#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_২৬
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
তটিনী বালতিটা ছোঁয়ামাত্রই গরম অনুভব করলো। বলল, বালতিটা নিয়ে আমার সাথে আসো। খুব গরম। আমি ধরতে পারছিনা।
শেরহাম এদিকওদিক চোখ বুলাচ্ছিল। তটিনী বলল, ‘ আরেহ নাও। আমার হাত পুড়ে যাবে। এদিকওদিক কি দেখছো? ‘
শেরহাম মহাবিরক্ত হয়ে তাকিয়ে চ কারান্ত শব্দ করে বলল,
‘ কি হয়েছে? ‘
‘ এতক্ষণ কাকে কি বলছিলাম আমি? বালতিটা নিয়ে আমার সাথে আসো। আমি ওদিকে সিন্নি দেব বাচ্চাগুলোকে। ‘
শেরহামের চোখে বিরক্তি ঝড়ে পড়লো। বালতি তুলে নিল সে। তটিনী বড় চামচে তুলে সবার পাতে সিন্নি তুলে দিল। দিতে দিতে সবার দিকে একপলক তাকিয়ে সগর্বে হাসলো। শেরহাম একবার তটিনীকে দেখলো আরেকবার ওদেরকে। সবাইকে তার দিকে তাকাতে দেখে চোখ সরিয়ে নিল। সোহিনী আনন্দে হাসছে। শবনম বলল,
‘ কি ব্যাপার বলোতো? ভাইজান সত্যি সত্যি এল? ‘
সায়রা বলল,
‘ এত খুশি হওয়ার কিছু নেই। মসজিদে প্রবেশ করলে খুশি হতাম। ‘
সোহিনী চুপ করে থাকলো। আয়শা বলল,
‘ ভাইজান বড় আপুর কথায় এল? আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। ‘
সোহিনী বলল,
‘ অবিশ্বাসের কি আছে? সবাই আর আপু কি এক হলো নাকি? ‘
‘ তা ঠিক। আপু তো বউ। ‘
বলেই ফিক করে হেসে উঠলো আয়শা। শবনম ধমকে বলল,
‘ তুমি বড় হবে না আয়শা? কথায় কথায় হাসো। ‘
আয়শা মন খারাপ করে ফেললো।
*****
সিন্নি বিলি শেষে সবাই একসাথে বসে সিন্নি খাচ্ছে। শাহানা তটিনীকে ডেকে বলল,
‘ মেহফিলে মানুষ আসা শুরু করেছে। ওদিকে আর যেওনা। এখানে বসে সিন্নি মুখে দাও। ‘
কলাপাতার মোড়কে সিন্নি হাতে তটিনী শেরহামের কাছে যাচ্ছিলো। আমতাআমতা করে বলল,
‘ এক্ষুণি চলে আসছি আম্মা। যাব আর আসবো। ‘
আশেপাশের নানান মানুষ থাকায় শাহানা রেগে গেলেও কিছু বলতে পারলো না। তটিনী চলে গেল। শেরহামকে দেখতে পেল না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দেখলো সে বড় পুকুরটির দিকে চলে গিয়েছে। পুকুরের ঘাটে বাবুর্চির লোকেদের চাল ডাল ধোঁয়া নিয়ে ব্যস্ততা লক্ষ করা যাচ্ছে। মশলাপাতির তীব্র গন্ধে ম ম করছে চারপাশ। মসজিদের মাইকে দোয়াদরূদ পড়ানো হচ্ছে। শেরহাম একটা লোককে ডেকে কি কি যেন জিজ্ঞেস করছে। তটিনী ডাকতেই সে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো আবারও কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সাফায়াত দূর থেকে তটিনীকে লক্ষ করছে।
তটিনী শেরহামের নিকটে গিয়ে বলল,
‘ এই নাও সিন্নি খাও। খুব মজা হয়েছে। ‘
যার সাথে কথা বলছিলো লোকটা মুচকি হেসে চলে গেল। শেরহাম ধমকে বলল,
‘ কথা বলছি দেখছিস না? ‘
তটিনী নিজেকে শান্ত রাখলো। যদি এই বেয়াদব সবার সামনে তাকে ধমকায় তাহলে সবাই তাকে কথা শোনাবে। সে বলল,
‘ সিন্নি খাওয়ানোর জন্য ডেকেছি। নাও। ‘
বলতে বলতে সে বাড়িয়ে দিল। শেরহাম উপায়ান্তর না দেখে খেল। খেতে খেতে ঠোঁটের আশপাশ মুছে এদিকওদিক তাকানো শুরু করলো পুনরায়। ওই শু**য়োরের বাচ্চাগুলো কোনদিকে গিয়েছে কে জানে!
তটিনী নিজেও খেতে খেতে বলল,
‘ আজকে তুমি মেহফিলে উপস্থিত থাকবে ঠিক আছে? ‘
শেরহাম চোখ সরু করে চাইলো। তটিনী হাসিহাসি মুখ করে বলল,
‘ একদিন বসলে কিছু হবে না। ‘
শেরহাম তার কথায় পাত্তা না দিয়ে ফের এদিকওদিক তাকানো শুরু করলো। তটিনী জিজ্ঞেস করলো
‘ কি খুঁজছো? আমার প্রশ্নের জবাব দাও। আজব!’
শেরহাম বলল,
‘ তুই ওদের কাছে যাহ। এখানে ঘুরঘুর করবি না। ‘
তটিনী মন খারাপ করে বলল,
‘ মসজিদে…
শেরহাম তাকে বলতে না দিয়ে কাঠকাঠ গলায় বলল,
‘ ভালোভাবে বললে কথা কানে ঢুকেনা তোর? অসহ্য। ‘
‘ আমি অসহ্য? ‘
‘ তো কি? তোকে যেতে বলেছি যাচ্ছিস না কেন?’
তটিনী রেগেমেগে বলল,
‘ তুমি অসহ্য। আমি সহ্য করছি তাই আমাকে মাথায় তুলে রাখা উচিত তোমার। ‘
‘ আয়। মাথায় তুলবো। ‘
‘ ধ্যাত। ‘
হনহনিয়ে হাঁটা ধরলো তটিনী। শেরহাম তার পিছুপিছু কিছুদূর গেল। আশপাশেই ঘুরঘুর করে খু্ঁজতে লাগলো। দলেদলে লোকজন আসছে মসজিদে। এত মানুষের ভীড়ে ওই শু**য়োরের বাচ্চাগুলো যদি ঢুকে যায় সে বুঝবে কি করে? হাতের কাছে পেলে আজ মুন্ডু আলাদা করে দেবে। শেহজাদ দূর থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কাকে খুঁজছেন উনি?
****
তটিনী যেতেই সবাই কথা থামিয়ে তার দিকে তাকালো। মরিয়ম সিন্নি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ তোমার বর খেয়েছে?’
তটিনী মাথা নাড়লো। শাহানা বলল,
‘ ওকে এখানে ডেকে এনে কি প্রমাণ করতে চাইছো তুমি? ‘
‘ আমি চেয়েছি ও এখানে আসুক। ‘
‘ এসে কি হলো? সে কি আল্লাহ’কে মানে? তার ঈমান আছে যে তুমি তাকে মসজিদে ডেকেছ? ‘
‘ আজ দুয়ারে এল। কাল মসজিদে ঢুকবে। বাড়িতে আসতে হলে তো উঠোনে আসতে হবে তাই না আম্মা? আজ দুয়ারে এনেছি, কাল মসজিদে প্রবেশ করাবোই। ‘
‘ তুমি কি মনে করছো ও মসজিদে এলেই ওর সব দোষ মাফ হয়ে যাবে? এতএত মানুষের প্রাণ গেল তার জন্য, সেসব? এত মানুষকে ঠকালো, ডাকাতি করতে গিয়ে এত এত মানুষ মারলো, তার বেলা? সব খুন মাফ? ও যে এতবড় কুফরী করে বেড়ায়? তাদের জায়গা তো জাহান্নামেও হবে না। কোনো অনুতাপ দেখেছ আজ পর্যন্ত ওরমধ্যে? নিজের মধ্যে হেদায়েত না আসলে তুমি পারবে ওকে ঠিক করতে? নিকাহ হয়েছে বলে ওর সব ভুলত্রুটি ক্ষমা করে সংসারধর্ম পালন করতে হবে এমন কোনো কথা আছে? কিছুদিন পর দেখা যাবে তোমাকে লাতি মেরে চলে যাবে। খুঁজেও পাবেনা তুমি। তখন কি করবে? তুমি কি ফেলনা যে ওর সব অপরাধ জানা স্বত্বেও ওর সাথে সংসার করে যেতে হবে! তুমি কি ভুলে গিয়েছ কিভাবে কেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ও তোমাকে নিকাহ করেছে? তুমি তো এমন ছিলে না। ওর কাছ থেকে মু্ক্তির জন্য ছটপট করছিলে? কি করেছে ও তোমাকে?
তটিনীর চোখদুটো কানায় কানায় ভরে উঠলো। হামিদা তাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে মাথাটা কাঁধে ফেলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল’ মেয়েকে এভাবে কেন বলছেন আপা? ‘
‘ তো কিভাবে বলব? সে যে নিকাহ করলো এটাও কি হালাল হয়েছে যে তার সাথে সংসার করছে? একসাথে থাকছে। সে কি কালেমা মানে? কালেমা বিশ্বাস করে? বিশ্বাস না করলে কবুল কি হালাল হয়েছে? ও কি খুকী যে ওকে সব বুঝাতে হবে আমাকে? ও পড়াশোনা জানা মেয়ে, সবদিক দিয়ে শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে মানুষ করেছি। ও কি জানেনা ও স্বয়ং নিজের খোদাতায়ালার সাথে নাফরমানি করছে! ‘
সোহিনী বলে উঠলো, ‘ সবাই মিলে ভাইজানকে এরকম বানিয়েছ। কেউ ভাইজানের ভালো চাক সেটা তোমাদের সহ্য হয় না। ‘
খোদেজা বলল,
‘ সোহি এসব কেমন কথা বললে তুমি? ‘
‘ আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি। মানলাম ভাইজান অনেক পাপী। তাই বলে তার সাথে সংসার করা যাবে না? শতশত মানুষ যে মদগাজা খেয়ে বউ পেটায় তাদের বউরা তাদের সাথে সংসার করছে না? ভাইজান কি আপুকে মারছে নাকি ধুর ছাই করে ফেলে রেখেছে? ‘
তটিনী কাঁদতে লাগলো। হামিদা তাকে শান্ত হতে বলছে।
সোহিনীর কথায় স্তব্ধ সকলে। অপরূপা এসে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করলো। তটিনীকে কাঁদতে দেখে সকলের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বুঝতে পারলো শেরহাম সুলতানকে ঘিরে কোনো কথা হচ্ছিল। খোদেজা তাকে দেখে বলল,
‘ তুমি বাইরে এত ঘনঘন কি করছো? ‘
অপরূপা দুপাশে মাথা নেড়ে বলল,
‘ কই! তেমন কিছু না। ‘
_____
শেরহাম মহিলাদের নামাজ কক্ষের দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়েছিল। ভাগ ভাগ হয়ে একত্রে মোটা কালো কাপড়ের বোরকা পরিহিত কয়েকজন মহিলা হাঁটাহাঁটি করছে। ওযুখানা হতে এসে দু’জন মহিলাদের নামাজ কক্ষে প্রবেশও করলো। শেরহাম তাদের নজর রেখেছে। পায়চারি করতে করতে কিছুদূর এগিয়েও গেল। তটিনী বাইরে উঁকি দিয়ে তাকে দেখে ভীষণ খুশি হলো। মায়ের বকুনিঝকুনি খেয়ে কান্নাভেজা মুখটা আড়াল করে একটুখানি হাসলো।
চাদরের আড়ালে শেরহামের হাতের মুঠোয় ধারালো খঞ্জর লুকোনো। শেহজাদ তাকে নজরে নজরে রেখেছিল অনেকক্ষণ । যখন নিশ্চিত হলো সে মেহফিল শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছে তখন আর এগোয়নি।
অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর শেরহাম নিশ্চিত হলো তার সন্দেহই ঠিক। নামাজ কক্ষের বাইরে যারা দাঁড়িয়ে আছে তারাই জাদুকর। তাদের উঁকিঝুঁকি দেয়া দেখে সে নিশ্চিত হলো। তার দিকে বারংবার তাকানো হাঁটাচলা মোটেও সুবিধার নয়। শেহজাদের সৈন্য যারা এসেছিল সকলেই মেহফিলে বসেছে। শেরহাম নামাজ কক্ষের দিকে এগিয়ে গেল। তাকে এগোতে দেখে যারা বাইরে ছিল তাদের মধ্যে দু’জন অন্যদিকে হেঁটে চলে গেল। আর তিনজন কক্ষে প্রবেশ করলো। শুধুই প্রবেশ করেনি ঢুকামাত্রই দরজা বন্ধ করে দিচ্ছিলো। শেরহাম বাজখাঁই গলায় চিৎকার দিয়ে উঠলো,
‘ এই সাবধান! খবরদার দরজা বন্ধ করবি না। ‘
খোদেজা, শাহানা, তটিনী, অপরূপা সকলেই স্তব্ধ। তিন’ চারজন বোরকা পড়া ছদ্মবেশী নামাজরত অবস্থায় ছিল।
শেরহামের গলার আওয়াজ শুনে নাটকীয়তা ছেড়ে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। তটিনী শবনম সায়রা সোহিনীর গলায় চাকু ধরলো। শেরহাম ততক্ষণে দরজা বন্ধ করতে চাওয়া লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে খঞ্জর বসাতে গিয়েছে। বোনদের কান্নাকাটি শুনে কলার চেপে তুলে দাঁড় করিয়ে বলল,
‘ ওদের ছাড়। আমি কি করতে পারি ভাবতেও পারছিস না তোরা। ‘
আয়শাকে নিয়ে অপরূপা পিছিয়ে গিয়েছে। মরিয়ম ভীতু হয়ে কাঁপছে। তাকে হাদিস পড়িয়ে শোনাচ্ছিলো খোদেজা। শাহানা বলল,
‘ মেয়েদের ছেড়ে আমাদের ধরো। ওদের ছেড়ে দাও। ‘
জাদুকরেরা হাসতে লাগলো।
অপরূপা আশেপাশে চোখ বুলালো। মাটির কলস রয়েছে দুটো। অন্যদিকে একটা ফুলের মাটির টব। আয়শাকে কাঁদতে বারণ করলো সে। শিখিয়ে দিল কি করতে হবে।
শেরহাম গর্জে বলল,
‘ কেন এসেছিস এখানে শু**য়োরোর বাচ্চা। ‘
তার হাতের চাকুর নীচে থাকা জাদুকরটি হাঁপাচ্ছে। চোখের পলকেই গলার র**গে খ্যাঁচ করে খঞ্জর লাগিয়ে দিতেই দরজা ঠেলে শেহজাদ, সাফায়াত আর বাবা জেঠুরাও চলে এলেন। রক্ত ছলকে কক্ষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো। লোকটা ধপাস করে পড়ে গিয়ে তড়পাতে তড়পাতে সেখানে মারা গেল।
শেহজাদ খাপ থেকে তলোয়ার বের করে বাকিদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
‘ একজনের গায়ে যদি আঘাত করেছ বেঁচে ফিরবে না। বাঁচতো চাইলে ওদের ছাড়ো। ‘
সায়রা সোহিনীকে ছেড়ে দিয়ে ওই দু’জন অপরূপার কাছে ছুটে গেল। অপরূপা কলস তুলে তাদের মাথা বরাবর ছুঁড়ে মারলো আর তক্ষুনি মাথায় হাত চেপে তার দিকে পুনরায় এগিয়ে এল দুজন। শেহজাদের হাত থেকে তলোয়ার ছুটে এল অপরূপার দিকে অপরূপা সেটি ধরে বাড়িয়ে রেখে বলল,
‘ খবরদার। যেখানে আছো সেখানে থাকো। ‘
আয়শা টব তুলে বেশ জোরেই ছুঁড়ে মারলো। যার মাথায় পড়লো সে ঢলে পড়লো। তার মাথা ফেটে গিয়েছে। তার গোঙানির শব্দে ভয় পেয়ে গেল আয়শা। অপরজনের গলার কাছে তলোয়ার তাক করলো অপরূপা। তাদের হাত থেকে পড়ে যাওয়া খঞ্জর তুলে আয়শা লোকটার পিঠের লাগিয়ে বলল,
‘ খঞ্জর ফেলে দাও। নইলে দুদিক থেকে আক্রমণ হবে। ‘
সাফায়াত এগিয়ে এসে লাতি দিয়ে তাকে ফেলে দিল। লাতি দিতে দিতে আধমরা করে ফেললো।
অপরদিকে তটিনী আর সোহিনীকে ধরে রাখা দু’জন পিছিয়ে গেল ক্রমশ। তাদের ভয় বেড়েছে। শেরহাম বলল,
‘ এই ওদের ছাড়। ছাড়তে বলেছি। ছাড় আর প্রাণ নিয়ে পালা। ‘
তারা বলল দরজার পথ ছেড়ে দিতে।
শেরহাম পথ ছেড়ে দাঁড়ালো। তারা অতি সাবধানে তটিনী আর সোহিনীকে নিয়ে পিছু হাঁটা শুরু করলো। তটিনী আর সোহিনী বিপদ আশঙ্কা করে ধস্তাধস্তি শুরু করলো। আর দুজনের কাঁধে খঞ্জর চালিয়ে পালিয়ে গেল তারা। পালাতে পারলো কোথায়? শেহজাদের সৈন্যদের হাতে গিয়ে বন্দি হলো তখুনি। তটিনী আর সোহিনী লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। শেরহাম ছুটে গিয়ে প্রচন্ড আক্রোশে গর্জন করে সোহিনীর মাথা তার কোলে তুলে নিয়ে বলল,
‘ এই গাড়ি নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি। ‘
সোহিনী বড় বড় শ্বাস ফেলছে। সাফায়াত তটিনীর মাথা তার কোলে নিতেই তটিনী কেঁদে উঠে তীর্যক দৃষ্টিতে শেরহামের দিকে তাকিয়ে চোখ নিভিয়ে নিল। শেরহাম সোহিনীর মাথা রেখে বলল,
‘ গাড়ি কোথায়? তাড়াতাড়ি গাড়ি আন। আর এই দুই শুয়ো*রকে জীবন্ত রাখ। এদের আমি জীবন্ত কবর দেব? খবরদার কেউ ওদের গায়ে হাত দিবিনা। এদের জীবন্ত কবর দিয়েই ছাড়বো আমি।’
গাড়ি চলে এল। সোহিনীকে কোলে করে নিয়ে গাড়িতে তুললো শেহজাদ। তটিনীকে সাফায়াত তুললো। অঝোরে কেঁদে চলেছে মা বোনেরা সকলে। সিভানকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে সায়রা। সে কাঁপছে তটিনী আর সোহিনীকে দেখে। দুজনের রক্তে শেহজাদ আর সাফায়াতের পাঞ্জাবি রক্তাক্ত। ঘোড়ার গাড়ি ছেড়ে দিতেই শেরহাম দূরে খঞ্জর ছুঁড়ে মেরে চোখ চেপে গর্জন করে উঠলো সশব্দে। আশেপাশের সকলেই কেঁপে উঠলো। মেহফিল মানুষজন আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে গেল একপ্রকার। সবকিছু সেখানেই স্থগিত।
কয়েকজন মিলে মৃত জাদুকরটিকে বের করে আনলো। আধমরা দুজনকে বের করে আনতেই শেরহাম চোখা দৃষ্টিতে তাকালো তাদের দিকে। আদেশ দিল কবর খুঁড়তে। এদের দুজন,আর ওদের দুজনকে একসাথে কবর দেবে সে।
শেরতাজ সাহেব এগিয়ে এসে কষে চড় বসালো তার গালে। একটা দুটো তিনটা। অপরূপা এসে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল,
‘ এখন এসব করার সময়? ওদিকে ওদের কি অবস্থা আল্লাহ জানেন। আপনারা শান্ত হতে পারছেন না? সবাই মিলে একসাথে পাগলামি শুরু করেছেন। ‘
‘ সব ওরজন্য হচ্ছে। ও সব অশান্তি টেনে নিয়ে এসেছে। সবাইকে মারবে বলে এসেছে। এখন শান্তি হয়েছ তুমি? আমাদের মুক্তি কখন দেবে তুমি? আমরা মরে গেলে? ‘
শাহানা বলল,
‘ আমি তোমার কাছ থেকে মুক্তিভিক্ষা চাইছি। তুমি তনীকে ছেড়ে দাও। এসব আমি আর নিতে পারছিনা। ওদের যদি কিছু হয় তোমাকে আমি ছাড়বো না শেরহাম। তুমি আমার মেয়ের জীবনটা শেষ করে দিলে। ও কি সারাজীবন তোমার অপকর্মের ফল বয়ে বেড়াবে? আমাদের সাথে করছো ঠিক আছে কিন্তু মেয়েটা তোমার কি দোষ করেছে? তোমার মা শেহজাদের ছয় ছয়টা ভাইবোনদের মেরেছে। তুমি কয়জনকে মারবে বলে পণ করেছ? ‘
শেরহামের চোখজোড়ায় আগুন জ্বলতে থাকে। পুড়তে থাকে বুকের ভেতরটাও। হাতের মুঠো শক্ত করে আধমরা দুজনের দিকে এগিয়ে যায় সে। সৈন্যদের হাতে তুলে দিয়ে বলে, সামাদকে গিয়ে বল এদের জন্য কবর খুঁড়তে। যাহ। ‘
শেহজাদের সৈন্যরা তাদের নিয়ে চলে গেল। কাশীম মহলের সবাইকে ঘোড়ার গাড়িতে তুলে দিল। সকলেই হাসপাতালে যাবে।
তারা যাওয়ার পর শেরহাম তার পিঠে চড়ে বসলো। মহলে ফিরে তারপর সৈন্যদের নিয়ে ডাকাত ঘাঁটিতে গিয়ে দেখতে পেল তার পাশেই কবর খোঁড়ার কাজ চলছে। সেবার এক জাদুকর বিরোধিতা করে তাকে প্রাণে মারার ষড়যন্ত্র করেছিল। এমনকি খঞ্জর প্রায় বুকের উপর চালিয়ে দিতে গিয়েছিল ক্রোধের বশবতী হয়ে।
তাকে আধমরা করে মাটির নীচে চাপা দিয়েছিল সে। ভারী নিঃশ্বাসের শব্দে কবরের কাঁচা মাটি পর্যন্ত দুলে উঠেছিল। শেরহামের অগোচরে চন্দ্রলাল তাকে তুলে পাঠিয়ে দিয়েছিল ডাকাত আস্তানায়। এখনো সে দৃশ্য মনে করে সামাদ আর মুরাদ কেঁপে উঠে। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে তারা ঘেমে উঠে প্রায়। শেরহাম চেয়ে থাকে। হিংস্র শ্বাপদের ন্যায় শক্ত মুখাবয়বে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন না দেখে মাটি খুঁড়তেই থাকে তারা। মাটি খোঁড়া শেষে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সৈন্যরা সকলে। শেরহাম তার মত পরিবর্তন করে বলে,
‘ এদের মাটির নীচে পুঁতে দে। শুধু মাথাটা যেন মাটির উপরে থাকে। এদের দেখে সবাই শিক্ষা নেবে আমার সাথে লাগতে আসলে কি পরিণতি হয়। ‘
সৈন্যরা তাই করলো। যারা আহত ছিল তাদের মাথা মাটির উপরে হেলে রইলো। যারা জীবিত ছিল তাদের হাত পা বেঁধে মাটি দিয়ে গলা অব্দি ঢেকে দিল সবাই। তারা চিৎকার করে ক্ষমা চাইতে লাগলো। জীবনভিক্ষা চাইলো। শেরহাম শুনলো না। হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। হাসপাতালের প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে গেল তাকে দেখে।
রুদ্রমূর্তি ধারণ করে শেরহাম গ্রিল ধরে গর্জে বলল,
‘ এই শেরতাজ সুলতান এই গ্রিল খুলতে আমার সময় লাগবে না। ভালোই ভালোই বলছি। খুলতে বলো। ‘
শেরতাজ সাহেব কাশীমকে বলল
‘ একে কেউ ঢুকতে দেবে না। তুমি ওদের সাথে দেখা করবে না। তুমি ঢাকঢোল পিটাও খুশিতে। তোমার উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে। ‘
শেরহাম হাসপাতালের দারোয়ানদের বলল,
‘ খুলে দে বলছি। নইলে সবার অবস্থা খারাপ করে দেব। ‘
কেউ খুললো না। তবে ভোররাতে সবাই যখন বারান্দার মেঝেতে বসে ঘুমে ঢুলে পড়েছিল তখন পুরুষালি পদধ্বনি শুনে চোখ মেললো সিভান। দেখলো বড়ভাইজান আপুদের কেবিনকক্ষে প্রবেশ করছে। সোহিনীর কেবিনকক্ষে প্রবেশ করে বোনের দিকে এগিয়ে গেল শেরহাম । কম্পমান হাত বোনের মাথায় ছুঁয়ে দিল।
তারপর একমুহূর্তও না দাঁড়িয়ে তটিনীর কক্ষে গেল। তটিনীর চোখবন্ধ। শম্বুকগতিতে তটিনীর কাছে গিয়ে বসলো। ধীরেধীরে তটিনীর হাতটা আলগোছে তুলে নিল দু’হাতের মুঠোয়। হাতের তালুতে নিজের চোখজোড়া চেপে হাতটা নামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল। হাসপাতাল ত্যাগ করলো। শেহজাদ ফজরের আজান শুনে চোখ খুলে বাইরে এসে দেখলো হাসপাতালের দারোয়ানগুলো গ্রিলে পিঠ লাগিয়ে বেকায়দায় পড়ে আছে। সাফায়াত আর সে ডাকাডাকি করতেই তারা চোখ মেললো। জানালো শেরহাম সুলতান তাদের ছলেবলে কাছে ডেকে কি যেন ছুঁড়ে মেরেছিলেন তারপর কি হয়েছে তারা জানেনা।
শেহজাদ আর সাফায়াত মহলে ফিরলো। শেরহাম সেখানে নেই। কাশীম জানালো ডাকাত ঘাঁটির পাশে ওই জাদুকরগুলোকে গলা অব্দিমাটির মধ্যে পুঁতে রাখা হয়েছে। তা দেখার জন্য হাজার-হাজার মানুষ জড়ো হয়েছে সেখানে। শেহজাদ সেখানে উপস্থিত হলো। কেউ ভয়ে এগোচ্ছে না সেদিকে। পানি খুঁজছিলো তারা। শেহজাদ গিয়ে পানি দিল। পানি পেয়ে তৃষ্ণা মিটিয়ে চোখ মেলে তাকালো তারা। প্রাণ ভিক্ষা চাইলো। শেহজাদ প্রাণ ভিক্ষা দিল শর্তের বিনিময়ে।
____________
মাথার শিয়রের কাছে একজন ডাক্তারকে দেখে চোখ পুরোপুরি মেললো তটিনী। ডাক্তারটাকে চিনতে স্বস্তি পেল। তাঈফ কাষ্ঠ হেসে বলল,
‘ আপনি মা হতে যাচ্ছেন এটা কি জানেন? ‘
তটিনী ভড়কে গেল। বলল,
‘ কে বলেছে আপনাকে? ‘
‘ একজন ডাক্তারকে এসব প্রশ্ন করাটা কতটা যুক্তিসঙ্গত? ‘
তটিনী ভয়ার্ত গলায় বলল,
‘ আপনি বলে দিয়েছেন? ‘
‘ না। জানাতে যাচ্ছিলাম কিন্তু প্রথমেই আপনাকে জানালাম। যাই খুশির খবরটা দিয়ে আসি। ‘
তটিনী ক্ষীণস্বরে চেঁচিয়ে বলল,
‘ ওহ আল্লাহ! না না। আমি এখনো বাচ্চার বাবাকে বলিনি। কাউকে বলবেন না দয়া করে। হাতজোড় করছি কাউকে বলবেন না। ‘
তাঈফ ঠোঁট উল্টে বলল, ‘ অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপার আপনাদের মহলের। মা হওয়ার খবর মানুষ চেপে রাখে এই প্রথম দেখলাম। যাইহোক আপনি বিশ্রামে থাকুন। ঘাড় নাড়াবেন না। ‘
তটিনী চোখ বুঁজলো পুনরায়। ভাবলো ‘সে’ যদি তাকে দেখার জন্য আসে তাহলে জানিয়ে দেবে সে মা হতে যাচ্ছে।
_____
মাথার উপর খটখট শব্দ হতে দেখে সোহিনী বিরক্ত হয়ে ডাক্তারটাকে উদ্দেশ্য করে বলল ‘ আমার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। আপনি একটু থামবেন? ‘
তাঈফ ঘাড় ঘুরিয়ে যন্ত্রপাতি নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়ে বলল,
‘ থামলাম। ‘
সোহিনী কপাল ভাঁজ করে বলল,
‘ বাইরে আমার পরিবারের কেউ আছে? ‘
‘ না নেই। ‘
‘ কি দরকার? ‘
‘ কিছু না। ‘
তাঈফ নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। একজন পৌঢ় ডাক্তার এসে সোহিনীকে দেখে গেল। সোহিনীর পানি তেষ্টা পেয়েছে। তাঈফ তাকে হাঁসফাঁস করতে দেখে বলল,
‘ আপনি কি তৃষ্ণার্ত? ‘
সোহিনী মাথা দোলালো। তাঈফ পানি এনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ পানি চাইতে এত লজ্জা কিসের? আপনার নাম কি শবনম?’
সোহিনী পানি খেয়ে ভুরু কুঁচকে তাকালো। বলল,
‘ আপনি শবনমকে দিয়ে কি করবেন? ‘
‘ এটা কেমন ধরণের কথা? ‘
‘ না, শবনমের খোঁজ কেন নিচ্ছেন তাই জানতে চাচ্ছি। ‘
‘ শবনম নামক কারো সাথে আমার নিকাহ ঠিক করেছেন চাচা। তাই জানতে চাচ্ছি। ‘
সোহিনী কপাল ভাঁজ করলো। অবাককন্ঠে জানতে চাইলো,
‘ কখন হয়েছে এসব? সত্যি! ‘
তাঈফ ভড়কে গিয়ে বলল,
‘ দেখুন আমি কিছু বলিনি চাচাজানকে। উনি আর ছোটমা মিলে এসব পরিকল্পনা করেছে। আমি আপনাকে পছন্দ-টছন্দ করি এসব একবারও বলিনি। ‘
‘ পছন্দ করেন মানে? ‘
‘ মানে কিছু না। আপনি রাজী না থাকলে নিকাহ হবে না। আমি ফিরে আসছি। বিশ্রামে থাকুন।
সোহিনী মহাবিরক্ত। এই লোক কি তাকে শবনম ভেবে নিয়েছে। আজব লোক তো!
দুপুরে শাহানা, হামিদা এল খাবার নিয়ে। তটিনী জিজ্ঞেস করলো,
‘ আমি কখন মহলে যাব আম্মা? ‘
‘ যাবে। ‘
‘ আজকে নিয়ে যাও। ‘
‘ বাড়াবাড়ি করো না। আরেকটু হলে রগ কেটে যেত। আল্লাহ বাঁচিয়েছে। নিজের চিন্তা করো এবার। ‘
তটিনী চুপ করে রইলো। হামিদা সোহিনীকে খাইয়ে তার পাশে এসে বসে বলল,
‘ এই যাত্রায় বেঁচে ফিরেছ। শুকরিয়া আদায় করো। তোমাকে কাল নিয়ে যাব। ‘
তটিনী দরজার দিকে তাকিয়ে হামিদার হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো, ‘ ও মহলে নেই? আসেনি কেন? ‘
হামিদা জানালো শেরহাম মহলে ফেরেনি কালকের পর থেকে। শোনা গেছে সে সবকিছু শেহজাদকে বুঝিয়ে দিয়ে মহল ছেড়ে দেবে।
তটিনী বলল, ‘ আমি আজকেই মহলে ফিরবো। একমুহূর্তও থাকবো না। ‘
তার জেদ থেকে শাহানাও জেদ করে বলল,
‘ তোমাকে নিয়ে যাব না। কালকে যাবে তুমি। ‘
তটিনী কাঁদলেও কেউ শুনলো না। তারপরের দিন মহলে ফিরিয়ে আনা হলো তাদের। তটিনী কক্ষে গিয়ে দেখলো শেরহামের একটা জিনিসও কক্ষে নেই শুধু একটি চাদর ছাড়া। সে চাদরটি জড়িয়ে কেঁদে উঠলো।
চলমান….