প্রিয় বেগম ২ পর্ব-২৩

0
1245

#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_২৩
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

শেহজাদ আর সাফায়াতের হাসপাতাল বাস তখন দু’সপ্তাহ পার হয়ে তিন সপ্তাহে পা দিয়েছে। চিকিৎসা চলছে। কড়া ঔষধের তোপে চোখ মেলে কিছুক্ষণ তাকাতে পারলেও কথা বলার অবস্থায় নেই। অপরূপা আর সায়রা সকাল হতে সন্ধ্যা অব্দি সময় কাটিয়ে রাতে মহলে ফিরে আসে। তাদের অপেক্ষা যেন ফুরোতেই চায় না।

এদিকে চুক্তি অনুসারে মক্তবের সামনেই খোলা মাঠটা দখল করে পরিত্যাক্ত জায়গা থেকে এসে নিজেদের ঘাঁটি গেঁড়েছে ডাকাতদল।
শেরহামকে এই ব্যাপারে নিরুত্তর নিরুত্তাপ দেখে শাহজাহান সাহেব আর শেরতাজ সাহেব তীব্র রোষে ফেটে পড়লেন। শেহজাদের অনুপস্থিতিতে যা তা শুরু করেছে সে। নগরে ডাকাতের প্রবেশ উন্মুক্ত করে দেয়া মানে যে নিজ হাতে নগরের ধ্বংস ডেকে আনা তা কি শেরহাম সুলতান বুঝতে চাইছেনা? অবশ্য সে তো নিজেই নগরের ধ্বংস চায়। আজ নগর দখল করছে, কাল মহল দখল করতে চলে আসবে। সকল বিষয়সম্পত্তি উপর তাদের হক দাবি করবে। শেরতাজ সাহেব চেঁচাতে শুরু করলেন। শেরহাম অতিথিশালায় ছিল। অতিথি শালা হতে সামাদের চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে আসছে। কুমুদিনীর সাথে যে তার একটা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল তা শেরহাম আজই জেনেছে, সামাদই তা স্বীকার করেছে মারের চোটে। কুমুদিনীর বাচ্চা নষ্ট করার কথাটা তাকে তটিনী জানিয়েছিল তখনই সে সন্দেহ করেছিল এমন কিছু। কিন্তু সত্যি সত্যি এমন হবে তা ভাবেনি। সামাদ চিৎকার করে যাচ্ছে তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য। শেরহাম তাকে মেরে দূরে চাবুক ছুঁড়ে হন্তদন্ত পায়ে বেরিয়ে এসে শেরতাজ সাহেবের উদ্দেশ্য বলল,

‘ কি হয়েছে? এত চেঁচাচ্ছ কেন? ‘

শেরতাজ সাহেব বললেন,

‘ কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয় না। ওরা তোমার মতোই। তাই পেটালে সোজা হবে না। শেহজাদ নেই তাই সুযোগ বুঝে নিজের লোকদের ঘাঁটি বসানোর আদেশ দিয়েছ না? কতবড় স্পর্ধা তোমার! ‘

শেরহাম রক্তচোখে চেয়ে থাকে। শেরতাজ সাহেব একেরপর এক বুলি ছুঁড়েন। শেরহাম চিবুক শক্ত করে হনহনিয়ে কক্ষের দিকে পা বাড়ায়। তটিনী পানি দিয়ে মেঝে মুছছিলো। শেরহামের কাপড়চোপর গাদাগাদি করে একটা পিতলের বালতিতে নিয়েছে ধোয়ার জন্য। শেরহামকে প্রবেশ করতে দেখলো। সে আলমিরা খুলে কিসে হাত দিতেই তা ঝপাৎ করে পড়ে গেল নীচে। বিকট শব্দ করে উঠলো। তটিনী আঁতকে উঠে সেদিকে চোখ রাখতেই দেখলো অসংখ্য বুলেট ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে মেঝেতে। শেরহাম কুড়িয়ে থলেতে ভরতে শুরু করলো। তটিনী অবাকচোখে চেয়ে বলল,

‘ এতগুলো! তুমি সত্যি সত্যি অস্ত্র পাচার করো? এই কথাটা সত্যি? ‘

‘ হ্যা। ‘

তটিনী রাগে ফেটে পড়লো। নিজেকে যতটা সম্ভব শান্ত রেখে নিজেও বুলেটগুলো কুড়িয়ে থলেতে ভরে দিতে শুরু করলে শেরহাম কপাল ভাঁজ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তটিনী তার দিকে একপলক তাকিয়ে পুনরায় বুলেট কুড়িয়ে নিতে নিতে বলল,

‘ তোমার ঘরনি হয়েছি তাই তোমার অপকর্মে সায় দিতে হবে না? ‘

শেরহাম এল ঝটকায় থলেটা নিয়ে আলমিরায় রেখে দেয়। বলে,

‘ কিছু নিয়ে আয়। খেয়ে বেরোবো। ‘

‘ ওই ডাকাতগুলো কেন ঘাঁটি গেঁড়েছে নগরে? ‘

‘ আমি বলেছি তাই। ‘

‘ তুমি নিশ্চয়ই স্বেচ্ছায় বলোনি? ‘

‘ খিদে পেয়েছে। আগে খেতে দে। তারপর কথা বল। যাহ নিয়ে আয়। ‘

তটিনী বেরিয়ে গেল বালতি হাতে নিয়ে। রসাইঘরে বালতিটা রাখতেই সোহিনী এসে হাত দিতেই তটিনী কেড়ে নিল। শেরহামের কয়েকটা পোশাক একদম রক্তে ভিজে দাগ পড়ে গেছে। সোহিনী সেগুলো দেখলে ভয় পেতে পারে। সে বলল,

‘ আমি ধুয়ে নেব। তুমি তোমার কাজে যাও। ‘

শাহানা, খোদেজা আঁড়চোখে তাকালো।
তটিনী হাত ধুঁয়ে এল।
গরম ভাতের পাতিলের ঢাকনা উল্টোতেই ‘ভক’ করে উঠলো। এই গরম ভাতের গন্ধ তার সহ্য হচ্ছেনা আজকাল। সকলেই তার দিকে তাকালো। তটিনী পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতেই নাক তুলে বলল,

‘ ছোঁ ছোঁ হেঁটে গেল পাশ দিয়ে। ওটার গন্ধ। ‘

শাহানা জানে সে ছোঁ ছোঁ ঘৃণা করে। দেখামাত্রই চেঁচিয়ে উঠে, বিরক্ত হয়। তাই অত না ভেবে কাজে মনোযোগ দিলেন। তটিনী ভাত বেড়ে, তরকারি, মাংস বেড়ে থালা নিয়ে শেরহামের কক্ষে চলে এল। খাবার বেড়ে দিতে দিতে বলল,

‘ এবার সত্যিটা বলো। না বললে আর জীবনেও বেড়ে খাওয়াবো না। ‘

শেরহাম তার সামনাসামনি খেতে বসে সরু চোখে চাইলো। তটিনী চোখ তুলে তাকিয়ে বলল,

‘ ওভাবে দেখে লাভ নেই। বলো, বলো। সত্যিটা বলো। ‘

‘ তোর কি মনে হচ্ছে? আমি স্বেচ্ছায় ওঁদের ঘাঁটি বসাতে বলিনি?’

‘ না। ‘

তটিনী গ্লাস থেকে পানি ঢেলে দিয়ে ভাত মাখতে লাগলো। শেরহাম বক্র হেসে বলল,

‘ আন্দাজে বলেছিস? ‘

‘ মিথ্যে বলছি বলছো? ‘

‘ নাহ। ‘

‘ তাহলে সত্যিটা কি? তুমি অবুঝ বাচ্চা নও যে শত্রুদের এখানে নগরে আসতে দেবে। তাহলে কেন দিলে? ‘

‘ ওদের ছাড়ছিলো না তাই শর্ত মেনে নিয়েছি। তোর এত বিশ্বাস অবিশ্বাস দিয়ে কি হবে? আমি এই মহলে এসেছিই এই উদ্দেশ্যে। ‘

তটিনী চোখ স্থির করে । বলে,

‘ নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ তোমার উদ্দেশ্য খুবই খারাপ ছিল? ‘

‘ উত্তম ছিল। আফসোস সেই উত্তম কাজ আমি করতে পারব না। ‘

তটিনী মুখভার করে লোকমা বাড়িয়ে দেয়। শেরহাম বলে,

‘ পেঁচার মতো করে রেখেছিস কেন মুখটা? ‘

‘ কিছু না। ‘

আর একটা কথাও বললো না তটিনী। খাওয়া শেষে ছোট তোয়ালে এনে শেরহামের মুখ মুছে দিয়ে কোলে উঠে বসে জড়িয়ে ধরে কাঁধে চোখ চেপে ধরলো। শেরহাম বলে উঠে,

‘ সর। আমার কাজ আছে। ‘

তটিনী ছেড়ে দেয়। শেরহাম বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ার সময় তটিনী আবার পথ আটকায়। বন্দুক কেড়ে নিয়ে শেরহামের বুকে নিজের পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে শেরহামের হাত দুটো টেনে এনে পেটের কাছে এনে রেখে বলে,

‘ তোমার সেইদিনগুলি মনে পড়েনা? যখন তুমি জুমার নামাজ পড়তে যেতে সবার সাথে? ‘

শেরহাম তাকে তৎক্ষনাৎ ছেড়ে দিয়ে গটগট পায়ে হেঁটে চলে যায়। তটিনী অশ্রুজলে হাসে। আলতোকরে নিজের উদরে হাত ছোঁয়ায়।

অপরূপা আর সায়রা হাসপাতাল থেকে সন্ধ্যায় ফিরে এল। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষগুলোকে একটু একটু করে জীবনের দিকে ফিরতে দেখছে রোজ। ফিরে এসে শেহজাদ আর সাফায়াতের সকল বৃত্তান্ত খুলে বলে সবাইকে।
জানতে পারে ঘটে যাওয়া ঘটনার সবকিছু।

অপরূপা গোসল নিয়ে এশার নামাজ আদায় করে মরিয়মের সাথে দেখা করে আসে। উনি দিনদিন রোগা, অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। অপরূপার মায়া হলো। কিন্তু কি করবে সে? অনুপমা আর ফজল সাহেব চলে গিয়েছেন চারদিন হলো। যদিও শেহজাদের এমতাবস্থায় যেতে দিতে চাইলো না কেউ, উনাদেরও খারাপ লাগছিলো কিন্তু শেহজাদ আর সাফায়াত বিপদমুক্ত শুনে চলে গিয়েছেন। অপরূপাকে কথা দিয়েছে শেহজাদ সুস্থ হলে আবারও আসবেন।

অপরূপা রসাইঘরে আসতেই দেখতে পায় কুমুদিনী ছাড়া সবাই মিলে রান্নাবান্না সাড়ছে। সে তাদের সাথে কথা বলতে বলতে টুকটাক কাজ করে। খোদেজা কতকগুলো আচারের বৈয়াম নিয়ে বসেন। একে একে সবগুলো অপরূপাকে বুঝিয়ে দেন। খেতে উৎসাহিত করেন। এসময় এমন হাজারো জিনিস খেতে ইচ্ছে করে। অপরূপা আচারের বৈয়াম থেকে একটা পেয়ালায় কিছু আচার নিয়ে পাশে রেখে দেয়। অল্পস্বল্প খেতে খেতে গল্প করে।

তটিনী এসে পেয়ালা হতে একমুঠো আচার নিয়ে চলে গেল। অপরূপা অবাক হয়ে তার যাওয়া দেখলো।

_______

কক্ষে বসে আরাম করে তা পা দুলিয়ে দুলিয়ে খেতে খেতে আবারও চেঁচামেচি শুনতে অন্দরমহলে আসর কক্ষে। ছুটে যেতেই দেখতে পায় শেরতাজ সাহেব চেঁচামেচি করছে। শেরহাম অগ্নিময় দৃষ্টি ফেলে রেখেছে মেঝেতে। শেরতাজ সাহেব বললেন,

‘ শেহজাদ ফেরার অপেক্ষা। তুমি এই মহলে থাকবে। সব তোমাকে দিয়ে চলে যাব আমরা। ‘

শেরহাম বলল,

‘ এতদিন আপদ নিজ থেকে ঘাড় থেকে নামবে। ‘

শেরতাজ সাহেব কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে চিৎকার দিয়ে বলেন,

‘ ঠিক মায়ের মতো হয়েছে? তোমার মাও কথায় কথায় আপদ বলতো সবাইকে। মায়ের মতো জা**নোয়ার হয়েছে। ‘

শেরহাম রেগে গিয়ে বলে,

‘ এই শেরতাজ সুলতান মুখ সামলে। আমার মায়ের নামে একটা কথাও যদি বলো জিভ টেনে ছিঁড়ে নেব। ‘

‘ একশবার বলব, হাজারবার বলব। ‘

শেরহাম রেগে গিয়ে কেদারায় লাতি বসাতেই তা ছিটকে গিয়ে পড়ে হামিদার দিকে। সকলেই আঁতকে উঠে। হামিদা নিজেকে আড়াল করে নেয়। শেরতাজ সাহেব সপাটে চড় বসায় তার গালে। একটা নয় দু’টোর পর তিন তিনটে। তটিনী ছুটে এসে শেরহামকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

‘ খোদার কসম করে বলছি মামুর সাথে তর্ক জড়িওনা। ‘

শেরহামকে আসর কক্ষ হতে বের করে দিয়ে সে ফের আসর কক্ষে চলে এল। শেরতাজ সাহেব বললেন

‘ আমি তাকে নিজ হাতে মারবো। ওকে মেরে তারপর নিজে মরব। ‘

তটিনী বলল,

‘ জন্মের পরপর কেন মেরে ফেলোনি মামু? মানুষ করতে পারবে না তো রেখেছিলে কেন? ‘

শাহানা ডাক দেয়, ‘ তনীইই! ‘

তটিনী ভড়কায় না। চেঁচিয়ে বলে,

‘ একটা সন্তানের জীবন কেন শুধু মা নিয়ন্ত্রণ করবে? একজন বাবার কি কোনো দায়দায়িত্ব নেই সন্তানের প্রতি। কেন তাকে নিজের গুণে গুণান্বিত করতে পারোনি? কেন সে মায়ের আদর্শে বড় হবে? কেন তোমার আদর্শে বড় হয়নি? সবসময় ওর উপর সব অন্যায়ের ভার চাপিয়ে দিয়েছ। যে সময় ওর তোমাদের সবাইকে দরকার ছিল সেসময় সে তার মায়ের সঙ্গ পেয়েছিল আর সেটা নিয়েই বড় হয়েছে। তোমরা কি করেছ ওর জন্য? তুমি বাবা হিসেবে কি করেছ? মনে পড়ে কখন ওর সাথে ভালো করে কথা বলেছ? সবার কথার বানে দিনের পর দিন ওকে অমানুষে পরিণত করেছ? ‘

সোহিনী এসে তাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকো। সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়ে তটিনী বলে যেতেই থাকো,

‘ ওর আজকের এই পরিণতির জন্য তোমরা সবাই দায়ী। আমার মৃত নানাজান দায়ী। তুমি দায়ী। বাবা হিসেবে তুমি ব্যর্থ। তুমি পরাজিত বাবা। তুমি তোমার সন্তানকেই বুঝতে পারোনা তুমি কেমন বাবা? ‘

তার কথা শুনে সকলেই চিন্তিত হয়ে পড়ে। শেরতাজ সাহেব শাহানাকে বলে, ও কেমন জাদু করেছে তোর মেয়েকে? ও আজ অব্দি এভাবে গলা তুলে কথা বলেনি আমার সাথে। কারো সাথেই বলতে দেখিনি। ‘

শাহানা অসহায় গলায় বলে,

‘ আমি জানিনা। কিচ্ছু জানিনা। একজন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়ছে, অন্যজন গলাবাজি করছে। কি হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা ভাইজান। ওর হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি তোমার কাছ থেকে। কি বলতে কি বলে ফেলেছে। ‘

বলেই তিনি তটিনীর হাত চেপে ধরে টেনে নিয়ে যায়। যেতে যেতে বলে,

‘ তুমি আজ থেকে ওর মুখও দেখবে না। আমার আর মেরোনা। আমি অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছি। তোমাকে উদ্ধার করতে গিয়ে তোমার ভাইয়ের কেমন দশা হয়েছে দেখতে পাওনি? তারপরেও কি করে শেরহামের হয়ে কথা বলো?’

তটিনী কাঁদতে থাকে। শাহানা তাকে কক্ষবন্দী করে বলে, ‘ অনেক ছাড় পেয়েছ তুমি। তোমার দিকে এতদিন মনোযোগ দিইনি বলে যথেষ্ট বাড় বেড়েছে তোমার। ওর সাথে থেকে নিজের অবনতি দেখতে পাচ্ছ চোখে? কতবড় বেয়াদব হয়ে গেছ তুমি? ‘

তটিনী দরজা ধাক্কা দিতে দিতে বলে,

‘ আমি ওর সংসার করব। তালাক দেব না। ‘

‘ বেশ। আমাকে মা ডেকোনা আজকের পর থেকে।’

শাহানা হনহনিয়ে চলে যায়।

এদিকে রাতের মধ্যেই খবর আসে শেহজাদের কথা ফুটেছে। সে দেখতে চায় সবাইকে।

চলমান……

রিচেক করা হয়নি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে