#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_৩২
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
ভাইজান এসেছে তা নানাজানের মুখে শুনে সোহিনীর চেহারার অন্ধকার দূর হয়ে গেল। ভাইজানের অপেক্ষায় রইলো সে। তবে চিন্তা কমলো না। তাঈফের মায়ের উপর হতে রাগ কমলো না। যে মানুষটা তাদের জীবন বাঁচিয়েছে সে যতই খারাপ হোক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। কিন্তু তিনি তা না করে উল্টো গলাবাজি শুরু করেছেন। সবকটা স্বার্থপর, অকৃতজ্ঞ।
এদিকে শাহানা চিন্তিত হলো। নানাজান তাকে আশ্বস্ত করে বললেন; আমি বলেছি রাতে না ফিরলেও সকালে যেন তনীকে মহলে নিয়ে আসে। চিন্তার কোনো কারণ নেই। বউয়ের জন্য ভালোই মহব্বত আছে দিলে।
শাহানা শান্ত হলো তবে স্বস্তি পেল না। শেহজাদের বুকের উপর থেকে যেন মস্তবড় একটা পাথর সরে গেল। চিন্তামুক্ত হয়ে কক্ষে গিয়ে পোশাক পাল্টালো। অপরূপা বিছানায় শুয়ে আছে পা বাইরে রেখে। আজ অনেক হেঁটেছে সে। অন্যদিনের চাইতে তা অনেক বেশি। ব্যাথা লাগছে। শরীর কাঁপছে।
শেহজাদ তার পা বিছানায় তুলে দিল। হিজাবটা কুড়িয়ে নিল। মাথার নীচে বালিশ রেখে ঝুঁকে বলল,
‘ রূপু খুব খারাপ লাগছে? পানি খাবে? ‘,
অপরূপা আধোআধো চোখ মেলে তাকিয়ে থাকলো। কথা বলতেই ইচ্ছে করছেনা তার। শেহজাদ উত্তর না পেয়ে আলো নিভিয়ে দিল।
অনাবৃত উদের উষ্ণ হাতের স্পর্শ টের পেয়ে চোখ বুঁজলো অপরূপা। শেহজাদ কাঁথা টেনে জড়িয়ে দিল গায়ে। নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলো। মুখের উপর হতে চুল সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ আর মাত্র ক’টা দিন। আরেকটু সবুর করো। হুহ। ‘
অপরূপা তার বুকে মুখ গুঁজলো। ব্যাথায় আর্তস্বরে কোঁকাতে কোঁকাতে ঘুমিয়ে পড়লো।
—-
শাড়ি ব্যতীত গয়নাগাটি, টানা নথ, মাথার টায়রা, খোঁপা সব খুলে ফেলেছে সোহিনী। সং সেজে বসে থাকতে ভালো লাগছে না। কক্ষ থেকে বের হয়ে সেলোয়ার-কামিজের জন্য তার কক্ষের উদ্দেশ্যে পা বাড়াচ্ছিলো। তাঈফের মুখোমুখি পড়ে গেল তখুনি। ভেতরে চেপে গেল সে। তাঈফ লাল বেনারসি পরিহিত নিরলঙ্কার রমণীকে অপলক দেখতে দেখতে কক্ষে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করলো। সোহিনী আমতাআমতা করে বলল,
‘ আমাকে বাইরে যেতে হবে। ‘
‘ কোথায়?’
তাঈফের সোজাসাপটা প্রশ্ন অথচ উত্তর দিতে জিভে শত জড়তা কাজ করছে সোহিনীর। চোখ তুলে এত সামনে দাঁড়িয়ে এই প্রথম কোনো পুরুষের মুখ ভালো করে অবলোকন করলো সে। নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় সে। দেখতে ভালো, গুণী মানুষ, আচার-আচরণ ভালো। সোহিনীর চাইতে উত্তম। সোহিনীর ঢোক গিলে ফেলা দেখে তাঈফ বলল,
‘ আর কোথাও যাওয়া চলবে না। ‘
‘ মানে? ‘
তাঈফ চোখের চশমা খুলে রেখে দিল। কপালে চুল সরাতে সরাতে জিভ দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, ‘ মানে কোথাও যাচ্ছ না তুমি। ‘
সোহিনী তার কথা না শুনে এগোলো দরজার দিকে। তখুনি হাতটা বাঁধা পড়লো তাঈফের হাতের মুঠোয়। তাকে টেনে সামনে এনে দাঁড় করালো তাঈফ। মুখোমুখি দাঁড় কড়িয়ে বলল,
‘ আমার সাথে সহজ হও। কথা বলো। তুমি আমার কাছ থেকে পালাতে চাচ্ছ তা আমি ধরে ফেলেছি। তোমাকে আমি পালাতে দেব না। ‘
সোহিনী হাত ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য ধস্তাধস্তি শুরু করলো। তাঈফ এক ধমক দিল। বলল,
‘ এত ছোট মেয়ের এত রাগ কিসের? তুমি জানো আমি তোমার কত বড়? বড়জনের কথা শুনতে হয় জানো না? ‘
সোহিনী অবাকচোখে চেয়ে রইলো। তাকে ধমকালো?বিয়ের চব্বিশ ঘন্টা না যেতেই ধমকাধমকি! ভাবনার সুঁতো ছিঁড়ে যাওয়ার আগেই তাঈফ তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল আচমকা। সোহিনী তার গলা টেনে ধরে বড় বড় চোখ করে চেয়ে রইলো। ঘাবড়ে গেল তাঈফের এমন কর্মকাণ্ডে। বুকের ভেতরটা ক্রমশ লাফিয়ে চলেছে। কি হচ্ছে এসব! তাঈফ বলল,
‘ আমি হুটহাট বেসামাল কাজ করে বসবো কথা না শুনলে। আজ কোলে নিলাম কাল অন্য কিছু করে বসব। কেউ পারলে আটকে দেখাক। ‘
সোহিনী চেয়ে রইলো নিষ্পলক। সে রাগ করতে পারছে না কেন?
_______________
ফজরের আজান ভেসে এল। প্রতিদিনের মতো আজও তটিনীর চোখ ছুটে গেল। চোখ মেলে পাশে শেরহামকে না দেখে ভয়ে বুক কামড়ে ধরলো তার। এখনো আজান দিচ্ছে। কোথায় গেল সে? তার গায়ে শেরহামের চাদর জড়ানো। কক্ষ ভর্তি অস্ত্রগুলো নেই। সেগুলো কোথায় নিয়ে গিয়েছে সে? তটিনী ধীরেসুস্থে উঠে বসলো। তার কোমর অব্দি কোঁকড়াচুলে অসংখ্য খড় লেগে আছে। সেগুলো ঝেড়ে ফেলার প্রয়াস দেখা গেলনা তার মধ্যে। চাদরটা ঢেকে দরজা ঠেলে কক্ষের বাইরে উঁকি দিতেই দেখলো কয়েকটা সৈন্যর সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে শেরহাম। সে চাদরে নিজেকে ভালো করে ঢেকে বের হলো। পেটে অসহ্য ব্যাথা হচ্ছে। শেরহামের স্বভাবগত কঠিন ধাতবের ন্যায় মুখটা আরও কঠিন দেখাচ্ছে। এত কি বলাবলি করছে সবাই? সৈন্যদের চোখ পড়লো তটিনীর দিকে। শেরহামকে বলতেই শেরহাম তার দিকে ফিরে তাকালো। কি যেন বলে এগিয়ে এল তটিনীর দিকে। এগিয়ে এসে বলল,
‘ উঠে যখন গিয়েছিস তখন চল তোকে মহলে দিয়ে আসি। ‘
তটিনী জিজ্ঞেস করলো,
‘ পালকিতে করে? ‘
‘ না ঘোড়ার গাড়ি। কোচোয়ানকে বলে দেব আস্তেধীরে চালাতে। তোর কোনো অসুবিধে হবে না। আমার হাতে সময় কম। আয়। ‘
বলেই সে কুটিরে ঢুকে পড়লো। তটিনী তার পিছুপিছু প্রবেশ করলো। চাদর ফেলে দিল। শেরহাম বলল,
‘ চুল ঝেড়ে ফেল। খড় লেগে আছে। ‘
‘ ঝেড়ে দাও। শক্তি পাচ্ছি না। ‘
শেরহাম এগিয়ে এসে চুল থেকে খড় বেছে নিতে নিতে বলল,
‘ তোর কি খিদে পেয়েছে?’
‘ মহলে ফিরে খাব। তুমি কি খাবে? ‘
‘ আমি হাঁটের দিকে গেলে দোকান থেকে কিনে খাব। ‘
শেরহাম তার চুল থেকে সব খড় বেছে ফেলে দিল। এলোমেলো ভাবে পেঁচিয়ে খোঁপা করে দিয়ে হিজাব তুলে ঝেড়ে মাথায় পেঁচিয়ে দিল। বড় ওড়নাটি তুলে গায়ে জড়িয়ে দিয়ে শরীর ঢেকে দিল। তটিনী চেয়ে রইলো তার দিকে একদৃষ্টে। ন’মাস পর ফিরে আসা মানুষটি গত মধ্যরাত অব্ধি তার সমস্ত অপেক্ষার কথামালা মনোযোগ দিয়ে শুনেছে, সমস্ত অভিযোগ মাথা পেতে নিয়েছে, কাউকে কৈফিয়ত না দেয়া মানুষটি তাকে প্রতিটি কাজের কৈফিয়ত দিয়েছে। তার প্রতিবার চাহনি, প্রতিটি কথা, প্রত্যেকবার স্পর্শ একটা কথায় জানিয়েছে, তটিনী একটু একটু করে ভালোবাসার বীজ বপন করেছে এই কঠিন হৃদয়ে। তটিনী মনে মনে বলে, আমি ভালোবেসে কোনো ভুল করিনি।
শেরহাম নিজের গায়ে চাদর জড়াতে জড়াতে হঠাৎ তার দিকে চোখ পড়তেই থমকে গেল। স্থির চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ কি?’
তটিনী এগিয়ে এল। তার বুকে মাথা ঠেকিয়ে বলল, ‘ ভালো লাগছেনা কিছু। তুমি রাতের আঁধারে আসো আবার দিনের আলোতে হারিয়ে যাও। ‘
শেরহাম তাকে জড়িয়ে ধরলো। দু’হাতের বন্ধন দৃঢ় করে তটিনীর কপালের পাশে গভীর আশ্লেষে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তটিনী মুখ তুলে তাকালো। তার চোখে জনম জনমের দুঃখ টিকরে পড়ছে। শেরহাম ফুঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কপালে পুনরায় ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,
‘ ছেলে বাবু হলে নাম দিবি শোহরাব অথবা শোইয়াব। আর মেয়ে বাবু হলে শানায়া, শেহরীন। ‘
তটিনীর চোখ ফুঁড়ে জল বেরিয়ে এল। বলল,
‘ শুধু কথা ঘোরাও, না? আমার জন্য তোমার মায়া হয় না একটুও? ‘
‘ মায়া হয় বলেই তোকে দেখা দিয়েছি। ওরা হন্য হয়ে আমাকে খুঁজছে। যদি জানতে পারে আমি এখানে আছি এখানে হামলা করবে। তারা মহলে হামলা করার আগে আমাকে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
তটিনী বুকে মাথা ফেললো ধপ করে। শেরহাম তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ কাঁদিস না। আমাকে মাফও করিস না। ‘
তটিনী কাঁদতে লাগলো। আবদার করে বলল,
‘ একবার মহলে চলো। সবাই তোমাকে দেখার জন্য মুখিয়ে আছে। শুধু একবার। আমাকে ফিরিয়ে দিওনা। ‘
শেরহামের হাতের বাঁধন আলগা হয়ে এল। তটিনী ঝাপটে ধরে রেখে বলল,
‘ এখন গেলে কেউ দেখবে না। একবার চলো। থাকতে বলব না। ‘
ঘোড়ার গাড়ি এসে থেমেছে বাইরে। তটিনী শক্ত করে ধরে রেখে বলল,’ গাড়ির ঝাঁকুনি সইতে পারব না। আমাকে একা পাঠিওনা। আমার শরীর খারাপ লাগছে খুব। ‘
শেরহাম বলল, ‘ খুব খারাপ লাগছে? ‘
‘ না বেশি না। কিন্তু আমাকে ছেড়োনা একা। আমার সাথে চলো। চলো। না বলো না। ‘
শেরহামের মন ঘামলো। কুটির থেকে বেরিয়ে সৈন্যদের সাথে কথা বলা শেষে ফিরে এল। তটিনীকে পাঁজাকোলা করে তুলে গাড়ির নিকট এগিয়ে গেল। কোচোয়ানকে বলল
‘ গাড়ি ধীরে চালাবে। ‘
‘ জ্বি হুজুর। ‘
গাড়ি চলতে শুরু করলে তটিনী আর্তস্বরে বলে উঠলে,
‘ ঝাঁকুনি লাগছে। ও আল্লাহ! গাড়ি থামাতে বলো। ‘
শেরহাম তাকে কোলের উপর টেনে নিল। পর্দা টেনে দিল। তটিনী শুইয়ে গেল তার কোলে। গলা জরিয়ে ধরলো। শেরহাম তাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলল,
‘ এবার ঝাঁকুনি লাগছে? ‘
তটিনী দুপাশে মাথা নাড়ালো। ‘নাহ।’
শেরহাম শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো তাকে। তটিনী একদৃষ্টে চেয়ে রইলো তার দিকে। জিজ্ঞেস করলো,
‘ একহাত রাখো এখানে। ‘
শেরহাম কপাল ভাঁজ করে তাকালো। একহাতে তাকে ধরে রেখে পেটে হাত রাখতেই তটিনী বলল,
‘ ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে বলো তো। ‘
” আমি কি খোদা, যে জানবো? ‘
তটিনী হঠাৎই ফিক করে হেসে উঠলো। জানতে চাইলো,
‘ আমার খোদাতায়ালা সব জানেন এটা স্বীকার করছো, তবে?’
শেরহাম অন্যত্র তাকিয়ে রইলো। তটিনী তার মাথা টেনে গাল ছুঁয়ে বলল,
‘ চুল, দাঁড়ি সব ছাঁটবে আজ। তোমাকে বনমানুষের মতো দেখাচ্ছে। ‘
‘ আমি বনমানুষই। ‘
‘ না তুমি আমার মনমানুষ। ‘
শেরহাম কপাল ভাঁজ করে তাকালো তার চোখের দিকে। তটিনী হেসে তার গালে ঠোঁট চাপলো শক্ত করে। তারপর জড়িয়ে ধরে চোখ বুঁজলো। বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘ তুমি যে অন্তর দিয়ে আমাকে ভালোবেসেছ সেই অন্তর থেকে আমি সমস্ত কলুষতা দূর করে দেব। খোদার কসম ‘
চলমান..