#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_৩০
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
তাইয়্যেবা বেগম আর আফজাল সাহেবের জ্ঞান ফেরার পর উনারা জানান কিছু তান্ত্রিক উনাদের বন্দি করেছেন। হত্যা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সবাই মিলে তন্মধ্যে বয়স্ক লোকটি আর উনার ভৃত্যদুজনকে ধরে বেঁধে নিয়ে আসে কয়েকজন মিলে। প্রচুর মারা হয়। আধমরা করে খুঁটির সাথে বেঁধে দলবেঁধে হৈহৈ করে লাফাচ্ছিল সবাই। আর তলোয়ার শান দেয়া হচ্ছিল সেই সময় গুহার ভেতর হতে একটা মানুষ বের হয়ে এল। বয়স্ক মানুষটাকে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন উনি। চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে সেই দলের নেতার সাথে বহু তর্কাতর্কি হচ্ছিলো। একপর্যায়ে বিকট শব্দ ভেসে এল। পেট্রোলের গন্ধ, ধোঁয়ায় উনারা এমনিতেই নিঃশ্বাস নিতে পারছিলেন না সেখানে কয়েকটা সৈন্য এগিয়ে এসে উনাদের নাকে রুমাল চেপে ধরলো। ব্যস, এতটুকুই মনে ছিল।
শেহজাদ জিজ্ঞেস করলো, যেই মানুষটা বের হয়ে এল মশাল হাতে তিনি দেখতে কেমন?
‘ লম্বা, স্বাস্থ্যবান, শ্যামকালো ছিল। ‘
শেহজাদের বুকে কম্পন সৃষ্টি হলো।
‘ আপনাদের সাথে কোনো কথা বলেনি? ‘
‘ নাহ কথা বলার সুযোগটাই তো হলো না। আমাদের কি উনি বাঁচিয়েছেন? ‘
শেহজাদ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল
‘ জানিনা আমরা। আপনাদের ঝিরিপথের পাশেই পেয়েছি। বিশ্রাম নিন। আমি আসছি। ‘
ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে গেল শেহজাদ। বাইরে বেরিয়ে বারান্দায় বসলো কাঠের বেঞ্চিতে। দু’হাতের তালুতে মুখ মুছে ভাবুক হতেই সাফায়াত পাশে এসে বসে বলল,
‘ কি বললেন উনারা? ‘
‘ ওটা ভাইজানই ছিল। ভাইজান এতদিন ওখানে ছিল আমার আশ্চর্য লাগছে। তারমানে পাহাড়ে আগুন ভাইজান লাগিয়েছেন। কিন্তু ভাইজান এখন কোথায়? কাশীম কি বললো? ‘
‘ পোড়া লাশ পাওয়া গেছে অনেক। শনাক্ত করা হচ্ছে। মুখ চেনায় যাচ্ছেনা। ‘
তার মুখ শুকনো দেখালো। শেহজাদ পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
‘ চিন্তা করো না। ভাইজান নিজেই ধ্বংস করেছেন ওই পাহাড়। নিজেকে ঠিকই নিরাপদে রাখবেন। উনি জানেন তনী মা হচ্ছে। ‘
‘ আপনি এত বিশ্বাসের সাথে কি করে বলছেন ভাইজান? ‘
‘ তুমি ভেবে দেখো ভাইজান যাওয়ার পর একটা ডাকাতও এদিকে আসেনি না কোনো জাদুকর। ভাইজান যখন ছিল তখন সবাই আশেপাশেই থাকতো। ভাইজান সরে গিয়েছেন এজন্য যাতে মহলে কোনো বিপদ না ঘটে। ‘
সাফায়াত বলল,
‘ ভাইজান কি আমাদের কাছে ফিরে আসবেন? উনি নিজেকে সমর্পণ করতে চাননা আমাদের কাছে। ‘
‘ আমাদের কাছে না করুক। নিজের সন্তানের কাছে তো সমর্পন করতেই হবে। ‘
‘ তাই যেন হয় ভাইজান। তনীর কষ্ট আমার সহ্য হচ্ছে না। আমার মহলে যেতে ইচ্ছে করেনা ওর মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে। আমাদের মুখ চেয়ে থাকে সবসময়। ‘
‘ আল্লাহ ভরসা। ‘
তন্মধ্যে এসে বলল,
‘ ভাইজান নানাজান ডাকছেন। তাড়াতাড়ি আসুন। ‘
শেহজাদ আর সাফায়াত সেদিকে ছুটে গেল। নানাজানের নাকের উপর ঔষধ লাগানো। উনি ধীরেধীরে শ্বাস ফেলছেন। শেহজাদ যাওয়া মাত্র উনার হাত ধরে বসলো। উনি হাতটা শক্ত করে ধরে বললেন,
‘ মরতে মরতে ফিরে এলাম ভাই। আমার ভাইটা কোথায়? ‘
‘ আপনার ভাই এখনো ফেরেনি। না উনার কোনো বিশ্বস্ত সৈন্যকে পেয়েছি। ভাইজান সত্যি সেখানে ছিল?’
