#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_২৫
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
হাসপাতালে নিয়ে আসা হলেও ডাক্তার কড়া আদেশ দিয়েছেন বিশ্রামে থাকতে। এখন কোনো প্রকার যুদ্ধ বিগ্রহে জড়ানো যাবে না। নিয়মিত ঔষধ খাওয়া আর ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে ঔষধ লাগানোতে অনিয়ম করতে বারণ করেছেন।
শেহজাদ সব ঠিকঠাক ভাবে করবে বলে চলে এসেছে। তাছাড়া তার যত্ন করার মানুষের অভাব নেই। কাশিমও চলে এসেছে তাদের সাথে। বাকিরা এখনো চিকিৎসাধীন অবস্থায়।
শেহজাদ সাফায়াত মহলে ফিরে কিছু মিষ্টান্ন ভোজন করে কামীলের কবরস্থানে চলে গেল। জেয়ারত করে কবরের মাটিতে হাত বুলিয়ে কাশিমের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল তার কঠিন চোখদুটোতে জল টলমল করছে। শেহজাদ মোনাজাত শেষে তাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরতেই সে হাঁটুভেঙে বসে পড়লো। শেহজাদ আর্তস্বরে অপরাধী সুরে বলল,
‘ আমি তোমার ভাইয়ের প্রাণ বাঁচাতে পারিনি কাশীম। আমায় ক্ষমা করো। আমার জন্য তার প্রাণ গিয়েছে। ‘
কাশীম উর্ধ্বগগনে তাকাতেই চোখের জল চোখ’ই শুঁষে নিল। বলল,
‘ আমরা পণ নিয়েছিলাম আপনার ঢাল হয়ে থাকবো। কামীল তার কথা রেখেছে। আমিও শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাব। ‘
সাফায়াত বলল,
‘ আল্লাহ তাকে জান্নাত নসীব করুক। সাওয়াব বখশিশ করে দাও কাশীম। আজ ওর ফাতেহা। আমরা তার জন্য দোয়া করব। ‘
কাশীম শান্ত হলো। শেহজাদ কবরের মাটিতে হাত বুলিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করলো,
‘ আমায় ক্ষমা করো বন্ধু। ‘
মহলে ফিরে এসে দেখতে পেল প্রাঙ্গনে সিন্নি রান্নার কাজকর্ম চলছে। মসজিদে বিরিয়ানি রান্নার সরঞ্জামপাতি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সিন্নি বিলি হবে মেহফিল শুরু আগে। বিরিয়ানি রাতে মেহফিল শেষ হওয়ার পর।
পুরো মহল পরিষ্কার ধোয়ামোছার কাজ দুপুরেই শেষ হয়েছে। শেরহামের কোনে বিধিনিষেধ না দেখে সকলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। কিন্তু শঙ্কা গেল না। শেহজাদ মহলে ফেরার পর একটুও বসেনি। শেরহাম মহলে নেই। ডাকাতের ঘাঁটিতে গিয়েছে। শেহজাদও সেই পথে গিয়েছে। গিয়ে দেখতে পেল বেশ মজবুত করে কয়েকটা কর্মী ঘাঁটি বাঁধার কাজ করছে। তাদের পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করানো হচ্ছে। শেহজাদকে দেখে চোখ নত করে কুর্নিশ জানিয়ে নিজেদের কাজ করতে লাগলো। শেরহাম তাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। সাফায়াত বলল,
‘ তনী বলেছে ভাইজান নাকি ওদের শর্ত মেনে নিয়েছে আমাদের ছাড়িয়ে আনার জন্য। বুঝতে পারছেন বিষয়টা?’
‘ পারছি। শেরহাম সুলতানের অন্য রূপ। ভীষণ আজব মানুষ তিনি। তবে এতদিনে এটুকু বুঝেছি উনি বড়মার মতো ধ্বংস করতে চাননি, রাজত্ব করতে চেয়েছেন রাজার মতো। যা উনি আমার জন্য পারেননি। ‘
‘ আপনি নিজেকে দায়ী করছেন না তো? ‘
‘ নাহ। পরিস্থিতি অমন হয়ে গিয়েছিল দাদাজানের কি করার ছিল! ভাইজান তো বরাবরের মতো অবুঝ ছিলেন। আজও রয়ে গেলেন ওভাবে। প্রতিহিংসা উনার চোখ ঢেকে দিয়েছে। উনি নিজের ভাইকে দেখছেন না, দেখছেন উনার প্রতিদ্বন্ধীকে। এরজন্য উনার একপাক্ষিক দোষ দিলেও চলে না। সবার আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। উনি বরাবরের মতো একরোখা, জেদি, বদমেজাজি ছিলেন। এখনও তেমন আছেন। উনি নিজেকে নিজেই দেখতে পাননা। নইলে নিজের মানুষদের প্রতি অতটা রোষ রাখতে পারতেন না। উনি কি চান তা যদি জানতে পারতাম! ‘
আফসোসের সুরে বলল শেহজাদ।
শেরহাম তাদের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
‘ এখানে কি? যাহ এখান থেকে। আবার মরতে এসেছিস নাকি?’
শেহজাদ চেয়ে থাকে। সাফায়াত বলে,
‘ আপনি আমাদের উদ্ধার করেছেন কেন? ‘
‘ কারণ তোদের মৃত্যু আমার হাতে। এখন মাথা খারাপ করিস না তো ভাই। যাহ সামনে থেকে। ‘
শেহজাদ বলল,
‘ তাই বলে ডাকাতরা দিনের পর দিন এখানে থাকা শুরু করবে? ‘
‘ হ্যা থাকবে। তোদের কি সমস্যা? এই নগর আমার। কে থাকবে কে দূর হবে তা আমি ঠিক করব। ‘
‘ ওরা গেঁড়ে বসার আগেই তুমি তাদের ফেরত যেতে বলো। নইলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। তুমি নিজেও আফসোস করবে। ‘
শেরহাম চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে বলল,
‘ এই দূর হ চোখের সামনে থেকে। যাহ। যেতে বলেছি। ‘
বলতে বলতে শেহজাদকে ধাক্কা মারলো। শেহজাদ দাঁড়িয়ে থেকে ওর হাত খপ করে ধরে বলল,
‘ যাচ্ছি। কিন্তু বলে যাচ্ছি তোমার অনেক আফসোস হবে ভাইজান। ‘
শেরহাম রক্তচোখে চেয়ে রইলো। শেহজাদ আর সাফায়াত চলে এল মহলে।
শেরহামও চলে এল তাদের পিছুপিছু। এসে দেখলো মহলে রমরমা পরিবেশ। সকলের চোখেমুখে আনন্দ উপচে পড়ছে। নতুন জামাকাপড় নিয়ে সকলেই ছোটাছুটি করছে। আগরবাতির গন্ধে ম ম করছে সারামহল। শেহজাদকে ঘিরে সকলেই তাদের নতুন জামাকাপড় দেখাচ্ছে। সবার মধ্যিখানে সিভান। তটিনী দাঁড়িয়ে সবার খুনসুটি দেখছিলো। শেরহামকে দেখতে পেল সে। একঝলক সবার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ হেঁটে নিজের কক্ষের দিকে পা বাড়ালো সে। তটিনীর মন খারাপ হলো। এত এত হৈচৈ আনন্দমুখর পরিবেশে এই মানুষটি যে ভীষণ একা তার নিজের দোষে তা ভাবতেই তার বুক ভার হয়ে আসে।
খচখচ করা সাদা পাঞ্জাবির প্যাকেট হতে একে একে পাঞ্জাবি বের করছিলো খোদেজা। সিভান তার পাঞ্জাবি টুপি নিয়ে আর পাঞ্জাবির মাফলার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খোদেজা অপরূপাকে শেহজাদেরটা দিল, সায়রাকে সাফায়াতেরটা। মফিজ আর আরও কয়েকজনেরটা মতিবানু আর ফুলকলিকে বুঝিয়ে দিয়ে শাহজাহান সাহেব আর শেরতাজ সাহেবের জন্যও রেখে দিলেন। আরেকটা বাকি ছিল। তটিনী আগ বাড়িয়ে এসে সেটা খপ করে হাতে তুলে নিতেই সকলেই অবাক চোখে তাকালো। শাহানা কপাল ভাঁজ করে বলল,
‘ তুমি পাঞ্জাবি দিয়ে কি করবে? ‘
তটিনী বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেল। আমতাআমতা করে বলল,
‘ ওর জন্য নিয়েছি। ‘
সকলেই আশ্চর্য হয়ে তাকালো। শাহানা কটাক্ষ করে বলল,
‘ যারা মেহফিলে যাবে মহল থেকে তাদের জন্য পাঞ্জাবির ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেহফিলে যাবেনা অমন ব্যক্তির জন্য নয়। ‘
তটিনী বলে উঠলো,
‘ ও যাবে আমার সাথে। আমি ওকে নিয়ে যাব। ‘
সকলেই কেমন কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। শাহানা বলল,
‘ তুমি কি মজা করছো? ‘
‘ ও না গেলে তখন কথা শুনিও আম্মা। ও কি ছোটবেলায় মসজিদে যায়নি? এত অবাক হওয়ার কি আছে? ‘
সকলেই একে অপরের দিকে তাকালো। তটিনী কক্ষে গিয়ে পাঞ্জাবি রেখে দিয়ে বলল,
‘ এই আসো আমার সাথে। ‘
শেরহাম ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। শেরহাম কোকেন দিয়ে কি যেন করছিলো। তটিনী চেঁচিয়ে বলল,
‘ আসতে বলেছি। ‘
শেরহাম খ্যাঁক করে উঠে বলল,
‘ কোথায় যেতাম? সর। ‘
প্রাঙ্গনে চলো। নাপিত কাকু এসেছে চুল কাটবে দাঁড়ি ছাঁটবে।
‘ মাথা নষ্ট করিস না। ‘
‘ করব। চুল লম্বা হয়ে গেছে। চলো। ‘
শেরহাম বলল,
‘ যাব না। কাজ করছি। বিরক্ত করবি না। ‘
তটিনী মনখারাপ করে বলল,
‘ ঠিক আছে। ‘
সে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। শেরহাম সেদিকে তাকালো। তটিনী ঘাড় ফিরিয়ে একবার তার দিকে চেয়ে হনহনিয়ে চলে গেল। শেরহাম বিছানার উপর রাখা পাঞ্জাবিটা দেখলো কপাল ভাঁজ করে।
***
অপরূপা পাঞ্জাবিটা রেখে কক্ষ হতে বেরোচ্ছিলো। শেহজাদকে কক্ষে প্রবেশ করতে দেখে থেমে গেল। শেহজাদ হেসে বলল,
‘ খুব ব্যস্ত? ‘
‘ না। হাতে হাতে একটু কাজ এগিয়ে দিচ্ছি। আপনাদের জন্য আলাদা খাবার রান্না করতে হচ্ছে তো তাই। আপনার কি কোনোকিছু দরকার? ‘
‘ অবশ্যই দরকার। ‘
‘ কি? ‘
‘ আপনাকে। ‘
অপরূপা ফোকলা হেসে এগিয়ে গিয়ে বুকে মাথা ঠেকালো। শেহজাদ জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ খাওয়াদাওয়া হচ্ছে ঠিকঠাক? ‘
‘ হুমম। ‘
অপরূপা তার ঘর্মাক্ত মুখ তুলে চাইলো।
শেহজাদ তার মুখ আগলে ধরে কানের পাশে চুল গুঁজে নাকের ডগায় চুমু খেয়ে বলল,
‘ কে আসছে? ‘
অপরূপা হিসহিসিয়ে ওর নিকটে গিয়ে বলল,
‘ শাহজাদী কিংবা শাহজাদা যেই আসুক। ‘
শেহজাদ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানের নীচে নাকমুখ ডুবাতেই অপরূপা ওর মাথার চুল মুঠোয় নিয়ে ফিক করে হেসে উঠে বলল,
‘ আপনি কিইই? ছাড়ুন কেউ চলে আসবে। ‘
শেহজাদ ছাড়লো না।
_______
মেহেফিলে যাওয়ার জন্য সকলেই প্রস্তুত হয়েছে। সিন্নির ডেকচি ভ্যানে তুলে দেয়া হয়েছে। তা মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মহল অঙ্গনে ঘোড়ার গাড়ির হাঁকডাক ভেসে আসছে। শেহজাদ মরিয়মের কক্ষে যেতেই দেখলো উনি শাড়ি বাছাই করছেন। শেহজাদকে দেখে শাড়ির আঁচল মাথায় তুুললেন। উনি খাটে বসা ছিলেন। ছেলেকে দেখে বললেন
‘ ইউভান! কিছু বলবে? ‘
শেহজাদ পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে বলল,
‘ মা কি করছে? ‘
‘ এইতো পাকঘর থেকে আসলাম সবেমাত্র। শাড়ি কোনটা পড়ব বলোতো? ‘
শেহজাদ আকাশী রঙের একটা বেছে দিল। বলল,
‘ তোমাকে সব শাড়িতেই ভালো মানায়। ‘
মরিয়ম হেসে বলল, তোমার মা ফুপুরা সবাই কালো কালো বোরকা পড়ছে। আমি ওখানে এভাবে যাব? আমার কেমন যেন লাগছে। আর ওখানে আমি গিয়ে কি করব? ‘
কক্ষে অপরূপা প্রবেশ করলো। হাতে একটা চকচকে প্যাকেট। এসেই শেহজাদের হাতে দিল। শেহজাদ সেটা হাতে নিয়ে উনার সামনে হাঁটুমুড়ে বসে বলল,
‘ এটা তোমার? ‘
‘ কি এটা? ‘
‘ খুলে দেখো। ‘
মরিয়ম প্যাকেট খুলতেই দেখতে পেল একটা কালো বোরকা। সে দ্বিধাগ্রস্তের মতো তাকালো। শেহজাদ মায়ের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
‘ আমি দুদিন আগে স্বপ্নে দেখলাম আমরা একসাথে নামাজ আদায় করছি। আমি তুমি আমরা। কত সুন্দর না মা? ‘
অপরূপা স্মিত হাসলো। মরিয়ম এখনো অবাকচোখে চেয়ে আছে। অপরূপা উনার পাশে বসে কাঁধে মাথা রেখে বলল,
‘ ভীষণ সুন্দর। ‘
শেহজাদ মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকলো। মায়ের হাত তার মাথায় টেনে এনে রাখলো। বলল,
‘ আমার মায়ের পায়ের নীচে আমার জান্নাত হবে না?’
মরিয়ম অশ্রুসজল নয়নে হেসে পুত্র ও পুত্রবধূকে জড়িয়ে ধরলেন।
___________________
সবাই বেরিয়ে পড়লো ঘোড়ার গাড়িতে। শাহানা মেয়েদেরকে তুলে নিয়ে সাফায়াতকে ডেকে বলল,
‘ বোন কোথায় দেখো তো? ‘
‘ দেখছি আম্মা।’
সাফায়াত মহলে প্রবেশ করতেই সায়রা বলল,
‘ আবার কোথায় যাচ্ছেন? ‘
‘ তনী কোথায়? ‘
‘ বড় ভাইজানের সাথে নাকি যাবেন।’
‘ কিন্তু বড় ভাইজান তো বেরিয়েছেন উনার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে। একা একা মহলে কি করে থাকবে?’
শেহজাদ এসে বলল,
‘ কি হয়েছে? ‘
সায়রা সবটা বলতেই শেহজাদ বলল, ‘আমি দেখছি। ‘
সে তটিনীকে ডাকতে গেল সাফায়াতের সাথে। তটিনী কান্নাজড়ানো গলায় বলল,
‘ ও আসবে। ‘
শেহজাদ বলল,
‘ আচ্ছা ততক্ষণ আমরা অপেক্ষা করব? ‘
‘ না তোমরা চলে যাও। ও এলে আমি ওর সাথে বেরোবো। ‘
সাফায়াত তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ বুঝার চেষ্টা করো ভাইজান আগের মতো নেই। উনি খোদাতায়ালাকে মানেন না। মসজিদে যাবেন না উনি। ‘
তটিনী কাঁদতে থাকলো। শেহজাদের খারাপ লাগলো তার কান্না দেখে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
‘ ধৈর্য্য ধরো। আমাদের সাথে চলো। ভাইজান যাওয়ার হলে এমনিই যাবেন। ‘
তটিনী অনেক কান্নাকাটির পর বের হলো সবার সাথে। রেগেমেগে আগুন হয়ে থাকলো ভেতরে ভেতরে। ওই শয়তানকে পেলে এবার সে খুন করবেই।
তাকে বেরোতে দেখে শাহানা শান্তি পেল। এই মেয়ের চিন্তায় উনার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। ঘোড়ার গাড়িতে উঠে বসলো সে। হাসাহাসি মাতামাতি আর হৈ-হল্লা হাসিঠাট্টায় মেতে সকলেই ক্ষণিকের জন্য হলেও সব দুঃখ ভুলে পাড়ি জমালো একসাথে রূপনগরের সবচাইতে বড় জামে মসজিদটিতে। সন্ধ্যার বর্ণিল আলোকসজ্জা বাহারি রকমের আলোকবাতি দিয়ে সাজানো আছে তার পাশের বড় একজন আউলিয়ার মাজার শরীফ। মসজিদে দোয়া-দরুদ পাঠ হচ্ছে। সকলেই এইসেই আলাপে মত্ত ছিল। মহলের মহিলাদের জন্য আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা ছিল। সিন্নি বিলানোর সময় অপরূপাকে ডাকলো সকলে। তার হাতে বাচ্চাদের পাতে সিন্নি বিলি হবে যাতে বাচ্চা সুস্থ ভাবে জন্ম নেয়। শেহজাদ বালতি ধরে রেখেছে। অপরূপা বড়সড় কাঠের চামচে সিন্নি তুলতেই গোলাপজলের সুগন্ধি পেল। বলল,
‘ খেতে দারুণ হয়েছে। ‘
‘ খেয়েও ফেলেছ? ‘
অপরূপা হেসে ফেলল। বলল,
‘ হ্যা সবার আগে। ‘
শাহজাহান সাহেব বললেন,
‘ রূপা এইতো এদিকে দাও। বিসমিল্লাহ বলে দাও।’
অপরূপা সবাইকে দেয়া শুরু করলো। বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালো। তারা হাসলো অপরূপার সাথে।
তটিনী দূর থেকে সেদিকে চেয়ে আছে। রাগে সবার অগোচরে কাঁদছে। শাহানা তার দিকে তাকাতেই অন্যদিকে ফিরে গেল সে। মনে মনে ভাবলো, ওই লোকের প্রতি তার সমস্ত মায়াকে সে বিসর্জন দেবে। কোনো দরকার নেই অমন একটা মানুষের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখে ধ্বংস ডেকে আনার। তার গর্ভের সন্তানকে সে একাহাতে মানুষ করবে। একজন না তার সন্তানের দায়িত্ব নিতে পারেনা? অবশ্যই পারে। বাবা যদি শয়তান হয় তাহলে দরকার নেই অমন বাবাকে। ভাবতে ভাবতে সে কাঁদলো।
হঠাৎই চোখ পড়লো মসজিদের সিংহদুয়ারের দিকে। একটি কালো কুচকুচে তেজস্বী ঘোড়ার এসে থামলো টগবগিয়ে। অশ্বারোহীর গায়ে কালো কালো রঙের চাদর। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলো শেরহাম। এদিকওদিক তাকাতেই দূরে তটিনীকে অবাকচোখে তাকিয়ে থাকতে দেখলো। সকলেই ঘাড় ফিরিয়ে তাকে দেখে স্তব্ধ। হাঁ করে চেয়ে আছে। শেরহাম এদিকওদিক চোখ বুলাচ্ছে। এদিকে কয়েকজন জাদুকরকে আসতে দেখেছিল সে। তারা আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে হয়ত। নিশ্চয়ই অপরূপার খোঁজ পেয়ে এসেছে। তটিনী গালমুছে সবার দিকে তাকিয়ে সগর্বে হেসে শেরহামের কাছে ছুটে এল। সবাই তাকিয়ে আছে নইলে ঝাপটে জড়িয়ে ধরতো সে। শেরহাম তাকে দেখে বলল,
‘ তোর হয়েছে? হলে চল। এখানে থাকার দরকার নেই। ‘
তটিনী বলল,
‘ ওখান থেকে একটা সিন্নির বালতি নাও। ‘
‘ কেন? কি করবি? ‘
‘ আমিও সিন্নি বিলি করব। ‘
শেরহাম বিরক্ত হয়ে চেয়ে রইলো। তটিনী বিড়বিড় করে বলল,
‘ আমার বাচ্চার ভালো চাইতে হবে না সোফিয়ার বাচ্চা। ‘
শেরহাম শেরতাজ সাহেবকে হুমকিধামকি দিয়ে তটিনীকে একটা সিন্নির বালতি এনে দিল। সকলেই চেয়ে আছে তাদের দিকে।
চলমান….