#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_১১
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
তটিনী ছাড়া পেয়ে উঠে খুকখুক করে কাশা শুরু করলো। নাকেমুখে পানি ঢুকে গিয়েছে। চোখদুটো রক্তিম হয়ে উঠে। কাশি বন্ধ হয় না। শেরহাম গায়ের পাঞ্জাবি খুলে পানিতে ধুঁয়ে মোচড়াতে মোচড়াতে তটিনীর দিকে ফিরে তাকালো। তার পড়নের সাদা কামিজে চুল ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। মাথা হতে চুয়ে চুয়ে বিন্দু বিন্দু জল গড়াচ্ছে। কাশতে কাশতে নিজেকে স্বাভাবিক করে শেরহামের দিকে চোখ পড়তেই হাত মুঠো করে শক্তপোক্ত করে কিল বসিয়ে দিল দু চারটে। তারপর চিবুক শক্ত করে বলল,
‘ নির্লজ্জ। মায়াদয়া তো রাখোনি নিজের মধ্যে একটুখানি লজ্জা অন্তত রাখো। কাপড়চোপড় খুলতে একটুও লজ্জা নেই। ‘
শেরহাম চোখ সরু করে নিরুত্তাপ কন্ঠে বলল,
‘ আমি মেয়েদের জিনিস দিয়ে কি করব? ‘
তটিনী চোখ কঠিন করে বলল,
‘ সেটাই তো কি বা করবে। কোথাকার উজবুক জন্তুজানোয়ারের সাথে নিকাহ হলো, মায়াদয়া, লাজলজ্জা কিছুর ছিঁটেফোঁটা নেই। দেখলেই আমার রাগ লাগে। ঘেন্না করে? ‘
‘ আমাকে ঘেন্না করে? ‘
তটিনী গলা উঁচু করে বলল,
‘ তো কি শরম করে বলব? ‘
শেরহাম ক্রুর হাসলো। তটিনী রাগে থাকতে না পেরে হাত বাড়িয়ে খামচে দিল। শেরহাম ফোঁস করে উঠতেই টুপ করল ডুব মেরে সে জায়গা থেকে সরে গেল। শেরহাম দাঁড়িয়ে থাকলো চুপচাপ। তটিনী ডুব দিয়ে উঠে শেরহামকে না দেখে এদিকওদিক তাকিয়ে পিছু ফিরতেই একদম নিকটে শেরহামকে দেখে ‘ওরেবাবা’ বলে সরে যাৃবে তক্ষুণি পুরুষালী হাতের গন্ডিতে বন্দি হয়ে জান যায় যায় অবস্থা হলো। পিঠটা একেবারে শক্তপোক্ত বুকের সাথে মিশে যেতেই পুরো শরীর কেঁপে উঠলো অকস্মাৎ। ভেজা নরম শরীরটা সামনে ঘুরিয়ে নিতেই তটিনী হাঁপিয়ে উঠে চোখ খিচিয়ে বন্ধ করে নিল। ভেজা চুল সামনে এসে মুখ গলা ঢেকে দিল।
দুহাতের স্পর্শে শক্তি হারিয়ে ফেলছে সে।
এই স্পর্শানুভূতি তার বাক কেড়ে নেয়, শক্তি শুঁষে নেয়, ধাবিত করে সেই অপর ব্যক্তির দিকে, নিজের সর্বনাশ জেনেও নিজেকে ফেরাতে ইচ্ছে করেনা তটিনীর। এই স্পর্শের প্রতি ধীরেধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে সে নিজের অজান্তে । যখনই সেই স্পর্শ সে পায় তখন সারাক্ষণ এই স্পর্শ পেতে ইচ্ছে করে। মনে হয় এই স্পর্শে দূষিত হয়ে গেলেও সে ক্ষান্ত হবে না।
অপরদিকে ক্ষমতালোভী, হিংস্র, নিষ্ঠুর পুরুষ তার শরীরের নিজস্ব সুবাসে মগ্ন হয়ে উঠে। তার শরীর এই সুবাস নাকে এলেই সে খেই হারিয়ে বসে। দিনদুনিয়া ভুলে যায়। ভুলে যায় নিজের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য। একবার পেলে আর ছাড়তে ইচ্ছে করেনা। এই কয়েকটা মুহূর্তগুলো যেন তার নিজের অজান্তেই আনন্দময় হয়ে উঠে। অদ্ভুত একটা শান্তি পায় সে। সে নিজে অস্বীকার করলেও তার মন স্বীকার করে যার কাছে তার মানসিক প্রশান্তি মিলে সে এই মেয়েটিই।
গাল, গলা, কাঁধ হতে লেপ্টে থাকা চুল বলিষ্ঠ আঙুলের সাহায্যে সরিয়ে গলার পাশে মুখ ডুবাতেই তটিনী সর্বশক্তি দিয়ে তার মাথার পেছনে হাত দিয়ে চেপে ধরে বড়সড় দম ফেললো। তার শরীর ততক্ষণে শেরহামের আয়ত্তে চলে গিয়েছে। শেরহাম তার শরীরটা নিজের সাথে চেপে ধরে মুখ দাবিয়েই রাখলো গলার ভাঁজে, ঠোঁটের চুম্বনে অস্থির করে তুললো তাকে। তটিনী নেতিয়ে পড়লো।
তারপর হঠাৎ কি যেন হলো এক ঝটকায় ফেলে দিল তাকে। পানিতে চুবে গিয়ে আবারও দাঁড়িয়ে পড়লো সে।
শেরহাম রক্তচোখে চেয়ে থাকলো তার দিকে। শক্ত বুকটা লাফাচ্ছে তার। হাতের মুঠো বারংবার শক্ত হয়ে উঠে।
তটিনী নিজেও গলার পাশে হাত চেপে ধরে অতি আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে। আবারও এই লোকের ছোঁয়ার জাদুতে বশীভূত হয়েছে সে। এমন অভিশপ্ত, শতমানুষের ঘৃণিত, লোভী মানুষের কাছে কখনোই সে হার মানতে পারেনা। কিছুতেই না।
একমুহূর্তও বিলম্ব না করে শেরহাম পানি থেকে উঠে গিয়ে গটগট পায়ে হাঁটা ধরে অতিথিশালার দিকে। নিজেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সে? এই সামান্য তুচ্ছ মানবীর কাছে সে কেন দুর্বল হয়ে পড়বে? তার দুর্বলতা সে নিজ হাতে মারে। একেও মারবে।
তটিনী ওড়নাবিহীন হওয়ায় গুটিগুটি পায়ে এগোয়। শেরহাম ফিরে আসে একটা চাদর নিয়ে। চোখের দিকে তাকায় না। তটিনীর দিকে চাদর ছুঁড়ে মেরে আবারও ফিরে যায়। তটিনী গায়ে চাদর ডেকে শেরহামের পিছু পিছু অতিথিশালার কক্ষে প্রবেশ করে। বলে,
‘ ভেজা পোশাকে মহলে যেতে পারব না। ‘
শেরহাম কুমুদিনীকে ডেকে পোশাক আনতে বলে। কুমুদিনী আশ্চর্য হয়ে পোশাক আনতে চলে যায়। শবনমকে বলে তটিনী পোশাক নিয়ে আসে। তটিনীকে পোশাক বদলানোর সুযোগ দেয়ার জন্য শেরহাম বাইরে বেরোতে যেতেই তটিনী ডাক দিয়ে বলে,
‘ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকো। তোমার চামচাগুলো নারীলিপ্সুক।’
শেরহাম দরজা পুরোপুরি বন্ধ না করে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। তটিনী পোশাক বদলে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। দরজা খুলে বেরিয়ে যেতেই শেরহামের মুখোমুখি হয়। শেরহাম অন্য দিকে চোখ রেখে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলে,
‘ আমি, আমার কাজ আর আমার সৈন্যদের থেকে দূরে থাকবি।’
‘ ওরা আমাকে বাজেভাবে ছুঁয়েছে। তুমি ওদের কিছু করবে না? আজ আমাকে অপদস্ত করার চেষ্টা করেছে কাল তোমার বোনকেও করতে পারে।’
‘ করুক। যাহ সামনে থেকে। ‘
‘ ভুলে গিয়েছি তুমিও ওদের মতো, সুযোগ পেলেই মেয়ে মানুষের সাথে নষ্টামি শুরু করে দাও। চোরকে শোনাচ্ছি চোরের গল্প। ‘
শেরহামকে কিছু বলতে না দিয়ে হনহনিয়ে মহলে চলে গেল সে। যাওয়ার পথে ডাক্তার সাহেব, আর উনার ভাইপো, ভাগ্নের সাথে পরিচয় হলো।
তারপর অন্দরমহলে যেতেই সকলেই তাকে আপাদমস্তক দেখলো। অনুপমা থাকায় কেউ তেমন কিছু বললো না। অনুপমার সাথে পরিচিত হলো সে। অনুপমাই যে অপরূপার মা তা জানতে পেরে বিস্মিত হলো সে। পাশে বসে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
‘ ও কোমলমতি। আপনাকে আপন করে নেবে আন্টিমা। ‘
অনুপমা ওর কথায় শান্তি পেল। থুঁতনি ছুঁয়ে বলল,
‘ মহলে কত মিষ্টি মিষ্টি মেয়ে আছে। আমি ওদের ঘটকালি করলে সমস্যা হবে?’
তটিনীকে কিছু বলতে না দিয়ে শাহানা তাকে চোখ রাঙিয়ে বলে উঠলো,
‘ না না সমস্যা হবে কেন? আমার তিনটা, ভাইদের দুটো আছে। আয়শা ছাড়া চারজনেই বিবাহযোগ্যা। ভালো পাত্র পেলেই নিকাহ দেব। ‘
তটিনী মায়ের মুখের উপর কিছু বললো না। তবে মা যে তার উপর ভীষণরকম রেগে আছে সেটা বুঝতে পারলো। কেন রেগে আছে তা ভাবলো না অত।
রসাইঘরে অপরূপার প্রবেশ। জলপাই রঙের শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা ঢাকা। মাথায় সোজা সিঁথি, আঁচড়ানো চুল হতে বেরিয়ে আসা ছোট ছোট চুল কপাল আর কানের পাশে বিছিয়ে আছে, চোখ নাক মুখ ফোলা। তাকে দেখে সবার সাথে সাথে কুমুরও হাসি থেমে গেল। অনুপমা তাকে চেয়ে রইলো। মুখটা দেখে এত মায়া হলো। ইচ্ছে করলো ঝাপটে জড়িয়ে ধরে আদর করে বুকে জড়িয়ে নিতে। অপরূপাও কয়েকবার আঁড়চোখে মায়ের দিকে তাকিয়েছে। পাতিল হতে হারিসা নিয়ে কক্ষ ফিরে এল পুনরায়।
সে কক্ষে এসেই শেহজাদকে দেখতে পেল। গায়ে শাল জড়িয়ে বের হচ্ছিল তাকে দেখেও না দেখার ভান করে বেরিয়ে গেল কক্ষ হতে। অপরূপা হারিসা খেতে খেতে চোখ মুছলো হাতের উল্টোপিঠে।
______________
তাঈফ আর নাদিরকে কক্ষে আরাম করতে পাঠিয়ে দিয়ে কুমুদিনীকে ডেকে পাঠালো শেহজাদ। কুমুদিনী আসতেই সাফায়াত শেহজাদের পেছনে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ ভাইজান এসেছে। ‘
শেহজাদ কুমুদিনীর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তুমি গিয়ে আরাম করো। ‘
সাফায়াত চলে গেল মাথা দুলিয়ে। কুমুদিনী ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছে। শেহজাদ তার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
‘ ওইদিন ঠিক কি হয়েছিল সত্যি সত্যি বল। রূপা তোর উপর রেগে গেল কেন? ও শুধু শুধু দোষারোপ করার মেয়ে নয়। ‘
কুমু ভয়ে চুপসে গেল। আমতাআমতা করে বলল,
‘ আমি বেলীফুল তুলতে গেছিলাম ভাইজান। বেগমও সেখানে গিয়েছিল। দু চারটা কথা কইলাম তারপর সে তার কক্ষে চলে গেল। আমি আর কিছু জানিনা। আপনে বকছেন তাই মাথা নষ্ট হয়ে গেছে তার। ‘
‘ ওর মুখে মুখে তর্ক করবি না। যাহ এখন।’
কুমু চলে গেল। শেহজাদ কেদারায় বসে মাথা এলিয়ে দিতেই কান মাথায় অদ্ভুত একটা শব্দ হতে লাগলো। অসহ্য লাগলো সবকিছু। কিছুক্ষণের মধ্যে সিংহদ্বার পেরিয়ে ছোট ছোট বাচ্চাদের মা বাবারা ছুটে এল কাঁদতে। একজন দুজন নয় দলে দলে। মহল প্রাঙ্গন ভরে উঠলো সবার ক্রন্ধনে। অপরূপা বারান্দায় এসে দাঁড়ালে। তার পেছন পেছন সবাই এল। ফজল সাহেব আর তাঈফ, নাদির বেরিয়ে এল ঘটনা শোনার জন্য। কাশীম শেহজাদের কানে কানে এসে জানালো শেরহামের সৈন্যরা ইতোমধ্যে পাড়ি দিয়েছে বাচ্চাগুলোকে উদ্ধার করার জন্য। কিন্তু শেহজাদ তাদেরকে বিশ্বাস করেনা। গতবারের মতো যদি এবারও বাচ্চাগুলোকে মেরে ফেলে! ঘটনাস্থলে শেরহাম এল। এসেই কেদারায় বসলো পায়ের উপর পা তুলে। শেহজাদ তার কেদারা চেপে ধরে গর্জে বলে
‘ তুমি কি চাচ্ছটা কি? সব পাওয়ার পরও শান্তি হচ্ছে না তোমার? এখন আবার বাচ্চা শিকার করা শুরু করেছ। ‘
‘ হ্যা করেছি। ‘
শেহজাদ রেগে গেল। কেদারায় লাতি বসিয়ে বলল,
‘ ভালোই ভালোই বাচ্চা গুলোকে ফিরিয়ে আনো। নইলে আমার চাইতে খারাপ কেউ হবে না। তোমার বেয়াড়াপনা অনেক সহ্য করেছি আর না।’
শেরহাম তৎক্ষনাৎ কেদারা ছেড়ে দাঁড়িয়ে শেহজাদের কলার চেপে ধরে বলে,
‘ কি করবি? মারবি? মেরে দেখা। আমিও দেখি কতবড় স্পর্ধা তোর। ‘
শেহজাদ রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে চেয়ে আছে। হাতের মুঠো নিশপিশ করতে করতে দিয়ে বসলো একটা ঘুষি। শেরহাম ভাবতেও পারেনি তা। সে শেহজাদের গলা চেপে ধরতেই সকলেই আঁতকে উঠলো। তটিনী সহ সায়রা সোহিনী শবনম সকলেই চলে এল প্রাঙ্গনে। তটিনী শেরহামকে টেনে ধরে বলল,
‘ ছাড়ো। কি শুরু করেছ? সত্যি কথা বললে এত জ্বলে কেন তোমার? ‘
শেরহামকে টেনে নিয়ে এল সে। শেরহাম শাঁসিয়ে বলল,
‘ আবার বন্দি করব তোকে। ‘
শেহজাদ বলে উঠলো,
‘ করে দেখাও। এবার আমি তোমাকে বন্দি করব। নেহাৎ ভাই, নয়ত এতদিনে তোমাকে আমি..
শেরহাম চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘ আমি দয়া করেছি বলে তুই বেঁচে আছিস। এবার তোকে মেরেই ছাড়বো। ‘
‘ এখন মারবেই তো। কাজ শেষ। আমাকে প্রয়োজন হয়েছিল বের করেছ এখন প্রয়োজন শেষ তাই মারবে। আমিও দেখবো তুমি আর কত নীচে নামতে পারো। ‘
অপরূপা এসে শেহজাদকে বলল,
‘ মেহমানের সামনে কি শুরু করেছেন? থামুন। ‘
শেহজাদ তার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল। অপরূপা দাঁড়িয়ে থাকলো। খোদেজা সবটা দেখলো বারান্দায় দাঁড়িয়ে। শেহজাদ কেন তার প্রিয় বেগমের সাথে এমন ব্যবহার করছে? সন্দেহ দানা বাঁধলো উনার মনে। ভয় ঝেঁকে ধরলো।
শেরহাম গর্জন করতে করতে চলে গেল।
_________
শেহজাদ কক্ষে যায়নি। রূপার মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করছেনা তার। দূরে থাকতে কষ্ট হচ্ছে, এদিকে কাছে গেলে অসহ্য ঠেকছে। নিজের এই দোলাচালে মহাবিরক্ত সে। বারান্দায় কেদারা পেতে বসে রইলো। সামনের ছাইদানি সিগারেটের শেষাংশে ভরে উঠেছে। ফজল সাহেব আসেন ধীরপায়ে হেঁটে। শেহজাদই উনাকে ডেকেছেন খাওয়ার পরে। তাই এসেছেন উনি। উনি আসামাত্র শেহজাদ উনাকে বসতে বলে আবারও মাথা ফেলে রাখলো। সারাক্ষণ শুয়ে কাটাতে ইচ্ছে করছে না পারতেই ছোটাছুটি করে কাজের তদারকি করছে সে। মনে হচ্ছে সে ধীরেধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
ফজল সাহেবের কাছে সে একটা বাচ্চা শিশু। বেশ স্নেহ করেন উনি শেহজাদ। সম্মানও করেন। রূপার প্রেমিক রহমান এবং শেরহামের আগমন বিষয়ক অনেক কথাবার্তা বলা শেষে রূপার প্রসঙ্গ এল। তাদের নিকাহ, এবং নিকাহ পরবর্তী সমস্ত ঘটনা, দুর্ঘটনা একে একে সবটা খুলে বললো শেহজাদ। একসময় বলল,
‘ আগে ও ভুল বললেও আমার মনে হতো তাই ঠিক। ও কষ্ট পাবে এমন কোনো কথা বলতে আমি শতবার ভাবতাম। কিন্তু ইদানীং ওকে কষ্ট দিয়ে ফেলছি বারংবার। আমি চাচ্ছি না কিন্তু এটা হয়ে যাচ্ছে। আগে অন্যরকম একটা টান অনুভব করতাম। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ওর প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে, আগের মতো অনুভব করতে পারছিনা, মনে হচ্ছে মাঝখানে অনেক ব্যবধান, আগের মতো আকর্ষিত হচ্ছিনা ওর প্রতি। ‘
ফজল সাহেব অবাক কন্ঠে বললেন,
‘ আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা এসব আপনি বলছেন? ‘
শেহজাদ বলল,
‘ হ্যা আমি বলছি। এটা সত্যি যে রূপাকে আমার সহ্য হচ্ছে না। এটা কি কোনো রোগ? এর কোনো সমাধান আছে আপনার কাছে? ‘
‘ আপাতত একটাই সমাধান। দুজন দুজনের কাছ থেকে কিছুদিন দূরে থাকা। ‘
আড়ালে দাঁড়িয়ে অপরূপা সবটা শুনেছে। তার কানে বেজেই চলেছে শেহজাদের বলা কথাগুলো। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তার প্রতি আকর্ষিত হচ্ছে না তারমানে তারমানে দু’দিনের ভালোবাসা ছিল তার প্রতি! দোষ তারই, সে লোভে সোনার খাঁচা দেখে বন্দি হতে চেয়েছিল, ভুলে গিয়েছিল সেটি খাঁচা।
শেহজাদ কক্ষে এসে দেখলো অপরূপা মেঝেতে মাদুর পেতে শুয়েছে। সে ভুরু কুঁচকে চাইলো। জিজ্ঞেস করলো,
‘ কি হচ্ছে এসব? ‘
অপরূপা জবাব দিল না। শেহজাদ জানতে চাইলো,
‘ রূপা বিছানায় ওঠো। আর বলব না। ‘
অপরূপার জবাব এল না। শেহজাদ তাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুয়ে দিতেই অপরূপা বলল,
‘ এত প্রেম না দেখালেও চলবে। এমন প্রেম অনেক দেখেছি। অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। শেরহাম সুলতানের চাইতেও অভিনয়ে যথেষ্ট পাকা আপনি। ‘
বলেই নেমে গেল বিছানা থেকে। শেহজাদ অবাককন্ঠে বলল,
‘ কি বলছো রূপা? আমি প্রেম দেখাচ্ছি? আমাদের সম্পর্ক কি শুধুই প্রেমের? ‘
অপরূপা তাকে আর বলতে না দিয়ে চোখ ফিরিয়ে বলল,
‘ হ্যা সেটাই ছিল। কেউ কখনোই আমার মায়ায় পড়েনি। শুধুই প্রেমে পড়েছিল। আপনিও তারমধ্যে একজন। ‘
শেহজাদ চেয়ে রইলো। অপরূপা মাদুরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। শেহজাদের ঘুম হলো না রাতে।
___________
ঝামেলা হওয়ায় শেরহাম কক্ষে খেল। তটিনী তার খাবার দিয়ে এসে নিজেও খেতে বসলো।
খোদেজা তাকে দেখে সাবধান করলো শাহানাকে। তার শরীরের পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। স্বামী সংস্পর্শে গেলে মেয়েদের মধ্যে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন ধরা পড়ে। তটিনীর ক্ষেত্রেও তাই। তা খোদেজা পরখ করেছে।
তাছাড়া আজকে তার অতিথিশালায় যাওয়া, সেখান থেকে অন্য পোশাকে ফিরে আসাটা তাই বলে দিচ্ছে তাদের সম্পর্ক গভীরে যাচ্ছে। এ হতে দেয়া যায় না। কারণ শেরহামের পরিণতি করুণ। এমন একটা মানুষের সাথে জড়িয়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
তটিনীর খাওয়া শেষে বোনদের কক্ষে চলে এল। শাহানাও এল। আয়শাকে বলল,
‘ আয়শামণি অসুবিধে হলে আম্মার কক্ষে চলে আসো তুমি। ‘
আয়শা বলল,
‘ কেন? মেঝ আপুর সাথে ঘুমাবো আমি। ‘
শবনম বলল,
‘ কি হয়েছে আম্মা? ‘
‘ তোমার বড় আপু ঘুমাবে তাই বলছিলাম যদি অসুবিধা হয়। ‘
তটিনী কিছু বলল না। সে নিজেও শেরহামের সাথে থাকতে চাই না।
শবনম বলল,
‘ বড় আপু ঘুমাতে পারবে তো। কেন আমরা আগে ঘুমাতাম না? ‘
শাহানা তটিনীর দিকে তাকায়।
‘ অসুবিধে হবে তোমার? ‘
তটিনী দু’পাশে মাথা নাড়ায়।
‘ ঠিক আছে। ‘
তটিনী শাহানার পিছু পিছু বেরিয়ে যায়। শাহানা জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাচ্ছ?
‘ ওই থালাবাসনগুলো আনা হয়নি। ‘
শাহানা রুক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
‘ থাক ওখানে। আনতে হবে না। ওর কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখবে এটা তোমাকে শিখিয়ে দিতে হচ্ছে দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি তনী। ‘
মায়ের এরূপ কথা শুনে তটিনীর চোখদুটো জলে টলটলে রূপ ধারণ করলো।
‘ কাফেরের বাচ্চা ডেকে ডেকে না কাফেরের বাচ্চা পেটে ধরে বসে থাকো। তোমাকে বুদ্ধিমতী ভেবেছিলাম। তুমি আমাকে বেকুব প্রমাণ করেছ। মা হয়ে এসব বলতেও লজ্জা করছে আমার। সাবধান করছি তোমাকে। ওর আর তোমার তালাক হয়ে যাবে কয়েকদিনের মধ্যে। আমি তোমাকে অন্যত্র নিকাহ দেব। ‘
তটিনী চোখ নত করে দাঁড়িয়ে রইলো। চোখ হতে টুপটাপ জল গড়িয়ে পড়লো মেঝেতে। শাহানা চলে গেল। মায়া বড়ই খারাপ জিনিস, মেয়েটা যেন মায়ায় জড়িয়ে না পড়ে। মায়া ভালো খারাপ দেখেনা। শুধু মানুষটা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়।
তারপরের দিন মাগরিবের নামাজের পর শেরহামের সাথে কুমুদিনীকে মহলের পেছনে দেখে খোদেজা। কুমুদিনীর হাতে বেলীফুল ছিল। তারা কথা বলছিলো একে অপরের সাথে। শেরহাম ধমকাচ্ছিলো কুমুকে। তা দেখে খোদেজার বক্ষ কেঁপে উঠে। তারমানে শেহজাদ আর রূপাকে জাদুটোনা করে আলাদা করার চেষ্টা করছে শেরহাম! উনি বিস্ময়ে ফেটে পড়েন। এদিকে অপরূপাকে কেউ খুঁজে পায় না। খোদেজা তটিনীকে সবটা খুলে বলে। তটিনী বাকহারা হয়ে পড়ে। ঘৃণা তার গা রি রি করে উঠে।
চলমান….
বাকি অংশ তাড়াতাড়ি করে দিবেন