প্রিয় বেগম ২ পর্ব-০৩

0
1273

#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_৩
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

অপরূপা অতি সন্তর্পণে তার কক্ষের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছে। তার চোখেরমুখের অবস্থা ভীষণ রকম ক্ষুদ্ধ। সবকিছু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। কাল থেকে তাকে পাহাড়ায় থাকতে হবে। সাফায়াত ভাইজানকে সবটা জানাতে হবে। শেরহাম সুলতানের সাথে তার মানে পরাগ পাহাড়ের জাদুকরের সাথে হাত আছে! ওই মেয়েগুলোর অবস্থা নিশ্চয়ই তার মতো হবে!
তাদেরও বলির জন্য প্রস্তুত করাবে পাখি শিকার, মাছ শিকার, ঘোড়ার লাগাম টানতে দিয়ে। তার হায়াত ছিল বলে সে বেঁচে ফিরেছে। আঘাত সইতে পেরেছে। এই মেয়েগুলো তো আরও কচি। বন্য পশুর সাথে লড়তে না পেরে মারাও যেতে পারে।
ভাবতে ভাবতে ডানেবামে তাকিয়ে নিজের কক্ষের দিকে দ্রুত পা বাড়ালো সে। কেউ দেখে নিলে সর্বনাশ। কথা ছেড়াছিঁড়ি হবে। শেরহাম সুলতান সতর্ক হয়ে যাবে। এ হতে দেয়া যাবে না।

অপরূপাকে আসতে দেখে শেরহাম সরে পিছু ফিরতেই তটিনীকে দেখলো । তটিনীর চোখেমুখে বিস্ময়। সে শেরহামের দিকে তাকিয়ে শব্দ করতে যাবে তার আগেই শেরহাম তার মুখ চেপে ধরে কক্ষে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। তটিনীকে বারণ করলো সে দেখেছে সে কথা যেন অপরূপাকে না বলে। শেহজাদের সাথে ফেরার পর অপরূপার চলনবলনে বিপুল পরিবর্তন টের পেয়েছিল সে। কিন্তু আজকে ওর বেশ দেখে তাজ্জব বনে গিয়েছে। কোথায় গিয়েছে সে? ধনুক হাতে কি শিকার করতে? তাও এমন বেশে! ধনুক ছোঁড়া শিখেছে কখন? তার সৈন্যরা কেউ তাকে দেখেনি? শেরহামকে ভাবিয়ে তুললো। তটিনীও ভাবুক হয়ে বসে আছে। মনে হচ্ছে অপরূপার বিষয়ে কথা বলতে গেলেই অপরূপা বিপদে পড়বে। সে অপরূপা বিপদে পড়ুক তা চায় না। অপরূপা বিপদে পড়া মানেই মহলের নিরাপত্তা আগের মতো কমে যাওয়া। শেরহামের লোকগুলোকে তার একটু বিশ্বাস হয় না। মহলে যুবতী মেয়ে আছে চারজন। তাদের নিরাপত্তা আর সুরক্ষা দিতে সাফায়াত ভাইজানের পাশাপাশি অপরূপাকেও দরকার। পরাগ পাহাড়ের জাদুকরের সাথে সে জীবনমৃত্যুর লড়াইয়ে বেঁচে ফিরেছে সেই পারবে শেরহাম সুলতানের সাথে লড়তে। নিজের কথা সে ভাবছে না। ছোট থেকেই সে তাকদীরে বিশ্বাসী। নসিবে যা লেখা আছে তাই হবে। আঘাত পেয়েছে ঠিক কিন্তু খোদাতায়ালার উপর হতে ভরসা হারায়নি। উনার পরিকল্পনা অনুযায়ী সব হচ্ছে। সে কে উনার বিরোধী হওয়ার?
ছোট থেকে সে জেনেই এসেছে তার নানাজান তার সাথে সুলতান মহলের বড় সন্তানের সাথে তার নিকাহ ঠিক করে রেখেছেন। বাড়ে বেগম ডেকে ডেকে সবাই তার সাথে মজা উড়াতো।
তখন সে সেসব বুঝতো না। তবে আনন্দিত হতো। সবার কথা শুনে মনে হতো এটা নিশ্চয়ই ভালো কিছু।
যখন কৈশোরে পদার্পণ করলো তখন সে কথা সবাই বলতো না আর। হয়ত সে বুঝতে শিখেছে তাই। কিন্তু এটা জানতো যে শ্যামকালো এই অতি সাহসী, মা পাগলা,বদমেজাজি যুবকের সাথে বড় হলেই তার নিকাহ হবে। ভীষণ ভয় পেত সে শেরহাম সুলতানকে। যদিও সে তখন বদমেজাজি ছিল কিন্তু অসৎ ছিল না।
সেই রঙিন ছোটবেলায় বৃষ্টি হলেই ছোট সাম্পানে গাদাগাদি করে চড়তো তারা সকলে। সায়রা সোহিনী শবনমও থাকতো। ফাঁক পেলেই তারা কমলবিলে সাম্পানে চড়তে চলে যেত। শেরহাম সুলতান, শেহজাদ ভাইজান, সাফায়াত ভাইজানের মধ্যে কথা কাটাকাটি লেগে যেত কে মাঝি হবে তা নিয়ে। ঝিলের মাঝপথে নিয়ে গিয়ে তাদের সবাইকে ডুবিয়ে দেওয়ার ভয় দেখানোর মতো দুষ্ট কাজটাও করতো শেরহাম সুলতান। শেহজাদ সুলতান আর সে সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মের দুজন। কিন্তু ছোটবেলায় একে অপরের মনের কত মিল ছিল! একজন রেগে গেলে অপরজন কারিশমা দেখিয়ে শান্ত করে দিত। অসীম ধৈর্যের অধিকারী শেহজাদ সুলতানের বিপরীত শেরহাম সুলতানের ধৈর্যের কৌটা নেহাতই কম। সে অল্পতেই রেগে যেত, কিন্তু অপরদিকে পানির মতোই সরল ছিল। আর শেহজাদ সুলতান যতই শান্তশিষ্ট সরলভাষী হোক একবার রাগলে মাথায় খুন চেপে যেত তার। দুজনেই কমবেশি ভয়ানক ছিল তটিণী-র কাছে। সাফায়াত ছিল বোকাসোকা, সহজসরল, নম্রভদ্র। ভাইজানদের ভীষণ অনুগত। দুই ভাইয়েরই প্রিয় ছিল সে।
তারপর এল সেইদিনক্ষণ গুলি। সবকিছু চোখের পলকে শেষ হয়ে গেল। এক নিমেষেই সে মহলে ধস নামতে দেখেছে। তটিনী জানে, সবকিছুর জন্য দায়ী ছিল বড়মামী। শেরহাম সুলতানের মা। উনার জন্য সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে চোখের পলকে। উনার নাস্তিকতায় উনার ছেলেকে পথভ্রষ্ট করেছে। উনি মারা গিয়েছেই ঠিকই কিন্তু ছেলের ভেতর নিজের বীজ বপন করে গিয়েছেন। তটিনীর স্পষ্ট মনে পড়ে সেদিনটার কথা যেইদিন শেরহামকে তাজ্যপুত্র ঘোষণা করেছিলেন শেরতাজ সাহেব। শেরহাম বেরিয়ে যাওয়ার পরের দিন যখন নদীতে অনেক মরা মানুষ পাওয়া গেল, মামু সেদিন অনেক কেঁদেছিলেন। ছোট্ট সোহিনীও অনেকদিন যাবত কথা বলেনি ভাইজানের শোকে। মহলের সবারই দুর্দিন গিয়েছিল তখন। কেউই মানতে পারেনি তাদের বড় সন্তান তাদের কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছে। হ্যা সে ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল ঠিক কিন্তু কেউই হারাতে চায়নি তাকে। আঘাত করতে চায়নি।
সেই মানুষ এত বছর পর ফিরে এসেছে।
তখন ছিল টগবগে যুবক এখন পূর্ণবয়স্ক পুরুষ। হিংস্রতা,পাশবতায় মোড়া এক অচেনা মানুষ। যার ধ্বংসই এখন তার একমাত্র চাওয়া নইলে মহল হতে চিরতরে শান্তি চলে যাবে। এই লোকটা শোধরানোর নয়। তার পতন না হওয়া অব্দি স্বস্তি নেই।

তার ভাবনায় ফোঁড়ন কেটে শেরহাম বলল,

‘ এই কথা কাউকে বলবি না। বললে তোর অবস্থা খারাপ করে দেব।’

তটিনী ফুঁসে উঠে মুখে মুখে বলে উঠলো,

‘ কি করবে? কি? বলো। চুপ করে আছ কেন? ‘

শেরহাম শুয়ে পড়লো। কপালের উপর হাত রেখে বলল,

‘ মাথা গরম করবি না। এক কথা বারবার বলতে ভালো লাগেনা আমার। ‘

তটিনী ধুপধাপ করে হেঁটে আলো নিভিয়ে বলল,

‘ আমাকে মুক্তি দাও। আমার এসব আর ভালো লাগছে না। ‘

শেরহাম তার কথাকে পাত্তা না দিয়ে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো। সে তটিনীর উপর মহাবিরক্ত। পারেনা গলা টিপে নিঃশ্বাসটা বন্ধ করে দিতে।
তটিনীরও মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় হাত পা বেঁধে তলোয়ার দিয়ে একদম কু***পি**য়ে ফেলতে। এই মানুষ তার জীবনে এমন অসহ্যকর একটা অধ্যায় হয়ে আসবে সে জীবনেও কল্পনা করেনি। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা মানুষের পাশে সে ঘুমায় ভাবতেই তার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায়। ঘৃণা হয়। ঘৃণায় কান্না পায়। সে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য জায়নামাজে কেঁদে মরে, আর এই লোক আগাগোড়া একজন নাস্তিক, কাফের। সে খোদার কাছে এই লোকের মৃত্যু কামনা করে।

______________

অপরূপা জর্দা বিরিঞ্জ রেঁধেছে ভোরে।
দশসের চাল, পাঁচসের মিছরি, সাড়ে তিনসের ঘি, আধাসের কিসমিস, একসের পেস্তা, একপোয়া লবন, আধপোয়া আদা, দেড় দাম জাফরাণ, আড়াই পুস্কল দারুচিনি, এ সকল একত্রে করে এই খাবার তৈরি করতে তার অনেক সময় লেগেছে। তার রান্নার হাত বরাবরের মতে ভালো। সবাই খেয়ে প্রশংসা করছে। কিন্তু তার এসব ভালো লাগছে না।
সে কক্ষে এসে বসে আছে। সম্রাটের চিন্তায় সে বিভোর। গতরাতে একফোঁটা ঘুমাতে পারেনি সে। সম্রাট তার পাশে থাকলে তার জন্য সবটা সহজ হতো। উনি উত্তম ফায়সালা দিতেন। পথ দেখাতেন। সাহস যোগাতেন।
রান্নার পরপরই শেহজাদের জন্য জর্দা বিরিঞ্জ পাঠিয়েছে সে। তারপর একাকী নিজ কক্ষে গিয়ে পায়চারি করতে করতে কয়েক ফোঁটা চোখের জল ফেললো। খোদা ছাড়া তার দুঃখ দেখার মতো কেউ নেই এখন। দেখলেও কারো কিছুই করার নেই। তাকে একাই লড়তে হবে। কিন্তু সম্রাটের কথা মনে পড়লেই ব্যাথায় বুক ভার হয়ে যাচ্ছে। সে না যাওয়াতে উনি নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছেন। নিশ্চয়ই অপেক্ষায় ছিলেন। হাতের ব্যাথা কেমন হলো! কতটুকু সাড়লো?

______

খাজনা পরিশোধ না করায় প্রায় বিশ পঁচিশজনের মতো লোককে সকাল সকাল ধরে নিয়ে এল শেরহামের সৈন্যরা। শেরহাম কেদারায় পায়ের উপর পা তুলে বসে সকলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে বলল,

‘ খাজনা জমা দাওনি কেন? ফসলও দাওনি। সব লেখা আছে খাতায়। কি সমস্যা? ‘

সকলেই কাঁচুমাচু করতে লাগলো। শেরহাম ধমকে বলল,

‘ বলবে নাকি বন্দি করব? ‘

‘ হুজুর কিছুদিন আগেই আমাদের গুদামঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল ডাকাতদল। তাই সম্রাট বলেছেন মহলের মজুতঘর হতে আমাদের খাবার দেবেন যতদিন না উৎপন্ন ফসল ঘরে উঠে। আমাদের খাজনাও উনি মওফুক করেছিলেন। ‘

দ্বিতল চত্বরে দাঁড়িয়েছিল সায়রা, শবনম,আয়শা,সোহিনী আর তটিনী। তটিনী মুখ মোচড়ে বলল,

‘ ডাকাতকে শোনাচ্ছে ডাকাতের গল্প। ‘

সামাদ বাজখাঁই গলায় বলে উঠলো,

‘ মগের মুল্লুক নাকি? খাবারও দেব, খাজনাও মওকুফ। এসব কি মামার বাড়ির আবদার নাকি? ‘

সাফায়াত শেরহামকে বলল
‘ উনাদের কি দোষ? দোষ তো ডাকাতের। পারলে ডাকাতদের ধরে এনে গণপিটুনি দাও। ‘

শেরহাম চোখা দৃষ্টিতে তাকালো সাফায়াতের দিকে। ওদিকে সায়রা সোহিনীরা সকলেই হাসতে লাগলো তা শুনে। সায়রা বলল,
‘ শেহজাদ ভাইজান এখানে উপস্থিত থাকলে দারুণ হতো। বেশ মজা পেতেন উনি। ‘
তটিনী বলল,
‘ এবার বুঝবে নগর পরিচালনা কত সহজ! ‘

লোকগুলো কেঁদেকেটে কোনোমতো পগারপার হলো। শেহরাম কক্ষে আসতেই দেখলো তটিনী কাপড় ভাঁজ করছে। শেরহাম বলল,

‘ তুই সারাক্ষণ আমার পেছন পেছন কি করিস? আমাকে নজরে রাখছিস নাকি? ‘

তটিনী কুশ্রী ভঙ্গিতে বলল,
‘ তুমি নজরে রাখার মতো মানুষ?’

শেরহাম ওর সাথে তর্কে গেল না। বিছানায় বসতেই তটিনী জিজ্ঞেস করলো,

‘ ওদের মজুতঘরে তুমি আগুন ধরিয়েছিলে শেহজাদ ভাইকে বিপদে ফেলার জন্য। ওদের গোয়ালের গরু চুরি করেছিল তোমার লোক। ইট মারলে পাটকেলটি খেতে হয়। এবার বুঝতে পেরেছ? ‘

শেরহাম সরু দৃষ্টিতে তটিনীর দিকে তাকালো। নিকাহ করে তো ভারী ঝামেলায় পড়লো সে। এই আবর্জনা তো পিছু ছাড়ে না।

‘ তোকে বকরবকর করতে কে বলেছে? আমি পরামর্শ চেয়েছি তোর কাছে? ‘

তটিনী ওর দিকে ফিরে তাকালো। কিছু বলল না। কাপড়চোপড় ভাঁজ করা শেষে শেরহামের বিপরীত পাশে গিয়ে বসে বলল,

‘ শেহজাদ ভাইকে ছেড়ে দাও। উনি সমাধান দেবেন। ‘

শেরহাম বলল,
‘ জাহাজ আসছে। দুর্দিনে পড়বে না। ‘

‘ পণ্যের জাহাজ? নাকি অস্ত্রের?’

শেরহাম রাগত দৃষ্টিতে তাকালো। তটিনী ভড়কালো না। শেরহাম বলল,

‘ তোকে বারবার করে বলছি আমার মুখে মুখে তর্ক করবি না। ‘

‘ একশবার করব। হাজার বার করব। তুমি কি নিজেকে সেয়ানা মনে করো নাকি? তোমার সাথে কথা বলতেও ঘৃণা লাগে আমার। ঘৃণা ঝড়ে ঝড়ে পড়ে। বুঝতে পারছো?’

শেরহাম চোখমুখ শক্ত করে চেয়ে থাকলো রক্তচোখে। তটিনী হনহনিয়ে চলে গেল।
শেরহাম চুপ করে ওর যাওয়া দেখলো। তারপর বিছানার চাদর টেনে নীচে ফেলে দিল।

_______________

ফটক দিয়ে ঢুকে পড়া রোদের আলো এসে পড়ছে শেহজাদের কুঠরির মধ্যে। সেই সূর্যরশ্মি পাশেই বসা ছিল শেহজাদ। একজোড়া পুরুষালী পদধ্বনি কানে আসতেই শেহজাদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই শেরহামকে দেখতে পেল। শেরহামের গ্রিলের ওপাশে এসে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো শেহজাদের উপর। শেহজাদ দাঁড়িয়ে পড়লো। পেছনে হাত রেখে দাঁড়িয়ে অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কি দেখতে এসেছ? ‘

‘ দেখতে এসেছি মহামতি সম্রাটের কি অবস্থা! তেজ এখনো গেল না তোর। ‘

শেহজাদ চোখ ফিরিয়ে ক্রুর হাসলো। তা গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিল শেরহামের। গ্রিল ঝাঁকিয়ে বলল,

‘ তোর বউ ধনুক হাতে রাত-বিরেতে কোথায় যাচ্ছে? তুই জানিস কিছু? তুই বলেছিস? ‘

শেহজাদ অবাক হলেও তা প্রকাশ না করে বলল,
‘ ও বুদ্ধিমতী। তোমার মতো নয়। ও যা করছে নিশ্চয়ই তার কোনো কারণ আছে।’

‘ আমার মতো নয় মানে কি বলতে চাচ্ছিস? সাবধান কর নয়ত চিরতরে পৃথিবী ছাড়তে হবে । ‘

শেহজাদ পুনরায় হেসে বলল,
‘ ওকে ভয় পাচ্ছ নাকি? ‘

শেরহাম শক্ত করে গ্রিল ধরে বলল,
‘ ও আমায় ভয় পাচ্ছে। পাবে। তুইও পাবি। সবাই পাবে। আমার সাথে পাল্লা দেয়ার মজা হারে হারে টের পাচ্ছিস তারপরও শিক্ষা হচ্ছে না তোর? ‘

‘ আমাকে শাস্তি দিতে দিতে তুমি নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়বে। আমি হব না। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়ার ধৈর্যও তোমার নেই। ‘

শেরহাম গ্রিলে লাতি বসিয়ে বলল,
‘ তোর মুক্তি নেই। পঁচে মর। ‘

বলেই গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল। শেহজাদ দুহাতে গ্রিল ধরে দাঁড়ালো। রূপা রাত-বিরেতে কোথায় যাচ্ছে? খোদা যেন তাকে হেফাজত করে।

__________

সন্ধ্যার দিকে খবর এল জাহাজ ডুবে গিয়েছে মাঝ নদীতে। সাফায়াত সে খবরটা নিয়ে এল শেরহামের কাছে। শেরহাম রাগে আগুন হয়ে বলল,

‘ এ কি করে সম্ভব? সামাদ! মুরাদ! কোথায় তোরা?

সামাদ আর মুরাদসহ সব সৈন্যরা ছুটে এল। বলল, ‘ জ্বি হুজুর। ‘

‘ জাহাজ কি করে ডুবলো? তোরা আমাকে কিছুক্ষণ আগেই বললি সব ঠিক আছে। ঘাটে পৌঁছাতে আর একঘন্টা দেরী। এখন জাহাজ ডুবলো কি করে? ‘

সামাদ আর মুরাদের উত্তর শেরহামের পছন্দ হলো না। তারা নিজেরাও জানেনা কিভাবে ডুবলো। এমন তো হওয়ার কথা না।

শেরহামের তর্জনে-গর্জনে সকলেই এসে হাজির। অপরূপাও এসে দাঁড়ালো দ্বিতল চত্বরে। জাহাজ ডুবে যাওয়া মানে অনেক ক্ষয়ক্ষতি। অনেক টাকার পণ্য। খাবারের ঘাটতি পড়ে যাবে। পঁচিশটি বাড়ির গুদামের অনেক টাকার পণ্য পুড়ে যাওয়ার ফল। পঁচিশটি গুদামের মজুতপণ্য বছর পেরিয়ে আরও মজুত থাকতো।
শেহজাদের পরিকল্পনা কি ছিল তা জানা নেই শেরহামের। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে তাকে শক্ত থাকতে হবে। শেরতাজ সাহেব আর শাহজাহান সাহেব চুপ করে বসে থাকলেন। চুপচাপ দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই উনাদের।
শেরহাম হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে গেল তার ঘোড়া নিয়ে।

______________

শেরহাম না থাকায় তটিনী ভাবলো অপরূপাকে কাল রাতের ঘটনাটা বলবে। শেরহাম তাকে দেখে ফেলেছে কথাটা বলে দেয়ার উপযুক্ত সময় এসেছে। সে রসাইঘরে গিয়ে দেখলো অপরূপা রান্নার কাজে ব্যস্ত। নেয়েঘেমে উঠেছে। তটিনী গিয়ে বলল তার কাজ শেষ হলে যেন তার কক্ষে আসে। অপরূপা তাই করলো। রান্না শেষ করে তটিনীর কক্ষের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে থাকলো। সে ভেতরে যাবে না।
তটিনী বাইরে বেরিয়ে এসে ডানে-বামে তাকিয়ে বলল,
‘ কাল রাতে কোথায় গিয়েছিলে তুমি? ‘
অপরূপা বিচলিত হলো। আমতাআমতা করতেই তটিনী রুঢ় কন্ঠে বলল,

‘ ধনুক ছিল তোমার হাতে। কাউকে মেরেছ? কি শিকার করতে গিয়েছ? তোমাকে ওই অবস্থায় শেরহাম সুলতান দেখে নিয়েছেন। ‘

অপরূপা হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো। বলল, উনার সাথে পরাগ পাহাড়ের জাদুকরের হাত আছে। উনি যুবতী সুন্দরী মেয়েদের পাচার করছেন। মেয়েগুলো কোথাকার জানিনা। কাল দুটো মেয়েকে ওই জাদুকরের হাতে তুলে দিয়েছেন উনার লোকগুলো। আমি আজ আবারও পাহাড়ায় থাকবো সাফায়াত ভাইজানের সাথে। আপনি এসব কাউকে বলবেন না। ‘

তটিনী হতচকিত। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে অপরূপার কঠিন মুখপানে চেয়ে রইলো। চোখের কোণায় রাগ চিকচিক করছে। অপরূপা বলল,

‘ আমি ওদের হাতেনাতে ধরবো আজ। এসব অনাচার আর হতে দেব না। ‘

তটিনী বলল,

‘ আমাকেও নিয়ে যাও। আমিও যাব। ‘

‘ না আপনি যেতে পারবেন না। আপনি তীর ছুঁড়তে পারবেন না। তাদের সাথে লড়তে হবে। ‘

সদর কক্ষ হতে শেরহামের গলার আওয়াজ ভেসে আসলো তখুনি। তটিনী বলল, ‘ উনি চলে এসেছেন। তুমি যাও। দেখে ফেললে সন্দেহ করবে।’

অপরূপা দ্রুত পায়ে চলে গেল। রাতের অপেক্ষায় থাকলো। আজ কি তারা আবারও আসবে?

শেরহাম কক্ষে এসে পোশাক বদল করে কেদারায় মাথা এলিয়ে দিয়ে বলল,
‘ এক গ্লাস পানি দে তো। ‘

তটিনী জগ থেকে পানি ঢেলে চোখমুখ শক্ত করে পানি ঢেলে জগটা আওয়াজ করে রাখলো। শেরহাম চোখ বুঁজে বসে রয়েছে। তটিনী গ্লাস এনে দিতেই শেরহাম ঢকঢক করে পানি খেয়ে তটিনীর দিকে তাকালো কপাল ভাঁজ করে। গোলাপিবর্ণের একটা ওড়নায় জড়ানো তার মাথায়। পা থেকে মাথা অব্দি আভিজাত্যপূর্ণ। শেরহাম বাঁকা হেসে বলল,
‘ তোর মতলব কি রে? আজকাল আমার আশেপাশে বেশি ঘুরঘুর করছিস? ‘
তটিনী কিছু বলল না। বিছানা ঝাড়তে লাগলো। শেরহাম কেদারা ছাড়লো। গা ঝাড়া দিয়ে তার আলমিরা খুলে তাক হতে খুলে বিড়ির প্যাকেট পকেটে পুড়ে নিল। সাথে সাথে চোখ গেল উপরের তাকে। কোকেইন পাউডারের বোতলটা নেই। নেই কোনো মোমবাতি, গাঁদাফুল,কোনো বাহুবন্ধনী,কোনো আতর, না তার প্রয়োজনীয় কোনো জিনিসপত্র। আলমিরার দরজা ধপাস করে বন্ধ করে তটিনীর কাছে ছুটে এসে বাহু খামচে ধরে বলল

‘ তুই ঘর সাফ করেছিস ভালো কথা। আমার জিনিসে হাত দিলি কেন? ‘

তটিনী বলল,

‘ হাতে লাগছে। ছাড়ো। ও আল্লাহ। ‘

শেরহাম তার হাত ছুঁড়ে দিল। তটিনী মেঝেতে গিয়ে পড়তেই কোমরের ব্যাথাটা খট করে কোথা হতে উড়ে গেল। হাড় শব্দ করে উঠলো। শেরহাম তাকে ধরতেই সে তীব্র আর্তনাদ করে বলল,
‘ না না। মাফ করো। আমি বোধহয় মরে যাচ্ছি। ও আল্লাহ! ‘
শেরহাম ধরলো না। তটিনী কোমর চেপে ধরে কোকাতে থাকলো। শেরহাম হাঁটু গেড়ে বসে বলল,

‘ আমার জিনিসগুলো কোথায় রেখেছিস বল। ‘

তটিনী কোমর চেপে চোখ খিঁচে বন্ধ করে রেখে বলল

‘ সব ফেলে দিয়েছি। আমার ঘর পবিত্র করেছি। তুমি এসব কুফরী কাজ বন্ধ করো। এর শাস্তি ভয়াবহ। ‘

শেরহাম তেড়ে গিয়ে ওর মুখ চেপে ধরবে তার আগেই তটিনীর দুচোখ জল ছেড়ে দিল। শেরহাম বলল

‘ নাটক করবি না। আমি তোকে কিছু করিনি। কথায় কথায় ঢং করবি না। ‘

তটিনী ব্যাথা সইতে না পেরে মূর্ছা গেল। শেরহাম মহাবিরক্তিতে বাহুডোরে ওর শরীরটা তুলে নিয়ে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল। এখন কাউকে ডাকলে মনে করবে সে মেরে বেহুশ বানিয়ে দিয়েছে। আগে জ্ঞান ফিরুক চড়াতে চড়াতে গাল লাল করে ফেলবে সে। তটিনীর সারামুখ ঘেমে উঠেছে। সে কক্ষের দরজা বন্ধ করে দিল কেউ চলে আসবে বলে। রুমাল ভিজিয়ে ঘষে ঘষে তটিনী মুখ মুছে দিল। দাঁতে দাঁত চিবোতে চিবোতে মনে হলো চড়িয়ে একদম গালটা লাল করে দিতে। নাটকবাজ। ওড়না সরিয়ে সে ঘষে ঘষে গলাও মুছে দিল। পাখা এনে বাতাস করতে করতে ডাকলো

‘ এই ওঠ! মারের ভয়ে বেহুশ হয়ে আছিস না। আমার জিনিস খুঁজে এনে দে। এই! ‘

তটিনীর জ্ঞান ফেরার কথাই নেই। শেরহাম নিঃসঙ্কোচে কোমরের কাছে কাপড় সরাতেই দেখলো সেখানে কালো দাগ পড়ে গেছে। সেই দাগ টনটনে ব্যাথা। ছুঁলেও ব্যাথা তাই তটিনী ওরকম করে। শেরহাম মলম এনে ধীরহস্তে মলম মাখিয়ে দিল। পুরো কাজটা করলো সে বিরক্ত সহকারে। মলম মাখিয়ে দিয়ে টেরই পেল না কখন চোখদুটো লেগে এসেছে।
চোখ খুললো তটিনীর চেঁচামেচিতে। সে বুকের সাথে ওড়না জড়িয়ে ধরে কেঁদেকেটে বললো,
‘ জানো**য়ার অ**মানুষ। সুযোগ পেয়ে আমার গায়ে হাত দিয়েছ। আমার কোমরে হাত দিয়েছ। আমার ওড়না তোমার হাতে কেন? কি করেছ? ‘
রাগে চোখের পানিতে তার চোখমুখ লাল হয়ে এসেছে। শেরহাম চোখ সরু করে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঝাঁজালো গলায় বলে উঠলো,
‘ যা মন চেয়েছে করেছি। কি করবি তুই? ‘
তটিনী চোখ বড় বড় করে গাল মুছতে মুছতে বলল,
‘ মানে? আর বড় গলা করে বলছও? আমার কাছে এসেছ কেন? সীমা ভুলে গিয়েছ? ‘
শেরহাম বলল,
‘ হ্যা ভুলে গিয়েছি। আজ থেকে মাঝখানে কাঁথাবালিশগুলোও রাখবো না। দেখি তুই কি করিস। ‘
তটিনী ঘৃণাভরে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে সরে পড়তে যাবে কোমরে শক্তি পেল না। পায়ে ভর দেয়ার সাথে সাথে পড়ে যেতেই শেরহাম হাত ধরতেই জোরে টান পড়লো। তটিনী উল্টেপাল্টে তার গায়ের উপর এসে পড়লো। শেরহাম নেতিয়ে পড়ে গেল খানিকটা। তটিনী তার গলা যেখানে জড়িয়ে ধরেছে। যেখানে ধরেছে সেখানে নখের আঁচড় কেটে দিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠে বলল,

‘ তুমি মরে গিয়ে হলেও মুক্তি দাও আমাকে। তোমাকে অসহ্য লাগছে। ‘

শেরহাম তার কান্নামুখর মুখের দিকে তাকিয়ে জোরে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে আঙুলদ্বারা গালের দুপাশে চেপে ধরে বলল,

‘ আজ থেকে তুই এই ঘরে থাকবি না। যা তোর মুক্তি। ‘

যন্ত্রণার মাঝে হলেও তটিনী হাসলো মুক্তির আনন্দে। কান্না চেপে বলল,

‘ সত্যি বলছো? আবার জোরাজোরি করবে না খোদার কসম করে বলো। ‘

‘ আমি খোদা মানিনা। ‘

গটগট পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল শেরহাম।
তটিনী বহুকষ্টে সায়রা সোহিনীদের ডাকলো। তারপর তার সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেল।
শেরহাম ফিরে এসে তাকে না দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

তার পেছন পেছন মুরাদ এসে দাঁড়ালো। বলল,
‘ হুজুর আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন? ‘

শেরহাম বলল,

‘ হ্যা। চাদর সরা। ‘

মুরাদ ভয়ে ভয়ে চাদর সরাতেই তার হাতে ব্যান্ডেজ দেখতে পেল শেরহাম। ক্রুর হেসে বলল,

‘ এই আঘাত কে করেছে? ‘

মুরাদ আমতাআমতা করতেই শেরহাম গর্জে বলল,
‘ ওরা নগরে এসেছে কিজন্য? ‘

‘ কথা বলার জন্য হুজুর। কথা বলে চলে গিয়েছে। তোরা আমাকে বলিসনি কেন? ‘

মুরাদ মাথা নামিয়ে রাখলো। বলল,

‘ আমি ভেবেছিলাম আপনি ওদের উপর চড়াও হবেন তাই। ‘

‘ আমি ওদের সাথে দেখা করতে চাই। ‘

মুরাদ উৎফুল্লতার সহিত বলল,

‘ ওরা আজ আবারও আসবে হুজুর। আপনি চাইলে দেখা করতে পারেন। ‘

‘ তাই হবে। মুরাদ চলে গেল। ‘

গভীর রাতে জাদুকরেরা পুনরায় এল। আজ শেরহামকেও যেতে দেখে অপরূপা আর সাফায়াত নিশ্চিত হলো যে নগর ধ্বংস হতে আর বেশি দেরী নেই। তারা দুজনেই একসাথে বেরিয়ে পড়লো শেরহামের পেছন পেছন।

চলবে……

রিচেক করা হয়নি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে