প্রিয় বেগম ২ পর্ব-১০

0
1225

#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_১০
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

অপরূপা স্থির চেয়ে রইলো কপাল কুঁচকে। এমন একটা মহিলাকে সে সাদা কালো একটা ছবিতে দেখেছিল সে ছোটবেলায়। চাচী দেখিয়েছিল।
অনুপমার চোখে জল দেখে সকলেই তখন কিছু না কিছু বুঝে নিয়েছে। ফজল সাহেব মনে মনে হাসলেন এই ভেবে উনার সন্দেহটা সঠিক হয়েছে। পূর্বের রূপা অসুস্থ ছিল বিধায় তার মুখ, শরীর শুকনো ছিল। তখন অতটা বুঝা না গেলেও এখন হৃষ্টপুষ্ট চেহারায় গায়ের রঙ খুলে যাওয়ায় হুবহু মায়ের মতো দেখতে লাগছে তাকে। গায়ের গঠন, চোখদুটো, নাক, ঠোঁটের আকৃতি সবকিছুই মাকে ছাপিয়ে আসা। হাঁটার ধরণটাও একই। তাছাড়া রেগে গেলেও মায়ের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠে তার মাঝে। যেন মায়ের মেয়ে!
বেগম বেশে তাকে দেখে মনে অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করলেন ফজল সাহেব। মনেপ্রাণে কেন যেন তখন বিশ্বাস করতেন রূপনগরের সম্রাট এই মেয়েটাকে নিয়ে ভাবেন, ভালোবাসেন, আগলে রাখতে চান। ফিরে এসে এমন সুখবর শুনে আনন্দে ভরে উঠলো মনটা। মা মেয়ের মিলনায়তনে নিজেকে এতটা সুখী কেন অনুভব হচ্ছে উনি জানেন না। এই মেয়ের জন্য অনুপমার কতশত নির্ঘুম রাত্রির স্বাক্ষী স্বয়ং উনি ছিলেন। অনুপমার পরিবার মেয়ের কথা ফজল সাহেবকে না জানালেও বিয়ের কয়েকদিনের মাথায় অনুপমা সবটা খুলে বলেন উনাকে। ফজল সাহেবের সম্মতি পেয়ে অনুপমা অপরূপাকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চান।
অপরূপার দাদীজান এই পুতুলের মতো মেয়েটিকে দেননি অনুপমাকে ।
মেয়েকে বাবা পায় বলে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। পরের সংসারে অপরূপার অযত্ন হবে এমন ভয়ে উনি নিজের কাছে রেখে বড় করেছেন অপরূপাকে। তাছাড়া শেষ বয়সে নিজের একটা মানুষের সঙ্গ দরকার ছিল উনার। অপরূপা উনার একাকিত্বের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। নূরজাহান অনেক বড় সাহেবী বংশের মেয়ে ছিলেন। ঠাঁটবাট বজায় রেখে চলা, রাগী, আর কড়া মেজাজের মানুষ ছিলেন। অপরূপার দাদাজানও তৎকালীন জমিদার ছিলেন কিন্তু ছেলেদের কারণে জমিজমা হারিয়ে শেষের দিকে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন যার দরুণ অকালে মারা যান।
নূরজাহানের সাথে পেরে উঠা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছিলো না অনুপমার। ফজল সাহেবের মাও চাননি আগের ঘরের সন্তানকে নিয়ে আসার জন্য। তাই তিনি নূরজাহানের পক্ষ নেন।
ছলেবলে কৌশলে অনুপমা অপরূপাকে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। নূরজাহান একদিন স্বশরীরে উপস্থিত হন অনুপমার বাপের বাড়িতে। শাপ দেন এই বলে অপরূপাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ফের বললে উনি আত্মহত্যা করবেন আর তার জন্য দায়ী থাকবে অনুপমা। অনুপমার সংসারেও একারণে অশান্তি বাঁধে। দূরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগেন অনেকদিন। উন্নত চিকিৎসার জন্য ফজল সাহেবে উনাকে নিয়ে দেশ ছাড়েন। দেশে ফেরেন ছয় বছর পর। দেশে ফেরার পরপরই অনুপমা অপরূপার খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন মেয়ে এখন স্কুলে পড়াশোনা করছে। একটা চিঠিও লেখেন উনি। চিঠিটা নূরজাহানের হাতে পড়তেই উনি ভয় পেয়ে যান। অপরূপাকে হারানোর ভয় পুনরায় ঝেঁকে ধরে। অপরূপাকে উনি কলিজার আধখান বলে সম্বোধন করতেন। কোনোকিছুর বিনিময়ে অপরূপাকে উনি হারাতে চাননি। তাই অনুপমাকে চিঠি লেখেন। নিজের ঠাঁটবাট বিসর্জন দিয়ে অনুপমার কাছ থেকে ভিক্ষে চান অপরূপাকে। বলেন, কোনোদিনও যেন উনি অপরূপাকে দাবি না করেন।
ফজল সাহেব অপরূপাকে ভুলে যেতে বলেন। অনুপমা হার মানেন না। অপরূপাকে চিঠি লেখেন।
কিন্তু তার আগেই অপরূপার চিঠি আসে। যেটাতে অপরূপা লিখেছিল, তার দাদীজানই তার মা, তার বাবা। মায়ের সাথে সে যেতে চায় না।
অনুপমার সব আশায় জল ঢেলে দেয় এই একটা চিঠি। অপরূপার কাছেও মায়ের একটা চিঠি আসে। যদিও সবকিছু নূরজাহান নিজেই করেছিল মায়ের কাছ থেকে অপরূপাকে দূরে সরানোর জন্য। মা মেয়ের এই মধ্যকার দূরত্বের একমাত্র কারণ ছিলেন নূরজাহান নিজেই। উনি অপরূপাকে নিজের কাছে রাখার জন্য, সম্পত্তির অধিকার আদায়ের জন্য ছাড়তে চাননি। তাছাড়া অপরূপা উনার জীবনের একটা অংশজুড়ে ছিল সেখানে মায়ের দ্বিতীয় সংসারে অপরূপাকে দিয়ে দেয়াটা উনার কাছে বোকামি ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি।
ফজল সাহেব খুব করে অপরূপাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন উনার অক্ষমতা জানার পর। অনুপমার সন্তান শোকও কমে যেত, উনার অক্ষমতার দুঃখও ঘুচে যেত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠেনি নূরজাহানের জন্য।

এদিকে অপরূপা বেড়ে উঠলো মা নামক মানুষটিকে ঘৃণা করে করে। সে জেনে এসেছে অন্য কথা। ছবিতে মাকে দেখেছিল সে। মাঝেমধ্যে মানুষ বলতো তাকে, তোর মা এসেছিল তোর খবর নিতে। চাচীও বলতো।
দাদীজান তা শুনে বলতেন ওরা তোর সাথে মজা নেয়। তোর মা বিদেশে থাকে। তার একটা সংসার আছে সেখানে তোকে নিয়ে যেতে চায় না। অনুপমা সত্যিই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন স্বামীর সাথে। সেখানেই থাকতেন।

অপরূপাকে দেখার সাথে সাথে উনি কাছে এগিয়ে গিয়ে মুখ ছুঁতেই অপরূপা উনার মুখের দিকে চেয়ে থাকে নিষ্পলক। অনুপমা তার মুখটা আগলে ধরে বলে,
‘ মাশাল্লাহ। সুকন্যা। ‘
অপরূপা শেহজাদের দিকে তাকায়। শেহজাদ এগিয়ে এসে বলে,
‘ আপনি রূপার কে হন?’
অনুপমা কান্নাজড়ানো গলায় বলে,
‘ আমি ওর জন্মদাত্রী মা। ‘
সকলেই চমকে উঠে। স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে।
অপরূপার শান্ত কৌতূহলী দৃষ্টিজোড়া অশান্ত হয়ে উঠে। নিজেকে ছাড়িয়ে চুপচাপ কক্ষের দিকে হেঁটে চলে যায় সে। শেহজাদ বলে,,
‘ আমি দেখছি। আপনারা বসুন। সায়রা উনাদের নাশতা পানি দাও। ‘
ফজল সাহেব বললেন, ‘ এত তাড়াহুড়োর প্রয়োজন নেই। অনুপমা নিজেকে সামলাও। ‘
শবনম আর সায়রা এসে অনুপমাকে নিয়ে গেল একটা কক্ষে।
চৌকিতে হেলান দিয়ে বসে চুপচাপ চোখ বুঁজতেই কক্ষে শেহজাদ প্রবেশ করে অপরূপাকে দেখে।
ঘাড় ফিরিয়ে শেহজাদকে দেখে ছুটে গিয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠে। শেহজাদ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে মুখটা আগলে ধরে চোখের জল মুছে দেয়। অপরূপা বলে,
‘ ওই মহিলার সামনে যেতে চায় না আমি। উনি আমার মা হতেই পারেনা। মায়ের কি অতটা নির্মম হয়? আপনি উনাকে চলে যেতে বলুন। ‘
শেহজাদ ওর চোখের জল মুছে দিতে দিতে বলে,
‘ শান্ত হও দয়া করে । তোমার কান্না অসহ্য লাগছে। ‘
অপরূপার কান্না থেমে গেল তখনি। অসহ্য লাগছে? আমার কান্না অসহ্য লাগছে আপনার?
শেহজাদ থতমত খেয়ে বলে,
‘ এমনটা বলতে চাইনি? ‘
‘ তো কি বলতে চেয়েছেন? আজ কান্না অসহ্য লাগছে, আগামীকাল আমাকে অসহ্য লাগবে। চমৎকার। আমি আছি কেন এই মহলে? ‘
শেহজাদ অনুতপ্ত হয়ে অপরূপার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
‘ আমি শান্তি চাই। আর কিছু না। তোমার কাছে এসেও শান্তি পাচ্ছি না। তুমি আমাকে শান্তি দিচ্ছ না। কি হয়েছে তোমার? ‘
‘ আপনার পরিবর্তন দেখতে পারছেন না আপনি? এখন আমি আপনাকে শান্তি দিচ্ছি না?’
শেহজাদ দরজা টেনে বেরিয়ে গেল হনহনিয়ে। দরজাটা শব্দ করে উঠলো।

কান্নার মধ্যে হঠাৎই সজোরে শেরহামকে ধাক্কা দিল তটিনী। তার সাদা কামিজে রক্ত লেগে গিয়েছে শেরহামের শরীর হতে। রক্ত দেখে আরও জোরে চেঁচিয়ে কাঁদলো তটিনী। বলল,

‘ অ**মানুষ, খু**নী তোর চামচাদের এক্ষুণি মার নয়ত আমাকে মার। ‘

শেরহাম কপাল ভাঁজ করে চেয়ে আছে। মাথায় রাগ চড়ে যেতেই দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো,

‘ তুই তুকারি শুরু করেছিস কেন? ‘

তটিনী রাগের চোটে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লো। তার গায়ের ওড়না নেই, মাথার চুলগুলো খোলা। সামাদ আর মুরাদের হাতের নোংরা স্পর্শে গা ঘিনঘিন করছে। চিৎকার করে কাঁদতে থাকলো। শেরহাম উপয়ান্তর না দেখে সামনে বসে বলল,

‘ ওদের মারবো। তুই শান্ত হ। এভাবে কাঁদছিস কিছুক্ষণ পর সবাই ছুটে এসে বলবে আমি তোকে মেরেছি। ‘

‘ তুই মেরেছিস কু*ত্তা। তোর চামচারা মেরেছে। না*ফর*মানের বাচ্চা, কাফেরের বাচ্চা ধুর হ আমার সামনে থেকে। মানুষখোকো জা**নোয়ার।’

শেরহাম ওকে থামাতে গাল চেপে ধরে বলল,
‘ মুখ বন্ধ কর নয়ত মেরে মুখ বন্ধ করব। তুই তুকারি বন্ধ কর। ‘

তটিনী রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কাঁদতে লাগলো। শেরহাম নিজেকে শান্ত রাখার প্রয়াস চালিয়ে শান্তস্বরে বুঝালো,

‘ দেখ আমি ডা**কাত মেরেছি। ওরা বাচ্চাদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তাই মে**রেছি। ‘

পরক্ষণে ভাবলো একে এত কৈফিয়ত দেয়ার কি দরকার। মেরে বেহুশ বানিয়ে রাখলেই তো হয়। যত্তসব।

তটিনী একদলা থুতু তার দিকে ছিটতেই শেরহাম সরে পড়লো । আঙুলের সাহায্য তটিনীর গালের দুপাশ চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,

‘ তুই বাড়াবাড়ি করছিস কিন্তু তনী। এখানে তলোয়ার আছে। মেরে কু*চি কু ** চি করে ফেলে রাখলে কেউ খোঁজ পাবে না। ‘

গাল চেপে ধরায় তটিনী কথা বললো না তবে কাঁদতে লাগলো। শেরহাম গাল ছেড়ে দিতেই তটিনী দাঁড়িয়ে পড়লো। একছুটে কক্ষ হতে বের হতে যাবে শেরহাম পথ আটকে ফেলে বলল,

‘ তোর গায়ে রক্ত লেগেছে। যেতে পারবি না। ‘

তটিনী তাকে সরিয়ে দিয়ে বলল,

‘ একশবার যাব। সরো। সবাইকে বলব তুমি খুন
করে এসেছ। শেহজাদ ভাইকে বলব। ‘

শেরহাম ওর বাহু চেপে সামনে এনে চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ সংবরণ করে বলল,

‘ দেখ আমি তোকে ভালোভাবে বলছি। আর সদর কক্ষে মেহমান বসে আছে। তুই এভাবে যাবি কি করে? আমার কথা শোন। ‘

তটিনী তার বাহুতে খামচি দিতেই শেরহাম কাটা জায়গায় ব্যাথা পেয়ে সরে পড়লো দ্রুত। তটিনী কক্ষ হতে বেরিয়ে গেল এক দৌড়ে। শেরহাম তা দেখে সাথেই সাথেই দৌড় দিয়ে বেরিয়ে গেল তার পিছুপিছু। সামাদ আর মুরাদ বারান্দায় বসা ছিল। তটিনীকে দৌড়ে আসতে দেখে দুজনেই দু’দিকে পালালো। তটিনী প্রাঙ্গনে দু’জন যুবক পুরুষের পদচারণা দেখে ফের পেছনে ছুটে লুকানোর চেষ্টা করতেই শেরহামের সাথে ধাক্কা খেল। শেরহাম তাকে কোলে তুলে নিতেই তটিনী তার গলা জড়িয়ে কিছু বলতে যাবে তখুনি শেরহাম কটমট গলায় বলল,

‘ চুপ থাক। তুই যেতে পারবি না এভাবে। ‘

বলেই অতিথিশালার পেছন দিয়ে মহলের অনেকটা পেছনে চলে গেল। পুকুরের মাছের জলডুবি দেখা যাচ্ছে। চাঁদের কিরণ পড়ে জল থৈথৈ করছে। পাশের ঝোঁপে ঝিঁঝি পোকার বিরক্তিকর চেঁচামেচি। হালকা বাতাসে নড়তে থাকা গাছের পাতার দোলার শব্দ আর রাতের নিঝুম আকাশের বুকে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা তারার মাঝে অর্ধচন্দ্রের আলোয় ধরণী প্রজ্ঝলিত। তটিনী বলল,

‘ কি করছো? নামাও আমাকে। ‘

‘ একদম চুপ। বেশি কথা বললে আরেক**টা খু**ন হয়ে যাবে এখানে। কত খু**ন করে নদী*তে ভা***সিয়ে দিয়েছি জানিস না।

তটিনী ভয়ে চুপসে গেল। নখ দিয়ে শেরহামের গলায় খামচে দিল। শেরহাম ব্যাথা পাওয়ায় ঘাটে নামতে নামতে তটিনীকে ছুঁড়ে ফেললো পুকুরের পানিতে। তটিনী ডুবে গিয়ে ভেসে উঠে নাকেমুখে পানি ঢুকে যাওয়ায় খুকখুক করে কাশতে শুরু করলো। পাশেই শেরহাম তার হাত, ঘাড়, গলা, পোশাক হতে ঘষে ঘষে লেগে থাকা র**ক্ত পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। তটিনী রোষাগ্নি দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে চেয়ে ফুঁসতে লাগলো। শেরহাম ওর মাথা চেপে ধরে পুকুরের পানিতে চুবিয়ে রাখলো।

চলমান..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে