প্রিয় বেগম ২ পর্ব-১৪

2
1558

#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_১৪
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

[ ১৩ পর্বে বলা হয়েছিল ফাদারের পুত্র। এটা ভুল লেখা ছিল। ফাদার’রা বিয়ে করেন না। ]

এমিলিকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে পাঠানো হয়েছে। অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। শেহজাদের চেঁচামেচিতে চুপ হয়ে আছে সবাই। সাফায়াত কি বলবে খুঁজে পেল না। মনে মনে সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে। বেচারী রূপা জানলে ভাইজানকে যুদ্ধে আহ্বান করবে।
শেহজাদ এশার নামাজ পড়েনি। নিজেকে অপবিত্র ঠেকছে। নির্লজ্জ মেয়েটা এরকম কাজ করে বসবে ভাবতেই পারেনি।
রাতে তার কামরায় খাবার নিয়ে মরিয়ম এসে বসে। বলে,

‘ ওর উপর রেগে থেকো না। ‘

শেহজাদ ঘাড় ফিরিয়ে মারিয়ামের দিকে তাকালো রোষাবিষ্ট চোখে। কটমট গলায় বলল,

‘ ওর কি মাথা খারাপ? আমি বিবাহিত জেনেও কিভাবে এসব করতে পারলো? ‘

বিবাহিত শুনে মরিয়ম দাঁড়িয়ে যান। শুনে খুশি হন। অসুস্থ শরীরটা নাড়িয়ে এগিয়ে এসে শেহজাদের গালে দুহাত রেখে পরম মমতা ঢেলে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করেন,

‘ বাচ্চা হয়েছে তোমাদের? ‘

‘ নাহ। ‘

মরিয়ম কিছুক্ষণ চুপ থাকে। শেহজাদের উনার মুখের দিকে তাকায় ধীরেধীরে । মা খোদেজার মতো মা ভাব ভাব আছে উনার মধ্যে। তা চাইলেও উপেক্ষা করা যায় না। সে চোখ সরিয়ে নেয়। মরিয়ম বলে,

‘ তোমার মধ্যে তোমার বাবার প্রতিচ্ছবি আছে। আঠাশ বছর পর আমার জীবনে আনন্দ নিয়ে এসেছ তুমি। আমার সব আয়ু তোমার হোক। আমি বেশিদিন আর বাঁচবো না। শেষবার যদি তোমার মুখটা দেখে মরতে পারতাম জীবনের সব দুঃখ ঘুচে যেত। ‘

শেহজাদ চোখ সরু করে নরম কন্ঠে বলল,

‘ কে বলেছে বেশিদিন বাঁচবেন না? ‘

‘ অসুখ বেড়েছে। বারো মাসে তের অসুখ। নিজের কাজকর্মটুকু করতে পারিনা। অন্যের উপর বোঝা হয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না। ‘

‘ বোঝা হবে কেন? আপনাকে কি কেউ এখানে দেখভাল করেনা? ‘

মরিয়ম চুপসে যায়। স্মিত হেসে বলে,

‘ বাদ দাও ওসব কথা। চলো তোমাকে খাইয়ে দেয়। মুসলমান পাড়ার একটা মেয়ে এসে রেঁধে দিয়ে গেল তোমার জন্য। খুব পরিচ্ছন্ন তার রান্না। খাবে মায়ের হাতে? ‘

শেহজাদ মাথা নাড়ালো। মরিয়ম খুশি হয়ে ভাত মেখে তার মুখের সামনে ধরলো। শেহজাদ খেতে খেতে বলল,

‘ আমার মনে হচ্ছে কেউ আপনার যত্ন করে না। আমি কারো দোষ দেব না। কিন্তু আপনার এত সহায় সম্পত্তি। আপনার উচিত ছিল না একজন কাজের মানুষ রাখতে আপনার জন্য? ‘

মরিয়ম চুপ করে রইলো। বলল,

‘ তুমি এখানকার পরিস্থিতি বুঝবে না ইউভান। সে যাইহোক, এমিলির মা বাবা তোমার আচরণে কষ্ট পেয়েছে। ‘

‘ তাতে আমার কিচ্ছু করার নেই। সে তার কর্মফল ভোগ করছে। ‘

মরিয়ম খাইয়ে দিতে দিতে বলল,

‘ তোমার পালিত মাতা তোমাকে নিশ্চয়ই খুব ভালোবাসে? তোমাকে ভালো শিক্ষা দিয়েছেন উনি। ‘

‘ মা মা-ই হয়। পালিত পর শব্দগুলো মায়ের সাথে যায় না। ‘

মরিয়ম ঠোঁট এলিয়ে হাসে। বলে,

‘ আমি কেমন মা? ‘

শেহজাদ পানি খেয়ে বলে,

‘পেট ভরে গেছে আমার। ‘

মরিয়ম ভুক্তাবশেষ বাসনের এককোণায় রেখে বলে,

‘ এগুলো আমার মায়েদের জন্য অমৃতসরূপ। ‘

চোখের কোণায় জল চিকচিক করে উনার। বলেন,

‘ আমাকে আপনি নয়, তুমি বলে ডাকো ইউভান।’

শেহজাদ মৃদু মাথা হেলে বলল,

‘ ঠিক আছে। ‘

মরিয়ম বাসন নিয়ে যাওয়ার সময় তার দিকে ফিরে তাকায়। বলে,

‘ যাওয়ার সময় একবার মা ডেকে যেও সোনা। ‘

শেহজাদ তাকিয়ে থাকে।

___________

অপরূপা সৈন্যদের কাছ থেকে জাহাজের খবর নেয়ার পর কক্ষে ফিরে এসেই শুনতে পায় অনুপমার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছে। ফজল সাহেব বলেন, শেহজাদ নেই। নইলে আজই পাড়ি দিতাম।
অপরূপা বলল, ‘ উনি ঔষধ খাননি? ‘
‘ খেয়েছে। জ্বর পড়তে সময় লাগবে। ‘
‘ ওহহ। ‘
ফজল সাহেব তার চেহারা দেখে বললেন,
‘ বলি কি রূপা মা। মায়ের পাশে গিয়ে একটু বসো। হতেও পারে তুমি তোমার মাকে ভুল বুঝে আছ। হুট করে একদিন পৃথিবী ছাড়লে তারও আফসোস থেকে যাবে, তোমার অনুতাপ থেকে যাবে। হায়াত মওত আল্লাহর হাতে। বলা তো যায় না কোন সময় কি বিপদ ঘটে। ‘
অপরূপা উনার কথায় গুটিগুটি পায়ে হেঁটে অনুপমার কক্ষের দিকে পা বাড়ায়। কক্ষে প্রবেশ করে দেখে অনুপমা চোখ বুৃঁজে আছে। গা কাঁথা দিয়ে ঢাকা। সে পাশে বসতেই অনুপমা চট করে চোখ মেলে তাকায়। জ্বরের ঘোরে তার চোখদুটো লাল হয়ে আসে। অপরূপাকে দেখে উঠে বসতে চাইলো। অপরূপা বাঁধা দিয়ে কপালে হাত দিয়ে বলল,
‘ জ্বর তো বেশি। কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? ‘
অনুপমা তার হাত কপালে চেপে ধরে রাখে। হাতটাতে চুমু দেয়। তারপর বুকে চেপে ধরে বলে,
‘ তুমি আমার সাথে দুটো কথা বলো। আমাকে বলতে দাও। আমার আর কিচ্ছু চাই না মা। ‘
অপরূপার চোখ ভারী হয়ে আসার উপক্রম। ঝুঁকে মায়ের বুকে মাথা রাখতেই ঝরঝরে কেঁদে ফেলে অনুপমা। অপরূপাও কাঁদে। অনুপমা তাকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কপালে গালে পরম মমতাভরে আদর করে কাঁদতে থাকে। কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে মা মেয়ের এরূপ দৃশ্য দেখে ফজল সাহেব প্রশান্তির হাসি হাসেন। বুকের উপর হতে মস্তবড় পাথর নেমে গেল যেন। অপরূপা মাকে জড়িয়ে ধরে গল্প করতে করতে মায়ের বুকেই ঘুমিয়ে পড়ে। অনুপমা ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করে। আজ সবচাইতে সুখী মানুষ সে।

__________________

ঘাটে জাহাজ এসে নোঙর ফেলতেই সৈন্যরা খবর নিয়ে আসে শেহজাদের কাছে। শেহজাদ প্রস্তুতি নেয়। মরিয়ম ছুটে আসে। শেহজাদ সেই তৈলচিত্রটি নিজের সাথে নিয়ে নেয়।
তার দুই চাচাদের উপর ভীষণ ক্ষেপেছে সে। তার মাকে অবহেলায় ফেলে রাখার জন্য। সব সহায় সম্পত্তি নিজেদের নামে করে তার মাকে দিনের পর দিন সবকিছু হতে বঞ্চিত করেছে সবাই।
মরিয়ম তাকে বারণ করলো, কোনো বিবাদে না জড়াতে। তার সহায় সম্পত্তি কিছু চায় না। মেঝ চাচা বলে, তোমার মাকে দেখভাল না করলে বেঁচে আছেন কি করে? মরার আগপর্যন্ত আমাদেরকেই তো দেখতে হবে। তুমি এমিলিকে বিবাহ করো। এখানে মা স্ত্রী সংসার নিয়ে থেকে যাও। তোমার অধিকার তুমি ফিরে পাবে।
শেহজাদ তাদের মুখের উপর বলল, আমি আমার মাকে নিয়ে যাব এখান থেকে। ‘

সাফায়াত একটা চাদর নিয়ে তার হাতে দেয়। শেহজাদ তা দিয়ে মরিয়মের মাথা ঢেকে দিতে দিতে হঠাৎই মরিয়মের চোখের দিকে চোখ পড়তেই দেখে মায়ের চোখে সমুদ্র। চোখের পলক পড়তেই তা গড়িয়ে পড়তে লাগলো। তিনি কখনোই ভাবেননি ইউভান তাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলবে। মনেপ্রাণে ঈশ্বরের কাছে এটাই প্রার্থনা করছিলো সে। যে তাকে মানুষ করেছে তার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে তাকে। ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে।
শেহজাদ চাদর জড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘ আমার সাথে যেতে কোনো অসুবিধে মা? ‘

মরিয়ম সাথে সাথে মাথা নাড়তে থাকে। শেহজাদ হাসে। মরিয়ম তাকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে। সাফায়াত এসে ছোটস্বরে বলল,

‘ ভাইজান এমিলি তেড়ে আসার আগে দ্রুত চলুন। জাহাজ অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। ‘

শেহজাদ মাকে ছেড়ে শক্ত করে হাতটা ধরে বলে, ‘ চলো রূপনগরে। তোমার সেবা করার মানুষের অভাব হবে না মা। ‘

মরিয়ম গাল মুছে। শেহজাদ মহল ত্যাগ করে। তারপর চার্চের দিকে চলে যায়। মরিয়ম চার্চে গিয়ে ঘন্টা বাজিয়ে প্রার্থনা সেড়ে চলে আসে। ফাদারের কাছে নিয়ে যায় শেহজাদকে।
ফাদারের সাথে চার্চ হতে বেরিয়ে আসে তারা। যায় শেহজাদের পিতার সমাধিস্থলে। কংক্রিট ও সাদা মার্বেল পাথরের ঢালাই করা অনেকগুলো সমাধি গোরস্থানটাতে। শেহজাদের পিতার সমাধির পাশেই তরতরিয়ে বেড়ে উঠেছে ফুলগাছ। মরিয়ম মুখে কাপড় গুঁজেন। শেহজাদ নীরব চোখে চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ। মরিয়ম বলে, ‘ তোমার পিতা তোমাকে হারানোর পর অনেক পাগলামি করেছিল। অনেক খুঁজেছিল। ‘
শেহজাদ সমাধিফলকে হাত বুলিয়ে দিল। বুকের ভেতরটা কেমন ভার হয়ে উঠলো। তারপর মাকে নিয়ে চলে এল জাহাজে। মায়ের পাশে বসলো। সাফায়াত মরিয়মের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে হাসছিল। মরিয়ম বলল, তুমি তো খুব পাজি ছেলে। বিয়ে করেছ?

