#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_৪
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
তটিনীকে বোনদের কক্ষে দেখে শাহানা কপাল ভাঁজ করে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন, ‘ তনী কি হয়েছে? কোমরে কি করে এত আঘাত লাগলো?’
তটিনী মাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো। শাহানা তার পাশে বসে মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরলো। তটিনী কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘ আম্মা আমার তালাক করিয়ে দাও উনার সাথে। আমি এমন অমানুষের ঘরণী হয়ে থাকতে চাই না।’
শাহানার বুকের ভেতর অসহ্যরকমের ব্যাথা হচ্ছে। আব্বাজান কেন এমন ভবিতব্য বলে গেলেন? খোদাতায়ালা কেন তার নিষ্পাপ মেয়েটার সাথে এমন করলেন? কাকে দোষ দেবেন উনি? রূপাকে? তাকে তো শেহজাদ ভালোবেসে নিকাহ করেছে। তটিনীকে তো সে নিকাহ করতে চায়নি শুরু থেকে। যদিও করতো তটিনীকে দায়িত্ব ভেবে নিত। রূপাকে সে আদৌ কি ভুলতে পারতো? দায়িত্ব আর ভালোবাসা যে দুই মেরুরেখা।
কৈশোরে মেয়েটা ভেবেছিল তার সাথে নিকাহ হবে একজনের সাথে। তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু হতে না হতেই সে চক্ষু আড়াল হয়ে গেল। তারপর হতে শুনে এল নিকাহ হবে তার ছোটভাইয়ের সাথে। তারও মন পেল না সে। ভালোবাসার আগেই তার সব শেষ হয়ে যায়। এতটাই দুর্ভাগা সে। এখন যা-ও নিকাহ হলো সে তো আস্ত একটা অমানুষ। একটা কাফের। তার সাথে কি করে সংসার সম্ভব? সে তো সারাক্ষণ তাকে আঘাত দিতে ব্যস্ত। কি হবে এর ভবিষ্যৎ?
মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে কেঁদে উঠলো মায়ের মন। বললেন, ‘ ও তোমাকে এত তাড়াতাড়ি তালাক দিলে নিকাহ করতো না। ‘
তটিনী মায়ের বুকে মুখ গুঁজে ফোঁপাতে লাগলো।
শাহানা তাকে শুয়ে দিল। কপালে চুমু খেয়ে বলল,
‘আমি মলম মালিশ করে দিচ্ছি। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো। ব্যাথা কমে যাবে। ‘
তটিনী বলল, ‘ না দরকার নেই। মালিশ করে দিয়েছে। তাই তো চলে এসেছি। আমাকে ছুঁলো কোন সাহসে? ঘৃণায় আমার গা জ্বলছে। ছিঃ। ‘
শাহানা আর কিছু বললেন না। শেরহাম মালিশ করে দিয়েছে! এ অবিশ্বাস্য!
___________
শেরহাম আর তার লোকজনের ঘোড়া থেমে যেতে দেখলো অপরূপা আর সাফায়াত। সাফায়াত বলল, ‘ রূপা আমাদের এখানে থেমে যাওয়া উচিত। নইলে ওরা টের পেয়ে যাবে। ‘
অপরূপা সম্মতি জানালো।
তারা বেশ খানিকটা দূরে ঘোড়া থামিয়ে পায়ে হেঁটে আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে শেরহামদের নিকটে চলে এল। জাদুকর গুলোর হাতে মশাল জ্বলছে। তাদের গায়ে কালো পোশাক। কপালে লাল চন্দন। দেখতে ভয়ংকর হিংস্র। শেরহামের মাথায় পাগড়ি পড়া। মুখ ঢাকা। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে মুখোমুখি দাঁড়ালো তাদের। অপরূপা সাফায়াতকে ইশারা করলো খুব আলগোছে হাঁটতে। তাদের কথাবার্তা শুনতে হবে। আজ কোনো মেয়ে দেখা যাচ্ছে না। তারমানে আজ মেয়ে নিয়ে যাবে না। তাহলে কেন এল?
ঝোপেঝাড়ের মাঝখানে সরু জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে আছে শেরহাম আর তার লোকজন। সেখানে সাদা মাটি। দুপাশেই ঝোপঝাড়। অপরূপা খালি পায়ে চুপিসারে হেঁটে ঝোপের পেছনে লুকিয়ে পড়লো। তাদের ঘোড়া অন্যপথে রেখে এসেছে। সেই শেরহামের যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তারপরও অপরূপার বুক কাঁপলো। ঝোপের আড়ালে দাঁড়াতেই শেরহাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশ দেখলো। তার লোকেরাও দেখছে।
জাদুকর সেই বৃদ্ধ লোকটি বলে উঠলো,
‘ রাজত্ব পেয়ে আমাদের ভুলেই গেছিস। কোন উদ্দেশ্যে এখানে এসেছিস তোর মনে নেই? যার কাছে দীক্ষা পেয়েছিস তার কথা দেখি মনেই নেই তোর। ‘
শেরহাম সে কথায় মুখের কাপড় সরিয়ে রক্তলাল চোখে চেয়ে বলল,
‘ অনেক সাহায্য করেছি। আবার কিসের সাহায্য? তোমরা কাল কেন এসেছিলে? মিথ্যে বললে একটাও জ্যান্ত রাখবো না।’
বৃদ্ধ লোকটার চোখদুটো মশালের আলোয় ভয়ংকর লাল দেখালো। কটমট গলায় বলল,
‘ দেখেছিস তোরা সবাই! আমি এটাই ভাবছিলাম। ক্ষমতা হাতে আসতেই আমাদের নকড়াছকড়া ভাবতে শুরু করে দিয়েছে। ভুলে যাস না আজকে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কার জন্য। আমাদের জন্য বেঁচে আছিস। আমি তোকে দীক্ষা দিয়েছি। আর এখন আমার উপর চোখ রাঙাচ্ছিস? ‘
শেরহাম রাগ সংবরণ করে বলল,
‘ যা বলতে চাও স্পষ্ট করে বলো। কি চাও আর? যা চেয়েছ সব তো দিয়েছি। জ্যান্ত গরু চেয়েছ। চৌদ্দটা গরু দিয়েছি। নগদ পয়সা দিয়েছি। আর কি? ‘
‘ আর কি মানে? যেটা আসল সেটাই তো চায়নি এখনো। নগরে আমাদের একটা বসতি স্থাপন করবো। পাহাড় থেকে এখানে চলে আসবো। সবখানে আমাদের রাজত্ব চলবে। তোকে এজন্যই তো সম্রাট হতে সাহায্য করেছি। আমার লোক তোর সাথে দিয়েছি। ‘
অপরূপা আর সাফায়াত একে অপরের দিকে তাকালো। অপরূপার হাত নিশপিশ করছে। ইচ্ছে করছে সবকটাকে শেষ করে দিতে। আজ এদের হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে সে। সাফায়াত শেরহামকে দেখে অবাক হচ্ছে। এ কেমন অমানুষ! এই মানুষটা তাদের বড় ভাইজান ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে।
‘ দেখো আজ জাহাজ ডুবে গিয়েছে। আমি ইতোমধ্যে একটা সমস্যায় আছি। এটা সমাধান হোক। আমি তোমাদের সবটা জানাবো। ‘
বৃদ্ধ লোকটা বলল,
‘ আরও একটা কথা আছে। সামাদ জানালো যেই মেয়েটা আমাদের হাত থেকে পালিয়েছে সে মেয়েটা নাকি তোর প্রেমিকা মেয়েটা ছিল! সে আমাদের হাত থেকে পালিয়েছে। তাকে আমাদের হাতে তুলে দে। তাকে দীক্ষিত করেছি। তাকে সঠিক সময়ে বলি দিতে না পারায় দশজনকে বলি দিতে হচ্ছে। মাত্র দুজন পেয়েছিলাম কিন্তু সেসব দিয়ে হবে না। তার চাইতে ভালো ওই মেয়েকে আমাদের হাতে তুলে দে। সে এখন তোর শত্রু। আমাদের হাতে তুলে দিলে খেল খতম। ‘
শেরহাম কপাল কুঞ্চন করে বলল,
‘ অপা? ও তোমাদের হাতে একমাস যাবত বন্দি ছিল? আর তোমরা আমায় জানালে না কেন? ‘
‘ জানাবো কি করে? আমরা জানতাম নাকি এই মেয়েটা তোর প্রেমিকা ছিল। তুই আমাদের তার সাথে সাক্ষাৎ করাসনি। ‘
শেরহাম বাজখাঁই গলায় বলে উঠলো,
‘ থামো। আর ওই দু’জন মেয়ে কোথায় পেয়েছ? ‘
সামাদ আর মুরাদ চোখ নত করে দাঁড়িয়ে রইলো। জাদুকরের সাথে আসা সৈন্যরা বলল,
‘ সামাদ আর মুরাদ কাল তুলে দিয়েছে দুজনকে। কিন্তু মেয়েগুলো বেশ কচি। মরে গিয়েছে । ‘
শেরহাম দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,
‘ কচি দেখে ছিঁড়ে খেয়েছিস নাকি সবাই মিলে? ‘
দু’জন সৈন্যের দিকে বৃদ্ধ আঙুল তাক করে বলল,
‘ এই নিমকহারাম দুটো নিজেদের সামলে রাখতে পারেনি। সোজা মেরেই তারপর ছেড়েছে। এত ক্ষিদে এদের। ‘
অপরূপার কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। পায়ে নীচের মাটি শক্ত হয়ে এল। তীব্র ক্রোধিত দৃষ্টিতে
তীর তাক করলো সেই দু’জনকে ঘিরে। আজ এদের ছাড়বে না সে। জ**বা**ই করে দেবে। রাগ সংবরণ করা দুষ্কর হয়ে উঠলো। ইচ্ছে করলো এখুনি ঝাঁপিয়ে জা**ন নিয়ে নিতে।
শেরহাম বলল,
‘এরপরের বার যা করবি আমাকে জানিয়ে করবি। নইলে একটাকেও জ্যান্ত রাখবো না। ‘
বৃদ্ধ জাদুকরটির চোখদুটো হিংস্র জন্তুর মতো দপদপ করে জ্বলে উঠলো। কুশ্রী ভঙ্গিতে বলল,
‘ ওই মেয়েকে কখন হাতে তুলে দিবি? আর বেশি সময় নেই আমাদের হাতে। বলি দিতে না পারলে আমাদের শক্তি ক্ষয় হবে। আমাদের ক্ষতি মানে তোর ধ্বংস একথা মনে রাখিস। ‘
অপরূপা নিজেকে আর সামলে রাখতে পারছেনা। এদিকে কুলকুল করে ঘামছে সাফায়াত। পাছে ধরা পড়বে এই ভয়। অপরূপা ধৈর্য ধরে লুকিয়ে থাকলো।
শেরহাম বলল,
‘ ও এখন শেহজাদের বেগম। ওকে বন্দি করা যাবে না। আমি এখন সমস্যায় আছি। ওটা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমাকে জ্বালাবে না। মেয়ে ছাড়া অন্যকিছু বলি দাও। আপাতত আমি এই নিয়ে ভাবছি না। পরে ভাববো তোমাদের নিয়ে। ‘
বলেই সে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলো। বৃদ্ধ জাদুকরটি বলল,
‘ তুই তোর কাজ কর। আমরা আমাদের কাজ করব। ওই মেয়েকে সুযোগ পেলে আমরা তুলে নিয়ে যাব। আর না পেলে দশটা মেয়েকে তুলে নিয়ে যাব। ‘
শেরহাম নির্বিকার চিত্তে বলল,
‘ শত্রু পুরোপুরি নিধন হলে যুদ্ধে মজা থাকেনা। আমি তাই তাদের তিলে তিলে শেষ করব। আমার শিকার আমিই করব। তোমরা তোমাদের কাজ করো। ‘
ঘৃণায় সমস্ত শরীর রি রি করে উঠলো অপরূপার। এই মানুষকে সে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিল?
নির্ঘুম রাত কাটিয়েছিল চিন্তায়? হায়রে ঠক, প্রতারক।
শেরহামের ঘোড়া উল্টো পথে চলতে শুরু করলো। তার পেছন পেছন সামাদ আর মুরাদ চলে গেল।
জাদুকরেরা ঘোড়ার পিঠে উঠে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো চলে যাওয়ার জন্য।
অপরূপা ধনুক হাতে নিয়ে উল্কাবেগে হাওয়ার তালে তীর ছুঁড়লো ওদের দিকে। একটা তীর গিয়ে পড়লো বৃদ্ধ লোকটার হাতে, সাফায়াতের তীর গিয়ে পড়লো অন্য একটা জাদুকরের পিঠে। একনাগাড়ে তীর ছুটে আসতেই জাদুকরগুলো ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে ধনুক হাতে নিয়ে ছুটে আসার তীরের উৎসস্থল খোঁজার চেষ্টা করলো। কিন্তু অন্ধকারে তারা টের পেয়ে উঠলো না কোথাহতে তীর আসছে। অনেকক্ষণ ধরে তাদের শিকার করে আছে তাদের বুঝতে দেরী হলো না। পরপর তীর ছুটে এসে হাতে পায়ে পিঠে বুকে বিদ্ধ হওয়া শুরু করতেই ঘোড়া আঘাত পাবে ভেবে বৃদ্ধ লোকটার সাথে চারজন আহত অবস্থায় কোনোমতে পালিয়ে গেল। তাদের ভাবনাতীত ঘটনা ঘটেছে। বুঝতে পারছেনা কারা আক্রমণ করেছে। তাদের ঘোড়া অদৃশ্য হতে লাগলো।
এদিকে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাওয়া সৈন্য দুটি চিৎকার করছে। অপরূপা সাফায়াতকে বারণ করলো আক্রমণ করতে। এরা দুজন মেয়ের প্রাণ নিয়েছে। এদের প্রাণই যাবে মেয়ের হাতে। ভয়*ক*র মৃত্যু দেবে সে।
জাদুকরদের ঘোড়ার ডাক ঝাপসা হতেই অপরূপা সঙ্গে সঙ্গে ঝোপ থেকে বের হয়ে দু’জনকে হামলা করলো । চোখের পলকেই কোমরে গাঁথা খাপ হতে তলোয়ার বের করে পা দিয়ে চেপে ধরলো একজনের বুক। অপরজন তা দেখে কোনোমতে শোয়া থেকে উঠে তলোয়ার বের করে অপরূপার দিকে হামলা করতেই অপরূপা একপায়ে তার পায়ের নীচের সৈন্যটিকে চেপে ধরে নিজের উপর আক্রমণ ঠেকালো। সাফায়াত পেছন থেকে সেই সৈন্যটির পিঠ বরাবর লাতি বসিয়ে ফেলে দিল। ফেলে গলা চেপে ধরলো। সৈন্যটির সাথে সাফায়তের ধস্তাধস্তি চলছে। সাফায়াতের হাত কেটে দিয়েছে। সাফায়াত তারপরও লাতি দিতে দিতে দুর্বল করে দিতে লাগলো সৈন্যটিকে।
এদিকে ওই সৈন্যটি অপরূপার পা চেপে ধরলো দুহাত দিয়ে। অপরূপাকে ফেলে তলোয়ার নিয়ে নিজেই অপরূপার দিকে হামলা করলো। অপরূপা শায়িত অবস্থায় তলোয়ার দিয়ে তলোয়ার আটকে রাখলো। সর্বশক্তি দিয়ে আটকে রাখলো। দম আটকে এল। তারপর লোকটার কোমর বরাবর লাতি দিয়ে ফেলে দিল লোকটাকে। ব্যাথায় কুকিয়ে উঠে লোকটা শুয়ে গেল। অপরূপা আর সময় নিল না। সোজা পে* টে*র মধ্যিখানে উপর-নীচ করে
ত * লো * য়া* র গেঁথে দিয়ে তলো**য়ার বে *র করে আনতেই লোকটা গগনবিহারী চিৎকার দিয়ে মাটিতে চিরশায়িত হলো।
সাফায়াত অত্যাধিক বিস্ময়ে অপরূপাকে দেখতে গিয়ে তার পায়ের নীচে শায়িত সৈন্যটি তাকে ধাক্কা দিয়ে অপরূপার দিকে তলোয়ার ছুঁড়ে মারলো। ভাগ্য ভালো অপরূপা হাত দিয়ে সেই তলোয়ার আটকে ফেললো। তার হাতের তালু হতে রক্ত নির্গত হতে লাগলো। অন্য হাতের তলোয়ার পড়ে গেল। সৈন্যটি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মাথায় প্যাঁচানো ওড়না টান দিয়ে খুলে নিল। সাথেসাথেই অপরূপার চুল ঝাঁপিয়ে পড়লো তার গায়ে। সৈন্যটি তার গলা চেপে ধরলো। সাফায়াতকে সাবধান করলো এগোলে মেয়েটাকে শেষ করে দেবে বলে।
অপরূপা চোখ উল্টে সাফায়াতের দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করলো তলোয়ার ছুঁড়ে মারতে। সাফায়াত তলোয়ার তুলে ছুঁড়ে মারতেই অপরূপা খপ করে সেটা ধরে পরপর দু’বার আ** ক্র***মণ করে ছি**ন্ন*বি* চ্ছিন্ন করে ফেললো শরীর।
গড়গড় শব্দ করতে করতে সৈন্যটা ম *রলো। অপরূপা তাদের মেরে নিজেই চিৎকার দিয়ে বসে পড়লো দু হাঁটু গেঁড়ে। চিৎকার করে বলল,
‘ হে খোদা দুটি নিষ্পাপ প্রাণের বিনিময়ে আমি এই পশুদের প্রা*ণ নি *য়ে ছি। ‘
বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লো। এ কান্না নাকি ক্রোধের গর্জন! যার কারণে সৈন্যদের ঘোড়াদুটি ভয়ে ডাকতে লাগলো জোরে জোরে। সাফায়াত বাকহীন স্তব্ধ চোখে অপরূপাকে দেখলো। এ যেন শেহজাদ সুলতানের আরেক প্রতিভিম্ব। বিধ্বংসী, পাপের বিনাশিনী। নিজের র *ক্ত*মাখা হাতদুটোর দিকে চুপচাপ চেয়ে রইলো অপরূপা।
____________
গোসলখানার ঘাটের পানিতে শরীরের একাংশ ভিজিয়ে বসে আছে অপরূপা। তার মাথার উপর পানি ঢালছে ফুলকলি, মতিবানু। রক্ত দেখে সায়রা সোহিনী, শবনম আর আয়শা এগোনোর সাহস করেনি। ফুলকলি তার হাত মুখ থেকে ঘষে ঘষে রক্ত ধুঁয়ে দিচ্ছে। অপরূপা নির্জীব জড় পদার্থের মতো বসে আছে। সায়রা সোহিনীরা দূরে দাঁড়িয়ে হতভম্ব দৃষ্টিতে অপরূপার মুখপানে চেয়ে রয়েছে। গায়ে সাবান ঢলে দিয়ে পানি ঢেলে অপরূপার গোসল সাড়িয়ে দিয়ে একটা সবুজ রঙের শাড়ি পড়িয়ে দিল তারা। অপরূপার চোখদুটো এখনো রক্তাভ। নাকের ডগা লালচে। চোখেমুখে এখনো ক্রোধের আগুন কেলি করছে। গা কাঁপছে তার। সায়রা তাকে কক্ষে নিয়ে গেল। চৌকিতে বসিয়ে বলল, ‘খাবার আনছি। তোমাকে ঔষধ খেতে হবে। জ্বর আসছে হাতের ব্যাথায়। ‘
অপরূপা বালিশে হেলান দিয়ে বসে রইলো। সাফায়াত এসে দেখলো অপরূপা চোখ বুঁজে বসে রয়েছে। হাতে ব্যান্ডেজ। সে চলে গেল। ভাইজানের সাথে যে করেই আজ দেখা করতে হবে। উপায় বের করতে হবে।
অপরূপার কক্ষে খোদেজা এল। অপরূপা তখন চোখ বুঁজে বসেছিল। খোদেজা তার সামনে এসে বসে মাথায় হাত রাখতেই অপরূপা ঝট করে চোখ মেললো। খোদেজাকে দেখার সাথে সাথেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে গা কাঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো। খোদেজা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। গাল বেয়ে নীরব অশ্রু ঝড়তে লাগলো। কোনো কথা হলো না কারো। অপরূপা শান্ত হলো। খোদেজা তাকে বুকে স্থান দেবে তা সে ভাবেনি। খোদেজা তার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,
‘ জী*বহ*ত্যা পাপ। প*শু*হ*ত্যা নয়। মনে করো প*শু*হ*ত্যা করেছ । ওরা তো প**শুর চাইতেও অধম।’
অপরূপা মাথা নাড়লো। সায়রা খাবার নিয়ে এল। খোদেজা ভাত মেখে ওর দিকে লোকমা বাড়িয়ে দিতেই অপরূপা উনার মুখ বরাবর চেয়ে প্রশ্ন করলো,
‘ আমার দাদীজান বলতেন আমি জন্মদুঃখী। আমি যেদিকে যাব সেদিকেই দুঃখ, সেদিকেই ধ্বংস। আপনি একথা বিশ্বাস করেন? ‘
‘ তোমার দাদী ঠিক কথায় বলেছেন। তুমি দুঃখিনী। কারণ বিবাহের পর তোমার সংসার হয়ে উঠেনি। তুমি ধ্বংস কারণ আজ তোমার হাতে পাপের ধ্বংস হয়েছে।’
‘ এখন তো আপনার পুত্র নেই। তাহলে কেন বের করে দিচ্ছেন না আমাকে? এমনও তো না যে আমি আপনার পুত্রের যোগ্য হয়ে গিয়েছি। তাহলে কেন?’
‘ আমি কখনোই চাইনি তোমাদের পথ আলাদা হোক। একজন মা চাই তার সন্তানকে তার জীবনসঙ্গী ভালোবাসুক। সেখানে শুরু থেকেই তোমাকে বিচলিত হতে দেখেছি শেরহামকে নিয়ে। তাই আমার বিশ্বাস ছিল না তোমার উপর। মনে হয়েছিল তুমি শেহজাদকে ভালোবাসতেই পারো না। ‘
‘ এখন কি মনে হচ্ছে ? ‘
‘ ভালোবাসাটা জরুরি নয়। পাশে থাকা আর হৃদয় ব্যাথার জড়িবুটি হওয়াটা জরুরি। ভালোবাসা তাদের হাত ধরেই আসে। হুট করে যে গাছ বড় হয় সেই গাছ ভেঙে পড়তেও সময় নেয় না। আর যে গাছ ধীরেধীরে বড় হয় তা সহজেই ভেঙে পড়ে না।
ভালোবাসাও ঠিক তেমনি। ধীরেধীরে যে মায়া জন্মায় তা হয় খাঁটি, বিশুদ্ধ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আছে। আমার পুত্রের ভালোবাসা পায়ে ঠেলে দেয়ার ক্ষমতা তোমার নেই। ভবিষ্যতেও হবে না। ‘
__________
খাওয়াদাওয়ার পর অপরূপা কক্ষ হতে বের হলো। হাঁটতে হাঁটতে শেহজাদের কক্ষের সামনে গিয়ে থামলো। আগে এই কক্ষের সামনে এলেই একপ্রকার অস্বস্তি, জড়িমা, সংকোচ কাজ করতো। আর আজ মনে হলো এটি তারও ঘর। অথচ একবারও প্রবেশ করেনি সে মহলে ফেরার পর। ঘরের মালিক যে থাকেনা সেথায়।
দরজা ঠেলে কক্ষে পা রাখলো সে। আলো জ্বালিয়ে দিয়ে সারা ঘরময় পায়চারি করলো। সারা ঘরে রাজকীয় আসবাবপত্র ছড়ানো ছিটানো। আতরের হালকা সুবাস সে ঘর মাখা। টেবিলে অসংখ্য বড় বড় মলাটের বই। দোয়াত কালি। হরেক রকমের কলমের শিশি। বিশাল দর্পনের পাশের চকচকে ঝুড়িটাতে একটা আতরের শিশি খুঁজে পেল সে। নিয়ে নাকে শুঁকতেই মনে হলো আরেহ এই তো সম্রাট। সে রেখে দিল সেটি নিজের কাছে। সুগন্ধিটা তার এত ভালো লাগে তার বলার বাইরে। গায়ে অল্পস্বল্প শীত করছে। একটা কালো রঙের চাদরের দেখা পেল সে। সেটি নিয়ে গায়ে জড়াতেই সারাগায়ে শিহরণ বয়ে গেল। প্রাণভরে গন্ধ শুঁকে নিল সে। এলোমেলো বিছানার চাদর ঠিক করে ঘরের আলো নিভিয়ে বেরিয়ে এল।
_________
জাদুকর সৈন্যদের মৃত্যুর খবর কানে এল শেরহামের। কেদারায় বসে দুলছিলো সে। তা কানে আসতেই কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। সামাদ আর মুরাদ বীভৎস খু**নের বর্ণনা দিয়ে ভয়ে বিচলিত হয়ে আছে। শেরহাম যা সন্দেহ করছে তা হলে তো সর্বনাশ। শেষমেশ বউকেও খু**ন করতে শিখিয়ে দিয়েছে শেহজাদ সুলতান! কক্ষ থেকে বেরিয়ে তটিনীকে চেঁচিয়ে ডাকলো সে।
‘ তনী ঘরে আয় দ্রুত। ‘
তটিনী শুনেও এল না। তার গায়ে জ্বর এসেছে। সারা শরীর ব্যাথা। গত কয়েকদিনে শেরহামের ধাক্কাধাক্কিতে তার কোমরের হাড়ে বেশ আঘাত পেয়েছে। হাঁটার শক্তিটুকু নেই। আরও ওই লোক এমনভাবে তাকে ডাকছে যেন সে তার অনুগত স্ত্রী। জীবনেও যাবে না। ‘
তটিনীর সাড়াশব্দ না পেয়ে শেরহাম সায়রা সোহিনীকে ডাকলো। সায়রা গিয়ে বলল,
‘ আপু অসুস্থ। জ্বর এসেছে। ‘
শেরহাম মহাবিরক্ত। মেয়েমানুষ এত নাটকবাজ। এখন ঝগড়া করতে বলুক। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করবে। সে হনহনিয়ে তটিনীর কাছে চলে গেল। তটিনী চোখ বুঁজে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। শেরহাম যেতেই শবনম আয়শা বেরিয়ে গেল। তটিনী চোখ খুলে আবারও চোখ বন্ধ করে নিল। শেরহাম বলল,
‘ এই ঘরে চল। কথা আছে। ‘
‘ তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই। ‘
শেরহাম তার গায়ের কাঁথা টেনে নিয়ে হাত ধরতেই তটিনী আর্তনাদ করে উঠে বলল,
‘ খোদার কসম আমার সারাগায়ে ব্যাথা। এভাবে টানলে আমি মরে যাব। ছাড়ো আমাকে। ‘
শেরহাম তার হাত ছেড়ে দিয়ে হাত গলিয়ে কোলে তুলে নিয়ে গটগট পায়ে হাঁটা ধরলো। তটিনী বলেই গেল,
‘ আরেহ মগের মুল্লুক নাকি? যখন যা চাইবে তাই হবে। বদলোক ছাড়ো আমায়। ঘেন্না লাগছে আমার। ‘
শেরহাম তার কক্ষে নিয়ে গিয়ে বিছানায় এক প্রকার ছুঁড়ে ফেললো। তটিনী আহ শব্দ করেই চোখ বুঁজে বলল,’ না*ফ*রমান। ‘
শেরহাম তার দিকে ঝুঁকে বলল,
‘ অপা কি আজ বের হয়েছিল মহল থেকে? সত্যিটা বলবি। ‘
তটিনী সরু চোখে চাইলো।
‘ অপা!!!’
তার কৌতুকভরা দৃষ্টি জোড়ায় শেরহাম আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল,
‘ হ্যা তাতে কি? সত্যিটা বল। ‘
‘ তুমি গিয়ে দেখে আসো। আমি কিছু জানিনা। ‘
শেরহাম সরে গেল। ঘরময় পায়চারি করতে করতে বলল,
‘ বিশ্বাস হচ্ছে না ও খু*ন করতে পারে। তাহলে ও কি আমাদের সব কথা শুনেছে? ‘
তটিনী বলল,
‘ কাকে খু**ন করেছে? ‘
‘ তুই চিনবি না। ‘
‘ রূপা খুন করেছে? ‘
‘ হ্যা। ‘
তটিনীর হঠাৎই মনে হল সে এত ভালো করে কেন কথা বলছে এই লোকের সাথে? দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘ একদম উচিত কাজ করেছে। ‘
হঠাৎ তার কন্ঠস্বর পরিবর্তনে শেরহাম তার দিকে ফিরে তাকালো। কপাল ভাঁজ করে বলল,
‘ তোকে তো কোকেন দিইনি। তাহলে পাগলামি করছিস কেন? ‘
তটিনী চেঁচিয়ে বলল,
‘ বেয়াদব লোক। আমাকে মুক্তি দিয়েছ বলে আবার এখানে নিয়ে এসেছ কেন? বউ দরদী দেখাচ্ছ সবাইকে। তোমার সাথে থাকবো না আমি।’
শেরহাম ওকে ঘাড় ধরে কক্ষ হতে বের করে দেবে ভেবেও বের করলো না। কক্ষের দরজা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে পাশাপাশি শুইয়ে বলল,
‘ মাফ কর ভাই। শক্তি নেই তোকে কোলে করে দিয়ে আসার। হেঁটে যেতে পারলে যা। ‘
তটিনী বালিশ দিয়ে জোরে ঠেলে দিয়ে বলল,
‘ না। দিয়ে আসো। এনেছ কেন? উঠো। ‘
শেরহাম কানের উপর বালিশ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। মধ্যরাতে চোখ খুলতেই দেখতে পেল তটিনীর পা দুটো তার বুকের উপর। মাথাটা বিছানার বাইরে। আচমকা হো হো করে হেসে উঠলো সে। তটিনীর চোখ ছুটতেই সে দেখলো তার মাথাটা ঝুলছে। পা দুটো যেখানে ছিল সেখানটাতে কাঁপছে। সে ভয়ে দোয়াদরুদ পড়লো। এত জোরে হাসছে কে? সে জোরে জোরে পড়া শুরু করলো, লা হাওলা অলা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। ‘
শেরহাম এসে তার মাথার নীচে হাত রেখে বলল,
‘ দুনিয়ার পা**গল ছা**গল সব আমার কপালে জোটে। মরার আর জায়গা পাস না। ‘
তটিনী মুখের উপর আবছা আলোয় শেরহামকে দেখে বড়বড় চোখে তাকালো। তারমানে সে ঝুলছে না। শেরহাম সরে পড়ার আগেই গলা জড়িয়ে ধরে চুল মুঠোয় বলল,
‘ অ*মানু*ষের বাচ্চা। শ**য়তানের বাচ্চা শ**য়তান। ‘
একথায় শেরহাম ফুঁসে উঠলো। রাগে, ক্ষোভে, ক্রোধের উন্মত্ততায় তটিনীকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে যাবে কিন্তু তটিনী ছাড়লো না। বিড়বিড় করতে লাগলো ভয়ে।
এই প্রথম কোনো নারী শরীরের সুঘ্রাণ কাছ থেকে পেল শেরহাম। গন্ধটা শুঁকতে শুঁকতে নাকটা তটিনীর গলায় গুঁজে গেল। তটিনীর সারা শরীর অবশ হয়ে এল।
এদিকে সকাল হতে না হতেই কয়েকজন লোক এসে কান্নাকাটি জুড়ে দিল তাদের কন্যায় নিখোঁজ হয়েছে বলে।
আরেকদল এল, একদল সন্ন্যাসী নদীর ধারে তাদের ফসলক্ষেত নষ্ট করছে এমন অভিযোগ নিয়ে।
চলমান…..