#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_৫
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
তৃণ ঘাস বিছানো প্রাঙ্গনে সাদা কেদারায় বসে আছে শেরহাম। তার পাশে শেরতাজ সাহেব, শাহাজাহান সাহেব, নগরের আরও কয়েকজন মান্যগন্য ব্যক্তিবর্গ। সাফায়াত শাহাজাহান সাহেবের পাশে বসা। লোকগুলোর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে শেরতাজ সাহেব কটাক্ষ করে বললেন,
‘ সবে তো শুরু। আরও কত কি দেখার বাকি আছে। ‘
শেরহাম অতি শান্ত দৃষ্টিতে পিতার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। তাতেই উনি চুপ করে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। শাহজাহান সাহেব উক্ত কন্যার পিতাদের উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘ তোমাদের কন্যা নিখোঁজ হয়েছে কবে? ‘
লোকদুটি কাঁদছে। কথা বলতে পারছে না। দ্বিতল চত্বরে দাঁড়িয়েছিল খোদেজা সহ মহলের সকল মেয়ে মহিলারা। অপরূপা সকলের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছিল। যদি তারা জানতো তাদের কন্যা নরপশুদের হাতে প্রাণত্যাগ করেছে তাহলে কতটা আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হতো!
তাদের আহাজারিতে মহলের হাওয়া ভারী হয়ে এসেছে। একজন বলল, ‘ সে বড়ই ভীতু। সান্ধের আগেই বাড়ি ফেরে ছাগল নিয়ে। কাল ফেরেনি। অনেক খোঁজাখুঁজি করার পর পেলেম না। তাই আপনার কাছে এলাম। শেহজাদা সম্রাট থাকাকালীন এমন কখনো হয়নি হুজুর। ‘
ওই কথাটায় শেরহামকে রাগিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। সে ঝাঁজালো সুরে বলল,
‘ তোমাদের মেয়ে মারা গিয়েছে। যারা মেরেছে তারাও মরেছে। যাও এবার। ‘
লোকদুটো আর কথা বলার সাহস পেল, না শক্তি পেল। তাদের পান্ডুর মুখখানা দেখে কষ্ট হলো অপরূপার। বাকিদের মুখও মলিন হয়ে এল। নীরবতা নেমে এল সেখানটাই। কিছুমুহূর্ত ওভাবে কেটে যেতেই লোকদুটো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। শেরহাম পায়ের কাছে এসে বসে বলল,
‘ এমন কথা বলবেন না হুজুর। কন্যার মা শুনলে আর বাঁচানো যাবে না। ‘
শেরহাম পা সরিয়ে নিয়ে বলল,
‘ অমন যুবতী মেয়েকে চোখে চোখে রাখতে পারো না? আমার কিছু করার নেই। এই ওদের নিয়ে যাহ। ‘
সৈন্যরা এসে লোকদুটোকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল।
শেরহাম কেদারায় গা এলিয়ে বসে কপালে আঙুল বুলাতে বুলাতে বাকিদের বলল,
‘ তোমাদের কি সমস্যা? ‘
সন্ন্যাসীদের হামলার কথা জানালো তারা। শেরহাম সামাদের দিকে চোখা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বারবার বারণ করা স্বত্বেও ওরা নগরে কি করছে? সামাদ চোখ নামিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
সভা-সমাবেশে হঠাৎ অন্দরমহলের নারীর আগমনে সকলেই কৌতূহলী চোখে তাকালো।
শেরহাম সরু চোখে তটিনীর দিকে তাকালো। সাফায়াত সোজা হয়ে বসে বলল,
‘ বোন তুমি এখানে কেন? ‘
শেরতাজ সাহেব আর শাহজাহান সাহেবের একই প্রশ্ন। উপস্থিত যে ব্যক্তিবর্গরা ছিলেন তারা বেগম বেশে তটিনীকে দেখে সম্মান জানিয়ে বলল,
‘ বেগম নিশ্চয়ই কোনো ফায়সালা নিয়ে এসেছে। ‘
শেরহাম কপাল ভাঁজ করে তটিনীর দিকে তাকালো। বলল,
‘ এখানে মহিলাদের কোনো কাজ নেই। ‘
তটিনী অভয়ে লোকগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ সন্ন্যাসীগুলো নিশ্চয়ই কালো ত্যানা কাপড়ে ছিল? ‘
লোকগুলো সকলেই একত্রে মাথা দোলাতে লাগলো। তটিনী আদেশ দিয়ে বলল,
