#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_২৯
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
আফজাল মুস্তাফী আর উনার স্ত্রীর তাইয়্যেবা বেগম সুলতান মহলে যাচ্ছিলেন। ভাইয়ের অনুরোধ রাখার জন্য আফজাল সাহেব স্ত্রীকে নিয়ে রওনা হয়েছিলেন। একমাত্র সন্তান তাঈফের জন্য নাকি পাত্রী নির্ধারণ করে রেখেছে চাচা চাচী মিলে। উনাদের দেখানোর পর পাকা কথা সেড়ে ফেলবেন এই ছিল মূল কথা। কিন্তু পথিমধ্যে এমন ভয়ংকর ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে কে জানতো? বেঁটেমতো মানুষ দুটোকে মেরে অজ্ঞান করে ফেলা হয়েছে প্রায়। বয়স্ক মানুষটাকে মারছে এখনও। রক্ত নির্গত হচ্ছে উনার নাক বেয়ে। তাইয়েবা চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলেন বাবার বয়সী মানুষটার উপর এমন অত্যাচার হতে দেখে। কাকুতিমিনতি করে বললেন,
‘ দয়া করে আমাদের সবাইকে ছেড়ে দিন। বয়স্ক মানুষটাকে আর মারবেন না। হায় আল্লাহ আপনি কি এসব অন্যায় দেখছেন না? ‘
এক তান্ত্রিক ধমক দেয়।
‘ নিজে মরবি কিছুক্ষণ পর, বুড়োকে নিয়ে তার চিন্তা হচ্ছে। ‘
বলেই হো হো করে হেসে উঠলো শতাধিক তান্ত্রিক একসাথে । কালো রঙের কাপড়চোপড় পড়া, লম্বা লম্বা চুল, ভয়ংকর, হিংস্র লোকগুলোর জঘন্য হাসি দেখে ঘৃণা ঝড়ে পড়লো তাইয়্যেবার চোখ দিয়ে। চেঁচিয়ে বলল,
‘ তোদের বিনাশ হবে শয়তান। জাহান্নামেও ঠাঁই হবেনা তোদের। ‘
কমলা রঙের পোশাক পরিহিত দুজন মহিলা এসে উনার মুখ বরাবর থুতু মেরে চলে যায়। কেঁদে উঠেন উনি। উনার স্বামী বলেন,
‘ তোমাকে চুপ করতে বলছি। আমার কসম লাগে আর কথা বলো না। আল্লাহকে ডাকো। উনি একমাত্র সহায়। ‘
তাইয়্যেবা কাঁদতে থাকেন। নানাজান আধমরা হয়ে পড়ে থাকেন। সবাই একত্রে হো হো করে হাসতে থাকে। নানাজানকে বন্দি করা হয়। রশি দিয়ে তিনজনকে শক্ত খুঁটির সাথে বেঁধে রাখে তারা। সামনেই দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। নানাজান পুরোপুরি অজ্ঞান না হওয়ায় আধোআধো চেয়ে থাকে আগুনের দিকে।
তন্মধ্যে ভারী পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়ে সতর্ক হয়ে যায় সকলে। তাইয়্যেবা বেগম আর আফজাল সাহেব সেই ভারী পায়ের শব্দের উৎসস্থল খুঁজতে গিয়ে দেখেন বলিষ্ঠ দেহের এক হিংস্র, কঠোর মানব এসে দাঁড়িয়েছে একহাতে বিশালাকৃতির একটা আগুনের মশাল হাতে। চেহারা কাঠিন্যে, রুক্ষ্মতা দেখে ভয়ে অন্তরআত্মা কেঁপে উঠে উনাদের। সাথে সাথে নাকে আসে পেট্রোলের কড়া গন্ধ। আচম্বিত বিকট শব্দ হয়। ভয়ংকরী জাদুনগরী কেঁপে উঠে সেই শব্দে। শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলার মতো বিকট শব্দ। চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে যায় চারিপাশে। মাথা ঘুরে আসে আরও একটা অদ্ভুত বিশ্রী গন্ধে।
______
শেহজাদ আর সাফায়াত পরাগ পাহাড়ের কাছাকাছি এসে থেমেছে সবেমাত্র । দূর হতে পোড়া পোড়া গন্ধ নাকে এসে লাগছিলো বেশ। সৈন্যরা বলার পরেও চুপ করে শুনে গেছে শেহজাদ। কেন পোড়া গন্ধ লাগছে সে জানে না।
তবে পরাগ পাহাড়ের কাছাকাছি আসার পর সবাই বুঝে গিয়েছে কেন এতক্ষণ পোড়া পোড়া গন্ধ লাগছিলো। কেন রাতের আকাশ এমন থমথমে তামাটবর্ণে সেজেছে। পাহাড়ের সেই গুহায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। পরপর বোমা ফাটার শব্দে কান ঝালাপালা হওয়ার অবস্থা। অত্যোধিক আওয়াজ, মনুষ্যে চিৎকার আর আর্তনাদ ভেসে আসছে। বনজঙ্গলের পশুপাখি অব্দি চুপসে গেছে এমন শব্দে। শেহজাদ চেয়ে রইলো সেই দিকে। সাফায়াত আঙুল দেখিয়ে বলে,
‘ ভাইজান এসব কি হচ্ছে? দেখতে পাচ্ছেন আগুন জ্বলছে ওখানে। ‘
শেহজাদ বলল, ‘ দেখতে পাচ্ছি। আমরা আরও সামনে এগোবো। চলো। ‘
‘ কিন্তু। ‘
‘ কিন্তু বললে চলবে না। কিভাবে আগুন লেগেছে তা তো জানতে হবে। ‘
‘ কিন্তু ওখানে অনেক জাদুকর। গতবার এমন ভুল করেছিলাম বলে আমাদের বিপদে পড়তে হয়েছে। আমি আপনাকে যেতে দিতে পারিনা। রূপা আর তনীর সময় ঘনিয়ে এসেছে এখন আমাদের সাবধানে পথ চলতে হবে। আমরা ছাড়া ওদের কেউ নেই। ‘
শেহজাদ আকাশের দিকে উড়ে যেতে থাকা কালো কালো আগুনের কুন্ডলীর দিকে চেয়ে রইলো। সত্যিই কি কেউ নেই? এই পরাগ পাহাড়ের গুহা জ্বালিয়ে দেয়ার পেছনে কেউ নেই?
শেহজাদ বলল, ‘ আমি যাব। আমার মনে হচ্ছে যাওয়া উচিত। সাফায়াত আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। আমার এভাবে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। ‘
সাফায়াত রাজী হয়। বলে, ঠিক আছে। চলুন। ততক্ষণে সৈন্যরা ছুটে আসে দলে দলে। বলে,
‘ সাহেব পরাগ পাহাড় জ্বলছে। তান্ত্রিকদের অনেকে মরেছে অনেকে আহত অবস্থায় ঘোড়া নিয়ে পালিয়েছে পশ্চিমে। ঝর্ণার ধারে কয়েকজনকে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আমরা ওদিকে এগোলে নিশ্চয়ই কিছু না কিছুর হদিস পাব। ‘
শেহজাদ আর দাঁড়ালো না। দলবল নিয়ে এগিয়ে গেল। কালো ধোঁয়ার কবলে সকলেই কাশা শুরু করলো। কাশতে কাশতে মশাল হাতে ঝিরিপথ ধরে হাঁটা শুরু করলো পাহাড়ের পাদদেশে। আগুনে পোড়ার শব্দ আর গন্ধে টিকে থাকা মুশকিল।
ঝিরিপথের ধার হতে পাঁচটা দেহ উদ্ধার করলো সৈন্যরা। আফজাল সাহেব আর তাইয়্যেবা বেগম তাদের সকলের অপরিচিত হলেও তাঈফের বর্ণনার সাথে হুবহু মিলে যাওয়ায় সকলেই নিশ্চিত যে উনারাই তাঈফের বাবা মা। সৈন্যরা হৈহল্লা শুরু করে দিল ওই তিনটা দেহ নিয়ে। শেহজাদ আর সাফায়াত চমকে গেল নানাজানকে দেখে। আঁতকে উঠলো কাপড়চোপড় আর তাদের শরীরে এমন অবস্থা দেখে।
ছুটে গিয়ে কোলে মাথা তুলে ডাকাডাকি শুরু করলো শেহজাদ আর সাফয়াত। নানাজান আর লোকদুটোর অবস্থা গুরুতর। শেহজাদ চেঁচিয়ে বলল,
‘ তারাতাড়ি রূপনগরে ফেরার ব্যবস্থা করো কাশীম। নানাজানকে বাঁচাতে হবে। তাড়াতাড়ি করো। ‘
তাঈফের মা আর বাবার হাত পা আর মুখের একপাশে আগুনে ছ্যাঁকা লেগে পোড়া ক্ষত হয়ে আছে। শেহজাদ নানাজানের মুখ ধরে ডাকাডাকি করে।
‘ নানাজান কথা বলুন। ‘
নানাজান আচমকা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে। শেহজাদ তার কান রাখে নানাজানের ঠোঁটের কাছে। নানাজান অস্ফুটস্বরে বলতে থাকেন,
‘ শেরহাম, বে..রিয়ে আ..য়। ‘
শেহজাদ সাথে সাথেই দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা পাহাড়ের দিকে তাকায়। ধোঁয়াটে পাহাড় ঝাপসা চোখে দেখতে থাকে সে। সাফায়াত ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ ভাইজান কি হলো? ‘
শেহজাদ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে সাফয়াতকে ঝাঁকিয়ে বলল,
‘ আমি বিশ্বাস করিনা ভাইজান ওখানে। ভাইজানের সাথে আমার অনেক ঝগড়া বাকি। ‘
সাফায়াত তাকিয়ে রয়।
__________________
খবর পেয়ে সকলেই হাসপাতালে চলে আসে। তাঈফ মা বাবার খবর শুনে ছুটে গেল। সকলের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। চিকিৎসা শুরু হলো সবার।
পরাগ পাহাড়ের কাছাকাছি থেকে যায় শেহজাদের সৈন্যরা। আগুন নিভে গেলে তারা খুঁজে দেখবে। সায়রা, শবনম, সোহিনীও এসেছে বাবা জেঠুদের সাথে। নানাজানকে ওই অবস্থায় দেখে কান্নায় ফেটে পড়ে সোহিনী। কাঁদতে থাকে অবিরত। তার সব আপন মানুষ দূরে দূরে চলে যায় শুধু। পনের বছর পর ভাইজান দেখা দিয়ে আবারও কোথায় নাই হয়ে গেল। চারিপাশ নীরব নিস্তব্ধ করে দিয়ে রূপনগরকে শান্তিনগরে বানিয়ে দিয়ে চলে গেল। এখন নানাজান। কতবছর পর উনাকে দেখলো সোহিনী। সেদিন আদর করলেন মনভরে। এও বললেন উনার বোনের বিয়েতে তিনি স্বয়ং উপস্থিত থাকবেন। নিজে নিকাহ পড়াবেন। সোহিনীর বুকফাটা আর্তনাদ শুনে শেহজাদ আর সাফায়াত ছুটে আসে । সোহিনী কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘ আমার ভাইজান কোথায়? সবাইকে পেয়েছেন। ভাইজানকে পাননি? কোথায় আমার ভাইজান?’
শেহজাদ তাকে জড়িয়ে ধরে তার মাথায় থুঁতনি ঠেকায়। তার বিশ্বাস ভাইজান আছে, তাদের ঢাল হয়ে, ছায়া হয়ে।
__________________
তটিনী হারিকেন হাতে বেরিয়ে আসে মহল প্রাঙ্গনে। আট মাসের উঁচু হওয়া পেটের ভারে হাঁটতে কষ্ট হলেও সেই কষ্ট সহ্য করে নীচে নেমে এসেছে সে। তাকে এদিকে আসতে দেখে অপরূপা চেঁচামেচি করে সবাইকে ডাকলো। শাহানা হামিদা সকলেই ছুটে এসে তটিনীকে ধরলো। শাহানা লন্ঠন কেড়ে নিল। হামিদা জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ কোথায় যাচ্ছ তুমি এই অন্ধকারে? ‘
তটিনী বলল,
‘ হাসপাতালে নিশ্চয়ই ও আছে। সবাই ওভাবে ছুটে গেল কেন? আমার কাছ থেকে কেউ কিছু লুকচ্ছ? মরে গেলে মরা মুখটা দেখতে দাও। আমি বলেছিলাম ও মরে গেলে ওর মরা মুখ দেখবো না। কিন্তু ওটাতো মন থেকে বলিনি। ও মরে যাক সেটা আমি চাইনি। আমি ওকে ঘিরে বাঁচতে চেয়েছি। আমার সাথে কেন এমন হলো? ‘
বসে পড়ে সে। হামিদা তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ শেরহাম নেই কোথাও। সে হাসপাতালে নেই। তাকে কেউ পায়নি। ‘
তটিনী কাঁদতে থাকে। শাহানাকে ঝাঁকিয়ে বলে, ও যেখানে থাকুক একবার আসতে বলো আম্মা। আমার বুক ছিঁড়ে যাচ্ছে। তোমরা কি ওকে ক্ষমা করোনি? ও অনুতাপের আগুনে পুড়তে পুড়তে মরে যাবে আম্মা। আমার কাছে আর ফিরবে না।’
শাহানা বলে, ‘ করেছি। সবাই ক্ষমা করেছি। আমরা চাই ও ফিরে আসুক। ‘
‘ তাহলে ফিরে আসছে না কেন? আমি ওকে অন্ধকার থেকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছি এটা আমার দোষ হয়ে গেল?’
শাহানা উত্তর দিতে পারেন না। মহলের সিংহদুয়ার পার হয়ে প্রবেশ করে শেহজাদ আর সাফায়াত। তটিনী তাদের কাছে ছুটে যায়। প্রশ্ন করে,
‘ ও মহলে আর কোনোদিন আসবে না? ওর বাচ্চার মুখ দেখবে না? নাম দেবে না? বাচ্চার কথাটাও জানবে না? ‘
শেহজাদ উত্তর দিতে পারেনা। নিরুত্তর চেয়ে রয়। ঘোড়ার পিঠে ছুটে চলা মানুষটি সেদিন হয়ত শুনতে পেয়েছিল বাচ্চার কথা তাই এত সুরক্ষিত রেখেছে মা বাচ্চা আর নগরকে।
তটিনী শেহজাদকে ঝাঁকিয়ে বলে,
‘ তুমি রূপনগরের সম্রাট হয়ে…
তাকে বাকিটুকু বলতে দেয় না শেহজাদ। জলদগম্ভীর স্বরে খেঁকিয়ে বলে উঠে,
‘ আমি সম্রাট নই। আমি শুধু শুধুই শেরহাম সুলতানের ভাই। আর কিচ্ছু না। এর পরের প্রজন্মে যারা আসবে তারাও শুধু ভাই ভাই হবে। কেউ সম্রাট নয়, কেউ গোলাম নয়। শুধুই ভাই। ‘
তার বাজখাঁই গলার স্বর মহলের প্রতিটা কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়ে। সকলেই নীরব হয়ে শোনে।
চলমান…..
রিচেক করা হয়নি
Aj k raate er cheye o aro boro boro 2ta prbo chai,,,,,, 😁😁😁😁😁😁😁 dien plz,,,,