প্রিয় বেগম ২ পর্ব-২০

0
1319

#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_২০
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

ফজরের আজানের সময় হয়ে এসেছে। আকাশের অবস্থান দেখে সময় করে নামাজ আদায় করেন নানাজান। ওদিকে আবদুল্লাহ আর আলাউদ্দিন নামক উনার ভৃত্য দুজন পাকে ব্যস্ত। হুজুরের কথায় ভোররাতেও রান্না বসিয়েছে। বয়স চল্লিয় পয়তাল্লিশের কৌটায় হবে। তটিনীকে মামু বলে ডাকতে বলেছিল তারা।

তটিনী শাড়ি পাল্টাবে বলে গুহারঘরে ঢুকেছিল আর বেরোনোর নামগন্ধ না দেখে শেরহাম গুহারঘরে প্রবেশ করে দেখলো সে শাড়ি পাল্টায়নি বরং যেটা পড়েছিল সেটা পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে গুহার মেঝেতে মাদুরের উপর।
গালে চোখের জল শুঁকিয়ে গিয়েছে। সে চোখ সরিয়ে গায়ের পোশাক খুলে ক্ষতস্থানে ঔষধ লাগালো। জ্বালাপোড়া করায় কিছুক্ষণ পায়চারি করলো গুহার মধ্যিখানে। তারপর ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে গেল। নানাজান বলল, ‘ কোথায় যাচ্ছিস? কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে নে। তোর বউ কোথায়? ‘
শেরহাম কোনোপ্রকার উত্তর না দিয়ে চলে গেল তলোয়ারের খাপ হাতে নিয়ে। নানাজান দেখলো তটিনী ঘুমিয়ে গেছে। তিনি বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, বউটার প্রতি যদি তার মন ঘামতো!
বেলা করে ঘুম ভাঙলো তটিনীর। শেরহামের দেখাসাক্ষাৎ নেই।

_________________

মহলের অবস্থা বেশ শোচনীয়। তটিনীর কোনো খোঁজখবর না পেয়ে শাহানা প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে কাঁদতে কাঁদতে। দূরদূরান্ত হতে আসা অতিথিরা চলে গেল। বেশিরভাগই থেকে গেল। শাহানার গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। অনুপমা আর মরিয়ম তাকে সঙ্গ দিয়েছে, সান্ত্বনা দিচ্ছে কিন্তু তার মন অশান্ত হয়ে আছে।
অপরূপার ঘুম ভাঙেনি বেশ রাত করে শুতে যাওয়ায়। মহলের সবার পদচারণা, তাদের কক্ষের পাশে থাকা জারুল গাছে বসা ডাক পাখিদের কলতানে চোখ খুললো তার। মৃদু নড়েচড়ে উঠতেই বুকের উপর ঘন চুলের একটা মাথার অবস্থান টের পেল সে। এজন্যই দম নিতে এমন লাগছিলো! আলতোহাতে চুলে হাত বুলিয়ে কাঁথা টেনে নিল সে মুখের উপর। মৃদুস্বরে ডাকলো,
‘ সবাই কি মনে করবে? বেলা হয়ে গেছে। উঠুন। ‘
শেহজাদ তার ধাক্কায় নড়েচড়ে উঠলো। মহাবিরক্ত ছোট ছোট চোখ করে চেয়ে বলল,
‘ এখনো সকাল হয়নি। ‘
‘ বললেই হলো? দুপুর গড়াতে চললো। ছাড়ুন আমাকে। আপনি ঘুমান ঢুসে ঢুসে। ‘

শেহজাদ তার বক্ষে মুখ ডুবিয়ে পুনরায় চোখ বুঁজলো। অপরূপা নড়েচড়ে উঠে তার বাহুবন্ধন হতে নিজেকে ছাড়িয়ে নেমে গেল। গায়ে শাড়ি জড়িয়ে বেরিয়ে গেল কক্ষ হতে। মুখহাত ধুঁয়ে রসাইঘরে যেতে যেতে শাহানার ক্রন্ধন শুনতে পেল পুনরায়। বুকটা ভার হয়ে এল তার। তাকে বেলা করে উঠতে দেখে কেউ তেমন কিছু বলল না। সাফায়াত এসে বলল,
‘ রূপা ভাইজান উঠেছে? ‘
‘ জ্বি। ‘
সাফায়াত শেহজাদের কক্ষের দিকে চলে গেল। অপরূপার পরপরই সায়রা ঢুকে এল। তটিনী বিষয়ক কথাবার্তা চলছে সারাক্ষণই। গতরাতেই শেরহামের সৈন্যগুলোকে আটক করেছিল শেহজাদ। মদ খেয়ে মাতলামি করছিলো।
তাদের বেদম পিটুনি দিয়েছে তটিনীকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা না বলায়। শেষমেশ মার সইতে না পেরে মুখ খুললো। জানালো জংলাহাঁটার ডাকাত আস্তানায় গিয়েছে শেরহাম। তটিনীকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
নির্ঘুম ছিল তাই শেষরাতে একটু ঘুম দিয়েছিল শেহজাদ। ভেবেছে ফজরের পরপর উঠে রওনা দেবে কিন্তু চোখ মেলতে পারেনি। সাফায়াত কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ ভাইজান আসি?
‘ হ্যা এসো। ‘
সাফায়াত ভেতরে প্রবেশ করে বলল,
‘ কাশীম জানালো পরাগ পাহাড়ের পথ দিয়ে জংলাহাঁটার ডাকাত আস্তানায় যেতে হয়। তার আগেই একটি মরা নদী আছে। পানি অতি দুর্গন্ধ। জায়গাটা নাকি নিষিদ্ধ, তখন দিনে-দুপুরে মানুষ ওদিকে গেলে ফিরে আসেনি। এখন সেটা ডাকাতদের আস্তানা। বড় ভাইজানের মতো এক ডাকাত সর্দার ছিল গুলজার। সেও ওই পরাগ পাহাড়ের জাদুকরের সঙ্গে আছে। আমার ভয় হচ্ছে তনীর যেন খারাপ কিছু না হয়। ‘
‘ ভয় পেওনা। কেন যেন ভাইজানের উপর আস্থা রাখতে ইচ্ছে করছে। আমরা ওই নদীর পাড়ে যাব। পরিস্থিতি বুঝবো তারপর আক্রমণ করব। বসে থাকা যাবে না। ‘

‘ ঠিক আছে। আপনি খেয়ে নিন। ‘

সায়রা, সোহিনী, শবনম মিলে সবার খাওয়ার দাওয়ার ব্যবস্থা করলো। খাইয়েদাইয়ে ধোঁয়ামোছাও করে ফেললো কাজের বুয়াদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে। অপরূপার কাজকর্ম করতে ইচ্ছে করেনা। খেতেও ইচ্ছে করেনা। সারাক্ষণ খালি ঘুম পায়। সুযোগ পেলেই সে টুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। অনুপমা তা বেশ লক্ষ করছিলো। খোদেজার কাছেও তাকে কেমন নির্জীব নির্জীব ঠেকছিলো তাকে। তাই মফিজকে বলে এক হুজুরের কাছ থেকে কিছু পানিপড়া নিয়ে এসেছিলেন অনুপমার পরামর্শে। তার লক্ষ্মণ দেখে ফজল সাহেব সন্দেহ করছেন সে সন্তানসম্ভবা।

পানিপড়া খাওয়ানোর সময় সে প্রশ্ন করলো
‘ এগুলো কেন?আমার তো কিছুই হয়নি। ‘
অনুপমা বলল,
‘ এগুলো খেতে হয়। কোনো প্রশ্ন নয়। ‘
অপরূপা খেল। তাকে এমন সন্দিগ্ধ দেখে খোদেজা বলল,
‘ তুমি কিছু খেতেটেতে পারছো না, কাজকর্ম করতে পারছোনা দেখে লক্ষ্মণ বুঝে তোমার বাবা বলছিলো তুমি অসুস্থ। ‘
অপরূপা বুকের ভেতরটা ধড়ফড়িয়ে উঠলো। চিন্তিত মুখে অনুপমার দিকে তাকালো। খোদেজার দিকে তাকাতেই উনি হাসলেন। হামিদা এসে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ সিভান চাচ্চু হতে যাচ্ছে। ‘
স্তব্ধ চোখে চেয়ে রইলো অপরূপা।
লজ্জায় মাথা নত হয়ে এল । অনুপমা জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ এত লজ্জার কিছু নেই। তোমার মধ্যে মা হওয়ার লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। এজন্য খাওয়াদাওয়া কমিয়ে দিয়েছ। ‘
অপরূপা বেকুববনে গেল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। লজ্জায় ঠোঁট কামড়াচ্ছে সে।
খোদেজা কড়া হুশিয়ারী দিলেন। ‘মহলের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত একথা কাউকে জানানোর দরকারও নেই। তনী ফিরে এলে তোমাদের বাচ্চার মঙ্গল চেয়ে আমি মানত করেছি মেহফিল দেব বড় করে। শিরনী বিলি করব তোমাকে দিয়ে। ‘
অপরূপা মাথা দুলালো। খোদেজা তাকে জড়িয়ে ধরলো। অনুপমাকে বলল,
‘ তনীটা ফিরে এলে বাঁচি। এত আনন্দ হচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছিনা। ‘
অপরূপা কক্ষের দিকে পা বাড়িয়ে মনে মনে বলল,
‘ ছিঃ ছিঃ কি লজ্জার কথা! ‘
শেহজাদ বেরোনোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। অপরূপা কক্ষে ঢুকার সাথে সাথে তার বুকের উপর হামলে পড়লো। শেহজাদ পিঠে এক হাত রেখে জড়িয়ে ধরলো। অন্য হাতে ড্রয়ার হতে চিরুনি বের করে বলল,
‘ কি ব্যাপার? ‘
‘ কিছু না। ‘
কপাল ভাঁজ করলো শেহজাদ। অপরূপা মুখ তুলে তাকালো। ভুরু নাচিয়ে বলল,
‘ এমন চিন্তিত হচ্ছেন কেন? ‘
শেহজাদ চেয়ে রইলো। অপরূপা তার হাত থেকে
চিরুনি কেড়ে নিয়ে চুল আঁচড়ে দিল সযত্নে । কপাল টেনে চুম্বন করে বলল,
‘ দ্রুত ফিরে আসুন। আমি প্রতিবারের মতো এবারও আপনার অপেক্ষায় থাকবো। ‘
শেহজাদ মৃদু হেসে ওকে জড়িয়ে ধরে থুতনি থেকালো ওর মাথায়।

___________

বক শিকার করে রেঁধেছে আবদুল্লাহ আর আলাউদ্দিন। খিদের চোটে গমের রুটি দিয়ে বড় আকারে দু টুকরো মাংস খেল তটিনী। খেতে-খেতে শেরহামের কথা মনে পড়লো। খালিপেটে লোকটা কোথায় গেল কে জানে? তাকে মেরে ফেলবে এই লোক। খিদের চোটে খেলেও তার মন তৃপ্ত হলো না। মন খারাপ করে বসেছিল পাথরের উপর। নানাজান তা দেখে বললেন,

‘ কোথায় যেতে পারে সে? ঘোড়াটাকেও নিয়ে গিয়েছে। জোরে লাগাম টানতে পারবে না। কাছাকাছিই থাকবে। ‘

আবদুল্লাহ বলল

‘ ঝর্ণা দেখলে আসো। তোমার গোঁয়ার জামাইয়ের জন্য মন খারাপ করো না। ‘

তটিনীর খারাপ লাগলো আরও। একটা অদৃশ্য তিক্ত অনুভূতি অনুভব করলো সে। ওই মানুষ তো খারাপই কিন্তু তার এত এত খারাপ লাগে কেন? খারাপ লাগলেও সে কি করবে? অন্যায়কে তো প্রশ্রয় দিতে পারেনা। সে আবদুল্লাহ আর আলাউদ্দীনের সাথে ঝর্ণা দেখতে গেল। পাথরের উপর বসে রইলো পানিতে পা ডুবিয়ে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো। শেরহামের দেখা সাক্ষাৎ নেই। তটিনীও ওখান থেকে এল না। আর কিছু খেলও না। আলাউদ্দিন আর আবদুল্লাহ শেরহামকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়লো। ফিরে এল খালি হাতে।
তটিনী এবার ধৈর্যহারা হয়ে পড়লো। নানাজান ইবাদতরত অবস্থা জায়নামাজে বসা ছিলেন। নানাজানের কাছে ছলছলে চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ আমাকে ফেলে চলে গেল নাকি ও?’

‘ বিশ্বাস নেই ওর। ‘

তটিনীর চোখ ফুঁড়ে দু’ফোঁটা জল গড়ালো। নানাজান বললেন,

‘ কেঁদো না। দেরী হলেও ফিরে আসবে। তুমি পোড়া শাড়ি পড়ে সারাদিন কাটিয়ে দিলে। পবিত্র হয়ে জায়নামাজে বসো। ‘

‘ আমার কিছু ভালো লাগছেনা নানা। আপনার মেয়ে ওর জীবনটা শেষ করে দিল। এখনো মায়ের পথকে সঠিক মনে করে সে। আপনার মেয়ে কেন এমন করলো? ‘

নানাজান ওর মাথায় হাত রাখলো। বলল,
‘ শান্ত হও। কেঁদোনা। তাকদীরে বিশ্বাস করলে আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।

তটিনী শান্ত হতে পারলো না। কোনো মায়া টান না থাকলে তাকে বাঁচাতে গেল কেন সে? তার এসব দোলাচলে তটিনী ভেঙেচুরে যাচ্ছে। একবার প্রিয়পুরুষের মতো কাছে টেনে নেয় আরেকবার ধুর ছাই করে দূরে সরিয়ে দেয়।

________________

শাহানাকে ঘুম পাড়িয়ে খোদেজা মেয়েদের সাথে নিয়ে গল্প করছিলো। অপরূপা শেরহামের মায়ের সম্পর্কে জানতে চাইলো। কিভাবে তিনি মারা গিয়েছেন। সোহিনী বড় হয়েছিল দাদী ফুপু আর খোদেজার কাছে, মায়ের কাছে ঘেঁষতে দেয়া হয়নি তাকে। মাকে সে ছোটবেলা থেকে বন্দি দেখে এসেছে। উনার ভয়ে তটস্থ থাকতেন সবাই। কাজের বুয়াগুলো বলতো, ওখামে তোমার মা আছে। ‘
সোহিনীর দেখতে মন চাইতো কিন্তু দাদীজান দেখতে দিতেন না। শেরহামের মতো মায়ের প্রতি তার তেমন টান ছিল না বললেই চলে। সে মা বলে চিনে এসেছে খোদেজাকে। সায়রার সাথে সাথে সমানভাবে তাকে ভালোবেসেছে মা খোদেজা। কখনো মনে করেনি সে উনার শত্রুর মেয়ে। বরঞ্চ সোফিয়া নিজেই সোহিনীকে সইতে পারতো না। উনি শেরহামের মধ্যেই নিজের প্রতিচ্ছবি দেখেছিলেন।
শেরহামের মা সোফিয়ার প্রেমিক ছিল এক জলদস্যু। সে পেশায় ছিল একজন জাদুকর।
সেই জলদস্যু মারা যায় শেরতাজ সুলতানের হাতে সমুদ্রপথে। ছলেবলে কৌশলে একথা জানতে পারে সোফিয়া। পরিবার প্রেমিককে মেনে না নেয়ায় সে পালিয়ে গিয়েছিল প্রেমিক লতিফের সাথে । ধর্ম ত্যাগ করেছিলো। বিয়েও করেছিলো কিন্তু বিয়ের রাতেই লতিফ মারা যায় শেরতাজ সুলতানের হাতে। সোফিয়া ততদিনে জাদুবিদ্যা আয়ত্ব করে ফেলেছিল লতিফের কাছ থেকে।
বিয়ের পোশাকে সে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল সে নদীর তীরে । তাকে উদ্ধার করেন শেরতাজ সাহেব। রূপনগরে নিয়ে আসে কোথাও যাওয়ার পথ ছিল না বলায়। মহলে গিয়ে সে একসময় জানতে পারে লতিফের খু**নী শেরতাজ সুলতান। তাই সে সুকৌশলে প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করতে থাকে। শেরতাজ সাহেব তখনও তার পরিচয় জানেন না। একসময় প্রণয়ের সম্পর্ক হয় শেরতাজ সুলতানের সাথে। তারপর পরিণয়। তারপর সংসার। সংসারের মায়ায় পড়ে প্রতিশোধের কথা ভুলে যায়। বুঝতে পারে শেরতাজ সুলতান ভালো মানুষ।
উনার পরপরই খোদেজা আসে মহলে। শ্বাশুড়ি সবসময় খোদেজাকে বেশি ভালোবাসতেন কারণ সে ধর্মভীরু ছিল অন্যদিকে সোফিয়া নামাজ-কালাম পড়তো না। তার সব কাজকর্ম সন্দেহজনক ছিল। তার গর্ভে সন্তান আসে না অন্যদিকে খোদেজা গর্ভবতী হয়। কিন্তু সোফিয়া চেয়েছিল তার সন্তান হবে সুলতান মহলের বড় সন্তান। খোদেজা এমনিতেও তার চক্ষুশূল ছিল। সে জাদুটোনার মাধ্যমে খোদেজার গর্ভের সন্তানের ক্ষতি করতে থাকে। একের পর এক সন্তান নষ্ট করার পর একসময় সে জানতে পারে তার গর্ভেও সন্তান এসেছে। সন্তান জন্মলাভ করার পর তাকে সন্দেহ করতে শুরু করে মহলের সকলে। শেরতাজ সাহেব সন্দেহ করায় উনি পরবর্তীতে তার বশবতী হয়ে ছিলেন। শেরতাজ সাহেবের একঘেয়েমি কথাবার্তা সকলের মনে সন্দেহ জাগিয়ে দিয়েছিল। একসময় শয্যাশায়ী হন শেরতাজ সাহেব।

এদিকে খোদেজাকে সন্তানহারা হাহাকার করতে দেখে আনন্দ পান সোফিয়া। তারপর একসময় শেহজাদকে নিয়ে আসেন সলিমুল্লাহ সুলতান। শেরহামের দু বছরের ছোট শেহজাদ। দুজনেই একসাথে বড় হতে থাকে। শেরহাম ছোট থেকেই মা ভক্ত ছিল, কিন্তু মাকে সবাই দেখতে পারতো না এতে সে কষ্ট পেত। শেরহাম যতই বড় হতে থাকে সোফিয়ার আধিপত্য ততই বাড়তে থাকে।

শেরহামের যখন সাত বছর বয়স তখন জানাজানি হয় তিনি কালাজাদু করেন। সলিমুল্লাহ সুলতানকে নিজের বশবতী করে সমস্ত সম্পত্তি নিজের নামে করে নেন। লতিফের লোকবল নিয়ে ঘাঁটি গেঁড়ে বসেন মহলে। যেখানে সারাক্ষণ আল্লাহ আল্লাহ জিকির হতো সেই মহলে বেড়ে গেল লুসিফা শয়তানের পূজো। পশুপাখির চিৎকার চেঁচামেচি , এমনকি মানুষের তীব্র চিৎকারও মাঝেমধ্যে ভেসে আসতো সেই ঘাঁটি থেকে। সকলেই আতঙ্কিত, শঙ্কিত থাকতো তখন। কতগুলো বছর খোদেজাকে নিজের খাসবাদী বানিয়ে রেখেছিস সে শেহজাদের প্রাণের বিনিময়ে।

শ্বাশুড়ি আহতারা বেগম, শাহজাহান সাহেব, শাহানা আর খোদেজা মিলে সলিমুল্লাহ সাহেবকে কোরআনি চিকিৎসা করায়। উনি সুস্থ হয়ে উঠার পরপরই সোফিয়াকে বন্দি করা হয়। তখন শেরহামের দশ বছর বয়স। সোহিনী সোফিয়ার গর্ভে। সোহিনীকে তার দাদীজান বড় করে তুলেন। শেরহামকেও তিনিই আগলে রেখেছিলেন। কিন্তু মায়ের জন্য তার মন পুড়তো। মাকে খাবার দিয়ে আসা থেকে শুরু করে মায়ের সেবাযত্ন, ও সময় কাটাতো সে।

পেরিয়ে যায় আরও বছরও পাঁচেক। সোফিয়া সেই কক্ষে বন্দিদশা অবস্থায়ও জাদু করা বাদ রাখেনি। মহলে অশান্তি বিরাজ করছিলো। এমনকি সারা নগরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল লতিফের লোকবল। চারিদিকে দলেদলে মানুষ মরছিলো। কি ভয়ংকর মৃত্যু তাদের। ঘনঘন নিখোঁজ হচ্ছিলো যুবতী ও বাচ্চা মেয়ে। এদিকে আনতারা বেগম মারা যান। খোদেজাও অসহায় হয়ে পড়ে।

আলীহুজুর একসময় খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন উনার মেয়ে সোফিয়ার শ্বশুরবাড়ি এই সুলতান মহলে। তিনি এসে দেখলেন সোফিয়ার জ্বালায় অতিষ্ঠ সকলে। উনার পরামর্শে সলিমুল্লাহ সাহেব একাহাতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। আর সোফিয়াকে হাত পায়ে শিকল পড়ানোর আদেশ দেন। সোফিয়া এতে ভীষণ ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে। হিংস্র বাঘিনীর চিৎকার করতে থাকে।
মহলের নিরাপত্তার জন্য সলিমুল্লাহ সুলতান আলীহুজুরকে রেখে দেন মহলে।
আর একসময় সেইদিনটা আসে। দাউদাউ করে জ্বলে উঠে সোফিয়ার সেই কক্ষটি যেখানে তাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। পাশাপাশি শেরহামের কক্ষও ছিল। তাতেও আগুন লেগে যায়। তার মরণ-চিৎকার সেদিন শেরহাম খুব কাছ থেকে শুনেছিল। জ্ঞান ফেরার পর কালো পোঁড়া একটা লাশ দেখেছিল সে। পরাজয় সইতে না পেরে সোফিয়া অপঘাতে মারা গিয়েছিল।
সন্তানদের জন্য তা দুঃখজনক হলেও গোটা নগরের জন্য সেদিনটা ছিল আনন্দের। মায়ের মৃত্যুর শোক থেকে বেরোতে প্রায় বছর খানেক সময় লেগেছিল শেরহামের। একা ঘরে চুপটি করে বসে থাকতো সে। তারপর একা একা বেরিয়ে যেত কোথায়। লতিফের লোকবল তাকে নিয়ে যেত তাদের সাথে। সেখান হতে শেরহামের জাদুবিদ্যার হাতে কড়ি। তারা বুঝায় তার মাকে সবাই মিলে মেরেছে। পাঁচ বছর ধরে বন্দি করে রেখে তারপর আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে।
সে ধীরেধীরে হিংস্র হয়ে উঠে। সলিমুল্লাহ সাহেব সবটা জানতে পেরে তাকে ফিরিয়ে আনতে চায় সঠিক পথে কিন্তু শেরহাম তখন শক্তসমর্থ কিশোর। তার সাথে পেরে উঠা সম্ভব ছিল না। তাকে বন্দি করতে চায়নি কেউ।
শেহজাদের নামে মা আগেও তাকে বলতো। সে বিশ্বাস করতো না। কিন্তু ধীরেধীরে বুঝতে পারলো সবাই তাকে নয় শেহজাদকে ভীষণ ভালোবাসে, শেহজাদকে সবকিছুর অধিকার দিয়েছে, শেহজাদকেই ভবিষ্যৎ সম্রাট হওয়ার জন্য ঘোষণ করছে। সলিমুল্লাহ সাহেব মৃত্যুপথযাত্রী ছিলেন। তাই নিজের তরবারিটা বুদ্ধিমান, সৎ ও সাহসী শেহজাদের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন শেরহামের মধ্যে উনি কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে না। তাই সবকিছুর দায়িত্ব পড়বে শেহজাদের উপর। উনি মারা গেলেন কিছুদিন পর। কিশোর শেহজাদকে নিয়ে সকলের মাতামাতি দেখে প্রতিহিংসায় জ্বলে উঠে সে। জাদুকরদের প্ররোচনায় শুরু করে সকল অপকর্ম। শেরতাজ সাহেব জানতে পেরে তাকে সাবধান করে কিন্তু সে সাবধানবাণী শোনেনা। দিনের পর দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে। শেরতাজ সাহেব তাকে তাজ্যপুত্র ঘোষণা করে। মহল থেকে বের করে দেয় ঝড়বৃষ্টির রাতে। সে নদীতে গিয়ে ঝাঁপ দেয়। সেবার নদীতে অনেক মরা লাশ ভেসে উঠেছিল তাই সবাই ভেবেছিল সে মারা গিয়েছে। অথচ সে গিয়ে পড়েছিল এক ডাকাত সর্দারের হাতে।

চলমান…..

রিচেক করা হয়নি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে