#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_৬
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
শেরহামের আঙুলের ফাঁকে রাখা বিড়ির ধোঁয়া উড়ছে। শেহজাদ নিগূঢ় ভঙ্গিতে হেঁটে শেরহামের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
শেরহাম তাকে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। শেষ হয়ে আসা বিড়ির শেষাংশটুকু ফেলে পায়ের নীচে চাপা দিয়ে শেহজাদের মুখোমুখি দাঁড়াতেই শেহজাদ বলল,
‘ হার, আত্মসমর্পণ নাকি সাহায্য। কোনটা ? ‘
শেরহাম তার সম্মুখে দাঁড়ালো। সামাদের হাত থেকে অস্ত্র নিয়ে তার ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
‘ নিয়োগ করেছি। কত মূল্য তোর?’
আঁতকে উঠলো সবাই। শেহজাদ অস্ত্রটি দুর্বার গতিতে খপ করে ধরে ফেললো। রাগান্বিত চোখে চেয়ে গর্জে বলল,
‘ আমার মূল্য তুমি তোমাকে বেঁচেও দিতে পারবে না। আর এসব ফষ্টিনষ্টি খেলা বন্ধ করো। যা তা অবস্থা হওয়ার পর এখন আমাকে নিয়োগ করছো! এতগুলো মানুষকে নিয়ে খেলনাপাতি খেলছো তোমার বিন্দুমাত্র লজ্জা হচ্ছে না?’
‘ হচ্ছে না। গলার নীচু করে কথা বল। আমার প্রয়োজনে তোকে বের করেছি। আমার নির্দেশমতো কাজ করবি। ক্ষমতায় কে আছে ভুলে যাস না। ‘
‘ সেই ঘুরেফিরে আমার কাছে এসেছ। ‘
‘ বউ লাগিয়ে দিয়েছিস মানুষ মারার জন্য। আজ দুটো, কাল দুটো, কি শুরু করেছে তোর বউ? তোর বউকে থামানোর জন্য তোকে বের করেছি। ‘
‘ বেশ করেছে মেরেছে। আরও কম হয়েছে। যে মেয়েদুটো অপহরণ হয়েছে আজকের মধ্যেই তাদের ফেরত নিয়ে এসো পরাগ পাহাড়ের জাদুকরের হাত থেকে। নইলে তোমার বদনাম রটিয়ে দেব বলে রাখলাম। ‘
শেরহাম খেপে উঠে কিছু বলে উঠার আগেই শেরতাজ সাহেব বললেন,
‘ তোমার আর কিছু বলার আছে বলে আমি মনে করিনা। শেহজাদ ওর সাথে তর্কে যেওনা। অনেক কাজ। বেরিয়ে পড়ো। ‘
শেহজাদ মাথা দুলিয়ে বলল,
‘ জ্বি। কামীল অশ্ব প্রস্তুত করো। বেরোবো। ‘
খোদেজা ডাক দিল দ্বিতল চত্বর হতে। উনার পেছনে অপরূপা দাঁড়িয়ে আছে। শেহজাদ মায়ের ডাক শুনে চোখ তুলে তাকালো। উনি বললেন,
‘ পুত্র খাওয়া ছাড়া বেরোবে না। গোসল নিয়ে গরম খাবার খাও, আরাম করো। তারপর যেও। ‘
শেহজাদ সে কথায় আপোস করলো না। বলল,
‘ আমি অভুক্ত নেই আম্মা। ফিরে এসে খাব। চিন্তার কিছু নেই। ‘
শেরহামকে আরও একবার সতর্ক করে চোখা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বেরিয়ে গেল সে দলবল নিয়ে। অপরূপা বারান্দার চত্বরে এসে দাঁড়ালো। শেহজাদ অশ্বের পিঠে চড়ে হঠাৎই সেদিকে দৃষ্টি রাখতেই অপরূপাকে দেখতে পেল।
অপরূপা এদিকেই চেয়ে আছে। তার দৃষ্টি স্থির, শান্ত।
শেহজাদ চোখ সরিয়ে লাগাম টেনে ছুটে চললো।
অপরূপার পেছনে এসে দাঁড়ালো হামিদা। উনাকে দেখে অপরূপা স্মিত হাসলো। উনি মৃদুস্বর হেসে উঠে বললেন,
‘ পাখি খাঁচা থেকে মুক্ত হয়েছে। কিছুক্ষণ প্রাণখুলে উড়তে দাও। সময় হলেই নীড়ে ফিরে আসবে। যা যা আয়োজন করেছ সব রাতে খেতে দিও। মন খারাপ করে না মেয়ে। ‘
অপরূপা মাথা নেড়ে বলল,
‘ না মন খারাপ করিনি। আমি ভেবেছিলাম উনি খেয়েই বেরোবেন। তাই। চলুন যাই। ‘
হামিদা সম্মতি জানিয়ে হাঁটা ধরলো। অপরূপা তার পেছন যেতে যেতে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ঘোড়াগুলোর দিকে পুনরায় ফিরে তাকালো।
শেরহাম কক্ষে গিয়ে মাথায় পাগড়ি পড়ে নিল। খাপের ভেতর তলেয়ার ঢুকিয়ে গটগট পায়ে কক্ষ হতে বের হয়ে যাওয়ার সময় তটিনী পথরুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ ওই না**ফরমান জাদুকরগুলোকে সাবধান করে দেবে আর যাতে কোনো মেয়ের দিকে নজর না দেয়। ‘
‘ তোর এত সাহস থাকলে তুই গিয়ে বলে আয়। সবসময় ফটরফটর করিস, কোনো কাজের কাজ কিছুই তো পারিস না। যত্তসব ফালতু। সর। ‘
তটিনী দাঁতে দাঁত পিষে সরে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ কাফেরের বাচ্চা কাফেরগুলোকে বলবে জঙ্গলের মানুষকে যেন এখানে আসতে না দেয়। ‘
‘ কে জঙ্গলের মানুষ? ‘
‘ আর কে? সামনে আস্ত যে বনমানুষ দাঁড়িয়ে আছে সে। ‘
শেরহাম কিছু বলবে না ভেবে নিল। এইসব পা*গল ছাগ*লের সাথে কথা বলাটাই বেকার।
সে হাঁটা ধরলো। তটিনী বলে উঠলো,
‘ ওই মেয়েগুলো যদি সহিসালামতে বেঁচে না ফেরে তোমাকে খু**ন করব আমি। ‘
যেতে যেতে পুনরায় থমকে থমকে দাঁড়ালো শেরহাম। ঘাড় ফিরিয়ে তটিনীর দিকে ফিরে তাকালো। তটিনীও তার দিকে ফিরলো।
শেরহাম সাথেসাথে চোখের দৃষ্টি অগ্নিতুল্য করে এগিয়ে আসবে তটিনী তার হাতে থাকা খেজুরগুলো মুখের উপর ছুঁড়ে মেরে পালিয়ে গেল। শেরহাম কিছুক্ষণ হাতের মুঠো শক্ত করে চোখ বুঁজে রাগ, ক্ষোভ সংবরণ করে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। বেয়াদবকে আজ হাতের কাছে পেলে মেরে মুখ বাঁকা করে দেবে। পরাগ পাহাড়ের উদ্দেশ্য রওনা দিল সে।
__________
বড় বড় পাথরের উপর আছড়ে পড়ছে সমুদ্রে উত্তাল ঢেউ। আকাশের নীলাভ মিতালিতে এসে মিশেছে গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘমালা। তীব্র বাতাসের চোটে পতপত শব্দ করে উড়ছে গায়ের শাল। এপাশ ওপাশ হচ্ছে মাথার ঘন চুল। শেহজাদ একটা পাথরের উপর অবস্থান নিয়ে দূরবীনের সাহায্যে সমুদ্রপথে আগত জাহাজের দিকে দৃষ্টি তাক করে রেখেছে। সাফায়াত বহুকষ্টে একটা পাথরের উপর দাঁড়িয়ে ডাকলো,
‘ ভাইজান সন্ধ্যা তো নেমেই এল। কিছু আহার করা উচিত আপনার। জাহাজ চলে এসেছে। ‘
শেহজাদ প্রসন্নমুখে বলল, ‘ হ্যা তা তো দেখছি। তোমরা না খেয়ে আছ কেন? খেয়ে নাও। আমার খিদে উবে গেছে। বাসি কাপড়ে খাব না। মহলে ফিরে খাব। তুমি খেয়ে নাও সবাইকে নিয়ে।’
সাফায়াত মাথা দুলিয়ে চলে গেল।
পশ্চিমাকাশে সূর্য ডুবে গেছে। মাগরিবের আজানের সময় হয়ে এসেছে। তারা মহল ছেড়েছিল সকাল সাতটা নাগাদ। জাহাজ ঘাটে এলেই কর্মীদের হাতে সব তুলে দিয়ে মহলে ফিরে যাবে।
সাফায়াত ফিরে এল একথোকা আঙুল নিয়ে। শেহজাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ ভারী মিষ্টি। কাশীম জঙ্গলের গাছ থেকে ছিঁড়েছিল। আমি পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুঁয়ে নিয়েছি। ‘
শেহজাদ আঙুরের থোকা নিল। বিসমিল্লাহ বলে আঙুল মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে বলল,
‘ হক কথা বলেছ। আসলেই মিষ্টি। সিভানের জন্য কয়েকটা রেখে দাও। ‘
সাফায়াত স্মিত হেসে বলল,
‘ সায়রাও আঙুর পছন্দ করে। ‘
শেহজাদ দৃষ্টি স্থির করতেই সাফায়াত লজ্জিত হয়ে বলল,
‘ ইয়ে মানে, আয়শাও খেতে পছন্দ করে। ‘
শেহজাদ সম্মুখে দৃষ্টি ফিরিয়ে মৃদু হেসে বলল,
‘ একথোকা রেখে দাও ‘
সাফায়াত খুশিমনে চলে গেল। সমুদ্রের ঢেউ আঁছড়ে পড়লো পাথরের উপর। দূরদূরান্ত হতে আজানের শব্দ ভেসে আসছে। মোলায়েম বাতাস গায়ে শিহরণ জাগিয়ে দিচ্ছে।
দশটা আঙুর গুনে-গুনে পকেটে ভরে নিল সে। তার একটা বউ আছে।
________________
ধোঁয়ার কুন্ডলী অনুসরণ করে গুহার সিংহদ্বারের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াতেই কয়েকজন কালো কালো পোশাকের জাদুকর এসে ঘিরে ধরলো শেরহামকে। পাগড়িখুলে মুখোশ খুলতেই মাথা নত করে সরে পড়লো। শেরহাম ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফ দিয়ে নেমে গুহার ভেতরে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে দলদলে সন্ন্যাসীরা ছুটে এল। সবার গুরু যেই বৃদ্ধ লোকটি তার পরেই শেরহামের স্থান। তাই সকলেই তাকে সমীহ করে চলে। শেরহাম ধোঁয়ার মাঝে হেঁটে গিয়ে গুরু চন্দ্রলালের তাঁবুর সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো। চারপাশে বিপুল পরিবর্তন এনেছে এ কয়েকদিনে।
দাউদাউ করে মশাল জ্বলছে চারপাশে। কালো কাঠ, নানারকম ফুল, হাঁড়, কঙ্কাল, ধূপ, ঘাস আরও নানারকম জিনিসের মাঝখানে জ্বলছে আগুনের লেলিহান শিখা। তা ঘিরে দশ বারো জনের উপরে বসে হাতজোড় করে কি যেন একনাগাড়ে জপ করে যাচ্ছে।
শেরহাম এগিয়ে গিয়ে মাটির কলস হতে পানি নিয়ে ছুঁড়ে মারতেই সকলেই চমকে উঠে চোখ মেললো। কয়েক মুহূর্তে্ স্তব্ধ থাকার পর চন্দ্রলালের ইশারায় সকলেই ঝাঁপিয়ে পড়লো শেরহামের উপর। খ্যাঁচখ্যাঁচ তলোয়ারের শব্দ শোনা গেল শুধু। ধোঁয়া কমে আসতেই চন্দ্রলাল সকলকে থামতে বলে শেরহামের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
‘ করছিস কি তুই? নিজের লোকের উপর আক্রমণ করছিস? দেড় বছর পর পা রেখেছিস এখানে। আসামাত্রই ধ্বংসলীলা শুরু করে দিয়েছিস। এ কেমন আচরণ? অহমিকা তোকে ধ্বংস করবে। ‘
শেরহাম চিবুক শক্ত করে বলল,
‘ জ্ঞান পরে দিও। ওই মেয়ে দুটোর কাছে নিয়ে চলো। অতদূর হতে নাটক দেখতে আসিনি। মেয়ে দুটোকে ছাড়ো। ‘
‘ মাত্রই এসেছিস। বোস। খোশগল্প করি। দেখ কতজন ওরা সবাই ওই পাহাড় থেকে চলে এসেছে। আমরা সবাই মিলে এখানে আছি। আমরা এখন গুটিকয়েকজন নেই। দেখ। ‘
শেরহাম চন্দ্রলালের সাথে ঘুরেফিরে সব দেখতে লাগলো।
‘ ওরা তোর সাক্ষাতের অপেক্ষায় ছিল। আমি তাদের রূপনগরের পাঠাতে চেয়েছিলাম তোর পায়ের ধুলো নেয়ার জন্য। ‘
‘ খবরদার ওইখানে কেউ যাবি না। ‘
কালো পোশাকে আবৃত সকলেই তা শুনে মাথা নত করে সম্মতি জানালো। চন্দ্রলাল বলল,
‘ আজ আমাদের সাথে রাত কাটিয়ে দে। পরে যাস। ‘
শেরহাম জেদী কন্ঠে বলল,
‘ কি বললাম শুনতে পাওনি? মেয়ে দুটোকে ছাড়ো। নিয়ে চলো ওদের কাছে। আর কোনো মেয়ে অপহরণ করবে না। আমার আদেশ। না শুনলে সবাইকে পুড়িয়ে মারবো। ‘
চন্দ্রলালের ইশারায় দু’জন এসে শেরহামকে গুহার ভেতরে নিয়ে গেল। গুহার গহীনের একটা অন্ধকার কক্ষের মতো জায়গায় বন্দি দুটি মেয়ে। গায়ে ঢাকা কালো লাল রঙের চাদর। তাদের চুলগুলো দেখা যাচ্ছে শুধু। শেরহামের দৃষ্টিতে আগুন হয়ে এল। পাশের দু’জনকে তীব্র বেগে গলা চেপে ধরে ঘুষি মারতে মারতে ফেলে দিয়ে বিকট গর্জন করে বলল,
‘ শু**য়োরের বাচ্চা আমি লা*শ দেখতে চেয়েছি? ‘
চন্দ্রলাল ছুটে এসে সাবধান বাণী দিয়ে বলল,
‘ শান্ত হ। চেঁচামেচি করিস না। আমি তোকে বুঝিয়ে বলছি। ‘
শেরহাম চন্দ্রলালের ঘাড় ধরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে হনহনিয়ে তাঁবুর কাছে সব তাঁবু তলোয়ার দিয়ে খন্ডবিখন্ড করে দিল। তাকে ধরতে এলে তাঁবুর ভেতরে থাকা সবুজ রঙের একটা আতরের শিশির মুখ খুলে দিতেই কাশতে কাশতে সকলেই দুর্বল হয়ে পড়লো। শিশি বন্ধ করে শেরহাম গর্জন করে বলল,
‘ ওদের লাশ রূপনগরে রেখে আয়। আমার পৌঁছানোর আগে রেখে আয়। নইলে একটাকে জ্যান্ত রাখবো না এখানে।’
বৃদ্ধ লোকটা এসে তলোয়ার নিয়ে শেরহামের গলার কাছে এসে ঠেকিয়ে বলল,
‘ তুই বাড়াবাড়ি করছিস। এসব নতুন কিছু নয়।’
শেরহাম বলল,
‘ আমি ক্ষমতায় আছি। এখন আমি কোনো দুর্যোগ আসতে দেব না নগরে। যেখানে ইচ্ছে হয় মর। রূপনগরে কেউ যাবি না। কেউ যদি যায় তার অবস্থা আমি বারোটা বাজিয়ে দেব।’
বলেই চন্দ্রলালকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে যাবতীয় জিনিসপত্র খুঁজে তার পুটলিতে নিয়ে নিল। মেয়েদুটোর লাশ ঘোড়ার গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হলো রূপনগরের তাদের বাড়ির আশেপাশেই রেখে আসার আদেশ দিল শেরহাম। পরিবার পরিজন লাশ অন্তত দেখতে পাবে।
____________
শেহজাদ মহলে ফেরার সাথেসাথেই কামীল খবর নিয়ে এল সেই মেয়ে দুটোর লাশ পাওয়া গিয়েছে তাদের বাড়ির পেছনে। কারা যেন রেখে গেছে। অত্যধিকবার ধ**র্ষ**ণ করার পর তাদের হত্যা করা হয়েছে।
শেহজাদ তখন সবেমাত্র মহলের সিংহদুয়ার পেরিয়েছে। মহলে প্রবেশ করেনি। খবরটা কানে আসার সাথে সাথে সে পুনরায় ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলো। লাগাম টেনে ছুটে গেল ঘটনাস্থলে। বহুদিন পর তাকে স্বচক্ষে দেখে মানুষজন যেমন চমকিত হলো, তেমনি আহাজারিতে ফেটে পড়লো। মৃত দু’জনের পরিবার পরিজন পায়ের কাছে এসে আছড়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো। শেহজাদ তাদের কি বলে সান্ত্বনা দেবে খুঁজে পেল না। মেয়েদুটোর জানাজা শেষে মহলে ফিরলো সে। মহলে প্রবেশ করলো না। মহল অঙ্গনে কেদারায় মাথা এলিয়ে দিয়ে বসে থাকলো। মেয়েদুটোর খবর শুনে মহলের সকলেই তটস্থ হয়ে আছে। অপরূপা যেই শুনলো শেহজাদ এসেছে সে মহল অঙ্গনে ছুটে এসে শেহজাদকে চোখ বুঁজে কেদারায় গা এলিয়ে বসে থাকতে দেখলো। বুঝতে পারলো আজ সারাদিন অনেক দখল গিয়েছে। সে কিছু বলবে কি বলবে না ভেবেই চুপ করে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকলো। শেহজাদের সাড়াশব্দ না দেখে ফের চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে ঠিক তখনি শেহজাদ বলে উঠলো,
‘ চলে যাচ্ছ কেন? ‘
অপরূপা চমকে উঠলো। তাকে দেখেছে?
দেখেছে নয় তার উপস্থিতি অনুভব করতে পেরেছে শেহজাদ। অপরূপা ধীরপায়ে এগিয়ে তার সামনে হাঁটুমুড়ে বসে হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
‘ সারাদিন আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। ‘
শেহজাদ পকেট থেকে আঙুর বের করে দিয়ে বলল,
‘ তোমার জন্য। ‘
অপরূপার হাত বাড়িয়ে নিল। হেসে বলল,
‘ দশটা! শুকরিয়া। অনেক খুশি হয়েছি আমি। ‘
আঙুরগুলো খেতে লাগলো। অসম্ভব মিষ্টি।
শেহজাদ স্মিত হাসলো। তার দিকে ঝুঁকে বসে বলল, আমি কিছু পেতে পারি না? ‘
অপরূপা হেসে উঠলো। তার ক্লান্তশ্রান্ত মুখটা আগলে ধরে মুখের কাছাকাছি এনে বলল,
‘ আপনি যে বলেছিলেন, আমার ভালোবাসা চায় না আপনার। ‘
‘ চাই না বলিনি, পরে বাসতে বলেছি। “পরে” এখনো আসেনি? ‘
‘ আম্মা বলেছেন যে বিবাহিত সম্পর্কে আল্লাহর রহমত থাকে সেই সম্পর্কের শিকড় একদিনেই অনেকদূর অব্দি গেঁড়ে যায়। আমাদের সম্পর্কে আল্লাহর রহমত আছে তাই “পরে” শব্দটার কোনো ঠাঁই নেই। ‘
‘ আলহামদুলিল্লাহ। আমার বেগম এখন অনেক বুঝদার। ঝড়েরবেগে উড়ে চলা পাতা নয়, আত্মবিশ্বাসী, সাহসী, মায়ার শেকড় গাঁড়া বৃক্ষ। ‘
অপরূপা হেসে উঠে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল তার কপালের পাশে।
শেহজাদ কেদারা ছেড়ে তাকে কোলে তুলে সারামুখে চুম্বন করে বলল,
‘ আমি ভাগ্যবান। ‘
অপরূপা বলল,
‘ আমি বেশি। দয়া করে নামিয়ে দিন কেউ দেখে নেবে। ‘
‘ সারা দুনিয়া দেখুক। ‘
______________________
সৈন্য সামন্ত নিয়ে শেরহাম মহলে ফিরে এল। মহলে ফেরামাত্রই তটিনী কোথাহতে ছুটে এসে তাকে ধাক্কা মেরে বসলো। বলল,
‘ শয়তান সত্যি সত্যি মেরে ফেলেছিস মেয়েগুলোকে। জা*নোয়ার। ‘
সৈন্যরা তাকে আটকাবে শেরহাম বলল,
‘ ভেতরে যাহ। মাথা খারাপ করবি না। ‘
তটিনী একদলা থুতু মেরে চলে এল। শেরহাম দাঁতে দাঁত পিষে দাঁড়িয়ে রইলো। সামাদ বলল,
‘ হুজর আদেশ দিন। এর একটা ব্যবস্থা করব। ‘
‘ এখন না। আমি বলব। বেশি বাড় বেড়েছে। ‘
শেরহাম কক্ষে চলে গেল। তটিনী কান্নাকাটি করে হুলস্থুল অবস্থা। এমন একটা মানুষের সাথে সে ঘর করবে না, করতে পারেনা। সে অপবিত্র হয়ে যাচ্ছে। শেরহাম আসার পূর্বেই কান্নাকাটি বন্ধ করে ফেলেছে। শেরহামের খাবার সাজানো আছে। মন ভালো থাকলে খাবারঘরে গিয়ে খায়। আজ খাবে না তাই তটিনী এই ঘরে খাবার এনে রেখেছে। সাথে গ্লাসে ঘুমের ঔষধও মিশিয়ে দিয়েছে। শেরহাম খাওয়াদাওয়া শেষ করে বন্দুকের নলে গুলি ভরে অতিথিশালায় যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়াতেই তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। তটিনী গিয়ে ধরলো। শেরহামের তার গায়ে ভার ছেড়ে দিয়ে রক্তলাল চোখে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পেষণ করে বলল,
‘ কি দিয়েছিস খাবারের ভেতর? ‘
তটিনী অভিনয় করে বলল,
‘ কোথায়? কিছু দেইনি। তুমি তো যাচাই-বাছাই করে খাও। আমি কি দেব? ‘
শেরহাম তার গলা চেপে ধরার শক্তিটুকুও খুঁজে পেল না। ঢলে পড়লো। তটিনী তাকে বিছানায় টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিল। শেরহাম ধসে পড়লো সাথে তটিনীকেও নিয়ে পড়লো। তটিনী মহাবিরক্ত। শেরহাম ধীরে ধীরে ঘুমে ঢলে পড়লো। কড়া ঔষধ দিয়েছে সে।
শেরহাম পুরোপুরি ঘুমিয়ে যেতেই তটিনী নিজেকে ছাড়িয়ে নিল শেরহামের হাত থেকে। বুকের নীচ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে ভাবলো যদি বলা হয় ঘুমন্ত মানুষ অসম্ভব নিষ্পাপ দেখতে হয় তাহলে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হবে শেরহাম সুলতান। অথচ সে অসৎপুরুষ। এই অসৎ পুরুষের আজ শেষ রাত। দেয়ালের কোণায় চকচকে ধারালো তলোয়ারটির দিকে নজর গেল তার। শেরহামের বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে তলোয়ারের উদ্দেশ্যে ছুটতেই বাঁধা পেল হঠাৎ।
পিছু ফিরে দেখলো শেরহামের হাতের মুঠোয় তার ওড়না।
গা থেকে ওড়না ফেলে তলোয়ারের কাছে ছুটলো সে। খাপ থেকে খ্যাঁচ করে তলোয়ার বের করে এক কো***প বসিয়ে দিল শেরহামের বাহুতে।
সাথে সাথে রক্ত ছিটকে আসতেই নিজে নিজেই চেঁচিয়ে উঠলো। শেরহাম ঘুমের মধ্যেই অদ্ভুত শব্দ করে করে উঠলো। রক্তলাল চোখদুটো পাকিয়ে ফেললো। তটিনী তলোয়ার ছুঁড়ে ফেলে মাথাটা তার কোলে নিয়ে বলল,
‘ ওঠো। তুমি জেগে আছ। আল্লাহ এখন কি হবে? ‘
তরতরিয়ে ঘেমে ওঠা শেরহামের ঘর্মাক্ত মুখ ওড়না দিয়ে মুছে দিয়ে চিৎকার করে ডাকলো,
‘ আম্মা আম্মা রে তাড়াতাড়ি আসুন। ভাইজান, মামু। তাড়াতাড়ি আসুন। ওকে বাঁচান। ‘
সকলেই হুড়মুড় করে ছুটতে ছুটতে এল। দেখলো তটিনী শেরহামের মাথার উপর বসে কাঁদছে চিৎকার করে। ওড়না দিয়ে শেরহামের বাহু বেঁধে দিয়ে মাথাটা কোলে নিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। সোহিনী এসে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘ কি করেছ আমার ভাইজানকে? সিভান এসে মুখ ধরে ডাকলো, কি হয়েছে ভাইজানের? এই ভাইজান ওঠো। মারামারি করো।
শেহজাদ ভীড় ঠেলে এসে গর্জে ডাকলো, কে কোথায় আছো। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কি করেছ তুমি?
তটিনী কেঁদেকেটে বলল, ‘ মেরে ফেলতে চেয়েছি। ‘
শাহানা ওর মুখ চেপে ধরে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ আল্লাহকে ডাকো মা। এমনটা কেউ করে?
শেরহামকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। তটিনী কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞানপ্রায়।
পরদিন সান্ধ্যবেলায় সবাইকে হতবাক, হতভম্ব করে দিয়ে শেরহাম হাসপাতাল হতে পালিয়ে এল অসুস্থ শরীরে। এসেই চিৎকার পাড়তে লাগলো,
‘ এই তনীর বাচ্চা বের হ। তুই আমাকে মারতে চেয়েছিলি? তোর এত বড় সাহস। বের হ। আমার সামনে আয়। ‘
তটিনী তার গলা শুনে রান্নাঘর হতে পালিয়ে গিয়ে শাহানার বুক মুখ লুকিয়ে কেঁদে উঠে বলল,
‘ আম্মা আমাকে মেরে ফেলবে এইবার।
চলমান….