#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_২১
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
শেরহাম ফিরে আসে এশার নামাজের পরপরই। তটিনী ঝর্ণার ধারে বসা ছিল। চারপাশে মশাল জ্বলছে। আবদুল্লাহ আর আলাউদ্দীন তাকে পাহাড়া দিচ্ছিলো। শেরহামকে ফিরতে দেখে নানাজান রেগে গেলেন। বললেন,
‘ কোথায় গিয়েছিস? বলে যাবি না? ওই মেয়েটাকে এত কষ্ট দিচ্ছিস কেন? তুই ওকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিস ভেবে মেয়েটা কাঁদছিলো। ‘
শেরহাম শান্ত স্বরে বলল,
‘ পরাগপাহাড়ে গিয়েছি। জাদুকরদের সাথে দেখা করতে। ‘
‘ আবার পরাগপাহাড়? চন্দ্রলাল তোকে আটকায়নি? ‘
‘ ও ডাকাত আস্তানায়। পরাগ পাহাড়ে নেই। ‘
‘ ওরা এত অন্যায় করার পরও তুই আবারও ওদের সঙ্গ দিচ্ছিস? ‘
‘ আমার সাথে কোনো অন্যায় করেনি। আর তোমরা মনুষ্যজাতিরা যখন আমাকে ধুর ছাই করে বের করে দিয়েছিলে সেসময় ওরা আমাকে আশ্রয় দিয়েছে। আজকের শেরহাম সুলতান তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে শুধু ওদের জন্য। ‘
‘ ভালোই তো কৃতজ্ঞতাবোধ আছে। আর ওই মেয়েটা যে তোর জন্য এত কষ্টে আছে তা দেখতে পাচ্ছিস না? আরেহ মেয়েটাকে ছেড়ে দে। ও একটা স্বাভাবিক জীবন আশা করে। ‘
‘ আমার বউকে নিয়ে ভাবার জন্য আমি আছি। সরো। ‘
বলেই হনহনিয়ে সে ঝর্ণার কাছাকাছি চলে এল। তার জন্য যে ব্যাকুল হয়ে বসেছিল তটিনী, তা তাকে বুঝতে দিল না সে। দেখেও চুপ করে থাকলো। শেরহাম তাকে টেনে ঝর্ণার নীচে দাঁড় করিয়ে দিল। একসাথে ভিজে উঠলো দুজনের শরীর। ঠান্ডায় তটিনীর শরীর কেঁপে উঠলো। শেরহামের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল।
শেরহাম রসিকতা করে বলল, ‘ আমার সাথে গোসল করার জন্য বসেছিলি নাকি?’
তটিনী অগ্নিময় দৃষ্টিতে তাকালো। শেরহাম হাসলো। হাসতে গায়ের পোশাক খুলে ধুয়ে তটিনীর মুখে ঝামটা মারলো। তটিনী আরও রেগে গেল। হনহনিয়ে গুহার ঘরে চলে এল। শেরহাম তার পিছুপিছু চলে এল। তটিনীকে পিচ রঙের একটা শাড়ি বের করে দিল পুটলি হতে। সাথে পেটিকোট, ব্লাউজ ছিল। শাড়িটা কেড়ে নিল সে শেরহামের দিকে না তাকিয়ে। ভেজা শাড়িটা খুলে রশিতে টাঙিয়ে ওপাশে দাঁড়িয়ে শাড়িটা পড়ে বেরিয়ে গেল। শেরহাম পাথরে পিঠ লাগিয়ে বসে কপাল উঁচিয়ে ভাবলো, ‘ শরমভরম কোথায় গেল?’
তটিনী গরম গরম খাবার নিয়ে এল শেরহামের জন্য। তারপর বেরিয়ে গেল। সে নানাজান আর লোকদুটোকে বেড়ে দিয়ে, নিজেও তাদের সাথে খেল। যাবেনা ওই লোকের সামনে। শেরহাম খেতেখেতে শুনতে পেল ওরা সবাই হাসাহাসি করে একসাথে বসে খাচ্ছে। রাগে মেজাজ খারাপ হলো তার। এদিকে সে একা একা খাচ্ছে। চিৎকার দিয়ে বলল,
‘ তনীর বাচ্চা এসে খাইয়ে দে। আমার হাতে ব্যাথা।’
তটিনী তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
‘ নানাজান বলে দাও আমি কারো চাকর নই। যে তার কথায় ওঠবস করব। ‘
নানাজান হাসলেন।
খাওয়াদাওয়া শেষে গুহারঘরে এসে ছোট ছোট কয়েকটা চেরাগ জ্বালিয়ে দিল তটিনী। শেরহাম খেয়েদেয়ে বেরিয়েছে তার ঘোড়াকে খাওয়ানোর জন্য। ফিরে এল তারপর।
তটিনী ভেজা চুল মুছতে মুছতে পেছনে ফিরে দেখলো শেরহাম দরজা বন্ধ করছে, সে চুল মোছায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তোয়ালেটা ভিজে যাওয়ায় পানি শোষণ করছে না। যার দরুন পানি পড়ছে টপটপ করে। শেরহাম জিজ্ঞেস করলো,
‘ আমি আরও ক’দিন এখানে থাকবো। কাজ আছে। তোর অসুবিধে হলে বল। তোকে দিয়ে আসি। ‘
তটিনী জবাব দিল না। ভালো করে চুল ঝেড়েমুছে রশিতে তোয়ালেটা মেলে দিয়ে পেছনে ফিরতে যাবে তক্ষুণি খেয়াল হলো একটি ছায়া তার নিকটে এসে দাঁড়িয়েছে। ধীরেধীরে ফিরে তাকাতেই তাকে চেরাগের আলোয় হলুদ ভেজা তেলতেলে অবস্থায় দেখতে পেয়ে নজর সরাতে গিয়েও সরাতে পারলো না শেরহাম।
তটিনী শুকোতে দেয়া তোয়ালের ওপাশে গিয়ে নিজেকে আড়াল করলো। বলল,
‘ আমার কারো সাথে কথা বলার কোনোপ্রকার ইচ্ছে নেই এখন। ‘
শেরহাম তোয়ালে সরাতেই তটিনী তাকে দেখে নাক ফুলিয়ে তাকালো। শেরহামের ঘোর লাগা চাহনি তার পরিচিত তাই লজ্জায় পিছু করে দাঁড়ালো। আপাদমস্তক তার লজ্জায় কেঁপে উঠেছে তরতরিয়ে। বুকের ভেতর কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে অনবরত। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে পেছনে ফিরবে তার আগেই শাড়ি গলে দু-হাত এসে খামচে ধরলো ওর মেদহীন উদর। আকস্মিক অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে টাল সামলাতে না পেরে স্তব্ধ হয়ে গেল তটিনী। হাতদুটো নিজহাতে চেপে ধরে চোখ বুঁজলো পরম উত্তেজনায়। তার ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে ঘাড়ে ঠোঁটের প্রলম্বিত চুম্বন আঁকলো শেরহাম। তটিনী বলে বলল,
‘ অসহ্য লাগছে আমার। ছাড়ো। ‘
শেরহাম মহাবিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিতেই একছুটে শুকোতে দেয়া চাদরের আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে বুকে হাত চেপে চোখ বুঁজে। হাঁপাতে লাগলো। চাদরটাও সরে গেল ধীরেধীরে। শেরহামকে সামনে দেখে গলা শুকিয়ে এল প্রায়। কঠিন চোখে চেয়ে থাকলো দুজন দুজনের দিকে। দেয়ালে পিঠ ঠেকাতেই শক্তপোক্ত একটা হাত তার কোমর টেনে ধরলো। শেরহামের উন্মুক্ত বুকে দু হাত ঠেকিয়ে চোখ তুলে চাইলো সে। কোমরে পিঠে শেরহামের অবাধ বিচরণে তটিনীর সর্বাঙ্গ শিহরিত হচ্ছে। শেরহামের মুখোমুখি তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে রক্তচোখে চেয়ে বলল,
‘ তুমি আবারও পরাগ পাহাড়ে গিয়েছ? ‘
শেরহাম বলল,
‘ হ্যা। তাতে তোর কি? ‘
তটিনী রেগে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো তার দিকে। তারপর হাতে খামচি দিয়ে বলল,
‘ আমাকে ছুঁবেনা তাহলে। সরো। ‘
রাগে ফোঁসফোঁস করতে লাগলো সে। শেরহাম তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ তোকে না ছুঁলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে? সর। যাহ। নাটকের শেষ নেই। দু’দিন হয়েছে আমার জীবনে এসেছিস। কি জানিস আমার ব্যাপারে? তুই আমাকে বারণ করার কে? ন্যাকা। ‘
বলেই বিছানায় শুয়ে পড়লো সে। তটিনী দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পাথরে মাথা ঠুকরে ঠুকরে চোখ বুঁজলো। রাগে ক্ষোভে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে বলল,
‘ আম্মা ঠিকই বলেছে। তুই একটা কাফের। কাফের কোনোদিন ভালো মানুষ হতে পারেনা। শয়তান কোথাকার। মরে যাহ। ‘
শেরহাম ধমকে বলল,
‘ তনী মুখ সামলে কথা বল। তুই তোকারি বের করে দেব এক চড়ে। ‘
‘ একশবার বলব। তুই শয়তান শয়তান শয়তান। একশোবার হাজারবার লক্ষবার কোটিবার বলব। ‘
শেরহাম শোয়া থেকে উঠে এগিয়ে আসছে মনে হতেই তটিনী বসা থেকে উঠে দৌড় দিচ্ছিলো দরজার দিকে। শেরহাম তলোয়ারের খাপ ছুঁড়ে মারলো পায়ের দিকে। পায়ে সেটা লাগায় মুখ থুবড়ে হোঁচট খেয়ে পড়ার আগমুহূর্তেই শেরহাম তার কোমর ধরে ফেললো। তটিনী তার গলা জড়িয়ে ধরলো। দৃষ্টি কঠিন করে তাকিয়ে বলল,
‘ আবারও বলব। ‘
শেরহাম তার মুখের উপর ঝুঁকে পড়লো। একদৃষ্টে চেয়ে কি যেন খুঁজে পেল মুখটাতে। তটিনী তার চাহনি দেখে চেপে গেল। কি যেন বিড়বিড় করলো।
ভেজা চুল গলা থেকে সরিয়ে সেখানে মুখ ডুবিয়ে গাঢ় চুম্বন করলো শেরহাম। তটিনীর আপাদমস্তক কেঁপে উঠলো। শেরহামের মুখ ভিজে গেল তার ভেজা চুলের স্পর্শে । তটিনীর কোমল ঠান্ডা শরীরটি উত্তপ্ত হয়ে উঠলো তার উষ্ণ স্পর্শে। শেরহাম তার কপালে কপাল, নাকে নাক ঠেকালো।
হাওয়ায় ভেসে বিছানায় পিঠ ঠেকলো তার। কপালে, নাকে তারপর ধীরে ধীরে অধরযুগলে শেরহামের অধরের বিচরণে চোখ বুুঁজে ফেললো তটিনী। স্বামী সোহাগে নিস্তেজ হয়ে পড়লো সে।
গলার ভাঁজে মুখ ডুবিয়ে গাল ঘষতেই তটিনী ব্যাথাসূচক শব্দ করে উঠলো। বুকের বিভাজিকায় প্রত্যক্ষ চুম্বনে মাতোয়ারা হলো সে। অবচেতনে শক্ত করে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমে তলিয়ে গেল তারা। যেন কেউ চায় না কেউ দূরে যাক।
_______________
তারপরের দিনই নগরে ফিরে এল তারা। কিন্তু শেহজাদ আর সাফায়াত ফেরেনি। একদিকে তটিনীর ফিরে আসার আনন্দ অপরদিকে শেহজাদ আর সাফায়াতের চিন্তায় অস্থির সকলেই।
শাহানা মেয়েকে দেখে যেমন আনন্দ অশ্রুতে ভাসলো অপরদিকে শেহজাদ আর সাফায়াতের চিন্তায় পাগলপারা। কাশীম, কামীল সহ তারা ছয়জনের মতো জংলাহাঁটার ডাকাত আস্তানায় গিয়েছে।
তটিনী বলল, ‘ ওখানে ডাকাতগুলো তো ভয়ংকর। আমি নিজ চোখে দেখেছি। কেন তোমরা ভাইজানদের পাঠালে? ‘
শেরহাম সদরকক্ষে পায়ের উপর পা তুলে বসেছিল। তটিনী এসে বলল,
” ভাইজানরা বন্দি হয়েছে। কিছু একটা করো। ‘
শেরহাম নির্বিকার চিত্তে বলল,
‘ তোর ভাইজানরা বন্দি হয়েছে আমার কি? আমি বন্দি হলে কার কি যায় আসতো? ‘
তটিনী বলল,
‘ এভাবে বলো না। অপরূপা সন্তান সম্ভাবা, সায়রার এখনো ভালো সংসার হয়নি। ভাইজানদের সাথে খারাপ কিছু হয়ে গেলে সব শেষ হয়ে যাবে। তোমার পায়ে পড়ছি কিছু একটা করো। ‘
শেরহাম বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ ওরা মরুক। আমারই লাভ। আমি পাঠিয়েছি ওখানে? গিয়েছে কেন? ‘
তটিনী ওকে ঝাঁকিয়ে বলল,
‘ ভাইজানদের কিছু হলে আমি…
শেরতাজ সাহেব বলে উঠেন, ‘ এককো*পে শেষ করব ওকে। ওদের গায়ে যদি আঁচড়ও লাগে তোমার অবস্থা করুন হবে। ‘
শেরহাম বলল,
‘ ওর বউকে যেতে বলো। ওদের ছেড়ে দেবে। ‘
অপরূপা আগেই বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল খোদেজা তাকে কক্ষে আটকে রেখেছে। সে কক্ষের দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে কেঁদে চেঁচিয়ে বলল,
‘ আমাকে যেতে দিন। আমি উদ্ধার করে আনবো। ‘
খোদেজা দরজার এপাশে কেঁদে কেঁদে বলল,
‘ ওর স্ত্রী সন্তান রক্ষা করা আমার কর্তব্য। ‘
অপরূপা চেঁচিয়ে বলল,
‘ উনি না বাঁচলে উনার স্ত্রী সন্তান কি নিয়ে বাঁচবে? আমাকে ছাড়ুন। সায়রা সাফায়াত ভাইজানের কসম লাগে। আমাকে ছাড়ো। ‘
সায়রা দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলো।
শেরহামের সৈন্যরা খোঁজখবর নিয়ে এল। জানালো শেহজাদ সুলতানের কামীল নামের যেই বিশ্বস্ত সৈন্যটি ছিল তাকে ভয়ংকরভাবে মেরে মরা নদীর তীরে ঝুলিয়ে দিয়েছে ডাকাত সৈন্যরা।
সেই খবর পেয়ে সায়রা, খোদেজা, শাহানা সকলেই কান্নায় ভেঙে পড়েছে। মরিয়ম ভাবলো, না না। যার জন্য এই মহলে সে আশ্রয় পেয়েছে, নতুন করে বাঁচার আলো দেখেছে সে এভাবে উনার কোল খালি করে যেতে পারেনা। একলা একা ঘরে ডুকরে কেঁদে মরলেন উনি। বাবা হতে যাচ্ছে এই খবরটাও সে শুনতে পেলো না ছেলেটা।
তটিনী শেরহামকে খুঁজে পেল না আর। তার বিশ্বাস মানুষটার মধ্যে একটা কোমল তুলতুলে মন লুকায়িত আছে। যেই মনটা সবার জন্য কাঁদে।
এদিকে কুমুদিনীকে রসাইঘরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে সকলেই বিচলিত হলো। ফজল সাহেব তার জ্ঞান ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ তুমি কি বিবাহিত? ‘
খোদেজা বললেন,
‘ বিবাহিত কি করে হবে? কেন এমন বলছেন? ‘
ফজল সাহেব অবাক গলায় বললেন,
‘ সে তো সন্তানসম্ভাবা। ‘
মুহূর্তেই আরেক হৈচৈ পড়ে গেল মহলে। খোদেজা তার গালে ঠাস ঠাস চড় বসিয়ে বললেন,
‘ কার সাথে এমন আকাম-কুকাম করেছিস বল। ‘
কুমুদিনী কাঁদতে লাগলো। খোদেজা আদেশ দিল মতিবানুকে।
‘ মহলের বাইরে এই ঘটনা রটার পূর্বেই তার বাচ্চা নষ্ট করা হোক। এইসব অনাচার আমি সইবো না। নিয়ে যাহ। এইসব পাপ করার সাহস যেন আর কেউ না পায়। ‘
মতিবানু কুমুদিনীকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। তা দেখে তটিনী ভড়কে গেল। তার ঋতুক্রিয়া বিলম্ব হয়েছে প্রায় এক সপ্তাহ। যদি তার সাথে মাও এমন করে? বলে সে কাফেরের বাচ্চা পেটে ধরেছে? সে তো খোদার কাছ থেকে একটা নেক সন্তান চায়। এটা তার অপরাধ? না সে কাউকে কিছু বুঝতে দেবে না। এমনকি শেরহাম সুলতানকেও নয়।
চলমান…..
রিচেক করা হয়নি।