#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_১৯
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
লোকদুটোর পালানোর শব্দ শুনে আলিঙ্গন মুক্ত হলো দুজনের মিলিত ওষ্ঠজোড়া। বুঁজে রাখা আঁখি পল্লব ধীরেধীরে মেলতেই চার চোখের মিলন হলো তখুনি। অতৃপ্তির স্পর্শ লেগে রইলো তাদের শুষ্ক শীতল ওষ্ঠপুটে। অতৃপ্ত মন আকুপাকু করতে লাগলো। কন্ঠনালী দিয়ে তটিনীর শুকনো ঢোক নেমে যাওয়া দেখলো শেরহাম।
তার গলা ঝাপটে ধরা একটা হাত শেরহামের গালের পাশে রাখলো তটিনী। শেরহাম পিঠ টেনে তাকে আরও নিকটে টেনে নিতেই তটিনী ঘনিষ্ঠ হয়ে এল। আচমকা তার ঠোঁটজোড়া ফের নিজের আয়ত্বে নিয়ে নিল শেরহাম। বলিষ্ঠ ঠোঁটের দংশনে অতিষ্ঠ, নাজেহাল করে তুললো তটিনীকে, তারপর আচমকা ছেড়ে দিল। তটিনীকে দূরে সরিয়ে দিয়ে চলে গেল সেখান থেকে। তটিনী স্তব্ধ হয়ে ওর যাওয়া দেখলো। ছুঁয়ে দেখলো নিজের ভেঁজা উচ্ছ্বসিত ঠোঁটজোড়া। পুরো শরীরে অদ্ভুত একটা ঝংকার দিয়ে উঠলো তখুনি।
বুকের ভেতরটা উচ্ছ্বাসে হত-বিহবল, কম্পমান। চোখ বন্ধ করে সেই স্পর্শানুভূতি মনে হতেই আনন্দিত হয়ে দুফোঁটা জল গড়ালো তার গাল বেয়ে। মনটা কেঁদে উঠলো তারপরেই। কি হবে তার ভবিষ্যৎ?
শেরহাম হেঁটে নানাজানের গুহার মধ্যে ঢুকে পড়তেই তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। শেরহাম একটা পাথরের উপর গিয়ে বসে আদেশ দিল,
‘ এই জল আন। ‘
বেঁটেমতো একটা লোক এগিয়ে এসে জলের পাত্র বাড়িয়ে দিতেই শেরহাম জলপান করতে করতে নানার দিকে তাকালো। পানি খাওয়া শেষে বলল,
‘ তোমার বয়স হচ্ছে কত? এখনো মরছো না কেন? ‘
নানাজান হাসলেন। অপূর্ব সুন্দর সেই হাসি। হেসে বললেন,
‘ সে কথা বাদ দে। আমি এত সহজে মরব না। ওই মেয়েটা কে? আদর মহব্বত ভালোই আছে দেখলাম। ‘
‘ লজ্জা সিন্দুকে তুলে ওসব দেখতে গিয়েছ? ‘
নানাজান আবারও হাসলেন। বললেন,
‘ আমার গোঁয়ার, জাদুকর নাতি নারীর প্রেমে কেমন মজেছে দেখতে হবে না? ‘
‘ কোনো প্রেমট্রেম নেই। সব মেয়েই হুট করে পুরুষমানুষের সঙ্গ পেলে এমন মাতলামি করে। ‘
গুহার সম্মুখে দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসতে লাগলো তটিনী। কেউ তাকে দেখলো না। নানাজান বললেন,
‘ মেয়েটাকে কোথা হতে শিকার করেছিস আবার? ফিরছিলি কোথা থেকে? ‘
শেরহাম গুহার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে গা এলিয়ে বসে সবটা খুলে বলতেই নানাজান হাসলেন।
‘ নাতিবউ এনেছিস আগে বলবি না? আমি ভেবেছি এমনি….
