#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_১৩
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
সকাল নাগাদ অপরূপা মহলে হাজির হলো। একটা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে। গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে দিল পয়সা দিয়ে। তারপর মহলে প্রবেশ করতেই সকলেই তাকে দেখে হতভম্ব। একেএকে হাজারও প্রশ্ন করে বসলো সবাই। অপরূপা নিজেও হতভম্ব। সে চিরকুট রেখে গিয়েছিল সবাই কি তা পায়নি?
সবার প্রশ্নের মুখে জানালো, সে একটা মসজিদের এক ইমাম সাহেবের কাছে গিয়েছিল। সন্দেহ হচ্ছিল শেহজাদের উপর জাদুটোনা করা হয়েছে তাই ওখানে গিয়ে কোরআনি চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে গিয়েছিল। ইমাম সাহেব জানালেন দু-তিনদিন সময় লাগবে তাই থেকে গিয়েছিল। কিন্তু তারমধ্যে সামাদ আর মুরাদের খপ্পরে পড়ে সে। কোনোমতে তাদের কাছ থেকে লুকিয়ে বাঁচলে টিংটিংকে বাঁচাতে পারেনি। তারা সাথে করে টিংটিংকে নিয়ে গিয়েছে।
অনুপমা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে লম্বা একটা দম নিলেন। অপরূপা চুপটি করে মায়ের বুকে পড়ে থাকলো। ছোট করে বলল,
‘ আমি ঠিক আছি। ‘
অনুপমা তাকে ছাড়লো। কিছু বলল না। খোদেজা এসে তার মুখে হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ টিংটিংকে কাশিম একটা লোকের কাছ থেকে কিনে নিয়ে এসেছে। সামাদ বোধহয় তাকে বিক্রি করে উল্টাপাল্টা কথা শিখিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ঘটনা তো যা ঘটবার তা ঘটে গেছে। শেহজাদ তোমাকে খুঁজতে ইন্দিরাপুরে গিয়েছে। জাহাজের খবর আসেনি এখন অব্দি। ‘
শাহজাহান সাহেব বললেন, বউ ফিরে এসেছে। তাই আমাদের আনন্দিত হওয়া উচিত। শেহজাদ সাফায়াত সকলেই আত্নরক্ষা জানে। রূপা তুমি বিশ্রাম করো। ‘
অপরূপা একটা পানির বোতল, কিছু আরবিতে লেখা কাগজ খোদেজাকে দিয়ে বলল, কাগজটা ডুবিয়ে পানি খাওয়াতে হবে উনাকে। সুস্থ হয়ে যাবেন।
খোদেজা তার কথায় স্মিত হেসে বলল, আমরা তার চিকিৎসা করেছি। ওর বাহুতে একটা তাবিজ পড়ানো ছিল। সেটা খুলে নিয়েছি। ও আগের চাইতে সুস্থ। চিন্তার কিছু নেই। ‘
হামিদা বলল, কি সাহসী মেয়ে! একা একা ওই জাদুকর দুটোর সাথে লড়াই করেছ? আমার তো ওদের দেখতেই ভয়ংকর লাগে। আর হ্যা তোমার পতিদেব এখন সুস্থ ঠিক কিন্তু বেগমকে না পেয়ে তো আরও অসুস্থ হয়ে উঠেছে। ‘
অপরূপা মলিন হাসলো। তারপর বলল,
‘ এগুলো রাখুন। ‘
অনুপমা জিজ্ঞেস করলো,
‘ আর কোথাও যেওনা মা। চারপাশে তোমার বিপদ। ‘
অপরূপা উনার দিকে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে বলল,
‘ শেরহাম সুলতানের সাথে কথা আছে। ‘
খোদেজা তার হাত ধরে রাখলো।
‘ কোনো দরকার নেই। সে আবারও জাদুটোনা করে মুখের কথা বন্ধ করে দেবে। নিজেকে বিবাদে জড়িওনা যতদিন অব্দি শেহজাদ ফিরে আসে। ‘
অপরূপা বলল,