শেহজাদ বলল, ‘ না পাত্রী দেখবো। ও যে বড় হয়ে গিয়েছে আমার খেয়ালই নেই। ‘

সাফায়াত মাথা চুলকে হাসলো। মরিয়মের চোখে ঘুম নামলো। শেহজাদ মাকে বুকে আগলে ধরে মাথায় চিবুক ঠেকিয়ে ভাবতে লাগলো রূপার কথা। কোথায় এখন সে? রূপনগরে পৌঁছে একমুহূর্তও দাঁড়াবে না সে। আবারও বেরিয়ে পড়বে রূপাকে খোঁজার জন্য।

সন্ধ্যা নাগাদ ঘাটে এসে জাহাজ থামলো। তার সৈন্যদের পাশাপাশি শেরহামের সৈন্যদের দেখা যাচ্ছে। একটা পাথরের উপর শেরহামকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। একটা জাহাজ এগিয়ে আসছে এদিকে। কিসের জাহাজ সেটি?
শেরহাম তার সাথে মরিয়মকে দেখে কপাল কুঁচকে চেয়ে থাকলো। বলল, ‘ ভাবলাম রূপনগর স্বাধীন। না তা হওয়ার নয়। ‘
শেহজাদ বক্র হেসে বলল, ‘ রূপনগর সেদিন স্বাধীন হবে যেদিন সেখানে শেরহাম সুলতান থাকবে না। ‘
শেরহাম রোষাবিষ্ট চোখে চেয়ে থাকে।

সৈন্যরা জানালো বেগম তারপরের দিন ফিরে এসেছেন। উনি রূপনগরেই ছিলেন। শেহজাদ রূপাকে দেখার জন্য উত্তেজিত অনুভব করলো। পালকিতে তুলে দিল মরিয়মকে। আর সে চড়ে বসলো ঘোড়ার পিঠে। টগবগিয়ে ছুটে চললো সুলতান মহলের উদ্দেশ্যে।
তাকে ফিরতে দেখে মহলে একপ্রকার হৈচৈ পড়ে গেল। শেহজাদ দেখলো মহল প্রাঙ্গনে কাঠপোড়ার ছাই, ধূপগন্ধী, জবা ফুল আরও হরেক রকমের জিনিস ছড়ানো ছিটানো। সে মরিয়মকে পালকি থেকে নামিয়ে একহাতে জড়িয়ে ধরে চারপাশটা দেখিয়ে বলল,

‘ এটা সুলতান মহল। ইউভান এখানেই থাকে মা। ‘

মরিয়ম মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগলেন। বোনেরা সকলেই ছুটে আসে। বাবা জেঠুরা আসে। খোদেজাও ছুটে আসে। দেখে এক পৌঢ়া মহিলাকে সযত্নে আশপাশে দেখিয়ে কথা বলতে বলতে নিয়ে আসছে শেহজাদ। শেহজাদ সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় মরিয়মকে দেখিয়ে।

‘ ইনি আমার মা। ইউভানের মা। আজ থেকে মহলে থাকবেন । ‘

শেরহামের ঘোড়া এসে থামে তার পেছনে। মহলে প্রবেশ করতে করতে সবটা শুনে মরিয়মের দিকে তাকায়। যে কেউ প্রথম দেখায় বলে দেবে তারা মা ছেলে। শেহজাদ তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,

‘ আমি ভিখারিনীর ছেলে নই। আমি রাণীর ছেলে। তাই না মা? ‘
মরিয়ম হাসে।
খোদেজা নিজেকে আড়াল করে রাখে। রূপা উনাকে কক্ষের দিকে চলে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করে, আপনার পুত্রের সাথে দেখা করেননি? ‘

খোদেজা উত্তর দেয় না। কক্ষে চলে যায়। অপরূপা এসে মরিয়মকে দেখে। শেহজাদ তাকে দেখে তাকিয়ে থাকে। অপরূপা সবার মুখে মুখে সবটা শুনে। সায়রা তটিনী মরিয়মের সাথে নিজেদের পরিচয় করিয়ে অপরূপাকে দেখিয়ে বলে,

‘ আপনার ইউভানের বেগম। ‘

মরিয়ম মুগ্ধচোখে তাকিয়ে বলে,

‘ কি স্নিগ্ধ! ‘

অপরূপা ভুলেও শেহজাদের দিকে তাকালো না। মরিয়মকে অন্দরমহলে রেখে শেহজাদ খোদেজার কাছে চলে যায়। অপরূপা মরিয়মকে নিয়ে যায়।
খোদেজা পা টেনে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শাহজাহান সাহেব উনাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, ‘ শেহজাদ দেখলে কি মনে করবে? বলবে তার মাকে তুমি সহ্য করতে পারছো না। ‘
খোদেজা কথা বলে না। শাহজাহান সাহেব আবারও বলেন,
‘ ও তোমাকে আর মা না ডাকলে একটা কথা। ‘
খোদেজা গর্জে বলে, ‘ এখান থেকে যান আপনি। ঘ্যানঘ্যান করবেন না। ‘

শাহাজাহান সাহেব বেরিয়ে যাওয়ার সময় শেহজাদকে দেখে। মাথা নাড়তে নাড়তে চলে যান।
শেহজাদ কক্ষে প্রবেশ করামাত্রই খোদেজা গালমুছে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। শেহজাদ মায়ের পাশে বসে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘ কেমন আছেন আম্মা? ‘

খোদেজা হু হু করে কেঁদে উঠে। বলে,

‘ কে তোমার আম্মা। আমি তোমার আম্মা নই। ‘

‘ আপনিই আমার আম্মা। আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি আম্মা। আমি আপনার কাছে মাকে আমানত রাখলাম। উনি জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছেন। ‘

খোদেজা তার কপালে চুমু এঁকে বলে ‘ আমি তোমাকে কারো কাছে দেব না। ‘

‘ কেউ আমাকে নিয়ে যাচ্ছে না। আপনার কাছ থেকে নেয়ার কথা ভাবতেই পারে না। ‘

মায়ের সাথে মান-অভিমান মিটিয়ে নেয়ার পর কক্ষের দিকে পা বাড়ালো সে। অপরূপা আলমিরা হতে কি যেন বের করছিল। শেহজাদ দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে তুলে নিয়ে কাঁধে মুখ ডুবিয়ে আদর করতেই অপরূপা এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বের হয়ে গেল শাড়িটা হাতে নিয়ে। শেহজাদ ডাকলো,

‘ এই মহিলা। ‘

অপরূপা শব্দ করে হাঁটলো। ফিরেও তাকাল না।

শেহজাদ সদর কক্ষে যাওয়ার পথে তটিনীকে দেখে। তার মলিন মুখ দেখে জিজ্ঞেস করে,

‘ কি হয়েছে? ভাইজান কি তোমার সাথে খুব কঠোর আচরণ করে? ‘

‘ উনি ভালো আচরণ করার মানুষ? ‘

‘ তাহলে কেন কাউকে কিছু বলছো না? তোমাকে এভাবে দেখলে আমার নিজেকে দোষী মনে হয়। আমি কাল কাজী ডাকবো। তুমি খুলা(তালাক) দাবি করো। কোনো ভয় নেই। উনি কিচ্ছু করতে পারবেন না। আমি আছি। ‘

শিঁস বাজাতে বাজাতে শেরহাম উপস্থিত হয় সেখানে। তটিনী চোখ বড়বড় করে তাকায়। শেরহাম যেতে যেতে তটিনী হাত ধরে শেহজাদের দিকে রক্তচোখে চেয়ে বলল,

‘ আমার বউ। আমি তালাক দেব নাকি রাখবো সেটা আমার ব্যাপার। তুই তোর পিঠে তেল দে। সর। ‘

তটিনী হাত ছাড়িয়ে শেহজাদের পেছনে এসে দাঁড়ায়। শাহানা হামিদা খোদেজা ছুটে আসে শেরহামের চেঁচামেচি শুনে। শাহানা পরিস্থিতি বুঝে তটিনীকে নিজের পেছনে নিয়ে এসে বলে,

‘ আমি এতদিন কিচ্ছু বলিনি তোমাকে। কিন্তু আর সহ্য করব না। তোমার কাছে মেয়ে রাখবো না আমি। তোমার বউ পরে, আগে ও আমার মেয়ে। তোমার মতো মানুষের সাথে ওর জীবন জড়াতে দেব না আমি। ‘

শেরহাম বিকট শব্দে চেঁচিয়ে বলে,

‘ আমি যেটা চাইবো সেটাই হবে। যাও কি করার করো।’

বলেই তটিনীর দিকে তাকালো অগ্নিময় দৃষ্টিতে। তারপর হনহনিয়ে বারান্দায় গেল। বন্দুক নিয়ে মহল প্রাঙ্গনের দিকে গুলি ছোঁড়া শুরু করতেই সকলেই আতঙ্কে দেবে গেল। শেহজাদ বারান্দায় গিয়ে ওর হাত থেকে গুলি নিয়ে গর্জে বলল,
‘ মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে তোমার? ‘
শেরহাম ওর হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয়ার জন্য হাতাহাতি শুরু করলো। উন্মুক্ত সিংহদ্বারের বাইরে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে কেউ একজন ধনুক তাক করলো তাদের দিকে। তীরটা ছুটতে ছুটতে এসে শেরহামের কাঁধের একপাশে গেঁথে যেতেই সে ছিটকে পড়ে গেল। শেহজাদ হতভম্ব। সকলেই ছুটে এল চিৎকার শুনে।
তটিনী এসে কেঁদে ওঠে তীর ছাড়িয়ে নিয়ে শেরহামের মুখ ধরে ডাকাডাকি করে বললো,

‘ কে মেরেছে? ‘

শেহজাদের আদেশে সৈন্যরা ছুটে গেল সিংহদ্বার পেরিয়ে। শেরহামকে ধরাধরি করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হলো। সে হাসপাতাল থেকে চলে এল রাতে। কোন কু**ত্তার বাচ্চা একাজ করেছে তাকে ধরে উত্তমমধ্যম দিয়ে মারা ছাড়া তার শান্তি নেই। সোজা জ** বা – ই করে ছাড়বে। কক্ষে এসে দেখলো খাবার রাখা নেই। হাসপাতালে থাকবে বলে তটিনী খাবার রেখে যায়নি। সে তটিনীকে কক্ষ থেকে বেরিয়ে ডাক দিল।

‘ এই তনী! তনীর বাচ্চা! তাড়াতাড়ি বের হ। মরে গিয়েছিস নাকি? বের হ। তোকে তালাক দেব। ‘

তটিনী শোয়া থেকে উঠে বসলো। বুক ধড়ফড় করে উঠলো। মনের দোলাচালে ভুগলো সে। ইচ্ছে হচ্ছে ছেড়েছুড়ে চলে যেতে। কিন্তু অদৃশ্য এক বাঁধা, লজ্জা তাকে আটকে রেখেছে।

শেরহামের চেঁচামেচি শুনে সকলেই বেরিয়ে আসে। কাউকে পরোয়া না করে সে দরজায় কড়া নেড়ে চেঁচামেচি করতে থাকে একনাগাড়ে।
সায়রা,সোহিনী, শবনম আর আয়শা তটিনীর দিকে চেয়ে থাকে। তটিনী ওদের পিছু করে বসে কাঁদতে থাকে। বুঝতে পারে না কেন এত খারাপ লাগছে তার। শেরহামের কন্ঠস্বর নিভে আসে। শাহানা বলে, ও তোমার মুখোমুখি হতে চায় না।

শেরহাম দাঁত চিবিয়ে বলে, সব কটাকে মহল থেকে বের করে দেব। কাল সকালে সবাই বেরিয়ে যাবি। আমার ঘাড়ে খেয়ে আমার সাথে শত্রুতা করছিস সবাই মিলে।

তটিনীর উদ্দেশ্যে বলল,
‘ তুইও নাটক শিখেছিস ওদের কাছ থেকে? এখন বের না হ। কাল সকালে বের হবি না? এক কো**পে মারবো। ‘

বলেই দরজায় লাতি দিয়ে চলে গেল। তটিনী শুয়ে পড়লো ধপাস করে। বালিশে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগলো। সোহিনী গিয়ে খাবার দিয়ে এল। শেরহাম তাকে জিজ্ঞেস করলো,

‘ তনী কোথায়? তুই এসেছিস কেন?’

সোহিনী সাহস দেখিয়ে প্রথমবারের মতো বলল,

‘ আপু কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর সাথে তোমার শত্রুতা নেই। তাই ওকে ছেড়ে দাও। ‘

শেরহাম কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজলো। তা ঠিক। তটিনী তার কোনো কাজে আসছে না। নিজের সাথে জড়িয়ে রাখার কোনো মানে নেই। কাল তালাক দিয়ে দেবে সে।

চলবে..

2 মন্তব্য

  1. ভাবতাছিলাম, পুরাটা গল্প শেষ হ‌ইলে একবারে পরমু,,,,,,, কিন্তু মনটা কেমন জানি নিশপিশ করে,,,,,, গল্প টা পড়ার লাইগ্যা ,,,,,,,, 😁😁😁😁

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে