#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_২৭
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
তটিনী অতিথি শালায় চলে এল। সেখানে শেরহামের সৈন্যদের কোনো অস্তিত্ব নেই। গুটিগুটি পায়ে মহলে যেতেই দেখতে পেল সেই আগের মতো সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। রসাইঘরে যেতেই দেখলো কাজের বুয়ারা রান্না করছে। বাকিরা কেউ সেখানে নেই। সে আঁতিপাঁতি করে কিসের বৈয়াম খুঁজতে লাগলো। মতিবানু, ফুলকলি তার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ কি খুঁজেন? ‘
তটিনী জবাব দেয় না। খুঁজতে খুঁজতে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পিছু ফিরে দেখে সেই বৈয়াম হাতে অপরূপা দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। তটিনী খপ করে বৈয়ামটা নিয়ে বেরিয়ে যায়। ওড়নার নীচে লুকিয়ে ফেলে । অপরূপা তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে। তটিনী যেতেই শাহানা এসে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কিছু খেয়েছে ও? কেন এসেছে? ‘
অপরূপা চোখের ইশারায় মতিবানুদের সাবধান করলো। ওরা আমতাআমতা করে বলল,
‘ পানি খাইতে আইছিলো। খাইয়া চইলা গেছে। ‘
শাহানা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে যায়। অপরূপা সোহিনীর কক্ষে যায়। তাকে তটিনীর কক্ষে যেতে বলে। তার এতটা মৌনতা স্বাভাবিক নয়। সোহিনী অপরূপার কথামতো তটিনীর কক্ষে যায়। কক্ষে গিয়ে দেখে সেখানে পুরো কক্ষটা ফাঁকা। ভাইজানের কাপড়চোপড় , বন্দুক ধনুক, চটি, কোনোকিছুই ছড়ানো ছিটানো নেই। তটিনী মেঝেতে বসে আছে খাটের পায়ায় হেলান দিয়ে। হাতে কিসের একটা বৈয়াম। ওড়নার কোণায় বারংবার চোখ মুছে যাচ্ছে। শুধু কক্ষ ফাঁকা হয়ে যাওয়া নয় তার বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। একটা মানুষ যাকে সে ঘৃণা করবে বলে পণ নিয়ে একটু একটু করে ভালোবাসায় ডুবেছে তার অনুপস্থিতি তাকে কতটা পোড়াচ্ছে তা কেউ বুঝবে না। হোক সে অমানবিক, পাষাণ, কাফের কিন্তু তনীর বেলায় সে কখনোই অমানবিক হয়নি। নিজের কলুষিত মনের বিরুদ্ধে গিয়ে তনীকে ভালোবাসার চেষ্টা করেছে। যেখানে পুরো পৃথিবীর কাছে সে পাপী সেখানে তনীর কাছে সে নিস্পাপ।
সোহিনী গুটিগুটি পায়ে হেঁটে এগিয়ে যায়। তার পাশে গিয়ে বসে। তটিনী ঘাড় ফিরিয়ে তাকে দেখে। চোখে টলমল করা জল গড়িয়ে পড়ে। সোহিনীর চোখ জলে ভরে উঠে। তটিনী ঝাপটে জড়িয়ে ধরে তাকে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে দুজন।
সোহিনী নিজেকে শান্ত করে তার চোখের পানি মুছে দেয়। আচারের বৈয়াম দেখে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। তটিনী কেঁদে উঠে বলে,
‘ আমি ওকে বলিইনি ও বাবা হতে যাচ্ছে। কাউকে বলিনি সবার আগে ওকে বলব বলে। আমাকে মাঝপথে ফেলে রেখে কোথায় চলে গেল ও? ‘
সোহিনী অবাকচোখে তাকিয়ে থাকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজেও কেঁদে উঠে । অপরূপা চোখ মুছতে মুছতে দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়।
___________
শেহজাদ আর সাফায়াত ডাকাত ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে ফিরে এসেছে। গুটিকয়েক ডাকাত এসেছিল সবে তাদের উপর হামলা করে ডাকাত ঘাঁটি ভাঙচুর করেছে। ক্লান্ত হয়ে দুজনেই প্রাঙ্গনে বসেছিল। জোরালো পদধ্বনির শব্দ পেয়ে চোখমেলে দেখলো কাশীম এসে দাঁড়িয়েছে। জানালো,
‘ শেরহাম সুলতান এসেছেন। শীঘ্রই দেখা করতে বলেছেন। ‘
শেহজাদ দাঁড়িয়ে যায়। সাফায়াতও। বিলম্ব না করে বেরিয়ে পড়ে তারা। অপরূপা তটিনীকে গিয়ে জানায়। তটিনী হন্তদন্ত পায়ে প্রাঙ্গনে ছুটে আসে। কাশীমকে বলে,
‘ আমাকে এক্ষুণি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। আমি যেতে চাই। আমি ওর সাথে দেখা করব। তাড়াতাড়ি করুন। ‘
‘ দুঃখীত বেগম। আমার কাছে আদেশ নেই। ‘
অপরূপা পেছনে এসে দাঁড়ালো। বলল,
‘ অনুরোধ করছি। উনাকে যেতে দিন। দ্রুত করুন। জানাজানি হলে সমস্যা হবে। গাড়িতে করে নিয়ে যান। ‘
কাশীম অপরূপার কথা ফেলতে পারলো না। ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে এল। তটিনীর গায়ে চাদর জড়িয়ে দিল অপরূপা। বলল,
‘ আমি এদিকটা সামলে নেব। আপনি সাবধানে থাকবেন।’
‘ তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। ‘
ঘোড়ার গাড়ি ছেড়ে দিল। গাড়ির শব্দ শুনে মহলের সবাই বেরিয়ে এল। অপরূপা ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো তাদের দিকে।
____________
ছোট ছোট পাহাড়ের একটা ঢালু জায়গার পাশেই শেরহামের ঘোড়াকে দেখে শেহজাদের ঘোড়া থামে। আকাশে মস্তবড় চাঁদ। চাঁদের কিরণে চারদিকে ফকফকা। ঝোপঝাড়ে অন্ধকার লুকিয়ে আছে। বাতাসের শাঁ শাঁ শব্দ আর বন্যলতার দুলে ওঠার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই চারপাশে।
শেরহামকে ঘোড়ার পাশেই বসে থাকতে দেখে শেহজাদ।
শেহজাদ আর সাফায়াতকে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতে দেখে উঠে দাঁড়ালো সে। শেহজাদ এগিয়ে এসে গমগমে স্বরে বলল,
‘ মহলে ফিরছো না কেন তুমি? এভাবে সবকিছু মাঝখানে ঝুলিয়ে রেখে হাওয়া হয়ে যাওয়ার মানে কি? শেরহাম সুলতানকে এত অচেনা ঠেকছে কেন? ‘
শেরহাম সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বাড়িয়ে দেয় হাতের মুঠোয় থাকা দলিলপত্র। তারপর চাবির তোড়া। একটা বাদামীরঙা পত্র। শেহজাদ নিয়ে সেদিকে না তাকিয়ে বলে,
‘ কি এসব? এসব আমি কেন নেব? তুমি মহলে চলো। তনী তোমাকে খুঁজছে। সবার কথা না ভাবো অন্তত তনীর কথা ভেবে ফিরে চলো। মেয়েটার মন ভেঙো না। ‘
শেরহাম ঘোড়ার দিকে এগিয়ে যায়। সাফায়াত ততক্ষণে শেহজাদের হাত থেকে দলিলপত্র নিয়ে তাতে চোখ বুলায়, বাদামী রঙা পত্রে চোখ বুলাতেই চেঁচিয়ে উঠে বলে,
‘ তালাকনামা! ‘
শেরহাম ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। উত্তর দেয়,
‘ হ্যা। এখানেই সব শেষ। তোদের অধিকার, সাম্রাজ্য সব ফিরিয়ে দিয়েছি। আর তনীকে মুক্তি। দ্বীনদার কারো সাথে ওর নিকাহ দিস। এই কাফের, শয়তান, জা**নোয়ার তোদের জীবন অতিষ্ঠ করতে আর যাবে না। ‘
শেহজাদ বলে উঠে, না, এটা হতে পারে না। তুমি আমাদের মাঝ সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছ। কোথায় যাবে তুমি? আবারও ওই জাদুকরদের কাছে? আবারও ধ্বংসের দিকে? মনুষ্যদের সাথে থাকতে থাকতে দুর্বল হয়ে যাচ্ছ? মায়ায় পড়ে যাচ্ছ? মনে পড়ছে যাদের সাথে শত্রুতা করে এসেছ তারা একসময় তোমার প্রাণের চাইতেও বেশি আপন ছিল? মনে পড়েছে তারা তোমার ভাই? ‘
শেরহাম মুখ ফিরিয়ে রাখে। শেহজাদ এগিয়ে তার পোশাক খামচে ধরে তার দিকে ফিরিয়ে বলে,
‘ উত্তর দাও। উদ্দেশ্য সফল হওয়ার আগে ফিরে যাচ্ছ কেন? এভাবে ভীতুর মতো পালিয়ে যাচ্ছ কেন? ফিরো আমার দিকে। আমাকে ধ্বংস করতে এসে তনীকে ধ্বংস করে চলে যাচ্ছ কেন? আমাকে ধ্বংস করো। আমাকে নিঃস্ব করো। খু–ন করো। রূপনগর দিয়ে দিয়েছি তোমাকে। বন্দি থেকেছি। সবকিছু তোমার হাতে ছেড়ে দিয়েছি। তারপরও পালিয়ে যাচ্ছ কেন? কারো কথায় আঘাত পাওয়ার মতো মানুষ তো তুমি নও। তাহলে কেন পালিয়ে যাচ্ছ? উত্তর দাও। ‘
শেরহাম নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। বলে,
‘ সোহিকে একটা ভালো ছেলের হাতে তুলে দিবি। সময় নেই তোদের সাথে বাজে কথা বলার। পথ ছাড়। ‘
বলেই ঘোড়ার দিকে পা বাড়ালো। শেহজাদ গর্জন করে বলল
‘ বীরের মতো এসে চোরের মতো পালিয়ে যাচ্ছ কেন? আমার সাথে সম্মুখযুদ্ধ বাকি। নাকি ভয় পাচ্ছ নিজের ভাইয়ের বুকে তলোয়ার চালাতে? যা করতে এসেছ তা করে যাও। ‘
শেরহাম ঘোড়ার পিঠে উঠে বসতে যায়। সাফায়াত পথরুদ্ধ করে বলে,
‘ তনীর কথা ভাবুন একবার। ও তো আপনার শত্রু নয়। ওকে কেন এত কষ্ট দিচ্ছেন? ‘
শেরহাম তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। কোনো পিছুটান সে রাখবে না। শেহজাদ তার পথরুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে বলে,
‘ ভাইজান আমি তোমাকে যেত দেব না এভাবে। পরিষ্কার করে বলো কেন তুমি এভাবে পালিয়ে যাচ্ছ? নিজের খোলস ছাড়তে তোমার এত ভয় কেন? ‘
শেরহাম তাকে সরিয়ে দিয়ে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে। তটিনীর গলার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। গাড়ি থেকে নেমে আঁকাবাঁকা পথ ধরে ছুটে আসছে সে। বলে যাচ্ছে,
‘ যেওনা। আমাকে রেখে যেওনা। ‘
শেরহাম একমুহূর্তও বিলম্ব না করে ঘোড়ার লাগাম টান দেয়। টগবগিয়ে ছুটে চলে তার ঘোড়া। শেহজাদ হাঁটুভেঙে বসে গলা ফাটিয়ে ডেকে উঠে,
‘ ভাইজান! একটিবার ফিরে তাকাও। ‘
তটিনী হোঁচট খেয়ে পড়ে সাফায়াতের সামনে। চেঁচিয়ে ডেকে বলে,
‘ তোমার ঔরশের সন্তান আমার গর্ভে। তুমি তাকে রেখে পালিয়ে যাচ্ছ কেন? কাপুরুষ কোথাকার। হাশরের মাঠে তোমাকে মাফ দেব না আমি। ‘
সাফায়াত এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। ভাইকে জড়িয়ে গা দুলিয়ে কেঁদে উঠে সে। সাফায়াতও ক্রন্ধনে কেঁপে উঠে। তটিনী শেরহামের অদৃশ্য হওয়ার দিকে আঙুল তাক করে বলে,
‘ ভাইজান ও শুনতে পায়নি আমার কথা? ‘
গহীন অভয়ারণ্যে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে পড়ে শেরহাম। পাথরে মাথা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে চোখ বুঁজে। সাথে সাথে দুচোখের কোণা বেয়ে বহু বছর পর উত্তপ্ত রক্তঅশ্রু গড়িয়ে পড়ে কানের কাছে গিয়ে ঠেকে। মাথায় একটা শীতল হাতের স্পর্শ পায় সে ঠিক তখুনি।
নানাজান তাকে শান্তির পথে আহ্বান করে। শেরহাম জানায়, একজন জাদুকরের সাথে একজন জাদুকর’ই লড়াই করার ক্ষমতা রাখে। যেখানে তার সৃষ্টি, সেখানেই তার ধ্বংস।
‘আর তুই ওই মেয়েটাকে ভালোবাসিস না? ‘
‘ না। ওসব মনুষ্যদের কাজ। আমি অমানুষ। ‘
‘ আর মেয়েটা যে তোকে ভালোবাসে! ‘
‘ ভুলে যাবে। দীর্ঘ পনের বছর আগে হারিয়ে যাওয়া শেরহাম সুলতানকে যেমন কেউ মনে রাখেনি, এবারও কেউ রাখবে না। ‘
নানাজানের গুহা ত্যাগ করলো সে তারপরের দিন। কয়েকমাস পর কোনো একটা কাজে রূপনগরে আসেন নানাজান। সেই সুবাদে সুলতান মহলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
চলমান..
Ajkr prbo ta choto hoye gese,,,,,, MN vore nai,,,,, 2/3ta prbo eksathe dien plz,,,,,,, r boro boro kore dien,,,,,,, 😁😁😁