‘ হ্যা। আগুনের মধ্য থেকে ও আর ওর সৈন্যগুলো আমাদের বের করে এনেছে। ও জানতো না আমরা সেখানে গিয়েছি, জানলে তখন বোম ফাটাতো না। আমি কেন যে নেতিয়ে পড়েছিলাম তাড়াতাড়ি বেশি কথা বলতে পারিনি তার সাথে। ‘
‘ উনি যে বাবা হচ্ছেন সেটা বলেননি? ‘
‘ বলেছি। কোনো উত্তর পায়নি। ও’ ওর নফসের সাথে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছে। ভালোমন্দ বুঝার পর এখন লড়াই করছে নিজের সেই অস্তিত্বের সাথে যেটা সে তিলে তিলে গড়েছিল। ওটা ধ্বংস করতে ওর তো পোহাতে হবে। ওই তান্ত্রিকগুলো সবকটা মরেছে কিনা কে জানে? নাহলে তো সবাই ঘোর বিপদে আছে। ওরা খেপে উঠবে ভীষণ। ‘
শেহজাদ চিন্তিত হয়ে পড়লো। ভাইজান কি আহত হয়েছেন? আহত হলে তো চিকিৎসার প্রয়োজন হবে।
______
সপ্তাহখানেক পর সবাইকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসা হলো। শেহজাদ তাঈফের মা বাবাকে মহলে থাকতে বললেন। যে উপলক্ষে এসেছে তা সম্পন্ন করে ফিরবেন।
অনুপমাকেও নিয়ে এসেছেন ফজল সাহেব। শেহজাদ বলেছে এই সময় রূপার তার মাকে প্রয়োজন। আট মাস গড়িয়ে ন’মাসে পড়েছে তাদের সময়। তটিনীকে চোখে চোখে রাখছেন সবাই। বেশ ক’দিন কান্নাকাটির পর এখন সে চুপচাপ হয়ে গেছে। খোদেজা বুঝিয়েছে গর্ভের সন্তান মায়ের অনুভূতি বুঝতে পারে । মা হাসলে তারা আনন্দ পায়, মা কাঁদলে তাদেরও খারাপ লাগে। তাই হয়ত নিজেকে শান্ত করেছে। সবার সামনে নিজেকে স্বাভাবিক রাখলেও সোহিনী দেখেছিল সেদিন ভাতের সাথে কিভাবে তার চোখের পানি মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল খাওয়ার সময়। হয়ত এই ভেবে বনে জঙ্গলের মানুষকে কে রেঁধেবেড়ে যত্ন করে খাওয়াচ্ছে? বাকি এক বেলা খেয়ে দশবেলা অভুক্ত থাকছে?
সবার ইচ্ছে ছিল শবনমের নিকাহ’র কথা তোলা হবে রূপা আর তনীর বাচ্চা ভূমিষ্ট পরবর্তীকালে। কিন্তু তাঈফের মা আর বাবার কারণে সেটা সম্ভব হলো না। তাঈফ শবনমকে দেখেছিল বার কয়েক। বেশিরভাগ দেখাসাক্ষাৎ আর যে দুয়েকবার কথা হয়েছে সবটা সোহিনীর সাথে। সায়রা, শবনমের মতো সোহিনী অতটা লাজুক নয়। সে সোজাসাপটা জড়তা ছাড়াই কথা বলে,
তাঈফ এই গুনে মুগ্ধ হয়ে চাচার কথায় সম্মতি দিয়েছিল কিন্তু যখন জানতে পারে যার সাথে নিকাহ হবে সেই মেয়েটা সোহিনী নয় তখন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এদিকে সোহিনী শবনম কেউ নিকাহ’র জন্য রাজী নয়। মায়ের ভয়ে শবনম তা কাউকে বলতে পারলো না। মা উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান পেয়ে হাতছাড়া করতে চাইছে না। তাই নিজের বুদ্ধিতে একটা কাজও করে বসলো। ডাক্তার সাহেবের যে বন্ধুটা ছিল উনি মহল চত্বরে সিভানের সাথে খুনসুটি করছিলেন। শবনম সবার কাছ থেকে লুকিয়ে উনার হাতে একটা চিরকুট দিয়ে বলেছিল এটা আপনি আপনার বন্ধুকে পড়ে শোনাবেন। লোকটা চিরকুটটা প্রথমেই নিতে চাইলো না। ত্যাড়ছা গলায় বলল, আমাকে কেন এসবে জড়াচ্ছেন? যার চিরকুট তাকে দেবেন। ‘
শবনম বলল, ‘ খুব জরুরী। অনুরোধ করছি। দেরী হলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। দয়া করে সাহায্যটুকু করুন। ‘
নাদির জবাব দিল, ‘ চিরকুট না পড়ে আমি নেব না। ‘
‘ বেশ পড়ুন। ‘
নাদির চিরকুটটা পড়লো। পড়তে পড়তে কপালে ভাঁজ পড়লো তার। শবনমের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বলল
‘ মাথা খারাপ? আমাকে কি মনে করেছেন? আমাকে এসবে জড়াচ্ছেন কেন? আপনি নিকাহ করতে রাজী নন সবাইকে তা বলতে পারছেন না? খুকী তো নন। ‘
শবনম অপমানিত বোধ করলো। আচ্ছা একটা বেয়াদব তো। মুখের উপর ফটাফট যা তা বলে দিল। খুকী নয় তো কি বুড়ি? সে বলল,
‘ আপনি এমন জানলে তো আর বলতে আসতাম না। সে যাইহোক সব তো জানলেন, না বললে নাই। কিন্তু আমি সবাইকে পরে বলব আমি আপনাকে বলতে বলেছি কিন্তু আপনি বলেননি। ক্ষতি আপনার ভাইয়েরই হবে ক্যাপ্টেন সাহেব। ‘
তা বলে চলে এল শবনম। নাদির কপাল কুঁচকে তার যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো।
শবনম ভাবুক হয়ে হাঁটতে হাঁটতে তটিনীর কক্ষে গেল। সেখানে অপরূপাও আছে। আয়শা তাদের মাঝে বসে ছোট কাপড়ের পুতুল বানাচ্ছে। কথা বলতে বলতে মাঝেমধ্যে হেসে উঠছে তারা। তটিনী পা টান টান করে বিছানায় বসা। অপরূপা আর আয়শা মেঝেতে। তটিনী আয়শার কথায় মাঝেমধ্যে হাসলেও তার চেহারা থেকে বিষণ্নতা মুছেনি। অপরূপা শবনমকে দেখে ডাকলো,
‘ বাইরে কেন? এসো। ‘
শবনম গুটিগুটি পায়ে কক্ষে প্রবেশ করলো। তটিনীর পাশে গিয়ে বসলো। তটিনী বলল,
‘ তুমি নাকি নিকাহ করতে রাজী হচ্ছ না? ‘
শবনম অবাক কন্ঠে বলল,
‘ কে বললো তোমাকে? ‘
তটিনী অপরূপার দিকে তাকালো। অপরূপা বলল,
‘ আমি বলেছি। আমাকে সায়রা সোহিনী বলেছে। ‘
শবনম তার পাশে গিয়ে বসলো। বলল,
‘ এখন এসব ভালো লাগছেনা আপু। আম্মাকে এসব বলো না। আমি যা করার করে নিয়েছি। ‘
তটিনী অবাক গলায় বলল,
‘ কি করেছ? আব্বার চিঠি এসেছে, উনি এই সম্বন্ধে রাজী আছেন। কেন রাজী হচ্ছ না তুমি? অন্তত তুমি আব্বাকে খুশি করাও। উনি তো আমার কথা উল্লেখও করেননি চিঠিতে। তুমি মত দেবে, আমি এতটুকুই জানি। ‘
‘ কিন্তু আপু আমি তো বলে দিয়েছি আমি নিকাহ করতে পারব না। ‘
‘ কাকে বলেছ? ‘
‘ আমি ডাক্তার সাহেবের যেই বন্ধুটা ছিল জনাব মেহমাদ, উনাকে বলেছি। ডাক্তার সাহেবকে পাচ্ছিলাম না তাই উনার বন্ধুকে বলেছি যে উনাকে যেন বলে দেন আমি এই নিকাহ করতে চাই না। ‘
তটিনী কপালে হাত চাপলো। শবনম বোকার মতো চেয়ে রইলো।
কিছুক্ষণ পর কক্ষে হন্তদন্ত পায়ে সোহিনী প্রবেশ করলো। সকলেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তার দিকে। সে ছুটে এসে শবনমকে বলল,
‘ এই তুই কি বলেছিস সবাইকে? ‘
শবনম বেকুব বনে গেল। ‘ কোথায় কি বলেছি? ‘
‘ তুই নাকি নিকাহ করতে পারবি না।
এখন ওই ডাক্তারের সাথে আমাকে নিকাহ দেয়ার কথা ভাবছে সবাই। ‘
‘ ভালোই তো। উনার সাথে তো তোর ভাব বেশি। তুই বেশি কথা বলিস। আমার সাথে তো উনার কথা হয়নি। ‘
‘ কি বললি? আমার ভাব বেশি? কি বলতে চাইছিস? ‘
সোহিনী শবনমের দিকে এগোচ্ছিলো খেপে গিয়ে।
সোহিনীকে আটকালো অপরূপা। বলল,
‘ কি হচ্ছেটা কি? দুজন ঝগড়া করছো কেন? ‘
সোহিনী রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
‘ ওই চশমাওয়ালাকে আমি নিকাহ করব না। আমি আছি আমার জ্বালায়। তোদের মতো রঙ্গ করার সময় নেই আমার। ‘
শবনম বলল,
‘ আমারও রঙ্গ করার সময় নেই। আমি এখন নিকাহ করতে পারব না। ‘
সোহিনী রেগেমেগে বলল,
‘ আমিও পারব না। নিকাহ’র কথা হচ্ছে তোর সেখানে আমাকে টানছিস কেন? আর সবাই বললেই আমি নিকাহ করব কেন? ‘
তটিনী বলে উঠলো,
‘ করবে না কেন? তোমার ভাই এসে তোমাকে কখন নিকাহ দেবে সেই আশায় বসে আছ? ‘
‘ হ্যা বসে আছি। আমি নিকাহ করব না। করব না মানে করব না। আমার ভাইয়ের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না আর আমাকে রঙ্গ পেয়েছে? কেউ নিকাহ করতে বললে তার একদিন কি আমার একদিন। দেখে নেব আমি। ‘ গটগট পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল সে।
শবনমের চিরকুটটা পাওয়ামাত্র তাঈফ মাকে সবটা জানালো। সে একটা বিভ্রান্তিতে ছিল। কাজে মনোযোগ দিতে পারছিল না। চিঠিটা পেয়ে মনটা হালকা হয়ে গেছে। নইলে কি একটা ঝামেলায় জড়িয়ে যাচ্ছিলো। শবনম রাজী নেই, তাই সে মাকে সোহিনীকে পছন্দের কথাটা জানিয়ে দিয়েছে।
