক টেনে ধরলো খপ করে। বলল,

‘ আর কিছুক্ষণ থাকো। তারপর যেও। নইলে এবার কামড়ে ছিঁড়ে ফেলবো। ‘

শেরহাম আচম্বিত হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বলল,

‘ কামড়া। তোর দাঁতের জোর দেখি। ‘

হাসতেই লাগলো সে। তটিনী তার মুক্তঝরা হাসি দেখে পরমানন্দ লাভ করলো। ফতুয়ার কলার চেপে ধরে তার দিকে টেনে এনে কুপিত স্বরে বলল,

‘ আমাকে যা কষ্ট দিয়েছ তার বেলায় একটা কামড় কিছু না। তুমি জানো প্রত্যেকটা দিন আমার কতটা কষ্টে কেটেছে? এখনো তো চলে যাবে, চলে যাবে করছো। নিজের বেলায় সাত খুব মাফ না? ‘

শেরহামের চোখে শীতলতা নেমে এল। তটিনীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ না না মাফ চাই না আমি। আমি জানি তুই কষ্ট পেয়েছিস, এখনো পাচ্ছিস। আমি তোকে আমার সাথে জড়িয়ে ভুল করে ফেলেছি। তাই তো মাফ না করতে বলেছি। ‘

তটিনী শক্ত হয়ে থাকে। শেরহাম তার মুখপানে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,

‘ কি হয়েছে? ‘

তটিনীর চোখের কোণা লাল হয়ে আসে। খেপাটে গলায় বলে,

‘ তুমি কি বলতে চাচ্ছ যে আসছে সে ভুলে আসছে? আমি ওকে আল্লাহর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। স্বেচ্ছায় চেয়েছি। এখানে ভুলের কোনো কথায় আসে না। ‘
শেরহাম তার কপাল হতে অবিন্যস্ত চুল সরিয়ে গালে বৃদ্ধাঙ্গুল বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ আচ্ছা বেশ বেশ। ভুল না। ‘
তটিনী তার গালে হাত রাখে। গলায় প্রগাড় মায়া ঢেলে বলে,
‘ আমাকে ভালোবেসে থেকে যাও। ‘
শেরহাম নাকমুখ ঠোঁট তার দুগালে দাবিয়ে চুম্বন করে। তটিনী তাকে জড়িয়ে ধরে। মাথাটা নিজের সাথে চেপে রেখে অর্ধভেজা চুলের মাঝে আঙুল ডুবিয়ে চুলের মাঝে ঠোঁট চেপে মুখ লাগিয়ে রেখে চোখ বুঁজে বলে,
‘ উত্তর দাও। ‘
শেরহাম বহুক্ষণ পর মুখ তুলে তাকায়। বলে,
‘ কথা এটা ছিল তনীর বাচ্চা? ‘
তটিনী চোখেমুখের রঙ পাল্টে যায়।
কারো পায়ের শব্দ পেয়ে দুজনেই দু’জনকে ছেড়ে দেয়। সোহিনী দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। বলে,

‘ আপু নাপিত কাকা চলে এসেছে। ভাইজানকে পাঠাও।’

তটিনী উঠে বসে। বলে,

‘ এই চলো। চুল, দাঁড়ি ছেঁটে নেবে। ‘

শেরহাম বন্দুকটা তুলে রেখে বলল,

‘ শুধু দাঁড়ি। চুল কাটবো না।’

‘ নাহহ। ‘

শেরহাম চিবুক শক্ত করে তাকায়। বলে,

‘ তো কি ? ‘

তটিনী বলল,

‘ চুল না কাটলে আমার সাথে আর কথা বলবে না।’

বলেই হনহনিয়ে বের হয়ে গেল কক্ষ হতে। শেরহাম মহাবিরক্ত। নীচে যেতেই দেখলো সিভানও চুল কাটছে। তাকে দেখে নাপিত কাকা বলে উঠলো,

‘ এইখানে বসেন বাবা। ‘

‘ আমি বাবা কখন হলাম? ‘

নাপিত চুপসে গেল। শেরহাম কেদারায় বসে বলল,

‘ চুল বেশি কাটবে না। ‘

‘ জ্বি আচ্ছা। ‘

মহলের সকলেই প্রাঙ্গনের আশেপাশে আছে। সরাসরি না দেখে, লুকিয়ে দেখছে। হঠাৎই বারান্দা হতে মেয়েলি গলার স্বর ভেসে আসে। সবাই চোখ তুলে তাকায়। তটিনী বলল,

‘ কাকা সব চুল ফেলে দিন। পারলে টাক করে দিন। ‘

শেরহাম অগ্নিময় দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। বাকিদের দিকেও তাকায়। সে তাকাতেই শেরতাজ সাহেব, সাফায়াতসহ সকলেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে। হাসি আড়াল করে।

চলবে..