‘ নাহ। উনি কি চান আমাকে জানতে হবে। যা চেয়েছে সবই তো পেয়েছে। তাহলে কেন এখনো এসব বন্ধ করছে না? ‘
খোদেজা তার হাত ধরে বলল,
‘ দোহাই লাগে। শেহজাদ নেই ও সাহস পেয়ে যাবে তোমাকে আঘাত করার। ওর মতো কাফের সব পারে। গলা টিপে মানুষ মারতেও দু’বার ভাবেনা সে। এমন করো না। রাগ সংবরণ করো। ধৈর্য ধরো। শেহজাদ ফিরুক। একটা না একটা মীমাংসা হবেই। ‘
অপরূপা গেল না। তটিনী চুপচাপ শুনলো কিছু বললো না। সোহিনী তাকে কিছু বলতে না দেখে আঁড়চোখে তাকিয়ে গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল সেখান থেকে।
সায়রা এসে অপরূপার কাঁধ ধরে নিয়ে যেতে যেতে ফিসফিস করে বলল,
‘ ভাইজান ফিরে এসে তোমাকে এমন বকুনি দেবেন। ‘
অপরূপা কপাল কুঁচকে তার দিকে তাকালো। বলল,
‘ আমাকে? ‘
‘ হুম। ‘
অপরূপা ভাবনায় মজে গেল। সে কথাই বলবে না।
তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। হোক জাদুর বশবর্তী হয়ে, কষ্ট তো দিয়েছেই। শেহজাদের ফেরার অপেক্ষায় দিন গুনতে লাগলো সে।
কুমুদিনীও মহলে ফিরে এল। তার মুখ হাত পা বেঁধে অতিথিশালায় ফেলে রেখেছিল শেরহাম।
তাকে দেখে অপরূপা ফোঁসফোঁস করে উঠতেই সে অপরূপার পা জড়িয়ে ধরে কেঁদেকেঁদে জানালো ওরা তাকে ভয় দেখিয়েছে, কথামতো কাজ না করলে জানে মেরে ফেলবে বলে, সে কথা শুনতে চায়নি, সে নিজেই জাদুর বশীভূত হয়েছিল। অপরূপা সবটা শুনে তাকে ক্ষমা করে।
কিন্তু তটিনী তার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না। তারমানে শেরহাম সুলতান তাকে বোকা বানাচ্ছে!
তার দুর্বলতা টের পেয়েই হয়তো তাকে বোকা বানিয়ে রাখার চেষ্টা করছে সে। ছিঃ! কতটা নিকৃষ্ট। নিজের উপর নিজের রাগ লাগলো তার। শেষমেশ তাকেও বোকা বানিয়ে ছাড়লো এই চতুর শেরহাম সুলতান। যার গায়ে মিশে আছে শয়তানের রক্ত। অথচ কতখুশি হয়েছিল সে। মনে হচ্ছিল এই বুঝি সব পাল্টে যাচ্ছে!!
অতিথি শালার দিকে হনহনিয়ে গেল সে। শেরহাম বিছানায় অস্ত্রসস্ত্রের মাঝে বসা ছিল।
তটিনী যেতেই চোখ তুলে তাকালো। হনহনিয়ে উঠে এসে বলল,
‘ বারবার বলেছি এখানে আসবি না। ‘
তটিনী সরোষে চেয়ে থেকে বলল,
‘ সত্যি করে বলো তুমি জাদুটোনা করেছ কিনা? সামেদ্দে মুরেদ্দেকে বেঁধে রেখেছে কেন? ‘
শেরহাম চোখ সরু করে বলল,
‘ আমি কাউকে কৈফিয়ত দিতে রাজী না। ‘
‘ আমাকে দিতে হবে। ‘
শেরহাম দাঁতে দাঁত চিবিয়ে এগিয়ে এসে হাত চেপে ধরে বলে,
‘ কেন? কে তুই? ‘
প্রশ্নের উপর তটিনীর টলটলে দিঘীর মতো চোখের জলে স্পষ্ট লেখা ছিল। শেরহাম বুঝেও বুঝলো না। ঘাড় ধরে বের করে দিল তটিনীকে।
তটিনী দরজায় মাথা ঠুকে দিয়ে কেঁদে উঠে বলল,
‘ আমি নতুন জীবনের দিকে যাব আর তুমি যাবে ধ্বংসের দিকে। তাহলে কেন আমাকে জড়ালে? ‘
শেরহামের পা জোড়া থমকে গেল।
______________________
শেহজাদ সমুদ্রতটে বসা ছিল সাফায়াতের সাথে। সৈন্যরা এসে জানালো চার্চের পাশেই একটা বড়সড় খ্রিষ্ট মহলের দেখা মিলছে। সেখানে তারা আশ্রয় চাইতে পারে। শেহজাদ দেরী করলো না। আবেদন পাঠিয়ে দিল তাদের আশ্রয় এবং রূপনগরে ফেরার জন্য সাহায্য চায়।
সেই মহলের শাসনকর্তা তাদের আবেদন মঞ্জুর করলেন। তাদের আশ্রয় দিলেন। তবে জানা গেল তারা খ্রিষ্টধর্মের। রূপনগরের সম্রাট পরিচয় পেয়ে তারা বেশ জাঁকজমক করে শেহজাদকে অভ্যর্থনা জানালো।
যিনি সেখানকার শাসনকর্তা তিনি সেই চার্চের ফাদার। বয়স্ক লোক। উনি চার্চে বেশিরভাগ সময় কাটান। বয়স হওয়ায় অতিরিক্ত কথা বলতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেন। শেহজাদকে দেখামাত্রই আপন করে নিলেন। মহলে থাকেন উনার পরিবার পরিজন। উনার ছেলেরা মহলের রক্ষক।
শেহজাদের খ্রিষ্ট মহলের প্রবেশ অত্যধিক সুন্দর ছিল যা সে কল্পনাও করেনি। তাদের আলাদা আলাদা শয়নকক্ষও দেয়া হলো। সাথে ভালো খাবার আর আরামদায়ক পোশাক। শেহজাদ খাওয়াদাওয়া সেড়ে ঘুমিয়ে পড়লো। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। যখন ঘুম ছুটলো তখন মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে গিয়েছে। সে নামাজ আদায়ের জন্য মহলের পেছনে সবুজ ঘাস আবৃত একটা জায়গায় চাদর বিছিয়ে নামাজ আদায় করে নিল।
ফাদারের দুই পুত্র এসে তাকে নামাজ আদায় করতে দেখে বলল,
‘ আমাদের বললে আমরা ব্যবস্থা করে দিতাম। ‘
শেহজাদ পেছনে দুহাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে জানালো, তার কোনো সমস্যা হয় না। দেশবিদেশ ঘুরতে গেলে তাকে এভাবেই নামাজ আদায় করতে হয়।
উনারা শেহজাদের সাথে কথা বলতে বলতে শেহজাদকে মহলের চারপাশে ঘুরে ঘুরে গল্প করতে লাগলেন।
হঠাৎ চোখ গিয়ে পড়লো বারান্দায় একটা যুবতী মেয়ের দিকে। সাথেসাথেই চোখ সরিয়ে নিল সে। কিন্তু যুবতীর চোখদুটো তাকে নিবদ্ধ করে রেখেছে সেই কবে থেকে। কালো যিবিন আর মাথায় প্যাঁচানো বাদামি রঙের পাগড়ি পরিহিত সুকুমার পুরুষ তার হৃদয় উদ্বেলিত করেছে। তাকে দেখার পর হতে তার হৃদকম্পন কিছুতেই থামছেনা। তাকে দেখার জন্য সারা মহলে ছোটাছুটি করেছে তখন থেকে, কখন সেই মানবকে আবারও দেখতে পাবে।
যুবতীর পিতা তাকে দেখে ডাকলো, ‘ এমিলি এসো এদিকে। ‘
এমিলি ছুটে এল। বয়স বাইশ তেইশের কৌটায় হবে। অত্যাধিক রূপসী আর লাস্যময়ী। তার পিতা মেয়েটির সাথে শেহজাদের পরিচয় করিয়ে দিল।
‘ সে আমার কন্যা। এমিলি খ্রিস্ট। কন্যা ইনি হচ্ছেন রূপনগরের সম্রাট। শেহজাদ সুলতান।’,
এমিলি হেসে চোখ নিভিয়ে মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে বলল,
‘ আমরা আনন্দিত আপনাকে পেয়ে। ‘
শেহজাদ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বলল,
‘ ধন্যবাদ। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া উনি এমন মানুষদের আশ্রয়ে রেখেছেন। ‘
এমিলি হাসলো। বলল,
‘ বাবা আমি তার সাথে আরও আলাপ করতে চাই।’
‘ হ্যা। কেন নয়। সম্রাট আপনি গল্প করুন। নৈশভোজের আয়োজন চলছে। ‘
এমিলি বলল,
‘ আপনি খানিকটা আমার বড় পিতার মতো দেখতে। ওদিকে আসুন। আমার বাগান। আপনার পরিবারে কে কে আছে?