রসাইঘরে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। তাঈফের মা শবনমকে পছন্দ করেছে। সোহিনীকে উনার মনে ধরেনি। মেয়েটা ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলে। কিন্তু ছেলে জানিয়েছে সে সোহিনীকে নিকাহ করতে চেয়েছে। নামের মধ্যে গন্ডগোল হয়েছে। সে শুরু থেকেই ভেবেছে চাচার তার সাথে সোহিনীর কথা বলছে। শবনমকে সে তেমন একটা দেখেওনি। সে অন্দরমহলের বাইরে অকারণে বেরোয় না। সোহিনী অসঙ্কোচে চলাফেরা করে। লজ্জা পায় না তেমন।
তাঈফের সোহিনীকে পছন্দ কথাটা মহলে রটে যেতেই শবনম সায়রা মজা উড়ালো সোহিনীর সাথে। শবনম বলল, এতক্ষণ তো আমাকে বকছিলি। এখন সত্যি হয়নি আমার কথা? ভাব ছিল না তোদের মধ্যে? ‘
সোহিনী হতবাক। ‘ ওই লোকটা তলে তলে এতদূর এগিয়েছে সে কি জানে নাকি? আজব মানুষজন! এত প্রেম আসে কোথা থেকে এদের? সোহিনী রাগে থাকতে না পেরে নিজেকে কক্ষবন্দী করলো। তার ভাইজানের খোঁজ খবর নেই সবাই আছে বিয়ের তালে। তার ভাইজান মরলেও কারো কিছু যায় আসবে না। তার ভাইপো ভাইঝি আসছে অন্তত তাদের দেখভাল করার জন্য তাকে মহলে থাকতে হবে। নিকাহ করে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার মতো অবস্থায় সে নেই। কিছুতেই নিকাহ করবে না সে। সন্ধ্যায় শেরতাজ সাহেব তার কাছে এল। সোহিনী শোয়া থেকে উঠে বসলো। শেরতাজ সাহেব বললেন,
‘ তোমার নানাজান তোমাকে ডাকছে। ‘
সোহিনী কান্না আড়াল করে বলল,
‘ জানি কেন ডাকছে। কেউ কি আমাকে বুঝতে পারছেন না নাকি চাচ্ছেন না আব্বা? ‘
‘ দেখো মা। তোমার নিকাহ’র বয়স হয়েছে। এমন ভালো পাত্র যে কিনা তোমাকে নিজেই পছন্দ করেছে তাকে কি করে ফিরিয়ে দিই? সে বলেছে নিকাহ’র পর তুমি এখানে থাকতে পারবে। যেহেতু সে এখানকার হাসপাতালে আছে। মাঝেমধ্যে ওদের বাড়িতে যাবে। এমন সুপাত্র আর পাব না মা। ‘
‘ আর ভাইজান? আমার ভাইজান কোথায় আছে না জেনে আমি বউ সাজবো? আমার ভাইপো ভাইঝিগুলোকে আমাকে দেখভাল করতে হবে না?’
‘ বললাম তো তোমাকে এখানে রাখবে। ‘
সোহিনী কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। সদরকক্ষে নানাজান অপেক্ষারত। সে ভালো করে মাথা ঢেকে নানাজানের কাছে গেল। নানাজান তাকে দেখামাত্র বলল,
‘ আয় আয় বোন। কাঁদছিলি নাকি? ‘
সোহিনী শক্ত কন্ঠে বলল,
‘ সোহাগ করো না অত। যা বলার জন্য ডেকেছ বলো। ‘
নানাজান মৃদু হাসলেন। বললেন,
‘ ভাইয়ের মতো মাথা এত গরম থাকে কেন সবসময়? আর বেশিদিন নেই আমি, যাওয়ার আগে অন্তত তোর নিকাহটা দেখে যাই। নয়ত শান্তি পাব না কিছুতেই। রাজী হয়ে যা বোন। অমন ভালো পাত্র আর আসবে না। এমন বদমেজাজি মেয়েকে এই ডাক্তার সামলাতে পারবে । তোর কাছে আমার শেষ ইচ্ছের কথা বললাম। নাতজামাই হিসেবে তাকে আমার ভীষণ রকম পছন্দ হয়েছে। ‘
সোহিনী ঘনঘন গাল মুছলো। নানাজান বললেন,
‘ আমি মরে গেলে আফসোস করবি। তোর কাছে শেষ ইচ্ছেটা রাখলাম। ‘
সোহিনীর গাল বেয়ে অশ্রু গড়াতে লাগলো। নানাজান হাসলেন। সদর দরজা পার হয়ে কথা বলতে বলতে প্রবেশ করছিলো শেহজাদ তাঈফরা সকলেই। সোহিনীকে নানাজানের উরুতে মাথা রেখে কাঁদতে দেখে সকলের পা থেমে গেল।
সকলের উপস্থিতি টের পেয়ে নানাজান তাদের দিকে তাকালেন। হেসে বললেন,
‘ আলহামদুলিল্লাহ বিবি রাজী ডাক্তার সাহেব। ‘
সাফায়াত তাঈফের পিঠ চাপড়ে বলল, ‘ মোবারক বাদ। ‘
তাঈফ প্রসন্ন হাসলো।
দ্বিতলে চত্বরে মহিলারা সকলে দাঁড়িয়েছিল। নানাজানের কথা শুনে সকলের মুখে মুখে আলহামদুলিল্লাহ রব উঠলো। তটিনী লম্বা-চওড়া একটা শ্বাস ফেললো, সুখ ঝড়ে পড়ুক তাদের ঘরে। তার মতো ঘর, বর কারো না হোক।
________________
আগামীকাল শুক্রবারে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হলো। নানাজান মসজিদে বিয়ে পড়াবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শেহজাদের সাথে গোপন পরামর্শ করে। গতবারের মেহফিলটা নষ্ট হওয়ার কারণে বিয়ে উপলক্ষে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করতে বললেন এবার। এখন ডাকাত হামলার ভয় নেই। যদি ডাকাতরা আসেও তার সাথে শেরহামও আসবে তাতে নানাজান বিশ্বাসী। শেহজাদ নানাজানের পরিকল্পনা বুঝতে পেরে রাজী হলো।
শুভক্ষণ ঘনিয়ে এল। মহলের ভেতর বাইরে রমরমা পরিবেশ। নিকাহ উপলক্ষে অতিথিরা আসছেন। শেহজাদ কড়া পাহাড়া রাখতে বলেছে কাশীমকে। সে মনেপ্রাণে চায় ভাইজান একবার হলেও দেখা দিক। নিকাহ’ পড়ানো হবে রাতে এশার নামাজের পর। এদিকে সন্ধ্যায় সামাদ আর মুরাদকে ধরে নিয়ে এল কাশীম। রোগা-সোগা, দেখে মনে হচ্ছে বহুদিন ধরে অসুস্থ ছিল তারা। শেরহামের কথা জিজ্ঞেস করলেও তারা মুখ খুললো না। শেহজাদ তাদের বন্দি করার আদেশ দিল। মুখ না খুলে পঞ্চাশ দেয়ার ভয় দেখাতেই তারা মুখ খুললো। জানালো গত এক সপ্তাহ ধরে শেরহাম পরাগ পাহাড়ের নিকটস্থ একটা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছে । শেহজাদ সেখানে চলে গেল সাফায়াতকে নিয়ে। সেখানকার পৌঢ় ডাক্তার জানালেন তিনি সকালে পালিয়েছেন। পুরোপুরি সুস্থ হননি এখনো। তা শুনে শেহজাদ হতাশ হয়ে বসে পড়লো। আর কত!
________________
জনমানবে পরিপূর্ণ মসজিদ প্রাঙ্গন। খাওয়াদাওয়া চলছে একপাশের প্যান্ডেলের ভেতর । সোহিনীকে পালকি থেকে নামানোর পরপর অপরূপাকেও নামানো হলো পালকি থেকে। সবার পরে তটিনীর পালকিটা এসে থামলো ঘোড়ার গাড়ির পাশাপাশি।
শাহানা গাড়ি থেকে নেমে তাকে ধরে ধরে পালকি থেকে নামালো। বলল, দু রাকাআত নফল নামাজ পড়ে নেবে তোমার সন্তানের জন্য। তোমার নানাজান বলেছেন। তোমাদের এই জন্যই এখানে আনা। তটিনী মায়ের কথায় মাথা দোলালো। শবনম, সায়রা এসে তটিনীকে ধরলো। তটিনী তাদের সাথে পা বাড়ালো। চারপাশে শেহজাদের সৈন্যদের পদচারণা। তটিনী এদিকওদিক তাকালো বারংবার। এত এত মানুষ! অথচ সেই একজন নেই। ভাবতেই তার বুকটা ভার হয়ে এল তার। কোথায় সে? একবার দেখা দিলে কি এমন হয়ে যাবে? একরাশ মন খারাপ আড়াল করে আর একদলা কান্না গিলে পা বাড়ালো সে।
দূর হতে একজোড়া চোখ যে তার বাড়ন্ত পেটের দিকে চক্ষু গেঁথে রেখেছে সেটা সে জানতেই পারলো না।
চলমান……