তটিনী রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে ভাবলো মেয়ে নিয়ে ব্যবসা ট্যাবসা করতো নাকি এই লোক? ওদেরও আদর করতো ওভাবে? নিজেকে শান্ত করলো সে। জা**নে মেরে ফেলবে তাকে ঠকালে।
শেরহাম বলল,
‘ পরাগ পাহাড় থেকে এখানে চলে এলে কেন? ‘
‘ ওরা অতিষ্ঠ করে তুলেছে আমাকে। তাই এখানে চলে এসেছি। তুই কি কোনোদিনও মানুষ হবিনা? ‘
‘ তুমি মানুষ? যে তোমার বংশধররা মানুষ হবে? তুমি নিজেই তো একটা বনমানুষ। ‘
‘ আমি খোদাতায়ালায় সাথে একান্তে সময় ব্যয় করার জন্য বনেজঙ্গলে থাকি। মানুষকে সঠিক পথ দেখাই। আর তুই? ‘
‘ কি করছি আমি? ‘
‘ তোর মায়ের পথ অনুসরণ করে নিজেকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে এসেছিস। সে পথভ্রষ্ট হয়েছে। শেরতাজ সুলতানের উপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নিজে ধ্বংস হয়েছে আর তোকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তুই খোদা চিনিস না, খোদাকে অমান্য করিস, কত নিকৃষ্ট অমানুষে পরিণত হয়েছিস তুই। আমার বারণও শুনলি না। ‘
শেরহামের চোখজোড়া হিংস্র হয়ে উঠে। বসা থেকে উঠে এগিয়ে এসে দাঁতে দাঁত পিষে আঙুল তুলে বলল,
‘ এই বুড়ো খোদা কি দিয়েছে আমাকে যে আমি তাকে মান্য করব? কি দিয়েছে আমাকে? আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে সব। সব পেয়েছে ওই শেহজাদ। আমার বাপের মরা বাপ সবটা ওকে দিয়ে গেছে। সবার মধ্যমণি ও। আমাকে কে কি দিয়েছে? তোমার খোদাকে প্রশ্ন করো। উত্তর দিক আমাকে। ‘
নানাজানের গলার আওয়াজ চওড়া হয়।
‘ খোদাতায়ালা সম্পর্কে এসব কথা আমি সইবো না শেরহাম। তোর মাকে অভিশাপ দিয়েছিলাম আমি। তোর মা ধ্বংস হয়েছে। তুই নিজে অভিশাপ নিস না আমার কাছ থেকে। আঙুল নামা। ‘
শেরহাম পাশে থাকা পাথরে লাতি বসিয়ে বলল,
‘ দাও অভিশাপ। দেখি কি হয়? দাও বলছি। ‘
নানাজান বড়বড় চোখ করে কিছু বলে উঠার আগেই তটিনী ছুটে এসে শেরহামের সামনে গিয়ে বুকে কিল দিয়ে কেঁদে উঠে নানাজানের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল,
‘ না না। এমনটা করবেন না। ও জেনেবুঝে কিছু বলছে না। ‘
শেরহাম ওকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ তোকে মাতব্বরি দেখাতে কে বলেছে এখানে? সর। ‘
তটিনী ওকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘ তুমি বেরিয়ে যাও এখান থেকে। যাও। নইলে পাথরে মাথা ফাটবো আমি। যাও। ‘
শেরহাম নানাজানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। তটিনী কাঁদতে কাঁদতে নানাজানের সামনে বসে পড়লো। উনি কিছুক্ষণ কাঁদতে দিলেন মেয়েটাকে। তারপর ধীরেধীরে হাতটা তুলে মাথায় রাখলেন। তটিনী চোখ তুলে তাকালো। উনি স্মিত হেসে বললেন,
‘ আমি অন্যকিছু বলতে যাচ্ছিলাম, অভিশাপ দিতে নয়। ‘
তটিনী আরও জোরে কান্নায় ভেঙে পড়লো। নানাজান বললেন,
‘ অবাক হচ্ছি এটা দেখে সবটা জানার পর কি করে তুমি কি করে ওকে আগলে রাখছো? ‘
তটিনী গাল মুছতে মুছতে বলল,
‘ আমার সব ভুলে ওর সাথে থাকতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ও আমার কাছে নিজেকে প্রকাশ করে না। মহলের সবার চোখের কাঁটা হয়ে উঠেছে সে। কেউ ওকে ভালোবাসেনা। ‘
‘ তাকে খোদাতায়ালা রহমত বরকত সম্পর্কে বুঝাও। তিনি কত দয়াবান, কতটা মহান, কতটা শক্তিশালী তা বুঝাও। বুঝাও সে তার মাকে অন্ধ ভালোবাসে। তার মা তার ইহকাল পরকাল ধ্বংস করে দিয়েছে। তার জীবন থেকে সব রঙ কেড়ে নিয়েছে। বুঝাও তাকে। ‘
‘ কি করে বুঝাবো? আমার কথা শুনতেই চায় না সে। ‘
‘ তার সাথে বেশি কথা বলো। ওকে কথা বলতে দাও। আমরা যাকে ভালোবাসি তার সাথে মনের কথা খুলে বলতে দ্বিধা করিনা। ‘
তটিনী বিমূঢ় হয়ে ভেবে বলল,
‘ ভালোবাসা? কিন্তু ও আমাকে ভালোবাসবে কি করে? ‘
নানাজান হতভম্ব হয়ে বললেন,
‘ ভালো না বাসলে ওর কাছে ঘেঁষছ কেন? ওর মধ্যে মায়া মহব্বত না জন্মালে ওর সাথে কিভাবে বাকিটা জীবন কিভাবে কাটাবে? ‘
তটিনী চোখ বুঁজে চোখ চেপে জল ফেলে বলে,
‘ জানিনা। কিছু জানিনা আমি। ‘
নানাজান ওর মাথায় হাত চেপে বলল,
‘ ওর কাছ থেকে দূরে থাকো।’
তটিনী বলে উঠে, সবাই শুধু এমনটা বলে। কিন্তু স্বামী স্ত্রী কখনো দূরে থাকতে পারে? ‘
‘ তোমাকে পারতে হবে। তোমার প্রতি ওর কোনো টান থাকলে তা তখন তুমি বুঝতে পারবে। তারপর ধীরেধীরে বুঝাবে সবটা। ‘
শেরহাম ফের প্রবেশ করে গুহায়। তটিনীর হাত ধরে তাদের গুহার কামরায় নিয়ে যেতে যেতে বলে
‘ তোর জন্য পোশাক আছে পুটলিতে। যাহ পড়ে নে। তোর শাড়ি পুড়ে গিয়েছে। এই বুড়োর সাথে কম কথা বলবি। ‘
তটিনী হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘ আমি জানি কে ভালো কে মন্দ। ‘
শেরহাম চেয়ে থাকে।
চলমান….