শেহজাদ তার পেছনে শ্লথগতিতে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
‘ আম্মা আব্বা বোন..
তাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে এমিলি বাগানের ফুল ছিঁড়ে নিল। শেহজাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ আমার বাগানের ফুল কখনো ছেঁড়া হয় না। শুধু আজ ছিঁড়লাম। ‘
শেহজাদ অপ্রস্তুত হলো। বলল,
‘ আমি ফুল পছন্দ করিনা। ‘
এমিলি আবারও হাসলো। বলল,
‘ সত্যি? ফুলের মতো মানুষ ফুল পছন্দ করে না? অবিশ্বাস্য! ‘
শেহজাদ কাষ্ঠ হাসলো। তন্মধ্যেই সাফায়াত এসে এমিলির সাথে শেহজাদকে দেখে ভুরু কুঁচকে তাকালো। বেচারি রূপা এই দৃশ্য দেখলে ভাইজানের কপালে বেশ দুঃখ ছিল। সাফায়াত আসতেই শেহজাদ এগিয়ে এসে বলল,
‘ ঘুম ভালো হয়েছে?’
‘ জ্বি ভাইজান। ‘
‘ কাছাকাছি জাহাজ না আসা অব্দি আমাদের এখানে থাকতে হবে সাফায়াত। আর কোনো উপায় নেই। আমি জানিনা রূপা কোথায় আছে। তার চিন্তা আমাকে শান্তি দিচ্ছে না। আমাকে এত অবিশ্বাস কি করে করলো সে? ‘
‘ চিন্তা করবেন না। আল্লাহ আছেন। ‘
‘ হ্যা তিনিই ভরসা। ‘
এমিলি ফুলগুলো সাফায়াতকে দিয়ে বলল,
‘ আপনার বন্ধুর জন্য নিয়েছিলান। উনি নাকি ফুল পছন্দ করেন না। ‘
সাফায়াত ফুলগুলো ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো। এমিলি যেতেই শেহজাদ সাফায়াতের বোকাবোকা চেহারার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসতেই সাফায়াত বলল,
‘ ভাইজান! ‘
শেহজাদ দরাজ গলায় হেসে উঠে তার পিঠ চাপড়ে বলল,
‘ বাদ দাও। কাশীমকে নজর রাখতে বলো জাহাজ এলেই যেন খবর দেয়। ‘
_______
এমিলি চার্চে গেল প্রার্থনা করার জন্য। বহুদিন পর তাকে চার্চে দেখে তার গ্র্যান্ডফাদার অবাক হলেন। জানতে চাইলেন কারণ কি।
এমিলি সহাস্যে বলে উঠে,
‘ ফাদার আমি মনে মনে যেমন পুরুষ খুঁজছিলাম। তেমন একজনকে পেয়ে গিয়েছি। ‘
ফাদার হয়ত আন্দাজ করতে পারলেন। মহল আঙিনায় এমিলির পিতাদের সাথে হেঁটে হেঁটে গল্পে মগ্ন শেহজাদের দিকে তাকিয়ে বলল।
‘ সে? ‘
‘ হ্যা। আমার তাকে চাই। আপনি আমাকে বিবাহের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। আমি না বলেছিলাম। কিন্তু এখন আমি তাকে বিবাহ করতে চাই। ‘
‘ কিন্তু তার ধর্ম আলাদা। সে মুসলিম সন্তান। পরহেজগার বান্দা। তোমাকে সে গ্রহণ করবে না। ‘
‘ আমি কিছু জানিনা। আমার তাকে চাই। তার চলে যাওয়ার সময় হওয়ার পূর্বে আমি তাকে চাই। কিছু একটা করুন।’
ফাদার বেশ সময় নিয়ে ভাবলেন। শেহজাদের দিকে তীক্ষ দৃষ্টি বুলিয়ে ধীরকন্ঠে বললেন,
‘ প্রস্তাব পাঠাও তার কাছে। ‘
এমিলি ভীষণ খুশি হয়ে ঘন্টা বাজিয়ে দৌড় দিল।
মহলে প্রবেশের সময় শেহজাদের মুখোমুখি হতেই লজ্জা পেয়ে পুনরায় দৌড় লাগালো।
এমিলির পিতা হেসে বলল, ‘ আমার প্রিয় কন্যা। চলুন আপনাকে একটা জিনিস দেখাই। সবাই বলাবলি করছে আপনার মধ্যে আমার বড় ভাইজান আর উনার সহধর্মিণীর ছাপ পাওয়া যায়। ‘
শেহজাদ জানতে চাইলো।
‘কোথায় উনারা? ‘
‘ ভাইজান মারা গিয়েছেন। ‘
‘ ওহ। ‘
একটা সুশোভিত কক্ষে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে একজন অভিজাতীয় পোশাকে একজন পুরুষের তৈলচিত্র দেখতে পেল শেহজাদ। সাফায়াত বিস্মিত হয়ে বলল,
‘ হ্যা তাই তো। চোখ, কপাল, বিশেষ করে গালের দাঁড়ির সেই প্যাঁচটি আপনার মতোই ভাইজান। ‘
শেহজাদ কপাল ভাঁজ করে বলল,
‘ হতেই পারে। অবিশ্বাস্য কিছু নয়। এভাবে বলার কি আছে?’
এমিলির পিতা আরও একটা তৈলচিত্র দেখালেন। সেখানে ভদ্রলোকের সাথে তার স্ত্রী আর পুত্রের ছবি। মহিলাটির মুখের ছাপও তার সাথে মিল আছে। শেহজাদের পায়ের নীচের মাটি নড়ে উঠলো বাচ্চাটিকে দেখে।
তার কক্ষের একটা তৈলচিত্রে যে বাচ্চাটিকে দাদাজানের কোলে দেখেছিল এই সেই বাচ্চাটি।
শেহজাদ জানতে চাইলো।
‘ কে এই বাচ্চাটি? ‘
‘ সে আমাদের রাজপুত্র ইউভান খ্রিষ্ট। চিনতে পেরেছেন নাকি? ফাদার বলছেন আমাদের হারিয়ে যাওয়া ইউভান আপনিই। ‘
বলেই কেমন রহস্যময় হেসে উঠলেন উনি। শেহজাদ বাকহারা হয়ে পড়লো। ভদ্রলোক হাসতে হাসতে বলল,
‘ অবাক হচ্ছেন কেন? ‘
‘ না এ আমি নই। ‘
ভদ্রলোকের তার কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বলল,
‘ তুমিই আমাদের ইউভান। ফাদার তোমাকে দেখার পরই সন্দেহ করেছিলেন তাই তোমার আগমন এভাবে আয়োজন করে করার আদেশ দিয়েছিলেন। উনি অনেক জ্ঞানী একজন। তিনি ভুল করবেন না। ইউভানকে তার মা বাবার কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল জলদস্যুরা। তাকে আমরা অনেক খুঁজেছি, খুঁজে পাইনি। ‘
শেহজাদ সরে পড়ে গলা উঁচু করে বলল,
‘ না আমার পরিচয় একটাই। আমি ইউভান নই। ‘
অন্দরমহল হতে একটা পৌঢ় মহিলা ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো সেই কামরায়। শেহজাদ ফের অবাক হলো মহিলাটিকে দেখে। সাদা শাড়িতে মহিলাটিকে ভীষণ নম্র মনে হলো তার। মাথার চুল, বাদামী সাদা, চেহারায় অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট। অতি লাবণ্যময়ী তারপরও। চোখদুটোতে মায়া উপচে পড়ছে। কামরায় প্রবেশ করে তারদিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। ভদ্রলোক বলেন
‘ ইনি তোমার মাতা। মরিয়ম খ্রিষ্ট। তুমি ইউশাম আর মরিয়ম খ্রিস্টের সন্তান ইউভান খ্রিষ্ট। ‘
শেহজাদ দেখেছিল উনাকে মহলে আসার পর। তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিলেন আড়ালে দাঁড়িয়ে মুখে কাপড় গুঁজে । চোখে চোখ পড়ার পর মিষ্টি করে হেসেছিলেন। তারপর মমতাময়ী চোখে অপলক চেয়ে ছিলেন। যেন তৃষ্ণা মিটছেনা দেখেও। শেহজাদ ভেবেছিল উনি এখানকার কাজের লোক!
শেহজাদ হনহনিয়ে মহিলাটির পাশ কাটিয়ে বেরোতে যাবে মহিলাটি ডাক দেয়
‘ ইউভান! সোনা আমার। ‘
শেহজাদ থমকায়। মরিয়ম বলে উঠে,
‘ বুকের বাম পাশে তোমার একটা জন্মদাগ ছিল। আমি সেটা দেখতে চাইবো না। ফাদার যখন বলেছে তখন তুমিই আমার ইউভান। তুমি যখন থেকে মহলে পা দিয়েছ আমার মনটা আনচান করছে। ‘
শেহজাদ ফিরে তাকায়। মরিয়ম তার দিকে ফিরে টলটলে চোখে তাকিয়ে কান্না বিজড়িত গলায় বলল,
‘ যদি সেই দাগটি থেকে থাকে তারপরও তুমি অস্বীকার করবে তোমার মাকে? যে তোমাকে জন্ম দিয়েছিল। তুমি আমার রক্ত ইউভান। ‘
‘ আপনারা সবাই চালাকি করে আমাকে মহলে রেখেছেন আমি বুঝতে পারছি এবার। ‘
মরিয়ম তার দিকে এগিয়ে এসে বলে,
‘ আমার দিকে তাকাও। তোমার পর আমার কোলে আর সন্তান আসেনি। তোমার পিতাও মারা গিয়েছে। আমি তোমার মা। আমার রক্ত বইছে তোমার শরীরে। ফাদারের কথা ভুল হতে পারে না।’
শেহজাদ তাকায় না। বলে,
‘ আমি আজকেই যেভাবেই হোক রওনা দেব। ‘
বলেই সে পা বাড়াতেই এমিলির মুখোমুখি হলো। এমিলি বড়বড় চোখ করে বলল,
‘ ইউভান! ‘
শেহজাদ হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল।
সাফায়াত তার পেছন পেছন ছুটে বলল,
‘ ভাইজান দাঁড়ান। আপনার বুকে সত্যিই জন্মদাগ আছে। তারমানে উনি আপনার মা। ভাগ্য আপনাকে উনাদের কাছে নিয়ে এসেছে। আপনার সাথে আপনার মায়ের অনেক মিল আছে। আপনি উনাদের মতোন হয়েছেন। আপনি তো এতদিন এটাই চাইছিলেন। আপনি আপনার জন্মপরিচয় খুঁজছিলেন এতদিন। তাহলে কেন অস্বীকার করছেন?’
শেহজাদ কথা শুনলো না। তার কামরায় গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকলো। সে খ্রিষ্টান পরিবারে জন্মেছিল!
সন্ধ্যা নাগাদ তার কাছে এমিলিকে বিবাহের প্রস্তাব আসে। সাফায়াত তার কামরায় এসে হাসতে হাসতে ঢলে পড়ে। হাসির চোটে বলে,
‘ ভাগ্যিস রূপা এসব শুনছেনা। সে তো কেয়ামত ঘটিয়ে দিত। ‘
শেহজাদ ভাবলো,
‘ মোটেও না। রূপা তো তাকে ভালোবাসেনা। ভালোবাসলে অত অবিশ্বাস করতে পারে মানুষ?’
তার প্রত্যাখান শুনে এমিলি ক্ষেপে উঠে। আজ পর্যন্ত কারো সাহস হয়নি তাকে ফেরানোর। সে যা চেয়েছে তা নিজের করে নিয়েছে। আর সে তো ভুল কাউকে চেয়ে বসেনি। ইউভানকে চেয়েছে যে তার বড়পিতার ছেলে। সে কোনদিক দিয়ে কম?
উন্মাদের মতো ছুটে গেল শেহজাদের কক্ষে। শেহজাদ মা বাবা, আর তার তৈলচিত্রটি মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছিলো। এই পিতাকে সে কখনোই আর দেখবে না এই জীবদ্দশায়। মাতাকে পেয়েছে। উনাকে সাথে নিয়ে যাবে। একা রাখবে না। তৈলচিত্রটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, একসময় দেখে কামরার দরজা খুলে প্রবেশ করেছে এমিলি। গায়ে প্রশস্ত গলার ইয়েলেক ( ব্লাউজ), কোমর ঘাগড়া। বক্ষ বিভীজিকা আর নাভিপদ্ম উন্মুক্ত। শেহজাদ দৃষ্টি সরিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, বেরিয়ে যাও আমার কক্ষ হতে।
এমিলি ধপ করে দরজা বন্ধ করে এগিয়ে এসে বলে,
‘ কেন আমাকে বিবাহ করবে না ইউভান? ‘
‘ আমি ইউভান নয়। যাও এখান থেকে। আমার গায়ে ময়লা মাখতে এসো না। দূর হও। ‘
এমিলি তার কাঁধে হাত দিয়ে চেপে বলে,
‘ তাকাও আমার দিকে। তোমাকে বিবাহ করতেই হবে। কি কমতি আছে আমার মধ্যে? ‘
‘ আমি বিবাহিত আগেই বলেছি। তোমাকে যেতে বলেছি। আঘাত করতে বাধ্য করো না। ‘
এমিলি তার পিঠ আঁকড়ে ধরে মাথা রেখে বলে,
‘ বিবাহ করো নয়ত আমার সাথে মিলিত হও। আমি তোমাকে চাইছি। আমি এভাবে কাউকে চাইনি। আমাকে ফেরাবে না ইউভান। ‘
শেহজাদ তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলে,
‘আমি সেই ইউভান নয় যে তোমার কথায় সায় দেবে। দূর হও আমার সামনে থেকে। ‘
এমিলি এগিয়ে এসে খামচে ধরে তার বুকের যিবিন ছিঁড়ে ফেলতেই জন্মদাগটি স্পষ্ট হয়ে উঠে। এমিলি তা ছুঁয়ে বলে উঠে, ‘ তুমি সত্যিই ইউভান। আমাকে সঙ্গ দাও। ‘
শেহজাদ চোখ বন্ধ করে নিয়ে বলে,
‘ খোদার কসম আমি তোমাকে আঘাত করব। ‘
এমিলি তার বুক ঝাপটে জড়িয়ে ধরে এলোপাতাড়ি চুমু খেতেই শেহজাদ সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা প্রয়োগ করে গর্জন করে তলোয়ার দিয়ে হাতে আঘাত করতেই এমিলি চিৎকার দিয়ে মেঝেতে শায়িত হয়। শেহজাদ দরজা খুলতেই মরিয়মকে দেখতে পায়। আরও অনেকে। মরিয়ম জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে ইউভান? এমিলি চিৎকার দিল কেন? ‘
শেহজাদ চিবুক শক্ত করে রক্তাক্ত তলোয়ার ছুঁড়ে মেরে বলে,
‘ আপনাদের মেয়ের ঘাড়ে শয়তান বসেছে। তাকে সাবধান করুন আর জানিয়ে দিন পরনারী আমার কাছে বিষাক্ত কাঁটার ন্যায়। ‘
চলমান..