‘ ওই ত্যানা কাপড় খুলে নিতে বেশি সময় লাগবে না। পাড়ায় যতজন থাকেন সবাই মিলে তাদের ত্যানা কাপড় খুলে নিয়ে রাস্তায় বড় বটগাছটির আগায় ঝুলিয়ে দেবেন। আমরা সবাই দেখতে যাব। ‘
হাসির রোল পড়ে গেল মুহূর্তেই । বহুদিন পর শাহজাহান সাহেব আর শেরতাজ সাহেব সহ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা সকলেই হেসে উঠলো। শেরহাম দাঁড়িয়ে পড়লো হঠাৎ। চোখের দৃষ্টি কঠিন করে বারান্দায় তাকাতেই অপরূপাকে চোখে পড়লো। অপরূপার নিরুত্তাপ দৃষ্টি তার রাগ বাড়িয়ে দিল। বুঝতে বাকি রইলো না এসব কার ছাল।
সকলের উদ্দেশ্য বলল, ‘ আপনারা এখন আসতে পারেন। পরে ডেকে নেব। তোমরাও যাও। আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি। ‘
চরম হতাশ হয়ে মহল প্রাঙ্গন ছাড়লো সবাই। তারা মহলের সিংহদ্বার পেরোতেই শেরহাম তেড়ে গিয়ে তটিনীর হাত ধরলো খপ করে। টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। শেরতাজ সাহেব কত ডাকাডাকি করলেন শেরহাম টানতে টানতে নিয়ে গেল। কারো কথা শুনলো না।
কক্ষের ভেতর ছুঁড়ে চড়া মেজাজে প্রচন্ডরকম চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘ এত বড় স্পর্ধা তোর। তুই সভায় গিয়ে মাতব্বরি করছিস? ‘
তটিনী একটুও না ভড়কে হাত বুকে ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে হেসে বলল,
‘ নবীন সম্রাটের বেগম বলে কথা। মাতব্বরি না করলে চলে? ‘
শেরহাম তেড়ে এসে তার হাত পিঠের কাছে নিয়ে গিয়ে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে,
‘ তুই আমার বউ হয়ে আমার সাথে বিরোধিতা করছিস? ‘
তটিনী হাতটা ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য সাপের মতো মোচড়াতে মোচড়াতে বলল,
‘ আমি মানি না এই নিকাহ। জোর করে নিকাহ করেছ এটা ভুলে গিয়েছ? ‘
শেরহাম চোখের দৃষ্টি কঠিন করে বলল,
‘ তোর অবস্থা অপার চাইতেও বেশি খারাপ হবে বাড়াবাড়ি করলে। তোকে চুপ করে বসিয়ে রাখার ঔষধ আমার কাছে আছে। মেরে গু**ম করে ফেলার ঔষধও আমার কাছে আছে। সাবধান করছি। আমার সাথে যুদ্ধে যাবি না। ধ্বংস হয়ে যাবি। ‘
তটিনী ভেংচি কাটলো তখনি। শেরহামকে নকল করে মুখ ভেঙচিয়ে ভেঙচিয়ে বলল,
‘ জুদদে যাবি না। দংচো হয়ে যাবি। আহা কি সংলাপ। তোমার মতো এমন খলনায়ক থাকতে শেহজাদ ভাই কেন যে শিল্পী খুঁজতে খুঁজতে মরতো কে জানে? ‘
শেরহাম চোখমুখ শক্ত করে তটিনীর মুখপানে চেয়ে রইলো। তটিনী নিজেকে ছাড়িয়ে শেরহামকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল,
‘এত এত মানুষ মরে, তোমার মরণ হয় না? সবাই বেঁচে যেত। তোমার মতো নরপশু মরলে কারো কিচ্ছু যায় আসবে না। ‘
শেরহাম এবার ভয়ানক চেঁতে গিয়ে তটিনীর গলা চেপে ধরতে গিয়েও ধরলো না। তটিনী এগিয়ে এসে বলল,
‘ কি হলো গলা চেপে ধরছো না কেন? সাধু সম্রাট হচ্ছো। শোনো সাধু সম্রাট হতে গেলে শুধু বউ পেটানো ছাড়লে হবে না, তোমার মনটাকে পরিষ্কার করো। ঠিক আছে? প্রতিহিংসা তোমাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে দেখেছ? আয়নায় দেখেছ নিজেকে? হিংসেয় জ্বলেপুড়ে নিজের কি হাল বানিয়েছ? এখন ক্ষমতা, যশ, প্রতিপত্তি সব আছে তোমার। আপন মানুষ আছে? তোমাকে আগলে রাখার মানুষ আছে? শেহজাদ ভাই বন্দী তাই তার বেগম তার হয়ে সব কাজ করছে। তাকে মুক্ত করার জন্য দিনরাত ছোটাছুটি করছে। তুমি বন্দী হলে কেউ তোমার কথা মুখেও আনবে না। ভুলে যাবে তোমাকে। তোমার হিংস্রতার কথা মনে করে তোমাকে ভুলে থাকতে চাইবে। আমি তো ভুলেই যাব এমন একটা নিকৃষ্ট মানুষের সাথে আমার নিকাহ হয়েছিল। ‘
শেরহাম হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিল। বলল,
‘ থাম। এখানে আমার কি দোষ? মেয়েগুলো অপহরণ হচ্ছে আমি জানতাম নাকি? না জানতাম সন্ন্যাসীরা ফসল ক্ষেত নষ্ট করছে। আমার দিকে সরাসরি আঙুল তোলা খুব সহজ না? স্বভাব হয়ে গেছে তোদের? আর আমাকে বন্দি করবে কে? শেহজাদ সুলতান? ওর জন্য তোর দরদ এত উপচে পড়ছে কেন? আরেকজনের স্বামী নিয়ে এত চিন্তা কেন তোর? ‘
তটিনী আঙুল তুলে বলল,
‘ মুখ সামলে কথা বলো। তুমি অসৎ পথে গিয়েছ তাই ওর সাথে আমার নিকাহ ঠিক হয়েছিল। তুমি সবাইকে অশান্তিতে রেখেছিলে। তোমার কারণে আজ আমার এই পরিণতি। মহলের সবাই কষ্টে আছে তোমার জন্য। সবকিছুর জন্য তুমি দায়ী। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগে শেহজাদ ভাইকে মুক্ত করো। সাহস থাকলে সামনাসামনি যুদ্ধ করো। তুমি যা করছো তাতে প্রমাণ হচ্ছে তুমি একটা ভীতু। ‘
শেরহাম গর্জে উঠলো,
‘ তুই বাড়াবাড়ি করছিস তনী। ‘
‘ তো মেরে ফেলছো না কেন? দাঁড়াও। ‘
কোকেন পাউডার, আতরের শিশি নিয়ে এল তটিনী। দেখিয়ে বলল,
‘ রাতে এসব খেয়ে তারপর চিরতরে মুক্তি নেব তোমার কাছ থেকে। ‘
শেরহাম কপাল ভাঁজ করে বিস্ময় নিয়ে তাকালো। শান্ত স্বরে সাবধান করে বলল,
‘ একফোঁটাও অনেক ক্ষতিকর। পুরোটা খেলে সেকেন্ডের ভেতর মরবি । আমাকে দে। তোদের এত সহজে মারবো না আমি। দে বলছি। ‘
তটিনী দিল না। নিজের পেছনে হাত লুকিয়ে বলল,
‘ দেব না। কি করবে তুমি? মারবে? মারো। গলা চেপে ধরবে? ধরো। তারপরও দেব না। আজকে মর*বই আমি। ‘
বলেই কক্ষের বাইরে চলে যাচ্ছিলো। শেরহাম দরজা বন্ধ করে তটিনীর হাত থেকে কোকেন নেয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। তটিনী তার হাতদুটো পেছনে লুকিয়ে দরজার সাথে চেপে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ নিতে পারবে না। আমি দেব না। সরো আমার সামনে থেকে। ‘
শেরহামের মাথায় হঠাৎই বুদ্ধি খেলে গেল। সে কটি চেপে তটিনীকে নিজের কাছে এনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। চেপে ধরে রেখে তটিনীর হাত থেকে কোকেইনের পাউডার উদ্ধার করতে করতে খেয়াল করলো তটিনীর হৃৎস্পন্দন। উত্তেজিত শরীরটা নরম হয়ে এসেছে।
তটিনী ঠেলে সরিয়ে দিতেই শেরহাম হাসতে হাসতে বলল,
‘ কার সাথে পাল্লা দিতে যাচ্ছিস তা ভালো করে ভেবে নিবি। এখন চুপ হয়ে গেলি কেন? ‘
চোখমুখ শক্ত করে তটিনী কপাল কুঁচকে তাকিয়ে ভাবলো এই লোকের মধ্যে সুন্দর কিছু থেকে থাকলে তা হলো তার হাসি। হাসি ছাড়া আগাগোড়া সে জঘন্য পুরুষ।
শেরহাম হাসি থামিয়ে মুখে গাম্ভীর্যতা টেনে বলল,
‘ এভাবে দেখার কি আছে? আরও সামনে এসে দেখ। ‘
তটিনী বিরক্তির সুরে বলল,
‘ নিজেকে অসহায় লাগে না তোমার? একটা মানুষও তোমাকে ভালোবাসেনা। তোমার ভয়ে আতঙ্কে থাকে সকলে। তোমার আফসোস হয় না?’
শেরহামের দৃষ্টি কঠিন হয়ে এল ধীরেধীরে। তাকে কিছু বলতে না দিয়ে তটিনী চলে গেল সেখান থেকে। শেরহামকে ভাবনায় ফেলে দিল কথাটি। আফসোস, অনুতাপ এসব তাকে ছুঁতে পারেনা। কভু না।
__________________________
অপরূপা শেহজাদের জন্য রেঁধে নিল। তারপর প্রহরীর অপেক্ষায় থাকলো। খোদেজা এসে দেখলো খাবার প্রস্তুত করে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে সে। খোদেজা ডাকতেই অপরূপা ঘাড় ঘুরিয়ে নিকটে এসে বলল,
‘ জ্বি আপনার নাকি শরীর খারাপ? উঠে এলেন কেন?’
খোদেজার চোখমুখ লাল। জ্বলজ্বল করছে। হাত পা কাঁপছে। ভালো করে দাঁড়াতে পারছেন না।
গায়ে খুব জ্বর এসেছে। জ্বর এলে শেহজাদ মায়ের শিয়রে বসে থাকতো অনেকক্ষণ। দোয়াদরুদ পড়ে ফুঁ দিত। খোশগল্পে মাতিয়ে রাখতো মাকে। জলপট্টি দিত। নিজ হাতে খাইয়ে, ঔষধও খাইয়ে দিত। তা মনে পড়তেই ছেলেকে দেখার তীব্র বাসনা জাগলো মনে। একবার যদি স্বচক্ষে দেখতে পেতেন ছেলেটাকে। অসুস্থতা বোধহয় ছেলের কথা মনে পড়তেই আরও বাড়ছে। অপরূপা উনাকে কেদারায় বসালো। গরম ভাতে ভুনা মাছের তরকারি দিয়ে বলল, ‘ খেয়ে ঔষধ খান। ‘
খোদেজা দু’পাশে মাথা নাড়ালো।
অপরূপা তার এমন অবস্থা দেখে ডাকলো সবাইকে। সায়রা সোহিনী তটিনীরা সকলেই ছুটে এল। সায়রা খোদেজাকে দেখে বলল, ‘ ও আল্লাহ, আম্মার জ্বর দেখি বেশি বেড়েছে। ‘
অপরূপা বলল, ‘ হ্যা। খেতে বলছি। খাবেন না বলছেন। না খেলে ঔষধ কি করে খাবেন? ‘
খোদেজা মাথা এলিয়ে দিল। চোখের কোণায় জল জমেছে। তটিনী খোদেজার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ তুমি খাইয়ে দাও। মামীমা আপনাকে সুস্থ থাকতে হবে। আপনি এভাবে ভেঙে পড়বেন না। ‘
খোদেজা আচম্বিত তার হাত খপ করে ধরে বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,
‘ শেরহামকে বলো শেহজাদকে যেন একটিবার দেখতে দেয়। তুমি ওর বেগম। ও তোমার কথা শুনবে। ‘
তটিনী মহাবিপদে পড়ে গেল। সে তো নামের বেগম, শেরহাম সুলতান তার কথা শুনেছে কবে?
শাহানা এসে সবটা শুনে বলল,’ হ্যা অপরূপা তার সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে। তুমিও তো করতে পারো। তোমারও তো একটা দায়িত্ব আছে মা। তুমি ওকে বুঝানোর চেষ্টা করেছ কখনো? ‘
তটিনী বুঝাবে শেরহাম সুলতানকে? সে বলল,
‘ অসম্ভব আম্মা। ‘
সোহিনী বলল
‘ অসম্ভব হোক। তুমি চেষ্টা তো করতে পারো। হোক ছলনা। একটিবার চেষ্টা করে দেখো। ‘
সকলেই সম্মতি জানালো।
অপরূপা খোদেজাকে ভাত খাইয়ে দিতে দিতে তটিনীর মনের অবস্থা বুঝার চেষ্টা করলো। শেরহাম সুলতান নিজের বেগমের কথাও শুনবেন না? কোনো সম্পর্কের দাম নেই উনার কাছে?
খোদেজা বলল,
‘ তোমার পায়ে পড়ি। একবার চেষ্টা করে দেখো। ‘
তটিনী বলল,
‘ কি বলছেন এসব? আমি চেষ্টা করব। আপনি দয়া করে এভাবে কাঁদবেন না। ‘
তটিনী মনেমনে পণ করলো সে এমন কিছু করবে যাতে শেরহাম সুলতান তার কথা শুনতে বাধ্য হয়।
——
খোদেজার জ্বর কমার নয়। অপরূপা উনার শিয়রে বসে কোরআন পাঠ করেছে । তারমনে ভয় ঝেঁকে বসেছে। শাহজাহান সাহেব বারকয়েক এসে দেখে গেলেন খোদেজাকে। অপরূপার মাথায় হাত বুলিয়ে চুপচাপ বিদেয় হলেন। লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আওড়ালেন, পুত্র দেখে যাও তোমার অনুপস্থিত কি ভীষণ পোড়াচ্ছে সবাইকে। সেই তুুমি পালিতপুত্র বলে অভিমানে মহল ছেড়েছিলে। ‘
সন্ধ্যায় তুমুলবেগে ঝড় নামলো। আঁধারে ছেয়ে গেছে পুরো নগর। জল থৈথৈ করছে চারপাশে। বাতাসের সে কি ডাক। দুমড়েমুচড়ে ভেঙে ফেলছে বড়বড় গাছের ডাল। রাতের আঁধার নামতে নামতে বন্য শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। সাথে ঝিঁঝি পোকার বিশ্রী রকমের খঞ্জনা। শেরহাম তার লোকজনের সাথে কোথায় যেন গিয়েছে। তার ফেরার অপেক্ষায় ছিল তটিনী। শুরুতেই ভেবে রাখলো আজ মেজাজ একদম শান্ত রাখবে সে। মুখেমুখে কথা বলবে না। তর্কে জড়াবে না।
শেরহামের ঘোড়া এসে মহল প্রাঙ্গনে থামতেই তটিনীর ভেতরকার উত্তেজনা বাড়লো। শেরহাম মাথার পাগড়ি খুলতে খুলতে মহলের ভেতরে পা রাখলো। তটিনী তাকে দেখে আঁতকে উঠলো। দেখে মনে হচ্ছে কাটাকাটি করে এসেছে কারো সাথে। নাকি মানুষ মেরে এসেছে। হায় খোদা এখন তো মেজাজ তুঙ্গে থাকবে। কিভাবে সে তাকে বশীভূত করবে। শেরহাম সুলতান কেনই বা তার কথা শুনবে? তাদের মধ্যে তো তেমন সম্পর্ক নেই। তটিনী নিজেকে বুঝালো আজ সে খুবই শান্ত থাকবে। যত্নশীল বেগমের মতো আচরণ করবে।
শেরহাম কক্ষে এসে কাপড়চোপড় নিয়ে হাম্মামখানায় চলে গেল। গোসল সেড়ে এসে তটিনীকে ডাকতে যাবে দেখলো তটিনী তার আগেই কক্ষে উপস্থিত খাবারদাবার নিয়ে। শেরহাম আর কিছু বললো না। শেরহাম প্লেট গ্লাস ভালো করে দেখে নিয়ে খেতে বসলো। খেতে খেতে বলল,
‘ রান্না কে করেছে? ‘
তটিনী মিথ্যে বলল,
‘ আমি। ‘
শেরহাম কোনো শব্দ ছাড়াই খেল। তটিনী দেখলো তার গলার একপাশে একটা ক্ষত। সম্ভবত আঁচড় লেগেছে কোনো লতাপাতায়। জঙ্গলে গিয়েছিল নাকি?
শেরহাম খাওয়া দাওয়া শেষ করতেই তটিনী সব গুছিয়ে ফেললো। শেরহাম নিজেও অবাক তটিনীর আচরণ দেখে। অন্যদিন খাওয়া শেষ হওয়ার আগে আজেবাজে গালাগালি করে, আজ কি হলো?
শেরহাম কেদারায় বসে বন্দুকের নলে গুলি ভরতে লাগলো খাওয়া শেষে। বন্দুক ভরা শেষে কক্ষ থেকে বের হতে যাবে তটিনী তার পথ আটকে দাঁড়ালো। শেরহাম কপাল ভাঁজ করে বলল,
‘ কি সমস্যা? পথ ছাড়। ‘
তটিনী পথ ছেড়ে দিল। শেরহাম এগোবে তখুনি আবারও আটকে দাঁড়ালো। নিকটে গিয়ে গলার পাশে হাত রেখে বলল,
‘ তোমার এখানে ছিলে গিয়েছে। এদিকে এসো। মলম মেখে দিই। ‘
শেরহাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার মুখপানে চাইলো। ছলনা বুঝতে পেরে মনে মনে হেসে তটিনীকে প্রশয় দিল। আজ তার খেলায় তাকে হারাবে সে। নাটক সেও জানে।
তটিনী বন্দুকটা নিয়ে রেখে দিয়ে মলমের কৌটা এনে পায়ের আঙুলের ভর দিয়ে বলল,
‘ তুমি বসো। আমি লাগাতে পারছি না। ‘
শেরহাম স্বাভাবিক গলায় বলল,
‘ আমি লাগিয়ে নেব। সর। ‘
তটিনী না না বলে উঠে জোর করে তাকে কেদারায় বসিয়ে দিল। তারপর শেরহামকে দ্বিগুন অবাক করে দিয়ে কোলে বসে একেবারে গলা জড়িয়ে ক্ষতচিহ্নে মলম লাগিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ মামীমা শয্যাশায়ী। শেহজাদ ভাইজানের সাথে একবার দেখা করিয়ে দাও। ছেলেকে একবার দেখার জন্য ছটপট করছে। উনি তো তোমার শত্রু নন। ‘
শেরহাম এতক্ষণে বুঝতে পারলে রহস্য কি। এই তাহলে ব্যাপার! তটিনীকে চমকে দিয়ে কোমর চেপে ধরে নিজের আরও কাছে টেনে নিয়ে বলল,
‘ চাবি দরকার? ‘
তটিনী এমন পুরুষালী হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠলো। গলা শুকিয়ে এল তার। অপ্রস্তুত হয়ে স্মিত হাসলো। কথা জড়িয়ে এল ঠোঁটে। শেরহামের নাকে গিয়ে ঠেকলো তার নাকের অগ্রভাগ। চোখ বুঁজে মাথা নেড়ে বলল,
‘ নাহ। ওই মানে একবার দেখা করিয়ে দাও। ‘
শেরহাম চালাকি করে বলল,
‘ আচ্ছা। ‘
তটিনী খুশি হয়ে গেল। চোখ মেলে তাকিয়ে বলল,
‘ সত্যি অনুমতি দিচ্ছ? ‘
শেরহাম মৃদুস্বরে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ছুঁয়ে দিতে দিতে বলল, ‘ হ্যা। ‘
তটিনীর হাত পা অবশ হয়ে আসতে লাগলো শেরহামের হাতের শক্ত বাঁধনে, আলতো স্পর্শে। অদ্ভুতভাবে শেরহামের এমন স্পর্শ তার ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে ছেড়ে না দিক।
গোসল করে আসায় শেরহামের শরীর ঠান্ডা। তটিনীর শরীরের উষ্ণতা তাকে পাগল করে দিচ্ছে। তটিনী বিপদসংকেত বুঝে মৃদুস্বরে বলে উঠলো, ‘ মলম মেখে দিয়েছি। চাবি দাও। ‘
শেরহাম মনে মনে হাসলো। নাকে নাক ঠেকিয়ে বলল,
‘ পকেটে হাত দে। ‘
বলতে দেরী পকেটে হাত দিতে দেরী নেই। চাবি পেয়ে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তটিনীর। চাবি মুঠোয় নিয়ে দ্রুত সরে যাবে শেরহাম হাতের বাঁধন আরও শক্ত করে ধরে নাকের সাথে নাক জোরে চেপে ধরে বলল,
‘ কোথায় যাচ্ছিস? ‘
তটিনী হাঁপাতে থাকলো। টাল সামলাতে শেরহামের গলা জড়িয়ে ধরে মিনমিন করে বলল,
‘ চাবি দিতে। ‘
শেরহাম ক্রুর হাসতেই তটিনী তা দেখে ভড়কে গেল। মধ্যেবর্তী কিঞ্চিৎ দূরত্ব মিটিয়ে শেরহাম তার ওষ্ঠদ্বয় নিজের আয়ত্তে নিতেই তটিনীর হাত থেকে চাবির তোড়া পড়ে গেল ঝণাৎ শব্দ তুলে। ঠোঁটের দংশনে, পেশনে তটিনী নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল। নিজের ক্ষোভ মিটিয়ে শেরহাম তাকে ছেড়ে দিয়ে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,
‘ আমার সাথে নাটক করার আগে একশবার ভাববি, আমি তোর চাইতে শতগুন নাটকবাজ। ‘
বলেই তটিনীকে মেঝেতে ঝেড়ে ফেলে দিল। তটিনী প্রচন্ড আক্রোশে, ক্রোধে কেঁদে উঠলো হু হু করে।
শেরহাম চাবি তুলে নিয়ে গটগট পায়ে হাঁটা ধরলো।
শাস্তিটা অন্যভাবে দিতে পারতো। কিন্তু নিজেকে আটকাতে পারেনি। কি যে হচ্ছে!
মহাবিরক্ত হয়ে গটগট পায়ে হেঁটে অতিথিশালায় ঢুকতেই দেখলো সৈন্যরা মদের আসর সাজিয়েছে। শেরহামকে দেখে সকলেই সরে বসলো। শেরহাম কেদারায় বসে ঢকঢক করে কয়েক বোতল খেতে খেতে তটিনীর ঘৃণামিশ্রিত মুখখানা মাথা থেকে ঝেড়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ এই শিলাবৃষ্টি হচ্ছে নাকি? ‘
সামাদ খেয়াল করে বলল
‘ হ্যা হুজুর। সব ফসল নষ্ট হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। ‘
শেরহাম হাতের কাঁচের বোতলটি দূরে ছুঁড়ে মারতেই সেটা ঝনঝন ঝনঝন শব্দ তুলে মেঝেতে পড়ে ভেঙে গেল।
ফের কক্ষে ফিরে গিয়ে দেখতে পেল তটিনী মেঝেতে বসে চৌকির সাথে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে। গুমরে গুমরে কাঁদছে। শেরহাম আলো নিভিয়ে শুইয়ে পড়লো। মধ্যরাতে ঘুম ভাঙতেই দেখলো তটিনী সেই অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছে। সে কোলে নিয়ে বিছানা শুইয়ে দিয়ে চাদর ঢেকে দিয়ে নিজে কেদারায় গিয়ে বসে রাত কাটিয়ে দিল। ভাবলো শেহজাদ সুলতানের সাথে মুখোমুখি লড়বে এবার। এদের এত নাটক আর নেয়া যাচ্ছে না। অসহ্য হয়ে উঠেছে।
সামাদের কথা সত্যি হলো। নগরের সমস্ত ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়ে গেল শিলাবৃষ্টির হওয়ার কারণে। চাষীরা দলে দলে এসে ফরিয়াদ জানালো তাদের এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দিতে। ডাকাতের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছে, একের পর এক দুর্যোগ আসছে। গত রাতে আবারও দুটো মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে। এদিকে নদীর ধারে দুজন সন্ন্যাসীর মৃতদেহও পাওয়া গেল। তাদের বুকে অসংখ্য তীর বিঁধেছিল। সকাল সকাল তার মাথা খারাপের মতো অবস্থা।
সকালের নাশতা খাওয়ার জন্য খাবার ঘরে যেতেই টেবিলে বসা শেরতাজ সাহেব, শাহাজাহান সাহেব আর সাফায়াতকে দেখলো। চেয়ার টেনে বসে খাবারে মনোযোগ দিতেই অপরূপা এল সেই কক্ষে মাংসের পেয়ালা হাতে নিয়ে। শেরহামকে তাকে দেখে সাফায়াতের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ গতরাতে নদীর ধারে সন্নাসীদের মেরেছে কে? ‘
অপরূপার সরাসরি জবাব।
‘ আমি। ‘
শেরতাজ সাহেব আর শাহজাহান সাহেব চমকালো। সাফায়াত চুপচাপ খেতে লাগলো। শেরহাম গর্জে উঠে বলল,
‘ এত স্পর্ধা হয় কি করে তোমার? ‘
অপরূপা বলল,
‘ আমার আস্পর্ধার কথা ছাড়ুন। নিজের রাজত্ব বাঁচান আগে। আজ না হয় কাল মানুষ খেতে না পেয়ে আপনাকে মারতে আসবে। শেহজাদ সুলতান ক্ষমতায় যতদিন ছিলেন ততদিন খাদ্য সংকটে পড়েনি। আপনাকে কেউ ঋণও দেবে না ক্ষমতা আসার সাথে সাথে। অনেক বিপদে আছেন আপনি। আপনার সৈন্যরা রাত-বিরেতে কি করে বেড়াচ্ছে তার উপর নজর দিন। আপনার ধ্বংস অতি নিকটে। ‘
বলেই সে হনহনিয়ে চলে গেল।
শেরহাম খাওয়া রেখে চাবুক হাতে নিয়ে অতিথি শালায় গিয়ে দেখলো সামাদ আর মুরাদসহ সকল সৈন্যরা তাজ খেলায় বসেছে। সামাদ আর মুরাদ কাল যায়নি। তাদের রেখে বাকিদের উপর সে আচম্বিত হামলা করে বসলো । চাবুক মেরে লাতি দিতে দিতে সবকটাকে আধমরা করে বলল,
‘ আমার খেয়ে, আমার পড়ে আমার পেছনে শত্রুতা করছিস। আমার কথা অমান্য করছিস। ‘
সবাই মিলে পা ধরে বলল,
‘ হুজুর মাফ করে দিন। এমন আর হবে না। আপনার কথামতো চলবো। ‘
তাদের চিৎকারে ছুটে এল মহলের সবাই। সিভান হাত তালি দিতে দিতে বলল, ‘ কি মজা কি মজা। গুন্ডারা মার খাচ্ছে। ‘
শেরহাম ওদের মেরে ক্ষান্ত হলো। চাবুক ছুঁড়ে মেরে সামাদকে বলল,
‘ পারলে এদের গায়ে নুনের ছিটা দে। আমার কথা যে অমান্য করবি এরপরের বার তাকে জ**বা**ই ক*রে দেব । সোজা কথা। ‘
হনহনিয়ে অতিথিশালা হতে বের হতেই সবাইকে দেখে বাজুতে ঘর্মাক্ত মুখ মুছলো সে। তারপর পাশ কেটে কক্ষে চলে গেল। গিয়ে দেখলো তটিনী কাপড়-চোপড় ভাঁজ করছে আনমনা হয়ে। তাকে নীরব, শান্ত দেখাতেই শেরহামের মনে হলো যে চিৎকার করে তাকে চুপ থাকা মানায় না। স্বভাব, অভ্যাস পাল্টানো মানে নিজের স্বত্বা হারিয়ে ফেলা। সেই বিষয়াদি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো সে। তাকে দেখে তটিনী ঘৃণাভরে তাকালো।
কক্ষ থেকে দ্রুত বের হয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। শেরহাম ওর পথ আটকে দাঁড়ালো। তটিনী পাশ কেটে যেতেই শেরহাম সেই পথও রুদ্ধ করে দাঁড়ালো। তটিনী চোখ তুলে রোষাগ্নি দৃষ্টিতে তাকাতেই দেখলো তার সামনে চাবির তোড়া ধরে আছে শেরহাম। তটিনীর চোখমুখে আনন্দ উপচে পড়লো। শেরহাম বলল,
‘ শেহজাদ সুলতানের মুক্তি। ‘
তটিনী খপ করে চাবি হাতে নিয়ে বলল, ‘ তাও নিজের কারণে। নিজের স্বার্থে। তুমি পরাজিত শেহজাদ সুলতানের ধৈর্যের কাছে। আজ থেকে শেহজাদ সুলতান মুক্ত। সামনাসামনি লড়াইয়ে সে জিতবে আর তুমি হারবে। ‘
শেরহাম নিষ্পলক চেয়ে বক্র হাসলো। সে আপনাআপনি কোনো কাজ করেনা। তটিনী খুশিমনে ছুটতে যাবে তখুনি কি মনে করে আবারও পিছু ফিরে বলল,
‘ আমি কবে মুক্তি পাব? ‘
‘ শীঘ্রই। ‘
তটিনী আর দাঁড়ালো না একমুহূর্তও।
মহলের ভেতর খুশির জোয়ার আছড়ে পড়লো মুহূর্তেই। হৈহল্লায় মেতে উঠলো চারিপাশ। সায়রা আলমিরা হতে নতুন চাদর বের করলো, শেহজাদের নতুন পোশাক, সুগন্ধি আতর। এতদিন যেন সকলেই ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। শেহজাদের মুক্তি শুনে জেগে উঠলো সকলে। কাজের বুয়ারাও এতদিন চুপসে ছিল ভয়ে। আজ তারাও আনন্দে আত্মহারা। অপরূপা বড় পাতিলের ঢাকনা সরিয়ে লবণ দেখছিল কাঠের কাঠিতে । সায়রা, সোহিনী, শবনম, আয়শা আর সিভান তাকে ঘিরে ঘুরতে ঘুরতে বলল,
‘মোবারক বাদ ভাবীজান। ভাইজানের মুক্তি। ‘
অপরূপা কাঠি হাতে দাঁড়িয়ে রইলো স্তব্ধ হয়ে। খুশিতে কি প্রতিক্রিয়া দেবে তা ভুলে বসলো।
খোদেজা অসুস্থ শরীরে হেঁটে চলে এল। অপরূপা এসে উনাকে জড়িয়ে ধরলো। উনি হাসলেন। বললেন, তোমার অপেক্ষা ফুরিয়েছে।
শোনা গেল শেহজাদের সৈন্যদের কলরব। চারপাশে যেন ঈদ লেগেছে এমন খুশিতে মেতে উঠলো পুরো মহল।
শেহজাদ বন্দি কুঠুরি হতে বেরিয়ে বাবার জেঠার জড়িয়ে ধরে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে সৈন্যদের মাঝখানে হেঁটে চলে এল। সিভান ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। শেহজাদ তাকে কোলে তুলে আদর করলো। সিভান হাসলো। সায়রা সোহিনীরা সকলেই তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। শেহজাদ তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দূরে খোদেজাকে দেখতে পেল। খোদেজা তাকে দেখে হাত বাড়িয়ে দিতেই সে মায়ের কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো। খোদেজা আনন্দের কান্নায় ভেসে গেল। শবনমের হাত থেকে চাদর নিয়ে শেহজাদের গায়ে জড়িয়ে দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল,
‘ আমার শাহজাদা। আজ মহলের প্রাণ ফিরে এসেছে। দেখো কত আনন্দিত সবাই। ‘
শেহজাদ চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
‘ এবার সব ঠিক হয়ে যাবে আম্মা। কাঁদবেন না। ‘
খোদেজা নিজেকে শান্ত করলো। শেহজাদ তটিনী আর শবনমের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ তোমরা ঠিক আছ? ‘
তটিনী মাথা দুলিয়ে বলল,
‘ এখন আরও বেশি ঠিক আছি। ‘
‘ এই আনন্দ স্থায়ী হোক। ‘
তটিনী ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো।
সাফায়াত এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো আচমকা। পিছিয়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে হেসে উঠলো শেহজাদ। সবাই হাসলো।
সাফায়াত কথা বলতে পারলো না। জড়ানো গলায় বলল,
‘ তোমার অনুপস্থিতিতে শুধুই মহল নয় নগরেও আঁধার নেমেছে ভাইজান। ‘
শেহজাদ পিঠ চাপড়ে বলল,
‘ আমার বন্ধু। আমি ফিরে এসেছি। আসতেই হতো। ‘
শেরতাজ সাহেব আর শাহজাহান সাহেব তাড়া দিল তাকে নীচে যেতে। অনেক জরুরি কথা আছে। খোদেজা পথ আটকে বলল,
‘ নাহ। তারও বেশি জরুরি কাজ বাকি আছে। তার বেগমের সাথে সাক্ষাৎটা ভীষণ জরুরি। যাও পুত্র। তাকে দেখা দিয়ে এসো। ‘
মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রসন্ন হেসে পা বাড়ালো শেহজাদ। শেহজাদকে আসতে দেখে অপরূপা জানালার দ্বার হতে ছুটে গিয়ে দরজার দ্বার মেলে দিল। সাথে সাথেই শেহজাদকে নয়নমেলে দেখে বড়সড় একটা দম ফেললো। টলটলে অশ্রুমিশ্রিত চোখে চেয়ে থেকে প্রাণখোলা হেসে বলল,
‘ স্বাধীনতা মোবারক প্রিয় । প্রতিবার এভাবেই জয়ী হয়ে ফিরে আসুন আমার কাছে। ‘
শেহজাদ মাথা হেলিয়ে বলল,
‘ তথাস্তু আমার বেগম। ‘
অপরূপা হেসে তাকে পিছু করে দাঁড়ালো। শেহজাদ হেঁটে চলে এল। সৈন্যদের সাথে বুকে বুক মিলিয়ে কাশীম আর কামীলকেও জড়িয়ে ধরলো। তারপর নীচে এসে দেখলো দাদাজানের সেই সিংহাসনের উপর পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে শেরহাম। বিড়ির ধোঁয়া উড়ছে। শেহজাদ তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
‘ হার নাকি আত্মসমর্পণ কোনটা ? ‘
শেরহাম তার সম্মুখে দাঁড়ালো। অস্ত্র ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
‘ নিয়োগ করেছি। কত মূল্য তোর?’
শেহজাদ অস্ত্রটি দুর্বার গতিতে খপ করে ধরে বলল,
‘ আমার মূল্য তুমি তোমাকে বেঁচেও দিতে পারবে না।
চলমান….
ধামাকা পর্ব😍