#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_৩৩:২ ( ৩৩ পর্বের ২য় পার্ট )
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

তাঈফের মা বাবা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিয়ের পর ছেলের বউকে বাড়ি নিয়ে যাবেন এটাই তো স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম। কিন্তু ছেলে নাকি কথা দিয়ে রেখেছে বউকে সে এখানেই রাখবে। ছেলের উপর রাগে তিনি আর থাকতে চাইলেন না। তাঈফ সোহিনীকে বলে যাতে, মাকে থাকার জন্য অনুরোধ করে। সোহিনী তাকে জবাব দেয়, আপনার মা আমার কথা শুনবে যেখানে আপনার কথা শুনছেনা? ‘
‘ তাও একবার বলে দেখো। ‘
সোহিনী উনাকে অনুরোধ করলেন কিন্তু উনি ভীষণ খেপে আছেন। কারো কথা শুনবেন না। বললেন, আমি নাদিরের সাথে চলে যাচ্ছি। ও আমাদের নামিয়ে দেবে। তুমি থাকো তোমার বউকে নিয়ে এখানে। মা বাবাকে দরকার নেই। ‘

তাঈফ মহাসংকটে পড়ে গেল। সোহিনী কিছুতেই যেতে রাজী নয়। ডাক্তার বলেছে তটিনী আর অপরূপার প্রসব বেদনা উঠতে পারে যেকোনো সময়। তাকে তার ভাইপো ভাইঝির দেখভাল করতে হবে। শেহজাদ ভাইজান বলেছেন ডাকতরা হামলা করার জন্য ওঁৎ পেতে বসে আছে। চারিদিকে বিপদ আর বিপদ। সেখানে সে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে রঙ্গ করতে পারবে না। তাইয়্যেবা বেগম আর আফজাল সাহেব নাদিরের সাথে রওনা দিলেন। নাদিরের মা ফজল সাহেবের বোন। গত চার বছর পূর্বে বোন আর বোন জামাতা মারা যান। নাদিরের বড় বোন বিবাহিত। তার বেশিরভাগ সময়ই কেটে যায় জাহাজে। মাঝেমধ্যে তো নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। কেউ খোঁজও পায় না। মামাদের সাথে তার সম্পর্ক খুব ভালো। কিন্তু তারপরও তাকে মামার বাড়িতে কেউ নিয়ে যেতে পারেনা। সে একলা একা থাকতে ভীষণ পছন্দ করে। অথৈ সমুদ্রে ঝড়-তুফান, আর জলদস্যুদের সাথে লড়াই করে জয়ী হয়ে ফিরে আসার মাঝেই সে আনন্দ খুঁজে পায়। নিজ মায়ের পিতৃভিটায় যাকে কেউ শত অনুরোধ স্বত্বেও নিয়ে যেতে পারেনা সে দিব্যি সুলতান মহলের আতিথেয়তা সানন্দে গ্রহণ করে নিয়েছে। এটা তাঈফের কাছে বেশ বিস্ময়কর হলেও নাদিরের কাছে খুবই সামান্য। সুলতান মহলের আতিথেয়তা তার ভালো লেগেছে বিধায় থেকেছে। তার চাইতে বেশি কিছু নয়। ফজল সাহেব চিন্তিত বোনের এই পুত্রের জন্য। তাই একবার বিয়ের কথাটাও পেড়ে দেখেছে তার সামনে। সে সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে। যেখানে তার জীবনের দু সেকেন্ডের বিশ্বাস নেই, যেকোনো সময় অতল সমুদ্রের গহবরে হারিয়ে যেতে পারে, ভয়ংকর জলদস্যুদের হাতে মরতে পারে সেখানে অন্য একটা প্রাণ নিজের সাথে জড়িয়ে ফেলা অসম্ভব। নিজের প্রাণের মায়া না থাকলেও অপরের প্রাণের মায়া তার আছে। যে মেয়েটির কথা মামু তাকে বলেছে সে নিজেও নিকাহ নামক সম্পর্কের বন্ধনে জড়াতে চায় না। তাহলে কেন এসব কথা উঠছে? ফজল সাহেব আর কিছু বললেন না। শাহানা সাফায়াতের কথায় শুরুর দিকে মন ঘামালেও যখন জানতে পারলেন ছেলের অভিভাবক বলতে তেমন কেউ নেই, মাঝসমুদ্রে তার দিনরাত কাটে তখন তিনি বেঁকে বসলেন। সেসব কথা ছড়াছড়ি হওয়ার পূর্বেই তিমি ধামাচাপা দিলেন তবে সে কথা শবনমের কানে পৌঁছায়নি এমন না। দুদিন আগেও যে কোনো পুরুষ মানুষকে ভাবতেও চায়নি, এখন তার ভাবনায় শ্যামবর্ণের গোমড়ামুখো একটা মুখ ভেসে উঠে। ভাবতেই খারাপ লাগে মানুষটার সব থেকেও কেউ নেই। জীবনটা এমন অদ্ভুত কেন? লোকটার সাথে তার একবারই কথাবার্তা হয়েছে। সামনাসামনি পরে গেলেও কখনো চোখাচোখি হয়নি অথচ কথাটা শোনার পর কেমন মন খারাপে ছেয়ে গেছে তার। আপুর কষ্ট দেখার পর আম্মা কখনো এমন পাত্রের কাছে তাকে সম্প্রদান করবে না। সেও চায় এমন না, তার ও একটা সুরক্ষিত জীবন দরকার। আপুর মতো দুঃখের ভেলায় ভাসার শক্তি, সাহস তার নেই। কিন্তু খারাপ লাগা কমছেনা।

________

নানাজান চলে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করলেন। বেজায় রেগে আছেন উনি। উনার ভৃত্য দু’জনের সাথে চেঁচামেচি করছেন।
শেরতাজ সাহেব, শেহজাদ, সাফায়াত সকলেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কোনো কথা বলছেনা। রাগে রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে নানাজানের হলুদাভ মুখমণ্ডল। চোখদুটো দিয়ে রক্ত ঝড়ছে। চোখে জলও দেখা যাচ্ছে। কেউ কথা বলার সাহস করে উঠতে পারছেনা। নানাজান গাট্টি বোচকা বাঁধছেন। পড়নের শালে ঘনঘন চোখ মুছছেন। তটিনী অপরূপা খোদেজা শাহানা সকলেই চত্বরে এসে দাঁড়ালো চেঁচামেচি শুনে। তিনি এভাবে চোখ মুছে যাচ্ছেন কেন? কেন কাঁদছেন? তটিনীর বুক ধড়ফড়িয়ে উঠলো। ও কি নানাজানের সাথে বেয়াদবি করেছে? হায় আল্লাহ নানাজানের যদি অভিশাপ পড়ে? তার হাঁটুজোড়া কেঁপে উঠলো। শেরহাম বেরিয়েছে। বলেছে মাগরিবের আগে ফিরবে। অনেক কান্নাকাটি করে তটিনী তাকে রাতটা থাকার জন্য রাজী করিয়েছে। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক দেখলে সে রাজী হতো না। স্বাভাবিক থাকায় রাজী হয়েছে। কিন্তু কি এমন ঘটলো যার জন্য নানাজান এভাবে কাঁদছেন? তটিনী নেমে গেল কাঁপা-কাঁপা পায়ে বহুকষ্টে। সোহিনী শবনম তাকে নিয়ে এল নানাজানের কাছে। সে আসামাত্রই নানাজান চোখ সরিয়ে নিলেন। তটিনী হাঁটুর কাছে গিয়ে বসলো। বলল,

‘ ও তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে নানাজান? আমাকে বলো। ‘

নানাজান চেঁচিয়ে বললেন,

‘ আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করিস না। চলে যাচ্ছি আমি। ওরা মা ছেলে শেষ করে দিল আমার সব আশা-ভরসা। কত আবদার করে বললাম আমার সাথে একটাবার মসজিদে চল। গেল না। আমাকে যা তা বলে গেল। বলল, আমাকে দুর্বল করে দিচ্ছ, আমি জাদুবিদ্যা ছাড়া ওদের সাথে লড়তে পারব না, এসব ছাড়তে পারব না, তোমার খোদার সাধ্যি আছে এতবড় পাপীর পাপ ক্ষমা করার? কতবড় কথা। আরও বললো আমি নাকি মহলে পড়ে আছি। চলে যাচ্ছিনা কেন? আমি নাকি ওর খারাপ চায়। ওকে মারতে চায়। ওকে দুর্বল করে দিচ্ছি। ওর শক্তি কি দিল ওকে জিজ্ঞেস কর কেউ। কি দিল ওকে? সব কেড়ে নিয়েছে সেই অপয়াশক্তি। বাচ্চাটার উপর বালামুসিবত না আসার জন্য আমি ওকে সুপথে আহ্বান করেছি। একজন সন্তানের জন্য মা খোদার দরবারে দু-হাত তুললে বাবা তুলবে না কেন? নিজের ভালো চায়নি, বউয়ের ভালো চায়নি, এখন সন্তানের ভালো চাইছেনা। আমি জিজ্ঞেস করলাম বাচ্চাটাকেও ওসব কাজে জড়াবি নাকি? মুখের উপর বলে দিল, হ্যা জড়াবো। ওকে জাদুনগরীর বাদশাহ বানাবো। তুমি কি করবে? যা করার করো। আমি বললাম তোর বউ জানে এসব? বলল, ওকে কিছু বললে জানে মেরে ফেলবো। গুম করে ফেলবো বুড়ো। আমার জীবনটায় বৃথা। কাউকে পথ দেখাতে পারলাম না। খোদার কাছে গিয়ে কি জবাব দেব আমি? মেয়েকে না বাঁচাতে পারলাম এই অপয়াশক্তির হাত থেকে না নাতিকে। কিভাবে এই মুখ দেখাবো আমি? ‘

বলতে বলতে এবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন উনি। উপস্থিত সকলেই ভারাক্রান্ত মনে চেয়ে থাকলো। তটিনী গাল মুছে বলে,

‘ ওসব মিথ্যে কথা বলেছে ও। আমি আমার বাচ্চাকে দেব না কাউকে। আমি ওকে হাফেজ বানাবো। তুমি ওকে অভিশাপ দিওনা। তোমার চোখের জল ওরজন্য অভিশাপ নানাজান। দিওনা অভিশাপ।’

নানাজানের ভৃত্যদুজন বলল, ‘ আমরা প্রস্তুত হুজুর। চলুন রওনা দিই। ‘

তটিনী নানাজানের পা ধরে রাখলো। বলল,

‘ না না যেওনা এভাবে। মুখ ফিরিয়ে নিওনা। আমি ওকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে টেনে এতদূর নিয়ে এসেছি। ওকে অভিশাপ দিওনা। মরে যাবে। ‘

নানাজান কথা শুনলেন না। সোহিনীও কত জোরাজোরি করলো আটকানোর। নানাজান কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলেন মহল থেকে। শেহজাদ, সাফায়াত, শেরতাজ সাহেব, শাহজাহান সাহেব অনেক আগে থেকেই বুঝিয়ে যাচ্ছিলেন। নানাজানের চোখের পানি দেখে সকলেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন।

মাগরিবের সময় শেরহাম মহলে ফিরে এল। কক্ষে এসে দেখলো তটিনী একটা মোড়ায় বসে সালাত আদায় করছে। সালাম ফিরিয়ে মোনাজাত শেষে শেরহামের দিকে চোখ ফিরিয়ে তাকালো। তটিনীর চোখমুখ দেখে বিষম খেল সে। পরপর দু-তিনটে বন্দুক রাখলো বিছানায়। তটিনী সেগুলি নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। বলল,

‘ আমার বাচ্চাকে জাদুনগরীর বাদশাহ বানাবে? এজন্য ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখছো আমাকে? ‘

শেরহাম হতভম্ব। বন্দুক তুলে নিয়ে বলল,

‘ কাঁদছিস কেন আজব? কি করেছি আমি? ‘

‘ কি করোনি সেটা বলো। নানাজানকে বলোনি এসব? নিজের সন্তানের ভালো যদি চাও নানাজানকে ফিরিয়ে আনো। ‘

শেরহাম এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। তটিনী তার বুকে পড়ে কাঁদতে থাকে। শেরহাম জিজ্ঞেস করে,

‘ নানা তো মসজিদে আছে। আমি নিয়ে আসছি। তুই কাঁদিস না। ওই বুড়ো পাগল হয়ে গেছে। ‘

তটিনী বলল,

‘ না। এতে সব সমাধান হবে না। তুমি আমার বাচ্চার জন্য একবারও দোয়া করেছ আল্লাহর কাছে? ওকে কেউ কাফেরের সন্তান বলুক তা চাই না আমি। আমার কষ্টে বুক ফেটে যায় তোমাকে কেউ অমানুষ, কাফের বললে।
আমাকে নিয়ে চলো মসজিদে। আমি নানাজানকে ফিরিয়ে আনবো। ‘

‘ তুই শান্ত হ। আমি নিয়ে যাচ্ছি তোকে নানার কাছে। ওই বুড়ো বেশি ভার বেড়েছে। ‘

তটিনী আরও জোরো চেঁচিয়ে বলল,
‘ বুড়ো বলবে না। ভাষা ঠিক করো। আমাকে কেন শান্তি দিচ্ছ না তুমি? তোমার জন্য কি করিনি আমি? কেন খুঁজে খুঁজে অভিশাপ নিচ্ছ? পাপ বাপকে ছাড়েনা কথাটা কি মনে নেই তোমার? ‘

শেরহাম তার দুগাল আঁকড়ে ধরে বলে,
‘ আমি এজন্যই আসতে চায়নি এখানে। এজন্যই আমার ছায়া পড়তে দিতে চায়নি এখানে। চল, নানাকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়। আমি চলে যাব। তোর সন্তানকে কেউ কাফেরের বাচ্চা বলবে না। তোর পরিচয়ে বড় করবি। ‘

তটিনী তার বুকে পড়ে কাঁদতে থাকে। পেটে হালকা হালকা যন্ত্রণা শুরু হয়।

তটিনীকে নিয়ে মসজিদে পাড়ি দেয় শেরহাম। খুব বেশি দূরে নয় মসজিদটি। ঘোড়ার গাড়িতে করে যায় তারা। সকালে যেভাব এসেছিল ঠিক সেভাবেই শেরহাম তাকে কোলে বসিয়ে এনেছে। নানাজান মসজিদের একপাশে বসে কাঁদছিলেন। উনার ভৃত্য দুজন উনার পেছনে বসে আছেন। হুজুরকে এই প্রথম এমন আকুল হয়ে কাঁদতে দেখেছে তারা। তাদের চোখেও জল। শেরহাম বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। বলে, মসজিদে প্রবেশ করে নানাজানকে নিয়ে আসো।

শেরহাম বলে, ‘ আমি পা দেব না। ‘

তটিনী বলে, ‘ অযু করে এসো। তাহলে প্রবেশ করতে পারবে। আল্লাহর দরবার সবার জন্য খোলা। যাও। অযুখানায় চলো। আমি শিখিয়ে দেব। ‘

শেরহামের মুখ কঠিন হয়ে আসে। তটিনীর হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,

‘ পারব না। ওখানে কেন যাব আমি? যেতে পারব না। আমি পাপী। ‘

তটিনী টলটলে চোখে চেয়ে রইলো। তার গাল বেয়ে অবিরাম গড়িয়ে পড়ছে নোনাজল। শেরহাম বোধহয় জীবনে এই প্রথমবার এতটা অসহায় বোধ করলো। এগিয়ে যেতেই তটিনী চোখ মুছতে মুছতে ধীরপায়ে হেঁটে চলে গেল মহিলাদের নামাজ কক্ষের দিকে। গিয়ে বসে পড়লো নীচে। কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল,
‘ তুমি ওকে কেন হেদায়েত দিচ্ছ না আল্লাহ ? কেন? ‘
আশপাশের সকলেই ওকে চেয়ে থাকে। শেরহাম কক্ষের বিশাল জানালার গ্রিল দিয়ে ওকে দেখে। গ্রিল ধরে চেয়ে থাকে। বহুকষ্টে কাঁদছে তটিনী। এদিকে পেটের যন্ত্রণা তীব্রতর হচ্ছে।
শেরহাম চোখবুঁজে উর্ধ্বে তাকায়, বিশালাকৃতির একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসে। পাঞ্জাবির বাহুতে নিজের ঘর্মাক্ত মুখ মুছে ডাকে, এই তনী!
তটিনী ফিরেনা। শেরহাম মনের চোখ মেলে দেখে সে যেখান থেকে এসেছে সেখানেই তার শেষ ঠাঁই। আর কিছু ভাবেনা সে। ছুটে চলে নিজের মনের ডাক অনুসরণ করে। খোলসে মোড়া নিজের পাপী হৃদয়টা আজ মুক্তি পায়। লুটিয়ে পড়ে খোদার আহৃবানে। এশার আজানের প্রতিধ্বনি ভেসে আসে সাথে সাথে। বহুবছর পর কানে প্রবেশ করে,

‘ আল্লাহু আকবর। ‘

_____________

জল বাড়িয়ে দেয়া মহিলাটির হাত থেকে পানির পাত্র হাতে নিয়ে পানি খায় তটিনী। মহিলাটি জিজ্ঞেস করে, ‘ তুমি তো অনেক অসুস্থ দেখছি। কেউ আসেনি সাথে? ‘

‘ এসেছে। চিন্তিত হবেন না। আমি ঠিক আছি। ‘

‘তাহলে কাঁদছো কেন এভাবে? ‘

তটিনী আবারও কাঁদতে থাকে। কাকে বুঝাবে সে কেন কাঁদছে? কাকে বুঝাবে অন্তরজ্বালার কথা। কাকে বুঝাবে সে এমন মানুষকে ভালোবেসেছে যার মুক্তির জন্য সে দিনরাত ছটফটিয়ে মরে। কাকে বুঝাবে সন্তানকে অপবাদের মুখ থেকে বাঁচানোর জন্য দিনরাত্রি এক করে খোদার কাছে আশ্রয় চায় সে। বোরকা পরিহিত মহিলাটি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, কেঁদোনা। আল্লাহ সব ঠিক করে দেবেন। ‘

তটিনী গাল মুছে। কোনোমতে দাঁড়িয়ে পড়ে। একটা আগরবাতি জ্বালিয়ে দেয়। নানাজানের গলা ভেসে আসে। পিছু ফিরতেই দেখতে পায়। নানাজান দাঁড়িয়ে আছেন। পাশেই সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত শেরহাম। তার মুখে বিন্দু বিন্দু জল। কপালের সামনের চুল গুলি ভেজা।
শেরহাম কক্ষে প্রবেশ করে। এগিয়ে এসে বলে,

‘ নানাকে নিয়ে এসেছি। মসজিদে প্রবেশ করেছি। চল এবার। ‘

তটিনী নানাজানের দিকে তাকায়। তারপর মাথায় ওড়না আরও ভালো করে টেনে নিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে কোরআন শরীফ নিয়ে আসে বুকের সাথে জড়িয়ে।
শেরহামের সামনে দাঁড়ায়। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে শেরহাম অবাকচোখে চেয়ে আছে। তটিনী তার দিকে ধীরপায়ে এগিয়ে আসে। কেঁদে ওঠে বলে,

‘ আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদ স্বীকার করো।
আল্লাহর নামে শপথ করো আজ থেকে তোমার অন্তর আত্মাকে সব কলুষতা থেকে মুক্তি দিয়েছ। আল্লাহ তোমাকে হেদায়েত না করলে আমি তোমার জীবনে আসতাম না। তোমার প্রতি মহব্বত সৃষ্টি হতো না। তোমার চোখে সুরমা পড়ানোর সুযোগ দাও আমাকে। তওবা করো আর মাফ চাও। শপথ করো আর কোনো মন্দকাজে নিজেকে জড়াবে না। ‘

শেরহামের জ্বলজ্বলে দৃষ্টি অন্যত্র ঘুরিয়ে পিছু হাঁটে সে। হাতের কব্জিতে কপাল চোখমুখ মুছে বলে,

‘ এটা হয় না তনী। ‘

‘ হয় । আল্লাহ পাক তোমাকে ক্ষমা করবে। উনি কাউকে ফেরান না। তওবা করো। ‘

শেরহাম তার দিকে চেয়ে থাকে একদৃষ্টে। গাড়ির ঝাঁকুনি লাগায় তটিনীর পেটের ব্যাথা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। সে ঠোঁট কামড়ে কেঁদে উঠতেই শেরহাম তার হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয় । বলে,

‘ করলাম। তুই কান্না বন্ধ কর। ‘

তটিনী অশ্রুজলে হাসে। ঝাপসা ঝাপসা চোখে দেখে একটা শুদ্ধ মানুষকে।
ক্রমেই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। শেরহামের বুকে ঢলে পড়ে। শেরহাম কোলে করে ওকে বের করে আনে। মসজিদ প্রাঙ্গন ছেড়ে গাড়ির কাছাকাছি এসে বলে, তাড়াতাড়ি গাড়ি ছাড়ো। এই তনী কেমন লাগছে তোর? ‘

তটিনী দু’পাশে মাথা নেড়ে শেরহামের বুক খামচায় অসহ্য যন্ত্রণায়। শেরহাম গাড়িতে উঠে বসে। হঠাৎই হাতে ভেজা অনুভব হতেই হাত তুলে দেখতে পায় রক্ত পানি। কয়েকজন মহিলা পাশ থেকে ছুটে আসে। বলে, তার প্রসববেদনা উঠেছে।

চলবে……

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে