#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_৩১
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
বিয়ের আসরে বর উপস্থিত, কনে আসতে বিলম্ব হচ্ছে। শেহজাদ পায়চারি করতে করতে সাফায়াতকে দেখে থামলো। রুমাল দিয়ে কপাল মুছতে মুছতে বলল, ‘এতক্ষণ লাগছে কেন? কি হয়েছে ওখানে? ‘
সাফায়াত মৃদুস্বরে বলল, ‘ সোহি কাঁদছে। আপনি একটু যান। ‘
শেহজাদ মাথা নাড়লো। পা বাড়ালো সেইদিকে। দরজায় টোকা দিতেই অপরূপা এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললো। শেহজাদ বলল,
‘ কি হয়েছে? ওখানে সবাই বসে আছে। ‘
‘ ও কাঁদছে। তাই দেরী হচ্ছে। আসুন না। ‘
শেহজাদ ভেতরে প্রবেশ করলো। খোদেজার বুকে পড়ে আকুল হয়ে কাঁদছে সোহিনী। খোদেজা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সান্ত্বনা দিচ্ছে এই বলে, ‘ তোমার ভাইজান ফিরে এসে যখন দেখবেন সুপাত্রের সাথে তার বোনের নিকাহ হয়েছে তখন সে খুশি হবে। এসময় এভাবে কাঁদলে চলে? ‘
শেহজাদকে দেখে খোদেজা বলল,
‘ দেখেছ কান্ড। কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। ‘
শেহজাদকে দেখে সোহিনীর কান্নার বেগ আরও বাড়লো। ছুটে গিয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ ভাইজান কি আসবেনা ভাইজান? ‘
শেহজাদ নিরুত্তর থাকতে পারেনা তাই জবাব দেয়
‘ আসবে। আজ না হোক কাল ঠিক আসবে। আমরা খারাপ হতে পারি কিন্তু আমরা ছাড়া এত আপন উনার কেউ নেই । পরিস্থিতি, সময়, আমাদের করা কিছু ভুল আমাদের মধ্যে যে বিভেদ, যে বৈষম্য তৈরি করেছে তার দেয়াল একদিন ঠিক ভাঙবে। তাই বলে জীবন থেমে থাকবে? তুমি তোমার জীবন ঘুচিয়ে নাও। সময়ের সাথে সাথে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। অপেক্ষার অপর নাম সংগ্রাম সেই সংগ্রামই জীবন। ‘
সোহিনী কাঁদতে থাকে। শেহজাদ তার গাল মুছে দেয়। বলে, ডাক্তার সাহেব অপেক্ষা করছেন। এই অপেক্ষা দীর্ঘতর করা উচিত হচ্ছে না মোটেও। সায়রা, শবনম নিয়ে এসো ওকে।
সোহিনী সবাইকে জড়িয়ে ধরার পর তটিনীকে জড়িয়ে ধরে। ফুঁপিয়ে উঠে। তটিনী চোখ মুছতে মুছতে বলল,
‘ হয়েছে। এবার যাও। তোমাদের তো আবার অপেক্ষা করানোর স্বভাব। ‘
সোহিনী আরও জোরে কেঁদে উঠে ছেড়ে দেয় তটিনীকে। হেঁচকি তুলে অপরূপাকে জড়িয়ে ধরে। জিজ্ঞেস করে,
‘ তুমি আমার ভাইজানকে ক্ষমা করেছ? ‘
অপরূপা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুই বলেনা। উনার প্রায়শ্চিত্ত উনার সব ভুল মাফ করে দেবেন। আর যেদিন উনি উনার সমস্ত পাপের খোলস ছাড়িয়ে একজন শুদ্ধ মানবে পরিণত হবেন সেদিন সারা দুনিয়া থাকে ক্ষমা করে দেবে। অপরূপা তাদের একজন।
সোহিনী আসার পরপরই বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। সকলেই তার জন্য অধীর আগ্রহে বসা ছিল। তাঈফ একপলক চোখ তুলে তাকালো কিন্তু ঘোমটার আড়ালে মুখটা দেখতে পেল না। মনে প্রশান্তি অনুভব করলো এই ভেবে সোহিনীকে রাজী করাতে তাকে বেগ পোহাতে হয়নি। তার তো মনে হয়েছিল এই মেয়েকে রাজী করাতে কেয়ামত ঘটে যাবে। নানাজানের প্রতি তার অশেষ কৃতজ্ঞতা।
নানাজান বিয়ে পড়াচ্ছেন। তাঈফের পাশে শেহজাদ, সাফায়াত, নাদিরসহ বয়স্করা বসেছেন। সিভান পর্দা সরিয়ে মাঝেমধ্যে সোহিনীকে দেখছে। তার হাতদুটো ধরে রাখলো সাফায়াত। বলল, শেহজাদ ভাইজান বকবে। চুপচাপ দেখছেন তোমার কান্ড।
সিভান আবারও পর্দা সরালো। শবনম তাকে চোখ রাঙালো। সাফায়াত নাদিরকে বলল,
‘ দেখেছ কান্ড? ‘
নাদির সিভানের হাতদুটো ধরলো। বলল,
‘ এবার দেখি কি করো তুমি। ‘
সিভান তার দিকে মুখ তুলে তাকালো। হেসে বলল,
‘ তোমার বন্ধু সুহি আপুকে নিকাহ করছে। তুমি কি শবনম আপুকে নিকাহ করবে? ‘
নাদির থতমত খেল সাফায়াতের সামনে সিভানের কথায়। বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেল। ঘাবড়ে গিয়ে গলা খাঁকাড়ি দিল।
সাফায়াত হেসে সামনে তাকালো। পর্দার ওপাশে শবনমকে দেখে ভাবলো, ‘ ঠিকই তো। শবনমের জন্যও তো একটা ভালো পাত্র আছে তাদের হাতে। এটা তো ভেবে দেখা হয়নি। তবে নাদির তাঈফের মতো অতটা হাসিখুশি নয়। গম্ভীর স্বভাবের। যেন কোনো এক চাপা কষ্ট নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সে কি শবনমকে নিকাহ করতে চাইবে? সাফায়াত কৌতূহল দমিয়ে রাখে। সোহিনীর বিয়ে চুকে যাক কোনো একসময় ভাইজানের কানে কথাটা তুলবে সে। তনীর তো অনেক কষ্ট পেল, এখনো পেয়ে যাচ্ছে। শবনমকে সে ভালো পাত্রের হাতে নিকাহ দেবে। তার বোনটা সুখী হবে। তনী তো বেছে নিয়েছে তার পথ। তার সন্তান আসবে। সে সন্তানকে ঘিরে বাঁচবে।
‘ মোহাম্মাদ আফজাল মোস্তাফি এবং বেগম তাইয়্যেবার একমাত্র সুপুত্র তাঈফ মোস্তাফির কাছে একশ এক পয়সা মোহরানায় শেরতাজ সুলতানের কন্যা সুলতানা সোহিনী মারওয়া’কে বিবাহ দিলাম। তিনবার ‘কবুল’।
তাঈফ বলল, ‘ কবুল কবুল কবুল। ‘
সকলের ঠোঁটের কিনারায় হাসি ফুটলো। নানাজান সোহিনীকে বললেন,
‘ বোন পান ছুঁয়ে বল’ আলহামদুলিল্লাহ’। ‘
অবগুণ্ঠনের ভেতর হতে রাঙা হাতটা বেরিয়ে পান ছুঁয়ে দিল। ভাঙা ভাঙা কম্পমান কান্নাজড়ানো মিষ্টি স্বরটা ভেসে এল ‘ আলহামদুলিল্লাহ ‘।
সকলেই একসাথে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো। অদূরে দাঁড়িয়ে শেরহাম মনভরে সেই দৃশ্য দেখলো। দীর্ঘ পনের বছর পর ফিরে আসার পরও যেই বোনের সাথে সে একদন্ড ভালো করে কথা বলেনি, অকারণে চড় মেরেছে, কষ্ট দিয়েছে সেই বোনের কাছে আজ সে ক্ষমাপ্রার্থী। তার পাপিষ্ঠ ছায়া সে কখনো তাদের উপর পড়তে দেবেনা আর।
বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর গন্ডগোল লেগে গেল তাঈফের মাকে নিয়ে। কে যেন উনাকে চুপিসারে বলেছেন সোহিনীর ভাই একজন জাদুকর, ডাকাত সর্দার। যত রকমের অপকর্ম আছে সবকিছুর ওস্তাদ। কার বোন পুত্রবধূ করে নিয়ে যাচ্ছেন উনি! সেসব শুনে উনি কড়া গলায় সবাইকে বললেন, এতবড় একটা কথা কিভাবে লুকোতে পারলেন আপনারা? আমি কখনো একজন ডাকাত সর্দারের বোনকে আমার পুত্রবধূ করতাম না জেনেশুনে। আপনারা আমার সাথে অন্যায় করেছেন মিথ্যে বলে। এই আপনাদের ছেলে ব্যবসার কাজে দূরে আছে? সেজন্যই তো বলি বউটা সবসময় এমন মনমরা থাকে কেন। আপনাদের মতো মানুষের কাছ থেকে এসব আশা করিনি আমি। আপনারা আমার ছেলেকে ঠকিয়েছেন। আমাদেরকে ঠকিয়েছেন। একজন ডাকাত সর্দার মানে একজন খুনী, একজন জাদুকর মানে একজন কাফের। এই সম্বন্ধ আমি কিছুতেই মানতে পারছিনা।
তাঈফ মাকে সেখান থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল,
‘ মা কে বলেছে তোমাকে এসব? ‘
‘ বলেছে একজন। তার নাম বললে সবাই তাকে মেরে গুম করে দেবে। উনারা উপরে অনেক চকচকে রঙিন, ভেতরে তা নয়। সবাই মিলে তোকে ঠকিয়েছে। ‘
সোহিনী রাগে ফোঁসফোঁস করে উঠলো। তটিনী তার হাত ধরে রাখলো। বলল,
‘ একটা কথাও বলবেনা ভাইয়ের পক্ষে। তোমার ভাই এসে যেদিন নিজেকে শুদ্ধ মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করবে সেদিন যদি কেউ কাফের, অমানুষ বলে তখন তর্কে যেও। তোমার চাইতে বেশি আঘাত আমি পাচ্ছি। আমি ভেবে মরছি এইসব কথা যেন আমার বাচ্চাকে শুনতে না হয়। যদি ওরও এইসব শোনা লাগে আমি ক্ষমা করব না তোমার ভাইজানকে। ‘
সোহিনী বলল,
‘ ওই মহিলা যা তা বলে যাচ্ছেন আর আমি চুপ থাকবো? করব না আমি তার ছেলের সংসার। তাতে কি যায় আসে..
শাহানা তার গাল চেপে ধরে বলল, চুপ করো। টেনে নিয়ে গেল সেখান থেকে। কক্ষে নিয়ে গিয়ে বলল,
‘ নতুন বউ তুমি। মাত্র নিকাহ হয়েছে। তার মা যা-ই বলুক সে তোমার স্বামী হয়। সংসার করব না বললেই হয়ে যায় না। ভাইয়ের মতো রগচটা হইয়োনা। তোমার ভাই যা তা বলছে উনি। স্বাভাবিক। আমরা সত্যিটা আড়াল করেছি যাতে নিকাহ’টা হওয়ার আগে কোনো ঝামেলা না হয়। তাঈফ সবটা জানে। সে এর আগে যখন মহলে এসেছে তখন স্বচক্ষে দেখেছে শেরহামকে। সবটা ওকে বুঝিয়েছে শেহজাদ। তুমি একটা কথাও বলবে না। তাঈফকে আঘাত করে কথা বলবেনা সোহি। তোমরা দুই ভাইবোন কপাল করে এমন জীবনসঙ্গী পেয়েছ। শুকরিয়া করো। আর রাগ কমাও নিজের। তাঈফের মাকে সামলানোর অনেকে আছে। তুমি একদম চুপ থাকো। ‘
সোহিনী কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘ অপরাধীর খাতায় শেরতাজ সুলতান আর বেগম সোফিয়ার নামটা তুলে দাও। সম্রাট সলিমুল্লাহর নামটাও তুলে দাও। আমার ভাইজান একা দোষী নয়। আমার ভাইজানকে সবাই মিলে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। সবাই দাঁড়াক কাঠগড়ায়। আমার ভাইজান কেন একা দোষী হবে?’
কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ে সে। তটিনীর কাঁধে মাথা রেখে ফোঁপাতে থাকে। তটিনীও কাঁদে।
তাইয়্যেবা বেগম শক্ত ভঙ্গিতে বসে থাকে। শেহজাদ সবটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। সে বাবুর্চির কাছে গিয়েছিল খাওয়া দাওয়া কতদূর এগোলে তা জানার জন্য। এসে এইসব শুনে তাইয়্যেবা বেগমের কাছে গেল। উনি তাকে দেখে বলে উঠলেন,
‘ আপনি সৎ, ন্যায়পরায়ন একজন মানুষ জেনে এসেছি। কি করে এত বড় সত্যিটা লুকোলেন? ‘
শেহজাদ শান্তশিষ্ট গলায় বলে, ‘ যে মানুষটার জন্য ভয়ংকর তান্ত্রিকদের হাত থেকে বেঁচে ফিরলেন তিনিই আমাদের ভাইজান। তিনিই সোহিনীর ভাইজান। আর কিছু বলার আছে আপনার? ‘
তাইয়্যেবা অশ্রুসজল নয়নে চেয়ে রইলেন। তাঈফ বলল
‘ বেঁচে না থাকলে এই সন্তানসন্ততি, ঘর সংসার কোথায় ভেসে চলে যেত আম্মা। এসবে আমার কিছু যায় আসে না। নিকাহ তো হয়ে গেছে আম্মা। আমরা এখন এক ঘরের মানুষ। দয়া করে তুমি শান্ত হও। ‘
তাইয়্যেবা চুপ করে রইলো। ওই কঠোর মানবটি সোহিনীর ভাইজান? আর ওই মিষ্টি মেয়েটার স্বামী! হায় খোদা এ কেমন সম্পর্কের বেড়াজাল?
_________________
নামাজকক্ষের পাশের কক্ষে খাওয়াদাওয়া চলছে মহিলাদের। সোহিনীকে খাওয়াতে বসিয়েছে তার শ্বাশুড়ির পাশে। যদিও সে মুখ গোমড়া করেই রেখেছে। হামিদা কত করে বুঝালো মুখটা স্বাভাবিক করতে সে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে না। অন্তরে রোষ পুষে মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখতে পারবে না সে। যা বুঝার বুঝুক। তাইয়্যেবা চুপচাপ খেলেন। কোনোরূপ কথা বললেন না। যে যাই বলুক ছেলে জেদ না ধরলে সোহিনীকে উনি পুত্রবধূ করতেন না। এমন তেজালো মেয়ে উনার পছন্দ নয়। মেয়েদের হতে হবে নরম তরম, ভদ্র, সুশীল। মহলের বাকি মেয়েগুলোর দিকে চোখ রাখলে ফেরানো দায়। কত সুন্দর করে কথা বলে, কত সুন্দর আচার-আচরণ। আর এই মেয়েকে দেখো! এজন্যই মায়ের শিক্ষাটা দরকার হয়। যতই জেঠি ফুপু শাসন করুক এই মেয়ে বেয়াদব মানে বেয়াদব। চেহারাটাকে কেমন করে রেখেছে দেখো!
মাংসের গন্ধ তটিনীর সহ্য হচ্ছিলো না। সে নামাজকক্ষে চলে এসেছে। নামাজ কক্ষ ফাঁকা। সে একটা আগরবাতি নিল। দেশলাইকাঠি জ্বালিয়ে আগরবাতি জ্বালিয়ে দিল। দরজার পাশে গেঁথে দিচ্ছিলো। হঠাৎই মনে হলো দরজার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল কেউ একজন। সে দরজার বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলো চাদর গায়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে একটা লোক। তার পিঠ কুঁজো। তটিনী চোখ সরিয়ে নিল। পুনরায় নামাজ কক্ষে প্রবেশ করে দরজার পাশে দাঁড়ালো। তন্মধ্যে নানাজান এলেন। বললেন,
‘ নাতবৌ আমার সাথে আয়। ‘
তটিনী জিজ্ঞেস করলো, ‘ কোথায়? ‘
‘ আয় জরুরি কাজে। ‘
তটিনী বেরিয়ে এল। নানাজানের সাথে বেরোতে দেখে কেউ তেমন কিছু বললো না। তটিনী নানাজানের পিছু পিছু সিংহদুয়ার পর্যন্ত গেল। জিজ্ঞেস করলো,
‘ কোথায় যাব? হাঁটতে তো কষ্ট হচ্ছে।’
‘ আরেকটু কষ্ট কর। আয়। ‘
তটিনী সিংহদুয়ার পার করলো। নানাজান বললেন
‘ ওই যে শিরীষ গাছ দেখছিস ওটার কাছে যাহ। ‘
তটিনীর এবার ভয় করলো।
‘ কেন? তুমিও আসো। ‘
‘ আমি যেতে পারব না। তুই যাহ। গেলে দেখতে পাবি। ‘
তটিনী বারংবার পিছু তাকাতে তাকাতে শিরীষ গাছের কাছাকাছি হেঁটে হেঁটে গেল। যেতে যেতে থমকে গেল । অন্ধকারে একটা ঘোড়ার উপস্থিতি টের পেল সে। ঘোড়াটি লেজ নেড়ে চলেছে অনবরত। ঘোড়াটির আশেপাশে কেউ নেই। সে পিছু ফিরে দেখলো নানাজান সেই জায়গায় নেই। ভয় তার বুক কামড়ে ধরলো। হাঁটু কাঁপতে লাগলো তরতরিয়ে। কোনো বিপদআপদ ঘটে গেলে সে দৌড়াতেও পারবে না। এতদূর কষ্ট করে কেন এল সে? নানাজান চলে গেল কেন? কি উদ্দেশ্য উনার?
হঠাৎ মাথায় এল শেরহামের ঘোড়ার কথা। ওর ঘোড়াটা কালো ছিল। এই ঘোড়াটা কার?
সে ঘোড়াটির দিকে এগিয়ে গেল ধীরপায়ে। আবছা আলোয় দেখতে পেল ঘোড়াটির রঙ কালো।
তটিনী অবাকচোখে তাকিয়ে রইলো। এটা তো ওর ঘোড়াটা! সেখামেই থেমে গেল তার পা। ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশে তাকিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিল জিভ দিয়ে। গলা শুকিয়ে এল তার। কপাল ভিজে উঠলো ঘামে। হাতের তালুও ঘেমে উঠেছে। ও কি এখানে আছে? আশেপাশে কোথাও? তাহলে আসছেনা কেন? এতদূর হেঁটে এসে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। পেটে ব্যাথা লাগছে। বাম পাশে হাত চেপে দম নিল সে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে দম নিতে। বড় বড় শ্বাস ফেললো সে।
সম্মুখে সামাদ আর মুরাদকে এগোতে দেখলো। অন্ধকার হওয়ায় সে শুধু তাদের প্রতিভিম্ব দেখলো।
চাদর দিয়ে তাদের মাথা হতে হাঁটু অব্দি ঢাকা। ভয়ংকর দেখাচ্ছে। তার কান-মাথা ভনভন করা শুরু করলো। পিছিয়ে যেতে যেতে বললো,
‘ কারা তোমরা? এগোচ্ছ কেন? পিছিয়ে যাও। সামাদ আর মুরাদ কিছু বলার পূর্বেই তটিনী
পিছাতে পিছাতে ঘোড়ার সাথে ধাক্কা লাগলো। ঘোড়াটি গা ঝাড়া মারতেই পেটের বাম পাশে হাত চেপে আর্তস্বরে ডেকে উঠে বসে পড়লো তটিনী। চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো। দেখলো দুটো লোক এগিয়ে আসছে, আর পাশেই ভয়ংকর একটি ঘোড়া তার দিকে চোখ পাকিয়ে আছে। সারা শরীর ঘেমে উঠলো তার। যেন নিঃশ্বাসটুকু গলার কাছে এসে আটকে রয়েছে। তার সারা শরীর অবশ হয়ে এল। ধীরে ধীরে হাত পা অসাড় হয়ে এল। চোখ দুটো বুঁজে এল। সন্তানের বিপদের ভয়ে কেঁদে উঠে নেতিয়ে পড়ার পূর্বে নানাজান বলে ডেকে উঠতেই নানাজান উঁকি দিল সিংহদুয়ারে দাঁড়িয়ে। বউকে এনে দিতে বলে আবার কোথায় চলে গেল গর্দভটা? তিনি এগোতে চাইলেন। কিন্তু অন্ধকারে দপদপ পায়ে হেঁটে তটিনীর দিকে দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসা মানবকে দেখে আর এগোলেন না। তটিনী পেট চেপে ধরে বলল, ‘ আল্লাহ রে আমার বাচ্চার ক্ষতি হলে কাউকে ছাড়বো না আমি। ‘
মাথা এলিয়ে দিল সে একটা শক্তপোক্ত হাতে আশ্রয় পেয়ে। অচেতন হলো না তবে পুরোপুরি সজাগও নয় এমন অবস্থায় আধখোলা চোখে দেখলো তার মুখের অতি নিকটে পরিচিত একটা মুখ। রুক্ষস্বরে বলল,
‘ তনীর বাচ্চার ক্ষতি করার সাধ্য কার? ঘোড়ার কাছে যেতে কে বলেছে তোকে? ‘
তটিনী প্রিয় বাহুডোর পেয়ে আরামে চোখ বুঁজলো।
অনুভব করলো সেই স্পর্শ, সেই শরীরের উষ্ণতা, সেই ঘ্রাণ, সেই নিঃশ্বাসের প্রগাঢ়তা। আর কিছু মনে নেই তার।
বেড়ার কুটিরটিতে চার ভাগের তিন ভাগই অস্ত্র। এটা কি অস্ত্রের গুদাম? ছোট্ট একটা চেরাগ জ্বলছে কুটিরের এককোণায় তাও বাতাসে নিবুনিবু। এত এত অস্ত্রশস্ত্রের মাঝখানে খড়ের উপর সে শায়িত। গায়ে সুড়সুড়ি লাগজে। কুটিরের চারিকোণায় অন্ধকার। মনে হচ্ছে খুব বেশি দূর থেকে বন্য শেয়ালগুলোর ডাক ভেসে আসছেনা। খুব কাছেই তারা। ঝিঁঝিঁ পোকাগুলো যেন কানের কাছে বসে ডাকছে এমন তীব্র খঞ্জনায় বিরক্ত তটিনী। পেটের বাম পাশে ব্যাথা ঠেকছে। উঠে বসার শক্তি পাচ্ছে না। চোখের কোণা বেয়ে দুফোঁটা জল গড়ালো। ওকে দেখেছিল সে সেসময়, নাকি তার ভ্রম?
হঠাৎই ঘরটা আলোকিত হতে লাগলো। তটিনী দেখলো ঘরের এককোনায় ছোট করে জ্বলতে থাক হারিকেন জ্বালিয়ে দিচ্ছে একটা মানব। আলো জ্বালিয়ে তার দিকে ফিরলো। ধীরপায়ে হেঁটে তার নিকটে এসে বসলো । তটিনী উঠে বসার চেষ্টা করলো কিন্তু তার সাহায্য ছাড়া পারলো না। প্রয়োজনও পড়লো না। তার প্রিয় মুখটা তার উপর ঝুঁকে আসতেই তটিনীর হৃৎস্পন্দন অচিরাৎ বেড়ে গেল। খুব বেশি কথা, অভিযোগ জমে গেলে মানুষ যেমন বোবা হয়ে যায় তটিনীর দশাও ঠিক তেমন। স্তব্ধ নেত্রে শুধু চেয়ে রইলো সে। চোখের কোণা বেয়ে তপ্ত জল গড়িয়ে তা কান ছুঁলো। ফুঁপিয়ে উঠে শেরহামের পোশাক টেনে চোখের নীচে গালের নরম মাংসে দাঁত ফুটাতেই শেরহাম চোখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে নিল। তটিনী একঝটকায় তাকে ছেড়ে দিল। অন্য গালে কামড়াতে যাবে ঠিক তখনি দেখলো গালের পাশটাতে পোড়া দাগ। হুহু করে কেঁদে উঠলো সে সর্বশক্তি দিয়ে। শেরহাম তার পিঠের নীচে হাত গলিয়ে তুলে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো নিজের সাথে। তটিনী আঁকড়ে ধরলো তাকে। কাঁদতে লাগলো আক্রোশে, অভিমানে। শেরহাম তার গালে, কপালে অসংখ্য চুম্বন করলো। তটিনী বলল,
‘ তুমি ছাড়ো আমায়। একদম ছুঁবে না। আমাকে রেখে পালিয়েছ। আর এখন কেন এসেছ? ‘
‘ আমি আবার চলে যাব তনী। ‘
তটিনী চুপ হয়ে গেল। শেরহামের মুখের দিকে চেয়ে রইলো থমথমে মুখে।
শক্ত হাতটা নিয়ে তার বাড়ন্ত অনাবৃত উদরে রেখে চোখ বুঁজলো। আরও নিকটে গিয়ে ভগ্নকণ্ঠে বলল,
‘ তুমি তোমার বাচ্চার কথা জেনেও দূরে ছিলে? আবারও ওখানে গিয়েছ?’
‘ আমার কি করার ছিল? ওদের সঙ্গ না দিলে বেপরোয়া হয়ে উঠছিলো। ‘
স্ফীত উদরে হাতের বিচরণে পাগল পাগল লাগছে তার। জিজ্ঞেস করলো,
‘ আবার কোথায় যাবে? ‘
‘ ওরা আমাকে খুঁজছে। যেকোনো সময় মহলে আক্রমণ করবে তাই আমাকে দূরে থাকতে হবে।’
‘ তুমি খুশি হয়েছ তোমার বাচ্চার কথা শুনে?’
শেরহাম মাথা দুলিয়ে বলল, ‘ হ্যা।’
তটিনী তার উদরে হাতটা আরও দাবিয়ে রাখলো। অদ্ভুত একটা শান্তি লাগছে। অশ্রুচোখে হাসলো সে ঠোঁট কামড়ে। শেরহাম নেমে পেট জড়িয়ে নাভিপদ্মে অসংখ্য বার ঠোঁট ছোঁয়ালো। তটিনী আনন্দে, খুশিতে কাঁদা শুরু করলো।
শেরহাম উঠে এসে বলল,
‘ আবার কাঁদছিস কেন?’
তটিনী কান্না থামিয়ে তার মাথাটা টেনে ধরলো নিজের দিকে। গালের দু’পাশে হাত রেখে বলল,
‘ এখানে পুঁড়েছে কিভাবে?’
‘ আগুনে। ‘
তটিনীর চোখ জলে ভরে উঠলো। দু’ঠোঁট চেপে অজস্র চুমু খেল সেখানে। শেরহাম তার মাথার হিজাব খুলে নিল ধীরেধীরে। ভাঁজ করে মাথার নীচে রাখলো। তটিনীর চুল খুলে পড়লো হিজাবের সাথে সাথে। শুকনো খড় চুলে জড়িয়ে গেল। শেরহাম তার চুল সরিয়ে কন্ঠনালীতে আর থুঁতনিতে চুমু খেয়ে গলায় ঠোঁট দাবিয়ে দিতেই তটিনী তার মাথার চুল মুঠোয় নিয়ে পরম আবেশে চোখ বুঁজলো। পিঠ টেনে শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে চুম্বনে রত শেরহাম গালে গাল চেপে ধরে জানতে চাইলো,
‘ মহলে ফিরে যাবি নাকি আজ থাকবি এখানে? ‘
তটিনী উত্তর দিল, ‘ এখানে এখানে। ‘
চলমান…..